অব্যক্ত
সেতারের তার অঙ্গুলিতাড়নে ঝংকার দিয়া উঠে। দেখা যায়, তার কাঁপিতেছে। সেই কম্পনে বায়ুরাশিতে অদৃশ্য ঢেউ উৎপন্ন হয় এবং তাহার আঘাতে কর্ণেন্দ্রিয়ে সুর উপলব্ধি হয়। এইরূপে তিনের সাহায্যে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে সংবাদ প্রেরিত ও উপলব্ধ হইয়া থাকে– প্রথমতঃ শব্দের উৎস ঐ কম্পিত তার, দ্বিতীয়তঃ পরিবাহক বায়ু এবং তৃতীয়তঃ শব্দবোধক কর্ণেন্দ্রিয়।
সেতারের তার
যতই ছোটো করা যায়, সুর ততই উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তমে উঠিয়া থাকে। এইরূপে বায়ুস্পন্দন
প্রতি সেকেণ্ডে ৩০,০০০ বার হইলে অসহ্য উচ্চ সুর শোনা যায়। তার আরও খাটো করিলে সুর
আর শুনিতে পাই না। তার তখনও কম্পিত হইতেছে, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয় সেই অতি উচ্চ সুর
উপলব্ধি করিতে পারে না। শ্রবণ করিবার উপরের দিকে যেরূপ এক সীমা আছে, নীচের দিকেও
সেইরূপ। স্থুল তার কিংবা ইস্পাত আঘাত করিলে অতি ধীর স্পন্দন দেখিতে পাওয়া যায়,
কিন্তু কোনো শব্দ শোনা যায় না। কম্পন-সংখ্যা ১৬ হইতে ৩০,০০০ পর্যন্ত হইলে তাহা
শ্রুত হয়; অর্থাৎ আমাদের শ্রবণশক্তি একাদশ সপ্তকের মধ্যে আবদ্ধ। কর্ণেন্দ্রিয়ের
অসম্পূর্ণতা হেতু অনেক সুর আমাদের নিকট অশব্দ।
বায়ুরাশির কম্পনে
যেরূপ শব্দ উৎপন্ন হয়, আকাশ স্পন্দনেও সেইরূপ আলো
উৎপন্ন হইয়া থাকে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের অসম্পূর্ণতা হেতু একাদশ সপ্তক সুর শুনিতে পাই।
কিন্তু দর্শনেন্দ্রিয়ের অসম্পূর্ণতা আরও অধিক; আকাশের অগণিত সুরের মধ্যে এক সপ্তক
সুরমাত্র দেখিতে পাই। আকাশস্পন্দন প্রতি সেকেণ্ডে চারি শত লক্ষ কোটি বার হইলে চক্ষু
তাহা রক্তিম আলো বলিয়া উপলব্ধি করে; কম্পন-সংখ্যা দ্বিগুণিত হইলে বেগুনি রঙ দেখিতে
পাই। পীত, সবুজ ও নীলালোক এই এক সপ্তকের অন্তর্ভুক্ত। কম্পন-সংখ্যা চারি শত লক্ষ
কোটির ঊর্ধ্বে উঠিলে চক্ষু পরাস্ত হয় এবং দৃশ্য তখন অদৃশ্যে মিলাইয়া যায়।
আকাশ-স্পন্দনেই আলোর উৎপত্তি, তাহা দৃশ্যই হউক অথবা অদৃশ্যই হউক।
এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, এই অদৃশ্য রশ্মি কি করিয়া ধরা যাইতে পারে, আর এই রশ্মি যে
আলো তাহার প্রমাণ কি? এ বিষয়ের পরীক্ষা বর্ণনা করিব। জার্মান অধ্যাপক হার্টজ
সর্বপ্রথমে বৈদ্যুতিক উপায়ে আকাশে ঊর্মি উৎপাদন করিয়াছিলেন। তবে তাঁহার ঢেউগুলি অতি
বৃহদাকার বলিয়া সরল রেখায় ধাবিত না হইয়া বক্র হইয়া যাইত। দৃশ্য আলোক-রশ্মির সম্মুখে
একখানি ধাতু ফলক ধরিলে পশ্চাতে ছায়া পড়ে; কিন্তু আকাশের বৃহদাকার ঢেউগুলি ঘুরিয়া
বাধার পশ্চাতে পৌঁছিয়া থাকে। জলের বৃহৎ ঊর্মির সম্মুখে উপলখণ্ড ধরিলে এইরূপ হইতে
দেখা যায়। দৃশ্য ও অদৃশ্য আলোর প্রকৃতি যে একই তাহা সূক্ষ্মরূপে প্রমাণ করিতে হইলে
অদৃশ্য আলোর ঊর্মি খর্ব করা আবশ্যক। আমি যে কল নির্মাণ করিয়াছিলাম তাহা হইতে উৎপন্ন
আকাশোর্মির দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। এই কলে একটি ক্ষুদ্র লণ্ঠনের
ভিতরে তড়িতোর্মি উৎপন্ন হয়। এক দিকে একটি খোলা নল; তাহার মধ্য দিয়া অদৃশ্য আলো
বাহির হয়। এই আলো আমরা দেখিতে পাই না, হয়তো অন্য কোনো জীবে দেখিতে পায়। পরীক্ষা
করিয়া দেখিয়াছি যে, এই আলোকে উদ্ভিদ্ উত্তেজিত হইয়া থাকে।
অদৃশ্য আলো দেখিবার জন্য কৃত্রিম চক্ষু নির্মাণ করা আবশ্যক। আমাদের
চক্ষুর পশ্চাতে স্নায়ু-নির্মিত একখানি পর্দা আছে; তাহার উপর আলো পতিত হইলে
স্নায়ুসূত্র দিয়া উত্তেজনা-প্রবাহ মস্তিষ্কের বিশেষ অংশকে আলোড়িত করে এবং সেই আলোড়ন
আলো বলিয়া অনুভব করি। কৃত্রিম চক্ষুর গঠন খানিকটা ঐরূপ। দুইখানি ধাতুখণ্ড পরস্পরের
সহিত স্পর্শ করিয়া আছে। সংযোগস্থলে অদৃশ্য আলো পতিত হইলে সহসা আণবিক পরিবর্তন ঘটিয়া
থাকে এবং তাহার ফলে বিদ্যুৎস্রোত বহিয়া চুম্বকের কাঁটা নাড়িয়া দেয়। বোবা যেরূপ হাত
নাড়িয়া সংকেত করে, অদৃশ্য আলো দেখিতে পাইলে কৃত্রিম চক্ষুও সেইরূপ কাঁটা নাড়িয়া
আলোর উপলব্ধি জ্ঞাপন করে।
এখন দেখা যাউক, দৃশ্য এবং অদৃশ্য আলোকের প্রকৃতি একবিধ অথবা
বিভিন্ন।
দৃশ্য আলোকের প্রকৃতি এই যে–
১. ইহা সরল রেখায় ধাবিত হয়। ২. ধাতুনির্মিত দর্পণে পতিত হইলে আলো প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে। রশ্মি প্রতিফলিত হইবারও একটা বিশেষ নিয়ম আছে। ৩. আলোর আঘাতে আণবিক পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। সেইজন্য আলো-আহত পদার্থের স্বাভাবিক গুণ পরিবর্তিত হয়। ফোটোগ্রাফের প্লেটে যে ছবি পড়ে তাহাতে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে এবং ডেভেলপার ঢালিলে ছবি ফুটিয়া উঠে। ৪. সব আলোর রঙ এক নহে; কোনোটা আলো লাল, কোনোটা পীত, কোনোটা সবুজ এবং কোনোটা নীল। বিভিন্ন পদার্থ নানা রঙের পক্ষে স্বচ্ছ কিংবা অস্বচ্ছ। ৫. আলো বায়ু হইতে অন্য কোনো স্বচ্ছ পদার্থের উপর পতিত হইলে বক্রীভূত হয়। আলোর রশ্মি ত্রিকোণ কাচের উপর ফেলিলে ইহা স্পষ্টত দেখা যায়। কাচ-বর্তুলের ভিতর দিয়া আলো অক্ষীণভাবে দূরে প্রেরণ করা যাইতে পারে। ৬. আলোর ঢেউয়ে সচরাচর কোনো শৃঙ্খলা নাই; উহা সর্বমুখী; অর্থাৎ কখনও ঊর্ধ্বঃ কখনও বা দক্ষিণে বামে স্পন্দিত হয়। স্ফটিকজাতীয় পদার্থ দ্বারা আলোক-রশ্মির স্পন্দন শৃঙ্খলিত করা যাইতে পারে; তখন স্পন্দন বহুমুখী না হইয়া একমুখী হয়। একমুখী আলোর বিশেষ ধর্ম পরে বলিব। |
দৃশ্য ও অদৃশ্য আলোর প্রকৃতি যে একই রূপ, এক্ষণে সেই পরীক্ষা বর্ণনা
করিব।
প্রথমতঃ, অদৃশ্য আলোক যে সোজা পথে চলে তাহার প্রমাণ এই যে,
বিদ্যুতোর্মি বাহির হইবার জন্য লণ্ঠনে যে নল আছে সেই নলের সম্মুখে সোজা লাইনে
কৃত্রিম চক্ষু ধরিলে কাঁটা নাড়িয়া উঠে। চক্ষুটিকে এক পাশে ধরিলে কোনো উত্তেজনার
চিহ্ন দেখা যায় না।
দর্পণে যেরূপ দৃশ্য আলো প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে এবং সেই
প্রত্যাবর্তন যে নিয়মাধীন, অদৃশ্য আলোকও সেইরূপে এবং সেই নিয়মে প্রতিহত হইয়া
প্রত্যাবর্তন করে।
দৃশ্য আলোর আঘাতে আণবিক পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। অদৃশ্য আলোকও যে
আণবিক পরিবর্তন ঘটায় তাহা পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছি।
পূর্বে বলিয়াছি যে, দৃশ্য আলোক নানা বর্ণের। অনুভুতির দ্বারা বর্ণের
বিভিন্নতা সহজেই করিতে পারি; কিন্তু বর্ণের বিভিন্নতা অনেকেই ধরিতে পারেন না।
তাঁহারা বর্ণ সম্বন্ধে অন্ধ। বর্ণের বিভিন্নতা অন্য উপায়ে ধরা যাইতে পারে; সে বিষয়
পরে বলিব। এইখানে বলা আবশ্যক যে, মানুষের দৃষ্টি-সীমার ক্রমবিকাশ হইতেছে। বহু
পূর্বপুরুষদের বর্ণজ্ঞান সংকীর্ণ ছিল, তাহা অন্ততঃ এক দিকে প্রসারিত হইয়াছে। আর
অন্য দিকেও কোনোদিন প্রসারিত হইবে। তাহা হইলে এখন যাহা অদৃশ্য তখন তাহা দৃশ্যের
মধ্যে আসিবে।
সে যাহা হউক, অদৃশ্য আলোর রঙ সম্বন্ধে কয়েকটি অদ্ভুত পরীক্ষা বর্ণনা
করিব। জানালার কাচের কোনো বিশেষ রঙ নাই, সূর্যের আলো উহার ভিতর দিয়া অবাধে চলিয়া
যায়। সুতরাং দৃশ্য আলোর পক্ষে কাচ স্বচ্ছ, জলও স্বচ্ছ। কিন্তু ইট-পাটকেল অস্বচ্ছ,
আলকাতরা তদপেক্ষা অস্বচ্ছ। দৃশ্য আলোকের কথা বলিলাম। অদৃশ্য আলোকের সম্মুখে জানালার
কাচ ধরিলে তাহার ভিতর দিয়া এইরূপ আলো সহজেই চলিয়া যায়। কিন্তু জলের গেলাস সম্মুখে
ধরিলে অদৃশ্য আলো একেবারে বন্ধ হইয়া যায়। কিমাশ্চর্যমতঃপরম্! তদপেক্ষাও আশ্চর্যের
বিষয় আছে। ইট-পাটকেল, যাহা অস্বচ্ছ বলিয়া মনে করিতাম তাহা অদৃশ্য আলোকের পক্ষে
স্বচ্ছ। আর আলকাতরা? ইহা জানালার কাচ অপেক্ষাও স্বচ্ছ! কোথায় এক অদ্ভুত দেশের কথা
পড়িয়াছিলাম; সে দেশে জলাশয় হইতে মৎস্যেরা ডাঙায় ছিপ ফেলিয়া মানুষ শিকার করে। অদৃশ্য
আলোকের কার্যও যেন অনেকটা সেইরূপই অদ্ভুত হইবে।
কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। দৃশ্য আলোকেও এরূপ আশ্চর্য ঘটনা দেখিয়াছি; তাহাতে অভ্যস্ত বলিয়া বিস্মিত হই না। সম্মুখের সাদা কাগজের উপর দুইটি বিভিন্ন আলো-রেখা পতিত হইয়াছে; একটি লাল আর একটি সবুজ। মাঝখানে জানালার কাচ ধরিলে উভয় আলোই অবাধে ভেদ করিয়া যায়। এবার মাঝখানে লাল কাচ ধরিলাম; লাল আলো অবাধে যাইতেছে, কিন্তু সবুজ আলো বন্ধ হইল। সবুজ কাচ ধরিলে সবুজ আলো বাধা পাইবে না; কিন্তু লাল আলো বন্ধ হইবে। ইহার কারণ এই যে, ১. সব আলো এক বর্ণের নহে; ২. কোনো পদার্থ এক আলোর পক্ষে স্বচ্ছ হইতে পারে, কিন্তু অন্য আলোর পক্ষে অস্বচ্ছ। যদি বর্ণজ্ঞান না থাকিত তাহা হইলেও একই পদার্থের ভিতর দিয়া এক আলো যাইতেছে এবং অন্য আলো যাইতেছে না দেখিয়া নিশ্চয়রূপে বলিতে পারিতাম যে, দুইটি আলো বিভিন্ন বর্ণের। আলকাতরা দৃশ্য আলোর পক্ষে অস্বচ্ছ এবং অদৃশ্য আলোর পক্ষে স্বচ্ছ, ইহা জানিয়া অদৃশ্য আলোক যে অন্য বর্ণের তাহা প্রমাণিত হয়। আমাদের দৃষ্টিশক্তি প্রসারিত হইলে ইন্দ্রধনু অপেক্ষাও কল্পনাতীত অনেক নূতন বর্ণের অস্তি দেখিতে পাইতাম। তাহাতেও কি আমাদের বর্ণের তৃষ্ণা মিটিত?
মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
পূর্বে
বলিয়াছি যে, আলো এক স্বচ্ছ বস্তু হইতে অন্য স্বচ্ছ বস্তুর উপর পতিত হইলে বক্রীভূত
হয়। ত্রিকোণ কাচ কিংবা ত্রিকোণ ইষ্টকখণ্ড দ্বারা দৃশ্য ও অদৃশ্য আলো যে একই নিয়মের
অধীন, তাহা প্রমাণ করা যায়। কাচ-বর্তুল সাহায্যে দৃশ্য আলোক যেরূপ বহুদূরে
অক্ষীণভাবে প্রেরণ করা যাইতে পারে, অদৃশ্য আলোকও সেইরূপে প্রেরণ করা যায়। তবে এজন্য
বহুমূল্য কাচ-বর্তুল নিষ্প্রয়োজন, ইট-পাটকেল দিয়াও এইরূপ বর্তুল নির্মিত হইতে পারে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের সম্মুখে যে ইষ্টনির্মিত গোল স্তম্ভ আছে তাহা দিয়া অদৃশ্য আলো
দূরে প্রেরণ করিতে সমর্থ হইয়াছি। দৃশ্য আলো সংহত করিবার পক্ষে হীরকখণ্ডের অদ্ভুত
ক্ষমতা। বস্তুবিশেষের আলো সংহত করিবার ক্ষমতা যেরূপ অধিক, আলো বিকিরণ করিবার
ক্ষমতাও সেই পরিমাণে বহুল হইয়া থাকে। এই কারণেই হীরকের এত মূল্য। আশ্চর্যের বিষয় এই
যে, চীনা-বাসনের অদৃশ্য আলোক সংহত করিবার ক্ষমতা হীরক অপেক্ষাও অনেকগুণ অধিক।
সুতরাং যদি কোনোদিন আমাদের দৃষ্টিশক্তি প্রসারিত হইয়া রক্তিম বর্ণের সীমা পার হয়
তবে হীরক তুচ্ছ হইবে এবং চীনা-বাসনের মূল্য অসম্ভবরূপে বাড়িবে। প্রথমবার বিলাত
যাইবার সময় অভ্যস্ত কুসংস্কার হেতু চীনা-বাসন স্পর্শ করিতে ঘৃণা হইত। বিলাতে
সম্ভ্রান্ত ভবনে নিমন্ত্রিত হইয়া দেখিলাম যে, দেওয়ালে বহুবিধ চীনা- বাসন সাজানো
রহিয়াছে। ইহার এমন কি মূল্য যে, এত যত্ন? প্রথমে বুঝিতে পারি নাই, এখন বুঝিয়াছি
ইংরেজ ব্যবসাদার।
অদৃশ্য আলো দৃশ্য হইলে চীনা-বাসন অমূল্য হইয়া যাইবে। তখন তাহার তুলনায় হীরক কোথায়
লাগে! সেদিন শৌখিন রমণীগণ হীরকমালা প্রত্যাখ্যান করিয়া পেয়ালাপিরিচের মালা সগর্বে
পরিধান করিবেন এবং অচীনধারিণী নারীদিগকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখিবেন।
সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
প্রদীপের অথবা সূর্যের আলো
সর্বমুখী; অর্থাং স্পন্দন একবার ঊর্ধ্বাধঃ অন্যবার দক্ষিণে বামে হইয়া থাকে।
লঙ্কাদ্বীপের টুর্মালিন
স্ফটিকের
ভিতর দিয়া আলো প্রেরণ করিলে আলো একমুখী হইয়া যায়। দুইখানি টুর্মালিন সমান্তরালভাবে
ধরিলে আলো দুইয়ের ভিতর দিয়া ভেদ করিয়া চলিয়া যায়; কিন্তু একখানি অন্যখানির উপর
আড়ভাবে ধরিলে আলো উভয়ের ভিতর দিয়া যাইতে পারে না।
অদৃশ্য আলোকও
এইরূপে একমুখী করা যাইতে পারে। কিরূপে তাহা হয় বুঝাইতে হইলে নীতি-কথার বক ও শৃগালের
গল্প স্মরণ করা আবশ্যক। বক শৃগালকে নিমন্ত্রণ করিয়া পানীয় দ্রব্য গ্রহণ করিবার জন্য
বারংবার অনুরোধ করিল। লম্বা
বোতলে পানীয় দ্রব্য রক্ষিত ছিল। বক লম্বা ঠোঁট দিয়া অনায়াসে পান করিল; কিন্তু শৃগাল
কেবলমাত্র সৃক্কনী লেহন করিতে সমর্থ হইয়াছিল। পরের দিন শৃগাল ইহার প্রতিশোধ
লইয়াছিল। পানীয় দ্রব্য থালাতে দেওয়া হইয়াছিল। বক ঠোঁট কাৎ করিয়াও কোনো প্রকারেই
পানীয় শোষণ করিতে সমর্থ হয় নাই। বোতল ও থালার দ্বারা যেরূপে লম্বা ঠোঁট এবং চেপ্টা
মুখের বিভিন্নতা বুঝা যায়, সেইরূপ একমুখী আলোকের পার্থক্য ধরা যাইতে পারে, তাহা
লম্বা কিংবা চেপ্টা-ঊর্ধ্বধঃ অথবা এ-পাশ ও-পাশ।
বক-কচ্ছপ সংবাদ
মনে কর, দুই
দল জন্তু মাঠে চরিতেছে–
লম্বা জানোয়ার বক ও চেপ্টা জীব কচ্ছপ। সর্বমুখী অদৃশ্য
আলোকও এইরূপ দুই প্রকারের
স্পন্দনসঞ্জাত। দুই প্রকারের জীবদিগকে বাছিবার সহজ উপায়,
সম্মুখে লোহার গরাদ খাড়াভাবে রাখিয়া দেওয়া। জন্তুদিগকে তাড়া করিলে লম্বা বক সহজেই
পার হইয়া যাইবে; কিন্তু চাপ্টা কচ্ছপ গরাদের এ-পাশে থাকিবে। প্রথম বাধা পার হইবার
পর বকবৃন্দের সম্মুখে যদি দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরা যায়, তাহা হইলেও বক তাহা
দিয়া গলিয়া যাইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদখানাকে যদি আড়ভাবে ধরা যায়, তাহা হইলে বক
আটকাইয়া থাকিবে। এইরূপে একটি গরাদ অদৃশ্য আলোর সম্মুখে ধরিলে আলো একমুখী হইবে।
দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরিলে আলো উহার ভিতর দিয়াও যাইবে, তখন দ্বিতীয় গরাদটা
আলোর পক্ষে স্বচ্ছ হইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদটা আড়ভাবে ধরিলে আলো যাইতে পারিবে না,
তখন গরাদটা অস্বচ্ছ বলিয়া মনে হইবে। যদি আলো একমুখী হয় তাহা হইলে কোনো কোনো বস্তু
একভাবে ধরিলে অস্বচ্ছ হইবে; কিন্তু ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলে তাহার ভিতর দিয়া আলো
যাইতে পারিবে। পুস্তকের পাতাগুলি গরাদের মতো সজ্জিত। বিলাতে রয়্যাল ইন্স্টিটিউসনে
বক্তৃতা করিবার সময় টেবিলের উপর একখানা রেলের টাইম-টেব্ল, অর্থাৎ ব্রাড্শ ছিল,
তাহাতে ১০ হাজার ট্রেনের সময়, রেল-ভাড়া এবং অন্যান্য বিষয় ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত
ছিল। উহা এরূপ জটিল যে, কাহারও সাধ্য নাই ইহা হইতে জ্ঞাতব্য বিষয় বাহির করিতে পারে।
আমি পুস্তকের তমসাচ্ছন্নতা কিছু না মনে করিয়া পরীক্ষার সময় দেখাইয়াছিলাম যে,
বইখানাকে এরূপ করিয়া ধরিলে ইহার ভিতর দিয়া আলো যাইতে পারে না; কিন্তু ৯০ ডিগ্রি
ঘুরাইয়া ধরিলে পুস্তকখানা একেবারে স্বচ্ছ হইয়া যায়। পরীক্ষা দেখাইবামাত্র হাসির
রোলে হল্ প্রতিধ্বনিত হইল। প্রথম প্রথম রহস্য বুঝিতে পারি নাই। পরে বুঝিয়াছিলাম।
লর্ড রেলী আসিয়া বলিলেন যে, ব্রাড্শর ভিতর দিয়া এ পর্যন্ত কেহ আলোক দেখিতে পায়
নাই। কি করিয়া ধরিলে আলো দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা শিখাইলে জগৎবাসী আপনার নিকট
চিরকৃতজ্ঞ রহিবে। আমার বৈজ্ঞানিক লেখা পড়িয়া কেহ কেহ স্তম্ভিত হইবেন, দন্তস্ফুট
অথবা চক্ষুস্ফট করিতে সমর্থ হইবেন না। তাহা হইলে বইখানাকে ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলেই
সব তথ্য একবারে বিশদ হইবে।
আলো একমুখী
করিবার অন্য এক উপায় আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। যদিও এলোমেলোভাবে আকাশস্পন্দন
রমণীর কেশগুচ্ছ প্রবেশ করে, তথাপি বাহির হইবার সময় একবারে শৃঙ্খলিত হইয়া থাকে।
বিলাতের নরসুন্দরদের দোকান হইতে বহু জাতির কেশগুচ্ছ সংগ্রহ করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে
ফরাসী মহিলার নিবিড় কৃষ্ণকুন্তল বিশেষ কার্যকরী। এ বিষয়ে জার্মান মহিলার স্বর্ণাভ
কুন্তল অনেকাংশে হীন। প্যারিসে যখন এই পরীক্ষা দেখাই তখন সমবেত ফরাসী পণ্ডিতমণ্ডলী
এই নূতন তত্ত্ব দেখিয়া উল্লসিত হইয়াছিলেন। ইহাতে বৈরী জাতির উপর তাহাদের প্রাধান্য
প্রমাণিত হইয়াছে, ইহার কোনো সন্দেহই রহিল না। বলা বাহুল্য, বার্লিনে এই পরীক্ষা
প্রদর্শনে বিরত হইয়াছিলাম। যে সব পরীক্ষা বর্ণনা করিলাম তাহা হইতে দেখা যায় যে,
দৃশ্য ও অদৃশ্য আলোর প্রস্তুতি একই. আমাদের দৃষ্টিশক্তির অসম্পূর্ণতা হেতু উহাদিগকে
বিভিন্ন বলিয়া মনে করি।
তারহীন সংবাদ
অদৃশ্য আলোক
ইট-পাটকেল, ঘর-বাড়ী ভেদ করিয়া অনায়াসেই চলিয়া যায়। সুতরাং ইহার সাহায্যে বিনা তারে
সংবাদ প্রেরণ করা যাইতে পারে। ১৮৯৫ সালে কলিকাতা টাউনহলে এ সম্বন্ধে বিবিধ পরীক্ষা
প্রদর্শন করিয়াছিলাম। বাংলার লেফ্টেন্যাণ্ট গবর্নর স্যার উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জি
উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎ-ঊর্মি তাঁহার বিশাল দেহ এবং আরও দুইটি রুদ্ধ কক্ষ ভেদ করিয়া
তৃতীয় কক্ষে নানাপ্রকার তোলপাড় করিয়াছিল। একটা লোহার গোলা নিক্ষেপ করিল, পিস্তল
আওয়াজ করিল এবং বারুদস্তূপ উড়াইয়া দিল। ১৯০৭ সালে মার্কনি তারহীন সংবাদ প্রেরণ
করিবার পেটেন্ট গ্রহণ করেন। তাঁহার অত্যদ্ভুত অধ্যবসায় ও বিজ্ঞানের ব্যবহারিক
উন্নতিসাধনে কৃতিত্বের দ্বারা পৃথিবীতে এক নূতন যুগ প্রবর্তিত হইয়াছে। পৃথিবীর
ব্যবধান একেবারে ঘুচিয়াছে। পূর্বে দূর দেশে কেবল টেলিগ্রাফের সংবাদ প্রেরিত হইত,
এখন বিনা তারে সর্বত্র সংবাদ পৌঁছিয়া থাকে।
কেবল তাহাই
নহে। মনুষ্যের কণ্ঠস্বরও বিনা তারে আকাশতরঙ্গ সাহায্যে সুদুরে শ্রুত হইতেছে। সেই
স্বর সকলে শুনিতে পায় না, শুনিতে হইলে কর্ণ আকাশের সুরের সহিত মিলাইয়া লইতে হয়।
এইরূপে পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অহোরাত্রি কথাবার্তা চলিতেছে।
কান পাতিয়া তবে একবার শোনা।
'কোথা
হইতে খবর পাঠাইতেছে?'
উত্তর-'সমুদ্র-গর্ভে, তিন শত হাত নীচে ডুবিয়া আছি। টর্পিডো দিয়া তিনখানা রণতরী
ডুবাইয়াছি, আর দুইখানার প্রতীক্ষায় আছি।' আবার এ কি? একেবারে লক্ষ লক্ষ কামানের
গর্জন শোনা যাইতেছে,
অগ্ন্যুৎপাতে যেন
মেদিনী বিদীর্ণ হইল। পরে জানিলাম মহাসাম্রাজ্য চূর্ণ হইয়াছে, কল্য হইতে পৃথিবীর
ইতিহাস অন্যরকম হইবে। এই ভীষণ নিনাদের মধ্যেও মনুষ্য-কণ্ঠের কত মর্মবেদনাধ্বনি, কত
মিনতি, কত জিজ্ঞাসা ও কত রকমের উত্তর শোনা যায়। ইহার মধ্যে কে একজন অবুঝের মতো বার
বার একই নাম ধরিয়া ডাকিতেছে–
'কোথায় তুমি–
কোথায় তুমি? কোনো উত্তর আসিল না-সে আর এই
পৃথিবীতে নাই।
এইরূপ দূরদূরান্ত বাহিয়া
আকাশের সুর ধ্বনিত হইতেছে। মনে কর, কোনো অদৃশ্য অঙ্গুলি বৈদ্যুতিক অর্গ্যানের বিবিধ
স্টপ আঘাত করিতেছে। বাম দিকের স্টপে আঘাত করাতে এক সেকেণ্ডে একটি স্পন্দন হইল। অমনি
শূন্যমার্গে বিদ্যুৎ-ঊর্মি ধাবিত হইল। কি প্রকাণ্ড সেই সহস্র ক্রোশব্যাপী ঢেউ! উহা
অনায়াসে হিমাচল উল্লঙ্ঘন করিয়া এক সেকেণ্ডে পৃথিবী দশবার প্রদক্ষিণ করিল। এবার
অদৃশ্য অঙ্গুলি দ্বিতীয় স্টপ আঘাত করিল। এইবার প্রতি সেকেণ্ডে আকাশ দশবার স্পন্দিত
হইল। এইরূপে আকাশের সুর ঊর্ধ্ব হইতে ঊর্ধ্বতরে উঠিবে; স্পন্দনসংখ্যা এক হইতে দশ,
শত, সহস্র, লক্ষ, কোটি
গুণ
বৃদ্ধি পাইবে। আকাশ-সাগরে নিমজ্জমান রহিয়া আমরা অগণিত ঊর্মি দ্বারা আহত হইব, কিন্তু
ইহাতেও কোনো ইন্দ্রিয় জাগরিত হইবে না। আকাশ-স্পন্দন আরও ঊর্ধ্বে উঠুক তখন
কিয়ৎক্ষণের জন্য তাপ অনুভূত হইবে। তাহার পর চক্ষু উত্তেজিত হইয়া রক্তিম, পীতাদি
আলোক দেখিতে পাইবে। এই দৃশ্য আলোক এক সপ্তক গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ। সুর আরও উচ্চে
উঠিলে দৃষ্টিশক্তি পুনরায় পরাস্ত হইবে, অনুভূতি শক্তি আর জাগিবে না, ক্ষণিক আলোকের
পরই অভেদ্য অন্ধকার।
তবে তো আমরা এই অসীমের মধ্যে একেবারে দিশাহারা, কতটুকুই বা দেখিতে
পাই? একান্তই অকিঞ্চিৎকর! অসীম জ্যোতির মধ্যে অন্ধবৎ ঘুরিতেছি এবং ভগ্ন দিক্-শলাকা
লইয়া পাহাড় লঙ্ঘন করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। হে অনন্ত পথের যাত্রী, কি সম্বল তোমার?
সম্বল কিছুই নাই, আছে কেবল অন্ধ বিশ্বাস; যে বিশ্বাসবলে প্রবাল
সমুদ্রগর্ভে দেহাস্থি দিয়া মহাদ্বীপ রচনা করিতেছে। জ্ঞান-সাম্রাজ্য এইরূপ অস্থিপাতে
তিল তিল করিয়া বাড়িয়া উঠিতেছে। আঁধার লইয়া আরম্ভ, আঁধারেই শেষ, মাঝে দুই একটি ক্ষীণ
আলো-রেখা দেখা যাইতেছে। মানুষের অধ্যবসায়-বলে ঘন কুয়াশা অপসারিত হইবে এবং একদিন
বিশ্বজগৎ জ্যোতির্ময় হইয়া উঠিবে।