বঙ্কিম রচনাবলী

ইন্দিরা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

এই উপন্যাসটি প্রথম সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৭৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায়। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।


চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : আমার প্রাণত্যাগের প্রতিজ্ঞা

আমি হারাণীকে সতর্ক করিয়া দিয়া আপনার শয়নগৃহে গেলাম। বাবুদের আহারাদি হইয়া গিয়াছে। এমন সময়ে একটা বড় গণ্ডগোল পড়িয়া গেল। কেহ ডাকে পাখা, কেহ ডাকে জল, কেহ ডাকে ঔষধ, কেহ ডাকে ডাক্তার। এইরূপ হুলস্থূল। হারাণী হাসিতে হাসিতে আসিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত গণ্ডগোল কিসের?”
    হা। সেই বাবুটি মূর্চ্ছা গিয়াছিলেন।
    আমি। তার পর?
    হা। এখন সামলেছেন।
    আমি। তার পর?
    হা। এখন বড় অবসন্ন—বাসায় যাইতে পারিলেন না। এখানেই বড় বৈঠকখানায় পাশের ঘরে শুইলেন।
    বুঝিলাম, এ কৌশল। বলিলাম। “আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে আসিবে।”
    হারাণী বলিল, “অসুখ যে গা।”
    আমি বলিলাম, “অসুখ না তোর মুণ্ড। আর পাঁচ-শ খানা বিবির মুণ্ড, যদি দিন পাই।”

হারাণী হাসিতে হাসিতে গেল। পরে আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে, হারাণী আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ঘর দেখাইয়া দিয়া আসিল। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি একাই শয়ন করিয়া আছেন। অবসন্ন কিছুই না; ঘরে দুইটা বড় বড় আলো জ্বলিতেছে, তিনি নিজের রূপরাশিতে সমস্ত আলো করিয়া আছেন। আমিও শরবিদ্ধ; আনন্দে শরীর আপ্লুত হইল।

যৌবন প্রাপ্তির পর আমার এই প্রথম স্বামিসম্ভাষণ। সে যে কি সুখ, তাহা কেমন করিয়া বলিব? আমি অত্যন্ত মুখরা—কিন্তু যখন প্রথম তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে গেলাম, কিছুতেই কথা ফুটিল না। কণ্ঠরোধ হইয়া আসিতে লাগিল। সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। হৃদয়মধ্যে দুপ দুপ শব্দ হইতে লাগিল। রসনা শুকাইতে লাগিল। কথা আসিল না বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম।

সে অশ্রুজল তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, “কাঁদিলে কেন? আমি ত তোমাকে ডাকি নাই—তুমি আপনি আসিয়াছ—তবে কাঁদ কেন?”

এই নিদারুণ বাক্যে বড় মর্মপীড়া হইল। তিনি যে আমাকে কুলটা মনে করিতেছেন—ইহাতে চক্ষুর প্রবাহ আরও বাড়িল। মনে করিলাম, এখন পরিচয় দিই—এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না, কিন্তু তখনই মনে হইল যে, পরিচয় দিলে যদি ইনি না বিশ্বাস করেন, যদি মনে করেন যে, “ইহার বাড়ী কালাদীঘি, অবশ্য আমার স্ত্রীহরণের বৃত্তান্ত শুনিয়াছে, এক্ষণে ঐশ্বর্যলোভে আমার স্ত্রী বলিয়া মিথ্যা পরিচয় দিতেছে”—তাহা হইলে কি প্রকারে ইঁহার বিশ্বাস জন্মাইব? সুতরাং পরিচয় দিলাম না। দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চক্ষুর জল মুছিয়া, তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলাম। অন্যান্য কথার পরে তিনি বলিলেন, “কালাদীঘি তোমার বাড়ী শুনিয়া আমি আশ্চর্য হইয়াছি। কালদীঘিতে যে এমন সুন্দরী জন্মিয়াছে, তাহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।”

তাঁর চক্ষের প্রতি আমি লক্ষ্য করিতেছিলাম, তিনি বড় বিস্ময়ের সহিত আমাকে দেখিতেছিলেন। তাঁর কথার উত্তরে আমি নেকী সাজিয়া বলিলাম, “আমি সুন্দরী না বান্দরী। আমাদের দেশের মধ্যে আপনার স্ত্রীরই সৌন্দর্যের গৌরব।” এই ছলক্রমে তাঁহার স্ত্রীর কথা পাড়িয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহার কি কোন সন্ধান পাওয়া গিয়াছে?”
    উত্তর। না।–তুমি কতদিন দেশ হইতে আসিয়াছ?
    আমি বলিলাম, “আমি সে সকল ব্যাপারের পরেই দেশ হইতে আসিয়াছি। তবে বোধ হয়, আপনি আবার বিবাহ করিয়াছেন।”
    উত্তর। না।
    বড় বড় কথায়, উত্তর দিবার তাঁহার অবসর দেখিলাম না। আমি উপযাচিকা, অভিসারিকা হইয়া আসিয়াছি,—আমাকে আদর করিবারও তাঁর অবসর নাই। তিনি সবিস্ময়ে আমার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। একবারমাত্র বলিলেন, “এমন রূপ ত মানুষের দেখি নাই।”

সপত্নী হয় নাই, শুনিয়া বড় আহ্লাদ হইল। বলিলাম, “আপনারা যেমন বড়লোক, এটি তেমনই বিবেচনার কাজ হইয়াছে। নহিলে যদি এর পর আপানার স্ত্রীকে পাওয়া যায়, তবে দুই সতীনে ঠেঙ্গাঠেঙ্গি বাধিবে।”

তিনি মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “সে ভয় নাই। সে স্ত্রীকে পাইলেও আমি আর গ্রহণ করিব, এমন বোধ হয় না। তাহার আর জাতি নাই বিবেচনা করিতে হইবে।”

আমার মাথায় বজ্রাঘাত হইল। এত আশাভরসা সব নষ্ট হইল। তবে আমার পরিচয় পাইলে, আমাকে আপন স্ত্রী বলিয়া চিনিলেও, আমাকে গ্রহণ করিবেন না! আমার এবারকার নারীজন্ম বৃথা হইল।

    সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “যদি এখন তাঁহার দেখা পান, তবে কি করিবেন?”
    তিনি অম্লানবদনে বলিলেন, “তাকে ত্যাগ করিব।”
    কি নির্দ্দয়! আমি স্তম্ভিতা হইয়া রহিলাম। পৃথিবী আমার চক্ষে ঘুরিতে লাগিল।
    সেই রাত্রিতে আমি স্বামিশয্যায় বসিয়া তাহা অনিন্দিত মোহনমূর্তি দেখিতে দেখিতে প্রতিজ্ঞা করিলাম, “ইনি আমায় স্ত্রী বলিয়া গ্রহণ করিবেন, নচেৎ আমি প্রাণত্যাগ করিব।”
 


পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : কুলের বাহির

তখন সে চিন্তিত ভাব আমার দূর হইল। ইতিপূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি আমার বশীভূত হইয়াছেন। মনে মনে কহিলাম, যদি গণ্ডারের খড়্গ-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি হস্তীর দন্ত-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি ব্যাঘ্রের নখব্যবহারে পাপ না থাকে, যদি মহিষের শৃঙ্গাঘাতে পাপ না থাকে, তবে আমারও পাপ হইবে না। জগদীশ্বর আমাদিগকে যে সকল আয়ুধ দিয়াছেন, উভয়ের মঙ্গলার্থে তাহা প্রয়োগ করিব। যদি কখন “মল বাজিয়ে” যেতে হয়, তবে সে এখন। আমি তাঁহার নিকট হইতে দূরে আসিয়া বসিলাম। তাঁর সঙ্গে প্রফুল্ল হইয়া কথা কহিতে লাগিলাম। তিনি নিকটে আসিলেন, আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আমার নিকটে আসিবেন না, আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে দেখিতেছি,” [হাসিতে হাসিতে আমি এই কথা বলিলাম এবং বলিতে বলিতে কবরীমোচনপূর্বক (সত্য কথা না বলিলে কে এ ইতিহাস বুঝিতে পারিবে?) আবার বাঁধিতে বসিলাম,] “আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে। আমি কুলটা নহি। আপনার নিকটে দেশের সংবাদ শুনিব বলিয়াই আসিয়াছি। অসৎ অভিপ্রায় কিছুই নাই।”

বোধ হয়, তিনি একথা বিশ্বাস করিলেন না। অগ্রসর হইয়া বসিলেন। আমি তখন হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “তুমি কথা শুনিলে না, তবে আমি চলিলাম, তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ,” এই বলিয়া আমি যেমন করিয়া চাহিতে হয়, তেমনি করিয়া চাহিতে চাহিতে, আমার কুঞ্চিত, মসৃণ, সুবাসিত অলকদামের প্রান্তভাগ, যেন অনবধানে, তাঁহার গণ্ড স্পর্শ করাইয়া সন্ধ্যার বাতাসে বসন্তের লতার মত একটু হেলিয়া, গাত্রোত্থান করিলাম।

আমি সত্য সত্যই গাত্রোত্থান করিলাম দেখিয়া তিনি ক্ষুণ্ণ হইলেন, আসিয়া আমার হাত ধরিলেন। মল্লিকাকোরকের বালার উপর তাঁর হাত পড়িল। তিনি হাতখানা ধরিয়া রাখিয়া যেন বিস্মিতের মত হাতের পানে চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “দেখিতেছ কি?” তিনি উত্তর করিলেন, “এ কি ফুল? এ ফুল ত মানায় নাই। ফুলটার অপেক্ষা মানুষটা সুন্দর। মল্লিকা ফুলের চেয়ে মানুষ সুন্দর এই প্রথম দেখিলাম।” আমি রাগ করিয়া হাত ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলাম, কিন্তু হাসিলাম, বলিলাম, “তুমি ভাল মানুষ নও। আমাকে ছুঁইও না। আমাকে দুশ্চরিত্রা মনে করিও না।”

এই বলিয়া আমি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম। স্বামী—অদ্যাপি সে কথা মনে পড়িলে দুঃখ হয়—তিনি হাতযোড় করিয়া ডাকিলেন, “আমার কথা রাখ, যাইও না। আমি তোমার রূপ দেখিয়া পাগল হইয়াছি। এমন রূপ আমি কখন দেখি নাই। আর একটু দেখি। এমন আর কখন দেখিব না।” আমি আবার ফিরিলাম—কিন্তু বসিলাম না—বলিলাম, “প্রাণাধিক! আমি কোন্ ছার, আমি যে তোমা হেন রত্ন ত্যাগ করিয়া যাইতেছি, ইহাতেই আমার মনের দুঃখ বুঝিও। কিন্তু কি করিব? ধর্মই আমাদিগের একমাত্র প্রধান ধন—একদিনের সুখের জন্য আমি ধর্ম ত্যাগ করিব না। আমি না বুঝিয়া, না ভাবিয়া, আপনার কাছে আসিয়াছি। না বুঝিয়া, না ভাবিয়া, আপনাকে পত্র লিখিয়াছিলাম। কিন্তু আমি একেবারে অধঃপাতে যাই নাই। এখনও আমার রক্ষার পথ খোলা আছে। আমার ভাগ্য যে, সেকথা এখন আমার মনে পড়িল। আমি চলিলাম।”

তিনি বলিলেন, “তোমার ধর্ম তুমি জান। আমায় এমন দশায় ফেলিয়াছ যে, আমার আর ধর্মাধর্ম জ্ঞান নাই। আমি শপথ করিতেছি, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়েশ্বরী হইয়া থাকিবে। এক দিনের জন্য মনে করিও না।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “পুরুষের শপথে বিশ্বাস নাই। এক মুহূর্তের সাক্ষাতে কি এত হয়?” এই বলিয়া আবার চলিলাম—দ্বার পর্যন্ত আসিলাম। তখন আর ধৈর্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া তিনি দুই হস্তে আমার দুই চরণ ধরিয়া পথরোধ করিলেন। বলিলেন, “আমি যে এমন আর কখন দেখি নাই।” তাহার মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। তাঁহার দশা দেখিয়া আমার দুঃখও হইল। বলিলাম, “তবে তোমার বাসায় চল—এখানে থাকিলে তুমি আমার ত্যাগ করিয়া যাইবে।”

তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। তাঁহার বাসা সিমলায়, অল্প দূর। তাঁর গাড়িও হাজির ছিল, এবং দ্বারবানেরা নিদ্রিত। আমরা নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। তাঁর বাসায় গিয়া দেখিলাম, দুই মহল বাড়ী। একটি ঘরে আমি অগ্রে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিলাম। স্বামী বাহিরে পড়িয়া রহিলেন। তিনি বাহির হইতে কাতরোক্তি করিতে লাগিলেন। ‍ আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “আমি এখন তোমারই দাসী হইলাম। কিন্তু দেখি, তোমার প্রণয়ের বেগ কাল প্রাতঃকাল পর্যন্ত থাকে না থাকে। যদি কালও এমনি ভালবাসা দেখিতে পাই, তখন তোমার সঙ্গে আবার আলাপ করিব। আজ এই পর্যন্ত।”

আমি দ্বার খুলিলাম না; অগত্যা তিনি অন্যত্র গিয়া বিশ্রাম করিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের অসহ্য সন্তাপে, দারুণ তৃষাপীড়িত রোগীকে স্বচ্ছ শীতল জলাশয়তীরে বসাইয়া দিয়া, মুখ বাঁধিয়া দাও, যেন সে জল পান করিতে না পারে—বল দেখি, তার জলে ভালবাসা বাড়িবে কি না?

অনেক বেলা হইলে দ্বার খুলিলাম, দেখিলাম, স্বামী দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমি আপনার করে তাঁহার কর গ্রহণ করিয়া বলিলাম, “প্রাণনাথ, হয় আমাকে রামরাম দত্তের বাড়ী পাঠাইয়া দাও, নচেৎ অষ্টাহ আমার সঙ্গে আলাপ করিও না। এই অষ্টাহ তোমার পরীক্ষা।” তিনি অষ্টাহ পরীক্ষা স্বীকার করিলেন।