বঙ্কিম-রচনাবলী

দেবী চৌধুরাণী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

তৃতীয় খণ্ড
সপ্তম পরিচ্ছেদ

    বস্তুতঃ হরবল্লভ রায় মহাশয় যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সে ইচ্ছাপূর্বক নহে, ঘটনাবিহীন। প্রথমে বড় ঘেঁষেন নাই। “শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং” ইত্যাদি চাণক্যপ্রদত্ত সদুপদেশ স্মরণ করিয়া তিনি সিপাহীদিগের ছিপে উঠেন নাই। একখানা পৃথক ডিঙ্গিতে থাকিয়া, লেফটেনান্ট সাহেবকে বজরা দেখাইয়া দিয়া, অর্ধ ক্রোশ দূরে পলাইয়া গিয়া ডিঙ্গি ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। তার পর দেখিলেন, আকাশের বড় ঘনঘটা। মনে করিলেন, ঝড় উঠিবে ও এখনই আমার ডিঙ্গি ডুবিয়া যাইবে, টাকার লোভে আসিয়া প্রাণ হারাইব–আমার সৎকারও হইবে না। তখন রায় মহাশয় ডিঙ্গি হইতে তীরে অবতরণ করিলেন। কিন্তু তীরে সেখানে কেহ কোথাও নাই দেখিয়া বড় ভয় হইল। সাপের ভয়, বাঘের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ভূতের ভয়। হরবল্লভের মনে হইল, কেন এমন ঝকমাবরি করিতে আসিয়াছিলাম। হরবল্লভের কান্না আসিল।
    এমন সময়ে হঠাৎ বন্দুকের হুড়মুড়ি, সিপাহী বরকন্দাজের হৈ হৈ শব্দ সব বন্ধ হইয়া গেল। হরবল্লভের বোধ হইল, অবশ্য সিপাহীর জয় হইয়াছে, ডাকাইত মাগী ধরা পড়িয়াছে, নহিলে লড়াই বন্ধ হইবে কেন? তখন হরবল্লভ ভরসা পাইয়া যুদ্ধস্থানে যাইতে অগ্রসর হইলেন। তবে এ রাত্রিকালে, এ অন্ধকারে, এ বন-জঙ্গলের মাঝে অগ্রসর হন কিরূপে? ডিঙ্গির মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ বাপু মাঝি, –বলি, ওদিকে যাওয়া যায় কিরূপে বলতে পার?”
    মাঝি বলিল, “যাওয়ার ভাবনা কি? ডিঙ্গিতে উঠুন না, নিয়ে যাচ্ছি। সিপাহীরা মারবে ধরবে না ত? আবার যদি লড়াই বাধে?”
    হর। সিপাহীরা আমাদের কিছু বলিবে না। লড়াই আর বাধিবে না–ডাকাইত ধরা পড়েছে। কিন্তু যে রকম মেঘ করেছে, এখনই ঝড় উঠবে–ডিঙ্গিতে উঠি কিরূপে?
    মাঝি বলিল, “ঝড়ে ডিঙ্গি কখন ডুবে না।”
    হরবল্লভ প্রথমে সে সকল কথায় বিশ্বাস করিলেন না–শেষ অগত্যা ডিঙ্গিতে উঠিলেন। মাঝিকে উপদেশ দিলেন, কেনারায় কেনারায় ডিঙ্গি লইয়া যাইবে। মাঝি তাহাই করিল। শীঘ্র আসিয়া ডিঙ্গি বজরায় লাগিল। হরবল্লভ সিপাহীদের সঙ্কেতবাক্য জানিতেন, সুতরাং সিপাহীরা আপত্তি করিল না। সেই সময়ে “গোইন্দা! গোইন্দা!” করিয়া ডাকাডাকি হইতেছিল। হরবল্লভ বজরায় উঠিয়া সম্মুখস্থ আরদালির সিপাহীকে বলিল, “গোইন্দাকে খুঁজিতেছ? আমি গোইন্দা।”
    সিপাহী বলিল, “তোমাকে কাপ্তেন সাহেব তলব করিয়াছেন।”
    হর। কোথায় তিনি?
    সিপা। কামরার ভিতর। তুমি কামরার ভিতর যাও।
    হরবল্লভ আসিতেছে জানিতে পারিয়া দেবী প্রস্থানের উদ্যোগ দেখিল। “কাপ্তেন সাহেবের জন্য কিছু জলযোগের উদ্যোগ দেখি” বলিয়া ভিতরের কামরায় চলিয়া গেল।
    এদিকে হরবল্লভ কামরার দিকে গেলেন। কামরার দ্বারে উপস্থিত হইয়া কামরার সজ্জা ও ঐশ্বর্য, দিবা ও নিশির রূপ ও সজ্জা দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন। সাহেবকে সেলাম করিতে গিয়া, ভুলিয়া নিশিকে সেলাম করিয়া ফেলিলেন। হাসিয়া নিশি কহিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! মেজাজ সরিফ্?”
    শুনিয়া দিবা বলিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! আমায় একটা কুর্ণিশ হলো না–আমি হলেম এদের রাণী।”
    সাহেব হরবল্লভকে বলিলেন, “ইহারা ফেরেব করিয়া দুই জনেই বলিতেছে, ‘আমি দেবী চৌধুরাণী।’ কে দেবী চৌধুরাণী, তাহার ঠিকানা না হওয়ায়, আমি তোমাকে ডাকিয়াছি। কে দেবী?”