ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ |
জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচিঝরা-পালক
বুকে তব সুর-পরী বিরহ-বিধুর গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর ! কোন্ দূর আকাশের ময়ূর-নিলীমা তোমারে উতালা করে ! বালুচরসীমা উল্লঙ্ঘি তুলিছো তাই শিরোপা তোমার,- উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি,-তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার ! গলে মৃগতৃষ্ণবিষ, মারীর আগল তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল ! উদ্যত ঊর্মির বুকে অরূপের ছবি নিত্যকাল বহিছো হে মরমিয়া কবি হে দুন্দুভি দুর্জয়ের, দুরন্ত, অগাধ ! পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি, বিজয়ের স্বাদ তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে ! কালে-কালে দেশে-দেশে মানুষ-সন্তানে তুমি শিখায়েছো বন্ধু দুর্মদ-দুরাশা ! আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা দুশ্চর তটের লাগি-সুদূরের তরে । রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে ধরেছো দুস্তরকাল;- তুচ্ছ অভিলাষ, দুদিনের আশা, অশান্তি, আকাঙ্ক্ষা, উল্লাস, পলকের দৈন্য-জ্বালা-জয়-পরাজয়, ত্রাস-ব্যথা-হাসি-অশ্রু-তপস্যা-সঞ্চয়,- পিনাকশিখায় তব হলো ছারখার । ইচ্ছার বাড়বকুন্ডে, উগ্র পিপাসার ধু-ধু-ধু-ধু বেদীতটে আপনারে দিতেছো আহুতি । মোর ক্ষুধা-দেবতারে তুমি করো স্তুতি ! নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি ‘পারীয়া’র প্রাণ ল’য়ে আছি মোরা জাগি বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে ! নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে বীভৎস খঞ্জের মতো করি মাতামাতি ! চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি ! ক্ষুরধার আকাঙ্ক্ষা অগ্নি দিয়া চিতা গড়ি তবু বার-বার- বার-বার ধুতুরার তিতা নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া । মোর বক্ষ-কপোতের কপোতিনী প্রিয়া কোথা কবে উড়ে গেছে,- প’ড়ে আছে আহা নষ্ট নীড়,- ঝরা পাতা,- পুবালির হাহা ! কাঁদে বুকে মরা নদী,- শীতের কু্যাশা ! ওহে সিন্ধু, আসিয়াছি আমি সর্বনাশা ভুখারী ভিখারী একা, আসন্ন-বিবশ ! -চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস, মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর, চাহি না নিতল নীড় বারুণীরানীর । মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার ! একদিন কুকুরের মতো হাহাকার তুলেছিনু ফোঁটা-ফোঁটা রুধিরের লাগি ! একদিন মুখখানা উঠেছিলো রাঙি ক্লেদবসাপিণ্ড চুমি রিক্ত-বাসনার ! মোরে ঘিরে কেঁদেছিলো কুহেলি আঁধার,- শ্মশানফেরুর পাল,- শিশিরের নিশা, আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা ! আমার হৃদয়পীঠে মোর ভগবান বেদনার পিরামিড পাহাড়প্রমাণ গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া; রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব-স্বপনে, হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে ! -পূজাথালা হাতে লয়ে আসিয়াছে কতো পান্থ, কতো পথবালা সহর্ষে সমুদ্রতীরে; বুকে যার বিষমাখা শায়কের জ্বালা সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে-চুপে একা । অন্ধকারে একবার দুজনার দ্যাখা । বৈশাখের বেলাতটে, সমুদ্রের স্বর,- অনন্ত, অভঙ্গ, উষ্ণ, আনন্দসুন্দর ! তারপর, দূর পথে অভিযান বাহি চ’লে যাবো জীবনের জয়গান গাহি ।
বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছো নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা অশান্ত সন্তান ওগো,— বিপ্লবিনী পদ্মা ছিলো তব নদী-মাতা। কালবৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতো রক্তপুঞ্জ তব উত্তাল ঊর্মির তালে, —বক্ষে তব লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব উদ্যত ফণার নৃত্যে আস্ফালিত ধূর্জটির কণ্ঠ-নাগ জিনি, ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিলো সদা শত্রু –অক্ষৌহিণী। স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি, এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ,— ক্লৈব্যের সংহারী। ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর, ভেঙেছিলে ধুলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর, ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভাণ্ড তীব্র দর্পে, — বৈরাগের রাগে, দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে—পৃথ্বী-পুরোভাগে। নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাবগঙ্গোত্তরী আর্ত অস্পৃশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি; বাদলের মন্দ্র-সম মন্ত্র তব দিকে-দিকে তুলিলে বৈরাগী। এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ, শান্তিপ্রিয় মুমূর্ষর শ্মাশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ, গাণ্ডীবের টঙ্কারেতে মহুর্মুহু বলেছিলে,— ‘আছি,আমি আছি ! কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী।’ ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভোলির সম, অলঙ্ঘ্য, অজয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম। ছিলে তুমি রুদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে, অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে- অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে । ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন-ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি। ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে উন্মত্ত ঝটিকাসম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে; শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশ্যলকরণী । ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে শব-সাধকের বেশে, —সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে। রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী; কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হ’লে দেশ-অধিপতি। বিধিবেশে দূরাগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক, অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোক। মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল, গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন,—উচ্ছ্বাসউচ্ছল । যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিলো ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে, তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিলো ভোগবতী ধারার আশ্লেষে। অর্চনার হোমকুণ্ডে হবি-সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি, বামদেবতার পদে অকাতর দিয়ে গেলো মেধ্য হিয়া ডালি। গৌরকান্তি শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা চুপে-চুপে রেখে এলো পুঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা।
জয়,—তরুণের জয় ! জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক, —জয়, —জয় চিন্ময়! স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিলো,— উষা উঠেছিলো জেগে পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে,— অরুণ-রঙিন মেঘে; আলোকে তোমার ভারত, এশিয়া,— জগৎ গেছিলো রেঙে ।
হে যুবক মুসাফের, স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শঙ্খ জাগরণপর্বের! জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি, সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী, রুক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়-দমন বাঁশি!
আসিলে সব্যসাচী, কোদণ্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিলো প্রাচী! টঙ্কারে তব দিকে-দিকে শুধু রণিয়া উঠিলো জয়, ডঙ্কা তোমার উঠিলো বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়; শঙ্কাহরণ ওহে সৈনিক,— নাহিকো তোমার ক্ষয়;
তৃতীয় নয়ন তব ম্লান বাসনার মনসিজ নাশি জ্বালাইতো উৎসব! কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিতো রুখে, হানিতে আঘাত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে, অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!
কৃষ্ণচক্র-সম ক্লৈব্যের হৃদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুসোত্তম, এসেছিলে তুমি ভিখারির দেশে ভিখারির ধন মাগি নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে,— হে তরুণ বৈরাগী ! মর্মে তোমার বাজিতো বেদনা আর্ত জীবের লাগি ।
হে প্রেমিক মহাজন, তোমার পানেতে তাকাইলো কোটি দরিদ্র-নারায়ণ; অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে বার-বার যবে কেঁদে-কেঁদে গেলো কাতর আঁখির জলে, অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে ।
কোথা পাপী ? তাপী কোথা ? -ওগো ধ্যানী তুমি পতিতপাবন-যজ্ঞে সাজিলে হোতা! শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু ক’রে দিলে হোম, কোটি পঞ্চমা আতুরের তরে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম, মন্ত্রে তোমার বাজিলো বিপুল শান্তি স্বস্তি ওঁ!
সোনার মুকুট ভেঙে ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে! স্বার্থ-লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি, যজ্ঞের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি, বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিলো অংশুমালী!
দরিয়ার দেশে নদী! —বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল বোধি! হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে, আসিলে করুণা-প্রদীপ হস্তে হিংসার অমারাতে, ব্যাধি-মন্বন্তরে এলে তুমি সুধা-জলধির সংঘাতে!
মহামারী-ক্রন্দন ঘুচাইলে তুমি শীতল পরশে, —ওগো সুকোমল-চন্দন! বজ্র-কঠোর, কুসুম-মৃদুল,—আসিলে লোকোত্তর; হানিলে কুলিশ কখনো, —ঢালিলে নির্মল নির্ঝর, নাশিলে পাতক, —পাতকীরে তুমি অর্পিলে নির্ভর।
চক্র-গদার সাথে এনেছিলে তুমি শঙ্খ-পদ্ম,—হে ঋষি, তোমার হাতে; এনেছিলে তুমি ঝড়-বিদ্যুৎ,—পেয়েছিলে তুমি সাম, এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব,—শান্তি-কুসুমদাম; মাভৈঃ-শঙ্খে জাগিছে তোমার নরনারায়ণ-নাম!
জয়,-তরুণের জয়! আত্মাহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়! তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে ওঠে বার-বার! নাহি রে মরণে বিনাশ,—শ্মশানে নাহি তার সংহার, দেশে-দেশে তার বীণা বাজে— বাজে কালে-কালে ঝঙ্কার! |