নবীন ও প্রবীণ
বিশ্বমানবের জ্ঞানের
পরিধিকে বিস্তৃত করিতে ভারতবর্ষ যাহা নিবেদন করিয়াছে, তাহার এক বিশিষ্টতা দেখা যায়
এই যে, উহা সকল সময়ে ক্ষুদ্র ছাড়িয়া বৃহতের সন্ধান করিয়াছে। অন্য দেশে জ্ঞানরাজ্য
এত বিভিন্নভাবে বিভক্ত হইয়াছে যে, তথায় সমগ্রকে এক করিয়া জানিবার চেষ্টা
লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। ভারতবর্ষের চিন্তাপ্রণালী অন্যরূপ। তাই তাহার কাব্য, তাহার
সাহিত্য, জ্ঞানের অন্তর্নিহিত এই মহান সত্য ব্যক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছে। জ্ঞানের
অন্বেষণে আকাশে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা, বিশ্বের অগণিত জীব ও ব্রহ্মাণ্ডের কোটি
সূর্যের মধ্যে সেই একতার সন্ধান করিয়াছে। তাই বোধ হয়, আপনারা জ্ঞান ও সাহিত্যকে একে
অন্যের অঙ্গ মনে করিয়া দুই বৎসর পূর্বে একজন বিজ্ঞানসেবীকে তাঁহার অজ্ঞাতে এই
সাহিত্য-পরিষদের সভাপতিত্বে নিযুক্ত করেন।
বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাহা বলিবার আছে তাহা অন্য দিন বলিব। তৎপূর্বে
পরিষদের ভবিষ্যৎ উন্নতিকল্পে কয়েকটি কথা আজ উত্থাপন করিব। যখন আপনারা আমাকে
সভাপতিত্বে নিয়োগ করেন তখন এ সম্বন্ধে আমার আপত্তি জানাইয়াছিলাম। এক দিকে সময়াভাব ও
ভগ্ন স্বাস্থ্য, অন্য দিকে পরিষদে কোনো কার্য করা সম্ভব হইবে কি না, এই সম্বন্ধে
আশঙ্কা ছিল। শুনিয়াছিলাম, এখানে দলাদলি এত প্রবল এবং আর্থিক অবস্থা এরূপ শোচনীয় যে,
ইচ্ছা সত্ত্বেও কেহ কিছু করিয়া উঠিতে পারেন না। এ জন্য অস্বীকার করিয়া লিখি। তাহা
সত্ত্বেও যখন আপনারা আমাকে মুক্তি দেন নাই তখন স্থির করিলাম, সাহিত্য-পরিষদের জন্য
যথাসাধ্য কার্য করিব এবং ইহার পূর্ণশক্তি বিকাশের জন্য চেষ্টিত হইব। যে মুমূর্ষ
সে-ই মৃত বস্তু লইয়া আগলাইয়া থাকে; যে জীবিত তাহার জীবনের উচ্ছ্বাস চতুর্দিকে
ব্যাপ্ত হয়। আমি দেখিতে পাইয়াছি যে, বর্তমান যুগে সমস্ত ভারতের জীবন প্রবাহিত করিয়া
একটা উচ্ছ্বাস ছুটিয়াছে, যাহা মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে। আমাদের সাহিত্য কেবলমাত্র পুরাতন
গ্রন্থ প্রকাশ লইয়া থাকিবে না; বর্তমান যুগের নব নব সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস,
বিজ্ঞান প্রভৃতিকে একত্র করিয়া একটি জীবন্ত সাহিত্য গঠিত করিয়া তুলিবে। ইহাই আমি
সাহিত্য-পরিষদের সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য মনে করি। এই উদ্দেশ্যকে কার্যে পরিণত করিবার
পথে যে বাধা, যে অন্তরায় আছে তাহা দূর করিতে হইবে। তাহার পর দেশের চিন্তাশীল
মনীষীদিগের বিক্ষিপ্ত চেষ্টা যাহাতে একত্রীভূত করিতে পারা যায় তজ্জন্য যত্নবান হইতে
হইবে।
আরও ভাবিবার বিষয় আছে। যে দলাদলি হইতে পরিষদের উন্নতি
পঙ্গুপ্রায় হইয়া উঠিতেছে, সেই দলাদলি হইতে পরিষদকে কিরূপে রক্ষা করা যায় এবং এই সব
বাধা দূরীভূত করিয়া পরিষদের মুখ্য উদ্দেশ্য– সাহিত্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশ কিরূপে
সাধিত হইতে পারে?
জীবনের বহু বাধাবিপত্তি সহিত সংগ্রাম ও নানা দেশ পরিভ্রমণের ফলে জানিতে পারিয়াছি,
সফলতা কোথা হইতে আসে এবং বিফলতা কেনই বা হয়। আমি দেখিয়াছি, যে অনুষ্ঠানে কর্তৃত্ব
শুধু ব্যক্তিবিশেষের উপর ন্যস্ত হয়, যেখানে অপর-সকলে নিজেদের দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলিয়া
দর্শকরূপে হয় শুধু করতালি দেন, না হয় কেবল নিন্দাবাদ করেন, সেখানে কর্ম শুধু কর্তার
ইচ্ছাতেই চলিতে থাকে। দেশের কল্যাণের জন্য যে শক্তি সাধারণে তাঁহার উপর অর্পণ
করিয়াছিল, এমন এক দিন আসে, যখন সেই শক্তি সাধারণকে দলন করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তখন
দেশ বহু দূরে সরিয়া যায় এবং ব্যক্তিগত শক্তি উদ্দামভাবে চলিতে থাকে। ইহাতে দলাদলির
যে ভীষণ বহ্নি উদ্ভূত হয় তাহা অনুষ্ঠানটিকে পর্যন্ত গ্রাস করিতে আসে। দলাদলির যে
ভীষণ বহ্নি উদ্ভূত হয় তাহা অনুষ্ঠানটিকে পর্যন্ত গ্রাস করিতে আসে। দলপতি যদি তাঁহার
সহকারীদিগকে কেবল যন্ত্রের অংশ মনে না করিয়া প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বকে
জাগরূক করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন তাহা হইলেই দেশের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হয়। এই
কারণে সাহিত্য পরিষদে ব্যক্তিগত প্রাধান্যের পরিবর্তে সাধারণের মিলিত চেষ্টা যাহাতে
বলবতী হয় সেজন্য বিবিধ চেষ্টা করিয়াছি। প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্য-সমিতিকে খর্ব করিয়া
নিজেরা বড়ো হইবার প্রয়াস আমি একান্ত হেয় মনে করি বলিয়া প্রত্যেক সমিতির আনুকুল্য ও
শুভ ইচ্ছা আদান-প্রদানের জন্য চেষ্টিত হইয়াছি। সাধারণ সদস্যদিগের উদ্যমের উপর
পরিষদের ভাবী মঙ্গল যে বহুল পরিমাণে নির্ভর করে, এ কথা স্মরণ করাইয়া তাঁহাদিগকে
লিখিয়াছিলাম- ‘পরিষদের সভাপতি, সম্পাদক ও কার্যনির্বাহক সভা সাহিত্য পরিষদের মুখ্য
উদ্দেশ্য সাধনের উপলক্ষ মাত্র!’ আরও লিখিয়াছিলাম যে, 'সদস্যগণ যদি নিজেদের দায়িত্ব
করিয়া নিঃস্বার্থ ও কর্তব্যশীল সভ্য নির্বাচিত করেন তাহা হইলেই পরিষদের উত্তরোত্তর
মঙ্গল সাধিত হইবে। এ সম্বন্ধে তাঁহাদের শৈথিল্যই ভবিষ্যৎ-দুর্গতির কারণ হইবে।' এই
সহজ পথ অপেক্ষা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অবলম্বিত উপায় কি শ্রেয় হইবে? তথায়
প্রতিযোগিতারই পূর্ণ প্রকাশ। সহযোগিতা কি আমাদের সাধনা নয়? রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পক্ষ
ও বিপক্ষের ভেদ প্রবল হইয়া উঠে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের ছিদ্র অন্বেষণ করে ও কুৎসা
রটায়, অন্য পক্ষও জবাবে এক কাঠি উপরে উঠেন। ইহার শেষ কোথায়? যে চিত্তবৃত্তির মহৎ
উচ্ছ্বাসে সাহিত্য বিকশিত হয় তাহা কি এইরূপ পঙ্কে নিমজ্জিত হইবে?
নবীন ও প্রবীণের মধ্যে একটা বৈষম্য আছে। তবে তাহাই বিসংবাদের প্রধান কারণ নহে।
ব্যক্তিবিশেষের আত্মম্ভরিতাই প্রকৃতি দলাদলির কারণ; ইহা প্রবীণ বা নবীন কাহারও
নিজস্ব নহে। প্রবীণ অতি সাবধানে চলিতে চাহেন, কিন্তু পৃথিবীর গতি অতি দ্রুত। যদিও
বার্ধক্য তাহার শরীরে জড়তা আনয়ন করে, মন তো তাহার অনেক উপরে, সে তো চিরনবীন! মন কেন
সাহস হারাইবে? অন্য দিকে নবীন, অভিজ্ঞতার অভাবে হয়তো অতি দ্রুত চলিতে চাহেন এবং
বাধার কথা ভাবিয়া দেখেন না। যাঁহারা বহুকাল ধরিয়া কোনো অনুষ্ঠানকে স্থাপিত
করিয়াছেন, তাঁহাদের সেই প্রয়াসের ইতিহাস ভুলিয়া যান। হয়তো কখনও প্রবীণের বহু কষ্টে
অর্জিত ধন নবীন বিনা দ্বিধায় নিজস্ব করিতে চাহেন। প্রবীণ ইহাতে অকৃতজ্ঞতার ছায়া
দেখিতে পান। সে যাহা হউক, ধরিত্রী প্রবীণকেও চায়, নবীনকেও চায়। প্রবীণ ভবিষ্যতের
অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনে যেন উদ্বিগ্ন না হন, আর নবীনও যেন প্রবীণের এতদিনের নিষ্ঠা
শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন। যে দেশে আমাদের সামাজিক জীবনে নবীন ও প্রবীণের কার্যকলাপের
মধ্যে সামঞ্জস্য সাধিত হইয়াছে, সে স্থানেও কি একথা আমাকে বুঝাইয়া দিতে হইবে?
পরিষদের কার্য সাধারণ সদস্যগণের নির্বাচিত কার্যনির্বাহক সমিতি দ্বারা পরিচালিত হয়।
তাঁহারাই সাধারণের প্রতিভূ হইয়া আসেন; তাঁহাদের অধিকাংশের মতের দ্বারাই প্রতি বিষয়
নির্ধারিত হইয়া থাকে। ইহা ব্যতীত কার্য সস্পাদনের অন্য উপায় নাই। যদি ইহাতে
ব্যক্তিবিশেষের মত গৃহীত না হয় এবং তজ্জন্য যদি কেহ পরিষদের সকল কর্ম ত্যাগ করিয়া
চলিয়া যাইতে চাহেন তবে উহাকে ছেলেদের আবদার ছাড়া কি বলা যাইতে পারে? আর একটা কথা-
অতীতের ত্রুটি সম্পূর্ণ মুছিয়া না ফেলিলে কোনো নূতন প্রচেষ্টা একেবারেই অসম্ভব।
যে সব ত্রুটির কথা বলিলাম তাহা একান্ত সাময়িক। বাদানুবাদের অনেক কথা শুনিয়াছিলাম।
অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, তাহার অনেকটা তিলকে তাল করিবার অভ্যাস হইতে। আমি উভয়
পক্ষকেই, তাঁহাদের মধ্যে কি কি বিষয় লইয়া বিসংবাদ তাহা আমাকে জানাইতে অনুরোধ
করিয়াছিলাম; পরে তাঁহাদের সহিত এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। দেখা গেল, বিবাদের প্রকৃত
কারণ কিছু নাই বলিলেই হয়।
যে সব বিষয়ের কথা উত্থাপন করিলাম তাহা কার্য করিবার উপলক্ষ মাত্র। সাহিত্যের
সর্বাঙ্গীন উন্নতি এই পরিষদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এতদর্থে প্রতিভাশালী মনীষীদের
চিন্তার ফল সাধারণের নিকট উপস্থিত করিবার জন্য ধারাবাহিক বক্তৃতার ব্যবস্থা করিতে
সমর্থ হইয়াছি।
কিছুদিন পূর্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন এ স্থান পরিদর্শন করিতে আসেন। সেই
কমিশনের বিদেশীয় সভ্যগণ ইহার কার্য লক্ষ্য করিয়া ইহাকে জাতীয় জীবন পরিস্ফুটনের এক
প্রধান অঙ্গ বলিয়া মনে করিয়াছেন। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশে ভ্রমণকালেও দেখিলাম,
আমাদের এই সাহিত্য পরিষদকে আদর্শ করিয়া তথায় অন্য পরিষদ গঠনের চেষ্টা হইতেছে। এ সবই
তো আশার কথা –আশা ব্যতীত আর কি আমাদের সম্বল আছে? সম্মুখে যে ভয়ংকর দুর্দিন আসিতেছে
তাহাতে আমাদের জাতীয় জীবন পর্যন্ত সংকটাপন্ন। দুর্দিনের মধ্যে কি আশা লইয়া তবে
থাকিব? যে দুই একটি আশার কথা আছে, তাহার মধ্যে সাহিত্য পরিষদ অন্যতম। আমাদের
অবহেলায় এই ক্ষীণ প্রদীপটি কি নিবিয়া যাইবে?
শতাধিক বৎসর পূর্বে আমাদের বংশের জননী প্রপিতামহী দেবী তরুণ যৌবনে বৈধব্য প্রাপ্ত
হইয়া একমাত্র শিশুসন্তান লইয়া ভ্রাতৃগৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। পুত্রের লালন
পালন ও শিক্ষার ভার লইয়া প্রপিতামহী দেবী যখন নানা প্রতিকূল অবস্থার সহিত সংগ্রাম
করিতেছিলেন তখন একদিন তাঁহার শিশুপুত্র শিক্ষকের তাড়নায় অন্তঃপুরে আসিয়া মাতার
অঞ্চল ধারণ করিয়াছিল। যিনি তাঁহার সমুদয় শক্তি একমাত্র পুত্রের উন্নতিকল্পে
প্রতিদিন তিল তিল করিয়া ক্ষয় করিতেছিলেন, সেই স্নেহময়ী মাতা মুহূর্তে তেজস্বিনীরূপ
ধারণ করিয়া পুত্রের হস্তপদ বাঁধিয়া তাহাকে শিক্ষকের হস্তে অর্পণ করিলেন। ভাবিয়া
দেখিলে আমাদের মাতৃভূমি আমার তেজস্বিনী বংশজননীর মতো। সন্তানদিগকে বিক্রম ও পৌরুষে
উদ্দীপ্ত হইতে তাড়া দিয়া তিনি তাহাদের প্রতি আপনার গভীর বাৎসল্য প্রকাশ করিয়াছেন।
তিনি তাঁহার পুত্রদিগকে অঙ্কে রাখিয়া আলস্যে কালহরণ করিতে দেন নাই; কিন্তু জগতের
অগ্নিময় কর্মশালে তাহাদিগকে নিক্ষেপ করিয়া দিয়া দৃঢ়স্বরে বলিয়াছেন, ‘পৃথিবীর
সংগ্রামময় কর্মক্ষেত্রে যখন যশঃ, বিক্রম ও পৌরুষ সংগ্রহ করিতে পারিবে তখনই আমার
ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিবে।’ মাতার আদেশ পালন করিবার জন্য বহু শতাব্দী পূর্বে দীপঙ্কর
হিমালয় লঙ্ঘন করিয়া তিব্বত গমন করিয়াছিলেন। তাহার পর হইতে আধুনিক সময় পর্যন্ত বহু
বাঙালী ভারতের বহুস্থানে গমন করিয়া কর্ম, যশঃ ও ধর্ম আহরণ করিয়াছেন। এই বিক্রমপুর
বিক্রমশালী সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যত্বহীন দুর্বলের নহে। আমার পুজা হয়তো তিনি
গ্রহণ করিয়াছেন, এই সাহসে ভর করিয়া আমি বহুদিন বিদেশে যাপন করিয়া জননীর স্নেহময়
ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। হে জননী, তোমারই আশীর্বাদে আমি বঙ্গভূমি এবং ভারতের
সেবকরূপে গৃহীত হইয়াছি।
কি ঘটনাসূত্রে আমি এখানে সভাপতিরূপে আহূত হইয়াছি তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই।
কোন্ নিয়মে আমাদের দেশে কোনো এক সংকীর্ণ পথে খ্যাতনামা ব্যক্তিদিগকে বিসদৃশ কার্যে
নিয়োগ করা হয় তাহার কারণ নির্দেশ করা কঠিন। যে যুক্তি অনুসারে ব্যবহারজীবীকে
কলকারখানার ডিরেক্টার করা হয় সেই নিয়মেই লোকালয় হইতে দূরে লুক্কায়িত শিক্ষার্থী আজ
রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নিয়োজিত হইয়াছে। এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ আপনারা
গ্রহণ করেন নাই। আপনাদের প্রীতিকর কিছু যে আমি বলিতে পারিব সে বিষয়ে আমার বিশেষ
সন্দেহ আছে। যে বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই সে বিষয়ে কিছু বলিতে উদ্যম করা
ধৃষ্টতা মাত্র। আমি স্বীয় জীবনে যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি কেবল সেই বিষয়েই কিছু
বলিব। পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করিয়া আমি ইহা উপলব্ধি করিয়াছি যে, আমাদের সমুদয়
শিক্ষা-দীক্ষা কেবল মনুষ্যত্বলাভের উদ্দেশ্যে মাত্র। কি করিয়া আমরা দুর্বলের
ক্রন্দন ও আবদার ত্যাগ করিয়া পুরুষোচিত শক্তিবলে স্বহস্তে স্বীয় অদৃষ্ট গঠন করিতে
পারি, তাহাই যেন আমাদের একমাত্র সাধনা হয়।
জীবনসংগ্রামে যে কেবল শক্তিমানই জীবিত থাকে, দুর্বল নির্মূল হয়, এ কথা কেবল নিম্ন
জীবের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য মনে করিতাম। কিন্তু পৃথিবী-ভ্রমণের ফলে এ ভ্রান্তি দূর
হইয়াছে। এখন দেখিতেছি, বিশ্বব্যাপী আহবে দুর্বল উচ্ছিন্ন হইবে এবং সবল প্রতিষ্ঠিত
হইবে। মনে করিবেন না যে, আমরা এখনও দূরে আছি বলিয়া এই খাণ্ডবদাহ আমাদিগকে স্পর্শ
করিবে না। বহুদিন হইতেই এই ভীষণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান আরম্ভ হইয়াছে।
অহিফেন সেবনে অতি সহজেই নানা কষ্ট হইতে নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা যায়। সুতরাং অতীত
গৌরব স্মরণই আমাদের পক্ষে বর্তমান দূরবস্থা ভুলিবার প্রকৃষ্ট উপায়। আর এই-যে
সম্মুখে ম্যালেরিয়াতে জনপদ নির্মূল হইতেছে, দেশী শিল্প জাপানের প্রতিযোগিতায়
উচ্ছিন্ন হইতেছে, এ সব কথা ভাবিতে নাই। আমাদের জড়তা সম্বন্ধে যদি আমি কোনো তীব্র
ভাষা ব্যবহার করি তাহা হইলে ক্ষমা করিবেন। আমার জীবনে যদি কোনো সফলতা দেখিয়া থাকেন
তবে জানিবেন, তাহা সর্বদা নিজেকে আঘাত করিয়া জাগ্রত রাখিবার ফলে। স্বপ্নের দিন
চলিয়া গিয়াছে; যদি বাঁচিতে চাও তবে কশাঘাত করিয়া নিজেকে জাগ্রত রাখো।
বিবিধ সংক্রামক রোগ যেন দেশকে একেবারে বিধ্বস্ত করিতে চলিল। এই সব বিপদ একেবারে
অনিবার্য নয়, কিন্তু এ আমাদের অজ্ঞতা ও চেষ্টাহীনতারই বিষময় ফল। যে পুকুর হইতে
পানীয় জল গৃহীত হয় তাহার অপব্যবহার সভ্যতার পরিচায়ক নহে। কি করিয়া এই সব অজ্ঞতা দূর
হইতে পারে? স্কুল বৃদ্ধি অতি মন্থর গতিতে হইতেছে; আর-কোনো কি উপায় নাই যাহা দ্বারা
অত্যাবশ্যক জ্ঞাতব্য বিষয় সহজে প্রচারিত হইতে পারে? আমাদের সর্বসাধারণে
শিক্ষাবিস্তারের চিরন্তন প্রথা কথকতা দ্বারা। তাহা ছাড়া চক্ষে দেখিলে একটা বিষয়ে
সহজেই ধারণা হয়। আমার বিবেচনায় স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় গৃহ ও পল্লী পরিষ্কার, বিশুদ্ধ
জল ও বায়ুর ব্যবস্থা নির্ধারণ। এ সব বিষয় শিক্ষাবিস্তার এবং আদর্শ-গঠিত পল্লী
প্রদর্শন অতি সহজেই হইতে পারে। ইহার উপায় মেলা স্থাপন। পর্যটনশীল মেলা দেশের এক
প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া অল্পদিনেই অন্য প্রান্তে পৌঁছিতে পারে। এই মেলায়
স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে ছায়া চিত্রযোগে উপদেশ, স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যায়াম
প্রচলন, যাত্রা, কথকতা, গ্রামের শিল্প-বস্তর সংগ্রহ, কৃষি-প্রদর্শনী ইত্যাদি
গ্রামহিতকর বহুবিধ কার্য সহজেই সাধিত হইতে পারে। আমাদের কলেজের ছাত্রগণও এই উপলক্ষে
তাঁহাদের দেশ পরিচর্যাবৃত্তি কার্যে পরিণত করিতে পারেন।