ভাষাংশ | জীবনানন্দ দাশ | জীবনানন্দ দাসের রচনাবলীর সূচি


ঝরা-পালক


মিশর

‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন,

‘স্ফীঙ্কস’-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ !

ঝাঁ-ঝাঁ মরুর ‘লু’য়ের ‘ফুঁ’য়ে হচ্ছে বিলীন-ক্ষীণ

মিশর দেশের কাফন পাহাড় পিরামিডের স্তূপ !

 

নিভে গেছে ‘ঈশিশে’রি বেদীর থেকে ধূমা,

জুড়িয়ে গেছে লকলকে সেই রক্তজিভার চুমা !

এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমারীপূজার ঘটা,

দুলছে মরুমশান-শিরে মহাকালের জটা !

ঘুমন্তদের কানে-কানে কয় সে,- ‘ঘুমা,- ঘুমা’ !

 

ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও,ফ্যারাও-ছেলে,

তাদের বুকে যাচ্ছে আকাশ বর্শা ঠেলে-ঠেলে !

হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে ‘মেম্ননে’রি বুক,

ডুবে গেছে মিশররবি, বিরাট ‘বেলে’র ভুখ

জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমায় জ্বেলে !

 

পিরামিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে

স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে !

সোনার কাঠি নেই কি তাহার ? জাগবে না কি আর !

মৃত্যু, সে কি শেষের কথা ? শেষ কি শবাধার ?

সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে !

 

নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ ।

কুমীরগুলোর খুলির খিলান,করাত দাঁতের খাপ

উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়; ঘুমপাড়ানির ঘুম

হানছে আঘাত, আকাশ-বাতাস হচ্ছে যেন গুম !

ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ !

 

নীলা, নীলা, ধুকধুকিয়ে মিশরকবর-পারে

রইলে জেগে বোবা বুকের বিকল হাহাকারে !

লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় ‘রামেসেসে’র দেশ !

অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ

নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে !

 

কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ওই নারী,

ওই পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি-সারি;

ইয়াঙ্কি ওই, ওই য়ুরোপী, চীনে-তাতার-মুর্

তোমার বুকের পাঁজর দলে টলতেছে হুড়মুড়,

ফেনিয়ে তুলে খুনখারাবী, খেলাপ, খবরদারি !

 

দিনের আলো ঝিমিয়ে গেলো, আকাশে ওই চাঁদ !

চপল হাওয়ায় কাঁকন কাঁদায় নীলনদেরই বাঁধ !

মিশর-ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুঁড়িখানার সুরে

বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে খেজুরবনে দূরে !

আফ্রিকা এই, এই যে মিশর জাদুর এ যে ফাঁদ !

 

‘ওয়েসিসে’র ঠাণ্ডা ছায়ায় চৈতিচাঁদের তলে

মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে !

চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট

এই যে মিশরআফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট !

কি এক মোহ এই হাওয়াতে এই দরিয়ার জলে !

 

শীতল পিরামিডের মাথা, ‘গীজে’র মুরতি

অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি

আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে !

‘মেম্ননে’র ওই কণ্ঠ ভরে চারণ-বীণার গানে !

আবার জাগে ঝাণ্ডাঝালর, জ্যান্ত আলোর জ্যোতি !

 

পিরামিড

বেলা ব’য়ে যায়

গোধূলির মেঘ-সীমানায়

ধূম্রমৌন সাঁঝে

নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে,

শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে;

পান্থ ম্লান চিতার কবলে

একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;

কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ

কি এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন !

অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন

চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের;

কোন্ দিবা-অবসানে  গৌরবের লক্ষ মুসাফের

দেউটি নিভায়ে গেছে চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া,

চ’লে গেছে প্রিয়তম চ’লে গেছে প্রিয়া

যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি

চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী

কবে কোন্ বেলাশেষে হায়

দূর অস্তশেখরের গায় ।

তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;

সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া

মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী,

তোরণে আসেনি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী

অশ্রু-ছলছল চোখে পাণ্ডুর বদনে;

কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তারা গেলো দূর দ্বারে বাতায়নে

জানো নাই তুমি;

জানে না তো মিশরের মূক মরুভূমি

তাদের সন্ধান ।

হে নির্বাক পিরামিড, অতীতের স্তব্ধ প্রেতপ্রাণ

অবিচল স্মৃতির মন্দির,

আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি ব’সে আছো স্থির;

নিষ্পল যুগ্মভুরু তুলে

চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে

মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে,

জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে

নূতন ভাস্কর;

বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর

নবোদিত অরুণের সনে-

কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গলি-তাড়নে !

পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধিরফোয়ারা-

কি এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া !

থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন;

শতাব্দীর বিরহীর মন

নিটল নিথর

সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত-পীত সাগরের ’পর;

বালুকার স্ফীত পারাবারে

লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে

মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি

মৌন ভিক্ষা মাগি ।

খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার

মুখরিত প্রাণের সঞ্চার

ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়

বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই ব’সে আছে পিরামিড হায় ।

কতো আগন্তুক-কাল অতিথি-সভ্যতা

তোমার দুয়ারে এসে ক’য়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা,

তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল,

তুমি রহো নিরুত্তর নির্বেদী নিশ্চল

মৌন, অন্যমনা;

প্রিয়ার বক্ষের ’পরে বসি একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা

হে প্রেমিক স্বতন্ত্র স্বরাট ।

কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট

উঠিবে জাগিয়া,

সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া

আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডু চূর্ণ ব্যথিত কপোলে,

মিশরঅলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্ব’লে,

ব’সে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই;

ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই

জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি প্রেমের প্রহরা ।

মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা

হেমন্তের বিদায়-কুহেলি

অরুন্তদ আঁখি দুটি মেলি

গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান

দু-দিনের তরে শুধু; নবোৎফুল্লা মাধবীর গান

মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে

নিমেষে চকিতে;

অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে

ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে ।

 

           মরুবালু

হাড়ের মালা গলায় গেঁথে অট্টহাসি হেসে

             উল্লাসেতে টলছে তারা, জ্বলছে তারা খালি !

ঘুরছে তারা লাল মশানে কপাল-কবর চষে,

             বুকের বোমাবারুদ দিয়ে আকাশটারে জ্বালি

পাঁয়জোরে কাল মহাকালের পাঁজর ফেঁড়ে-ফেঁড়ে

             ‌মড়ার বুকে চাবুক মেরে ফিরছে মরুর বালি !

 

সর্বনাশের সঙ্গে তোরা দম্ভে খেলিস পাশা !

            হেথায় কোন্-এক সৃষ্টিপ্রাতের সূত্রপাতের ভূমি,

শিশুমানব গড়েছিলো ওই সাহারায় বাসা;

             সে-সব গেছে কবে ঘুমের চুমার ধোঁয়ায় ধূমি !

অটল আকাশ যাচ্ছে জরির ফিতার মতো ফেঁড়ে,

             জবান তোদের জ্বলছে যমের চিতার গেলাস চুমি !

 

তোদের সনে ‘ডাইনোসুরে’র লড়াই হলো কতো

             আলুথালু লুটিয়ে বালুর ডাইনী ছায়ার তলে

আজকে তারা ঘুমিয়ে আছে, চুল্লি শত-শত

             উঠলো জ্ব’লে তাদের হাড়ে, তাদের নাড়ের বলে;

কাঁদছে খাঁ-খাঁ কাফন-ঢাকা বালুর চাকার নিচে

             মুণ্ড তাদের, মড়ার কপাল ভৈরবেরি গলে !

 

তোদের বুকে জাগছে মৃগতৃষ্ণা, জাগে ঝড় !

            নিস উড়িয়ে শিকার-সোয়ার ধোঁয়ার পিছে-পিছে,

মেঘে-মেঘে চড়াও, বাজের বুক চিরে চক্কর !

            নাচতে আছিস আকাশখানার গোখরাফণার নিচে,

আরব-মিশর চীন-ভারতের হাওয়ায় ঘুরে-ঘুরে

            সত্য-ত্রেতা দ্বাপর-কলি হাপর খিঁচে-খিঁচে !

 

তোদের ভাষা আস্ফালিছে শেখ-সেনারীর বুকে !

            লাল সাহারার শেরের সোয়ার বালুর ঘায়ে ঘেয়ো,

ধমক মেরে আঁধির বুকে ছুটছে রুখে-রুখে !

           তোদের মতন নেইকো তাদের সোদর-সাথী কেহ,

নেইকো তোদের মতন পিছুডাকের মায়া,

             নেইকো তাদের মোদের মতন আর্ত মোহ-স্নেহ ।

 

দানোয়-পাওয়া আগুনদানা, দারুণ পথের মুখে !

            ঘায়েল করি মেঘের বুরুজ বল্লমেরি ঘর,

উড়িয়ে হাজার ‘ক্যারাভেন’ ও তাম্বুশিবির-বুকে,

            উজিয়ে মরীচিকার শিখা কালফণা-জর্জর

টলতে আছিস, দলতে আছিস, জ্বলতে আছিস ধু-ধু

           সঙ্গে স্যাঙাতমসুদ ডাকাত, তাতার যাযাবর !

 

গাড়তে যাবে যারা তোদের বুকের মাঝে বাসা

            হাড্ডি তাদের ফোঁপরা হ’য়ে ঝুরবে বালুর মাঝে,

এইখানেতে নেইকো দরদ, নেইকো ভালোবাসা,

            বর্শা লাফায়, উটের গলার ঘুণ্টি শুধু বাজে !

ফুরিয়ে গেছে আশা যাদের, জুড়িয়ে গেছে জ্বালা,

            আয় রে বালুর ‘কারবালা’তে, অন্ধকারের ঝাঁঝে !