পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাজিয়ে যাব মল
আমি গঙ্গা কখনও দেখি
নাই। এখন গঙ্গা দেখিয়া, আহ্লাদে প্রাণ ভরিয়া গেল। আমার এত
দুঃখ, মুহূর্ত্তজন্য সব ভুলিলাম। গঙ্গার প্রশস্ত হৃদয়! তাহাতে
ছোট ছোট ঢেউ—ছোট ঢেউর উপর রৌদ্রের চিকিমিকি—যতদূর চক্ষু যায়,
ততদূর জল জ্বলিতে জ্বলিতে ছুটিয়াছে—তীরে কুঞ্জের মত সাজান
বৃক্ষের অনন্ত শ্রেণী; জলে কত রকমের কত নৌকা; জলের উপর দাঁড়ের
শব্দ, দাঁড়ি-মাঝির শব্দ, জলের উপর কোলাহল, তীরে ঘাটে ঘাটে
কোলাহল; কত রকমের লোক, কত রকমে স্নান করিতেছে। আবার কোথাও সাদা
মেঘের মত অসীম সৈকত ভূমি—তাতে কত প্রকারের পক্ষী কত শব্দ
করিতেছে। গঙ্গা যথার্থ পুণ্যময়ী। অতৃপ্ত নয়নে কয় দিন দেখিতে
দেখিতে আসিলাম।
যে দিন কলিকাতায় পৌঁছিব, তাহার পূর্ব্বদিন, সন্ধ্যার কিছু
পূর্ব্বে জোয়ার আসিল। নৌকা আর গেল না। একখানা ভদ্র গ্রামের
একটা বাঁধা ঘাটের নিকট আমাদের নৌকা লাগাইয়া রাখিল। কত সুন্দর
জিনিস দেখিলাম; জেলেরা মোচার খোলার মত ডিঙ্গীতে মাছ ধরিতেছে,
দেখিলাম। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘাটের রাণায় বসিয়া শাস্ত্রীয় বিচার
করিতেছেন, দেখিলাম। কত সুন্দরী, বেশভূষা করিয়া জল লইতে আসিল।
কেহ জল ফেলে কেহ কলসী পুরে, কেহ আবার ঢালে, আবার পুরে, আর
হাসে, গল্প করে, আবার ফেলে, আবার কলসী ভরে। দেখিয়া আমার
প্রাচীন গীতটি মনে পড়িল,
একা কাঁকে কুম্ভ করি,
কলসীতে জল ভরি,
জলের ভিতরে শ্যামরায়!
কলসীতে দিতে ঢেউ,
আর না দেখিলাম কেউ,
পুন কানু জলেতে লুকায়।
সেইদিন সেইখানে দুইটি মেয়ে দেখিয়াছিলাম, তাহাদের কখন ভুলিব না।
মেয়ে দুইটির বয়স সাত আট বৎসর। দেখিতে বেশ, তবে পরম সুন্দরীও
নয়। কিন্তু সাজিয়াছিল ভাল। কাণে দুল, হাতে আর গলায় একখানা
গহনা। ফুল দিয়া খোঁপা বেড়িয়াছে। রঙ্গ করা, শিউলীফুলে ছোবান,
দুইখানি কালাপেড়ে কাপড় পরিয়াছে। পায়ে চারিগাছি করিয়া মল আছে।
কাঁকালে ছোট ছোট দুইটি কলসী আছে। তাহারা ঘাটের রাণায় নামিবার
সময়ে জোয়ারের জলের একটা গান গায়িতে গায়িতে নামিল। গানটি মনে
আছে, মিষ্ট লাগিয়াছিল, তাই এখানে লিখিলাম। একজন এক এক পদ গায়,
আর একজন দ্বিতীয় পদ গায়। তাহাদের নাম শুনিলাম, অমলা আর
নির্ম্মলা।
প্রথমে গায়িল,—
অমলা
ধানের ক্ষেতে,
ঢেউ উঠেছে,
বাঁশ তলাতে জল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
নির্ম্মলা
ঘাটটি জুড়ে,
গাছটি বেড়ে
ফুটল ফুলের দল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
অমলা
বিনোদ বেশে
মুচ্কে হেসে,
খুলব হাসির কল।
কলসী ধ'রে,
গরব ক'রে
বাজিয়ে যাব মল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
নির্ম্মলা
গহনা গায়ে,
আল্তা পায়ে,
কল্কাদার আঁচল।
ঢিমে চালে,
তালে তালে
বাজিয়ে যাব মল।
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
অমলা
যত ছেলে,
খেলা ফেলে,
ফিরচে দলে দল।
কত বুড়ী,
জুজুবুড়ী
ধরবে কত জল,
আমরা মুচকে হেসে,
বিনোদ বেশে
বাজিয়ে যাব মল।
আমরা বাজিয়ে যাব মল,
সই বাজিয়ে যাব
মল॥
দুই জনে
আয় আয় সই,
জল আনিগে,
জল আনিগে চল॥
বালিকাসিঞ্চিতরসে, এ জীবন কিছু শীতল হইল। আমি মনোযোগপূর্ব্বক
এই গান শুনিতেছি, দেখিয়া বসুজ মহাশয়ের সহধর্ম্মিণী
আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "ও ছাই গান
আবার হাঁ করিয়া শুনচ কেন?" আমি
বলিলাম "ক্ষতি কি?"
বসুজপত্নী। ছুঁড়ীদের মরণ আর কি? মল বাজানর আবার গান!
আমি। ষোল বছরের মেয়ের মুখে ভাল শুনাইত না বটে, সাত বছরের মেয়ের
মুখে বেশ শুনায়। জোয়ান মিন্সের
হাতের চড়-চাপড় জিনিস ভাল নহে বটে,
কিন্তু তিন বছরের ছেলের হাতের চড়-চাপড়
বড় মিষ্ট।
বসুজপত্নী আর কিছু না বলিয়া ভারি হইয়া বসিয়া রহিলেন। আমি
ভাবিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এ প্রভেদ কেন হয়? এক জিনিস দুই রকম
লাগে কেন? যে দান দরিদ্রকে দিলে পুণ্য হয়, তাহা বড়মানুষকে দিলে
খোষামোদ বলিয়া গণ্য হয় কেন? যে সত্য ধর্ম্মের প্রধান,
অবস্থাবিশেষ তাহা আত্মশ্লাঘা বা পরনিন্দা পাপ হয় কেন? যে ক্ষমা
পরমধর্ম্ম, দুষ্কৃতকারীর প্রতি প্রযুক্ত হইলে, তাহা মহাপাপ
কেন? সত্য সত্যই কেহ স্ত্রীকে বনে দিয়া আসিলে লোকে তাহাকে
মহাপাপী বলে; কিন্তু রামচন্দ্র সীতাকে বনে দিয়াছিলেন, তাঁহাকে
কেহ মহাপাপী বলে না কেন?
ঠিক করিলাম, অবস্থাভেদে এ সকল হয়। কথাটা আমার মনে রহিল। আমি
হইার পর একদিন যে নির্লজ্জ কাজের কথা বলিব, তাহা এই কথা মনে
করিয়া করিয়াছিলাম। তাই এ গানটা এখানে লিখিলাম।
নৌকাপথে কলিকাতা আসিতে দূর হইতে কলিকাতা দেখিয়া, বিস্মিত ও ভীত
হইলাম। অট্টালিকার পর অট্টালিকা, বাড়ীর গায়ে বাড়ী, বাড়ীর পিঠে
বাড়ী, তার পিঠে বাড়ী, অট্টালিকার সমুদ্র—তাহার অন্ত নাই,
সংখ্যা নাই, সীমা নাই। জাহাজের মাস্তুলের অরণ্য দেখিয়া জ্ঞান
বুদ্ধি বিপর্যস্ত হইয়া গেল। নৌকার অসংখ্য, অনন্ত শ্রেণী দেখিয়া
মনে হইল, এত নৌকা মানুষে গড়িল কি প্রকারে? [* কলিকাতায় এক্ষণে
নৌকার সংখ্যা পূর্ব্বাকার শতাংশও নাই।] নিকটে আসিয়া
দেখিলাম, তীরবর্ত্তী রাজপথে গাড়ি পাল্কী পিঁপড়ের সারির মত
চলিয়াছে—যাহারা হাঁটিয়া যাইতেছে, তাহাদের সংখ্যার ত কথাই নাই।
তখন মনে হইল, ইহার ভিতর খুড়াকে খুঁজিয়া বাহির করিব কি প্রকারে?
নদীসৈকতের বালুকারাশির ভিতর হইতে, চেনা বালুকাকণাটি খুঁজিয়া
বাহির করিব কি প্রকারে?
কৃষ্ণদাস বাবু কলিকাতায়
কালীঘাটে পূজা দিতে আসিয়াছিলেন। ভবানীপুরে বাসা করিলেন। আমাকে
জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোমার খুড়ার বাড়ী কোথায়? কলিকাতায় না
ভবানীপুরে?"
তাহা আমি জানিতাম না।
জিজ্ঞাসা করিলেন, "কলিকাতায় কোন্ জায়গায় তাঁহার বাসা?"
তাহা আমি কিছুই জানিতাম না—আমি জানিতাম, যেমন মহেশপুর একখানি
গণ্ডগ্রাম, কলিকাতা তেমনই একখানি গণ্ডগ্রাম মাত্র। একজন
ভদ্রলোকের নাম করিলেই লোকে বলিয়া দিবে। এখন দেখিলাম যে,
কলিকাতা অনন্ত অট্টালিকার সমুদ্রবিশেষ। আমার জ্ঞাতি খুড়াকে
সন্ধান করিবার কোন উপায় দেখিলাম না। কৃষ্ণদাস বাবু আমার হইয়া
অনেক সন্ধান করিলেন, কিন্তু কলিকাতায় একজন সামান্য গ্রাম্য
লোকের ওরূপ সন্ধান করিলে কি হইবে?
কৃষ্ণদাস বাবু কালীর পূজা দিয়া কাশী যাইবেন, কল্পনা ছিল। পূজা
দেওয়া হইল, এক্ষণে সপরিবারে কাশী যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
আমি কাঁদিতে লাগিলাম। তাঁহার পত্নী কহিলেন, "তুমি আমার কথা
শুন। এখন কাহারও বাড়ীতে দাসীপনা কর। আজ সুবী আসিবার কথা আছে,
তাকে বলিয়া দিব, বাড়ীতে তোমায় চাকরাণী রাখিবে।"
আমি শুনিয়া আছড়াইয়া পড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলাম।
―"শেষে
কি কপালে দাসীপনা ছিল!" আমার ঠোঁট কাটিয়া রক্ত পড়িতেছিল।
কৃষ্ণদাস বাবুর দয়া হইল সন্দেহ নাই, কিন্তু তিনি বলিলেন, "আমি
কি করিব?" সে কথা সত্য—তিনি কি করিবেন? আমার কপাল!
আমি একটা ঘরের ভিতর গিয়া একটা কোণে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম।
সন্ধ্যার অল্প পূর্বে কৃষ্ণদাস বাবুর গিন্নী আমাকে ডাকিলেন।
আমি বাহির হইয়া তাঁহার কাছে গেলাম। তিনি বলিলেন, "এই সুবো
এয়েছে। তুমি যদি ওদের বাড়ী ঝি থাক, তবে বলিয়া দিই।"
ঝি থাকিব না, না খাইয়া মরিব, সে কথা ত স্থির করিয়াছি;—কিন্তু
এখনকার সে কথা নহে— এখন একবার সুবোকে দেখিয়া লইলাম। "সুবো"
শুনিয়া আমি ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম যে "সাহেব সুবো" দরের একটা কি
জিনিস—আমি তখন পাড়াগেঁয়ে মেয়ে। দেখিলাম, তা নয়—একটি
স্ত্রীলোক—দেখিবার মত সামগ্রী। অনেকদিন এমন ভাল সামগ্রী কিছু
দেখি নাই। মানুষটি আমারই বয়সী হইবে। রঙ্ আমা অপেক্ষা যে ফরসা
তাও নয়। বেশভূষা এমন কিছু নয়, কাণে গোটাকতক মাকড়ি, হাতে বালা,
গলায় চিক, একখানা কালাপেড়ে কাপড় পরা। তাতেই দেখিবার সামগ্রী।
এমন মুখ দেখি নাই। যেন পদ্মটি ফুটিয়া আছে—চারি দিক্ হইতে সাপের
মত কোঁকড়া চুলগুলা ফণা তুলিয়া পদ্মটা ঘেরিয়াছে। খুব বড় বড়
চোখ—কখন স্থির, কখন হাসিতেছে। ঠোঁট দুইখানি পাতলা রাঙ্গা
টুকটুকে ফুলের পাপড়ির মত উল্টান, মুখখানি ছোট, সবশুদ্ধ যেন
ফুটন্ত ফুল। গড়ন-পিটন কিরকম, তাহা ধরিতে পারিলাম না। আমগাছের
যে ডাল কচিয়া খায়, সে ডাল যেমন বাতাসে খেলে, সেই রকম তাহার
সর্বাঙ্গ খেলিতে লাগিল—যেমন নদীতে ঢেউ খেলে, তাহার শরীরে তেমনই
কি একটা খেলিতে লাগিল—আমি কিছু ধরিতে পারিলাম না, তার মুখে কি
একটা যেন মাখান ছিল, তাহাতে আমাকে যাদু করিয়া ফেলিল। পাঠককে
স্মরণ করিয়া দিতে হইবে না যে, আমি পুরুষ মানুষ নহি—মেয়ে
মানুষ—নিজেও একদিন একটু সৌন্দর্য্যগর্ব্বিতা ছিলাম। সুবোর
সঙ্গে একটি তিন বছরের ছেলে—সেটিও তেমনি একটি আধফুটন্ত ফুল।
উঠিতেছে, পড়িতেছে, বসিতেছে, খেলিতেছে, হেলিতেছে, দুলিতেছে,
দৌড়াইতেছে, হাসিতেছে, বকিতেছে, মারিতেছে, সকলকে আদর করিতেছে।
আমি অনিমেষলোচনে সুবোকে ও তার ছেলেকে দেখিতেছি দেখিয়া,
কৃষ্ণদাস বাবুর গৃহিণী চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, "কথার উত্তর দাও না
যে—ভাব কি?"
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "উনি কে?"
গৃহিণী ঠাকুরাণী ধমকাইয়া বলিলেন, "তাও কি বলিয়া দিতে হইবে? ও
সুবো, আর কে?"
তখন সুবো একটু হাসিয়া বলিল, "তা মাসীমা, একটু বলিয়া দিতে হয় বৈ
কি? উনি নূতন লোক, আমায় ত চেনেন না।" এই বলিয়া সুবো আমার
মুখপানে চাহিয়া বলিল, "আমার নাম সুভাষিণী গো—ইনি আমার মাসীমা,
আমাকে ছেলেবেলা থেকে ওঁরা সুবো বলেন।"
তার পর কথার সূত্রটা গৃহিণী নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন। বলিলেন,
"কলিকাতার রামরাম দত্তের ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। তারা বড়
মানুষ। ছেলেবেলা থেকে ও শ্বশুরবাড়ীই থাকে— আমরা কখন দেখিতে পাই
না। আমি কালীঘাটে এসেছি শুনে আমাকে একবার দেখা দিতে এসেছে। ওরা
বড়মানুষ। বড়মানুষের বাড়ী তুমি কাজকর্ম্ম করিতে পারিবে ত?"
আমি হরমোহন দত্তের মেয়ে, টাকার গদিতে শুইতে চাহিয়াছিলাম— আমি
বড়মানুষের বাড়ী কাজ করিতে পারিব ত? আমার চোখে জলও আসিল; মুখে
হাসিও হাসিল।
তাহা আর কেহ দেখিল না—সুভাষিণী দেখিল। গৃহিণীকে বলিল, "আমি
একটু আড়ালে সে সকল কথা ওঁকে বলি গে। যদি উনি রাজি হন, তবে
সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।" এই বলিয়া সুভাষিণী আমার হাত ধরিয়া
টানিয়া একটা ঘরের ভিতর লইয়া গেল। সেখানে কেহ ছিল না। কেবল
ছেলেটি মার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া গেল। একখানা তক্তপোষ পাতা ছিল।
সুভাষিণী তাহাতে বসিল—আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া বসাইল। বলিল,
"আমার নাম না জিজ্ঞাসা করিতে বলিয়াছি। তোমার নাম কি ভাই?"
"ভাই!" যদি দাসীপনা করিতে পারি, তবে ইহার কাছে পারি, মনে মনে
ইহা ভাবিয়াই উত্তর করিলাম, "আমার দুইটি নাম—একটি চলিত, একটি
অপ্রচলিত। যেটি অপ্রচলিত, তাহাই ইঁহাদিগকে বলিয়াছি; কাজেই
আপনার কাছে তখন তাহাই বলিব। আমার নাম কুমুদিনী।"
ছেলে বলিল, "কুনুডিনী।"
সুভাষিণী বলিল, "আর নাম এখন নাই শুনিলাম, জাতি কায়স্থ বটে?"
হাসিয়া বলিলাম, "আমরা কায়স্থ।"
সুভাষিণী বলিল, "কার মেয়ে, কার বউ, কোথায় বাড়ী, তাহা এখন
জিজ্ঞাসা করিব না। এখন যাহা বলিব, তাহা শুন। তুমি বড়মানুষের
মেয়ে, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি—তোমার হাতে গলায়, গহনার কালি
আজিও রহিয়াছে। তোমাকে দাসীপনা করিতে বলিব না—তুমি কিছু কিছু
রাঁধিতে জান না কি?"
আমি বলিলাম, "জানি। রান্নায় আমি পিত্রালয়ে যশস্বিনী ছিলাম।"
সুভাষিণী বলিল, "আমাদের বাড়ীতে আমরা সকলেই রাঁধি। (মাঝখান থেকে
ছেলে বলিল, "মা, আমি দাঁদি") তবু, কলিকাতার রেওয়াজমত একটা
পাচিকাও আছে। সে মাগীটা বাড়ী যাইবে। (ছেলে বলিল, "ত মা বালী
দাই") এখন মাকে বলিয়া তোমাকে তার জায়গায় রাখাইয়া দিব। তোমাকে
রাঁধুনীর মত রাঁধিতে হইবে না। আমরা সকলেই রাঁধিব, তারই সঙ্গে
তুমি দুই এক দিন রাঁধিবে। কেমন রাজি?"
ছেলে বলিল, "আজি? ও আজি?"
মা বলিল, "তুই পাজি।"
ছেলে বলিল, "আমি বাবু, বাবা পাজি।"
"অমন কথা বলতে নেই বাবা!" এই কথা ছেলেকে বলিয়া আমার মুখপানে
চাহিয়া হাসিয়া সুভাষিণী বলিল, "নিত্যই বলে।" আমি বলিলাম,
"আপনার কাছে আমি দাসীপনা করিতেও রাজি।"
"আপনি কেন বল ভাই? বল ত মাকে বলিও। সেই মাকে লইয়া একটু গোল
আছে। তিনি একটু খিট্খিটে—তাঁকে বশ করিয়া লইতে হইবে। তা তুমি
পারিবে—আমি মানুষ চিনি। কেমন রাজি?"
আমি বলিলাম, "রাজি না হইয়া কি করি? আমার আর উপায় নাই।" আমার
চক্ষুতে আবার জল আসিল।
সে বলিল, "উপায় নাই কেন? রও ভাই, আমি আসল কথা ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি আসিতেছি।"
সুভাষিণী ভোঁ করিয়া ছুটিয়া মাসীর কাছে গেল—বলিল, "হাঁ গা, ইনি
তোমাদের কে গা?"
ঐটুকু পর্যন্ত শুনিতে পাইলাম। তাঁর মাসী কি বলিলেন, তাহা
শুনিতে পাইলাম না। বোধ হয়, তিনি যতটুকু জানিতেন, তাহাই বলিলেন।
বলা বাহুল্য, তিনি কিছুই জানিতেন না; পুরোহিতের কাছে যতটুকু
শুনিয়াছিলেন, ততটুকু পযর্ন্ত। ছেলেটি এবার মার সঙ্গে যায়
নাই—আমার হাত লইয়া খেলা করিতেছিল। আমি তাহার সঙ্গে কথা
কহিতেছিলাম। সুভাষিণী ফিরিয়া আসিল।
ছেলে বলিল, "মা, আঙ্গা হাত দেখ্।"
সুভাষিণী হাসিয়া বলিল, "আমি তা অনেক্ষণ দেখিয়াছি।" আমাকে বলিল,
"চল গাড়ি তৈয়ার। না যাও, আমি ধরিয়া লইয়া যাইব। কিন্তু যে কথাটা
বলিয়াছি—মাকে বশ করিতে হইবে।"
সুভাষিণী আমাকে টানিয়া লইয়া গিয়া গাড়িতে তুলিল। পুরোহিত
মহাশয়ের দেওয়া রাঙ্গাপেড়ে কাপড় দুইখানির মধ্যে একখানি আমি
পরিয়াছিলাম—আর একখানি দড়িতে শুকাইতেছিল—তাহা লইয়া যাইতে সময়
দিল না। তাহার পরিবর্তে আমি সুভাষিণীর পুত্রকে কোলে লইয়া
মুখচুম্বন করিতে করিতে চলিলাম।