দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
: হারাণীর হাসিবন্ধ
এখন হইতে এই
ইতিবৃত্তমধ্যে পাঁচ শত বার আমার স্বামীর নাম করা আবশ্যক হইবে। এখন তোমরা
পাঁচজন রসিকা মেয়ে একত্র কমিটীতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া বলিয়া দাও, আমি কোন্
শব্দ ব্যবহার করিয়া তাঁহার নাম করিব? পাঁচ শত বার “স্বামী” “স্বামী” করিয়া
কাণ জ্বালাইয়া দিব? না জামাই বারিকের দৃষ্টান্তানুসারে, স্বামীকে
“উপেন্দ্র” বলিতে আরম্ভ করিব? না, “প্রাণনাথ” “প্রাণকান্ত” “প্রাণেশ্বর”
“প্রাণপতি” এবং “প্রাণাধিকে”র ছড়াছড়ি করিব? তাঁহাকে যে কি বলিয়া ডাকিব, এমন
কথা পোড়া দেশের ভাষায় নাই। আমার এক সখী, (দাসদাসীগণের অনুকরণ করিয়া)
স্বামীকে “বাবু” বলিয়া ডাকিত—কিন্তু শুধু বাবু বলিতে তাহার মিষ্ট লাগিল
না—সে মনোদুঃখে স্বামীকে শেষে “বাবুরাম” বলিয়া
ডাকিতে আরম্ভ করিল। আমারও ইচ্ছা করিতেছে, আমি তাই করি।
মাংসপাত্র ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, মনে মনে স্থির করিলাম, “যদি বিধাতা হারাধন
মিলাইয়াছে—তবে ছাড়া হইবে না। বালিকার মত লজ্জা করিয়া সব নষ্ট না করি।”
এই ভাবিয়া আমি এমত স্থানে দাঁড়াইলাম যে, ভোজনস্থান হইতে বহির্বাটিতে
গমনকালে যে এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে। আমি মনে মনে
বলিলাম যে, “যদি ইনি ওদিক্ চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে। আমি মনে
মনে বলিলাম যে, “যদি ইনি এদিক্ ওদিক্ চাহিতে চাহিতে না যান, তবে আমি কুড়ি
বৎসর বয়স পর্যন্ত পুরুষের চরিত্র কিছুই বুঝি নাই।” আমি স্পষ্ট কথা বলি,
তোমরা আমাকে মার্জনা করিও—আমি মাথার কাপড় বড় খাটো করিয়া দিয়া
দাঁড়াইয়াছিলাম। এখন লিখিতে লজ্জা করিতেছে, কিন্তু তখন আমার কি দায়, তাহা
মনে করিয়া দেখ।
অগ্রে অগ্রে রমণ বাবু গেলেন; তিনি চারিদিক চাহিতে চাহিতে গেলেন, যেন খবর
লইতেছেন, কে কোথায় আছে। তার পর রামরাম দত্ত গেলেন—তিনি কোন দিকে চাহিলেন
না। তার পর আমার স্বামী গেলেন—তাঁহার চক্ষু যেন চারি দিকে কাহার অনুসন্ধান
করিতেছিল। আমি তাঁহার নয়নপথে পড়িলাম। তাঁহার চক্ষু আমারই অনুসন্ধান
করিতেছিল, তাহা বিলক্ষণ জানিতাম। তিনি আমার প্রতি চাহিবামাত্র, আমি
ইচ্ছাপূর্বক—কি বলিব, বলিতে লজ্জা করিতেছে—সর্পের যেমন চক্রবিস্তার
স্বভাবসিদ্ধ, কটাক্ষও আমাদিগের তাই। যাঁহাকে আপনার স্বামী বলিয়া
জানিয়াছিলাম, তাঁহার উপর একটু অধিক করিয়া বিষ ঢালিয়া না দিব কেন? বোধ হয়,
“প্রাণনাথ” আহত হইয়া বাহিরে গেলেন।
আমি তখন হারাণীর শরণাগত হইব মনে করিলাম। নিভৃতে ডাকিবামাত্র সে হাসিতে
হাসিতে আসিল। সে উচ্চ হাস্য করিয়া বলিল, “পরিবেশনের সময় বামন ঠাকুরাণীর
নাকালটা দেখিয়াছিলে?” উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সে আবার হাসির ফোয়ারা
খুলিল।
আমি বলিলাম, “তা জানি, কিন্তু আমি তার জন্য তোকে ডাকি নাই। আমার জন্মের শোধ
একবার উপকার কর। ঐ বাবুটি কখন যাইবেন, আমাকে শীঘ্র খবর আনিয়া দে।”
হারাণী একেবারে হাসি বন্ধ করিল। এত হাসি, যেন ধুঁয়ার অন্ধকারে আগুন ঢাকা
পড়িল। হারাণী গম্ভীরভাবে বলিল, “ছি! দিদি ঠাকরুন! তোমার এ রোগ আছে, তা
জানিতাম না।”
আমি হাসিলাম। বলিলাম, “মানুষের সকল দিন সমান যায় না। এখন তুই গুরুমহাশয়
গিরি রাখ্—আমার এ উপকার করবি কি না বল।”
হারাণী বলিল, “কিছুতেই আমা হইতে এ কাজ হইবে না।”
আমি খালি হাতে হারাণীর কাছে আসি নাই। মাহিয়ানার টাকা ছিল; পাঁচটা তাহার
হাতে দিলাম। বলিলাম, “আমার মাথা খাস্, এ কাজ তোকে করিতেই হইবে।”
হারাণী টাকা কয়টা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিল, কিন্তু তাহা না দিয়া, নিকটে উনান
নিবাইবার এক ঝুড়ি মাটি ছিল, তাহার উপর রাখিয়া দিল। বলিল—অতি গম্ভীরভাবে, আর
হাসি নাই—“তোমার টাকা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিলাম, কিন্তু শব্দ হইলে একটা
কেলেঙ্কারী হইবে, তাই আস্তে আস্তে এইখানে কুড়াইয়া লও। আর এসকল কথা মুখে এন
না।”
আমি কাঁদিয়া ফেলিলাম। হারাণী বিশ্বাসী, আর সকলে অবিশ্বাসী, আর কাহাকে ধরিব?
আমার কান্নার প্রকৃত তাৎপর্য সে জানিত না। তথাপি তার দয়া হইল। সে বলিল,
“কাঁদ কেন? চেনা মানুষ না কি?”
আমি একবার মনে করিলাম, হারাণীকে সব খুলিয়া বলি। তার পর ভাবিলাম, সে এত
বিশ্বাস করিবে না, একটা বা গণ্ডগোল করিবে। ভাবিয়া চিন্তিয়া, স্থির করিলাম,
সুভাষিণী ভিন্ন আমার গতি নাই। সেই আমার বুদ্ধি, সেই আমার
রক্ষাকারিণী—তাহাকে সব খুলিয়া বলিয়া পরামর্শ করি গিয়া। হারাণীকে বলিলাম,
“চেনা মানুষ বটে—বড় চেনা, সকল কথা শুনিলে তুই বিশ্বাস করিবি না, তাই তোকে
সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলিলাম না। কিছু দোষ নাই।”
“কিছু দোষ নাই” বলিয়া একটু ভাবিলাম। আমারই পক্ষে কিছু দোষ নাই, কিন্তু
হারাণীর পক্ষে? দোষ আছে বটে। তবে তাকে কাদা মাখাই কেন? তখন সেই “বাজিয়ে যাব
মল” মনে পড়িল। কুতর্কে মনকে বুঝাইলাম। যাহার দুর্দশা ঘটে, সে উদ্ধারের জন্য
কুতর্ক অবলম্বন করে। আমি হারাণীকে আবার বুঝাইলাম, “কিছু দোষ নাই।”
হা। তোমাকে কি তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে হইবে?
আমি। হাঁ।
হা। একা?
আমি। একা।
হা। আমার বাপের সাধ্য নহে।
আমি। আর বৌ ঠাকুরাণী যদি হুকুম দেন?
হা। তুমি কি পাগল হয়েছ? তিনি কুলের কুলবধূ—সতী লক্ষ্মী, তিনি কি
এ সব কাজে হাত দেন!
আমি। যদি বারণ না করেন, যাবি?
হারাণী। যাব, কিন্তু টাকা নিব না। তোমার টাকা তুমি নাও।
আমি। আচ্ছা, তোকে যেন সময়ে পাই।
আমি তখন চোখের জল মুছিয়া সুভাষিণীর সন্ধানে গেলাম। তাহাকে
নিভৃতেই পাইলাম। আমাকে দেখিয়া সুভাষিণীর সেই সুন্দর মুখখানি, যেন সকালের
পদ্মের মত, যেন সন্ধ্যাবেলার গন্ধরাজের মত, আহ্লাদে ফুটিয়া
উঠিল—সর্ব্বাঙ্গ, যেন সকালবেলার সর্বত্র পুষ্পিত শেফালিকার মত, যেন
চন্দ্রোদয়ে নদীস্রোতের মত, আনন্দে প্রফুল্ল হইল। হাসিয়া আমার কাণের কাছে
মুখ আনিয়া সুভাষিণী জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন চিনিয়াছ ত?”
আমি আকাশ থেকে পড়িলাম। বলিলাম, “সে কি? তুমি কেমন করে জানলে?”
সুভাষিণী মুখ চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “আহা:, তোমার সোণার চাঁদ বুঝি আপনি এসে ধরা
দিয়েছে? আমরা যাই আকাশে ফাঁদ পাততে জানি, তাই তোমার আকাশের চাঁদ ধরে এনে
দিয়েছি!”
আমি বলিলাম, “তোমার কে? তুমি আর র-বাবু?”
সু। না ত আবার কে? তুমি, তোমার স্বামী শ্বশুরের আর তাঁদের গাঁয়ের নাম বলিয়া
দিয়াছিলে, মনে আছে? তাই শুনিয়াই র-বাবু চিনিতে পারিলেন। তোমার উ-বাবুর একটা
বড় মোকদ্দমা তাঁর হাতে ছিল—তারই ছল করিয়া তোমার উ-বাবুকে কলিকাতায় আসিতে
লিখিলেন। তার পর নিমন্ত্রণ।
আমি। তার পর পাতিয়া বুড়ীর দালটুকু নেওয়া।
সু। হাঁ, সেটাও আমাদের ষড়্য়যন্ত্র।
আমি। তা, আমার পরিচয় কিছু দেওয়া হয়েছে কি?
সু । আ সর্বনাশ! তা কি দেওয়া যায়? তোমাকে ডাকাতে কেড়ে নিয়ে
গিয়েছিল, তার পর কোথায় গিয়েছিলে, কি বৃত্তান্ত, তা কে জানে? তোমার পরিচয়
পেলে কি ঘরে নেবে? বলবে একটা গছিয়ে দিচ্চে। র-বাবু বলেন, এখন তুমি নিজে যা
করিতে পার।
আমি। আমি একবার কপাল ঠুকিয়া দেখিব—না হয় ডুবিয়া মরিব। কিন্তু
আমার সঙ্গে দেখা না হইলে, কি করিব?
সু। কখন্ দেখা করবে, কোথায় বা দেখা করবে?
আমি। তোমরা যদি এত করিয়াছ, তবে এ বিষয়েও একটু সাহায্য কর। তাঁর
বাসায় গেলে দেখা হইবে না,—কেই বা আমাকে নিয়ে যাবে, কেই বা দেখা করাইবে?
এইখানেই দেখা করিতে হইবে।
সু। কখন্?
আমি। রাত্রে, সবাই শুইলে।
সুভা। অভিসারিকে?
আমি। তা বৈ আর গতি কি? দোষই বা কি—স্বামী যে।
সু। না, দোষ নাই। কিন্তু তাহা হইলে তাঁকে রাত্রে আটকাইতে হয়।
নিকটে তাঁর বাসা; তা ঘটিবে কি? দেখি একবার র-বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে।
সুভাষিণী রমণ বাবুকে ডাকাইল। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হইল, তাহা আমাকে আসিয়া
বলিল। বলিল, “র”-বাবু যাহা পারেন তাহা এই:—তিনি এখন মোকদ্দমার কাগজপত্র
দেখিবেন না—একটা ওজর করিয়া রাখিবেন। কাগজ দেখিবার জন্য সন্ধ্যার পর সময়
অবধারণ করিবেন। সন্ধ্যার পর তোমার স্বামী আসিলে, কাগজপত্র দেখিবেন।
কাগজপত্র দেখিতে দেখিতে একটু রাত্র করিবেন। রাত্র হইলে আহারের জন্য অনুরোধ
করিবেন। কিন্তু তার পর তোমার বিদ্যায় যা থাকে তা করিও। রাত্রে থাকিতে আমরা
কি বলিয়া অনুরোধ করিব?”
আমি বলিলাম, “সে অনুরোধ তোমাদের করিতে হইবে না। আমিই করিব। আমার
অনুরোধে যাহাতে শুনেন, তাহা করিয়া রাখিয়াছি। দুই একটা চাহনি ছুঁড়িয়া
মারিয়াছিলাম, তিনি তাহা ফিরাইয়া দিয়াছেন। লোক ভাল নহেন। এখন আমার অনুরোধ
তাঁহার কাছে পাঠাই কিপ্রকারে? এক ছত্র লিখিয়া দিব। সেই কাগজটুকু কেহ তাঁর
কাছে দিয়ে এলেই হয়।”
সু। কোন চাকরের হাতে পাঠাও না?
আমি। যদি জন্মজন্মান্তরেও স্বামী না পাই, তবুও পুরুষ মানুষকে
একথা বলিতে পারি না।
সু। তা বটে। কোন ঝি?
আমি। ঝি বিশ্বাসী কে? একটা গোলমাল বাধাইবে, তখণ সব খোওয়াব।
সু। হারাণী বিশ্বাসী।
আমি। হারাণীকে বলিয়াছিলাম। বিশ্বাসী বলিয়া সে নারাজ। তবে তোমার
একটু ইঙ্গিত পাইলে সে যাইতে পারে। কিন্তু তোমায় এমন ইঙ্গিত করিতে কি
প্রকারে বলিতে পারি? মরি, ত আমি একাই মরিব।—পোড়া চোখে আবার জল আসিল।
সু। হারাণী আমার কথা কি বলিয়াছে?
আমি। তুমি যদি বারণ না কর, তবে সে যাইতে পারে।
সুভাষিণী অনেক্ষণ ভাবিল। বলিল, “সন্ধ্যার পর তাকে এই কথার জন্য
আসিতে বলিও।”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : আমাকে একজামিন দিতে হইল
সন্ধ্যার পর আমার
স্বামী কাগজপত্র লইয়া রমণ বাবুর কাছে আসিলেন। সংবাদ পাইয়া, আমি আর একবার
হারাণীর হাতে পায়ে ধরিলাম। হারাণী সেই কথাই বলে, “বৌদিদি যদি বারণ না করে,
তবে পারি। তবে জানিব, এতে দোষ নাই।” আমি বলিলাম, “যাহা হয় কর্—আমার বড়
জ্বালা।”
এই ইঙ্গিত পাইয়া হারাণী একটু হাসিতে হাসিতে সুভাষিণীর কাছে ছুটিল। আমি
তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, সে হাসির ফোয়ারা খুলিয়া দিয়া,
আলু থালু কেশ বেশ সামলাইতে সামলাইতে, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, ছুটিয়া আসিল। আমি
জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি গো এত হাসি কেন?”
হা। দিদি, এমন জায়গায়ও মানুষকে পাঠায়? প্রাণটা গিয়াছিল আর কি!
আমি। কেন গো?
হা। আমি জানি বৌদিদির ঘরে ঝাঁটা থাকে না, দরকারমত ঝাঁটা লইয়া
গিয়া আমরা ঘর ঝাঁটাইয়া আসি। আজ দেখি যে, বৌদিদির হাতের কাছেই কে ঝাঁটা
রাখিয়া আসিয়াছে। আমি যেমন গিয়া বলিলাম, “তা যাব কি?” অমনি বৌদিদি সেই ঝাঁটা
লইয়া আমাকে তাড়াইয়া মারিতে আসিল। ভাগ্যিস পালাতে জানি, তাই পালিয়ে বাঁচলেম।
নহিলে খেঙ্গরা খেয়ে প্রাণটা গিয়েছিল আর কি? তবু এক ঘা বুঝি পিঠে পড়েছে—দেখ
দেখি দাগ হয়েছে কি না?’
হারাণী হাসিতে হাসিতে আমাকে পিঠ দেখাইল। মিছে কথা—দাগ ছিল না।
তখন সে বলিল, “এখন কি করতে হবে বল—করে আসি!”
আমি। ঝাঁটা খেয়ে যাবি?
হা। ঝাঁটা মেরেছে—বারণ ত করে নি। আমি বলেছিলাম, বারণ না করে ত
যাব।
আমি। ঝাঁটা কি বারণ না?
হা। হা, দেখ দিদিমণি, বৌদিদি তখন ঝাঁটা তোলে, তখন তার ঠোঁটের
কোণে একটু হাসি দেখেছিলাম। তা কি করতে হবে, বল।
আমি তখন এক টুকরা কাগজে লিখিলাম।
“আমি আপনাকে মনঃপ্রাণ সমর্পণ করিয়াছি। গ্রহণ করিবেন কি? যদি
করেন, তবে আজ রাত্রিতে এই বাড়ীতে শয়ন করিবেন। ঘরের দ্বার যেন খোলা থাকে।
সেই পাচিকা।”
পত্র লিখিয়া, লজ্জায় ইচ্ছা করিতে লাগিল, পুকুরের জলে ডুবিয়া থাকি, কি
অন্ধকারে লুকাইয়া থাকি। তা কি করিব? বিধাতা যেমন ভাগ্য দিয়াছেন! বুঝি আর
কখন কোন কুলবতীর কপালে এমন দুর্দশা ঘটে নাই।
কাগজটা মুড়িয়াসুড়িয়া হারাণীকে দিলাম। বলিলাম, “একটু সবুর।” সুভাষিণীকে
বলিলাম, “একবার দাদাবাবুকে ডাকিয়া পাঠাও। যাহা হয়, একটা কথা বলিয়া বিদায়
দিও।” সুভাষিণী তাই করিল। রমণ বাবু উঠিয়া আসিলে, হারাণীকে বলিলাম, “এখন
যা।” হারাণী গেল, কিছু পরে কাগজটা ফেরত দিল। তার এক কোণে লেখা আছে,
“আচ্ছা।” আমি তখন হারাণীকে বলিলাম, “যদি এত করিলি, তবে আর একটু করিতে হইবে।
দুপুর রাত্রে আমাকে তাঁর শুইবার ঘরটা দেখাইয়া দিয়া আসিতে হইবে।”
হা। আচ্ছা, কোন দোষ নাই ত?
আমি। কিছু না। উনি আর জন্মে আমার স্বামী ছিলেন।
হা। আর জন্মে, কি এ জন্মে, ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।
আমি হাসিয়া বলিলাম, “চুপ।”
হারাণী হাসিয়া বলিল, “যদি এ জন্মের হন, তবে আমি পাঁচ শত টাকা
বখশিশ নিব; নহিলে আমার ঝাঁটার ঘা ভাল হইবে না।”
আমি তখন সুভাষিণীর কাছে গিয়া এসকল সংবাদ দিলাম। সুভাষিণী
শাশুড়ীকে বলিয়া আসিল, “আজ কুমুদিনীর অসুখ হইয়াছে; সে রাঁধিতে পারিবে না।
সোণার মাই রাঁধুক।”
সোণার মা রাঁধিতে গেল—সুভাষিণী আমাকে লইয়া গিয়া ঘরে কবাট দিল। আমি জিজ্ঞাসা
করিলাম, “এ কি, কয়েদ কেন?” সুভাষিণী বলিল, “তোমায় সাজাইব।”
তখন আমার মুখ পরিষ্কার করিয়া মুছাইয়া দিল। চুলে সুগন্ধ তৈল মাখাইয়া, যত্নে
খোঁপা বাঁধিয়া দিল; বলিল, “এ খোঁপার হাজার টাকা মূল্য, সময় হইলে আমায় এ
হাজার টাকা পাঠাইয়া দিস।” তার পর আপনার একখানা পরিষ্কার, রমণীমনোহর বস্ত্র
লইয়া জোর করিয়া পরাইতে লাগিল। সে যেরূপ টানাটানি করিল, বিবস্ত্রা হইবার ভয়ে
আমি পরিতে বাধ্য হইলাম। তার পর আপনার অলঙ্কাররাশি আনিয়া পরাইতে আসিল। আমি
বলিলাম, “এ আমি কিছুতেই পরিব না।”
তার জন্য অনেক বিবাদ বচসা হইল—আমি কোন মতেই পরিলাম না দেখিয়া সে বলিল,
“তবে, আর এক সুট আনিয়া রাখিয়াছি, তাই পর।”
এই বলিয়া সুভাষিণী একটা ফুলের জার্ডিনিয়র হইতে বাহির করিয়া মল্লিকা ফুলের
অফুল্ল কোরকের বালা পরাইল, তাহার তাবিজ, তাহারই বাজু, গলায় তারই দোনর মালা।
তার পর এক জোড়া নূতন সোণার ইয়াররিং বাহির করিয়া বলিল, “এ আমি নিজের টাকায়
র—বাবুকে দিয়া কিনিয়া আনাইয়াছি—তোমাকে দিবার জন্য। তুমি যেখানে যখন থাক, এ
পরিলে আমাকে তুমি মনে করিবে। কি জানি ভাই, আজ বৈ তোমার সঙ্গে যদি দেখা না
হয়—ভগবান তাই করুন,—তাই তোমাকে আজ ইয়ার্রিং পরাইব। এতে আর না বলিও না।”
বলিতে বলিতে সুভাষিণী কাঁদিল। আমারও চক্ষে জল আসিল, আমি আর না বলিতে
পারিলাম না। সুভাষিণী ইয়াররিং পরাইল।
সাজসজ্জা শেষ হইলে সুভাষিণীর ছেলেকে ঝি দিয়া গেল। ছেলেটিকে কোলে লইয়া তাহার
সঙ্গে গল্প করিলাম। সে একটু গল্প শুনিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। তার পর মনে একটি
দুঃখের কথা উদয় হইয়াছিল, তাও এ সুখের মাঝে সুভাষিণীকে না বলিয়া থাকিতে
পারিলাম না। বলিলাম, “আমি আহ্লাদিত হইয়াছি, কিন্তু মনে মনে তাঁহাকে একটু
নিন্দা করিতেছি। আমি চিনিয়াছি যে, তিনি আমার স্বামী, এই জন্য আমি যাহা
করিতেছি, তাহাতে আমার বিবেচনায়, দোষ নাই। কিন্তু তিনি যে আমাকে চিনিতে
পারিয়াছেন, এমন কোন মতেই সম্ভবে না। আমি তাঁহাকে বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায়
দেখিয়াছিলাম। এজন্য আমার প্রথমেই সন্দেহ হইয়াছিল। তিনি আমাকে একাদশ বৎসরের
বালিকা দেখিয়াছিলেন মাত্র। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন, এমন কোন লক্ষণও
দেখি নাই। অতএব তিনি আমাকে পরস্ত্রী জানিয়া যে আমার প্রণয়াশায় লুব্ধ হইলেন,
শুনিয়া মনে মনে বড় নিন্দা করিতেছি। কিন্তু তিনি স্বামী, আমি
স্ত্রী,—তাঁহাকে মন্দ ভাবা আমার অকর্তব্য বলিয়া সেকথার আর আলোচনা করিব না।
মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম, যদি কখনও দিন পাই, তবে এ স্বভাব ত্যাগ করাইব।”
সুভাষিণী আমার কথা শুনিয়া বলিল, “তোর মত বাঁদর গাছে নাই, ওঁর যে
স্ত্রী নেই।”
আমি। আমার কি স্বামী আছে না কি?
সু। আ মলো! মেয়ে মানুষে পুরুষ মানুষে সমান! তুই কমিসেরিয়েটের
কাজ করে টাকা নিয়ে আয় না দেখি?
আমি। ওরা পেটে ছেলে ধরিয়া, প্রসব করিয়া, মানুষ করুক, আমি
কমিসেরিয়েটে যাইব। যে যা পারে, সে তা করে। পুরুষ মানুষের ইন্দ্রিয় দমন কি
এতই শক্ত?
সু। আচ্ছা, আগে তোর ঘর হোক, তারপর ঘরে আগুন দিস। ও সব কথা রাখ।
কেমন করে স্বামীর মন ভুলাবি, তার একজামিন দে দেখি? তা নইলে ত তোর গতি নেই।
আমি একটু ভাবিত হইয়া বলিলাম, “সে বিদ্যা ত কখনও শিখি নাই।”
সু। তবে আমার কাছে শেখ। আমি এ শাস্ত্রে পণ্ডিত, তা জানিস?
আমি। তা ত দেখিতে পাই।
সু। তবে শেখ। তুই যেন পুরুষ মানুষ। আমি কেমন করিয়া তোর মন ভুলাই
দেখ।
এই বলিয়া পোড়ারমুখী, মাথায় একটু ঘোমটা টানিয়া, সযত্নে স্বহস্তে প্রস্তুত
সুবাসিত একটি পান আনিয়া আমাকে খাইতে দিল। সে পান সে কেবল রমণ বাবুর জন্য
রাখে, আর কাহাকেও দেয় না। এমন কি, আপনিও কখনও খায় না। রমণ বাবুর আলবোলাটা
সেখানে ছিল, তাহাতে কল্কে বসান; গুলের ছাই ছিল মাত্র; তাই আমার সমুখে ধরিয়া
দিয়া, ফুঁ দিয়া ধরান, সুভাষিণী নাটিত করিল। তার পর, ফুল দিয়া সাজান
তালবৃন্তখানি হাতে লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। হাতের বালাতে চুড়িতে বড় মিঠে
মিঠে বাজিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, “ভাই! এ ত দাসীপনা—দাসীপনায় আমার কতদূর বিদ্যা,
তারই পরিচয় দিবার জন্য কি তাঁকে আজ ধরিয়া রাখিলাম?”
সুভাষিণী বলিল, “আমরা দাসী না ত কি?”
আমি বলিলাম, “যখন তাঁর ভালবাসা জন্মিবে, তখন দাসীপনা চলিবে। তখন
পাখা করিব, পা টিপিব, পান সাজিয়া দিব, তামাকু ধরাইয়া দিব। এখনকার ওসব নয়।”
তখন সুভাষিণী হাসিতে হাসিতে আমার কাছে আসিয়া বসিল। আমার হাতখানা আপনার
হাতের ভিতর তুলিয়া লইল, মিঠে মিঠে গল্প করিতে লাগিল। প্রথম প্রথম, হাসিতে
হাসিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, কাণবালা দোলাইয়া, সে যে সং সাজিয়াছিল, তারই
অনুরূপ কথা কহিতে লাগিল। কথায় কথায় সে ভাব ভুলিয়া গেল। সখীভাবেই কথা কহিতে
লাগিল। আমি যে চলিয়া যাইব, সে কথা পাড়িল। চক্ষুতে তার এক বিন্দু জল চক চক
করিতে লাগিল। তখন তাহাকে প্রফুল্ল করিবার জন্য বলিলাম, “যা শিখাইলে, তা
স্ত্রীলোকের অস্ত্র বটে, কিন্তু এখন উ-বাবুর উপর খাটিবে কি?”
সুভাষিণী তখন হাসিয়া বলিল, “তবে আমার ব্রহ্মাস্ত্র শিখে নে।”
এই বলিয়া, মাগী আমার গলা বেড়িয়া হাত দিয়া আমার মুখখানা তুলিয়া
ধরিয়া, আমার মুখচুম্বন করিল। এক ফোঁটা জল, আমার গালে পড়িল।
ঢোক গিলিয়া আমার চোখের জল চাপিয়া, আমি বলিলাম, “এ যে ভাই
সঙ্কল্প না হতে দক্ষিণা দেওয়া শিখাইতেছিস।”
সুভাষিণী বলিল, “তোর তবে বিদ্যা হবে না। তুই কি জানিস, একজামিন
দে দেখি। এই আমি যেন উ-বাবু এই বলিয়া সে সোফার উপর জমকাইয়া বসিয়া,—হাসি
রাখিতে না পারিয়া, মুখ কাপড় গুঁজিতে লাগিল। সে হাসি থামিলে বলিল, “একজামিন
দে”| তখন যে বিদ্যার পরিচয় পাঠক পশ্চাৎ পাইবেন,সিভাষিনীকেও তাহার কিছু
পরিচয় দিলাম।সুভাষিনী আমাকে সোফা হইতে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল—বলিল “দূর হ
পাপিষ্ঠা! তুই আস্ত কেউটে!”
আমি বলিলাম, “কেন ভাই?”
সুভাষিণী বলিল, “ও হাসি চাহনিতে পুরুষ মানুষ টিকে? মরিয়া ভূত
হয়।”
আমি। তবে একজামিন পাস?
সু। খুব পাস—কমিসেরিয়েটের এক-শ ঊনসত্তর পুরুষেও এমন হাসি চাহনি
কখন দেখে নাই। মিন্সের মুণ্ডটা যদি ঘুরে যায়, ত একটু বাদামের তেল দিস্।
আমি। আচ্ছা। এখন সাড়া শব্দে বুঝিতে পারিতেছি, বাবুদের খাওয়া হইয়া গেল। রমণ
বাবুর ঘরে আসিবার সময় হইল, আমি এখন বিদায় হই। যা শিখিয়াছিলে, তার মধ্যে
একটা বড় মিষ্ট লাগিয়াছিল—সেই মুখচুম্বনটি। এসো আর একবার শিখি।
তখন সুভাষিণী আমার গলা ধরিল, আমি তার গলা ধরিলাম। গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক
পরস্পরে মুখচুম্বন করিয়া, গলা ধরাধরি করিয়া, দুই জনে অনেক্ষণ কাঁদিলাম। এমন
ভালবাসা কি আর হয়? সুভাষিণীর মত আর কি কেহ ভালবাসিতে জানে? সুভাষিণীর মত আর
কি কেহ ভালবাসিতে জানে? মরিব, কিন্তু সুভাষিণীকে ভুলিব না।