ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ | জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচি


ঝরা-পালক


ছায়া- প্রিয়া

দুপুররাতে ও কার আওয়াজ !

            গান কে গাহে,- গান না !

কপোত - বধূ ঘুমিয়ে আছে

নিঝুম ঝিঁঝিঁর বুকের কাছে,

অস্তচাঁদের আলোর তলে

        এ কার তবে কান্না !

        গান কে গাহে,- গান না !

 

শার্সি ঘরের উঠছে বেজে,

       উঠছে কেঁপে পর্দা !

বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে

জল-ডাহুকের বুকের কাছে,

কোন্ বাঁশি শার্সি বাজায়

       এ কোন হাওয়া ফর্দা !

       দেয় কাঁপিয়ে পর্দা !

 

নূপুর কাহার বাজলো রে ওই !

             কাঁকন কাহার কাঁদলো !

পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে,

ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া

          মায়ার মিলন ফাঁদলো !

          কাঁকন যে তার কাঁদলো !

 

 খসখসালো শাড়ি কাহার !

উসখুসালো চুল গো !

পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে,

জুলপি কাহার উঠলো দুলে !

      -দুললো কাহার চুল গো !

     উসখুসালো চুল গো !

 

আজকে রাতে কে ওই এলো

     কালোর সাগর সাঁতরি !

জীবনভোরের সঙ্গিনী সেই,-

মাঠে -ঘাঠে আজকে সে নেই !

কো‌‌‌‌‌ন্ তিয়াষায় এলো রে হায়

         মরণপারের যাত্রী !

       -কালের সাগর সাঁতরি !

 

কাঁদছে পাখি পউষনিশির

           তেপান্তরের বক্ষে !

ওর বিধবা বুকের মাঝে

যেন গো কার কাঁদন বাজে !

ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,

নিদ‌ নাহি মোর চক্ষে !

       তেপান্তরের বক্ষে !

 

এলো আমার ছায়া-প্রিয়া,

        কিশোরবেলার সই গো !

পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে

দুধের শিশুর বুকের কাছে;

মনের মরু,- মনোরমা,-

        কই গো সে মোর – কই গো !

        কিশোরবেলার সই গো !

 

ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে !

      গান কে গাহে, গান না !

কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে

বনের ছায়ায়, - মাঠের কাছে;

অস্তচাঁদের আলোর তলে

      এ কার তবে কান্না !

      গান কে গাহে, - গান না !

 

ডাকিয়া কহিলো মোরে রাজার দুলাল

 

ডাকিয়া কহিলো মোরে রাজার দুলাল,-

ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার, - রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,

চুল যার শাঙনের মেঘ, - আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন,

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, - স্বপ্নে - কতো দিন !

মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপরে –

তখন শকুনবধূ যেতেছিলো শ্মশানের পানে উড়ে–উড়ে !

 

মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিলো উঁকি,

সে কোন বালিকা একা অন্তঃপুরে এলো অধোমুখী !

পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার ’পরে

দাঁড়ালো সে, - বাসররাত্রির বধূ, -মোর তরে, যেন মোর তরে !

তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ,- চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,-

ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে - ঝরিতেছে ফুলঝুরি,- স্বপনের কুঁড়ি !

 

অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে-থেকে ফুঁপায় উদাসী !

কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী !

কিঙ্খাবে –গালিচা-খাটে রাজবধূ- ঝিয়ারীর বেশে

কভু সে দেয়নি দ্যাখা - মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে !

দাঁড়ালো সে হেঁটমুখে - চোখ তার ভ’রে গেছে অশ্রুজলে !

মীনকুমারীর মতো কোন্ দূর সিন্ধুর অতলে

 

ঘুরছে সা মোর লাগি !-  উড়েছে সে অসীমের সীমা !

অশ্রুর অঙ্গারে  তার নিটোল ননীর গাল,- নরম লালিমা

জ্ব’লে গেছে - নগ্ন হাত - নাই শাঁখা,- হারায়েছে রুলি,

এলোমেলো কালো চুল খ’সে গেছে খোঁপা তার, - বেণী গেছে খুলি !

সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,

ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,- হিম স্তন,- হিম রোমকূপ !

 

আমি দেখিয়াছি তারে,ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি

তারি পেয়ালায় হায়! - পৃথিবীর উষা ছেড়ে আসিয়াছি নামি

কান্তারে;- ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর,

আমি দেখিয়াছি ছায়া, - শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর !

বুকে মোর,কোলে মোর - কঙ্কালের কাঁকালের চুমা !

-গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,- ‘ঘুমা- ঘুমা !’

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-   

ডালিম ফুলের মত ঠোঁট যার, -রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,

চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আখিঁ গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন,

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,-স্বপ্নে – কতো দিন!

                    

                          কবি

        ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন

        আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন !

        নিরালায় সুর বাঁধি,-বাঁধি মোর মানসীর বেণী,

        মানুষ দেখেনি মোরে কোনোদিন,-আমারে চেনেনি !

 

কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায়নি মোর চারিপাশে,-

শুধায়নি কেহ কভু- ‘আসে কি রে,-সে কি আসে-আসে-!

আসেনি সে ভরাহাটে,-খেয়াঘাটে- পৃথিবীর পসরার মাঝে,

পাটনী দেখেনি তারে কোনদিন- মাঝি তরে ডাকেনিকো সাঁজে ।

পারাপার করেনি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-

চেনা-চেনা মুখ সবি, -সে যে শুধু সুদূর-অজানা !

 

        করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,

        রূপ-সাগরের মাঝে কোন্ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে !

        সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;

        খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,

        বাবলার ফুলে-ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতির-পাখা,

        ননির আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনা-শাখা !

 

হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে

বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে !

হয়তো শুনেছো তারে,- তার সুর, -দুপুর আকাশে

ঝরাপাতা-ভরা মরা দরিয়ার পাশে

বেজেছে ঘুঘুর মুখে, - জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়

হলুদ পাতায় ভিড়ে শিরশিরে পুবালি হাওয়ায় !

 

        হয়তো দেখেছো তারে ভূতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের ’পরে

        নিভে-যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে !

         শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় যেই জ্যোৎস্না ভাসে

         তারি বুকে চুপে-চুপে কবি আসে,- সুর তার আসে !

         উসখুস এলো চুলে ভ’রে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-

         তারি পাশে সুর ভাসে,- অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি !

 

বালুঘড়িটির বুকে ঝিরিঝিরি-ঝিরিঝিরি গান যবে বাজে

রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে,- অকাজে !

ঘুম-কুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ,

যখন ঘমায়ে থাকে টুনটুনি,-মধুমাছি,-ঘাস,

হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী ঝাড়ে,

বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,

তেঁতুলের শাখে-শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,

মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে !

 

         জোনাকির মতো সে যে দূরে-দূরে যায় উড়ে-উড়ে-

         আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে !

         জ্ব’লে ওঠে আলেয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি ।

         আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্ পাষাণী !

 

জানে না তো কি যে চায়, -কবে হায় কি গেছে হারায়ে !

চোখ বুজে খোঁজে একা,- হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে

কারে আহা ।- কাঁদে হাহা পুবের বাতাস,

শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস !

তারি লাগি মুখ তোলে কোন্ মৃতা, -হিম-চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,

তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়া-পুত্তলিকা !