বঙ্কিম রচনাবলী

ইন্দিরা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

এই উপন্যাসটি প্রথম সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৭৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায়। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।


ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : বিদ্যাধরী

দেখিলাম, এক্ষণে অনায়াসে আত্মপরিচয় দিতে পারি। আমার স্বামীর নিজ মুখ হইতে আমার পরিচয় ব্যক্ত হইয়াছে। কিন্তু কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিতে, আমি পরিচয় দিব না, স্থির করিয়াছিলাম। তাই বলিলাম, “এখন আত্মপরিচয় দিব। কামরূপে আমার অধিষ্ঠান। আমি আদ্যাশক্তির মহামন্দিরে তাঁহার পার্শ্বে থাকি। লোকে আমাদিগকে ডাকিনী বলে, কিন্তু আমরা ডাকিনী নই। আমরা বিদ্যাধরী। আমি মহামায়ার নিকট কোন অপরাধ করিয়াছিলাম, সেই জন্য অভিসম্পাতগ্রস্ত হইয়া এই মানবীরূপ ধারণ করিয়াছি। পাচিকাবৃত্তি এবং কুলটাবৃত্তিও ভগবতীর শাপের ভিতর। তাই এসকলও অদৃষ্টে ঘটিয়াছে। এক্ষণে আমার শাপ হইতে মুক্ত হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। আমি জগন্মাতাকে স্তবে প্রসন্ন করিলে, তিনি আজ্ঞা করিয়াছেন যে, মহাভৈরবীদর্শন করিবামাত্র আমি মুক্তিলাভ করিব।”

তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কোথায়?”

আমি বলিলাম, “মহাভৈরবীর মন্দির মহেশপুরে তোমার শ্বশুরবাড়ীর উত্তরে। সে তাঁদেরই ঠাকুরবাড়ী, বাড়ীর গায়ে, খিড়কি দিয়া যাতায়াতের পথ আছে। চল, মহেশপুরে যাই।”

তিনি ভাবিয়া বলিলেন, “তুমি বুঝি আমার ইন্দিরাই হইবে। কুমুদিনী যদি ইন্দিরা, তাহা হইলে কি সুখ! পৃথিবীতে তাহা হইলে আমার মত সুখী কে?”

আমি। যেই হই, মহেশপুর গেলেই সব গোল মিটিবে।

তিনি। তবে চল, কাল এখান হইতে যাত্রা করি। আমি তোমাকে কালাদীঘি পার করিয়া দিয়া মহেশপুরে পাঠাইয়া দিয়া, নিজে আপাততঃ বাড়ী যাইব। দুই একদিন সেখানে থাকিয়া আমি মহেশপুর যাইব। যোড়হাতে তোমার কাছে এই ভিক্ষা করি যে, তুমি ইন্দিরাই হও, আর কুমুদিনীই হও, আর বিদ্যাধরী হও, আমাকে ত্যাগ করিও না।

আমি। না। আমার শাপান্ত হইলেও দেবীর কৃপায় আবার তোমায় পাইতে পারিব। তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয় বস্তু।

“এ কথাটা ত ডাকিনীর মত নহে।” এই বলিয়া তিনি সদরে গেলেন। সেখানে লোক আসিয়াছিল। লোক আর কেহ নহে, রমণ বাবু। রমণ বাবু আমার স্বামীর সঙ্গে অন্তঃপুরে আসিয়া আমাকে সীল-করা পুলিন্দা দিয়া গেলেন। আমার স্বামীকে সে সম্বন্ধে যে উপদেশ দিয়াছিলেন, আমাকেও সেই উপদেশ দিলেন। শেষ বলিলেন, “সুভাষিণীকে কি বলিব?”

    আমি বলিলাম, “বলিবেন, কাল আমি মহেশপুর যাইব। গেলেই আমি শাপ হইতে মুক্ত হইব।”
    স্বামী বলিলেন, “আপনাদের এ সব জানা আছে না কি?”
    চতুর রমণ বাবু বলিলেন, “আমি সব জানি না, কিন্তু আমার স্ত্রী সুভাষিণী সব জানেন।”
    বাহিরে আসিয়া স্বামী মহাশয় রমণ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি ডাকিনী যোগিনী বিদ্যাধরী প্রভৃতি বিশ্বাস করেন?”
    রমণ বাবু রহস্যখানা কতক বুঝিয়াছিলেন, বলিলেন, “করি। সুভাষিণী বলেন, কুমুদিনী শাপগ্রস্ত বিদ্যাধরী।”
    স্বামী বলিলেন, “কুমুদিনী কি ইন্দিরা, আপনার স্ত্রীকে ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিবেন।”
    রমণ বাবু আর দাঁড়াইলেন না। হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন।


বিংশ পরিচ্ছেদ : বিদ্যাধরীর অন্তর্দ্ধান

এইরূপ কথাবার্তা হইলে পর আমরা যথাকালে উভয়ে কলিকাতা হইতে যাত্রা করিলাম। তিনি আমাকে কালাদীঘি নামক সেই হতভাগ্য দীঘি পার করিয়া নিজালয়ের অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

সঙ্গের লোকজন আমাকে মহেশপুর লইয়া গেল। গ্রামের বাহিরে বাহক ও রক্ষকদিগকে অবস্থিতি করিতে বলিয়া দিয়া আমি পদব্রজে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। পিতার গৃহ সম্মুখে দেখিয়া, এক নির্জ্জন স্থানে বসিয়া অনেক রোদন করিলাম। তাহার পর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম। সম্মুখেই পিতাকে দেখিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়া আহ্লাদে বিবশ হইলেন। সেসকল কথা এস্থানে বলিবার অবসর নাই।

আমি এত দিন কোথায় ছিলাম, কি প্রকারে আসিলাম—তাহা কিছুই বলিলাম না। পিতামাতা জিজ্ঞাসা করিলে বলিলাম, “এর পরে বলিব।”

সময়ান্তরে স্থূল কথা তাঁহাদিগকে বলিলাম, কিন্তু সব কথা নহে। এতটুকু বুঝিতে দিলাম যে, পরিশেষে আমি স্বামীর নিকটেই ছিলাম এবং স্বামীর নিকট হইতেই আসিয়াছি। এবং তিনিও দুই একদিনের মধ্যে এখানে আসিবেন। সব কথা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া কামিনীকে বলিলাম। কামিনী আমার অপেক্ষা দুই বৎসরের ছোট। বড় রঙ্গ ভালবাসে। সে বলিল, “দিদি! যখন মিত্রজা এত বড় গোবরগণেশ, তাকে নিয়া একটু রঙ্গ করিলে হয় না?” আমি বলিলাম, “আমারও সেই ইচ্ছা।” তখন দুই বহিনে পরামর্শ আঁটিলাম। সকলকে শিখাইয়া ঠিক করিলাম। বাপ-মাকেও একটু শিখাইতে হইল। কামিনী তাঁহাদিগকে বুঝাইল যে, প্রকাশ্যে গ্রহণ করাটা এখনও হয় নাই। সেটা এইখানে হইবে। আমরাই তাহা করিয়া লইব। তবে আমি যে এখানে আসিয়াছি, এই কথাটা তাঁহারা, জামাতা আসিলে তাঁহার সাক্ষাতে প্রকাশ না করেন।

পরদিন, সে জামাতা আসিলেন। পিতামাতা তাঁহাকে যথেষ্ট আদর-অপেক্ষা করিলেন। আমি আসিয়াছি, এ কথা বাহিরে কাহারও মুখে তিনি শুনিলেন না। কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। যখন অন্তঃপুরে জলযোগ করিতে আসিলেন, তখন বড় বিষণ্ণবদন।

জলযোগের সময়, আমি সম্মুখে রহিলাম না। কামিনী বসিল, আর দুই চারি জন জ্ঞাতি ভগিনী ভাইজ বসিল। তখন সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ হইয়াছে। কামিনী অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল; তিনি যেন কলে উত্তর দিতে লাগিলেন। আমি আড়ালে দাঁড়াইয়া সব শুনিতে দেখিতে লাগিলাম। পরিশেষে তিনি কামিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার দিদি কোথায়?”

কামিনী খুব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “কি জানি কোথায়? কালাদীঘিতে সেই যে সর্বনাশটা হইয়া গেল, তার পর ত আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই।”

তাঁর মুখখানা বড় লম্বা হইয়া গেল। কথা আর কহিতে পারেন না। বুঝি কুমুদিনীকে হারাইলাম, এ কথা মনে করিয়া থাকিবেন; কেন না, তাঁর চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারা বহিতে লাগিল।

চক্ষের জল সামলাইয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমুদিনী বলিয়া, কোন স্ত্রীলোক আসিয়াছিল কি?”
কামিনী বলিল, “কুমুদিনী কি কে, তাহা বলিতে পারি না, একটা স্ত্রীলোক পরশু দিন পাল্কী করিয়া আসিয়াছিল বটে। সে বরাবর মহাভৈরবীর মন্দিরে গিয়া উঠিয়া দেবীকে প্রণাম করিল। অমনিই একটা আশ্চর্য ব্যাপার উপস্থিত হইল। হঠাৎ মেঘ অন্ধকার হইয়া ঝড়বৃষ্টি হইল। সেই স্ত্রীলোকটা সেইসময় ত্রিশূল হাতে করিয়া জ্বলিতে জ্বলিতে আকাশে উঠিয়া কোথায় চলিয়া গেল।”

প্রাণনাথ জলযোগ ত্যাগ করিলেন। হাত ধুইয়া মাথায় হাত দিয়া অনেক্ষণ বসিয়া রহিলেন; অনেকক্ষণ পরে বলিলেন, “যে স্থান হইতে কুমুদিনী অন্তর্ধান করিয়াছে, তাহা দেখিতে পাই না?”

কামিনী বলিল, “পাও বৈ কি? অন্ধকার হয়েছে—আলো নিয়ে আসি।”

এই বলিয়া কামিনী আমাকে ইঙ্গিত করিয়া গেল—“আগে তুই যা। তার পর আলো নিয়ে উপেন্দ্র বাবুকে লইয়া যাইব।” আমি আগে মন্দিরে গিয়া বারেণ্ডায় বসিয়া রহিলাম।

সেইখানে আলো ধরিয়া (খিড়কী দিয়া পথ আছে বলিয়াছি) কামিনী আমার স্বামীকে আমার কাছে লইয়া আসিল। তিনি আসিয়া আমার পদপ্রান্তে আছাড়িয়া পড়িলেন। ডাকিলেন, “কুমুদিনী, কুমুদিনী! যদি আসিয়াছ—ত আর আমায় ত্যাগ করিও না।”

তিনি বার দুই চারি এই কথা বলার পর, কামিনী চটিয়া উঠিয়া বলিল, “আয় দিদি! উঠে আয়! ও মিন্‌সে কুমুদিনী চেনে, তোকে চেনে না।”

    তিনি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি! দিদি কে?”
    কামিনী রাগ করিয়া বলিল, “আমার দিদি—ইন্দিরে। কখনও নাম শোন নি?”

এই বলিয়া দুষ্টা কামিনী আলোটা নিবাইয়া দিয়া আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল। আমরা খুব ছুটিয়া আসিলাম। তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হইলেই আমাদের পিছু পিছু ছুটিলেন। কিন্তু অন্ধকার—পথ অচেনা; একটা চৌকাট বাধিয়া একটা ছোট রকম আছাড় খাইলেন। আমরা নিকটেই ছিলাম, দুই জনে দুই দিক হইতে হাত ধরিয়া তুলিলাম। কামিনী চুপি চুপি বলিল, “আমরা বিদ্যাধরী—তোমার রক্ষার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতেছি।”

এই বলিয়া, তাঁকে টানিয়া আনিয়া আমার শয্যাগৃহে উপস্থিত করিলাম। সেখানে আলো ছিল। তিনি আমাদের দেখিয়া বলিলেন, “এ কি? এ ত কামিনী, আর এ ত কুমুদিনী।” কামিনী রাগে দশখানা হইয়া বলিল, “আ: পোড়া কপাল! এই বুদ্ধিতে টাকা রোজগার করেছ? কোদাল পাড় নাকি? এ কুমুদিনী না,
ইন্দিরেইন্দিরেইন্দিরে!!! তোমার পরিবার! আপনার পরিবার চিনিতে পার না?”

তখন স্বামী মহাশয় আহ্লাদে অজ্ঞান হইয়া আমাকে কোলে টানিয়া লইতে গিয়া কামিনীকেই কোলে টানিয়া লইলেন। সে তাঁর গালে চড় মারিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।

সেদিনের আহ্লাদের কথা বলিয়া উঠিতে পারি না। বাড়ীতে খুব উৎসাহ বাধিল। সেই রাত্রে কামিনীতে আর উ-বাবুতে প্রায় এক শত বার বাগ্উ‍যুদ্ধ হইল। সকলবারই প্রাণনাথ হারিলেন।