ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ | জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচি


ঝরা-পালক


 মরীচিকার পিছে—

ধূম্র তপ্ত আঁধির কু্য়াশা তরবারি দিয়ে চিরে

সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে

            ছুটে যায় দুটি আঁখি

            —কতো দূর হায় বাকি!

উধাও অশ্ব বল্গাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,

পথে-পথে তার বাধা জমে যায়, —তবু সে আসে না ফিরে!

 

দূরে, —দূরে, —আরো দূরে, —আরো দূরে,

অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ-সীমানা জুড়ে

            ভাসিয়াছে মরুতৃষা!

            —হিয়া হারায়েছে দিশা!

কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে

কোন্ দিগন্তে নির্জন কোন্ মৌন মায়াবী-পুরে!

 

কোন্ এক সুনীল দরিয়া সেথায় উথলিছে অনিবার!

—কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার,

            ছোটে অঞ্জলী পেতে,

            তৃষার নেশায় মেতে,

ঊষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!

খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!

 

কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি!

যতো খুন যতো খারাবির ঘোরে পরান আছিলো মাতি,

            নিমেষে গিয়েছে ভেঙে

            স্বপন-আবেশে রেঙে

আঁখি-দুটি তার জৌলস-রাঙা হয়ে গেছে রাতারাতি

কোন্ যেন এক জিন্-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী!

 

কোন্ যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!

পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!

            গেঁথে গোলাপের মালা

            তাকায়ে রয়েছে বালা,

বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস কালো পশমিনা চুলে

বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে

 

ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত-জর্জর,

চারিদিকে তার বালুর পাথার, —মরুর হাওয়ার ঝড়;

            নাহি ভ্রান্তির লেশ,

            সুদূর নিরুদ্দেশ—

অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের পর!

পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!

 

আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!

চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!

            ঝড়ের বাতাস মিছে

            ছুটিছে তাহার পিছে!

মরুভূ প্রেত চমকিয়া তার চক্ষের পানে যায়,—

সুরার তালাসে চুমুক দিলো কে গরলের পেয়ালায়!

 

   জীবন-মরণ দু্য়ারে আমার

সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,

ঘরের শার্সি বাজে তাহাদের গানে,

            পর্দা যে উড়ে যায়

তাহাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!

—মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!

            আজো মন ওঠে রেঙে

দিলদারদের দরাজ গলার রবে,

            সরায়ের উৎসবে!

কোন্ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়

পেয়ালা তাদের থেকে-থেকে বেজে যায়

            বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!

সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!

            পাণ্ডুর দুটি ঠোঁটে

ডালিম ফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!

            মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসিভরা লাল গাল,

ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যতো কিছু জঞ্জাল!

            আখেরের ভয় ভুলে

            দিলওয়ার প্রাণ খুলে

জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি!

অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি,—

            নিভেছে দিনের আলো;

—জীবন-মরণ দুয়ারে আমার, কারে যে বাসিবো ভালো

            একা-একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!

পূর্ণ হয়নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন,

            খুলিনি একটি দল,—

যৌবন শতদলে মোর হায় ফোট নাই পরিমল!

            উৎসব-লোভী অলি

            আসেনি হেথায়,—

কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!

            —সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে

তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন যায় দুলে

            আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে,

সুদূর মরূদ্যানের পানেতে চেয়ে!

            সুখ-দুঃখের দোদুল ঢেউয়ের তালে

নেচেছে তাহারা, —মায়াবীর জাদুজালে

মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,

মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!

            মস্তানা সেজে ভেঙে গেছে ঘরদোর,

লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!

কারার ধূলায় লুণ্ঠিত হয়ে বান্দার মতো হায়

কেঁদেছে বুকের বেদুইন মোর দুরাশার পিপাসায়!

            জীবনপথের তাতার দস্যুগুলি

হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি

            মোর গবাক্ষে কবে!

কণ্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে!

            আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,

সারাটি নিশীথ খুন-রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে

            একাকী রয়েছি বসি,

নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী

            পাইনি যে তাহা টের!

—দূর দিগন্তে চলে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!

            কোন্ সুদূরের তূরাণী-প্রিয়ার তরে

            বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!

দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা

            চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের রোজা’;

আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দ্যাখা,

            পরানে কখনো জাগেনি রোজার ঠেকা!

            কি যে মিঠা এই সুখের-দুঃখের ফেনিল জীবনখানা!

এই যে-নিষেধ, এই যে-বিধান, —আইন-কানুন, এই যে শাসন মানা,

            ঘরদোর-ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি

              নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি

              যুবানবীনের নটনর্তন তালে,

            ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে-দেশে কালে-কালে,

এই-যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশার-জয়-সংগ্রাম-ভুল

            সফেন সুরার ঝাঁঝের মতন করে দেয় মজ্‌গুল

                        দিওয়ানা প্রাণের নেশা!

ভগবান, —ভগবান, —তুমি যুগ-যুগ থেকে ধরেছো শুঁড়ির পেশা!

—লাখো জীবনের শূন্য পেয়ালা ভরি দিয়া বার-বার

            জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার,—

            মাতালের চিৎকার!

    অনাদি কালের থেকে;

মরণশিয়রে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!

            হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ-প্রায়

জীবনের নদী কলরোল বয়ে যায়!

            কোটি শুঁড় দিয়ে দুঃখের মরুভূ নিতেছে তাহারে শুষে,

ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে!

মরণ-সাহারা আসি

            নিতে চায় তারে গ্রাসি!—

তবু সে হয় না হারা

            ব্যথার রুধিরধারা

জীবন-মদের পাত্র জুড়িয়া তার

            যুগ-যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশলাদার!

 

               বেদিয়া

চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!

পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া কে তারে আনিবে ডাকি?

উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,

গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;

নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,

ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!

কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,

ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে!

যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,

কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে

তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!

দিকে-দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরি-চূড়া-তরু

ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে

কালো-মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে

ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্‌দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!

বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দ্যাখা মাগি

লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!

ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিক-গাঙচিল-বুনোহাঁস

নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে-ফিরে

বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!

তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,

তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে

ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে

নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে

তারই লাগি কোথা বালুপথে দ্যাখা দেয় হীরকের কোণা,

তাহারি লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!

চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে

ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!

যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,

চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,

তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি,

তার চেয়ে ভালো আলো-ঝলমল শীতল শিশিরবীথি,

তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,

তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!

কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!

মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে

আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,

মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!

 

           নাবিক

কবে তব হৃদয়ের নদী

বরি নিলো অসম্বৃত সুনীল জলধি!

 সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে

দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে

বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!

—পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!

 কারাগার-মর্মরের তলে

নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে

 ভ'রে যায় বসুধার আহত আকাশ!

অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!

 —সহস্রের অঙুলিতর্জন

নিত্য সহিতেছি মোরা, —বারিধির বিপ্লব-গর্জন

বরিয়া লয়েছ তুমি, —তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;

তোমার পক্ষরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন—দুরন্ত, ঝাঁঝালো!—

তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,

 অবগুণ্ঠিতার

হিমকৃষ্ণ অঙুলির কঙ্কাল-পরশ

পরিহরি গেলে তুমি, —মৃত্তিকার মদ্যহীন রস

তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা

চকিতে চূর্ণিয়া গেলে, —সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা

বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,

তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট

তোমারে ডাকিয়া নিলো মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!

নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!

প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!

ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,

 অগাধের সাধ

তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!

মণিময় তোরণের তীরে

 মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে

     নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে

         হে দুরন্ত দুর্নিবার, —প্রাণ তব কাঁদে!

ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,

সমুদ্রের যৌবন-গর্জন

তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের!

টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের

 হে জলধি পাখি!

পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!

ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রত্নচূড় ময়ূখের টিপ,

কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ

 করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!

বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে

 সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছো কবে!

কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে,—

স্তম্ভিত নয়নে

নীল বাতায়নে

তাকায়েছ তুমি!

অতি দূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের

আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি

সাজিয়াছো বিচিত্র মায়াবী!

সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি

আনিয়াছো কবে উন্মোচিয়া

হে জল-বেদিয়া!

অল্য বন্দর পানে ছুটিতেছো তুমি নিশিদিন

সিন্ধু বেদুঈন!

নাহি গৃহ, —নাহি পান্থশালা—

লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা

তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্যপাতালে—

বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!

প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!

সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছো পিছু-ডাকা স্বর

ভুলেছো নোঙর!

কোন্ দূর কুহকের কূল

লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল

কে বা তাহা জানে!

অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!