ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ |
জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচিঝরা-পালক
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে- পুণ্য ভারতপুরে পূজার ঘণ্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে-সুরে ! আহ্নিক হেথা শুরু হ’য়ে যায় আজান-বেলার মাঝে, মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে-গগনে বাজে; জপে ঈদগাতে তসবী ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে, সন্ধ্যা-উষায় বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি ? —মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী; আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা ওগো ভারতের মোসলেমদল,—তোমাদের বুক-জোড়া ! ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা, —আর্যাবর্ত ভাঙি গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি ! —নবীন প্রাণের সাড়া আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা !
রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন, —তোমার প্রাণ ! —হেথায় তোমার ধর্ম-অর্থ, —হেথায় তোমার ত্রাণ; হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা; যুগ-যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছো তুমি বাসা, গড়িয়াছো ভাষা কল্পে-কল্পে দরিয়ার তীরে বসি, চক্ষে তোমার ভারতের আলো, —ভারতের রবি, শশী, হে ভাই মুসলমান তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান !
এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহেকো আমার একা, —হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ, মুসলমানের রেখা; হিন্দু-মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে, ইন্দ্রদ্যুম্নে-উজ্জয়িনীতে মথুরা-বৃন্দাবনে ! পাটলীপুত্র-শ্রাবস্তী-কাশী-কোশল-তক্ষশীলা অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা ! —ভারতী কমলাসীনা কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা !
এই ভারতের তখ্তে চড়িয়া শাহানশাহার দল স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল ! —গিয়েছে তাহারা কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি, পরশে তাদের জেগেছে আরব-উপন্যাসের রাতি ! জেগেছে নবীন মোঘল-দিল্লী,—লাহোর,—ফতেহ্পুর, যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর ! নতুন প্রেমের রাগে তাজমহলের তরুণিমা আজো উষার অরুণে জাগে !
জেগেছে হেথায় আকবরী আইন, —কালের নিকষ কোলে বার-বার যার উজল সোনার পরশ উঠিছে জ্ব’লে । সেলিম,—শাজাহাঁ,—চোখের জলেতে একশা করিয়া তারা গড়েছে মিনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা ! —ছড়ায়ে রয়েছে মোগল ভারত, —কোটি-সমাধির স্তূপ তাকায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন,—অপলক, অপরূপ ! — যেন মায়াবীর তুড়ি স্বপনের ঘোরে স্তব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী !
মোতিমহলের অযুত রাত্রি, —লক্ষ দীপের ভাতি আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি ! আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে —অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে ! দিকে-দিকে আজো বেজে ওঠে কোন্ গজল-ইলাহী গান ! পথ-হারা কোন্ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ ! —নিখিল ভারতময় মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয় !
এসেছিলো যারা ঊষর ধূসর মরুগিরিপথ বেয়ে, একদা যাদের শিবিরে-সৈন্যে ভারত গেছিলো ছেয়ে, আজিকে তাহারা পড়শি মোদের, মোদের বহিন-ভাই; —আমাদের বুকে বক্ষ তাদের, আমাদের কোলে ঠাঁই । ‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে, ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা, মোস্লেম্ বিনা ভারত বিফল,—বিফল হিন্দু বিনা; —মহামৈত্রীর গান বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান !
নিখিল আমার ভাই —কীটের বুকেতে যেই ব্যাথা জাগে আমি সে বেদনা পাই; যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি, কোন্ ফণী যেন আকাশ-বাতাসে তোলে বিষ-গরজনি ! কি যেন যাতনা মাটির বুকেতে অনিবার ওঠে রণি, আমার শস্য-স্বর্ণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই ! —সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।
আকাশ হতেছে কালো কাহাদের যেন ছায়াপাতে হায়, নিভে যায় রাঙা আলো ! বাতায়নে মোর ভেসে আসে যেন কাদের তপ্ত-শ্বাস, অন্তরে মোর জড়ায়ে কাদের বেদনার নাগপাশ, বক্ষে আমার জাগিছে কাদের নিরাশা, গ্লানিমা, ত্রাস, —মনে-মনে আমি কাহাদের হায় বেসেছিনু এতো ভালো । তাদের ব্যথার কুহেলি-পাথারে আকাশ হতেছে কালো ।
লভিয়াছে বুঝি ঠাঁই আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে নিখিলের বোন-ভাই ! আমার গানেতে জাগিছে তাদের বেদনা-পীড়ার দান, আমার প্রাণেতে জাগিছে তাদের নিপীড়িত ভগবান, আমার হৃদয়-যূপেতে তাহারা করিছে রক্তস্নান, আমার মনের চিতানলে জ্ব’লে লুটায়ে যেতেছে ছাই ! আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে লভিয়াছে তারা ঠাঁই ।
আগার তাহার বিভীষিকাভরা— জীবন মরণময় ! সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে, —সে যে ব্যাধি, —সে যে ক্ষয়; প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগার রচিয়াছে সে যে, —দিনের আলোয় রুদ্ধ করেছে দ্বার ! সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর, কালনাগিনীর ফণার মতন নাচে সে বুকের ’পর ! চক্ষে তাহার কালকূট ঝরে, —বিষপঙ্কিল শ্বাস, সারাটি জীবন মরীচিকা তার, —প্রহসন-পরিহাস ! ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হ’য়ে যায় শশীতারকার শিখা, আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা ! সে যে মন্বন্তর, —মৃত্যুর দূত, —অপঘাত, —মহামারী, — মানুষ তবু সে, —তার চেয়ে বড়ো, —সে যে নারী, সে যে নারী !
মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,— নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে-ধীরে বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে ! —আকাশ মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর ! —নিস্তব্দ পল্লীর পথে কুহকের সুর বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে-ক্ষণে ! সে কোন্ পিপাসা কোন্ ব্যথা তার মনে ! হারায়েছে প্রিয়ারে কি ?- অসীম আকাশে ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে ? বাঞ্জিত দেয়নি দ্যাখা নিমেষের তরে ! — কবে কোন্ রুক্ষ কালবৈশাখীর ঝড়ে ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি ! —নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী গেয়ে যায় ; সুপ্ত পল্লীতটিনীর তীরে ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে ! —পল্লবে নিস্তব্ধ পিক, —নীরব পাপিয়া, গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিনী হিয়া ! আকাশে গোধূলি এলো, —দিক হলো ম্লান, ফুরায় না তবু হায় হুতাশীর গান ! —স্তিমিত পল্লীর তটে কাঁদে বার-বার, কোন্ যেন সুনিভৃত রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত হ’লো না আর কোন্ সে গোপন নিলো না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন !
কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে রূপময়ী তন্বী মাধবীরে ধরণী বরিয়া লয় বারে-বারে-বারে ! —আমাদের অশ্রুর পাথারে ফুটে ওঠে সচকিতে উৎসবের হাসি,— অপরূপ বিলাসের বাঁশি ! ভগ্ন-প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি, ফেনাময় সুরাপাত্র ধরি ভুলে যাই বিষের আস্বাদ ! মোহময় যৌবনের সাধ আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন-অধর ! চির-মৃত্যুচর হে মৌন শ্মশান, ধূম-অবণ্ডণ্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান হেরিতেছো কিসের স্বপন ! ক্ষণে-ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নির্বাপন স্তব্ধ করি রাখিতেছো বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি ! তব মুখপানে চেয়ে কবে বৈতরণী হ’য়ে গেছে কলহীন ! বক্ষে তব হিম হ’য়ে আছে কতো উগ্রশিখা চিতা হে অনাদি পিতা ! ভস্মগর্ভে, —মরণের অকূল শিয়রে জন্মযুগ দিতেছো প্রহরা,— কবে বসুন্ধরা মৃত্যুগাঢ় মদিরার শেষ পাত্রখানি তুলে দেবে হস্তে তব, —কবে লবে টানি কঙ্কাল-অঙ্গুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে শ্মশান-তিমিরে, লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার বিবসনা শোভা দিব্য মনোলোভা ! কোটি-কোটি চিতা-ফণা দিয়া রূপসীর অঙ্গ আলিঙ্গিয়া শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু ! এ বসুধা-বধূ আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার ধ্বক-ধ্বক-দারুণ তৃষ্ণার রসনা মেলিয়া— অপেক্ষায় জেগে আছে শ্মশানের হিয়া ! আলোকে-আঁধারে অগণন চিতার দুয়ারে যেতেছে সে ছুটে, তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে আনিতেছে নব-মৃত্যু-পথিকেরে ডাকি, তুলিতেছে রক্ত-ধূম্র আঁখি ! —নিরাশার দীর্ঘশ্বাস শুধু বৈতরণীমরু ঘেরি জ্ব’লে যায় ধু-ধু, আসে না প্রেয়সী ! -নিদ্রাহীন শশী, আকাশের অনাদি তারকা রহিয়াছে জেগে তার সনে; শ্মশানের হিম বাতায়নে শত-শত প্রেতবধূ দিয়ে যায় দ্যাখা,- তবু সে যে প’ড়ে আছে একা, বিমনা-বিরহী ! বক্ষে তার কতো লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি, কতো শৌর্য-সাম্রাজ্যের সীমা প্রেম-পুণ্য-পূজার গরিমা অকলঙ্ক সৌন্দর্যের বিভা গৌরবের দিবা ! —তবু তার মেটে নাই তৃষা; বিচ্ছেদের নিশা আজো তার হয় নাই শেষ ! অশ্রান্ত অঙ্গুলি সে যে করিছে নির্দেশ অবনীর পক্কবিম্ব অধরের ’পর ! পাতাঝরা হেমন্তের স্বর ক’রে দেয় সচকিত তারে, হিমানী-পাথারে কুয়াশাপুরীর মৌন জালায়ন তুলে চেয়ে থাকে আঁধারে অকূলে সুদূরের পানে ! বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ-সন্ধানে এলো কি রে জাহ্নবীর শেষ উর্মিধারা ! অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি, —কামনা-সাহারা ! |