ঝড়
থামিল; নৌকাও থামিল। দেবী বজরার জানালা হইতে দেখিতে পাইলেন,
প্রভাত হইতেছে। বলিলেন, “নিশি! আজ সুপ্রভাত!”
নিশি বলিল, “আমি আজ সুপ্রভাত!”
দিবা। তুমি অবসান, আমি সুপ্রভাত!
নিশি। যেদিন আমার অবসান হইবে, সেই দিনই আমি সুপ্রভাত বলিব। এ অন্ধকারের অবসান নাই। আজ বুঝিলাম, দেবী চৌধুরাণীর সুপ্রভাত–কেন না, আজ দেবী চৌধুরাণীর অবসান।
দিবা। ও কি কথা লো পোড়ারমুখী?
নিশি। কথা ভাল। দেবী মরিয়াছে। প্রফুল্ল শ্বশুরবাড়ী চলিল।
দেবী। তার এখন দেরী ঢের। যা বলি, কর দেখি। বজরা বাঁধিতে বল দেখি।
নিশি হুকুম জারি করিল–মাঝিরা তীরে লাগাইয়া বজরা বাঁধিল। তার পর দেবী বলিল, “রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা কর, কোথায় আসিয়াছি? রঙ্গপুর কত দূর? ভূতনাথ কত দূর?”
রঙ্গরাজ জিজ্ঞাসায় বলিল, “এক রাত্রে চারি দিনের পথ আসিয়াছি। রঙ্গপুর এখান হইতে অনেক দিনের পথ। ডাঙ্গা-পথে ভূতনাথে এক দিনে যাওয়া যাইতে পারে।”
“পাল্কী বেহারা পাওয়া যাইবে?”
“আমি চেষ্টা করিলে সব পাওয়া যাইবে।”
দেবী নিশিকে বলিল, “তবে আমার শ্বশুরকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দাও।”
দিবা। এত তাড়াতাড়ি কেন?
নিশি। শ্বশুরের ছেলে সমস্ত রাত্রি বাহিরে বসিয়া আছে, মনে নাই? বাছাধন সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কায় আসিতে পারিতেছে না, দেখিতেছ না?
এই বলিয়া নিশি রঙ্গরাজকে ডাকিয়া, হরবল্লভের সাক্ষাতে বলিল, “সাহেবটাকে ফাঁসি দিতে হইবে। ব্রাহ্মণটাকে এখন শূলে দিয়া কাজ নাই। উহাকে পাহারাবন্দী করিয়া স্নানাহ্নিকে পাঠাইয়া দাও।”
হরবল্লভ বলিলেন, “আমার উপর হুকুম কিছু হইয়াছে?”
নিশি চোখ টিপিয়া বলিল, “আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হইয়াছে। তুমি স্নানাহ্নিক করিয়া আইস।”
নিশি রঙ্গরাজের কাণে কাণে বলিল, “পাহারা মানে জল-আচরণী ভৃত্য।”
রঙ্গরাজ সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া হরবল্লভকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দিল।
তখন দেবী নিশিকে বলিল, “সাহেবটাকে ছাড়িয়া দিতে বল। সাহেবকে রঙ্গপুর ফিরিয়া যাইতে বল। রঙ্গপুর অনেক দূর, এক শত মোহর উহাকে পথখরচ দাও, নহিলে এত পথ যাইবে কি প্রকারে?”
নিশি শত স্বর্গ লইয়া গিয়া রঙ্গরাজকে দিল, আর কাণে কাণে উপদেশ দিল। উপদেশে দেবী যাহা বলিয়াছিল, তাহা ছাড়া আরও কিছু ছিল।
রঙ্গরাজ তখন দুই জন বরকন্দাজ লইয়া আসিয়া সাহেবকে ধরিল। বলিল, “উঠ।”
সাহেব। কোথা যাইতে হইবে?
রঙ্গরাজ। তুমি কয়েদী–জিজ্ঞাসা করিবার কে?
সাহেব বাক্যব্যয় না করিয়া রঙ্গরাজের পিছু পিছু দুই জন বরকন্দাজের মাঝে চলিল। যে ঘাটে হরবল্লভ স্নান করিতেছিলেন, সেই ঘাট দিয়া তাহারা যায়।
হরবল্লভ জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?”
রঙ্গরাজ বলিল, “এই জঙ্গলে।”
হর। কেন?
রঙ্গরাজ। জঙ্গলের ভিতর গিয়া ফাঁসি দিব।
হরবল্লভের গা কাঁপিল। সে সন্ধ্যা-আহ্নিকের সব মন্ত্র ভুলিয়া গেল। সন্ধ্যাহ্নিক ভাল হইল না।
রঙ্গরাজ জঙ্গলে সাহেবকে লইয়া গিয়া বলিল, “আমরা কাহাকে ফাঁসি দিই না। তুমি ঘরের ছেলে ঘরে যাও, আমাদের পিছনে আর লেগো না। তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম।”
সাহেব প্রথমে বিস্ময়াপন্ন হইল–তার পর ভাবিল, “ইংরেজকে ফাঁসি দেয়, বাঙ্গালির এত কি ভরসা?”
তার পর রঙ্গরাজ বলিল, “সাহেব! রঙ্গপুর অনেক পথ, যাবে কি প্রকারে?”
সাহেব। যে প্রকারে পারি।
রঙ্গ। নৌকা ভাড়া কর, গ্রামে গিয়া ঘোড়া কেন–নয় পাল্কী কর। তোমাকে আমাদের রাণী এত শত মোহর পথখরচ দিয়াছেন।
রঙ্গরাজ মোহর গণিয়া দিতে লাগিল। সাহেব পাঁচ থান মোহর লইয়া আর লইল না। বলিল, “ইহাতেই যথেষ্ট হইবে। এ আমি কর্জ্জ লইলাম।”
রঙ্গরাজ। আচ্ছা, আমরা যদি তোমার কাছে আদায় করতে যাই ত শোধ দিও। আর তোমার সিপাহী যদি কেহ জখম হইয়া থাকে, তাহাকে পাঠাইয়া দিও। যদি কেহ মরিয়া থাকে, তবে তাদের ওয়ারেশকে পাঠাইয়া দিও।
সাহেব। কেন?
রঙ্গ। এমন অবস্থায় রাণী কিছু কিছু দান করিয়া থাকেন।
সাহেব বিশ্বাস করিল না। ভাল মন্দ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।
রঙ্গরাজ তখন পাল্কী বেহারার সন্ধানে গেল। তার প্রতি সে আদেশও ছিল।
নিশি বলিল, “আমি আজ সুপ্রভাত!”
দিবা। তুমি অবসান, আমি সুপ্রভাত!
নিশি। যেদিন আমার অবসান হইবে, সেই দিনই আমি সুপ্রভাত বলিব। এ অন্ধকারের অবসান নাই। আজ বুঝিলাম, দেবী চৌধুরাণীর সুপ্রভাত–কেন না, আজ দেবী চৌধুরাণীর অবসান।
দিবা। ও কি কথা লো পোড়ারমুখী?
নিশি। কথা ভাল। দেবী মরিয়াছে। প্রফুল্ল শ্বশুরবাড়ী চলিল।
দেবী। তার এখন দেরী ঢের। যা বলি, কর দেখি। বজরা বাঁধিতে বল দেখি।
নিশি হুকুম জারি করিল–মাঝিরা তীরে লাগাইয়া বজরা বাঁধিল। তার পর দেবী বলিল, “রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা কর, কোথায় আসিয়াছি? রঙ্গপুর কত দূর? ভূতনাথ কত দূর?”
রঙ্গরাজ জিজ্ঞাসায় বলিল, “এক রাত্রে চারি দিনের পথ আসিয়াছি। রঙ্গপুর এখান হইতে অনেক দিনের পথ। ডাঙ্গা-পথে ভূতনাথে এক দিনে যাওয়া যাইতে পারে।”
“পাল্কী বেহারা পাওয়া যাইবে?”
“আমি চেষ্টা করিলে সব পাওয়া যাইবে।”
দেবী নিশিকে বলিল, “তবে আমার শ্বশুরকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দাও।”
দিবা। এত তাড়াতাড়ি কেন?
নিশি। শ্বশুরের ছেলে সমস্ত রাত্রি বাহিরে বসিয়া আছে, মনে নাই? বাছাধন সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কায় আসিতে পারিতেছে না, দেখিতেছ না?
এই বলিয়া নিশি রঙ্গরাজকে ডাকিয়া, হরবল্লভের সাক্ষাতে বলিল, “সাহেবটাকে ফাঁসি দিতে হইবে। ব্রাহ্মণটাকে এখন শূলে দিয়া কাজ নাই। উহাকে পাহারাবন্দী করিয়া স্নানাহ্নিকে পাঠাইয়া দাও।”
হরবল্লভ বলিলেন, “আমার উপর হুকুম কিছু হইয়াছে?”
নিশি চোখ টিপিয়া বলিল, “আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হইয়াছে। তুমি স্নানাহ্নিক করিয়া আইস।”
নিশি রঙ্গরাজের কাণে কাণে বলিল, “পাহারা মানে জল-আচরণী ভৃত্য।”
রঙ্গরাজ সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া হরবল্লভকে স্নানাহ্নিকে নামাইয়া দিল।
তখন দেবী নিশিকে বলিল, “সাহেবটাকে ছাড়িয়া দিতে বল। সাহেবকে রঙ্গপুর ফিরিয়া যাইতে বল। রঙ্গপুর অনেক দূর, এক শত মোহর উহাকে পথখরচ দাও, নহিলে এত পথ যাইবে কি প্রকারে?”
নিশি শত স্বর্গ লইয়া গিয়া রঙ্গরাজকে দিল, আর কাণে কাণে উপদেশ দিল। উপদেশে দেবী যাহা বলিয়াছিল, তাহা ছাড়া আরও কিছু ছিল।
রঙ্গরাজ তখন দুই জন বরকন্দাজ লইয়া আসিয়া সাহেবকে ধরিল। বলিল, “উঠ।”
সাহেব। কোথা যাইতে হইবে?
রঙ্গরাজ। তুমি কয়েদী–জিজ্ঞাসা করিবার কে?
সাহেব বাক্যব্যয় না করিয়া রঙ্গরাজের পিছু পিছু দুই জন বরকন্দাজের মাঝে চলিল। যে ঘাটে হরবল্লভ স্নান করিতেছিলেন, সেই ঘাট দিয়া তাহারা যায়।
হরবল্লভ জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?”
রঙ্গরাজ বলিল, “এই জঙ্গলে।”
হর। কেন?
রঙ্গরাজ। জঙ্গলের ভিতর গিয়া ফাঁসি দিব।
হরবল্লভের গা কাঁপিল। সে সন্ধ্যা-আহ্নিকের সব মন্ত্র ভুলিয়া গেল। সন্ধ্যাহ্নিক ভাল হইল না।
রঙ্গরাজ জঙ্গলে সাহেবকে লইয়া গিয়া বলিল, “আমরা কাহাকে ফাঁসি দিই না। তুমি ঘরের ছেলে ঘরে যাও, আমাদের পিছনে আর লেগো না। তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম।”
সাহেব প্রথমে বিস্ময়াপন্ন হইল–তার পর ভাবিল, “ইংরেজকে ফাঁসি দেয়, বাঙ্গালির এত কি ভরসা?”
তার পর রঙ্গরাজ বলিল, “সাহেব! রঙ্গপুর অনেক পথ, যাবে কি প্রকারে?”
সাহেব। যে প্রকারে পারি।
রঙ্গ। নৌকা ভাড়া কর, গ্রামে গিয়া ঘোড়া কেন–নয় পাল্কী কর। তোমাকে আমাদের রাণী এত শত মোহর পথখরচ দিয়াছেন।
রঙ্গরাজ মোহর গণিয়া দিতে লাগিল। সাহেব পাঁচ থান মোহর লইয়া আর লইল না। বলিল, “ইহাতেই যথেষ্ট হইবে। এ আমি কর্জ্জ লইলাম।”
রঙ্গরাজ। আচ্ছা, আমরা যদি তোমার কাছে আদায় করতে যাই ত শোধ দিও। আর তোমার সিপাহী যদি কেহ জখম হইয়া থাকে, তাহাকে পাঠাইয়া দিও। যদি কেহ মরিয়া থাকে, তবে তাদের ওয়ারেশকে পাঠাইয়া দিও।
সাহেব। কেন?
রঙ্গ। এমন অবস্থায় রাণী কিছু কিছু দান করিয়া থাকেন।
সাহেব বিশ্বাস করিল না। ভাল মন্দ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।
রঙ্গরাজ তখন পাল্কী বেহারার সন্ধানে গেল। তার প্রতি সে আদেশও ছিল।