ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ |
জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচিঝরা-পালক
ওগো দরদিয়া তোমারে ভুলিবে সবে, —যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া; ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে কে জানে রহিবে কোথা নিশিভোরে নেশাখোর আঁখি তব বুজে ! —হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে ! চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূর লহরীর পানে, গীতিহারা প্রাণ তব হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে ! হয়তো বা বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে শিশিরের দলে; হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি রবে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা,— তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ,— নীহারীকা, —তারা, তোমারে চিনিবে শুধু প্রেত-জ্যোৎস্না, —বধির জোনাকি ! তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি ! তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ— মৌন, —আলোহারা, তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা ! কিংবা কেহ চিনিবে না,— হয়তো বা জানিবে না কেহ কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ ! —হয়েছিলো পরিচয় ধরণীর পান্থশালে যাহাদের সনে, তোমার বিষাদ-হর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে, যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি, তোমারে ভুলিবে তারা,— ভুলে যাবে সব কথা, —সবটুকু স্মৃতি ! নাম তব মুছে যাবে মুসাফের,— অঙ্গারের পাণ্ডুলিপিখানি নোনা-ধরা দেয়ালের বুক থেকে খ’সে যাবে কখন না জানি ! তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি, দণ্ড দুই মাছিগুলো ক’রে যাবে মিছে কানাকানি ! তারপর উড়ে যাবে দূরে-দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে, মৃত এক অলি শুধু প’ড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে ! পেয়ালা উপুর ক’রে হয়তো বা রেখে যাবে কোন একজন, কোথা গেছে ইয়োসোফ্ জানে না সে,— জানে না সে গিয়েছে কখন । জানে না যে, —অজানা সে, —আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে,— জানে না যে চাপা প’ড়ে গেছে সে যে কোবেকার কোথাকার ভিড়ে ! —জানিতে চাহি না কিছু, —ঘাড় নিচু ক’রে কে বা রাখে আঁখি বুজে অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে ! —যৌবনের কোন্ এক নিশীথে সে কবে তুমি যে আসিয়াছিলে বনরানী । জীবনের বাসন্তী-উৎসবে তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ,— আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি তুমি যে ভরিয়াছিলে— জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ, —গেছে ফুরায়ে তলানি ! তবু তুমি আসিলে না, —বারেকের তরে দ্যাখা দিলে নাকো হায় ! চুপে-চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়— তুমি তাহা জানিলে না,— চলে গেছে মুসাফের, কবে ফের দ্যাখা হবে আহা কে-বা জানে ! কবরের ’পরে তার পাতা ঝরে, —হাওয়া কাঁদে হা-হা !
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরি কথা হয়
চোখ দুটো ঘুমে ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে ! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিলো গোপন, —স্বপন ক-দিন রয় ! এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ, —এ তবু গোধূলি নয় ! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরি কথা হয়, আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের ’পরে !
কেটেছে যে নিশি ঢের,- এতোদিন তবু অন্ধকারে পাইনি তো কনো টের ! দিনের বেলায় যাদের দেখিনি, —এসেছে তাহারা সাঁঝে; যাদের পাইনি পথের ধুলায়— ধোঁয়ায়— ভিড়ের মাঝে,— শুনেছি স্বপনে তাদের কলসি ছলকে, —কাঁকন বাজে । আকাশের নিচে— তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের !
চোখদুটো ছিলো জেগে কতোদিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্কান্–রাঙা মেঘে । কতোদিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের খেতে ! ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে কতোদিন হায় ! —কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে ঘোর ভেঙে গেলো, —খেয়ালের খেলাঘরটি গেলো যে ভেঙে !
দুটো চোখ ঘুমে ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে ! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিলো গোপন,— স্বপন ক-দিন রয় ! এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ, —এ তবু গোধূলি নয় ! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরি কথা হয়,— আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের ’পরে ! |