ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ |
জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচিঝরা-পালক
বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়— মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়! ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে,— সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে বনের চাতক— মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে! কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে! বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে-চেয়ে বনের চাতক— মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে, ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে চাতক, —বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে, "দে জল!" ব’লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্ছল্ ! মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
মনের চাতক, —হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি? ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে, আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে! আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, —আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের চাতক, —মনের চাতক আসে না আর ফিরে, কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে! সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে! চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে পাতলা পাখা রে তোর দূর-দূরাশায় মেলে! ফেনার বৌয়ের নোন্তা মৌয়ের- মদের গেলাস লুটে, ভোর-সাগরের শরাবখানায়- মুসল্লাতে জুটে হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!
ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে, ছুটছো তুমি ছলচ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই! উছলে ওঠে তোমার আলতো ফেনা-সই! ঢেউয়ের ছিটার মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!
রে মুসাফের,- পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা সাগর-জলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা ! তাই কি গেলে ভেঙে হেথার বালিয়াড়ির বাড়ি ! দিচ্ছো যাযাবরের মতো সাগর-মরু পাড়ি,– ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া,- পিছের আকাশ ফিকা !
বাসা তোমার সাত সাগরের ঘূর্ণি হাওয়ার বুকে ! ফুটছে ভাষা কেউটে-ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে ! প্রয়াণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে বরুণ-রাণী ফিরছে যে,- মুক্তা-প্রদীপ জ্বলে ! যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ উঠে ফুকে।
যেইখানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে সাঁজসকালে,- ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে ! যায় না জাহাজ যেথায়,- নাবিক পায় না নাগাল যার; লঘু উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার ঘুরছে অবুঝ, সে কোন্ সবুজ স্বপন–খোঁজার কাজে!
ওরে কিশোর –দূর-সোহাগী ঘর –বিরাগী সুখ!- -টুকটুকে কোন্ মেঘের পারে ফুট্ফুটে কার মুখ ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার ! -শাদা শকুন –পাখায় যে তাই তুলেছে হাহাকার
ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা
কাঁদন,- ফাপর-ফাটা বুক! চলছি উধাও,বল্গাহারা,-ঝড়ের বেগে ছুটিঁ শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে! কোন সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি ! -আঁধার আলোর সাগরশেযে প্রেতের মতো আসছে ভেসে !
আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে, যেদিন আমি জেগেছিলাম,সেও জেগেছে আমার মনে !
আমার মনের অন্ধকারে ত্রিশূলমূলে দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ-পূজার পুষ্প ঢেলে ! স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে,- আমায় পেলে ! রাত্রি-দিবার জোয়ারস্রোতে নোঙর-ছেঁড়া হৃদয় হ'তে জেগেছে সে হালের নাবিক,- চোখের ধাঁধায়,-ঝড়ের মাঝে,- মনের মাঝে,-মনের মাঝে! আমার চুমোর অন্বেষণে প্রিয়ার মতো আমার মনে অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রুপাথার-কূলে ! ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে হাতটি রেখে হাতে ! দেখিনি তার মুখখানি তো- পাইনি তারে টের, জানিনি হায় আমার বুকে আশেক,- অসীমের জেগে আছে জনম-ভোরের সূতিকাগার থেকে ! কতো নতুন শরাবশালায় নাবনু একে-একে ! সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি কাটিয়ে দিলাম কতো খুশির রাতি ! জীবন–বীণার তারে-তারে আগুন –ছড়ি টানি গুলজরিয়া এলো গেলো কতো গানের রানী,- নাসপাতি-গাল গালে রাখি কানে-কানে করলে কানাকানি শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিলো আঁখি ! -ফুলের ফাগে বেহুঁশ হোলি নাকি ! হঠাৎ কখন স্বপন –ফানুস কোথায় গেলো উড়ে ! -জীবন–মরু–মরীচিকার পিছে- ঘুরে-ঘুরে ঘায়েল হ'য়ে ফিরলো আমার বুকের ক্যারাভেন,- আকাশ-চরা শ্যেন ! মরুঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি প্রাণ যে তাহার রইলো তবু জাগি ইবলিশেরি সঙ্গে তাহার লড়াই হলো সুরু ! দরাজ বুকে দিল্ যে উড়ু-উড়ু ! -ধূসর ধু-ধু দিগন্তরে হারিয়ে-যাওয়া নার্গিসেরই শোভা থরে-থরে উঠলো ফুটে রঙিন-মনোলোভা ! অলীক আশার,- দূর-দুরাশার দুয়ার ভাঙার তরে যৌবন মোর উঠলো নেচে রক্তমুঠি,- ঝড়ের ঝুঁটির পরে ! পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটক-কারাগার, ভেঙে শিকল,-ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার চললো সে যে ছুটে !
শৃঙ্খল কে বাঁধলো তাহার পায়ে,- চুলের ঝুঁটি ধরলো কে তার মুঠে! বর্শা আমার উঠলো ক্ষেপে খুনে, হুম্কি আমার উঠলো বুকে রুখে! দুশমন কে পথের সুমুখে! -কোথায় কে বা ! এ কোন্ মায়া! মোহ এমন কার! বুকে আমার বাঘের মতো গর্জালো হুঙ্কার! মানের মাঝের পিছুডাকা উঠলো বুঝি হেঁকে,- সে কোন্ সুদূর তারার আলোর থেকে মাথার পরের খাঁ-খাঁ মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে নেমে এলো রাত্রিদিবার যাত্রাপথে কে রে! কি তৃষা তার!.... কি নিবেদন!.... মাগছে কিসের ভিখ!... উদ্যত পথিক হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে,- আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়! -এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়! পথ-আলোয়ার খেয়ার ধোঁয়ার ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি আজকে নিলো ডাকি হালভাঙা এই ভূতের জাহাজটারে! মড়ার খুলি,- পাহাড়-প্রমাণ হাড়ে বুকে তাহার জ'মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা! আক্রোশে হা ছুটছিলো সে একরোখা,- একসোজা চুম্বকেরি ধ্বংস-গিরির পানে, নোঙর-হারা মাস্তুলেরি টানে! প্রেতের দলে ঘুরেছিলো প্রেমের আসন পাতি, জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী! জানে কি সে ভোরের আকাশ,- লক্ষ তারার আলো তাহার মনের দুয়ার-পথেই নিরিখ হারালো! জানেনি সে তাহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে কোন্ দিওয়ানার সারেং কাঁদে নয়নে নীর ঝরে! কপোত-ব্যথা ফাটে রে কার অপার গগন-ভেদী! তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদী কোন্ সে অসীম আসি! লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি প্রেমের খবর পুছে কবের থেকে কাঁদতে আছে- 'পেয়ালা দে রে মুঝে!' |