ব্রতচারী
প্রবেশ
গুরুসদয় দত্ত
ব্রতচারী, বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সংস্করণের সম্পাদনা
ওয়াহিদুল হক
প্রথম প্রকাশ
ডিসেম্বর ২০০৪
দ্বিতীয় সংস্করণ
ফেব্রুয়ারি ২০০৯
প্রকাশক
ব্রতচারী
আদিত্য, ফ্ল্যাট # ডি৭ বাড়ি # ৮/এ/১২/ক
সড়ক ৩০ (পুরাতন) ১৪ (নতুন)
ফোন : ৯১২১৮৯৬
স্বত্ব
ব্রতচারী
প্রচ্ছদ: রায়বেঁশে নৃত্য
শিল্পী কামরুল হাসান
কম্পিউটার কম্পোজ ও মুদ্রণ
মূল্য
৫০ (পঞ্চাশ) টাকা মাত্র।
ভূমিকা
উনিশ শ' ত্রিশের দশক। ব্রিটিশ শাসন। তখন থেকে বছর ত্রিশেক আগে বাংলা বিভক্ত হলেও,
তখন যুক্ত। রবীন্দ্রনাথ জীবিত। দেশে লাগল এক প্রবল ঢেউ। নাম তার ব্রতচারী আন্দোলন।
সিলেট জেলার কুশিয়ারা নদী-পারের বীরশ্রী গ্রামের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ গুরুসদয় দত্ত
১৯৩৪-এ বাংলার ব্রতচারী সমিতি অনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করলেও, কাজ তাঁর চলছিল
দেশময় অনেক আগে থেকেই। গ্রামের পাঠশালা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্রতচারী চর্চা আরম্ভ
হয়ে গেছে। গুরু-ট্রেনিং পাশ শিক্ষকেরা ব্রতচারীতেও প্রশিক্ষণ নিতেন এবং নিজেদের
কর্মক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলিতে ব্রতচারীর গীত, নৃত্য এবং আদর্শ প্রচার করতেন,
সত্যিকারের ব্রত পালনকারীর মতো। কিন্তু ৪০-এর দশকের গোড়ায় সারা ভারতবর্ষ, বিশেষ করে
বঙ্গদেশ ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক আবর্তে পড়ে যায়। পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ করে মুসলিম লীগ।
সাম্প্রদায়িকতা দাউ দাউ করে ছড়াতে থাকে। ৪১-এ রবীন্দ্রনাথও চলে যান তাঁর সোনার
বাংলাকে ছেড়ে। বাংলা ও বাঙালির ভাবনা ভাববার কেউ রইলো না। অর্ধেক বাঙালি পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ। অপরার্ধ বাঙালি আত্মত্যাগের অগ্নিযুগ শেষে
তার সার্থক ফললাভ স্বাধীন ভারতের উত্থান নিয়ে মানসিকভাবে ব্যাপৃত। ৪৭-এর ভারত ভাগে,
পাঞ্জাব ও বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হলো। এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে, - মানুষের তখন
কী অবস্থা! শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চা পড়লো চাপা। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অনুভব করেছিলেন
শিশু এবং যুব শক্তির শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন, শান্তিনিকেতনের বৈপ্লবিক
প্রচেষ্টা ছাড়াও, অতিরিক্ত কিছু। তাঁর ভক্ত, অসাধারণ জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক জগদানন্দ
রায়কে বলে তাঁর সুঠামদেহী, সচ্চরিত্র ভ্রাতুষ্পুত্র ধীরানন্দকে দিয়ে 'ব্রতী বালক'
নামে এক খোলা মাঠে খেলার দল গড়ে তোলেন। রবীন্দ্র-প্রয়াণে সে প্রচেষ্টার অপমৃত্যু হয়
এবং ৪৭-এর দেশভাগের প্রচ- ডামাডোলে ব্রতচারীও তার বিকাশ পায় না।
স্বাধীনতার প্রাথমিক উত্তেজনা কাটলে দুই স্বাধীন দেশেই অগ্রসর মানুষের সময় হয়
ব্রতচারীর দিকে ফিরে তাকাবার। সময়ের সঙ্গে ভুলে ধারণাগুলি অপসৃত হলে ব্রতচারীর মানব
ঐক্য-ভিত্তিক চরম অসাম্প্রদায়িক, শিশু ও যুব শক্তির দেহমন বিকাশের ব্যাপারটি সবার
চোখে পড়ে। শ্রম ও আনন্দের ভিতর দিয়ে ব্রতচারীর যাবতীয় নৃত্য ও কৃত্য সবটা গড়ে ওঠা।
জ্ঞান সত্য শ্রম আনন্দ ঐক্যের এই অসাধারণ যোটকটির সকল প্রেরণার আধার হচ্ছে বাঙালির
স্বদেশ। ফলে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে দেশপ্রেমের অতুল প্রকাশ
মুক্তিযুদ্ধ লড়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশে পরিণত করে, তখন ব্রতচারী তার পূর্ণতায়
বিকাশ পাবার ক্ষেত্রটি পায়। পটুয়া কামরুল হাসান, বাংলাদেশের কালজয়ী চিত্রশিল্পী,
ছিলেন গুরুসদয় দত্তের ঘনিষ্ঠ সাক্ষাৎ শিষ্য। তিনি ৪৮-এ ব্রতচারীর গীত-নৃত্যাদি
শেখাতে থাকেন তাঁর মুকুল ফৌজ সংগঠনে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি ব্রতচারী আন্দোলনকে
সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার কাজে হাত দেন। কিন্তু এত দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দৃঢ়-সংবদ্ধ
হবার আগেই রাষ্ট্রিক উপপ্লবের কবলে পড়ে দেশ। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করে
চরম নৈরাজ্য। মুকুল ফৌজ, কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর প্রতিষ্ঠানত্রয় শিশু-বিকাশের
ক্ষেত্রে ভালো কাজ করলেও কোন একটি অন্তর-সাযুয্যপূর্ণ দেহমন-জড়ানো, সত্য-সুন্দরের
আদর্শ সংবলিত, দেশীয় ঐতিহ্যধারক গীত-নৃত্যের, বিমল ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আবয়বিক
পূর্ণতাসম্পন্ন টেঙ্টের অভাবে তাদের কাজ এগুতে পারে না কাঙ্ক্ষিত লক্ষে অথচ
'ব্রতচারী'তে বাঙালির অতীব প্রয়োজনীয় ঠিক সেই জিনিষটির সন্ধান পাওয়া যায়,
পূর্ণাবয়বে, প্রথম থেকে।
ব্রতচারী কোন বই নয় যে, পড়লেই তা হওয়া যাবে, হয়ে যাবে। তন্ দুরুস্তেন দুরুস্ত, মন
দুরুস্তেন্ দুরুস্ত-এই সূত্রে বিশ্বাসী ব্রতচারীর প্রায় সবটারই চর্চা খোলা মাঠে,
অনেককে নিয়ে। এবং সুস্থ সবল জীবন সংগঠনে ব্যক্তির একার সতত সঙ্গী ও ব্রতচারী
আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্তের কর্মজীবনের পরিচয় ব্রতচারী লক্ষের উপর আলোকপাত
করে। শ্রীহট্ট জেলার এই দেশপ্রেমিক কর্মবীর দেশে লভ্য উচ্চতম শিক্ষা অল্প বয়সে
কৃতিত্বের সঙ্গে আয়ত্ত করে, বৃটিশ ভারতে সর্বাপেক্ষা গৌরবের পরীক্ষা, আইসিএস দিতে
ইংল্যান্ডে যান। তাতেও অসামান্য ফল পান, অশ্বচালনায় সকল পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম
হন। ত্রিশ বছর বয়সে বিহারের আরা জেলায় মহকুমা শাসকের নিয়োগ পেয়ে তাঁর সরকারী চাকুরি
জীবনের আরম্ভ। বৃটিশ উপরআলাদের সঙ্গে অনেক প্রশ্নে তিনি দ্বিমত করেন। এবং বিচারক
থাকা কালে তাঁর অনেক রায় ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে গেলে তাঁর কর্মজীবন,
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরই মত, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারই মধ্যে তাঁর পত্মীর মৃত্যু
হলে, 'সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি'র পত্তন করে তিনি আমৃত্যু সমাজ সেবার আদর্শ গ্রহণ
করেন। তাঁর দৃষ্টি যেতে থাকে পল্লী বাংলার সর্বত্র অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা কারুশিল্প,
হারিয়ে যেতে থাকা গীত-নৃত্যের প্রতি। ১৯২৯-এ তাঁর এই প্রাণের কাজের স্বীকৃতি-স্বরূপ
রোমে আন্তর্জাতিক কৃষি সম্মেলনে ও কেমব্রিজে বিশ্ব বয়স্ক শিক্ষা সম্মেলনে আহূত হয়ে
ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন।
তিনি সেই বছরই
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হলে তাঁর দেশপ্রাণতা বিপুল বেগ পায়। তিনি
পল্লী-সংস্কার ও বাংলার সাংস্কৃতিক উজ্জীবন কর্মে আত্মনিয়োগ করেন সেখানে। ব্রতচারীর
গীত ভাণ্ডারের এক বিরাট অংশ ময়মনসিংহে সংগৃহীত। বীরভুমে বদলি হয়ে সেখানে তিনি
বাঙালির বীরত্বপূর্ণ হারিয়ে যাওয়া লোকনৃত্য 'রায়বেঁশে' -কে পুনরাবিষ্কার করেন।
একত্রিশ সালে তিনি 'পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি' পত্তন করেন। এই সমিতির পরিচালনায়
প্রথম লোকনৃত্য শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হয়। পরের বছর চৌত্রিশ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়
বাংলার ব্রতচারী সমিতি। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে তিনি ১৯৪০-এ 'ব্রতচারী গ্রাম'
প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা মহানগরের উপকণ্ঠে।
বাংলার নৃত্য, বাংলার সাহিত্য, বাংলার লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, ছড়া, বাংলার লোকশিল্প,
বাংলার জাতীয় খেলা, বাংলার আল্পনা প্রভৃতি গণশিল্প বাঙালির জাতীয় জীবনের উপরে কী
প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেই দিকে লক্ষ রেখে তিনি জ্ঞান সত্য শ্রম ঐক্য ও
আনন্দ এই পঞ্চব্রতের সাধনপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। যদিও এই পরিচেষ্টার প্রাথমিক কথা
হলো দেশের সংস্কৃতি ধারার সাধনা ও সমাজসেবা, জনসেবা, কিন্তু তলিয়ে দেখলে পাই
ব্রতচারীর মর্মমূলে রয়েছে, মানুষের প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবার ব্যবস্থা ও
প্রক্রিয়া-পদ্ধতি। আজকের দিনে যাকে আমরা বলি মানব-উন্নয়ন। এই লোকব্রতের, দেশব্রতের
তুলনাহীন সাধক ১৯৪১-এর ২৫-এ জুন দেহত্যাগ করেন।
ব্রতচারী গ্রাম, চব্বিশ পরগণা থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত দুইটি পুস্তিকা 'ব্রতচারী
সখা' ও 'ব্রতচারী পরিচয়', প্রতি ব্রতচারীর জন্য অপরিহার্য নিত্যদিনের সঙ্গী।
উপস্থিত 'ব্রতচারী প্রবেশ' পুস্তিকা একেবারেই ম্যানুয়াল ধরণের। বাংলাদেশের ব্রতচারী
শিক্ষা শিবির পরিচালনকালে এই মত একটি দেশে ছাপা সুলভ 'কেজো' বইয়ের প্রয়োজন অনুভূত
হয়। 'ব্রতচারী সখা'রই টেঙ্ট অনুসরণে সুযোগ নেওয়া হয়েছে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ও
সংশোধনের। যত্ন নেওয়া হয়েছে যাতে কোনক্রমেই গুরুসদয় দত্ত-কৃত মূলের উদ্দেশ্য ও
ভাব-ব্যঞ্জনা ক্ষুণ্ন না হয়। 'সতের মানাতে' যেমন আছে 'কোঁচা ঝুলাইয়া চলিব না' এবং
নারী ব্রতচারীদের বেলায় 'কোমল হলেও গলিব না' সে-স্থলে 'ব্রতচারী প্রবেশ'-এ ঢুকেছে
'বিলাসী চালেতে চলিব না'। 'ষোল পণ'-এ ঢুকেছে 'শ্রমের সম্মান বিবর্ধন' ও 'পারিপাট্য
সংরচন' নিতান্তই ছন্দ-শিথিলতা সারাবার জন্য। আধুনিকতার দাবীতে 'বাঙ্গালী'-কে কোথাও
কোথাও হতে হয়েছে 'বাঙালি'। 'লেখাপড়া গানে' 'সকল দুঃখ দৈন্য দূর করে সে চড়ে
গাড়ি-ঘোড়া' অংশে গাড়ি-ঘোড়া চড়াকে বাদ দিয়ে এসেছে 'শিখে লেখাপড়া'। 'আমরা মানুষ দল'
গানে 'আনন্দ-উৎফল' এই কথাকে ত্যাগ করে জায়গা করা হয়েছে 'আনন্দ-চঞ্চল'-এর জন্যে। সব
এই ধরণের পরিবর্তন।
পশ্চিমবঙ্গে ব্রতচারী আবার 'বিদ্যালয় শিক্ষা'র অপরিহার্য অঙ্গ হয়েছে। কিন্তু
প্রয়োজন ছিলো ব্রতচারীর ভিত্তিতে বাঙালির ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠার। তা হয়নি।
যেন এটা ফিজিকাল এডুকেশন তথা শরীরচর্চা শিক্ষার অঙ্গ হয়েই থাকল সেখানে। আমরা মনে
করি ব্রতচারী আন্দোলনের সার্থকতা জাতির সকল শিশু-কিশোর-যুবক-এর জীবন-প্রবেশক
অবশ্য-শিক্ষণীয় হিসেবে। কেবলই তন্ দুরুস্তের ব্যাপার এটা নয়। মন দুরুস্ত করা
ব্রতচারী আন্দোলনের বড় কথা। সেই পঞ্চব্রত- জ্ঞান-ব্রত, শ্রম-ব্রত, সত্য-ব্রত,
ঐক্য-ব্রত, আনন্দ-ব্রত-এর সাধনা অবশ্যই চরিত্রের সাধনা। মনুষ্যত্বের সাধনা।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী, নব যুবক-যুবতীরা ব্রতচারীর সকল কৃত্যে, সংকল্পে,
গীতিনৃত্যে, যূথ-আনন্দে, সমাজের জন্য শুভকর ব্যক্তি-জীবনের উজ্জ্বল দিক-নির্দেশনা
খুঁজে পাবে। 'ব্রতচারী প্রবেশ' পুস্তিকা, আন্দোলনের ব্যাপ্তির সঙ্গে তাল রেখে
বৃহদাকার পাবে, এ আমাদের আশা।
ওয়াহিদুল হক
সম্পাদক, 'ব্রতচারী প্রবেশ'
ব্রতচারী, বাংলাদেশ : একবিংশ শতক
সন্জীদা খাতুন
২০০৩ সালের ২৪ জুলাই ১১০ লেক সার্কাসে 'নালন্দা' বিদ্যালয়ের ভাড়াবাড়ির দোতলায়
ব্রতচারীর ক্লাস শুরু হয়। বিষ্যুৎবার বিকেলে কামরুল হাসানের এক শিষ্য মোঃ
রোকনউদ্দীন এসে ক্লাস নিতেন। 'নালন্দা' বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী-শিক্ষার্থী ছাড়া
'উদীচী'-র কয়েকজন আর বাইরের আরো কয়েকজন এসে ক্লাসে যোগ দিতেন। 'চল্ কোদাল
চালাই'-এর পাঠ দিয়ে হল শুভারম্ভ। এই নৃত্যের পূর্ববর্তী আবৃত্তি অংশ সকলকে
দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
'লাগো কাজে কোমর বেঁধে খুলে দেখ জ্ঞানের চোখ
কোদাল হাতে খাটে যারা তারাই আসল ভদ্রলোক'।
২০০৩-এর শেষ দিকে 'কেন্দ্রীয় ব্রতচারী নৃত্যোৎসব পরিষদ' গঠন করে বড় মাপের প্রশিক্ষণ
শিবির করবার চেষ্টা শুরু হল। ভারতের 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' থেকে ব্রতচারী সখা
ছাড়া আরো কিছু বই এসে গেল। ঐ সমিতির সভাপতি কমলেশ চ্যাটার্জি 'বেঙ্গল অলিম্পিক
অ্যাসোসিয়েশন'-এর কাজে ঢাকায় এসেছিলেন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে গেলেন।
ব্রতচারীতে উৎসাহী 'নালন্দা'র সভাপতি সন্জীদা খাতুন তখন নৃত্যোৎসব পরিষদেরও
সভাপতি। কলকাতা থেকে প্রশিক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কমলেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা হয়ে গেল।
২০০৪ সালের ২৩ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের 'সরকারি শিশু পরিবার' আবাসিক
বিদ্যালয়ের বালক শাখায় প্রথম প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন হল। কলকাতার উলিস্নখিত
সংগঠনের প্রধান প্রশিক্ষক অহীন্দ্রভূষণ সাহার সঙ্গে এলেন তপন পাল আর ইলা
ব্যানার্জি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে দিনাজপুর, রংপুর, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা,
নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর থেকে শ'খানেক শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিল এই ক্যাম্পে।
সাতদিনের প্রশিক্ষণ শেষে বিশিষ্টজনদের বক্তৃতার পরে ব্রতচারী নৃত্যগীত পরিবেশন হল।
সবশেষে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞানপত্র তুল দেওয়া হল।
২০০৪ সালেই ঢাকার কেন্দ্রীয় প্রস্তুতি পরিষদ থেকে বাংলাদেশে 'ব্রতচারী' গঠন করা হয়।
ওই বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার সমিতি থেকে আটকজনকে কলকাতার উপান্তে 'জোকা' গ্রামের
প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হল। ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত 'জোকা'তে
তাঁর নিজের বিশাল ভূসম্পত্তিতে 'ব্রতচারী গ্রাম' তৈরি করবার ব্যবস্থা করে
গিয়েছিলেন। প্রতি বছর সে গ্রামে ব্রতচারীর প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। ভারতের বিভিন্ন
অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা চলে আসে। ব্রতচারী শিখবার আগ্রহের অন্যতম কারণ, ভারত সরকার
স্কুলে স্কুলে ব্রতচারী শিক্ষা দেবার নিয়ম করে দিয়েছেন। ফলে স্কুলে চাকরি পাবার
একটি ভালো উপায় ব্রতচারী শিক্ষার এই সার্টিফিকেট অর্জন।
২০০৪ সালে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা জোকা থেকে ভালো
প্রশিক্ষণ নিয়ে এল। সেই থেকে প্রতি বছর এদেশের শিক্ষার্থীরা ব্রতচারী গ্রামে গিয়ে
ট্রেনিং নিয়ে আসছে।
'ব্রতচারী'-এর দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল ২০০৫ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের
নালস্নাপাড়ায়। 'বেলায়েত হোসেন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়' মাঠে সেই স্কুলের উঁচু
ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, টাঙ্গাইল আর শেরপুর থেকে
গিয়ে বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্রতচারী হিসেবে শিক্ষা নিয়েছে নালস্নাপাড়ায়। গ্রামে
বিপুল সাড়া পড়ে গিয়েছে। সমাপনী অনুষ্ঠানে গ্রামের মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে সত্যিকারের
বাঙালি আর মানুষ হবার শপথমূলক ব্রতচারী নৃত্যগীত প্রত্যক্ষ করে। বেলায়েত হোসেন
বিদ্যালয়ে সেই থেকে ব্রতচারীর চর্চা অব্যাহত আছে। জোকা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা
একজনকে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বাংলাদেশে দু'বার আর জোকাতে
একবার, মোট তিনবারের প্রশিক্ষণের ফলে এদেশে প্রশিক্ষণ দেবার মতো বেশ কজন শিক্ষক
তৈরি হয়ে উঠেছে।
খুলনার বটিয়াঘাটা অঞ্চলের এক গ্রামের 'জলমা-চক্রাখালী হাই স্কুলে' আমাদের কেন্দ্রের
তৃতীয় প্রশিক্ষণ শিবির হল ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে। এ শিবিরে 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি'র
অহীন্দ্রভূষণ সাহার সঙ্গে এলেন ঢোলবাদ্যে পারঙ্গম আশোক রাউত। ক্যাম্পে জয়পুরহাট,
খুলনা, ঢাকা, শেরপুর, টাঙ্গাইল থেকে অনেকে এসে যোগ দিয়েছিল জলমা চক্রাখালীর উচুঁ
ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। সাতদিন ব্যাপী শিবিরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের সংগঠনের
একজনের অবাঞ্ছিত কার্যক্রমে শিবির ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। তবে জলমা-চক্রাখালী স্কুল
কর্তৃপক্ষ এবং কলকাতা থেকে আগত প্রশিক্ষকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় আর শ্রমে সমাপনী
অনুষ্ঠান পর্যন্ত সবকিছু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। পরবর্তী স্বাধীনতা দিবসে আঞ্চলিক
আন্তঃস্কুল অনুষ্ঠানে জলমা-চক্রাখালী হাইস্কুল প্রথম স্থান অধিকার করে পরপর দু'বার।
ফলে খুলনার স্থানীয় প্রশিক্ষকদের কাছে আশপাশের স্কুলগুলি ব্রতচারীর শিক্ষাগ্রহণে
প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করে। এভাবে খুলনা অঞ্চলের বহু স্কুলে ব্রতচারী চর্চা ছড়িয়ে
পড়েছে।
সিলেটে কুলাউড়ার লংলা চা বাগানের 'ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউণ্ডেশান স্কুলে' ২০০৬ সালের
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে আমাদের তৈরি করা দুজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে অহীন্দ্রভূষণ সাহা
আর অশোক রাউত স্কুলের শিক্ষক-ছাত্রদের ব্রতচারী শিখিয়ে এসেছিলেন। সেখানে ব্রতচারীর
চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্রতচারী নৃত্যগীত পরিবেশনা অত্যন্ত
প্রশংসিত হচ্ছে বলে তাঁরা আর একবার ওখানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবার অনুরোধ
জানিয়েছেন।
'ব্রতচারী'-র নিজস্ব একজন প্রশিক্ষক বিয়ানিবাজারে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছিলেন
২০০৬ সালে।
২০০৬ সালের শেষে গুরুসদয় দত্তের একশো পঁচিশ বছরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে 'বাংলার
ব্রতচারী সমিতি' এক বিশাল আয়োজন করে। তাতে যোগ দেবার জন্য বাংলাদেশে সাড়া পড়ে যায়।
ব্রতচারী সমিতি, বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় গুরুসদয় দত্তের জন্মস্থান বীরশ্রী গ্রামের
স্কুলে অনুষ্ঠান করে স্মারক মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে সিলেটের তরুণ দল ঢাকার অভিমুখে রওনা
হয়। ঢাকা, শেরপুর, নালস্নাপাড়া থেকে সমাগত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমবেত
কণ্ঠে ব্রতচারী গান গাওয়ার পর, নৈশ কোচে বেনাপোল সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু হয়।
সীমান্তে এসে যোগ দেয় জয়পুরহাটের শিক্ষার্থীরা, পরে খুলনার এক শিক্ষার্থী জোকাতে
গিয়ে যুক্ত হয়েছিল। সেবার বিশ জনের দল 'জোকা'র প্রশিক্ষণ এবং জন্মোৎসবে যোগ দেয়।
কথা ছিল সীমান্ত থেকে মশালটি হাতে তুলে নেবেন ওপারের ব্রতচারীরা। সীমান্তে পৌঁছে
দীপ হস্তান্তর পর্বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের চক্ষু চড়কগাছ। তাদের জন্যে ফুলে ফুলে
ভরা শুভেচ্ছা! আর পথের ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে অগণিত মানুষ।
চলার পথে কিছু পরে পরে তাদের থামিয়ে মঞ্চে বসিয়ে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে সংবর্ধনা!
ব্রতচারী বিষয়ে এত সচেতনতা আর বাংলাদেশের ব্রতচারীদের প্রতি এমন সহমর্মিতা চোখে না
দেখলে বোঝা কঠিন। বাংলাদেশ থেকে সঙ্গী হওয়া কয়েকজন পর্যবেক্ষক সে উচ্ছ্বাস আর
সমাদরের বর্ণনা করবার ভাষা খুঁজে পাননি। সেবার জানুয়ারি মাসে অর্থাৎ ২০০৭-এ সমাপনী
অনুষ্ঠানে পল্লীসুরের গান গাইবার জন্য বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শিল্পী
চন্দনা মজুমদার, তাঁর পিতা সুগায়ক নির্মলচন্দ্র মজুমদার আর বিমানচন্দ্র বিশ্বাস।
পুরুলিয়ার ছৌ নাচ ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী পল্লীসংস্কৃতির নানা ধারার প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়ে
পর্যবেক্ষণকারীরা আপস্নুত হয়েছিলেন। গুরুসদয় দত্ত বাংলার পল্লীর নৃত্যগীত বিষয়ে
তাঁর অনুসারীদের সার্থকভাবে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন বলেই ব্রতচারী গ্রামে তাঁর
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এমন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ আয়োজন সম্ভব হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরেও
ব্রতচারী গ্রামের ক্যাম্পে আমাদের কিছু শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিল।
গত বছর ২০০৮ সালে ৭ থেকে ১০ জুন ময়মনসিংহের 'মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে' আমাদের
চতুর্থ প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন হয়েছিল। গরমের সময় হলেও কক্ষাভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক
পাখার সুবিধা পাওয়াতে শ্রমসাধ্য প্রশিক্ষণ দুঃসাধ্য হয়ে ওঠেনি। বিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের সর্বাত্নক সহযোগিতা এবং সুশৃঙ্খল কর্মদক্ষতায় 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি'
থেকে আগত প্রশিক্ষকবৃন্দ (অহীন্দ্রভূষণ সাহা, আশোক রাউত, মমতা চ্যাটার্জি, ইলা
ব্যানার্জি) প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের
শেরপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নালস্নাপাড়ায় ব্রতচারী-প্রেমীদের ঐকান্তিক আগ্রহে
জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার শিক্ষার্থীরা এই ক্যাম্পে শিক্ষা
গ্রহণ করেছে।
আমাদের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আর 'জোকা'তে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে গড়ে-ওঠা
প্রশিক্ষকরা খুলনা, ঢাকা, শেরপুর, নালস্নাপাড়া প্রভৃতি স্কুলে ব্রতচারী নৃত্যগীত
শিক্ষা দিয়ে আসছে। আমাদের বিশ্বাস, দেশের কিশোর-যুবাদের শরীর ও মনের সুস্বাস্থ্য
এবং নীতিবোধের যাথার্থ্য নিশ্চিত করবার জন্য দেশের সর্বত্র ব্রতচারীর চর্চা ছড়িয়ে
দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্কুল কলেজে বয় স্কাউট আন্দোলন চালু করেছিলেন
ব্রিটিশরা। আমাদের সিলেটের বীরশ্রী গ্রামনিবাসী গুরুসদয় দত্ত বাঙালির উপযুক্ত
চরিত্র গঠনের জন্য যে একান্ত বাঙালি ধরনে ব্রতচারী চর্চার প্রবর্তন করে গেছেন, তার
সাহায্যেই বাঙালি জাতি উদ্ধার পাবে। দেশের সবরকমের বিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে
ব্রতচারীর পাঠ দিতে পারলে দেশের বহু সমস্যার নিরসন হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। গুরুসদয়
দত্ত জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য আর আনন্দের আদর্শে দেশবাসীকে প্রাণিত করতে চেয়েছিলেন।
অতীত ঐতিহ্যের অনুসরণে বাঙালিকে বীর জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার আহ্বান
জানিয়েছিলেন। দেশের আনাচে-কানাচে চর্চিত নানা শিল্পকর্ম সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিয়ে এর
গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালিকে। গুরুসদয় চেয়েছিলেন, দেশকে সম্পূর্ণ জেনে বাঙালি
হিসেবে আত্মমর্যাদাবোধে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশবাসী যথার্থ মানুষ হয়ে উঠুক। এই
প্রচেষ্টা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে, যুবসমাজকে আলস্য-বিমুখ সক্রিয় দেশসেবক করে
তুলবার জন্য 'ব্রতচারী' কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ বছর, ২০০৯ সালে আমাদের
কেন্দ্রীয় ব্রতচারী ক্যাম্প হতে চলেছে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ উপজেলার কলাতিয়ার ডিগ্রি
কলেজ, কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং স্থানীয় দেওয়ান বাড়ির আমবাগান এলাকায়। এলাকাবাসী
সকল মানুষের আগ্রহ-আনুকূল্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রশিক্ষণ শিবিরটিকে সফল করে তুলবে আশা
করি। এবারেও 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' প্রশিক্ষক পাঠাচ্ছেন। আশপাশের সব শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষক আর একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে ক্যাম্পে পাঠাবার অনুরোধ
জানানো হয়েছে। প্রতিবারের মতো, পঞ্চম শিক্ষা শিবির উপলক্ষেও একটি স্মরণিকা প্রকাশিত
হবে। এই পুস্তিকাগুলিতে ব্রতচারী বিষয়ে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় চিন্তাবিদদের লেখা
মুদ্রিত হয়ে থাকে।
কেন্দ্রীয় সমিতি শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য গুরুসদয় দত্তের রচনা থেকে সংকলন করে
'ব্রতচারী প্রবেশ' প্রকাশ করেছে। পঞ্চম প্রশিক্ষণ শিবির উপলক্ষে বইটির দ্বিতীয়
সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরী, কেরাণীগঞ্জ, শেরপুর, খুলনা, নালস্নাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ,
সিলেট, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায় 'ব্রতচারী'-এর
শাখা তৈরি হয়েছে। আমাদের চেষ্টায় গড়ে-ওঠা প্রশিক্ষকদের ভিতরে হারুন অর রশিদ, সাবিনা
ইয়াসমিন লিপি, মো: সোহরার হোসেন রবি, জাকারিয়া হাসান, নরোত্তম হালদার বিভিন্ন
স্কুলে ব্রতচারী নৃত্যগীতের শিক্ষা দিচ্ছে।
'ব্রতচারীর ক্রমবৃদ্ধির কামনা' উদ্ধৃত করে 'ব্রতচারী'-র কার্যক্রমের বিবরণ শেষ করা
হল।
'যত দিন বাঁচব ততদিন বাড়ব
রোজ কিছু শিখব রোজ দোষ ছাড়ব
যাহা কিছু করব ভাল করে করব
কাজ যদি কাঁচা হয় শরমেতে মরব।'
সূচীপত্র
ভূমিপ্রেমের তিন উক্তি............................................. ১৩
বাংলাদেশের ব্রতচারীর ষোল পণ................................ ১৩
ষোল'র অতিরিক্ত পণ............................................. ১৩
বাংলার ব্রতচারীর সতেরো মানা.................................. ১৪
শিশু ব্রতচারীর বারো পণ.......................................... ১৪
ব্রতচারীর ক্রমবৃদ্ধির কামনা........................................ ১৫
চতুর্বর্গ................................................................ ১৫
সাধনা পর্যায়......................................................... ১৫
ব্রতচারীর পূর্ণ-বৃত্ত................................................... ১৫
পরহিতে শ্রম ব্রতচারীর দৈনিক অবশ্য-কৃত্য..................... ১৫
ব্রতচারীর বাক্-সংযম............................................... ১৫
ব্রতচারীর কণ্ঠ-সংযম................................................ ১৫
ব্রতচারীর মান-অপমান.............................................. ১৬
ব্রতচারীর বেকারত্ব বর্জন............................................ ১৬
ব্রতচারীর আত্মবিশ্বাস................................................ ১৬
ব্রতচারীর আদি নীতি................................................. ১৬
ব্রতচারীর অন্তঃশুদ্ধি................................................... ১৬
ব্রতচারীর পঞ্চ-ব্রত.................................................... ১৬
বাংলার ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা............................................ ১৭
পরিশেষে ব্রতচারী নেন বাংলার ব্রতচারীর সংকল্প................. ১৭
ব্রতচারীদের বাংলা-প্রেম.............................................. ১৭
বাংলার ধারা-বহন..................................................... ১৭
মন ও কাজ............................................................. ১৭
খাওয়া ও কাজ.......................................................... ১৭
উচ্ছিষ্ট নিয়ম............................................................. ১৮
সভার শিষ্টাচার........................................................... ১৮
সভার মৌনতা অভ্যাস................................................... ১৮
দাঁত মাজা................................................................. ১৮
হবে জয় নিশ্চয়........................................................... ১৮
ব্রতচারীর পঞ্চ বর্জন..................................................... ১৮
ব্রতচারীর কর্মাগ্রহ........................................................ ১৮
ব্রতচারীর কার্য............................................................ ১৮
ব্রতচারীর নির্লিপ্তি......................................................... ১৯
জ-সো-বা (জয় সোনার বাংলা)....................................... ১৯
বাংলাভূমির দান........................................................... ১৯
আমরা বাঙালি............................................................. ২০
বাংলাভূমির মাটি.......................................................... ২০
লেখাপড়া.................................................................. ২১
বাংলা প্রেম (ধামাইল).................................................... ২১
নারীর মুক্তি (কীর্তন)...................................................... ২২
সূর্যিমামা.....................................................................
২২
কোদাল চালাই............................................................... ২৩
আমরা মানুষ দল............................................................ ২৩
হ্যাঁ ও না......................................................................
২৪
চল্ হই...................................................................... ২৪
ব্রতচারী নাম..................................................................
২৫
চাস যদি...................................................................... ২৫
বীর-নৃত্য......................................................................
২৫
তরুণ দল...................................................................... ২৬
রাইবিশে...................................................................... ২৬
জীবনোলস্নাস......................................................................
২৭
বাংলার স্থান (ভাটিয়ালি)..................................................... ২৮
স্বাগত...........................................................................
২৮
সবার
প্রিয়....................................................................... ২৮
মিলন
স্মৃতি....................................................................... ২৯
চল্ চল্ (চলন গীত)............................................................
২৯
অগ্রে চল.......................................................................
৩০
ব্রতচারী.......................................................................
৩০
তরুণতা....................................................................... ৩১
হয়ে দেখ.......................................................................
৩১
পূর্ণ স্ব-স্থ ও পূর্ণ
স্বরাট........................................................ ৩২
মানুষ হ'.......................................................................
৩২
চাষা....................................................................... ৩২
বাংলার শক্তি...................................................................
৩৩
বৃক্ষরোপণ................................................................... ৩৪
নাইরে ব্যবধান...................................................................
৩৪
বাংলাভূমির মান.................................................................
৩৫
কৌতুকগীতি................................................................. ৩৫
হা-খে-না-খা................................................................. ৩৫
হা-না-বা................................................................. ৩৬
শিক্ষা বলি কাকে?...............................................................
৩৬
লোকগীতি................................................................ ৩৮
সারি নৃত্যের
গান................................................................. ৩৯
ঝুমুর নৃত্যের গান...............................................................
৪০
ঝুমুর নৃত্যের মাদলের বোল................................................... ৪০
জারি নৃত্যের গান...............................................................
৪০
বয়াত............................................................... ৪১
গান............................................................... ৪২
বয়াত............................................................... ৪২
গান............................................................... ৪৩
বয়াত............................................................... ৪৩
বন্দনা............................................................... ৪৩
কাঠি নৃত্যের গান...............................................................
৪৩
রায়বেঁশে নৃত্য............................................................... ৪৫
রায়বেঁশে নৃত্যের বোল..........................................................
৪৫
দ্রুত লস্ফনে প্রবেশ ও দিক্বন্দনা..............................................
৪৫
ধনুশ্চালনার ভঙ্গি...............................................................
৪৬
সামরিক কসরৎ............................................................... ৪৬
অশ্বচালনার ভঙ্গি...............................................................
৪৬
ভলস্ননিক্ষেপ
ভঙ্গি............................................................... ৪৭
রণ-পা আরোহণের ভঙ্গি....................................................... ৪৭
অসিচালনার ভঙ্গি...............................................................
৪৭
ভূমিপ্রেমের তিন উক্তি
"আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি,
আমি বিশ্বভুবনকে ভালোবাসি"
"আমি বাংলাদেশের সেবা করব,
আমি বিশ্বভুবনের সেবা করব"
"আমি বাংলাদেশের ব্রতচারী,
আমি বিশ্বভুবনের ব্রতচারী"
বাংলাদেশের ব্রতচারীর ষোল পণ
জ্ঞা নের সীমা প্রসারণ
ব নভূমি প্রবর্ধন
শ্র মের সম্মান বিবর্ধন
স বজি ফলের উৎপাদন
আ লো হাওয়ার সঞ্চালন
গ রুর পুষ্টি সম্পাদন
জ লের শুদ্ধি সুরক্ষণ
পা রিপাট্য সংরচন
ব্যা য়াম ক্রীড়ার প্রবর্তন
না রীর মুক্তি সংসাধন
বি য়ের আগে উপার্জন
শি ল্প শক্তির প্রস্ফুরণ
স ময় নিষ্ঠানুবর্তন
সে বায় আত্ম নিয়োজন
সং ঘ সাম্য সংস্থাপন
আ নন্দোৎস সঞ্জীবন
এই ষোল পণ ছাড়াও ছয়টি অতিরিক্ত পণ নির্ধারিত হয়েছে
ষোল'র অতিরিক্ত পণ
অ পচয় নিবারণ
প্র গতি ও প্ররক্ষণ
নে তার আজ্ঞানুবর্তন
ত্যা গে আত্ম-উন্নয়ন
নি র্মল বাক্য দেহ মন
সু ষম পটু আচরণ
বাংলার ব্রতচারী সতেরো মানা
বি লাসী চালেতে চলিব না
খি চুড়ি ভাষায় বলিব না
ভু লেও ভুঁড়ি বাড়াইব না
খি দে না থাকিলে খাইব না
আ য়াধিক ব্যয় করিব না
বি পদ বাধায় ডরিব না
বি লাসিত্য ভাব পুষিব না
রা গ পাইলেও রুষিব না
দু খেও হাসিতে ভুলিব না
দে মাকেতে মনে ফুলিব না
অ সত্য ভাব পালিব না
অ শিষ্ট চাল চালিব না
দৈ বে ভরসা রাখব না
চে ষ্টা না করে থাকিব না
বি ফল হলেও ভাঙিব না
ভি ক্ষা জীবিকা মানিব না
ক থা দিয়ে কথা ভাঙিব না
শিশু ব্রতচারীর বারো পণ
ছু টব খেলব হাসব
স বায় ভাল বাসব
গু রু জনকে মানব
লি খব পড়ব জানব
জী বে দয়া দানব
স ত্য কথা বলব
স ত্য পথে চলব
হা তে জিনিস গড়ব
শ ক্ত শরীর করব
দ লের হয়ে লড়ব
গা য়ে খেটে বাঁচব
আ নন্দেতে নাচব
ব্রতচারীর ক্রমবৃদ্ধির কামনা
যত দিন বাঁচব ততদিন বাড়ব
রোজ কিছু শিখব রোজ দোষ ছাড়ব
যাহা কিছু করব ভালো করে করব
কাজ যদি কাঁচা হয় শরমেতে মরব
চতুর্বর্গ
শক্ত দেহ তীক্ষ্ণ মন
পূর্ণ কৃত্য দৃঢ় পণ
সাধনা পর্যায়
প্রথমে চরিদ্র
দ্বিতীয়ে কৃত্য
তৃতীয়ে সঙ্ঘ
চতুর্থে নৃত্য
ব্রতচারীর পূর্ণ-বৃত্ত
ব্রতচারীর বৃত্ত- কৃত্য আর নৃত্য
নৃত্য ছাড়া কৃত্য হয়- কৃত্য ছাড়া নৃত্য নয়
দেহ করে সক্ষম, বল আনে চিত্তে
ব্রতচারী নৃত্যের স্থান তাই কৃত্যে
পরহিতে শ্রম ব্রতচারীর দৈনিক অবশ্য-কৃত্য
খেলাধুলা ব্যায়াম বা নৃত্য
পরহিতে কিছু শ্রম নিত্য
ব্রতচারীর কিছু শ্রম নিত্য
ব্রতচারীর অবশ্য- কৃত্য
ব্রতচারীর বাক্-সংযম
একে যবে কথা কয়
অন্য সবে মৌন রয়
ব্রতচারী কণ্ঠ-সংযম
যত মৃদু হ'লে হয়
তার চেয়ে উঁচু নয়
ব্রতচরীর মান-অপমান
সকল রকম শ্রমের কাজ
ব্রতচারীর সমান মান;
নিজের পায়ে না দাঁড়ালে
পায় মনে সে অপমান
ব্রতচারীর বেকারত্ব বর্জন
হাতের কাছে যে কাজ আসে ব্রতচারী করে
বেকার হয়ে থাকতে বসে শরমেতে মরে
ব্রতচারী আত্মবিশ্বাস
অসম্ভব কিছু নয়
সাধানাতে সব হয়
ব্রতচারীর আদি নীতি
মন দুরুস্তেতন্ দুরুস্ত
তন্ দুরুস্তেমন দুরুস্ত
ব্রতচারীর অন্তঃশুদ্ধি
নিজে খেটে নাশে দোষ, অপরের দোষে না
কারো প্রতি বিদ্বেষ ব্রতচারী পোষে না
ব্রতচারীর পঞ্চ-ব্রত
জ্ঞান-ব্রত অনুসরণ
শ্রম-ব্রত অনুসরণ
সত্য-ব্রত অনুসরণ
ঐক্য-ব্রত অনুসরণ
আনন্দ-ব্রত অনুসরণ
জ্ঞান-ব্রত শ্রম-ব্রত সত্য-ব্রত ঐক্য-ব্রত আনন্দ-ব্রত
জ্ঞা-শ্র-স-ঐ-আ
বাংলার ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা
ব্র ত লয়ে সাধব মোরা বাংলাদেশের কাজ
বাংলা সেবার সাথে সাথে বিশ্ব সেবার কাজ
বিশ্ব সেবার সঙ্গে বিশ্ব-মানব সেবার কাজ
ত রুণতার সজীব ধারা আনব জীবন মাঝ
চা ই আমাদের শক্ত দেহ মুক্ত উদার মন
রী তিমত অনুসরণ করব প্রতি পণ
ব্রতচারীর সংকল্প
আমি বাংলার ধারা-বৈশিষ্ট্যে, গৌরবময় অতীতে ও ততোধিক গৌরবময় ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি।
সেই গৌরবময় ভবিষ্যতের ও বৈশিষ্ট্যের সাধনার জন্য দেহে, মনে, চরিত্রে, বাক্যে,
আচরণে, কৃত্যে, সঙ্ঘে- সর্বদা আমার জীবনে ব্রতচারীর আদর্শ ফুটিয়ে তুলতে এবং বাংলার
স্ব-ভাব, স্ব-ছন্দ ও স্ব-ধারা আমার জীবনে প্রবাহিত করে বাংলার ও বিশ্বের পূর্ণ
ব্যক্তি হয়ে উঠতে চেষ্টা করব! 'জয় সোনার বাংলা- জ-সো-বা'!
ব্রতচারীদের বাংলা-প্রেম
বাংলাভাষী সকল মানুষ আমর পরম ইষ্ট
আমার প্রাণের গভীর প্রিয় বাংলাতে যা সৃষ্ট
বাংলার ধারা-বহন
ব্রতচরী বাংলার ধারাবহ বিন্দু
ধারা প্রবাহিত রেখে চলে যাবে সিন্ধু।
মন ও কাজ
মন যার বড় তার কোন কাজ ছোট নয়
মন যার ছোট তার সব কাজ ছোট হয়।
খাওয়া ও বাঁচা
খাওয়ার জন্য বাঁচি না মোরা বাঁচার জন্য খাই
সে জন অতীব মূর্খ যে করে বেশী খাওয়ার বড়াই
আরো খাও বলে খেতে সাধাসাধি করে যে
প্রিয়জন-পরমায়ু পরিণামে হরে সে।
উচ্ছিষ্ট নিয়ম
উচ্ছিষ্ট ভূঁয়েতে নয়
পাত্রে ফেলিতে হয়।
সভার শিষ্টাচার
যেথা কোন সভা হয়
সেথা সবে মৌন রয়।
সভার মৌনতা অভ্যাস
কাকে করে কা-কা
মানুষ মৌন হ'য়ে যা।
দাঁত মাজা
ব্রতচারী মাজে দাঁত
উঠে ভোরে, পুনঃ রাত।
দু'বেলা না মাজলে দাঁত
করবে পরে অশ্রুপাত।
হবে জয় নিশ্চয়
মনে ভয় কর লয়-
হবে জয়। -নিশ্চয়!
ব্রতচারীর পঞ্চ বর্জন
রাগ ভয় ঈর্ষা লজ্জা ঘৃণা
পাঁচ দোষ ব্রতচারীর মানা।
ব্রতচারীর কর্মাগ্রহ
ব্রতচারী করে কাজ
বিনা ঘৃণা বিনা লাজ।
ব্রতচারিতার কার্য
কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য।
দমন-সাধনা ব্রতচারিতা কার্য।
ব্রতচারীর নির্লিপ্তি
ফল-নিন্দা সুখ্যাতি বিরাগী
ব্রতচারী কৃত্য-অনুরাগী।
জা-সো-বা (জয় সোনার বাংলা)
[ব্রতচারীর সর্বজনীন গীত। ৪/৫ জন বা ততোধিক ব্রতচারী কাজ কোথাও সম্মিলিত হলে সেই
সম্মেলন শেষ হবার ঠিক আগে সকলে দণ্ডায়মান হয়ে একসঙ্গে এই গান গাইতে হয়। সমগ্র গানটি
গাইবার যথেষ্ট সময় না
থাকলে কেবলমাত্র প্রথম চার ছত্র গাইলেও চলে। গাওয়ার পর হাত তুরে জ-সো-বা বলতে হয়।]
চির ধন্য সুজনা ভূমি বাংলার
জয় জয় সোনার বাংলার
জয় জয় ভাষার বংলার
জয় জয় আশার বাংলার
জয় স্বভাবের বাংলার
ধারারূপ ছন্দের বাংলার
শস্যের, শিল্পের, শৌর্যের, বীর্যের, লক্ষরে, ঐক্যের, জ্ঞানের-
জয় অবদানের বাংলার
বাংলাভূমির দান
[বাংলা ভাষী সকল মানুষ আমার পরম ইষ্ট
আমর প্রাণের গভীর প্রিয় বাংলাতে যা সৃষ্ট]
আমার বাঙালি, সবাই বাংলা মা'র সন্তান-
বাংলা-ভূমির জল ও হাওয়ায় তৈরী মোদের প্রাণ।।
মোদের দেহ, মোদের ভাষা, মোদের নাচ আর গান
বাংলা-ভূমির মাটি হাওয়া জলেতে নির্মাণ।
বাংলা-ভূমির প্রেমে মোদের ধর্ম আর ঈমান-
বাংলা-ভূমি মোদের কাছে স্বর্গসম স্থান।
বাংলাদেশের ছন্দধারার পালন ক'রে মান-
দানব মোরা বিশ্বে মোদের শ্রেষ্ঠতম দান।
আমরা বাঙালি
আমরা বাঙালি
আমরা বাঙালি
সত্যে ঐক্যে আনন্দে জীবন-প্রদীপ জ্বালি
আমরা শ্রমব্রত পালি
আমরা জ্ঞানব্রত পালি
কণ্ঠ মন আর অঙ্গ আমরা ছন্দে সঞ্চালি।।
বাংলা ভূমির ঐক্য-সূত্র চিত্তে সঞ্চারি
বাংলা প্রেমে যুক্ত আমরা সব নরনারী
বাংলা জন-সেবা ধর্মে আমরা প্রাণ ঢালি।।
আমরা বাঙালি
আমরা বাঙালি।।
বাংলাভূমির মাটি
গ্রামের সকল কাজ মোরা সযতনে সাধব
গ্রামের সকর লোকের হৃদয় প্রেমের ডোরে বাঁধব।
গ্রামের সকল শ্রমের কাজে বনব মোরা দক্ষ
গ্রামের সকল শ্রমিক সনে পাতব মোরা সখ্য।
গ্রামের যে সব ভাল প্রথা সে সব মোরা মানব।
গ্রামের লোকে জানে যাহা সে সব মোরা জানব।
শিক্ষা করি আমরা যাহা সে সব তাদের বলব
গ্রামের জীবন সনে প্রাণের মিলন রেখে চলব।
বাবুয়ানির ছাড়ব সাজ, গতর খেটে করব কাজ,
লেখাপড়ার সাথে সাথে কারিগরি শিখব হাতে।
যে যতটা গড়তে পারে, শক্তি তাহার ততই বাড়ে।
মানুষ শুধু তারেই মান, মিলবে দেশের পরিত্রাণ।
একের কাছে শক্ত যা' দশের কাছে হয় সোজা-
গ্রামের রাস্তা মেরামতি করে না যে মূর্খ অতি-
ব্রতচারী ধন্য নাম রচলে পর আদর্শ গ্রাম
মোদের বাংলাদেশের মাটি-
তোমার শহর গ্রাম ও বাটি
সযতনে সবাই মোরা রাখব পরিপাটি।
করব মশার উৎসাদন।
গড়ে স্নিগ্ধ সতেজ মন
বইয়ে দেব আলো-হাওয়ার মুক্ত বিচরণ;
সাধব মোরা নিত্য তোমার ধনের বিবর্ধন-
রচে' তরকারি ফলফুলের বাগান কোদাল হাতে খাটি।।
লেখাপড়া
মোরা শিখব লেখাপড়া,
যে লেখাপড়া শেখে না তার
গলায় পড়ে দড়া।।
লেখাপড়া শেখে যে সে
দক্ষ কৃষক হয়,
তার দারিদ্র হয় ক্ষয়;
তার ক্ষেত্রে ফলে দ্বিগুণ ফসল
ভরে টাকার তোড়া।।
সে ব্যবসা ক'রে দেশ-বিদেশে
বণিক-বেশে যায়,
মনের আনন্দে বেড়ায়;
সকল দুঃখ-দৈন্য দূর করে সে
শিখে লেখাপড়া।।
জ্বেলে জ্ঞানের আলো করব মোরা
ধনের উৎপাদন-
দেশের দুঃখ বিমোচন;
খুঁজে নিত্য নূতন সত্য, উজল
করব বসুন্ধরা।
বাংলা প্রেম (ধামাইল)
বাংলাভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল
আমি বাংলা-প্রেমে ঢাইলমু আমার দেহ মনের বল গো-
মাটির গড়ন ভূমি রে ভাই, মিলে সকল ঠাঁই-
এমন সোনার ভূমির মতন ভূমি কোথায় গেলে পাই গো।
না জানি ভাই, বাংলা-ভূমি কি যে যাদু জানে-
ওগো চিনিলে তাই চাইবে না আর অন্য ভূমির পানে গো।
ক্ষতি কিছু নাই গো তাতে আমি যদি মরি।।
ওগো বাজাইয়া জীবনে আমার বাংলার বাঁশরি গো।।
নারীর মুক্তি (কীর্তন)
শিশু দোলে যাদের কোলে, তাদের জোরেই রাজ্য চলে।
অন্ধকারে থাকলে মা'রা মানুষ গঠন করবে কারা?
নারী যদি না পায় মুক্তি স্বরাজ রক্ষার বৃথাই যুক্তি
মায়ের জাতের মুক্তি দে রে!
নয়তো যাত্রাপথের বিজয় রথের
চক্র তোদের ঠেলবে কে রে?
জ্ঞানের আলো পায় না যারা
শক্তিবিহীন ব্যর্থ তারা,
শক্তিবিহীন মায়ের ছেলে
সকল কাজে যায় যে হেরে।
লক্ষ্ণী যেথায় ঢাকেন আনন
দুর্নীতি কে করবে দমন?
অত্যাচারীর উগ্রপ্রতাপ
নিত্য সেথায় যায় যে বেড়ে।
মায়ের জাতের মুক্ত প্রভাব
গড়বে তোদের বীরের স্বভাব;-
বিশ্ব-সভার উচ্চাসনে
চড়বে না কেউ তোদের ছেড়ে।
শক্তিময়ী মূর্তি সেজে
উদ্ভাসিত জ্ঞানের তেজে-
শক্তি-মন্ত্র সাধন ক'রে
গড়বে নারী সন্তানেরে।।
সূর্যিমামা
(১)
সুপ্রভাত! হে সূর্যিমামা,
ঘুম হলো কাল কেমনটি?
ওগো তোমার ভয়ে চাঁদ আর তারা
লুকোয় কেন এমনটি?
দেখেছিলাম কালকে তুমি
সাঁঝের বেলায় শুতে গেলে;
ওগো কষ্ট কিছু হয়েছিল কি?
খাট-বিছানা কোথায় পেলে?
(২)
আমি কভু শুই না, বাছা
দেখে বেড়াই দেশ-বিদেশ-
ভাগ্নে-ভাগ্নীগুলি আমার
পাচ্ছে কি না কোথাও ক্লেশ।
পথে পথে দিই জাগিয়ে
ফুল পাখী আর ভোমরাদের;
তোমাদেরও জাগাই আমি,
তোমরা সেটি পাও না টের!
(৩)
ও ভাই সূর্যি মোদের বাসেন ভালো-
বাসেন ভালো ঊষারাণী;
সূর্যি মোদের সবার মামা,
ঊষা মোদের মাতুলানী।।
নিত্য ঊষা হেসে মোদের
করেন নূতন জীবন দান;-
ও ভাই দিনের আলো সর্ব-জীবের
আনন্দেতে ভরে প্রাণ।
কোদাল চালাই
[লাগো কাজে কোমর বেঁধে খুলে দেখ জ্ঞানের চোখ
কোদাল হাতে খটে যারা তারাই আসল ভদ্রলোক]
চল্ কোদাল চালাই
ভুলে মানের বালাই-
ঝেড়ে অলস মেজাজ
হবে শরীর ঝালাই।।
যত ব্যাধির বালাই
বলবে "পালাই পালাই"-
পেটে খিদের জ্বালায়
খাব ক্ষীর আর মালাই।।
আমরা মানুষ দল
আমরা মানুষ দল
এই ভুবনের ছন্দে মোরা আনন্দ-চঞ্চল।
চন্দ্র-সূর্য-তারার মেলা।
মোদের সাথে পাতায় খেলা-
জগৎ-জোড়া এই মিতালির আনন্দ সম্বল।
ফুলের হাসি পাখীর গানে
জ্যোৎস্না নিশার মধু-স্নানে-
কোন অচেনা স্নেহের টানে প্রাণ করে চঞ্চল;
অন্তহীনের অসীম লীলায়
মর্ম মোদের ছন্দ মিলায়
বিশ্বদোলার শঙ্কাহারা অঙ্কে সমুজ্জ্বল-
মৃত্যুজয়ী আনন্দের এই খেলায় মেতে চল।
আমরা মানুষ দল!
হ্যাঁ ও না
মোরা ছুট্ব মোরা খেল্ব বসে কুঁড়ে হয়ে থাক্ব না;
ছাতি ফাট্বে মাথা ভাঙবে তবু পরাজয় মান্ব না।
মোরা নাচ্ব মোরা গাইব মিছে শরমেতে জড়ব না;
গুরু ছাত্র পুঁথি মাত্র পড়ে অকালেতে মরব না।
মোরা হাস্ব ভয় নাশ্ব বাধা বিপদেতে টল্ব না,
প্রাণ খুল্ব মানা ভুল্ব দীন দুখীদের ঠেল্ব না।।
গায়ে খাট্ব বন গড়বো মাথা গুঁজে বসে ভাব্ব না।
মাটি খুঁড়ব চাষ জুড়ব কভু শ্রমে হেলা র্কব না।
লেখা লিখ্ব পড়া শিখ্ব তবু বাবু বনে উঠ্ব না।
গ্রামে ও জেলায় জলেতে হেলায় কভু পানা ঘাস রাখ্ব না।।
দেশ র্ঘুব জ্ঞান র্পুব জাতি-ভেদাভেদ মান্ব না,
ভালো বাসব দুখ নাশ্ব কভু ছোট-বড় বাছ্ব না।।
চল্ হই
ব্রতচারী দেশের শক্তি
মনের মুক্তি গড়ে-
চল ভাই মোরা ব্রতচারী
হই সব ত্বরা করে।
জ্ঞানে শ্রমে সত্যে ঐক্যে
আনন্দেতে পূর্ণ-
জীবন হবে সফল মোদের
বিঘ্ন হবে চূর্ণ।।
ব্রতচারী নাম
মোরা গরব করি
ধ'রে ব্রতচারী নাম!
সকল বয়সে করি
নৃত্য ও ব্যায়াম।
দেই শিস, আর হাসি
লড়ে বিপদ বাধায়;
স্ব-মর্যাদ্ পালি-
তাতে প্রাণ যদিও যায়!
চাস যদি
চাস যদি করতে চিত্তকে তোর
জোর আর ফূর্তির ধাম
চাস যদি গড়তে শরীরকে তোর
সুন্দর আর সুঠাম-
চল তবে আয় ধেয়ে, দে যোগ ঝট্পট্
ব্রতচারীর দলে-
নাচ গান পণ তার দ্রুত তোর তন্ মন্
ছেয়ে দেবে স্বাস্থ্যে বলে;
তোর হৃদয় ভ'রে প্রেম আর সখ্যে
সময় ভ'রে শ্রমে
নিজ-হিতে আর দেশ-হিতে জান্ তোর
মজায় তুলবি জ'মে।।
বীর-নৃত্য
সব চল্ আয় খেলি
বীর-নৃত্যের কেলি,
মনের ভয় আর ভাবনা দিয়ে
দূরে ফেলি।
বিপদ বাধা হেলি প্রাণ উঠবে ঠেলি,
ছুটে চলরে আনন্দের পতাকা মেলি।
মোদের দেহের ভূষণ হবে
মাটির ধূলি,
উঠ্বে দামামার তারে তালে
অঙ্গ দুলি,
উঠ্বে উলস্নাসভরে সিংহনাদের বুলি,
বাড়বে বুকের পাটা বাহুর ঝাঁকায় ফুলি।
আয় ধেয়ে চলি
খেলি পরাণ খুলি-
যাক্ সবার হৃদয়ে
সবার হৃদয় মিলি!
তরুণ দল
বাংলা মা'র দুর্নিবার আমরা তরুণ দল;
শ্রান্তি-হীন ক্লান্তি-হীন সঙ্কটে অটল!
গঙ্গা-রাঢ় পালরাজার
বীর্য গরিমা-
চ-ীদাস জয়দেবের
ছন্দ-ভঙ্গিমা-
হোসেন শাহ ঈশা খাঁর শক্তি-মহিমা-
লালন শাহ নজরুলের ছন্দ ভঙ্গিমা-
ঢেউ তাদের দেয় মোদের চিত্তে অবিরল!
নিঃস্বতার দৈন্য-ভার
করব উৎসাদন;
অজ্ঞতার অন্ধকার
করব নির্বাসন;-
নবযুগের উন্মেষের জ্বালব দীপ উজল।
সংযমের পৌরুষের
পাল্ব প্রেরণা;
শ্রম-যোগের উদযোগের
সাধব সাধনা;
বাংলার মা'র লাঞ্ছনার মুছব অশ্রুজল!
রাইবিশে
আয় মোরা সবাই মিশে খেল্বো রাইবিশে।।
মোরা খেল্বো রাইবিশে-
মোরা নাচ্বো রাইবিশে;
আয় মোরা সবাই মিশে খেল্বো রাইবিশে।।
মোদের ভাবনা ভয় কিসে?
হ'য়ে খেলায় ময় ভাবনা ভয় ভাঙবো নিমিষে।
হ'য়ে নৃত্য ময় ভাবনা ভয় নাশবো নিমিষে।।
ই-আঃ!
দামামার তালে তালে হেলে দুলে
মোরা র্মাবো কুঠার নিরানন্দের মূলে;
দেখে পরের নাচ আন্বো না কুভাব মনে
নেচে নির্মল আনন্দ পাবো আপন মনে।।
ই-আঃ
আয় রে দশ-বিশে;
চলিস্নশে!
ছিয়ালিস্নশে!
ভয় কিসে?
আয় মোরা সবাই মিশে-খেলবো রাইবিশে।
আ ব্ ব্ ব্ ব্ ব্ - ই-আঃ! (৩ বার)
জীবনোলস্নাস
আয় মোরা সবাই মিলে
নাচিয়া গাহি তালে তালে!
আসবে যখন-আসবে দুখ,
বিরহ বেদনা মৃত্যু-শোক-
জীবনের আনন্দটুক্
ভুলে যাবি কি তাই ব'লে?
খোলা মাঠের উধাও হাওয়ায়
ভাবনা ভয় তেয়াগি আয়,-
বিশ্ব-প্রবাহী প্রেমধারায়
বহিয়ে দে প্রাণ হিলেস্নালে!
ভরে সে প্রাণ ভালবাসায়-
মরণ পারের মিলন আশায়-
পাখীর গানে ফুলের ভাষায়
চাঁদনী রাতের কিরণ জালে।।
বাংলার স্থান (ভাটিয়ালি)
কৃত্যে নৃত্যে পূর্ণ ক'রে রে-
কায় মন প্রাণ গড়ে নো;
বাংলা দেশের নরনারীর সেবায় সঁপে দে!
জ্ঞানে শ্রমে সত্যে ঐক্যে
বিমল আনন্দেতে জীবন ভরে নে-
যেন বিশ্ব মাঝে বাংলার হয় স্থান,
সমুচ্চ আসনে-
কায় মন প্রাণ গড়ে নে!
স্বাগত
স্বাগত, স্বাগত, স্বাগত-
স্বাগত হে হেথা শুভ অতিথি;
আজি মিলনের পুলকিত পরশে
হরষ-আবেশে হাসে প্রকৃতি-
হাসে প্রকৃতি, হাসে প্রকৃতি।
স্বাগত হে হেথা শুভ অতিথি।
চিত্তে জাগিছে নব আশা,
ঝঙ্কৃত হৃদয়ের ভাষা,
উথরে বিমল ভালবাসা- (২)
পরাণের নিরমল প্রীতি-
স্নেহ-প্রীতি- স্নেহ-প্রীতি।
তব মঙ্গল বিভু- পদে মিনতি!
করি মিনতি!
করি মিনতি, করি মিনতি,
স্বাগত হে হেথা শুভ অতিথি।
সবার প্রিয়
সে যে মোদের সবার প্রিয়,
সকলের আদরণীয়-সকল গুণে বরণীয়।।
বিভু, তোমায় এই মিনতি-
দীর্ঘ জীবন তারে দিও;
সুস্থ জীবন তারে দিও-
সফল জীবন তারে দিও;
মোদের প্রীতি জড়িয়ে দিও-
মোদের গীতি জড়িয়ে দিও-
মোদের স্মৃতি জড়িয়ে দিও-
মোদের প্রীতি, মোদের গীতি মোদের স্মৃতি জড়িয়ে দিও।
জয় জয় জয়
জয় জয় জয়
জয় জয় জয় তারে দিও।।
মিলন স্মৃতি
এই মিলন-তিথির মোহ স্মৃতি ভুলব না;
কভু ভুলব না;
ভুলব না-ভুলব না!
প্রণয়ের গাঁথন ডোরের বাঁধন কভু খুলব না-
খুলব না-খুলব না!
কত হাসা-গাওয়া পরাণ খুলি,
মেলামেলি ভাবনা ভুলি;
স্বপন-সুখের নেশায় কত স্বরগ-লোকের কল্পনা;
মানস-পটে দিবস-রাতি
ফুটবে তাহার বিমল ভাতি,-
গভীর দুখের বিষাদ নিশায়
মিলবে তাহার সান্ত্ম্বনা;-
সান্ত্ম্বনা!
সান্ত্ম্বনা!
চল্ চল্ (চলন গীত)
চল্ চল চল্
বিঘ্ন-বাধায় না রাখি ডর
দর্পে পা ফেলি ধরণী পর
বক্ষে সাহসে পাতিয়া ভর
চল্ রে চল্ রে চল্।
চল্ রে চল্ রে চল্
বাড়িয়া অগ্রে চল্
বিসরি' কুণ্ঠা ছল্
জ্ঞানে-আনন্দে-সত্যে-ঐক্যে শ্রমে আহরি বল।।
হাসিয়া নাচিয়া চল্
খাটিয়া বাঁচিয়া চল্।
সখ্য পাতিয়া,
সংঘ গাঁথিয়া
কর্মে মাতিয়া চল্!
চল্ চল্ চল্!
অগ্রে চল
হ'য়ে ধর্ম-পূর্ণ-বক্ষ
কর্ম-পূর্ণ-লক্ষ
মর্ম-পূর্ণ-সখ্য,
সদর্পে অগ্রে চল্।।
ব্রতচারী
কত যে কাজ করতে আছে
নাহি তাহার শেষ,
কত যে দান মোদের কাছে
চাহে মোদের দেশ;
হবে না তার কিছুই সাধন
না লভিলে জ্ঞান-
আয় মোরা তাই
মিলে সবাই
গাহি জ্ঞানের গান-
বাধা ঠেলে
সবে মিলে
চড় জ্ঞানের সোপান;
নর-নারী
ব্রতচারী
হয়ে লভে যেন সবে জ্ঞান।
প্রেমে ধর্মে
হিত কর্মে
কর দেশকে মহীয়ান;-
যেন বিশ্বের জনসভা মাঝে
বাড়ে বাংলার সম্মান।
তরুণতা
জন্ম হবার সময় হতেই
বয়সটা চলে বেড়ে,-
বন্ধ করতে সেটি ত আর
উঠবে না কেউ পেরে;
বয়সে না হয় বাড়ব তবু
রাখব তরুণ প্রাণ-
আয় তবে গাই
মিলে সবাই
তরুণতার গান।
তরুণতায়
তরুণতায়
কর জীবন পূর্ণ;
তরুণতায়
তরুণতায়
কর বিঘ্ন বিচূর্ণ।
গীতি নৃত্যে
নিতি চিত্তে
আনো বিমল হর্ষ-
আনো ভেদাভেদ-বিদূরিত চিত্তে
সারা বিশ্বের স্পর্শ।।
হয়ে দেখ
ব্রতচারী হয়ে দেখ
জীবনে কি মজা ভাই-
হয় নি ব্রতচারী যে সে
আহা কি বেচারিটাই!
হাসবে খেলবে নাচবে গাইবে
খাটবে ভুলে ভয় আর মান;
দেহের তেজ আর মনের তুষ্টি
আনন্দে উথ্লাবে প্রাণ।
পূর্ণ স্ব-স্থ ও পূর্ণ স্বরাট
হও স্বচেত-বক্ষ
স্ব-মার্গ লক্ষ
প্রতিষ্ঠ স্বভূমি-ছন্দে।
হও পূর্ণ স্ব-স্থ
হও পূর্ণ-স্বরাট
পর-ভূমি ধারা বহিও না স্কন্ধে।।
মানুষ হ'
মানুষ হ', মানুষ হ'
আবার তোরা মানুষ হ'-
অনুকরণ খোলস ভেদি
কায়-মনে বাঙালি হ'
শিখে নে দেশ-বিদেশের জ্ঞান
তবু হারাস নে মা'র দান-
বাংলা ভাবে পূর্ণ হয়ে
সুধন্য বাঙালি হ'।।
করে বাংলা-জাত প্রাণ
খেটে বাংলা সেবায় দান
বাংলা ভাষার বুলি বলে
বাংলা ধাঁচে নেচে খেলে
ষোল আনা বাঙালি হ'-
সম্পূর্ণ বাঙালি হ'-
বিশ্বমানব হ'বি যদি-
শাশ্বত বাঙালি হ'।।
চাষা
যদি তার নাই বা সরে মুখের ভাষা-
ছোটলোক নয় রে চাষা!
চাষীর জোরে শক্তি জাতির-
চাষের মূলে দেশের আশা।।
চাষীরে মূর্খ রেখে
দেখে তারে ঘৃণার চোখে
পাশ্ করা লোক ভদ্র ব'নে
দিয়েছে ছেড়ে লাঙ্গল চষা;
তাই আজ দেশের এ দুর্দশা
মরছে মানুষ বাড়ছে মশা-
সোনার এই বাংলাদেশ আজ
বন্লো রে তাই রোগের বাসা।।
ভুলে গিয়ে বাবুয়ানা
মাটি খুঁড়ে তোল্রে সোনা;
মাঠে চল্ কোদাল হাতে
ছেড়ে দিয়ে কলম-ঘষা;
মানুষ যদি হ'বি আবার
কর আয়োজন ভূমির সেবার;
খুলে চোখ জ্ঞানের আলোয়
গতর খেটে, গতর খেটে,
গতর খেটে বন্বে চাষা।
জ্ঞানের মশাল নিয়ে হাতে
নেমে আয় চাষার ক্ষেতে,-
(যেথায়) চলছে চাষীর আঁধার নিশির
ঘুমের ঘোরে কাঁদা হাসা;
সে আলোর পরশ পেলে
জাগবে চাষী নয়ন মেলে;
হবে তার শক্তি বিকাশ-
দেশের দুঃখ-দৈন্য নাশা।।
বাংলার শক্তি
বাংলার মাটি হাওয়া জল ফুল ফল
সেবি গড় বাঙ্গালী দেহে মনে বল্।
বাংলার ভাষা কলা নৃত্য ও গান
সাধি কার সার্থক দেহ মন প্রাণ।
করে বাংলার শিল্প ও শস্যের চাষ
বাংলার কোল জুড়ে কর সুখের বাস।।
বাংলার পল্লীর প্রাণধারা সাথ্
বাংলার শিক্ষার সংযোগ পাত।
বাংলার মানুষেরে প্রেম করে দান
বাংলার প্রাণ সনে বন্ সম-প্রাণ।
পালি বাংলার স্ব-তন্ত্র ধারার মান
বাংলার শক্তিরে কর জয়-বান।।
বৃক্ষরোপণ
চল্ চল্ ঝটিতি চল্
রোপিব বৃক্ষ চল্।
বৃক্ষ মেলিবে রোদ্দুরে ছায়া
বৃক্ষে ফলিবে ফল।।
করি তার কোলে বাসা নির্মাণ
শাখে বসে পাখী শুনাইবে গান,
শ্রান্ত পথিক শুইবে ক্ষণিক
ছায়া পেয়ে সুশীতল।।
ফুটিবে উজলি ডালে ডালে ফুল,
লুটিবে তাদের মধু অলিকুল,
রাখালের ছেলে মিলে তার তলে
পাতিবে খেলার দল।।
নাইরে ব্যবধান
সহায় খোদা ভগবান-
দশের কর্মে মোদের প্রাণ
ব্রত লয়ে চল আয় মোরা করি সবাই দান
চল আয় করি সবাই দান-
চল আয় করি সবাই দান।
মুসলমানের সেবায় হিন্দু করে যে জীবন দান
হিন্দুর উপকারে দে রে মুসলমান তোর প্রাণ-
তাতে নাইরে অপমান-
মোদের ধর্ম-গাঙ্গের চর ছাপিয়ে ছুটুক প্রেমের বান
তাতে বাড়বে দেশের মান!
রাম রহিমের বিবাদ রচে রহিসনে অজ্ঞান-
যেই ভগবান সেই যে খোদা
নাই রে ব্যবধান-
শুধুই নামের ব্যবধান।
বাংলাভূমির মান
মোরা বাংলাদেশের ব্রতচারী
বাংলাদেশের মান।
বাংলাভূমির জনসেবায় জীবন মোদের দান।।
এক তালেতে যাত্রা মোদের
এক সুরেতে গান-
এক ডোরেতে যুক্ত মোরা করি বহুর প্রাণ।।
আনব বটে জগৎ ঘুরে
দেশ-বিদেশের জ্ঞান,
তবু রাখব ব'রে সমাদরে
বাংলাভূমির দান।
বাংলাভূমির দান,
মোদের বাংলাদেশের দান-
মোরা রাখব ব'রে সমাদরে
বাংলাভূমির দান।
মোদের বাংলাদেশের দান।।
কৌতুকগীতি
হা-খে-না-খা
'হ'য়ে 'আ'কার আর 'স' ভাইরে 'হ'য়ে 'আ'কার আর 'স'
চেষ্টা করে নিত্য একটু হাঃ-হাঃ-হাঃ-স!
'খ'য়ে 'এ'কার আর 'ল' ভাইরে 'খ'য়ে 'এ'কার আর 'ল'-
চেষ্টা করে নিত্য একটু 'খ'য়ে 'এ'কার আর 'ল'!
'ন'য়ে আকার আর 'চ' ভাইয়ে 'ন'য়ে 'আ'কার আর 'চ'
চেষআ করে নিত্য একটু 'ন'য়ে 'আ'কার আর 'চ'
'খ'য়ে 'আ'কার আর 'ট' ভাইরে 'খ'য়ে 'আ'কার আর 'ট'-
চেষ্টা করে নিত্য কসে 'খ'য়ে 'আ'কার আর 'ট'!
'বঁ'য়ে 'আ'কার আর 'চ' ভাইরে 'বঁ'য়ে 'আ'কার আর 'চ'-
হেসে খেলে নেচে খেটে 'বঁ'য়ে 'আ'কার আর 'চ'।
হা-না-বা
হা-হা-হা স
হা-হা-হা স
ভাবনা ও ভীতি না-আ শ-
ভুলি ভেদ ভাল-বা-আ স
হা-হা-হা হা-হা স!
বিঘ্ন বিপদে
হা-হা স-
পরাজয়ে জয়ে
হা-হা স-
ভার-তি বহনে
হা-হা স-
রোগ শোক তাপ ত্রা-আস
হেঃ-হে হে-সে না-আ শ!
শিক্ষা বলি কাকে?
মোরা শিক্ষা বলি কাকে?
পরীক্ষা দিয়ে ভিক্ষা করা চাকরি ঝাঁকে ঝাঁকে-
মোরা শিক্ষা বলি তাকে!
মোরা শিক্ষা বলি কাকে?
এই পরের উপর হুকুম ঝেড়ে নবাবী করাটাকে।
আর ঐ ঘি ভাত খেয়ে ভুঁড়ি গজিয়ে ভদ্র বনাটাকে।।
মোরা শিক্ষা বলি তাকে!
[পরবর্তী প্রত্যেক্ষ দুই লাইনকে এই প্রণালীতে গাইতে হয়।]
এই গতর খাটে যারা তাদের ঘেন্না করাটাকে;
আর ঐ ধানোৎপাদনকারীদের ছোট ভাবাটাকে।।
এই অর্থ না বুঝেও পুঁথি মুখস্থ করাটাকে,
আর ঐ পরীক্ষায় তা আউড়ে দিয়ে ডিগ্রি পাওয়াটাকে।।
এই উপার্জনের আগে বংশ বৃদ্ধি করাটাকে;
আর ঐ ঘরে বসে ধ্বংস করা বাপের অন্নটাকে।।
এই পুরুষ জাতের শতেক দোষে চক্ষু বোজাটাকে;
আর ঐ মেয়ের বেলা স্বল্প দোষে শাস্তি বিধানটাকে।।
এই মিহি সুরে নাকী গলায় গানের গানের ধরণটাকে;
আর ঐ পৌরুষের ভাব ছেড়ে কচি সংসদ হওয়াটাকে।।
এই মুর্খ হলেও জাতের জোরে বড়াই করাটাকে;
আর ঐ ভোট লালসায় হিন্দু-মোসলেম লড়াই সৃষ্টিটাকে।।
এই পা ফাঁক করে সিগ্রেট টেনে সাহেব বনাটাকে;
আর ঐ মাতৃভাষা লিখতে বলতে ভুলে যাওয়াটাকে।।
এই নেচে গেয়ে আনন্দলাভ লজ্জা করাটাকে;
আর ঐ পরের নৃত্য দেখে মনে কুভাব আনাটাকে।।
এই হয় যদি কেউ বড় তবে হিংসা করাটাকে;
আর ঐ দীন দরিদ্রের দুঃখে শুধু কথায় কান্নাটাকে।।
এই গরীব লোকের দিকে ঘৃণার চক্ষে চাওয়াটাকে;
আর ঐ ধনী হ'তে পারলে বেজায় দেমাক করাটাকে।।
এই বক্তৃতার আসরে বিশ্ব বিজয় করাটাকে;
আর ঐ কাজের বেলা ঘুঘু বনে পিছু হটাটাকে।।
এই নামের গোড়ায় খেতাব জুড়ে জাঁকে ভরাটাকে;
আর ঐ পথে হাঁটা ছেড়ে মোটর গাড়ী চড়াটাকে।।
এই বিদেশীদের হাতে দেশের ব্যবসা ছাড়াটাকে;
আর ঐ মনুষ্যত্ব ভুলে পরের পদলেহনটাকে।।
এই পুরুষ নারীর জন্য পৃথক কানুন বিধানটাকে;
আর ঐ মানুষে মানুষে জাতের বিভেদ রচাটাকে।।
এই মায়ের জাতির দিকে পশুর চক্ষে চাওয়াটাকে;
আর ঐ ঘোমটা টেনে অন্ধ করা ভগ্নী, বৌ আর মাকে।।
আর এই স্ত্রীকে ঘরে বন্ধ রেখে ফুর্তি করাটাকে;
এই গরীব লোকের রক্ত শুষে ধনী হওয়াটাকে;
আর ঐ কাজ না করে পরের কাজে বাধা দেওয়াটাকে।।
এই পুজোর মন্ত্র আওড়ানোকে পুণ্যি ভাবাটাকে;
আর এ ছোঁয়াছুঁয়ির ভণ্ডামিকে ধর্ম বলাটাকে।।
এই বিয়ে দিয়ে খেয়ে দেওয়া ছেলের মাথাটাকে;
আর ঐ কন্যাদায়ীর ঘাড় ভেঙে পণ আদায় করাটাকে।।
এই শঙ্খ ঘন্টা বাজানোকে ধর্ম ভাবাটাকে;
আর ঐ ফোঁটা-তিলক টেনে ফাঁকে মুরগী-ভোজনটাকে।।
এই নগ্দী রেখে প্রজা সমাজ জব্দ করাটাকে;
আর ঐ মনে এক ভেবে মুখে আর এক বলাটাকে।।
এই রায়ত শুষে খাজনা ক'ষে আদায় করাটাকে;
আর ঐ রাজধানীতে বসে তাহা খরচ করাটাকে।
এই হাকিম হয়ে চোখ রাঙিয়ে হুকুম ঝাড়াটাকে;
আর ঐ উকিল মোক্তার বেশে মক্কেলের ঘাড় ভাঙাটাকে।।
এই উপাধি পদবীর লোভে পাগল হওয়াটাকে;
আর জীবনটা খিচুড়ি করে নষ্ট করাটাকে।।
লোকগীতি
বাউল, জারি, কাঠি, ঝুমুর প্রভৃতি লোকনুত্যের প্রত্যেকটির সঙ্গে তার আনুষঙ্গিক
লোকগীতি গাওয়ার প্রথার প্রচলন আছে। ঐ সকল গানের অনুষঙ্গ বিনা ঐ লোকনৃত্যগুলির
অঙ্গ-ভঙ্গ হয়। আবার তেমনি প্রত্যেকটির আনুষঙ্গিক নৃত্য বাদ দিয়ে শুধু সুর-সহযোগে
গীতিগুলি গাইলে সেই সঙ্গীত ভগ্নাঙ্গ, অপূর্ণ ও ভগ্নরস হয়ে পড়ে। এই সকল লোকনৃত্যের
আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে এদের প্রত্যেকটির আনুষঙ্গিক লোকগীতিগুলি পল্লীবাসীদের মুখ
থেকে শুনে আমি নিজে সংগ্রহ করেছি। সেই সংগ্রহের সম্পূর্ণ প্রকাশের স্থান এ নয়;
এখানে আমার সংগ্রহ থেকে প্রথম-শিক্ষার্থীর উপযোগী সহজ সুর ও ভাবের কয়েকটি গান
ছাপানো হল।
জাতীয় জীবনের পুনর্গঠন করতে হলে জাতির প্রত্যেক নর-নারী ও প্রত্যেক বালক-বালিকা
যাতে করে জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির আবহমান ধারার সঙ্গে পরিচয় ও সংযোগ স্থাপন করতে
পারে এবং সেই সংস্কৃতিগত মনোভাব, আচরণ ও কলাচর্যাকে নিজের জীবনে ওতপ্রোতভাবে
প্রবাহিত করে নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। এতে করে জাতির জীবনে যেমন
পারস্পরিক ঐত্য ভাব ও অধিজাতীয়তার গৌরব জাগিয়ে তোলা যায় তা অন্য কোন প্রকারে সম্ভব
নয়। দেশের সকল শ্রেণীর মধ্যে সারল্য, সহজতা, সৌহার্দ্য ও সাম্যভাব জাগিয়ে তোলবারও
এটি একটি অদ্বিতীয় উপায়। এই কারণে লোকনৃত্য ও লোকগীতির চর্চা অধিজাতীয় জীবন গঠনের
পক্ষে যে একটি অপরিহার্য ও অমূল্য উপাদান, তা উপলব্ধি করে বাংলার লোকগীতি ও
লোকনৃত্যের চর্চা বাংলার প্রত্যের ব্রতচারী ও ব্রতচারী সঙ্ঘের কৃত্যরূপে নির্ধারিত
করা হয়েছে।
সারি নৃত্যের গান
১.
ও কাইয়ে ধান খাইল রে
খেলানের মানুষ নাই;
খাওয়ার বেলায় আছে মানুষ-
কামের বেলায় নাই-
কাইয়ে ধান খাইল রে।।
ওরে হাত পাও থাকিতে তোরা
অবশ হইয়া রইলি;
কাইয়ে না খেদাইয়া তোরা
খাইবার বসিলি-
কাইয়ে ধান খাইল রে।।
ওরে ও পাড়াতে পাটা নাই পুতা নাই
মরিচ বাটে গালে,
তারা খাইল তাড়াতাড়ি
আমরা মরি ঝালে-
কাইয়ে ধান খাইলে রে।।
ওরে তারে না না রেনা নারে
তারে নারে রে
তারে না না রে না নারে
তারে নারে রে
কাইয়ে ধান খাইল রে।।
আরে হিও-আরে হিও-আরে হিও!
আ-ব্-ব্-ব-ব্-ব্-ব্-ব্-ব্-ব্-ব্!
২.
দেওয়াল্যা১ বানাইলা মোরা সাম্মানের২ মাঝি-এ-
চাঁদ-মুখে মধুর হাসি, (দাদা) চাঁদ-মুখে মধুর হাসি।
বাহার মার্ইযা যায় গোই৩ সাম্মান রে, দাদা-
না মানে উজান-ভাটি, (দাদা) না মানে উজান-ভাটি।।
দেওয়াল্যা বানাইলা মোরে সামমানের মাঝি।।
কুতুবদিয়ার পশ্চিম ধারে সাম্মান-আলার ঘর;
লাল বাওটা৪ তুইল্যা দিছে সাম্মানের উপর।
বাহার মার্ইযা-ইত্যাদি।।
[১দেঊলিয়া, ২সাম্পান নৌকা, ৩যায় গো ঐ, ৪পাল]
ঝুমুর নৃত্যের গান
১.
আগা ডালে ব'স কোকিল
মাঝ ডালে বাসা রে-
ভাঙ্গিল বিরিখির ডাল
জীবনে নাই আশা রে।
অকালে পুষিলাম পাখী
ঘিরত মধু দিয়া রে-
সুকালে পালাইলেন পাখী
দারুণ শেল দিয়া রে।।
অকালে পুষিলাম পাখী
খুদ কুঁড়া দিয়া রে-
সুকালে পালাইলেন পাখী
দারুণ শেল দিয়া রে।।
[হাত হাতে ধরাধরি তালে পড়ে পা রে-
হেসে খেলে নেচে ভুলি ভয় আর ভাবনা রে।]*
ঝুমুর নৃত্যের মাদলের বোল
ধাতিন্ তাতাক্ তিন্ধা ধাতিন্ ধাতিন্ তাতাক্ খি
ধাতিন্ তাতাক্ তিন্ধা ধাতিন্ ধাতিন্ তাতাক্ খি
ধাতিন্ তাতাক্ তিন্ধা ধাতিন্ খি খি খি।
জারি নৃত্যের গান
ডাক
আরে ভালো ভালো ভালোরে ভাই
আরে ও ও আহা বেশ ভাই
আমরা আলস্নার নামটি লইয়ারে ভাই
আমরা নাইচা নাইচা সবায় যাই
আরে শোন ক্যান্ শোন ক্যান্ মোমিন ভাই
আমরা বেয়াদপির মাপটি চাই।।
ঐ যে তিলেতে তৈল হয় দুধে হয় দই-(বয়তি)
ঐ যে ধানেতে তৈয়ার হয় মুড়ি চিড়া খই-(সকলে)
সাবাস্ সাবাস্ সাবাস্ ভাই-(সকলে)
সাবাস্ সাবাস্ সাবাস্ ভাই- (বয়াতি)
বেশ বেশ বেশ ভাই-(সকলে)
সাবাস্ ভাই-(বয়াতি) বেশ ভাই-(সকলে)
বেশ ভাই-(বয়াতি) সাবাস্ ভাই-(সকলে)
বাবাস্ গো-(বয়াতি) বেশ গো-(সকলে)
চুপ কর ভাই (বয়াতি) সবুর-(সকলে)
ঐ যে মৌমাছিরা বলে মোরা চৌদিকেতে ধাই-(বয়াতি)
ঐ যে ভুরে (ভোরে) উঠি কত দৌড়ি ফুল যেথায় পাই-(সকলে)
ঐ যে কি যতনে রাখি মধু মুমেরি (মোমেরি) কুঠিায়-(বয়াতি)
ঐ যে কি কৌশলে করি ঘর কে দেখিবি আয়-(সকলে)
ঐ যে বেশ বেশ বেশ ভাই-ইত্যাদি
ঐ যে সবুজ বরণ ঘাস পাতা লাল শিমূল ফুল-(বয়াতি)
ঐ যে হলুদ-বরণ পাকা কলা কালো মাথার চুল-(সকলে)
ঐ যে বেশ বেশ বেশ ভাই-ইত্যাদি
বয়াত
সভা কইরা বইস ভাইরে হিন্দু মুসলমান।
বন্দনা সারিয়া আমি (আমরা) গাইমু জারির গান।।
মুসলমান ভাইদের জানাই মোর সালাম।
হিন্দু ভাইদের আমি করি গো পেরনাম।
আলস্নার নামে বাইন্দা ঘর রসুলের নামে ছাইও।
সেই ঘরের মাঝে বান্দা সুখে নিদ্রা যাইও।।
সেই ঘরের মাঝে ভাইরে তীর্থ বারাণসী।
মুসলমানের তিরিশ ভাইরে তীর্থ বারাণসী।
মুসলমানের তিরিশ রোজা হিন্দুর একাদশী।।
মুসলমান বলেন খোদা হিন্দু বলেন হরি।
মনে ভাইব্যা দেখ ভাইরে দুই নামেতেই তরি।।
গান
তাইরিয়া নাইরিয়া গো
নাইরিয়া নারে নার;
তাইরিয়া নাইরিয়া গো
নাইরিয়া নারে নার-
তাইরিয়া নাইরিয়া নারে নারে নারে নারে রে
এ এ ফুলের ভারে গো ভারে
ফুলের ভারে ডাল পড়ে আলিয়া
ও কি বেশ বেশ-
নিশাকালে ফুটে ফুল নীহুর লাগিয়া-
ও কি বেশ বেশ-
ভোমরা না করে রুদন (রোদন) মধুর লাগিয়া রে- এ এ
ফুলের ভারে গো ভারে ফুলের ভারে ডাল পড়ে আলিয়া।।
বয়াত
জগত পিতার অংশ মোরা যতেক ভগ্নি ভাই
মানুষে মানুষে কোন জাতের বিভেদ নাই।।
ছোট বড় কেউ নয় সকলে সমান
সকলেই করি মোরা সকলে সম্মান।।
আয় জাতি ভেদ ভুলে সবাই গলায় জড়াজড়ি
এই দেশেতে জন্ম আয় এই দেশের কাজেই মরি।।
একের গুরু অবতার বা ইমাম নবী যাহারা
অপরের শ্রদ্ধা উপহার পাবেন ভাই তাহারা।।
তাইরিয়া নাইরিয়া নারে নারে নারে-ইত্যাদি।
গান
* এ এ দেশের কাজে গো কাজে, দেশের কাজে আয় সব নামিয়া
(ওকি বেশ বেশ), স্বর্থজালের মায়া মোহ আয় ফেলি ভাঙ্গয়া
আয়রে দেশের কাজে সবে পরাণ দেই ঢালিয়া র-
বয়াত
কারবালতে ইমাম হোসেন, কাসেম দিলেন প্রাণ।
তারি লাইগা বাংলায় কান্দে হিন্দু মুসলমান
আয়রে হিন্দু মুসলমান ভাই গলায় জড়াজড়ি
এক দেশেতে জন্ম আয়রে দেশের কাজে মরি।
তাইরিয়া নারিয়া ইত্যাদি।
আরে ও ও হানিফ আইস গো আইস
আইস লয়ে মদিনার বারি;
ওকি বেশ বেশ-
ভাইয়ের শুকে (শোকে) জান বিদ গলায় দিব ছুরি-
আইস রে মদিনার লুক (লোক) গলায় গলায় মিলি রে-এ এ
এ হানিফ আইস গো আইস, আইস লয়ে মদিনার বারি।।
বন্দনা
* বন্দনা সারিয়া আমরা গাইমু জারির গান
* কারবালার কাহিনীর দুঃখে বিদরে পরান।।
কান্দে সাকীনা হায় হায় পিয়ারা আমার
কে মাইল শ্যালের ঘা বদনে তোমার।।
কাঠি নৃত্যের গান
১.
মাদল বাজনা ও উদার বোল
ধাতিন্ তাং ধাতিন্ তাং
ধাতিন্ তাতাক্ ধাতিন্ তাং
তাক্তা ধাতিন্ ধাতিন্ তাং
তাতাক্ ধাতিন্ ধাতিন্ তাং
২.
ধাতিন্ তাতাক্ ধিনদা ধাতিন্ তাং তাং
৩.
কাঠি নাচ করিতে সবে রে,
ভাইরে ভাইরে, না করিও হেলা;
কিবে না করিও হেলা;
সকল খেলার বড় খেলা রে-
ওরে মোদের ভাই,
কাঠি নাচের খেলা-
কিবে কাঠি নাচের খেলা।।
৪.
কাঠি সামালো, রে ভাই, কাঠি সামালো-
চোখে মুখে লাগে যদি রে,
ওরে মোদের ভাই,
নাম দোষ নাই-
সবে কাঠি সামালো।।
৫.
বাবুদের বাড়ীতে, হায়রে হায় কিবে
শঙ্খ-চিলের বাসা-
কিবে শঙ্খ-চিলের বাসা,
ছোঁ মেরে নিয়ে গেল রে,
ওরে রইল আশা-
কিবে মনে রইল আশা।।
রায়বেঁশে নৃত্য
বাংলার জাতীয় নৃত্যের মধ্যে রায়বেঁশে নৃত্যই সর্বাপেক্ষা গৌরবময়। এক সময় এই নৃত্য
বাংলার পদাতিক সৈন্যরা অনুশীলন করত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যের পৌরুষব্যঞ্জক
ভঙ্গী ও কলাগৌরব দেখে মুগ্ধ হয়ে লেখেন, "এ'রকম পুরুষোচিত নাচ দুর্লভ। আমাদের দেশের
চিত্তদৌর্বল্য দূর করতে পারবে এই নৃত্য।" যুদ্ধের উত্তেজনা ও মাদকতার আবহাওয়ায় এই
নৃত্য পরিপূর্ণ। এই নৃত্যে সামরিক কুচকাওয়াজের ন্যায় বহু ভঙ্গী আছে এবং বাহু ও
হস্তের হাবভাব দ্বারা ধনুশ্চালনা, অসিচালনা, বর্শা নিক্ষেপ, অশ্বচালনা, রণ-পায়ের
ভঙ্গী প্রভৃতির নির্দেশ করা হয়। কখনও কখনও একজনের কাঁধের উপর আর একজন দণ্ডায়মান হয়ে
নৃত্য করে থাকে। প্রাচীন বাংলায় ও ভারতে যুদ্ধের পর বিজিত বন্দীর কাঁধের উপর
দাঁড়িয়ে নৃত্য করার প্রথা ছিল। এটা সেই প্রাচীন প্রথারই ধারাবহিক আচার।
রায়বেঁশে নৃত্যের শেষে বহু প্রকার কসরৎ হয়ে থাকে। যথা, দাঁড়িপালস্না, তালগাছ,
হনুমান ডন্, ব্যাঙভাসা, পালট্, লাঠিখেলা ইত্যাদি। উপরোক্ত কসরৎগুলি খুবই
উচ্চাঙ্গের ব্যায়াম এবং বর্তমান পাশ্চাত্য দেশের জিমনাস্টিক থেকে কোন অংশে কম নয়।
রায়বেঁশে নৃত্যে ঢোল ও কাঁসির ব্যবহার অপরিহার্য। এই নৃত্যে ধুতিকে মালকোঁচা
(আঁটোসাঁটো) করে লাল শালুকে ধুতির উপর বাঁধতে হয় এবং উন্মুক্ত শরীরে নৃত্যানুষ্ঠান
করতে হয়।
রায়বেঁশে নৃত্যের বোল
১। দ্রুত লম্ফনে প্রবেশ ও দিক্বন্দনা
ঘিউর গিজ্জা ঘিউর গিজ্জা .........
(উর্র) ঘিনিতা ঘিনিতা তা তা তা (ইয়া)
(উর্র) জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ-তা তা তা তাতাক্ তা
২। ধনুশ্চালনার ভঙ্গি
ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা-তিলিতা তা তা (২) (উর্র)
ঝাঁউর গিজার গিজি ঘিনি-
৩। সামরিক কসরৎ
(উর্র) ঘিনাক্ তাকুর কুরতা, কুরা কুরাক্ তাকুর কুরতা-
ঘিনাক্ তাকুর কুরতা, কুরা কুরাক্ তাকুর-
তাকুকুর, তাকুকুর, কুরা কুর তা-কুরাকুর তা-কুরা কুর তা- কুরাকুর কুরা-
গিজাঘিন্-গিজাঘিন্-গিজা ঘিন্-তা-
জাঘিন্ ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ, জাঘিন্ তা তা তা তা
জাঘিন্ ঝাঁ জাঘিন্ তা (২)
জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ, তা তা তা তাতাক্ তা (ইয়া)
(উর্র) ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা-তিলিতা-তিলিতা তা তা (২)
ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনি
৪। অশ্বচালনার ভঙ্গি
(উর্র) তাতাক্ তাতাক্ তাতাক্ তা, তাক্তা খিতা খিতা
ঝাঁ জাঘিন্ ঘনা তা
তাতাক্ তাতাক্ তাতাক্ তা, তাক্তা খিতা খিতা
ঝাঁ জাঘিন ঘিনা তা
তাগক তাতাক তাতাক তা,
তাকতা খিতা খিতা,
ঝাঁ জাঘিন্ ঘিনা-
ঘিনা ঘিনা ঘিনা ঝাঁ ঝাঁ, ঘিনা ঘিনা ঘিনা তা তা
জাঘিন্ ঝাঁ জাঘিন্ তা (২)
জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ, তা তা তা তাতাক্ তা (ইয়া)
(উর্র) ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা-তিলিতা-তিলিতা তা তা (২)
ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনি
৫। ভলস্ননিক্ষেপ ভঙ্গি
(উর্র) ঘিনাক্ তাতাক্ তাক্তা, উর্র তাক্তা খিতা তাক্তা (২)
জঘিন্ ঝাঁ জাঘিন্ তা (২)
জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ, তা তা তা তাতাক্ তা (ইয়া)
(উর্র) ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা-তিলিতা-তিলিতা তা তা (২)
ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনি
৬। রণ-পা আরোহণের ভঙ্গি
(উর্র) ঝাঁউর ঘিনাক্ তা তা তা, ঝাঁউর ঘিনাক্ তা তা তা
জাঘিন্ ঝাঁ জাঘিন্ তা (২)
জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ, তা তা তা তাতাক্ তা (ইয়া)
(উর্র) ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনিতা-তিলিতা-তিলিতা তা তা (২)
ঝাঁউর গিজার গিজা ঘিনি
৭। অসিচালনার ভঙ্গি
(উর্র) ঘি ঠক্ ঠক্-ঠক্ ঠক্ গিজার ঝাঁ (২)
ঠঠক্ ঠঠক্ ঠঠক্ ঠক্ (উর্র)-ঠক্ ঠকা ঠক্ ঠঠক্
ঠক্-ঠঠক্ ঠক্ ঠক্-ঠক-ঠঠক্ ঠক্ ঠক্
(উর্র) ঘিনাক্ ঘিনাক্ (২)
জাঘিন্ জাঘিন্ জাঘিন্ ঝাঁ
তা তা তা তাতাক্ তা (ইয়া)
ব্রতচারী বিজ্ঞান
উপরে যে সাঙ্কেতিক পরিরচনাটি ছাপানো হয়েছে, এটা বাংলার ব্রতচারীর ব্যক্তিগত ও
সঙ্ঘগত বিচিহ। এতে ব্রতাচরীর পাঁচটি সাঙ্কেতিক চিহ সন্নিবেশিত আছে। মাঝখানে জ্ঞানের
প্রদীপ; দুই পার্শ্বে প্রতীক কোদাল ও কুঠার; মধ্যভাগে সত্যের সরল পথসূচক রেখা ও
ঐক্যের গ্রন্থি এবং এগুলিকে ধারণ করে রয়েছে আনন্দের লহরী। আবার কোদাল ও কুঠারে
দুইটি 'ব' আঁকা আছে; এই 'ব-ব' সূচনা করেছে 'বাংলার ব্রতচারী'। বিচিহের নীচে আছে
'জ-সো-বা'; উহার অর্থ-জয় সোনার বাংলার।
কোন অভিষ্ট সিদ্ধির জন্য মনে দৃঢ় পবিত্র সংকল্প গ্রহণ করে একাগ্রচিত্তে সেই
সংকল্পকে কার্য্যে পরিণত ক'রে তুলবার কায়মনোবাক্যে চেষ্টার নামই ব্রত। যে পুরুষ,
নারী, বালক বা বারিকা এরকম কোন সংকল্প মনে গ্রহণ ক'রে তাকে একাগ্রচিত্তে পালন করাই
নিজের কর্তব্য মনে করেন এবং সেই ভাবে আচরণ করেন, তাঁকে আমরা ব্রতচারী বলি। এই হ'ল
ব্রতচারীর সাধারণ অর্থ। কিন্তু আমরা ব্রতচারী কথাটাকে একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার
করেছি। এখানে যে ব্রতের কথা আমরা বুঝি, তা জীবনের যে-কোন একটা বিশেষ অভিষ্ট-সিদ্ধির
ব্রত নয়। মানুষের জীবনকে সব দিক থেকে সকল প্রকারে সফল, সার্থক ও পূর্ণতাময় ক'রে
তোলবার অভীষ্ট নিয়ে যাঁরা ব্রত ধারণ করেন, ব্রতচারী বলতে আমরা এখানে তাঁদের কথাই
বুঝব। এর চেয়ে বড় বা ব্যাপক অভীষ্ট সংসারে মানুষের হ'তে পারে না।
মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ সার্থক, ও পূর্ণতাময় ক'রে তোলবার, অভীষ্ট সিদ্ধি করবার
জন্য যে পূর্ণব্রত গ্রহণ করা হবে, সেই পূর্ণ ব্রতটিকে আমরা পাঁচ ভাগে অথবা পাঁচটি
ভিন্ন ভিন্ন ব্রতে বিভক্ত করেছি। সেগুলি এই : জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য ও আনন্দ।
সংক্ষেপে জ্ঞা-শ্র-স-ঐ-আ। ব্রতচারীর এই পাঁচটি ব্রত অথবা পঞ্চব্রত। এই পাঁচটি
ব্রতের সমষ্টিকেই আমরা মানুষের পূর্ণাদর্শের জীবন-ব্রত বলে ধরে নিতে পারি। যিনি এই
পাঁচটির প্রত্যেকটি একসঙ্গে পালন করতে দৃঢ় সংকল্প করেছেন এবং জীবনে কায়মনোবাক্যে এই
পঞ্চব্রত পালন করবার জন্য সরলভাবে চেষ্টা ক'রে থাকেন, সেই পুরুষ, নারী, বালক বা
বালিকাকেই আমরা বলি ব্রতচারী।
সুতরাং এই অর্থে, সকল দেশের পুরুষ, নারী, বালক, বালিকাই ব্রতচারীর আদর্শ গ্রহণ করতে
পারেন এবং শুধু তাই নয়, প্রত্যেকেরই গ্রহণ করা উচিত। এই আদর্শ পালনের দুটো দিক আছে।
একটা ব্যক্তির নিজের দিক দিয়ে- নিজের জীবনকে অর্থাৎ নিজের চরিত্রকে, চিন্তাকে,
কর্মকে ও দেহকে পূর্ণ ক'রে তোলবার দিক থেকে। আর একটা হচ্ছে, সমগ্র মানুষের দিক
থেকে-নিজের চিন্তা, কর্ম ও আচরণের দ্বারা অপর একটা হচ্ছে, সমগ্র মানুষের জীবনকে
সফল, সার্থক ও পূর্ণতাময় ক'রে তোলবার যে কর্তব্য তা পালন করবার চেষ্টার দিক থেকে;
অর্থাৎ ব্রতচারীর আদর্শের দুটো মুখ থাকবে। একটা হচ্ছে ব্যক্তি-মুখ আর একটা সমাজ
অথবা সমষ্টি-মুখ। এই দু'মুখী আদর্শ সম্পূর্ণভাবে যে ফুটিয়ে তুলতে পারবে সে-ই হবে
সত্যকার এবং সফলতাবান ব্রতচারী এবং এই অর্থে প্রত্যেক ব্রতচারীই নিজেকে সমগ্র
বিশ্বের পৌরজন বলে মনে করতে পারেন।
কিন্তু ব্রতচারীর সমষ্টি-মুখ আদর্শ পালনের বেলা এটা ভুললে চলবে না সমগ্র মানবজাতির
অথবা মানব সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হ'রে তার আগে প্রত্যেক মানুষকে তার
কর্তব্য পালন করতে হবে সেই ভূমি বিশেষের বা দেশ বিশেষের প্রতি- যে ভূমি বিশেষের বা
দেশ বিশেষের সে অধিবাসী এবং যে ভূমি বিশেষের বা দেশ বিশেষের লোকের সঙ্ঘবদ্ধ চেষ্টার
ফলে সে তার জীবনে সুখ, শান্তি, শিক্ষা, অর্থ ইত্যাদি লাভ করবার সুযোগ পেয়েছে বা
পাওয়ার আশা রাখে এবং যে ভূমির বিশিষ্ট ছন্দের সে প্রকাশ অভিব্যক্তি বা
'ব্যক্তি-স্বরূপ' সেই আদর্শ বা আচরণকে ডিঙ্গিযে সে যদি বিশ্বের অন্যান্য ভূমির
মানুষের প্রতি আদর্শ আচরণ করতে চায়, অথবা অন্য ভূমির ধারার প্রকাশ করতে চায়, তবে সে
সত্যকার বিশ্ব ব্রতচারী হ'তে পারবে না। এটা যেমন বিশ্বের দিক থেকে বলা হয়েছে, এই
রকম একটা মহাদেশের বা মহাভূমির দিক থেকেও বলা চলে। ধরা যাক, যেমন ভারতবর্ষের কথা;
ভারতবর্ষ একটা মহাদেশ বা মহাভূমি। তার মধ্যে অনেকগুলি বিশেষ দেশ বা ভূমি আছে যার
ভিতর বাংলাভূমি একটা বিশেষ ভূমি, যে ভূমির বিশিষ্ট ছন্দ সংস্কৃতির অর্থাৎ ছন্দধারায়
বহন ও অভিব্যক্তি করে, বাংলার পুরুষ, মেয়ে, বালক, বালিকা নির্বিশেষে প্রত্যেক
ব্যক্তির নিজেকে কৃতার্থ মনে করা উচিত এবং যে ভূমির অধিবাসী, সমগ্র লোকের প্রতি তার
কর্তব্য পালনের আদর্শ তাকে মেনে চলা উচিত। প্রত্যেক ভারতবাসীর উচিত ব্রতচারীর আদর্শ
পালন করা; কিন্তু তাই বলে সে যদি ভারতবাসীর প্রতি তার কর্তব্যকে ভারতের স্ব-ছন্দ ও
স্ব-ধারাকে অবজ্ঞা করে ও অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি ধারা অনুযায়ী কার্যকলাপ ও
অন্যান্য দেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করতে চায়, তা হ'লে সে যেমন সত্যকার
ব্রতচারী হ'তে পারে না, সেই রকম প্রত্যেক বাঙ্গালী যদি বাংলাভূমির ভাব-ধারার ও
ছন্দ-ধারার অভিব্যক্তি স্বরূপ হয়ে বাঙ্গালী হিসাবে নিজের চরিত্র, মন, শরীর ও
কর্মপদ্ধতি গঠন ক'রে বাংলার বিশিষ্ট সংস্কৃতি ধারার প্রতি এবং বাংলার সমগ্র
অধিবাসীদের প্রতি তার কর্তব্য পালনের ব্রত নিয়ে প্রথমে বাংলার ব্রতচারীর আদর্শ
গ্রহণ ও নিজে তাতে সিদ্ধিলাভ না করতে পারে, তবে তার ভারত-ব্রতচারী বা
বিশ্ব-ব্রতচারী হবার স্পর্ধা ধৃষ্টতা মাত্র।
সুতরাং বাংলার মানুষকে ও বাংলাভূমিকে যদি সফল ও সার্থক হতে হয় তবে বাংলার অধিবাসী
প্রত্যেক পুরুষ, মেয়ে, বালক, বালিকাকে প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ হ'তে হবে বাংলার ব্রতচারী
অর্থাৎ বাংলাভূমির অধিবাসীর জীবনের পূর্ণাদর্শপালক মানুষ।
একদিকে যেমন ব্রতচারীর পঞ্চ-ব্রতের আদর্শ সার্বজনীন এবং এই পঞ্চব্রত সমগ্র
বিশ্বমানবের সাধারণ আদর্শস্বরূপ গণ্য হয়ে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে ঐক্যগ্রন্থিতে বদ্ধ
করে সঙ্ঘবদ্ধ চেষ্টায় উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে, তেমনি আবার দেশ ও কালের
পারিপার্শ্বিক অবস্থাভেদে ব্রতচারীর কৃত্যের অর্থাৎ কর্তব্য কার্য্যের আদর্শ
বিভিন্ন হ'তে বাধ্য।
যাঁরা জাতিতে বাঙ্গালী নহেন তাঁরা যদি বাংলাদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বাস করেন,
বাংলাকে ভালবাসেন ও বাংলার সেবা করার জন্য আগ্রহান্বিত হন, তবে তাঁরাও বাংলার
ব্রতচারী হতে পারেন।
ভূমি-প্রেমের তিন উক্তি :-
"আমি বাংলাকে ভালবাসি"
"আমি বাংলার সেবা করব"
"আমি বাংলার ব্রতচারী"
বাংলার অল্পবয়স্ক ব্রতচারীগণকে পূর্বোক্ত ভূমিপ্রেমসূচক তিন উক্তি করতে হয়। কিন্তু
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভূমির প্রত্যেক ব্রতাচরীকে ভারতভূমির প্রতি এবং তার
সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের মানব সমাজের প্রতি কর্তব্যে উদ্বুদ্ধ হ'তে হবে। কারণ
ব্রতচারীর আদর্শ পূর্ণতা ও সর্বসংস্থিতি ময়। তাই কিশোর ব্রতচারীদের জন্য
ভূমি-প্রেমের তিন উক্তির একটি মধ্যম রূপ গ্রহণ করার বিধান হয়েছে।
যথা :-
"আমি বাংলাকে ভালবাসি; ভারতকে ভালবাসি"
"আমি বাংলার সেবা করব; ভারতের সেবা করব"
"আমি বাংলার ব্রতচারী; ভারতের ব্রতচারী"
বয়স্ক ব্রতচারীর ভূমি-প্রেমের তিন উক্তির রূপ হবে চূড়ান্ত ভাবে পূর্ণতাময়।
যথা :-
"আমি বাংলাকে ভালবাসি; ভারতকে ভালবাসি;
বিশ্বভুবনকে ভালবাসি"
"আমি বাংলার সেবা করব; ভারতের সেবা করব;
বিশ্বভুবনের সেবা করব"
"আমি বাংলার ব্রতচারী; ভারতের ব্রতচারী;
বিশ্বভুবনের ব্রতচারী"
কোন নায়কের সম্মুখে যে কোন ইচ্ছুক ব্যক্তি পূর্বোক্ত তিন উক্তি করলেই তাঁকে 'বাংলার
ব্রতচারী' সঙ্ঘভুক্ত করা যেতে পারে। কিভাবে এই উক্তিগুলি বলতে ও পঞ্চ ব্রত নিতে হয়
তা প্রত্যেক নায়ককে শিখিয়ে দেওয়া হয়। ব্রতচারী সঙ্ঘভুক্ত হবার পদ্ধতি এই অধ্যায়ের
শেষে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হ'ল। পোষক ব্রতচারীর সংক্ষিপ্ত ভুক্তি হ'তে পারে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, দেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাভেদে ব্রতচারীর কৃত্য বিভিন্ন হ'তে
বাধ্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে, 'জঙ্গলপানার নির্বাসন' বর্তমান কালে বাংলার
ব্রতচারীর পক্ষে অবশ্য কর্তব্য, কিন্তু যে যে দেশে জঙ্গলপানা নেই সেখানে এই কৃত্য
অনাবশ্যক, অতএব কর্মপদ্ধতির ও ভাষার বিভিন্নতা অনুসারেই ব্রতচারীকে নানা প্রাদেশিক
সঙ্ঘে ভাগ হ'তে হয়েছে। ব্রতচারী পরিচেষ্টা পঞ্চ ব্রতের মধ্য দিয়ে সর্বত্র বিশ্বের
মানব সমাজের ঐক্য ও সখ্য আনয়ন করবে। কিন্তু মূলতঃ সম্পূর্ণ এক ও অবিভক্ত থেকেও
জীবনের পূর্ণতালাভের জন্য দেশ ও কালের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পণ গ্রহণ ক'রে ভিন্ন
ভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন ব্রতচারী সঙ্ঘ গড়বে। সব দেশের ব্রতচারীর পঞ্চ ব্রত একই
থাকবে। কিন্তু দেশ ও অবস্তা-ভেদে এই পঞ্চব্রত-মূলক কর্তব্র পালনের পণের পার্থক্য
থাকবে।
বাংলার ব্রতচারীর জন্য নিম্নের ষোল পণ অথবা কর্তব্যসূচক উক্তি নির্দিষ্ট হয়েছে।-
ব্রতচারীর ষোল পণ
সযত্নে অনুসরণ
এই ষোল পণ ছাড়াও ছয়টি অতিরিক্ত পণ নির্ধারিত হয়েছে-
বাংলাদেশে বর্তমান কালে সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন গড়তে হ'লে ষোল পণের প্রত্যেকটি এবং
অতিরিক্ত পণ ছয়টি সর্বপ্রযত্নে পালন ক'রে চলতে হবে। ব্রতচারীর প্রথম ও প্রধান
কর্তব্য-প্রত্যেকটি পণ, মানা, প্রণিয়ম সযত্নে মনে রাখা।
পণ-পালন ছাড়া আবার অন্য দিকেও নজর রাখবার দরকার আছে। অনেকগুলি রীতি আমাদের সামাজিক
ও ব্যক্তিগত জীবনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়ে জীবনের সুগঠনের পথে প্রতিবন্ধকতা করে। রীতিমত
পণ-পালন কররেও অনেক সময় এদেরেই জন্য যথোপযুক্ত উন্নতি হয় ন। অতএব আদর্শ মানুষ হওয়ার
জন্য পণ নিয়ে যখন অগ্রসর হব, তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে পথের বাধাগুলিও নির্মমভাবে নষ্ট
করে চলব। এই জন্য ব্রতচারীকে বাধা দুর করবার প্রতিজ্ঞাও গ্রহণ করতে হয়। এইগুলি
ব্রতচারীর মানা। বাংলার ব্রতচারীর সতেরো মানা-
* নারী ব্রতচারীর পক্ষে প্রথম ও তৃতীয় মানার পরিবর্তিত রূপ-
প্রথম মানা কো মল হয়েও গলিব না
তৃতীয় মানা ভু লি গৃহ কাজ ধাইব না
বাংলার সকল ব্রতচারী (নারী, পরুষ, বালক ও বালিকা) সংক্ষেপতঃ ব-ব নামে অভিহিত হন।
আবার তাঁদের মধ্যে যাঁদের বয়স কম, তারা ছোট ব্রতচারী সংক্ষেপতঃ ছো-ব। ছোট ব্রতচারীর
জীবনে জটিলতা কম, তাদের জীবন অপেক্ষাকৃত সহজ; ছো-ব'র পণ মাত্র বারোটি-
নিজেকে ব্রতচারী বলবার অধিকারী হ'তে হ'লে প্রত্যেক ব্রতচারীকে পূর্বোক্ত সকল পণ ও
মানা সযত্নে মনে রাখতে হবে। পণ ও মানা ছাড়া ব্রতচারীকে কয়েকটি প্রণিয়ম গ্রহণ করতে
হবে। সেগুলি ধারাবাহিক ভাবে নিম্নে দেওয়া হল।
ব্রতচারী জীবনের ক্রমবৃদ্ধি স্বীকার করেন; কারণ ক্রমবৃদ্ধি না মানলে জীবনকে
অস্বীকার করা হয়। ব্রতচারীর ক্রমবৃদ্ধির কামনা-
সর্বাঙ্গীণ পূর্ণ জীবন গঠনই ব্রতচারীর উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যের সফলতাকলেস্ন
ব্রতচারীর আজীবন যে চতুর্বিধ আদর্শ থাকা প্রয়োজন তাকে বলা হয় ব্রতচারী চতুবর্গ-
ব্রতচারীর সর্বপ্রধান লক্ষ হবে চরিত্রের দিকে। কারণ বনিয়াদ দৃঢ় না হ'লে যেমন তার
উপর ইমারত টেকে না, তেমনি চরিত্র দৃঢ় না হ'লে জীবন গঠনের সমস্ত চেষ্টাই বৃথা।
ব্রতচারী চরিত্রবান হয়ে সমস্ত কৃত্যগুলি সম্পাদন করেন; তারপর সঙ্ঘ অর্থাৎ
মিলনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। তারপর নৃত্যের অনাবিল আনন্দস্রোতের মধ্যে আত্মা মুক্তি পাবে,
জীবন সেই সময়েই পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠবে। তাই ব্রতচারীর সাধনা পর্যায়-
অতএব দেখা যাচ্ছে, ব্রতচারীর সর্বশেষ সাধনা নৃত্য। নৃত্য না করলে জীবনকে পূর্ণতম
করা যায় না; নৃত্যের অভাবে পঞ্চব্রতের শেষ ব্রত 'আনন্দ' অঙ্গহীন হয়। কিন্তু অসমর্থ
হ'লে নৃত্য না করলেও ব্রতচারীর চলতে পারে। কৃত্য ও নৃত্য নিয়ে ব্রতচারীর জীবনের
পূর্ণ-বৃত্ত। নৃত্য না করলেও কৃত্য চলতে পারে, কিন্তু যিনি কৃত্য না করবেন তিনি
নৃত্যের অধিকারী নন এবং তিনি ব্রতচারী আখ্যা লাভের সম্পূর্ণ অযোগ্য।
কিন্তু ব্রতচারীর নৃত্যের স্বরূপ ও প্রকৃতি সাধারন নৃত্য থেকে বিভিন্ন; তাই
ব্রতচারী নৃত্যের স্থান কৃত্যের মধ্যে
ব্রতচারী-প্রণালীর মধ্যে আছে দেশের মানুষের সেবা, বিশ্ব-মানবসেবা, তরুণতা ও
সদানন্দময়তা, দেহের পূর্ণ বিকাশ, মনের পূর্ণ সাধনা ও মুক্তি এবং চরিত্রের, কৃত্যের
ও সঙ্ঘের সাধনামূলক পণ-পালন-এই সকল আদর্শের পূর্ণ সমন্বয়। 'ব্রতচারী শব্দটাকে
'ব্র', 'ত', 'চা', 'রী'- এই চার অক্ষরে ভাগ ক'রে প্রত্যেকটির বিভিন্ন অর্থ দিয়ে
ব্রতচারী তাঁর জীবনের এই বহু আদর্শের সমন্বয়ে পরিচয় দেন।
ব্রতচারী প্রণীতি
তিন উক্তি; পণ, মানা, প্রণিয়ম ও সংকল্প ব্রতচারী অন্তর্গত। ইহা ছাড়াও ব্রতচারীর
কয়েকটি প্রণীতি আছে; সেগুলি নিম্নে প্রদত্ত হল।
ব্রতচারীর বাংলা-প্রেম
বাংলাভাষী সকল মানুষ আমার পরম ইষ্ট
আমার প্রাণের গভীর প্রিয় বাংলাতে যা সৃষ্ট
ব্রতচারীর ভারত-প্রেম
ভারতবাসী সকল মানুষ আমরা পরম পরম ইষ্ট
আমার প্রাণের গভীর প্রিয় ভারতে যা সৃষ্ট
বাংলার ধারা-বহন
ব্রতচারী বাংলার ধারাবহ বিন্দু
ধারা প্রবাহিত রেখে চ'লে যাবে সিন্ধু।
মন ও কাজ
মন যার বড় তার কোন কাজ ছোট নয়
মন যার ছোট তার সব কাজ ছোট হয়।
খাওয়া ও বাঁচা
খাওয়ার জন্য বাঁচি না মোরা বাঁচার জন্য খাই
সে জন অতীব মূর্খ যে করে বেশী খাওয়ার বড়াই
আরো খাও বলে খেতে সাধাসাধি করে যে
প্রিয়জন-পরমায়ু পরিণামে হরে সে।
উচ্ছিষ্ট নিয়ম
উচ্ছিষ্ট ভূঁয়েতে নয়
পাত্রে ফেলিতে হয়।
সভার শিষ্টাচার
যেথা কোন সভা হয়
সেথা সবে মৌন রয়
সভার মৌনতা অভ্যাস
কাকে করে কা-কা
মানুষ মৌন হ'য়ে যা।
দাঁত মাজা
ব্রতচারী মাজে দাঁত
উঠে ভোরে, পুনঃ রাত।
দু'বেলা না মাজলে দাঁত
করবে পরে অশ্রুপাত।
হবে জয় নিশ্চয়
মনে ভয় কর লয়-
হবে জয়।-নিশ্চয়!
ব্রতচারীর পঞ্চ বর্জন
রাগ ভয় ঈর্ষা লজ্জা ঘৃণা
পাঁচ দোষ ব্রতচারী বিনা।
ব্রতচারীর কর্মাগ্রহ
ব্রতচারী করে কাজ
বিনা ঘৃণা বিনা লাজ।
ব্রতচারিতার কার্য্য
কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য্য
দমন-সাধনা ব্রতচারিতার কার্য্য।
ব্রতচারীর নির্লিপ্ততা
ফল-নিন্দা-সুখ্যাতি-বিরাগী
ব্রতচারী কৃত্য-অনুরাগী।
ব্রতচারী ভুক্তির পদ্ধতি
১। ভূমি-প্রেমের তিন উক্তি
২। ব্রতচারীর পঞ্চ-ব্রত অনুসরণ
জ্ঞান-ব্রত অনুসরণ
শ্রম-ব্রত অনুসরণ
সত্য-ব্রত অনুসরণ
ঐক্য-ব্রত অনুসরণ
আনন্দ-ব্রত অনুসরণ
জ্ঞান-ব্রত শ্রম-ব্রত সত্য-ব্রত ঐক্য-ব্রত আনন্দ-ব্রত অনুসরণ
জ্ঞা-শ্র-স-ঐ-আ
৩। আমি বাংলার ও ভারতের ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা লইব
বাংলার ব্রতচারী পরিচয় প্রতিজ্ঞা আবৃত্তি
৪। আমি ব্রতচারী ষোলপণ লইব
ষোলপণ আবৃত্তি
জ্ঞা-জ-শ্র-স আ-গ-জ-গ ব্যা-না-বি-শি স-সে-সং-আ
অতিরিক্ত পণ আবৃত্তি
অ-প্র-নে-ত্যা-নি-সু
৫। আমি বাংলার ব্রতচারীর সতেরো মানা লইব
সতেরো মানা আবৃত্তি
কোঁ-খি-ভূ-খি আ-ব-বি-রা দু-দে-অ-অ দৈ-চে-বি-ভি-ক
৬। ব্রতচারীর বৃত্ত-
ব্রতচারীর নৃত্যের স্থান
ব্রতচারীর দৈনিক কৃত্য
ব্রতচারীর চতুর্বর্গ
ব্রতচারীর সাধনা-পর্যায়
ব্রতচারীর ক্রম-বৃদ্ধি
ব্রতচারীর বাক্-সংযম
ব্রতচারী কণ্ঠ-সংযম
ব্রতচারী মান-অপমান
ব্রতচারী বেকারী-বর্জন
ব্রতচারীর অন্তঃশুদ্ধি
৭। 'ছো-ব'র পণ আবৃত্তি
ছু-স-গু লি-জী স-স হা-স দ-গা-আ
৮। ব্রতচারী-বিেিহর ব্যাখ্যা
সংঘ আরাব এবং 'ই-আ' ও 'জ-সো-বা'র ব্যাখ্যা
(ই = ইষ্ট; আ = আভাষণ; 'জ-সো-বা' = জয় সোনার বাংলার)
৯। বিচিহ দান
১০। 'ই-আ'-'জ-সো-বা'
১১। ব্রতচারীর সংকল্প
ব্রতচারীর ষোল আলি
'আলি' কথাটি একটি ব্রতচারী পরিভাষা। ইহা 'ক্রিয়া' অথবা 'অনুষ্ঠান' অর্থে ব্যবহৃত
হয়। ব্রতচারীর জীবনের সমগ্র অনুষ্ঠান ষোলটি আলিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলি
ব্রতচারীর সাধনার একান্ত অঙ্গীভূত অনুষ্ঠান। এই ষোলটি আলি নিয়মিতভাবে ব্যক্তিগত ও
সংঘগত সাধনার ফলে ব্রতচারীরা নিজ নিজ জীবন ও জাতীয় জীবন গঠিত করবার চেষ্টা করবেন।
মূল আলির অনেকগুলির আবার একাধিক শাখা-আলি আছে।
"ব্রতচারী অনুষ্ঠান 'আলি'-বদ্ধ-মূল
মূলালির সংখ্যা ষোল, শাখালি বহুল"
প্রত্যেক আলির প্রতি মাসে বহুবার নিয়মিত সাধনা প্রত্যেক ব্রতচারী সংঘের কর্তব্য।
সপ্তাহে অন্ততঃ একবার মূলালির সংঘবদ্ধ সাধনা অবশ্য কর্তব্য।
"মাসে মূলালির বহু পর্ব
ব্রতচারী-সংঘের গর্ব"
মূলালি
আবৃত্তি এবং কণ্ঠস্থ করার সুবিধার জন্য মূলালির আদ্যক্ষর তালিকা-
আ-কৃ-স-ক্রী ম-বী-সে-শি জ্ঞা-চা-দ-সং ফৌ-ক-ভ্র-কৌ
মূলালির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও কতিপয় শাখা আলির নির্দেশ
১। আবৃত্তালি
সংযত চিত্তে অখ- মনোযোগ সহকারে উক্তি, ব্রত, পণ, মানা, প্রণিয়ম, প্রণীতি, সংকল্প
প্রভৃতি ছন্দোবদ্ধ আবৃত্তি সাধনা। কায়মনোবাক্যে এইরূপ নিয়মিত সাধনার ফলে ঐগুলি
মনোবৃত্তির অঙ্গীভূত হবে এবং আত্মগঠনের সহায়তা করবে।
২। কৃত্যালি
ব্যাপক অর্থে কৃত্যালির ভিতর অ্যান্য অনেক আলিই পড়তে পারে, কিন্তু এ স্থলে
অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ অর্থেই কৃত্যালি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যে কাজে, ব্যক্তি বিশেষের
নয়- সাধারণের উপকার হয় সেই শ্রেণীর কাজের দলবদ্ধভাবে সাধনাকে কৃত্যালি আখ্যা দেওয়া
যায়।
ব্রতচারীর দৈনিক কৃত্য
'পরহিতে কিছু শ্রম নিত্য
ব্রতচারীর অবশ্য-কৃত্য'
প্রতিদিন যথেষ্ট সময় না পেলে অন্ততঃ কয়েক মিনিটের জন্যও প্রত্যেক ব্রতচারীর পরহিতে
বা জনহিতে কোন না কোন কৃত্য সাধনা করা অবশ্য কর্তব্য।
নিয়মিত কৃত্যালির অনুষ্ঠান
প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে এক নির্দিষ্ট দিনে ব্রতচারীগণ একত্রিত হয়ে
কৃত্যালি-উৎসব সম্পন্ন করবেন। পুরাতন রাস্তা মেরামত, নূতন রাস্তা নির্মাণ,
পয়ঃপ্রণালীর উন্নতি সাধন, জঙ্গল পরিষ্কার, পুকুরের পানা পরিষ্কার,
ম্যালেরিয়া-নিবারক কাজ, নিরক্ষরদের মধ্যে শিক্ষারিবস্তার প্রভৃতি কৃত্যালির
অঙ্গীভূত। পল্লী উন্নয়ন ও আত্মগঠনের পক্ষে কৃত্যালির বিশেষ প্রয়োজন।
৩। সঙ্গীতালি
ব্রতচারী নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সুসমঞ্জস সাধনা। নৃত্যালি, গীতালি ও বাদ্যালি ইহার
বিভিন্ন শাখা।
সাহিত্য-সঙ্গীত-কলাবিহীনঃ
সাক্ষাৎ পশুঃ পুচ্ছ-বিষাণহীনঃ
(ভর্তৃহরি-নীতিশতক)
তাৎপর্য
সঙ্গীত অর্থাৎ নৃত্য, গীত ও বাদ্য-এই তিনটিই সাধনা শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ;
কারণ এগুলির সাধনা ব্যতীত মানুষ পশুত্ব অতিক্রম করে মনুষ্যত্বে পৌঁছাতে পারে না;
ব্রতচারী নৃত্য, গীত ও বাদ্যের মধ্যে কোন একটি বাদ দিলে সাধনা অপূর্ণ থাকে। সুতরাং
ব্রতচারীরা তিনটিরই শিক্ষায় যত্নবান হবেন।
৪। ক্রীড়ালি
শাখালি- (ক) স্ব-ক্রীড়ালি (জাতীয় ক্রীড়ালি)
(খ) অন্য-ক্রীড়ালি
(ক) জাতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির অঙ্গীভূত সরল শ্রমমবহুল গ্রাম্য ক্রীড়া-অল্পায়তন
ক্ষেত্রে বিনা ব্যয়ে বা অত্যল্প ব্যায়ে যা খেলা যায়, সেগুলি স্ব-ক্রীড়া।
যথা- হা-ডু-ডু, নারিকেল কাড়াকাড়ি, দাড়িয়াবান্দা, গোলস্নাছুট, নোন্তা, বুড়ি-চু,
খো-খো, ডাণ্ডাগুলি, ল্যাংচা ইত্যাদি।
(খ) দেশের উপযোগী অন্যদেশীয় ক্রীড়া।
যথা- ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, বাস্কেটবল ইত্যাদি। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতামূলক
ব্যাপারও ইহার অন্তর্গত।
যথা-লম্ফনালি, ধাবনালি, ক্ষেপনালি।
স্ব-ক্রীড়া, শিক্ষার পর, অন্য-ক্রীড়ার অনুশীলন, ব্রতচারীদের হহা মনে রাখা দরকার।
৫। মলস্নালি
প্রধান শাখালি--
যষ্ট্যালি, কসরতালি, মুষ্ট্যালি, কুস্ত্ম্যালি, যুযুৎসালি, ব্যায়ামালি, যোগাসনালি
ইত্যাদি।
শরীরগঠনের ও আত্মরক্ষার জন্য এবং বিপন্নের উদ্ধারের পক্ষে মলস্নালি সাধনা বিশেষ
প্রয়োজনীয়। ইহাতে শরীর বলিষ্ঠ ও কর্মক্ষম হয় এবং বিপদে ধৈর্যহানি ঘটে না।
৬। বীরালি
"বীরালির উপাদান- সাহসালি, স্বরাজ্য,
দুষ্করালি, রক্ষণালি, শিষ্টালি ও সাহায্য।"
প্রধান শাখালি-
দুষ্করালি, সপ্রতিভালি, শিষ্টালি, সাহায্যালি, ত্যাগালি, রক্ষণালি, নির্বাণালি,
মগ্নোদ্ধারালি প্রভৃতি-দুর্বলের রক্ষণ ও শত্রুকেও নিজের কবলে পেয়ে ক্ষমা করা বীরের
কাজ। নিজের জীবন বিপন্ন করেও আর্তের উদ্ধার-সাধন বীরত্বের পরিচায়ক। বয়োবৃদ্ধের ও
নারীজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন বীরের পক্ষেই সম্ভব। আত্মসংযম ও তমোবৃত্তির দমন
দ্বারা অন্তশ্চরিত্র গঠন স্ব-রাজ্যের মূল অর্থ। বীরালির একটি প্রধান অঙ্গ ও লক্ষণ।
দুষ্কর কার্য সাধনা করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ও দলবদ্ধভাবে অভিযান করে বাধা-বিঘ্নে
ভ্রূক্ষেপ না করা বীরালির অঙ্গস্বরূপ।
৭। মানুষ, পশু-পক্ষী প্রভৃতির সস্নেহ সেবা; প্রশংসা বা প্রত্যুপকারের প্রত্যাশা না
রেখে আর্তের ও ইতর জীবের সেবা দুর্লভ আনন্দলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়।
রোগীর সেবা শুশ্রূষা করতে হলে রোগীর প্রতি সহানুভূতি, রোগ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং
রোগ শুশ্রূষা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা দরর্কা প্রাথমিক প্রতিবিধান, স্বাস্থ্যবিধি,
গৃহশুশ্রূষা প্রভৃতি বিধিবদ্ধভাবে শিক্ষা ব্রতচারী মাত্রেই কর্তব্য।
৮। শিল্পালি
শাখালি-চিত্রালি, সীবনালি ইত্যাদি।
স্বহস্তেসৌন্দর্য সৃষ্টি, ব্যবহারোপযোগী দ্রব্যের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপের
সহিত মনের অপূর্ব সমন্বয় এনে দেয়। দৈনন্দিন জীবনে যেগুলি প্রয়োজন, এরূপ শিল্পালির
চর্চা করা দরকার। যেমন- সেলাই-এর কাজ, বোতম তৈয়ারী, গামছা বোনা, রুমাল তৈয়ারী,
সামান্য ছুতোরের কাজ, সাবান তৈয়ারী ইত্যাদি। তা ছাড়া মানচিত্র অঙ্কন, মৃৎশিল্প,
কার্ডবোর্ডের কাজ, বই বাঁশের কাজ প্রভৃতি শিক্ষা করা ব্রতচারীর উচিত।
৯। জ্ঞানালি
'জ্ঞানের সীমা প্রসারণ'
'রোজ কিছু শিখ্ব।'
প্রতিদিন বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন। বিজ্ঞান, শিল্প, বাণিজ্য, ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ পাঠ,
পত্রিকা পাঠ ও গ্রন্থাগার স্থাপন; নূতন নূতন ভাষা ও বিভিন্ন জাতির সামাজিক তথ্য
প্রভৃতি শিক্ষা এবং নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন ব্রতচারীর কর্তব্য।
১০। চাষালি
'সবজী ফলের উৎপাদন!'
'গরুর পুষ্টি সম্পাদন।'
প্রধান শাখালি-কর্ষণালি, গো-সেবালি, উদ্যান-রচনালি।
আমাদের দেশ কৃষি প্রধান। কৃষির উন্নতি ব্রতচারীর বিশেষ কর্তব্যের অন্তর্গত। গো-সেবা
কৃষির সহিত সংশিস্নষ্ট। প্রত্যেক ব্রতচারীর গো-পালন বিষয়ক পুস্তক পাট এবং গরুর
পুষ্টি-সাধন করা উচিত।
নিজের হাতে কৃষিক্ষেত্রে লাঙ্গল চালনা, কোদাল চালনা, উদ্যান রচনা, ফল-ফুল সব্জীর
উৎপাদন ইত্যাদি অশেষ আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যপ্রদ। স্কুলের বাগানে ব্রতচারীরা পুঞ্জে
পুঞ্জে বিভক্ত হয়ে জমিতে কোদাল হাতে কাজ করবেন এবং নিজেদের সম্ভবমত বাগান করবেন।
অধিক ফসল জন্মানো ব্রতচারীরা কর্তব্য।
১১। দক্ষতালি
শাখালি-গ্রন্থ রচনালি, সন্তরণালি, রন্ধনালি, ধনুর্বিদ্যালি, অশ্বারোহণালি,
নৌচালনালি, আলোকচিত্রাবলী ইত্যাদির যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়ে দক্ষতা অর্জন ব্রতচারীর
কর্তব্য।
১২। সংধ্যানালি
প্রত্যহ কিছু সময় নীরবে একনিষ্ঠচিত্তে কোন বিষয়ে একা অথবা অনেকে একসঙ্গে গভীর
চিন্তা করা। এতে অন্তর্দৃষ্টি উন্মেষিত হয়, চিত্ত বলবান হয় ও আত্মার বিকাশ হয়।
সমবেতভাবে একই চিন্তায় মগ্ন থাকলে পরস্পরের আত্মার মিলনে উৎকর্ষ সাধিত হয়।
১৩। ফৌজালি
প্রধান শাখালি-দ--ফৌজালি, কোদাল-ফৌজালি, বাদনী-ফৌজালি, মার্জনী-ফৌজালি,
রিক্ত-ফৌজালি। মাতৃভাষায় ফৌজালি হুকুম আবশ্যক।
ব্রতচারী ফৌজালির উদ্দেশ্য শরীর গঠন নয়, সংনিয়ম ও অনুশৃঙ্খলার সাধনই এর মুখ্য
উদ্দেশ্য। কোথাও কৃত্যালি বা অন্য কার্য উপলÿ্যে যেতে হলে ফৌজালির প্রণালী অবলম্বন
করে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাই একান্ত প্রয়োজন। এতে ঐক্য আনয়ন করে এবং কর্মে আগ্রহ ও
শক্তি বৃদ্ধি হয়। এমন কি, একজনের বেশী ব্রতচারীর একসঙ্গে কোথাও যেতে হলে
সমপদ-বিক্ষেপে যাওয়া ফৌজালির মূলীভূত প্রণালী। সমগ্র জীবনকে একটি আধ্যাত্মিক ও
চারিত্রিক সংগ্রামক্ষেত্র মনে করে প্রত্যেক ব্রতচারীকে শান্তিসেনা বা ফৌজি-ব্রতচারী
সাজতে হবে। এজন্য ফৌজালির নিয়মাবলী দৈনন্দিন জীবনে পালন করা কর্তব্য। এতে শৃঙ্খলা ও
তৎপটুয়া এনে দেবে।
১৪। কথালি
নানাবিধ প্রয়োজনীয় বিষয়ে সুগ্রথিত চিন্তারাজির সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি, ভাবের
আদান-প্রদান, চিন্তাশক্তির উৎকর্ষ সাধন। অল্পকথায় মনের ভাব প্রকাশে দক্ষতা।
স্বাভাবিক কুণ্ঠার বিলোপ সাধন ও নির্ভীকতা অর্জন এর ফল। ব্রতচারীদের মধ্যে নানা
প্রয়োজনীয় বিষয়ে রীতিমত কথালির অনুষ্ঠান একান্ত কর্তব্য। প্রত্যেক বিষয়ে
বিশেষজ্ঞদের দ্বারা কথালির অনুষ্ঠানও বিশেষ প্রয়োজনীয়।
১৫। ভ্রমন্তালি
নানাস্থানে ভ্রমণ শিক্ষার একটি প্রকৃষ্ট পন্থা।
ঐতিহাসিক স্মৃতি সমৃদ্ধ স্থানে গমন ও প্রাচীন কীর্তির সন্দর্শন দ্বারা মনে স্বজাত্য
ভাব আসে, মন উদার হয়, নানা স্থানের সন্বন্ধে অভিজ্ঞতা জন্মে, লোক চরিত্র নির্ণয়ে
দক্ষতা আসে। যন্ত্রশিল্পের কলকারখানা সন্দর্শনেও অনেক মূল্যবান শিক্ষা হয়। এক মাইল,
দুই মাইল দূরবর্তী স্থানে এক সঙ্গে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে গিয়ে খেলাধূলা, নৃত্যালি,
কৃত্যালি ইত্যাদির সাধনা দ্বারা ব্রতচারীরা যথেষ্ট উপকার লাভ করতে পারেন।
গন্তব্যস্থানে অথবা গমনপথে অবস্থিত সংঘের সঙ্গে পূর্বে পত্র ব্যবহার করলে অনেক
বিষয়ে সুবিধা হতে পারে।
১৬। কৌতুকালি
অনাবিল আনন্দপূর্ণ রঙ্গ-আবৃত্তি, নির্মল কৌতুক, রসময় গল্প, বিভিন্ন চরিত্রের নিখুঁত
অভিনয় প্রভৃতি। এর উদ্দেশ্য 'আনন্দোৎসব সঞ্জীবন'- কঠিন শ্রমের পর আনন্দ-পরিবশেন।
এখানে "আলির" সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো। এগুলির রীতিমত অনুষ্ঠান দ্বারা ব্রতচারীগণ
ব্যক্তিগত জীবনে ও সংঘগত জীবনে ব্রতচারীর আদর্শ ফুটিয়ে তুলতে যত্নবান হবেন।
ব্রতচারীর পর্য্যায় বিভাগ
(অর্থাৎ বয়স এবং শিক্ষা অনুসারে ব্রতচারীগণের শ্রেণীবিভাগের নির্দেশ)
গৃহীত-ভুক্তি ব্রতচারীগণকে (ক) পোষ-ব অর্থাৎ পোষক ব্রতচারী এবং (খ) শীল-ব অথাৎ শীলক
ব্রতচারী এই পর্যায়ে বিভক্ত করা হবে। যাঁরা ভুক্তি গ্রহণ ক'রে ব্রতচারী আদর্শ পোষণ
করেন তাদের প্রথম পর্যায়ে এবং যে সকল নরনারী, বালকবালিকা সঙ্গীতালি, ব্যায়ামালি ও
কৃত্যালি ইত্যাদির অনুশীলনের ভিতর দিয়ে ব্রতচারী শিক্ষা ও সাধনা করবেন করবেন তাঁদের
দ্বিতীয় পর্যায়ে ভুক্ত করা হবে।
বয়সের তারতম্য অনুসারে পর্যায়ে বিভাগ :
বয়ঃক্রম অনুসারে ব্রতচারীগণ নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিভক্ত হবেন-
ক) শিশু-ব (শিশু-ব্রতচারী; ৩-৫ বৎসর)
খ) ছো-ছো-ব (ছোট হতেও ছোট ব্রতচারী; ৬-৮ বৎসর)
গ) ছো-ব (ছোট ব্রতচারী; ৯-১২ বৎসর)
ঘ) কিশো-ব (কিশোর ব্রতচারী; ১৩-১৬ বৎসর)
ঙ) যু-ব (যুবক ব্রতচারী; ১৭-৩৫ বৎসর)
চ) প্রেীঢ়-ব (প্রৌঢ় ব্রতচারী; ৩৬-৫৫ বৎসর)
ছ) প্র-ব (প্রবীণ ব্রতচারী; ৫৫ বৎসরের ঊর্ধে)
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্রতচারীদের অনুষ্ঠিতব্য
আলিগুলির সম্বন্ধে সাধারণভাবে নিদের্শ
শিশু-ব
আবৃত্তালি - ছো-ব'র পণের তিনটি- ১, ২ ও ১২
ক্রীড়ালি- গীতি-ক্রীড়া
ছো-ছো-ব
আবৃত্তালি- ভূমিপ্রেমের এক উক্তি; পঞ্চব্রত-বার পণ, ৩ মানা- ১, ৪ ও ১২; কৃত্যালি-
আপন বাড়ীর ও পাঠ-গৃহের পরিপাটিতা রচনা; গীতালি- কোদাল চালাই, সবার প্রিয়, আগুয়ান
বাংলা, বাংলা ভূমির মাটি, হা-খে-না-খা; ক্রীড়ালি- গীতিক্রীড়া; স্বক্রীড়া- হা-ডু-ডু
ইত্যাদি; মলস্নালি- সহজ রায়বেঁশে কসরৎ; ফৌজালি- প্রাথমিক পর্যায়; শিল্পালি-
মৃৎশিল্প, কার্ডবোর্ড ইত্যাদি।
ছো-ব
আবৃত্তালি- ভূমি-প্রেমের দুটি উক্তি, পঞ্চ ব্রত, বারপণ, বাক সংযম, ক্রমবৃদ্ধি,
দৈনিক কৃত্য; কৃত্যালি-জঙ্গল পানা পরিষ্কার ও পরিপাটিতা রচনা; গীতালি- অগ্রে চল,
জীবনোলস্নাস, বীর নৃত্য, হ'য়ে দেখ, সূর্যিমামা, নারীর মুক্তি ইত্যাদি;
বাদ্যালি-কাঁসি; নৃত্যালি- ঝুমুর, কাটি, বাউল, সারি; ক্রীড়ালি- স্ব-ক্রীড়া বা অন্য
ক্রীড়া; মলস্নালি- রায়বেঁশে কসরৎ; সেবালি- প্রাথমিক প্রতিবিধান, জনসাধারণের
স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য; শিল্পালি- মৃৎশিল্প ও কার্ডবোর্ড ইত্যাদি; ফৌজালি- যতটা
সম্ভব; ভ্রমন্তালি- শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সম্ভব হলে মাসে একদিন করে ভ্রমন্তালির
ব্যবস্থা।
কি-শো-ব
ছো-ব'দের অনুষ্ঠিতব্য সকল বিষয়; এবং
আবৃত্তালি-ভূমি-প্রেমের তিন উক্তি, পঞ্চ ব্রত, পণ মানা, প্রণীতি ও প্রণিয়ম সমস্ত;
কৃত্যালি-সেবালি, পল্লী স্বাস্থ্য; শুশ্রষালি-গো সেবালি, চাষালি, জঙ্গল পরিষ্কার,
কচুরীপানা নাশ, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত, জনসাধারণের স্বাস্থ্যরক্ষায় সাহায্য,
সমষ্টির স্বাস্থ্যরক্ষায় সাহায্য প্রভৃতি; নৃত্যালি-সমস্ত; বাদ্যালি-কাঁসি, মাদল
এবং বিশেষ পারদর্শীদের জন্য ঢোল ও গাবগুবা; ক্রীড়ালি-হা-ডু-ডু, নারকেল কাড়াকাড়ি এবং
অন্য খেলা। যথা-ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল ইত্যাদি; মলস্নালি-কসরৎ, কুস্ত্ম্যালি,
মুষ্ট্যালি, যুযুৎসালি ও নানাবিধ ব্যায়ামালি, লাঠিখেলা ইত্যাদি; সেবালি-প্রাথমিক
প্রতিবিধান, জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি; শিল্পালি-ঝুড়ি, মোড়া তৈয়ারী, বই
বাধাঁই, সাবান প্রস্তুত, বয়ন শিল্প ইত্যাদি; জ্ঞানালি-নানবিধ বিষয়ে জ্ঞানার্জন;
চাষালি-সব্জি বাগান, গো-সেবা; ফৌজালি-যতটা সম্ভব; ভ্রমন্তালি-সম্ভব হলে মাসে একবার;
কৌতুকালি-অভ্যাস করতে হবে।
যু-ব
ছো-ব'দের অনুষ্ঠিতব্য সকল বিষয়; এবং
আবৃত্তালি-ব্রত, পণ মানা, প্রণিয়ম সমস্ত; কৃত্যালি-সপ্তাহে অন্তত একবার, সম্ভব হলে
ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিন; গীতালি-ব্রতচারী সখার সকল গান; বাদ্যালি-ঢোল, কাঁসি, মাদল,
ঢাক, গাবগুবা; বাদনালি-ধামসা, তাসা, বাঁশি; নৃত্যালি-সমস্ত; ক্রীড়ালি-সকল রকমের
ক্রীড়া; মলস্নালি-সমষ্টি ব্যায়ামের জন্য আখড়া স্থাপন এবং দৈনিক নানাবিধ
ব্রায়ামানুশীলন; বীরালি-অগ্নিনির্বাপণালি, মগ্নোদ্ধারালি ইত্যাদি; সেবালি-প্রাথমিক
প্রতিবিধান, জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানাপ্রকার জনসেবার অনুষ্ঠান এবং
তদুদ্দেশ্যে মুষ্টিভিক্ষা প্রবর্তন; শিল্পালি-যতদূর সম্ভব ব্যাপক অনুষ্ঠান;
জ্ঞানালি-যতদূর সম্ভব ব্যাপক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে গ্রন্থগার স্থাপন ও ব্যবহার;
চাষালি-যতদূর সম্ভব ব্যাপক অনুষ্ঠান-"অধিক ফসল জন্মাও"; দক্ষতালি-যতদূর সম্ভব
ব্যাপক অনুষ্ঠান; ফৌজালি- সমস্ত অনুষ্ঠান-বিশেষ করে জাতীয় বাদনী সহ ফৌজালির অভ্যাস,
ভ্রমন্তালি-সম্ভব হলে সপ্তাহে একবার; কৌতুকালি-যতদূর সম্ভব। সংঘ গঠন ও পরিচালনা।
প্রৌঢ়-ব
অবস্থা ও স্বাস্থ্য অনুযায়ী যতদূর সম্ভব যুব-ব-দের অনুরূপ সংঘ সংগঠন ও পরিচালন।
প্র-ব
গীতালি-সবার প্রিয়, জ-সো-বা, ভারতমাতা, প্রার্থনা, আগুয়ান বাংলা, বাংলাভূমির দান,
আমরা বাঙ্গালী; জ্ঞানালি, চাষালি ও কথালি-যথাসম্ভব অনুষ্ঠান। সংঘ গঠন ও পরিচালন।
গানের সাজি
এই বিভাগে যে সব গান ছাপানো হ'ল সেগুলি আমার নিজের রচিত। দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়
অবলম্বন করে এইরূপ অনেকগুলি সমষ্টি-গীত আমি রচনা করেছি। এগুলিতে সূক্ষ্ণ কবিত্বের
রোমান্টিক (ৎড়সধহঃরপ) কল্পনাবিলাস ও ভাববিলাস অথবা সৌখিন শব্দ বিন্যাসের
লীলা-নিক্কন ফুটিয়ে তুলবার প্রয়াস করা হয়নি; কথার, ভাবের, ছন্দের ও সুরের প্রাঞ্জল
সমাবেশ করে এবং দৈনন্দিন জীবনের ধূলি-বালি-মাখা কাজের কথা দিয়ে এগুলিকে একটা সহজ
গতিভঙ্গির ছাঁচে ঢেলে এমনি করে সহজ নৃত্যের সঙ্গে গাওয়ার উপযোগী করে তৈরী
হয়েছে-যাতে করে আমাদের বর্তমান শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের ও বয়স্কদের জীবনে ও চরিত্রে
একদিকে যে জড়তা, নীরসতা, নিরানন্দভাব, অতি-গাম্ভীর্য্য, আত্মকুণ্ঠা ও অতি-নারীভাব
এবং অপরদিকে যে অতি সৌখীনতার ও বিলাসিতার ভাব এসে পড়েছে সেগুলি নিবারণ করে প্রাণের
একটা স্বাভাবিক সহজ সরল সবল প্রাণবান মুক্তভাব, আনন্দ ও গতিশীলতা আনিয়ে দিতে সহায়তা
করে।
বাংলার শিক্ষিত সমাজের জীবনে আজকাল যে কৃত্রিম ও কচি ভাব এসে পড়েছে এটা জাতির
শক্তি-বিকাশের পক্ষে অনিষ্টকর ও অন্তরায় জনক। বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি যে সহজ ও
বলিষ্ঠভাবে গঠিত, বর্তমান বাংলার শিক্ষাপ্রণালীর ফলে আমরা তার ঠিক উল্টো দিকে গিয়ে
পড়েছি। বাঙ্গালীর নিজস্ব আদিম চরিত্রের ও সংকৃষ্টির অন্তনির্হিত যে সহজ-ভাব ও সরল
ছন্দ, তাকেই আবার জাতীয় সাহিত্যে ও জাতীয় জীবনে আনার জন্য এই সব গানের রচনা আমি
করেছি। বাংলার বাহির থেকে আমদানি শহুরে ও মজলিসি নৃত্যের ও গীতের নির্বাসন করে
বাংলার নিজস্ব সরল ও নির্মল ছন্দের এবং সুরের নৃত্য ও গীতিকে শিক্ষিত বাঙ্গালীর
জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা বাংলার ব্রতচারী সমিতির একটি প্রধান উদ্দেশ্য। আশা করি
বাংলার প্রতি জেলায় শহরে ও গ্রামে এবং প্রত্যেক বিদ্যালয়ে এই সকল নৃত্য-গীত আবার
বাংলার জীবনে ছড়িয়ে পড়ে জাতিকে বলিষ্ঠ, সতেজ ও সজীব করবে এবং খাঁটি বাঙ্গালী করে
গড়ে তুলবে।
চৈত্র, ১৩৪০ গুরুসদয় দত্ত
জ-সো-বা (জয় সোনার বাংলার)
[ এটা বাংলার ব্রতচারীরা সার্বজনীন জাতীয় গীত। চার পাঁচজন বা ততোধিক ব্রতচারীর কাজে
কোথাও সম্মিলিত হলে সেই সম্মেলন শেষ হবার ঠিক আগে সকলে দণ্ডায়মান হয়ে একসঙ্গে এই
গান গাইতে হয়। সমগ্র গানটি গাইবার সময় না থাকলে কেবলমাত্র প্রথম চার ছত্র গাইলে
চলে। গাওয়ার পর হাত তুলে জ-সো-বা বলতে হয়।]
আপন পরিবারে করে'
সুশিক্ষা প্রদান,
গড়ে উন্নতির সোপান;
হয় জীবন তাহার দেশের সেবায়
সার্থকতায় ভরা।।
রাইবিশে
আয় মোরা সবাই মিশে
খেলবো রাইবিশে।।
মোরা খেলব রাইবিশে-
মোরা নাচবো রাইবেশে;
আয় মোরা সবাই মিশে
খেলবো রাইবিশে।।
নহে ঘৃণ্য জিনিষ এ-
মহামূল্য জিনিষ এ-
আয় মোরা সবাই মিশে
খেলবো রাইবিশে।।
মোদের ভাবনা ভয় কিসে?
হ'য়ে খেলায়ময় ভাবনা ভয় ভাঙ্গব নিমিষে।।
হ'য়ে নৃত্যময় ভাবনা ভয় নাশবো নিমিষে।।
ইঃ-আঃ!
দামামার তালে তালে হেলে দুলে
মোরা মারবো কুঠার নিরানন্দের মূলে
দেখে পরের নাচ আনবো না কুভাব মনে
নেচে নির্মল আনন্দ পাবো আপন মনে।।
ইঃ -আঃ!
আয় রে দশ-বিশে;
চলিস্নশে!
ছিয়ালিস্নশে!
ভয় কিসে?
দুলে নৃত্যের বশে, মারবো পিত্তের বিষে!
ইঃ- আঃ!
রাজা মানসিংহের দুর্দ্ধর্ষ ফৌজ "রায়বেঁশে"-
এমনি নাচতো উলস্নাসে রণ বিজয় শেষে।
বাংলার বীর সৈন্য রায়বেঁশের বংশ
এই নৃত্যের শেষে করত শক্রর ধ্বংস।
কলিঙ্গের সম্রাটের পদাতিক বেশে
এমনি ছুটত "রায়বেঁশে"র দল গুজরাট দেশে।
আয় বিভেদ ভুলি' সবে খেলি মিশে
আয় বিভেদ ভুলি' সবে নাচি মিশে!
আয় মোরা সবাই মিশে-খেলবো রাইবিশে।
আ ব্ ব্ ব্ ব্ ব্- ইঃ-আঃ! (৩বার) (সিউড়ী, ১৯৩২)
প্রর্থনা
ভগবান হে! খোদাতালা হে!
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
তুমি কর সবে সম স্নেহ দান হে।
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
নহ বিভু তুমি কভু ভিন্ন হে;
জগৎ জুড়িয়া তার চিহ হে;
দেহ প্রেম ভক্তি জ্ঞান হে;
মোহ হতে কর ত্রাণ হে;
কর ত্রাণ হে! কর ত্রাণ হে!
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
সকলের সনে কর যুক্ত হে!
কর হিংসা কলহ হ'তে মুক্ত হে;
কর মুক্ত হে! কর মুক্ত হে;
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
কর স্বার্থ প্রাচীর-কারা চূর্ণ হে;
কর ভেদ-বিহীন ভাবে পূর্ণ হে;
কর পূর্ণ হে! কর পূর্ণ হে!
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
কর কল্যাণ কর্মে ব্রতী হে!
তব পানে রাখো সদা মতি হে;
নাশো বিঘ্ন হে! নাশো ভয় হে;
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে!
[পরলোকগত প্রিয়জনের উদ্দেশে নিম্নলিখিত পদটি গাওয়া হয়।]
দিও পরলোকে পরগতি দান হে-
প্রেম-পূর্ণ পরমলোকে স্থান হে!
দিও স্থান হে! দিও স্থান হে!
জয় জয় হে! তব জয় জয় হে! (সিউড়ী, ১৯৩২)
সাধনা
ও তুই সবার কাজে আপনাকে দে বিলায়ে;
সবার মনে আপনাকে দে মিলায়ে।।
মনের আপন পরের প্রভেদ দে তুই নাশায়ে;
তোর স্বার্থ-প্রাচীর বিশ্ব-প্রেমের বানেতে নিক ভাসায়ে, ভাসায়ে।
যদি শান্তি পাবি সবার চোখের অশ্রু দে তুই মুছায়ে;
যদি স্বস্তি পাবি বুকের ব্যথা দে তুই ঘুচায়ে;
ঘুচায়ে, ঘুচায়ে।।
যদি বৃহৎ হবি সবার তরে বিত্ত দে তোর বিলায়ে;
যদি মহৎ হবি সবার মনে চিত্ত দে তোর মিলায়ে, মিলায়ে।
যদি উচ্চ হবি সবার নিচে আসন নে তোর বিছায়ে,
যদি অসীম হবি সবার জীবন স্নেহে দে তুই সিঁচায়ে;
সিঁচায়ে, সিঁচায়ে।
যদি শ্রেষ্ঠ হবি সবার সেবায় মাথা দে তোর নোয়ায়ে;
যদি শুদ্ধ হবি সবার দেহের ধূলি দে তুই ধোয়ায়ে. ধোয়ায়ে।
যদি সফল হবি সবার বোঝা ব'য়ে দে হাত বাড়ায়ে,
যদি অমর হবি সবার মাঝে আপনাকে ফেল হারায়ে;
হারায়ে, হারায়ে।
(সিউড়ী, ১৯৩১)
১
করব মোরা চাষ
মোরা করব মাটির চাষ
মোদের চাষের জোরে ঠেলব দূরে
দুঃখ দৈন্য ব্যাধির বাস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
২
মোরা রাখব না এ গস্নানি,
হয়ে পুঁথিজীবী প্রাণী
গায়ে খাটা গেছি ভুলে
গায়ে খাটা গেছি ভুলে
তাতেই এত হানি
(দেশের তাতেই এত হানি)
(দেশের তাতেই এত হানি)
মোরা ভূমির সেবা করে ব্রত,
ঘুচার এ পরিহাস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৩
তাই বিধি মোদের বাম,
ধরে ভদ্রলোকের নাম
শ্রমের হেলার দোষেই মোদের
উজাড় হল গ্রাম
(মোদের উজাড় হল গ্রাম)
(মোদের উজাড় হল গ্রাম)
সবাই কোদাল হাতে খেটে মোরা
ভাঙ্গব অলসতার ফাঁস
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৪
মোদের দেশের জল ও মাটি,
মোরা রাখব পরিপাটি-
রচব বাগান ঘরে ঘরে
কোদাল হাতে খাটি
(সবাই কোদাল হাতে খাটি)
(সবাই কোদাল হাতে খাটি)
ভ'রে ফুলে ফলে দেশের মাটি
নিরন্নতা করব নাশ
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৫
রোজ উঠে ভোরের বেলা,
মোরা জুড়ব চাষের মেলা
ফুটবে দেহের স্বাস্থ্য
পেয়ে খোলা হাওয়ার খেলা
(পেয়ে খোলা হাওয়ার খেলা)
(পেয়ে খোলা হাওয়ার খেলা)
তাজা তরকারি ফল ফলিয়ে মোরা
ফেলব ছিঁড়ে রোগের ফাঁস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৬
ঐ যে গাছের ঘন ঝোপ,
এরাই রোগের কামান তোপ
কেটে উজাড় করে এদের
করব রোগের লোপ
(মোরা করব রোগের লোপ)
(মোরা করব রোগের লোপ)
এনে ভগবানের আলো হাওয়া
খুলব গ্রামে স্বাস্থ্যাবাস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৭
মোদের গ্রামের শতেক ভাই
যাদের দরদী কেউ নাই
তাদের পিছে ফেলে মোদের
স্বদেশ-পূজায় ছাই
(মোদের স্বদেশ-পূজায় ছাই)
(মোদের স্বদেশ-পূজায় ছাই)
গ্রামের দশের সেবায় লাগব মোরা
ভুলে গিয়ে ভোগ-বিলাস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৮
জাতির শক্তিরূপা নারী
ক'রে ভ্রান্ত বিধান জারি
তাদের অন্ধকারে রেখে মোরা
সব কাজেতেই হারি
(মোরা সব কাজেতেই হারি)
(মোরা সব কাজেতেই হারি)
করে মাতৃ জাতির মুক্তি বিধান
খুলব মোদের গলার ফাঁস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
৯
হোক বাঙ্গালী কি শিখ
সবার শিক্ষা লাভে ধিক
সেজে ভেড়ার বেশে বেড়ায় যারা
চাকরি করে ভিখ
(শুধু চাকরি করে ভিখ)
(শুধু চাকরি করে ভিখ)
করে ধনোৎপাদন ব্রত মোরা
চাকরি-মোহ করব নাশ।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
১০
ত্যাজি অলসতার লেশ
পরব ব্যবসায়ীর বেশ
খুলে কারখানার কল করব দেশের
দৈন্যদশার শেষ
(দেশের দৈন্যদশার শেষ)
(দেশের দৈন্যদশার শেষ)
মোরা মানুষ হয়ে উঠলে মোদের
কাড়বে না কেউ মুখের গ্রাস।
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
১১
ভুলি' হিন্দু-মুসলমান
করব ভ্রাতৃ-স্নেহ দান
একই মায়ের দেওয়া মোদের
দুই ভাইয়েরই প্রাণ
(মোদের দুই ভাইয়েরই প্রাণ)
(মোদের দুই ভাইয়েরই প্রাণ)
মোরা ভ্রাতৃবিবাদ বেঁধে দেশের
করব না আর সর্বনাশ
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
১২
মোরা শপথ নিলাম আজ
ছেড়ে হিংসা বিবাদ সাজ
এক জোটেতে মিলে সবাই
করব দেশের কাজ
(সবাই করব দেশের কাজ)
(সবাই করব দেশের কাজ)
স্বদেশ প্রেমের বানে ভাসিয়ে দেব
ভারতভূমির সকল ত্রাস
(করব মোরা চাষ-
সবাই করব মাটির চাষ)
(হাওড়া, ১৯২৭)
সাঁতার সঙ্গীত
(আমরা) ধারি না ধার অলসতা, খেলি ছুটে সাঁতার,
(আমরা) মরিব ডুব হইব পার, নদনদী, পাথার।
ঝলকি ঝল, নাচিছে জল-ঝাঁপিয়ে পড়ি চল
জাগিবে ভুখ; ফুলিবে বুক, বাড়িবে দেহে বল
উঠিছে ঝড়, কড়কি কড়, স্বনে আকাশে বাজ,
প্রলয় বায় ঢেউ মাতায় অতল সিন্ধু-মাঝ।
তরণী হায় উলটি যায় নাহি পরাণে ডর-
দিব সাঁতার, হইব পার করি সাহসে ভর-
(আমরা) করি না ভয় ঝড় প্রলয়, নাচে তালে হৃদয়-
(আমরা) মারিব ডুব, দিব সাঁতার, করিব মৃত্যু জয়!
(সিউড়ি, ১৯৩২)
আমরা সবাই অভিন
আমরা সবাই অভিন-
(রে ভাই) আমরা সবাই অভিন
আমরা এই চেতনায় জগৎ জুড়ে
আনব জীবন নবীন-
(রে ভাই) আনজ জীবন নবীন।
ভেদ বিচারের দ্বন্দ্ব-মোহ করব মোরা চূর্ণ-
শান্তিসুধায় সব মানুষের করব জীবন পূর্ণ-
(মোরা) করব জীবন পূর্ণ।
হব বয়সে যতই প্রবীণ
ততই বনব মনে নবীন-
ততই বনব মোরা নবীন-
রেখে মন চেতনায় অভিন
(রে ভাই) আমরা চির অভিন
(রে ভাই) আমরা চির নবীন।।
বাংলার জয়
গাহো জয়
গাহো জয়
গাহো বাংলার জয়-
দেহে নাহি ক্লান্তি, বুকে নাহি ভয়।।
যার গঙ্গারাঢ়ীয়-যুগ-বীর্য্য-গরিমা দিক-বিজয়ী সেকেন্দর চিত্তে
জাগিয়ে দিল ভয়-
যার রায়বেঁশে ঢালি সেনা যুগে যুগে রণ ভূমে
দিল শৌর্য্যের পরিচয়-
মহা-শৌর্য-শালিনী সেই বাংলার জয়!
চির-শৌর্য-শালিনী সেই বাংলার জয়!
হিন্দু-মুসলমান সন্ততি মিলি যার
বিনাশে দৈন্য দুঃখ ভয়-
মহা-ঐক্য-শালিনী সেই বাংলার জয়!
যেথা সততার জয়
যেথা সখ্যের জয়
যেথা সাহসের জয়
যেথা ঐক্যের জয়-
যেথা কৃত্য-সাধনে দৃঢ় লক্ষরে জয়-
সেই বাংলার জয়-
নব বাংলার জয়!
সততার সখ্যের সাহসের ঐক্যের
পরমোৎকর্ষের যেথা পরিচয়-
নব-জাগ্রত সেই বাংলার জয়!
নব-সঞ্জাত সেই বাংলার জয়!
হে খোদাতালা-ভগবান মঙ্গলময়-
তব শুভাশিস দাও সারা বাংলা ময়।
(কলিকাতা, ১৯৩৬)
শা-স্ব-বা (শাশ্বত-বাংলা ও শাশ্বত-বাঙালী)
চন্দ্র-সূর্য তারায় ভরা
ব্যোম-ঘেরা এই বিশাল ধরা-
মোদের সোনার বাংলাভূমি শোভে তাহার মাঝে-
ব্রক্ষপুত্র তিস্তা কুশী গঙ্গাধারার সাজে।।
হিমাচলের শিখর স্রোতের
মানস-সরের সাগর-ব্রতের
এই ভূমিতেই হয় অতুলন মিলন পরিণতি-
এই ভূমিতেই বয় অনুপম পদ্মা মধুমতি।।
বিন্ধ্য গিরির বিন্দু-বারির
আরাবলীর উৎস-সারির
যুক্ত ধারার মুক্ত প্রসার শতেক বাহু মেলে'
এই ভূমিতেই নিত্য নূতন সৃষ্টি প্রলয় খেলে।।
রূপনারায়ণ মেঘনা ফেণী
করতোয়া আর ত্রিবেণী
এই ভূমিতেই সিক্ত করে' ধায় সাগরের পানে-
এই ভূমি বিধৌত প্রবল দামোদরের বানে।।
ভারতভূমির লুপ্তি-হারা-
যুগে যুগে স্বরাজের উদাত্ত নিনাদ হানি
এই ভূমিতেই হয় ধ্বনিত মুক্তি-পথের বাণী।।
সংখ্যাবিহীন জাতির ধারা
এই ভূমিতেই বিরোধ-হারা
যুগে যুগে রচে নব সমন্বয়ের গতি-
এই ভূমিতেই বয় ভারতের আদিম স্রোতস্বতী।।
দেশ-বিদেশ শিল্পাবদান
সাগর বুকে নৌ-অভিযান
চীন-জাপান যব ব্রক্ষে প্রদান বিশ্বপ্রেমের বাণী-
করেছিল এই ভূমিরই শিল্পী বীর আর জ্ঞানী।।
প্রাচীন যুগে পুরু জয়ের
পরিশেষে সেকেন্দরের
অভিযানোদ্যত সেনা পূর্ব ভারত জয়ে
ফিরে গেল এই ভূমিরই গঙ্গারাঢ়ীর ভয়ে।।
সব মানুষের সমান প্রীতির
সেবাব্রতের সরল রীতির
মহাজ্ঞানের উদার নীতির ছন্দ প্রদীপ জ্বালি'
এই ভূমিতেই শ্রেষ্ঠ মানব সাজায় জীবন-ডালি।।
কীর্তনীয়া বাউল গাজি
ভাটিয়াল আর সারির মাঝি
এই ভূমিতেই অন্ত-বিহীন জ্ঞানের গভীর বাণী
সহজ কথায় নৃত্যে সুরে দেয় জীবনে আনি।।
যুগে যুগে রণভূমে ধায়
রায়বেঁশে আর ঢালি হেথায়-
হিন্দু-মসুলমানের প্রাণের মিলন নির্ঝরিণী-
জাগায় এই ভূমিতেই বাংলা ভাষার মধুর প্রতিধ্বনি।।
(ধুয়া) এই ভূমির অখন্ড ধারায় বিশ্বেতে দীপালি-
দিব সন্ততি এই স্বর্ণ-ভূমির সুধন্য বাঙ্গালী-
মোরা সুধন্য বাঙ্গালী-
মোরা সুধন্য বাঙ্গালী।।
কৌতুক গীতি
ব্রতচারীর জীবনের আদর্শ একদিকে যেমন জ্ঞান ও সত্যের গভীর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত
এবং চরিত্রের দৃঢ়তার ও কর্মের, শ্রমের এবং সেবার কঠোর সাধনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও
অনুপ্রাণিত, তেমনি আবার আনন্দের অনাবিল ধারা জীবনে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত করবার দন্য
তাতে নির্মল ক্রীড়া-কৌতুকের একটা বিশিষ্ট স্থান আছে; এবং বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও
বার্দ্ধক্য নির্ব্বিশেষে, সকল বয়সেই এই বালসুলভ ক্রীড়া কৌতুকের সহজ আনন্দকর ও
অফুরন্ত লহরী ব্রতচারীর জীবনকে নিয়ত তরঙ্গায়িত করে' তার প্রাণকে চির-সজীব ও
চির-নবীন করে রাখে। সুতরাং নির্মল কৌতুক গীতিও ব্রতচারী-সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট
বিভাগ।
তিনটি ব্রতচারী কৌতুকগীতি ছাপানো হল।
গুরুসদয় দত্ত।
হা-খে-না-খা
'হ'য় 'আ'কার আর 'স' ভাইরে 'হ'য় 'আ'কার আর 'স'-
চেষ্টা করে নিত্য একটু হাঃ-হাঃ-হাঃ-স!
'খ'য় 'এ'কার 'ল' ভাইয়ে 'খ'য় 'এ'কার আর 'ল'-
চেষ্টা করে নিত্য একটু 'খ'য় 'এ'কার আর 'ল'-
'ন'য় 'আ'কার আর 'চ' ভাইরে 'ন'য় 'আ'কার আর 'চ'-
চেষ্টা করে নিত্য একটু 'ন'য় 'আ' কার আর 'চ'!
'খ'য় 'আ' কার আর 'ট' ভাইরে 'খ'য় 'আ'কার আ 'ট'-
চেষ্টা করে নিত্য ক'সে 'খ'য় 'আ'কার আর 'ট'!
'বঁ'য় 'আ'কার আর 'চ' ভাইরে 'বঁ'য় 'আ'কার আর 'চ'-
হেসে খেলে নেচে খেটে 'বঁ'য় 'আ'কার আর 'চ'!
হা-না-বা
হা-হা-হা স
হা-হা-হা স
ভাবনা ও ভীতি না-আ শ;-
ভুলি ভেদ ভাল-বা-আ স
হা-হা-হা হা-হা স!
বিঘ্ন বিপদে
হা-হা- স-
পরাজয়ে জয়ে
হা-হা স-
শাস্তি গ্রহণে
হা-হা স-
ভার-তি বহনে
হা-হা স-
রোগ শোক তাপ ত্রা-আস
হেঃ-হে হে-সে না-আ শ!
হবু-জবু
১
হবুচাঁদ নামক এক রাজার ছিল জবুচাঁদ নামক এক উজির;
জবুচাঁদ উজির রাখতেন হিসাব হবুচাঁদ রাজার পুঁজির!
হবুচাঁদ রাজা খেতেন পায়েস ছানা গুড় আর সুজির;
হবুচাঁদ রাজার পায়েসের হিসাব রাখতেন জবুচাঁদ উজির।
২
হবুচাঁদ নামক এক রাজার ছিল গবুচাঁদ নামক এক গায়ক;
হবুচাঁদ রাজার সভামাঝে ছিলেন গবুচাঁদ গানের নায়ক।
গবুচাঁদ গায়েকের গৎগুলি ছিল এত গদ-গদ-ভাব-প্রদায়ক-
(যে) হবুচাঁদ রাজা হাই তুলে বলতেন "বলিহারি, গবুচাঁদ-গায়ক"!
৩
হবুচাঁদ নামক এক রাজার ছিল নবুচাঁদ নামক এক নাজির;
হবুচাঁদ রাজার হুঁকা হতে নবুচাঁদ নতশিরে থাকতেন হাজির।
হবুচাঁদ রাজার হবে জিৎ কি হার ঘোড়দৌড়েতে বাজির-
নবুচাঁদ নাজির বলে দিতেন তা' পালটে পাতা পাঁজির।
৪
হবুচাঁদ নামক এক রাজার ছিল ভবুচাঁদ নামক এক ভৃত্য;
হবুচাঁদ রাজার নিত্য ভবুচাঁদ নৃত্য।
হ'তো যদি কভু বদ-হজমে বিষণ্ন হবুচাঁদ রাজার চিত্ত-
ভবুচাঁদ ভৃত্যের হাত ধরে হবুচাঁদ করতেন ধেই ধেই নৃত্য।
৫
হবুচাঁদ নামক এক রাজার ছিল ডবুচাঁদ নামক এক ড্রাইভার;
ডবুচাঁদ করতেন হবুচাঁদের কাজ মোটার-কার চালাইবার।
হবুচাঁদ যখন করতেন আদেশ কাঁচরাপাড়ায় যাইবার-
ডবুচাঁদ গাড়ী হাঁকিয়ে যেতেন "বোলান পাস" কি "খাইবার"।
ব্রতচারি গ্রাম
[এই গানটি লেখকের শেষ রচনা। কলকাতার উপকণ্ঠে ডায়ম-হারবার রোডের উপর ঠাকুরপুকুর বাস
টারমিনাসের পাশে ব্রতচারী সমিতি ১৯৪০ সারে কিছু জমি ক্রয় করেন। শ্রদ্ধেয় গুরুসদয়
দত্ত ব্রতচারীদের কর্মউদ্যোগের জন্য এবং জাতীয় অনুপ্রেরণা ও জাতীয় নবজীবন লাভের
উৎসস্বরূপ, গণতান্ত্রিক শিক্ষার আদর্শ কেন্দ্র (জনশিক্ষা প্রতিষ্ঠান) গড়ে তোলার
উদ্দেশ্যে স্থানটি নাম দেন "ব্রতচারী গ্রাম" এবং এই গানটি রচনা করেন। বর্তমান
ব্রতচারী গ্রামে শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্তের সংগৃহীত বাংলার অমূল্য ও দুষ্প্রাণ্য
লোকশিল্পের নমুনা (যাহা সমগ্র বাঙ্গালীর শিল্প-গৌরবের নিদর্শনরূপে স্বদেশ ও বিদেশের
শিল্প-রসিকগণ কর্তৃক প্রশংসিত) বাংলার ব্রতচারী সমিতির প্রতিষ্ঠিত "গুরুসদয়
সংগ্রহশালায়" রক্ষিত আছে। এছাড়া ব্রতচারী পরিচেষ্টার অন্তর্গত বিভিন্ন শিক্ষাশ্রেণী
ও শিবির বাংলার ব্রতচারী সমিতির তত্ত্বাবধানে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়।]
ব্রতচারী গ্রাম, মোদের ব্রতচারী গ্রাম!
আলোয় উজল স্নিগ্ধ, সুজল মধুর প্রাণারাম!
হেথা পাখী ডাকে শাখে শাখে, ফুলে ফলে মেলা;
ছায়ায় খেলে রাখাল ছেলে নিঝুম দুপুর বেলা;
হেথা শ্যামল মাঠের বিতান সাজায় স্বরগ-শোভার ধাম,
আলোয় উজল স্নিগ্ধ সুজল মধুর প্রাণারাম।
হেথা জেগে উঠে চেতনা যা প্রাণের তলে সুপ্ত,
পিতৃভূমির পুণ্য ধারা প্রায় হ'ল যা লুপ্ত;
কর্মে ও আনন্দে হেথা মিলন অবিরাম,
আলোয় উজল স্নিগ্ধ সুজল মধুর প্রাণারাম।।
হেথা পল্লীতে ও নগরে হয় সমন্বয়ের সৃষ্টি,
ধর্মে ও বিজ্ঞানে মিলে ফলে অতুল কৃষ্টি;
হেথা জীবন ভরে সহজতায়, শরীর হয় সুঠাম,
আলোয় উজল স্নিগ্ধ সুজল মধুর প্রাণারাম।
হেথায় এসে বাংলাবাসী পাবে নবীন প্রাণ,
ভারতবাসী হেথায় এসে হবে অভিন-প্রাণ;
হেথা-শান্তিকামী জগৎ হবে পূর্ণ-মনস্কাম,
আলোয় উজল স্নিগ্ধ সুজল মধুর প্রাণারাম।।
(ব্রতচারী গ্রাম, ১৯৪১)
বাউল নৃত্যের গান
হ'ল মাটিতে চাঁদের উদয়,
কে দেখবি আয়
এমন যুগল চাঁদ কেউ দেখিস নাই-
দেখসে নদীয়ায়।
তোরা কে দেখবি আয়,
তোরা কে দেখবি আয়-
এমন যুগল চাঁদ কেউ দেখিস নাই-
দেখসে নদীয়ায়।
ঢালি নৃত্য ও ঢোলের বোল
ঢালি সামরিক নৃত্য। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের বাহান্ন হাজার ঢালি সৈন্যের কথা বাংলার
সাহিত্যে সুপরিচিত। ঢাল, তরবারি কিংবা সড়কী, ঢালি সৈন্যের প্রধান অস্ত্র ছিল।
দক্ষিণবঙ্গে নদী নালা থাকায় অশ্ব পরিচালনায় পক্ষে অসুবিধা বিবেচনা করে প্রতাপাদিত্য
"ঢালি" সেনা গঠন করেন। বর্তমান ঢালিনৃত্যটি খুলনা যশোহরের অতীত স্মৃতি বহনকারী
কয়েকজনের নিকট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। নৃত্যে কাঠের তরবারি বা বাঁশের ছোট লাঠি ও
বেতের ঢালের ব্যবহার হয়ে থাকে। নৃত্যটি ঢোলের তালে তালে অনুষ্ঠিত হয় এবং ঢোল বাদকই
প্রকৃতপক্ষে নৃত্যটি পরিচালনা করে থাকেন। নৃত্যের কয়েকটি পর্যায় ও ঢোলের বোল দেওয়া
হোল।
১। আসর বন্দনা
ঘিওর গিজ্জা গিজ্জা গিজ্জা............(কয়েকবার)
২। কসরৎ
(ক) শরীরের ভারসাম্য পিছনদিকে রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে পা ছোঁড়া;
(খ) লাফিয়ে শূন্যে ঘোরা; (গ) বৈঠক; (ঘ) বীরচলন; (ঙ) শ্বাসত্যাগ ও গ্রহণ, ব্যায়াম।
ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ তা তা....................(কয়েকবার)
৩। বীর নৃত্য
(তা) গিজার গিজা ঘিনিতা তা...........(কয়েকবার)
৪। যুদ্ধ প্রস্তুতি ও যুদ্ধ
ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ তা তা তা (কয়েকবার)
ঝাঁ ঘিনা ঘিনা ঝাঁ তা তা (কয়েকবার)
কুর কুর কুর কুর তা তা (কয়েকবার)
ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ তা তা (যুদ্ধের সময় দ্রুত লয়ে)
৫। যুদ্ধ শেষ ও তা-ব নৃত্য
গিজার গিজ ঘিনিতা তা (কয়েকবার)
ধানভানা
ও ধান ডানরে ডানরে মুরলী গান শুনি
বৃন্দাবনে ভানে ধান ষোলশ' গোপিনী!
ঢেঁকিটা বলের ভাই আমি নারদের হাতি
অষ্ট অঙ্গ ছেড়ে আমার ল্যাজে মারে লাথি।
পায়া দুটো বলেরে ভাই আমরা জোড়া ভাই
মাটির ভিতর থেকে আমরা কৃষ্ণগুণ গাই।
আসলাইটা বলে আমি আটে কাটে দড়
আমি না থাকিলে ঢেঁকি কাত হ'য়ে পড়।
মুষলাইটা বলে রে ভাই লোহায় বাঁধা মুখ
আমার এঁটো খেয়ে লোকের চাঁদ পারা মুখ।
কুলোটা বলেরে ভাই করি হোঁস ফোঁস
ঢেঁকি ভায়া ভানে ধান আমি উড়াই তুষ।
ঝাঁটাটা বলেরে ভাই আমার গোড়া দড়
ঢেঁকি ভায়া ভানে ধান আমি করি জড়।
উঠানটা বলেরে ভাই আমার নাম মিলে।
পোয়া পুশুরি বলেরে ভাই আমার নাম চাঁপা
ঢেঁকি ভায়া ভানে ধান আমি দিই মাপা।
ধামাটা বলেরে ভাই ডোম বাড়িতে হই
ঢেঁকি ভায়া ভানে ধান কাঁখে করে বই।
পাইক নৃত্যের গীত
পাইক নৃত্য শিকার ও যুদ্ধবহুল ঘটনাকে উপজীব্য করে সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমান
নৃত্যটি মহাভারতের বিখ্যাত কীরাত ও অর্জুনের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের ও মহাবরাহ নিধনের
ঘটনার রূপায়ণঃ-
গান
লোহার খনি ভাই এই অঙ্গে (২)
আপনি মরিলে বাবা কাহার লাগি কান্দো রে-কাহার লাগি কান্দো।
পাহার পর্বত যামুরে, আলু তুম্মা খামুরে-
ভেড়িয়া বান্দর পামুরে, কলিজা খুইল্যা খামুরে-আমরা সবাই মিলে যামুরে।।
ঢোলের তালে তালে সমগ্র নৃত্যটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ঢোল ছাড়াও দামামা
সানাই ব্যবহার করা যেতে পারে। বরাহের একটি মুখোস; অর্জুনের শাদা অথবা
গেরুয়া ধুতি এবং গলার উপবীত থাকবেই চলবে। অন্যান্যদের শিকারীরা ন্যায় পোষাব
থাকলে ভালো হয়।
পাইক নৃত্যের ঢোলের বোল
কিরাত কিরাতিনীদের প্রবেশঃ-
ঘিউর গিজ্জা ঘিউর গিজ্জা (কয়েকবার) উরর ঝাঁ।
শিকার অন্বেষণঃ-
-উরর খিটি খ তা (২ বার) ঘি তা তা
ঘিনা ঘিনা ঘিনা ঘি তা তা (৩ বার)
শিকার বধের সময় :-
ঘি তা তা (কয়েকবার)
অর্জুন ও কিরাতের যুদ্ধের সময় :-
ঝাঁ তা তা (কয়েকবার)
বধূবরণ নৃত্যের গান
বাংলাদেশ বিবাহ উপলÿ্যে বেশ কয়েকটি নৃত্য প্রচলিত আছে। অষ্টসখি নৃত্য, সাজানো
নৃত্য, বধূবরণ নৃত্য ইত্যাদি। বিবাহের পর স্বামীগৃহে পদার্পণের সময় বধূকে নৃত্যে
পারদর্শিতা দেখাতে হত। এই কারণে "ঘুঙ্গুর দেওয়া মলের" প্রচলন ছিল। যে বধূ নৃত্য
জানতো না তাকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হত। এ সম্পর্কে একটি প্রচলন প্রবাদ "নাচতে না
জানলে উঠোন বাঁক।"
নিম্নোক্ত গানটি শ্রীহট্ট জেলার বধূবরণ নৃত্যের একটি লোকগীতি।
সোহাগ চাঁদ বদনি ধ্বনি নাচোতো দেখি
বালা নাচোতো দেখি, বালা নাচোতো দেখি।।
যেমনি নাচেন নাগর কানাই, তেমনি নাচেন রাই-
(একবার) নাচিয়া ভুলাও তো দেখি নাগর কানাই।।
ঝুনুর ঝুনুর নূপুর বাজে ঠমক ঠমক তালে,
নয়নে নয়ন লাগিয়া গেল সরমের রঙ লাগে গালে।
নাচেন ভালো সুন্দরী এ বাঁধেন ভালো চুল
হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগ কেশরের ফুল-
বালা নাগ কেশরের ফুল।।
সমবায়
যদি জীবনে সফলকাম হইবি ধরায়,
যদি ধন-সমৃদ্ধি লভিবি ব্যবসায়,-
তবে ঠাঁই ঠাঁই ভাব ত্যাগি,
একে অপরের লাগি-
সবে মিলে' জোট বেঁধে গড় সমবায়।
একটি ক্ষুদ্র তৃণের জোরে হয় না কোন কাজ,
রজ্জু-বন্ধ হয়ে' তৃণ বাধে গজ-রাজ;
বাঁধলে সমবায়ের দল,
নিজে হলেও দুর্ব্বল-
সকল দুঃখ দৈন্য দূর করিবার গড়িবে উপায়।
মাসের শেষেতে কর কসে' হিসাবের নিকাশ,
আয়ের অধিক ব্যয় যার বেশি-হয় তার সর্ব্বনাশ;
ছেঁটে' পার্ব্বণ আর পর্ব্ব
খরচ করে' দে খর্ব্ব-
ও ভাই মুক্তি চাস এড়িয়ে যদি মহাজনের দায়।।
সমিতির ভাণ্ডারেতে কর সঞ্চয়ের অভ্যাস,
সঞ্চয়ী যে নয় তার গলায় দেনার পড়ে ফাঁস;
হাতে থাকলে অবশেষ,
খরচেতে হয় নিঃশেষ-
ও ভাই ব্যাঙ্কে জমা দিলে টাকা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
ব্যাঙ্কে জমা দেয় না যে তার উদ্বৃত্ত অর্থ,
রুদ্ধ করে সে জন দেশের শক্তি সামর্থ্য;
ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সম্বল-
যেন নদীর স্রোতের জল-
দেশের দশের কাজে লেগে' আপন উৎসে ফিরে যায়।।
সে ধনের দাদন নিয়ে না দিলে ফিরায়ে,
দশের মঙ্গলের ধারা যাবে শুকায়ে;
কিস্ত্মী-খেলাপ করে যে
ঘোরতর পাপী সে;-
তার দোষে দেশের শক্তির উৎস ধ্বংস হয়ে যায়।
হীনবিত্ত হলেও একে অপরের জোরে,
মূলধন পায় সমিতির প্রত্যেক মেম্বর তার ঘরে;
সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার বলে
সবার ক্ষেতে সোনা ফলে-
দেশে ধনের ছড়াছড়ি দেখে' দারিদ্র্য পলায়।।
দশের পুঁজি যোগ করে' লাগালে ব্যবসায়,
গড়ে' উঠবে দশের লাঠি একলাঠির বোঝায়;-
সঙ্ঘ-বদ্ধ লভে জয়,
বিভক্তের হয় পরাজয়;-
বিভক্তের হয় পরাজয়;-
তাই সবাই তোল প্রত্যেককে টেনে'- প্রত্যেকে সবায়।
জগৎ জুড়ে' সমবায়ের পড়েছে সাড়া,
দেশে দেশে জাগলো নব-জীবনের ধারা;-
তাই আয়রে সবাই ত্বরায় আয়,
ভুলি' ভেদাভেদের দায়;-
আয় সবার সনে সবাই মিলে' গড়ি সমবায়।