নিশি ব্রজেশ্বরকে সঙ্গে করিয়া দেবীর শয্যাগৃহে লইয়া গেল।
ব্রজেশ্বর দেখিলেন, শয়নঘর দরবার কামরার মত অপূর্ব সজ্জায়
সজ্জিত। বেশীর ভাগ, একখানা সুবর্ণমণ্ডিত মুক্তার ঝালরযুক্ত
ক্ষুদ্র পালঙ্ক আছে। কিন্তু ব্রজেশ্বরের সে সকল দিকে চক্ষু ছিল
না। এত ঐশ্বর্যের অধিকারিণী প্রথিতনাম্নী দেবীকে দেখিবেন।
দেখিলেন, কামরার ভিতর অনাবৃত কাষ্ঠের উপর বসিয়া,
অর্ধাবগুণ্ঠনবতী একটি স্ত্রীলোক। নিশি ও সাগরে, ব্রজেশ্বর যে
চাঞ্চল্যময়তা দেখিয়াছিলেন, ইহাতে তাহার কিছুই নাই। এ স্থিরা,
ধীরা–নিম্নদৃষ্টি, লজ্জাবনতমুখী। নিশি ও সাগর, বিশেষতঃ নিশি
সর্বাঙ্গে রত্নালঙ্কারমণ্ডিতা, বহুমূল্য বসনে আবৃতা, –কিন্তু
ইহার তা কিছুই নাই। দেবী ব্রজেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাতের ভরসায়
বহুমূল্য বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা হইয়াছিলেন, ইহা আমরা পূর্বেই
দেখিয়াছি। কিন্তু সাক্ষাতের সময় উপস্থিত হইলে, দেবী সে সকলই
ত্যাগ করিয়া সামান্য বস্ত্র পরিয়া, হাতে কেবল একখানি মাত্র
সামান্য অলঙ্কার রাখিয়া ব্রজেশ্বরের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।
প্রথমে নিশির বুদ্ধিতে দেবী ভ্রমে পড়িয়াছিল; শেষে বুঝিতে
পারিয়া আপনা আপনি তিরস্কার করিয়াছিল; “ছি! ছি! ছি! কি করিয়াছি!
ঐশ্বর্যের ফাঁদ পাতিয়াছি!” তাই এ বেশ পরিবর্তন।
ব্রজেশ্বরকে পৌঁছাইয়া দিয়া নিশি চলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর প্রবেশ
করিলে, দেবী গাত্রোত্থান করিয়া ব্রজেশ্বরকে প্রণাম করিলেন।
দেখিয়া ব্রজেশ্বর আরও বিস্মিত হইল–কই, আর কেহ ত প্রণাম করে
নাই? দেবী তখন ব্রজেশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইল–ব্রজেশ্বর দেখিল,
যথার্থ দেবীমূর্তি! এমন আর কখন দেখিয়াছে কি? হ্যাঁ, ব্রজ আর
একবার এমনই দেখিয়াছিল। সে আরও মধুর, –কেন না, দেবীমূর্তি তখন
বালিকার মূর্তি–ব্রজেশ্বরের তখন প্রথম যৌবন। হায়! এ যদি সেই
হইত! এ মুখ দেখিয়া, ব্রজেশ্বরের সে মুখ মনে পড়িল, কিন্তু
দেখিলেন, এ মুখ সে মুখ নহে। তার কি কিছুই এতে নাই? আছে বৈ
কি–কিছু আছে। ব্রজেশ্বর তাই অবাক হইয়া দেখিতে লাগিল। সে ত অনেক
দিন মরিয়া গিয়াছে–তবে মানুষে মানুষে কখন কখন এমন সাদৃশ্য থাকে
যে, একজনকে দেখিলে আর একজনকে মনে পড়ে। এ তাই না ব্রজ?
ব্রজ তাই মনে করিল। কিন্তু সেই সাদৃশ্যেই হৃদয় ভরিয়া গেল–ব্রজের
চক্ষে জল আসিল, পড়িল না। তাই দেবী সে জল দেখিতে পাইল না।
দেখিতে পাইলে আজ একটা কাণ্ডকারখানা হইয়া যাইত। দুইখানা মেঘেই
বৈদ্যুতি ভরা।
প্রণাম করিয়া, নিম্ননয়নে দেবী বলিতে লাগিল, “আমি আপনাকে আজ জোর
করিয়া ধরিয়া আনিয়া বড় কষ্ট দিয়াছি। কেন এমন কুকর্ম করিয়াছি,
শুনিয়াছেন। আমার অপরাধ লইবেন না।”
ব্রজেশ্বর বলিলেন, “আমার উপকারই করিয়াছেন।” বেশী কথা বলিবার
ব্রজেশ্বরের শক্তি নাই।
দেবী আরও বলিল, “আপনি আমার এখানে দয়া করিয়া জলগ্রহণ করিয়াছেন,
তাহাতে আমার বড় মর্যাদা বাড়িয়াছে। আপনি কুলীন–আপনারও মর্যাদা
রাখা আমার কর্তব্য। আপনি আমার কুটুম্ব। যাহা মর্যাদাস্বরূপ আমি
আপনাকে দিতেছি, তাহা গ্রহণ করুন।”
ব্র। স্ত্রীর মত কোন্ ধন? আপনি তাই আমাকে দিয়াছেন। ইহার বেশী আর
কি দিবেন?
ও ব্রজেশ্বর! কি বলিলে? স্ত্রীর মত ধন আর নাই? তবে বাপ-বেটায়
মিলিয়া প্রফুল্লকে তাড়াইয়া দিয়াছিলে কেন?
পালঙ্কের পাশে একটা রূপার কলসী ছিল–তাহা টানিয়া বাহির করিয়া,
দেবী ব্রজেশ্বরের নিকটে রাখিল, বলিল, “ইহাই গ্রহণ করিতে হইবে।”
ব্র। আপনার বজরায় এত সোণা-রূপার ছড়াছড়ি যে, এই কলসীটা নিতে
আপত্তি করিলে, সাগর আমায় বকিবে। কিন্তু একটা কথা আছে–
কথাটা কি–দেবী বুঝিল, বলিল, “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, এ চুরি
ডাকাইতির নহে। আমার নিজের কিছু সঙ্গতি আছে–শুনিয়া থাকিবেন।
অতএব গ্রহণপক্ষে কোন সংশয় করিবেন না।”
ব্রজেশ্বর সম্মত হইল–কুলীনের ছেলের আর অধ্যাপক ভট্টাচার্যের
“বিদায়” বা “মর্যাদা” গ্রহণে লজ্জা ছিল না–এখনও বোধ হয় নাই।
কলসীটা বড় ভারী ঠেকিল, ব্রজেশ্বর সহজে তুলিতে পারিলেন না।
বলিলেন, “এ কি এ? কলসীটা নিরেট না কি?”
দেবী। টানিবার সময় উহার ভিতর শব্দ হইয়াছেল–নিরেট সম্ভবে না।
ব্র। তাই ত? এতে কি আছে?
কলসীতে ব্রজেশ্বর হাত পুরিয়া তুলিল–মোহর। কলসী মোহরে পরিপূর্ণ।
ব্র। এগুলি কিসে ঢালিয়া রাখিব?
দেবী। ঢালিয়া রাখিবেন কেন? এগুলি সমস্তই আপনাকে দিয়াছি।
ব্র। কি?
দেবী। কেন?
ব্র। কত মোহর আছে?
দেবী। তেত্রিশ শ।
ব্র। তেত্রিশ শ মোহরে পঞ্চাশ হাজার টাকার উপর। সাগর আপনাকে
টাকার কথা বলিয়াছে?
দেবী। সাগরের মুখে শুনিয়াছি, আপনার পঞ্চাশ হাজার টাকার বিশেষ
প্রয়োজন।
ব্র। তাই দিতেছেন?
দেবী। টাকা আমার নহে, আমার দান করিবার অধিকার নাই। টাকা দেবতার,
দেবত্র আমার জিম্মা। আমি আমার দেবত্র সম্পত্তি হইতে আপনাকে এই
টাকা কর্জ দিতেছি।
ব্র। আমার এ টাকার প্রয়োজন পড়িয়াছে–বোধ হয়, চুরি-ডাকাতি করিয়াও
যদি আমি এ টাকা সংগ্রহ করি, তাহা হইলেও অধর্ম হয় না; কেন না, এ
টাকা নহিলে আমার বাপের জাতি রক্ষা হয় না। আমি এ টাকা লইব।
কিন্তু কবে পরিশোধ করিতে হইবে?
দেবী। দেবতার সম্পত্তি, দেবতা পাইলেই হইল। আমার মৃত্যুসংবাদ
শুনিলে পর ঐ টাকার আসল আর এক মোহর সুদ দেবসেবায় ব্যয় করিবেন।
ব্র। সে আমারই ব্যয় করা হইবে। সে আপনাকে ফাঁকি দেওয়া হইবে। আমি
ইহাতে স্বীকৃত নহি।
দেবী। আপনার যেরূপ ইচ্ছা, সেইরূপে পরিশোধ করিবেন।
ব্র। আমার টাকা জুটিলে আপনাকে পাঠাইয়া দিব।
দেবী। আপনার লোক কেহ আমার কাছে আসিবে না, আসিতেও পারিবে না।
ব্র। আমি নিজে টাকা লইয়া আসিব।
দেবী। কোথায় আসিবেন? আমি এক স্থানে থাকি না।
ব্র। যেখানে বলিয়া দিবেন।
দেবী। দিন ঠিক করিয়া বলিলে, আমি স্থান ঠিক করিয়া বলিতে পারি।
ব্র। আমি মাঘ ফাল্গুনে টাকা সংগ্রহ করিতে পারিব। কিন্তু একটু
বেশী করিয়া সময় লওয়া ভাল। বৈশাখ মাসে টাকা দিব।
দেবী। তবে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটেই
টাকা আনিবেন। সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত এখানে থাকিব। সপ্তমীর
চন্দ্রাস্তের পর আসিলে আমার দেখা পাইবেন না।
ব্রজেশ্বর স্বীকৃত হইলেন। তখন দেবী পরিচারিকাদিগকে আজ্ঞা দিলেন,
মোহরের ঘড়া ছিপে উঠাইয়া দিয়া আইসে। পরিচারিকারা ঘড়া ছিপে লইয়া
গেল। ব্রজেশ্বরও দেবীকে আশীর্বাদ করিয়া ছিপে যাইতেছিলেন। তখন
দেবী নিষেধ করিয়া বলিলেন, “আর একটা কথা বাকি আছে। এ ত কর্জ
দিলাম–মর্যাদা দিলাম কই?”
ব্র। কলসীটা মর্যাদা।
দেবী। আপনার যোগ্য মর্যাদা নহে। যথাসাধ্য মর্যাদা রাখিব।
এই বলিয়া দেবী আপনার আঙ্গুল হইতে একটি আঙ্গটি খুলিল। ব্রজেশ্বর
তাহা গ্রহণ করিবার জন্য সহাস্য বদনে হাত পাতিলেন। দেবী হাতের
উপর আঙ্গটি ফেলিয়া দিল না–ব্রজেশ্বরের হাতখানি ধরিল–আপনি
আঙ্গটি পরাইয়া দিবে।
ব্রজেশ্বর জিতেন্দ্রিয়, কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোলমাল হইয়া
গেল, জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর তাহা বুঝিতে পারিল না। শরীরে কাঁটা
দিল–ভিতরে যেন অমৃতস্রোত ছুটিল। জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর, হাতটা
সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেল। বিধাতা এক এক সময়ে বাদ সাধেন যে, সময়ে
আপন কাজ ভুলিয়া যাইতে হয়।
তা, দেবী সেই মানসিক গোলযোগের সময় ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে ধীরে
ধীরে আঙ্গটি পরাইতে লাগিলেন। সেই সময়ে ফোঁটা দুই তপ্ত জল
ব্রজেশ্বরের হাতের উপর পড়িল। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, দেবীর মুখ
চোখের জলে ভাসিয়া যাইতেছে। কি রকমে কি হইল, বলিতে পারি না,
ব্রজেশ্বর ত জিতেন্দ্রিয়–কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোল
বাধিয়াছিল–সেই আর একখানা মুখ মনে পড়িল; এই সেই এই, কি এমনই
একটা গোলমাল বাধিয়া গেল। ব্রজেশ্বর কিছু না বুঝিয়া–কেন জানি
না–দেবীর কাঁধে হাত রাখিল, অপর হাতে ধরিয়া মুখখানি তুলিয়া
ধরিল–বুঝি মুখখানা প্রফুল্লের মত দেখিল। বিবশ বিহ্বল হইয়া সেই
অশ্রুনিষিক্ত বিম্বাধরে–আ ছি ছি! ব্রজেশ্বর! আবার!
তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কি করিলাম! এ কি
প্রফুল্ল? সে যে দশ বৎসর মরিয়াছে! ব্রজেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে
পলায়ন করিয়া একেবার ছিপে গিয়ে উঠিল। সাগরকে সঙ্গে লইয়াও গেল
না। সাগর “ধর! ধর! আসামী পলায়!” বলিয়া, পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া
ছিপে উঠিল। ছিপ খুলিয়া ব্রজেশ্বরকে ও ব্রজেশ্বরের দুই
রত্নাধার–একটি সাগর আর একটি কলসী–ব্রজেশ্বরের নৌকায় পৌঁছাইয়া
দিল।
এদিকে নিশি আসিয়া দেবীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দেবী
নৌকার তক্তার উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতেছে। নিশি তাহাকে উঠাইয়া
বসাইল–চোখের জল মুছাইয়া দিল– সুস্থির করিল। তখন নিশি বলিল, “এই
কি মা, তোমার নিষ্কাম ধর্ম? এই কি সন্ন্যাস? ভগবদ্বাক্য কোথায়
মা, এখন?”
দেবী চুপ করিয়া রহিল। নিশি বলিল, “ও সকল ব্রত মেয়েমানুষের নহে।
যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মত হইতে হইবে। আমাকে
কাঁদাইবার জন্য ব্রজেশ্বর নাই। আমার ব্রজেশ্বর বৈকুণ্ঠেশ্বর
একই।”
দেবী চক্ষু মুছিয়া বলিল, “তুমি যমের বাড়ী যাও।”
নি। আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমার উপর যমের অধিকার নাই। তুমি
সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।
দেবী। সে পথ খোলা থাকিলে আমি এ পথে আসিতাম না। এখন বজরা খুলিয়া
দিতে। চার পাল উঠাও।
তখন সেই জাহাজের মত বজরা চারিখান তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল।