জন্তুদেহে এক স্থানে আঘাত করিলে আঘাতের ধাক্কা স্নায়ু দ্বারা দূরে পৌঁছে। স্নায়বীয়
প্রবাহের কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ আছে। প্রথমতঃ স্নায়বীয় বেগ বিবিধ অবস্থায় হ্রাস বা
বৃদ্ধি পায়। উষ্ণতায় বেগ বৃদ্ধি এবং শৈত্যে বেগ হ্রাস পায়। এতদ্ব্যতীত
বিদ্যুৎপ্রবাহে স্নায়ুতে কতকগুলি বিশেষ পরিবর্তন ঘটে। যতক্ষণ স্নায়ু দিয়া
বিদ্যুৎপ্রবাহ বহিতে থাকে ততক্ষণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটে না। কিন্তু
বিদ্যুৎপ্রবাহ প্রেরণ এবং বন্ধ করিবার সময় কোনো বিশেষ স্থলে উত্তেজনা এবং অন্য
স্থানে অবসাদ পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যুৎপ্রবাহ বহিবার মুহূর্তে যে স্থান দিয়া বিদ্যুৎ
স্নায়ুসূত্র পরিত্যাগ করে সেই স্থলেই স্নায়ু হঠাৎ উত্তেজিত হয়। এতদ্ব্যতীত যদি
স্নায়ুর কোনো অংশে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করা যায় তবে সেই অংশ দিয়া আর কোনো সংবাদ
যাইতে পারে না। কিন্তু বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করিলে অমনি রুদ্ধ পথ খুলিয়া যায়,
স্নায়ুসূত্র পুনরায় সংবাদবাহক হয়।
যন্ত্রের সাহায্যে বৃক্ষদেহেও যে স্নায়বীয় সংবাদ প্রেরিত হয় তাহা অতি সূক্ষ্মভাবে
ধরা যাইতে পারে এবং একই কলের সাহায্যে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে সংবাদ পৌঁছিতে কত
সময় লাগে তাহাও নির্ণীত হয়। স্নায়বীয় বেগ বৃক্ষদেহে ভেকদেহের তুলনায় মন্থর; কিন্তু
নিম্নজাতীয় জন্তু হইতে দ্রুত। প্রাণী ও উদ্ভিদে নয় ডিগ্রি উষ্ণতায় স্নায়ুবেগ প্রায়
দ্বিগুণ বর্ধিত হয়। বিদ্যুৎপ্রবাহের আরম্ভকালে বৃক্ষস্নায়ুর এক স্থান উত্তেজিত,
অন্য স্থল অবসাদিত হয়। বিদ্যুৎপ্রবাহ-দ্বারা বৃক্ষের স্নায়বীয় ধাক্কা হঠাৎ বন্ধ হয়।
স্নায়ু সম্বন্ধে যত প্রকার পরীক্ষা আছে, সমস্ত পরীক্ষা-দ্বারা জীব ও উদ্ভিদে যে এ
সম্বন্ধে কোনো ভেদ নাই তাহা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছি।
জীবদেহে অংশ বিশেষ একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়। মানুষ এবং অন্যান্য জীবে এরূপ
পেশী আছে যাহা আপনা-আপনি স্পন্দিত হয়। যত কাল জীবন থাকে তত কাল হৃদয় অহরহ স্পন্দিত
হইতেছে। কোনো ঘটনাই বিনা কারণে ঘটে না। কিন্তু জীবস্পন্দন কি করিয়া স্বতঃসিদ্ধ হইল?
এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।
তবে উদ্ভিদেও এইরূপ স্বতঃস্পন্দন দেখা যায়। তাহার অনুসন্ধানফলে সম্ভবত
জীবস্পন্দন-রহস্যের কারণ প্রকাশিত হইবে।
শরীরতত্ত্ববিদেরা মানুষের হৃদয় জানিতে যাইয়া ভেক ও কচ্ছপের হৃদয় খেলা করেন। হৃদয়
জানা কথাটি শারীরিক অর্থে ব্যবহার করিতেছি, কবিতার অর্থে নহে। সমস্ত ব্যাঙটিকে লইয়া
পরীক্ষা সুবিধাজনক নহে; এজন্য তাঁহারা হৃদয়টিকে কাটিয়া বাহির করেন, পরীক্ষা করেন কি
কি অবস্থায় হৃদয়-গতির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।
হৃদয় কাটিয়া বাহির করিলে তাহার স্বাভাবিক স্পন্দন বন্ধ হইবার উপক্রম হয়। তখন
সূক্ষ্ম নল দ্বারা হৃদয়ে রক্তের চাপ দিলেই স্পন্দন ক্রিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া অক্ষুণ্ণ
গতিতে চলিতে থাকে। এ সময়ে উত্তাপিত করিলে হৃদয়স্পন্দন অতি দ্রুতবেগে সম্পাদিত হয়;
কিন্তু ঢেউগুলি খর্বকায় হয়। শৈত্যের ফল ইহার বিপরীত। নানাবিধ ভৈষজ্য দ্বারা হৃদয়ের
স্বাভাবিক তাল বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয়। ইথার প্রয়োগে ক্ষণিকের জন্য হৃদয়স্পন্দন
স্থগিত হয়, হাওয়া করিলে সেই অচৈতন্য অবস্থা চলিয়া যায়। ক্লোরোফরমের প্রয়োগ
অপেক্ষাকৃত সাংঘাতিক। মাত্রাধিক্য হইলেই হৃদয়ক্রিয়া একেবারে বন্ধ হইয়া যায়।
এতদ্ব্যতীত বিবিধ বিষপ্রয়োগে হৃদয়স্পন্দন বন্ধ হয়। কিন্তু এ সম্বন্ধে এক আশ্চর্য
রহস্য এই যে কোনো বিষে হৃদয়স্পন্দন সংকুচিত অবস্থায়, অন্য বিষে ফুল্ল অবস্থায়
নিস্পন্দিত হয়। এইরূপ পরস্পরবিরোধী এক বিষ দ্বারা অন্য বিষের ক্রিয়া ক্ষয় হইতে
পারে।
জীবের স্বতঃস্পন্দন সম্বন্ধে সংক্ষেপে এই কয়টি প্রধান ঘটনা বর্ণনা করিলাম। গাছেও কি
এই সমস্ত আশ্চর্য ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়? নানাবিধ পরীক্ষা করিয়া কোনো কোনো
উদ্ভিদ-পেশীও যে স্পন্দনশীল তাহার বহুবিধ প্রমাণ পাইয়াছি।
বনচাঁড়াল গাছ দিয়া উদ্ভিদের স্পন্দনশীলতা অনায়াসে দেখা যাইতে পারে। ইহার ক্ষুদ্র
পাতাগুলি আপনা-আপনি নৃত্য করে। লোকের বিশ্বাস যে, হাতের তুড়ি দিলেই নৃত্য আরম্ভ হয়।
গাছের সংগীতবোধ আছে কি না বলিতে পারি না, কিন্তু বনচাঁড়ালের নৃত্যের সহিত তুড়ির
কোনো সম্বন্ধ নাই। তরুস্পন্দনের সাড়ালিপি পাঠ করিয়া জন্তু ও উদ্ভিদের স্পন্দন যে
একই নিয়মে নিয়মিত তাহা নিশ্চয়রূপে বলিতে পারিতেছি।
প্রথমতঃ পরীক্ষার সুবিধার জন্য বনচাঁড়ালের পত্র ছেদন করিলে স্পন্দন ক্রিয়া বন্ধ
হইয়া যায়। কিন্তু নল দ্বারা উদ্ভিদরসের চাপ দিলে স্পন্দন ক্রিয়া পুনরায় আরম্ভ হয়
এবং অনিবারিত গতিতে চলিতে থাকে। তাহার পর দেখা যায় যে, উত্তাপে স্পন্দনসংখ্যা
বর্ধিত, শৈত্যে স্পন্দনের মন্থরতা ঘটে। ইথার প্রয়োগে স্পন্দন ক্রিয়া স্তম্ভিত হয়;
কিন্তু বাতাস করিলে অচৈতন্য ভাব দূর হয়। ক্লোরোফরমের প্রভাব মারাত্মক। সর্বাপেক্ষা
আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, যে বিষ দ্বারা যে ভাবে স্পন্দনশীল হৃদয় নিস্পন্দিত হয়, সেই
বিষে সেই ভাবে উদ্ভিদের স্পন্দনও নিরস্ত হয়। উদ্ভিদেও এক বিষ দিয়া অন্য বিষ ক্ষয়
করিতে সমর্থ হইয়াছি।
এক্ষণে দেখিতে হইবে, স্বতঃস্পন্দনের মূল রহস্য কি। উদ্ভিদ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে
পাইতেছি যে, কোনো কোনো উদ্ভিদপেশীতে আঘাত করিলে সেই মুহূর্তে তাহার কোনো উত্তর
পাওয়া যায় না। তবে যে বাহিরের শক্তি উদ্ভিদে প্রবেশ করিয়া একেবারে বিনষ্ট হইল তাহা
নহে; উদ্ভিদ সেই আঘাতের শক্তিকে সঞ্চয় করিয়া রাখিল। এইরূপে আহারজনিত বল, বাহিরের
আলোক, উত্তাপ ও অন্যান্য শক্তি উদ্ভিদ সঞ্চয় করিয়া রাখে; যখন সম্পূর্ণ ভরপুর হয় তখন
সঞ্চিত শক্তি বাহিরে উথলিয়া পড়ে। সেই উথলিয়া পড়াকে আমরা স্বতঃস্পন্দন মনে করি। যাহা
স্বতঃ বলিয়া মনে করি প্রকৃতপক্ষে তাহা সঞ্চিত বলের বহিরোচ্ছ্বাস। যখন সঞ্চয় ফুরাইয়া
যায় তখন স্বতঃস্পন্দনেরও শেষ হয়। ঠাণ্ডা জল ঢালিয়া বনচাঁড়ালের সঞ্চিত তেজ হরণ করিলে
স্পন্দন বন্ধ হইয়া যায়। খানিকক্ষণ পর বাহির হইতে উত্তাপ সঞ্চিত হইলে পুনরায় স্পন্দন
আরম্ভ হয়।
গাছের স্বতঃস্পন্দনে অনেক বৈচিত্র্য আছে। কতকগুলি গাছে অতি অল্প সঞ্চয় করিলেই শক্তি
উথলিয়া উঠে; কিন্তু তাহাদের স্পন্দন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। স্পন্দিত অবস্থা রক্ষা
করিবার জন্য তাহারা উত্তেজনার কাঙাল। বাহিরের উত্তেজনা বন্ধ হইলেই অমনি স্পন্দন
বন্ধ হইয়া যায়। কামরাঙা গাছ এই জাতীয়।
আর কতকগুলি গাছ বাহিরের আঘাতেও অনেক কাল সাড়া দেয় না; দীর্ঘকাল ধরিয়া তাহারা সঞ্চয়
করিতে থাকে। কিন্তু যখন তাহাদের পরিপূর্ণতা বাহিরে প্রকাশ পায় তখন তাহাদের উচ্ছ্বাস
বহুকাল স্থায়ী হয়। বনচাঁড়াল এই দ্বিতীয় শ্রেণীর উদাহরণ।
মানুষের একটা অবস্থাকে স্বতঃ-উদ্ভাবনশীলতা অথবা উদ্দীপনা বলা যাইতে পারে। সেই
অবস্থার জন্য সঞ্চয় এবং পরিপূর্ণতার আবশ্যক। কতকগুলি লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় যে, সেই
অবস্থা স্বতঃস্পন্দনের একটি উদাহরণ বিশেষ। যদি তাহা সত্য হয় তাহা হইলে সেই
অবস্থা-অভিলাষী সাধক চিন্তা করিয়া দেখিবেন, কোন্ পথ-কামরাঙা অথবা বনচাঁড়ালের
পদাঙ্ক অনুসরণ-তাঁহার পক্ষে শ্রেয়।
পরিশেষে উদ্ভিদের জীবনে এরূপ সময় আসে যখন কোনো এক প্রচণ্ড আঘাতের পর হঠাৎ সমস্থ
সাড়া দিবার শক্তি অবসান হয়। সেই আঘাত মৃত্যুর আঘাত। কিন্তু সেই অন্তিম মুহূর্তে
গাছের স্থির স্নিগ্ধ মূর্তি ম্লান হয় না। হেলিয়া পড়া কিংবা শুষ্ক হইয়া যাওয়া অনেক
পরের অবস্থা। মৃত্যুর রুদ্র-আহ্বান যখন আসিয়া পৌঁছে তখন গাছ তাহার শেষ উত্তর কেমন
করিয়া দেয়? মানুষের মৃত্যুকালে যেমন একটা দারুণ আক্ষেপ সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়া
বহিয়া যায় তেমনি দেখিতে পাই, অন্তিম মুহূর্তে বৃক্ষদেহের মধ্য দিয়াও একটা বিপুল
কুঞ্চনের আক্ষেপ প্রকাশ পায়। এই সময়ে একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ মুহূর্তের জন্য মুমূর্ষ
বৃক্ষগাত্রে তীব্রবেগে ধাবিত হয়। লিপিযন্ত্রে এই সময় হঠাৎ জীবনে লেখার গতি
পরিবর্তিত হয়-ঊর্ধ্বগামী রেখা নিম্নদিকে ছুটিয়া গিয়া স্তব্ধ হইয়া যায়। এই সাড়াই
বৃক্ষের অন্তিম সাড়া।
এই আমাদের মূক সঙ্গী, আমাদের দ্বারের পার্শ্বে নিঃশব্দে যাহাদের জীবনের লীলা
চলিতেছে তাহাদের গভীর মর্মের কথা তাহারা ভাষাহীন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়া দিল এবং
তাহাদের জীবনের চাঞ্চল্য ও মরণের আক্ষেপ আজ আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে প্রকাশিত করিল।
জীব ও উদ্ভিদের মধ্যে যে কৃত্রিম ব্যবধান রচিত হইয়াছিল তাহা দূরীভূত হইল। কল্পনারও
অতীত অনেকগুলি সংবাদ আজ বিজ্ঞান স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়া বহুত্বের ভিতরে একত্ব
প্রমাণ করিল।