৩.২.২
চিত্রালঙ্কার

'আমি'র নিজস্ব প্রথম ঘর তার দেহ। দেহের সীমানা পেরুলে, 'আমি'র চারপাশে বিশালজগতের ক্ষুদ্র এক কোণে নিজেকে আবিষ্কার করে। ত্রিমাত্রিক জগতে 'আমি' একটি আশ্রয় চায়, যে আশ্রয় তার নিজের দেহের মতই নিজের মনে  হবে। নিজের জন্য পাওয়া স্থানটি হলো 'ঘর'। আদিমানবের আশ্রয় নিয়েছিল গুহায়। সেই থেকে মানুষের ঘরের প্রাপ্তি। আদিম মানুষের কাছে বাসস্থানের সমাধানে স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিল। খাদ্য সংগ্রহের ভিতর দিয়ে আদিম মানুষের দৈহিক ক্ষুধার নিরসন হয়েছিল। বাসস্থানের সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তার বিষয়টিরও নিষ্পত্তি হয়েছিল। এই দুটি বিষয় পূরণের সূত্রে মনে যে স্বস্তিবোধের সঞ্চার ঘটেছিল, সেখান থেকে জন্মেছিল মানসিক ক্ষুধা। এই ক্ষুধা ছিল মূলত আনন্দলাভের ক্ষুধা। এই ক্ষুধার তাড়না থেকে মানুষের মনে জেগে উঠেছিল নান্দনিক বোধ। দেখার আনন্দের সূত্রে গুহাবাসী মানুষ পাথুরে দেওয়ালে চিত্রকর্ম করার চেষ্টা করেছিল। ধীরে ধীরে রেখার মধ্য দিয়ে চিত্রের রূপ ফুটে উঠেছিল।

গুহামানবদের চিত্রকর্মের দিকে তাকালে দেখা যায়, বেঁচে থাকার সংগ্রামের ছবি। এই সংগ্রামের অন্যতম বিষয় ছিল নিজে খাদ্য সংগ্রহ আর অন্যের খাদ্যে পরিণত না হওয়া। মানুষের খাদ্যের এবং বিপদের প্রধান বিষয় ছিল পশু। তাই আদিম মানুষের ছবির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল নানা ধরনের পশু। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮ হাজার বছর আগে স্পেনের আলতামিরা গুহায় আঁকা ছবিগুলোতে যে নানাজাতের পশুর ছবি পাওয়া যায়, তার পিছনে খাদ্যের ভাবনাটা বড় হয়ে উঠে।

প্রথম দিকে মানুষ কোনো দৃশ্যমান সত্তার অবিকল রূপকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। ধীরে ধীরে সে ছবির সাথে নিজের অনুভূতি মিশিয়ে সুন্দর করার চেষ্টা করেছিল। এটা ছিল চিত্রশিল্পের প্রথম ধাপ। এরপর শিল্পীকে ভাবতে হয়েছিল ছবির উপাদান সমূহের পরিমাপ সম্পর্কে। একটি বিশাল আকারের ষাঁড়ের ছবিকে দেয়ালের ছোট্ট পরিসরে আঁকতে গেলে, ছোটো করে আঁকতে হবে। এই ছোটো করার চেষ্টার ভিতরে থাকবে ষাঁড়ের পা, লেজ, শিং ইত্যাদির আকারগত সমন্বয়। এই সমন্বয়ের প্রচেষ্টার ভিতরে চিত্রকলার দ্বিতীয় ধাপ তৈরি হয়েছিল। এই দুটি ধাপে গুহামানবদের কেউ কেউ শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন।

সত্যাশ্রয়ী ভাবনায় ছবি আঁকার প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, চিত্রালঙ্কার। অঙ্কিত চিত্রে শিল্পী সৌন্দর্যের তাড়নায় যা কিছু নতুন যোগ করে, তাই হয়ে যায় বাড়তি কিছু। এই বাড়তি উপাদান যখন মূল চিত্রকে বিশেষভাবে শোভিত করে, তখনই তা হয়ে যায় চিত্রালঙ্কার। যেদিন থেকে শিল্পী দৃশ্যের সত্যকে নিজের দেখার সত্য-সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য বাড়তি উপাদানের চেষ্টা করেছেন, সেদিনই চিত্রালঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে।

সার্বিকভাবে যে কোনো ছবির দুটি অংশ থাকে। এর মূলভাগটি হলো ভিত্তি। অপরটি অলঙ্কার।

চিত্রালঙ্কারের এই রূপগত বিষয় নিয়ে উদাহরণ হিসেবে আল্পনাকে তুলে ধরা যেতে পারে।

আল্পনা
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বঙ্গীয় শব্দকোষ মতে
'উৎসব বা মঙ্গলকার্যে গৃহদ্বারে, অঙ্গনে, ঘরের দেওয়ালে ও তলে পিটালির বা খড়ি-প্রভৃতি রঙের চিত্রাঙ্গন বা অঙ্কিত চিত্র।' বর্তমানে অবশ্য আলপনা অঙ্গন বা আঙিনা ছেড়ে প্রশস্ত রাজপথেও বড় পরিসরে জায়গা করে নিয়েছে। যেমন বাংলাদেশে নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখে বা ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা শহিদ দিবসে ঢাকার রাজপথে আলপনা আঁকা হয়ে থাকে।

আলপনা মানবসভ্যতার একটি নান্দনিক লোকজ ঐতিহ্য। সারা পৃথিবী জুড়ে এর বিকাশ ঘটেছে নানা আঙ্গিকে।  মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ভারতবর্ষের আদি গোষ্ঠীর ভিতরে আলপনার সূচনা হয়েছিল আদিকালে। আলপনায় যে ধরনের চিত্র-নমুনা যুক্ত থাকে, তার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তাম্র, ব্রোঞ্জযুগের পাত্র বা ফলকে অঙ্কিত চিত্রে। এই বিচারে আলপনা হলো  মানুষের নান্দনিক বোধের ক্রমবিকাশের  ধারার একটি মৌলিক এবং আদিমতম উপাদান। আধুনিক নকশা বা বর্ণাঢ্য সমারোহের পাশাপাশি আলপনার ব্যবহৃত হচ্ছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বিবাহে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।

আধুনিক মানুষ, যাকে আমরা Homo sapiens বলি, পৃথিবীতে প্রজাতি হিসাবে টিকে থাকার নিমিত্তে এরা খাদ্যের জন্য এবং প্রকৃতি প্রতিকূল পরিবেশ, হিংস্র জীবজন্তু ও রোগের আক্রমণ থেকে নিজদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে। আবার এরই অবসরে পর্বত গুহায় ছবি এঁকেছে। সেকালের সেসব ছবির ভিতরে থেকে একসময় সৃষ্টি হয়েছে লিপি, আবার এই সূত্রে বিকশিত হয়েছে নানা রকমের মনোগ্রাহী ছবি। আবার কোনো কোনো ছবি অলঙ্কৃত হয়েছে আরও অন্যান্য রেখার দ্বারা।

কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে আলাদা আলাদাভাবে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, সে সূত্রে চিত্ররচনা শৈলীতে নানা রকম পার্থক্য সূচিত হয়েছে। এই সকল চিত্রকর্মে প্রভাব পড়েছে লোকজ জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই সবের সাথে ভাষা, পোশাক, লোকাচার ইত্যাদি নিয়ে তৈরি হয়েছে স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতি। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আলপনার মতো উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছে।

ভারতবর্ষে নানারকম জাতির মিশ্রণে ভারতীয় জাতি সত্ত্বার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতবর্ষের প্রাক্-আর্যকালে যে লোকজ চিত্র ছিল, তার সাথে আর্যদের চিত্র শৈলী মিশ্রিত হয়ে নতুন রূপ লাভ করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ অব্দের ভিতরে। এই সময়টাকে বলা হয় বৈদিকযুগ। এরপর পৌরাণিক আমলে এসে ধর্মীয় বোধের ক্রমবিকাশের সূত্রে আলপনা নতুন ভাবে স্থাপিত হয়েছে। যেমন বৈদিক যুগে আর্যরা দেয়ালে যে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকতো, তা এখনো অঙ্কিত হয়। বৈদিক যুগের পরে ভারতীয় পৌরাণিক আমলে ধর্মীয় ভাবনার সাথে যুক্ত হয়েছিল লক্ষ্মীর পা, লক্ষ্মীর ঘট ইত্যাদি। এসব আঁকা হতো মন্দির-গাত্রে, আঙিনা বা গৃহদ্বারে। ধীরে ধীরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে লতাপাতা এবং নানা রকম নান্দনিক রেখা।

প্রকৃত অর্থে শাব্দিক বিচারে আলপনা বলতে যা বুঝায় তা, একান্তই ভারতীয় লোকজ সংস্কৃতিজাত নকশা। আর সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে। ভারতের পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশে আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের আলপনার স্বাভাবিক রঙ হলো সাদা। গ্রাম-বাঙলায় আলপনা আঁকার ক্ষেত্র ছিল ঘরের দরজার সম্মুখে, আঙিনা, দেওয়াল। আল্পনার প্রেক্ষাপট হিসেবে এ সব স্থানকে মাটি দিয়ে লেপে স্থানটিকে শুকিয়ে নেওয়া হওয়া। তারপর চালের গুড়া পানিতে গুলিয়ে আলপনা আঁকা হয়। মাটির প্রেক্ষাপটে সাদা রঙের আলপনা ঘর এবং আঙিনাকে আলাদা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে গ্রাম-বাঙলার নারীরাই মূখ্য শিল্পী হিসাবে অঙ্কনের কাজটি করতেন। মূল ধারার গ্রামীণ আলপনা তেমনটাই আছে। বর্তমানে শহরাঞ্চলে খড়িমাটির গোলা দিয়ে আলপনা করা হয়। শহরাঞ্চলে আলপনার স্থায়ীত্ব বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করা হয়। সেক্ষত্রে গ্রামবাঙলার আলপনায় ব্যবহৃত সাদা রঙের পরিবর্তে বিভিন্ন সিনথেটিক রঙ ব্যবহার করা হয়।

অলঙ্কার হিসেবে আলপনা ব্যবহৃত হয়, অঙিনা, দেওয়াল, রাজপথ, ঐতিহ্যবাহী লোকজ পিঠা, ধাতব বা মাটির গৃহস্থালী উপকরণে, পোশাকে, পুস্তক-পুস্তিকায়, আসবাবপত্রে। এসব আল্পনার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, মূলত আলপনা হলো রেখাচিত্র। তবে দুই ধরনের রেখাচিত্রের সমন্বয়ে আল্পনা রচিত হয়ে থাকে। এই ধরণ দুটি হলো

     আল্পনার জ্যামিতিক উপাদান

আলপনার প্রাকৃতিক উপাদান

১. অর্থহীন জ্যামিতিক রেখা: এক্ষেত্রে ব্যবহৃত চিত্রগুলিতে জ্যামিতিক সংজ্ঞা পাওয়া যায়, কিন্তু এর দ্বারা কোনো বিশেষ অর্থ প্রকাশিত হয় না। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অর্থহীন জ্যামিতিক রেখার দ্বারা সৌন্দর্য সৃষ্টি করা।

২. প্রাকৃতিক উপাদান: দৃশ্যমান প্রাকৃতিক উপকরণ বা এই সকল উপকরণের অংশ দিয়ে রেখাচিত্রের মাধ্যমে এই জাতীয় আলপনা তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে আলপনার উপাদান
ফল-ফুল, গাছ, মাছ, নদী, হাতি মানুষ ইত্যাদির যে কোনোটি হতে পারে।

আলপনার গাঠনিক উপাদান :
আলপনা জ্যামিতিক বা প্রাকৃতিক যাই হোক না কেন, তা দুটি গাঠনিক উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। এই উপাদান দুটি হলো-

১. মৌলিক উপাদান:
যে কোনো চিত্রেরই এই উপদান রয়েছে। এর প্রধান উপাদান হলো বিন্দু। আর বিন্দুর সমপ্রসারণে তৈরি হয় সরল বা বক্র রেখা। তাই রেখাকে ধরা হবে সম্প্রসারিত  উপাদান হিসেবে। চিত্রকর্মে বিন্দুর চেয়ে ব্যবহারিক উপাদান হিসেবে রেখাই বিশেষ অবদান রাখে। তাই
কিন্তু চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে বিন্দু ও রেখাকে মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

২. সমন্বিত উপাদান: একাধিক বিন্দু ও রেখার সমন্বয়ে একটি অবয়ব তৈরি করা যায়। আল্পনার প্রাথমিক স্তরে চিত্র তৈরি হয় বিন্দু ও রেখার সমন্বয়ে। যে কোনো চিত্রকর্ম উপভোগের প্রাথমিক স্তরে আমরা মৌলিক উপাদানকে অগ্রাহ্য করে সমন্বিত উপাদানের দিকে নজর দিই। সৌন্দর্যের সূক্ষ্মস্তরে আমরা দেখার চেষ্টা করি বিন্দু ও রেখার সমন্বয়ের বিষয়ে।

একটি সরলরেখা মৌলিক উপাদানকে যদি আমরা একটি মৌলিক এবং একটি একক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে, এই রেখা দিয়ে তৈরি বর্গক্ষেত্র সমন্বিত আলপনা বলতে পারি। এইভাবে তৈরি হতে পারে একটি ফুল, পাখি, মাছ, মানুষ ইত্যাদির মতো অসংখ্য আলপনা। কিন্তু যখন এই জাতীয় আলপনা অন্য কোনো বড় আলপনার অংশ হিসাবে উপস্থাপন করা হবে, তখন তা একটি সমন্বিত আলপনা উপাদান হিসাবে বিবেচিত হবে।


১. একটি পাতা এবং ফুলের সমন্বিত কাঠামো


২. একটি আবর্তিত পুষ্পকোড়ক


৩. প্রথম দুটি আলপনার সমন্বয়ে সৃষ্ট নতুন আলপনা

ধরা যাক একটি পাতা, ফুল কুঁড়ি দিয়ে দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দুটি সমন্বিত আলপনা আঁকা হয়েছে  (পাশের ১ ও ২ সংখ্যক চিত্রের মতো)। যদি এই দুটি আলপনাকে সমন্বিত করে তৃতীয় একটি আলপনা তৈরি করা যায়, তাহলে এই দুটি  সমন্বিত আলপনা, তৃতীয় আলপনার বিচারে  দুটি সমন্বিত আলপনা উপাদান-এ পরিণত হবে।

আলপনার উপাদান বিন্যাস :
আলপনার  জ্যামিতিক বা প্রাকৃতিক যাই হোক না কেন উপাদনসমূহ উপস্থাপিত হয় দুটি ধরায়। এই ধারা দুটি হলো

১. প্রবহমান আলপনা
একটি একক আলপনাকে বারবার ব্যবহার করে, একটি প্রবহমান সৌন্দ্যর্যের সৃষ্টি করা হয়। এই জাতীয় আলপনা কোনো বিষয়ের প্রতীকী চিত্র হিসাবে থাকতে পারে। যেমন
কোনো ফুলের আলপনা। আবার কোনো জ্যামিতিক উপাদানও এইভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রবহমান আলপনা ব্যবহার করা হয় দুইভাবে।

চক্রকার প্রবহমান আলপনা

সরল প্রবহমান আলপনা

কোনো কেন্দ্রীয় আলপনাকে কেন্দ্র করে, তার চারদিকের প্রান্তীয় অংশে প্রবহমান আলপনা ব্যবহার করা হয়। এই আলপনা চক্রকারে বা একটি সরল রেখা অবলম্বনে থাকতে পারে। কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট প্রবহমান আলপনাকে চক্রাকার প্রবহমান আলপনা বলা যেতে পারে। একই ভাবে একটি সরল রেখা অবলম্বন করে সৃষ্ট আলপনাকে সরল প্রবহমান আলপনা বলা যেতে পারে। সরল প্রবহমান আলপনা সাধারণত কোনো কেন্দ্রীয় আলপনার প্রান্তদেশে বা কোনো ক্ষেত্রের চারদিকের প্রান্ত বরাবর ব্যবহৃতা হয়। তবে এই আলপনা  ক্ষেত্রের একদিকে, দুইদিকে বা সবদিকে ব্যবহৃত হতে পারে। কার্পেট এই জাতীয় আলপনা চার-প্রান্তেই দেখা যায়। শাড়ীর পাড়ে এই আলপনা থাকে উভয় পার্শ্বের দৈর্ঘ্য বরাবর। মসজিদ বা কোন গৃহের দেওয়ালের শুধু উপরের দিকে প্রবহমান আলপনা ব্যবহার করা হয়। প্রবহমান আলপনায় কোনো বিশেষ জ্যামিতিক উপাদান বা প্রকৃতিক উপাদান ব্যবহৃত হতে পারে। নিচের চিত্রে সরল প্রবহমান আলপনায় সপুষ্পক শাখার ব্যবহার দেখানো হয়েছে।

 

. খণ্ডিত আলপনা : প্রবহমান আলপনার বিপরীত উপস্থাপনকে খণ্ডিত আলপনা বলা যেতে পারে। মূলত কোনো বড় আলপনার 'সমন্বিত আলপনা-উপাদান'গুলো যখন বার বার ব্যবহার না করে, পৃথক পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাকে বড় আলপনাটির বিচারে খণ্ডিত আলপনা বলা হবে। অনেক সময় একটি আলপনাকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি বসিয়ে নতুন প্রবহমানতা বিনষ্ট করা হয়।  নিচের তিনটি ছবিতে অলঙ্করণসহ এর পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের নমুনা তুলে ধরা হলো।


 

একই আলপনার বিপরীত বিন্যাস ও তার বর্ধিত রূপ

অর্থের বিচারে আলপনা রূপ:
আলপনায় ব্যবহৃত কোনো চিত্রই আলোকচিত্রের মতো বাস্তবধর্মী নয়। যাঁরা বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কনে অত্যন্ত পারদর্শী, তাঁরাও আলপনায় বাস্তবধর্মী চিত্র ব্যবহার করেন না। আলপনার রেখাচিত্রগুলোতে বাস্তবতার চেয়ে কল্পলোকের শৈল্পিক তুলির আঁচড়ই প্রাধান্য পায়। তাই প্রকৃতির ফল-ফুল, গাছ, মাছ, মানুষ বাস্তব রূপে ধরা দেয় না। কিছু কিছু আলপনার দ্বারা শুধুই সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়। এই সকল আলপনায় দেখার আনন্দ আছে, ভাব উদ্ধারজনীত আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস নেই। আবার এমন আলপনা আছে যেখান ভাবকে প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই বিচারে আলপনাকে চারটিটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো- অর্থহীন আলপনা, বাস্তবধর্মী আল্পনা, আলপনা।

ছবি : তাসনুভা। আমলাপাড়া, ঢাকা। ১৩ জুলাই, ২০১১

১. অর্থহীন চিত্ররূপ
রেখার দ্বারা শুধুই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য এই জাতীয় আলপনা তৈরি করা হয়। এই সকল আলপনায় দেখার আনন্দ আছে, ভাব উদ্ধারজনীত আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস নেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি, ভাষা-দিবস, নববর্ষ ইত্যদিতে অর্থবহ বাস্তব বা কল্পচিত্রধর্মী আলপনার পাশাপাশি এই জাতীয় আলপনা প্রচুর ব্যবহৃত হয়।

এই জাতীয় আলপনা ছোটো ছোটো আকারে বাড়ির সিঁড়ি, ঘরের কোণায় বা মাঝখানে আঁকা হয়। পাঞ্জাবী বা এই জাতীয় পোশাকের বুকে বা পিঠে, শাড়ি বা উড়নাতে এই জাতীয় আলপনা দেখা যায়। অনেক সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঝুলন্ত ব্যানারে মঞ্চের পাশের পার্শ্বফলকে এই জাতীয় আলপনা ব্যবহার করা হয়। ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে এই জাতীয় আলপনাকে নির্দোষ আলপনা বলা যেতে পারে।

২. বাস্তবধর্মী চিত্ররূপ
আলপনায় যে সকল চিত্র কোনো বাস্তব রূপকেই তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ যার ভিতর দিয়ে কোনো বিশেষ অর্থকে প্রকাশ করা হয় না।

নন্দলাল বসুর আলপনাতে শঙ্খ বা লতার চিত্র

এই জাতীয় আলপনায় মাছ, পাখি ফুল, মানুষ অন্য কোনো অর্থ বহন করেন। অবশ্য এইসব উপাদনের সমন্বয়ে সৃষ্ট আলপনা কোনো লোক-ঐতিহ্য (নবান্ন), জাতীয় উৎসব (ভাষা-দিবস) ইত্যাদির প্রকাশ করা যেতে পারে। 

অঞ্চল বিশেষে এই জাতীয় আলপনায় বাস্তব উপাদানে হেরফের লক্ষ্য করা যায়। এক সময় বাংলা লোকজ-আলপনায় ব্যবহৃত হতো নানা ধরনের মানুষ, মাছ, বাঘ, হাতি, ময়ুর, পেঁচা ইত্যদির চিত্র। এছাড়া থাকতো ধানের ছড়া, যবের ছড়া, জবা ফুল, দোলন চাঁপার মতো কিছু অতি-পরিচিত উপাদান। একসময় গ্রাম বাংলার আলপনায় শঙ্খ, ত্রিশূল, প্রদীপ, লতা-পাতা ইত্যাদি বাস্তবধর্মী চিত্ররূপ উপস্থাপন করা হতো প্রচুর পরিমাণে।

৩.প্রতীকধর্মী আলপনা:  
এই জাতীয় আলপনায় কোনো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ রূপ ভাবকে আলপনায় প্রকাশ করা হয়।

কোলে পোকাঁখে পো

 নন্দলাল বসুর আলপনাতে জলের প্রতীক

বহু সন্তানবতী নারীর মাতৃরূপ প্রকাশের ক্ষেত্রে 'কোলে পোকাঁখে পো' প্রতীকী চিত্রটি এরকম একটি আলপনা। আবার কোনো বিশেষ অর্থকে প্রতীকী চিহ্ন দ্বারা অনেকে প্রকাশ করেছেন। যেমন নন্দলাল বসুর আলপনাতে জলের প্রতীক হিসাবে আবর্ত চিহ্ন ব্যবহার করেছেন।

সম্পদ ও মঙ্গলের প্রতীক হিসাবে অনেক সময় শষ্যের দানা বা শিষ, শঙ্খ ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে পায়ের ছাপকে লক্ষ্মীর পা হিসাবে আলপনায় ব্যবহার করা হয়। ত্রিশূল দিয়ে মহাদেবকে বুঝানো আবার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের প্রতীক হিসাবে ওঁ চিহ্নের ব্যবহৃত হয়। শুভ বা মঙ্গলদায়কের প্রতীক হিসাবে স্বস্তিকাচিহ্ন ব্যবহৃত হয়। বাঙালি খ্রিষ্ট-ধর্মাবলম্বীর আলপনা দ্বারা অলঙ্কৃত ক্রুশ চিহ্ন ব্যবহার করে থাকেন। নিচে কিছু প্রতীকী আলপনা উপাদানের ছবি দেওয়া হলো।

লক্ষ্মীর পা ওঁ চিহ্ন স্বস্তিকাচিহ্ন

.মিশ্র আলপনা:  
বিভিন্ন ধরনের আলপনার সংমিশ্রণে সৃষ্ট আলপনাকে মিশ্র আলপনা বলা হয়। এক্ষেত্রে অর্থবোধক, বাস্তবধর্মী এবং প্রতীকধর্মী সকল উপাদানই ব্যবহৃত হয় বা এর যে কোনো দুটিও ব্যবহৃত হয়। আবার এতে খণ্ডিত আলপনা বা প্রবহমান আলপনাও থাকতে পারে।

অঙ্গ আলপনা :
বর্তমানে মেয়েরা মেহদি পাতার রঙ ব্যবহার করে হাতে পায়ে বিচিত্র ধরনের আলপনা আঁকে। সাধারণত মুসলমান মেয়েরা বিবাহ বা কোনো ধর্মীয় উৎসবে এই জাতীয় আলপনা আঁকতো। বর্তমানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মেয়েরাও সাধারণ উৎসবে মেহেদির আলপনা আঁকে। হাতের আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত নানা ধরনের আলপনা আঁকা হয়। নিচে কিছু মেহদি আলপনার নমুনা দেখানো হলো।

দেহের বিভিন্ন অংশে আঁকা উল্কি আল্পনারই একটি প্রকরণ। আজকাল মেয়েরা আলপনার মতো করে টিপ পরে। এমন কি কেউ কেউ নখে ক্ষুদ্র আলপনা আঁকে।

চিত্রালঙ্কারে প্রয়ো্গ

আলপনাকে কেউ অলঙ্কার ছাড়া আর কিছু ভাবে না। কিন্তু অন্যান্য চিত্রকেও অলঙ্কার হিসেবে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। যাদুঘরে রক্ষিত বা চিত্রপ্রদর্শনশালায় চিত্রকর্ম চিত্রকর্ম শুধুই চিত্রকর্ম। এর বাইরে সচিত্র বিবরণের চিত্রও অলঙ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত ছবি হয়ে যায় ঘরের অলঙ্কার। চিত্রকর্মের এই রকম ব্যবহারে, অনেক সময়ই চিত্রের মহিমা লাঞ্ছিত করে। যদি এমন হতো, নামাজের ঘর, পূজার ঘর, লেখাপড়ার ঘরের মতো একটি ছবির ঘর থাকতো, তাহলে ছবির নান্দনিক মূল্য থাকতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য হয়তো এটা অতি-বিলাসিতা হবে। কিন্তু লক্ষ টাকা দিয়ে যিনি ছবি কিনে নিয়ে যান, তার জন্য ছবির বিশেষ মর্যাদা দেওয়াটা খুব অসম্ভব নয়।
দামি ছবি দিয়ে ঘর সাজানোর ভিতরে নিজেক দেখানোর বাড়তি প্রচেষ্টা থাকে। এই জাতীয় গৃহসজ্জার ভিতরে গৃহকর্তার আভিজাত্যের চোখ রাঙানি আছে। প্রতিনিয়ত অতিথিকে স্মরণ করিয়ে দেয়
দেখো আমার অর্থও আছে, রুচি আছে।