২.২
আনন্দ
মানুষ অস্বস্তিদশা থেকে স্বস্তিদশায় বার বার ফিরে আসতে চায়। যখন সে স্বস্তিবোধে ফিরে আসে তখন তাকে আমরা ভালো-লাগা বলতে পারি। স্বস্তি বা অস্বস্তি উভয়ই মূলত তুলনামূলক একটি দশা বিশেষ। স্বস্তিদায়ক দশার প্রতিটি স্তরে জন্ম নেয় ভালো-লাগার বোধ। ধরা যাক একটি দৃশ্য দেখে কারো ভালো লেগেছিল। এর অর্থ এই নয় যে, ওই দৃশ্যটি দেখার আগে সে অস্বস্তিতে ছিল। কিন্তু দৃশ্যটিকে প্রথম দেখার আগে, তখন হয়তো তার দেহ ও মন সাধারণ স্বস্তিদশাতেই ছিল। সে যখন দৃশ্যটি দেখলো, তখন তার মন, দেখার ভিতর দিয়ে ভিন্নতর এবং অধিকতর স্বস্তিদায়ক দশার দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। যা থেকে সৃষ্টি হলো দেখার সুখ এবং সেখান থেকেই সৃষ্টি হলো আনন্দের অনুভূতি। এই আনন্দের অনুভূতি যদি তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে, তাহলে তার ভিতরে ভালোলাগার বোধ তীব্রতর হয়ে অনু্ভূত হবে। এই বোধ যদি তাকে দৃশ্যটি বারবার দেখার জন্য তাড়িত করে, তাহলে মনের ভিতর জন্ম নেবে আকাঙ্ক্ষা। আকাঙ্ক্ষা পূরণের তীব্র ইচ্ছা লোভে পরিণত হয়। আকাঙ্ক্ষার গভীরে থাকে আকর্ষণ। যখন কোনো নান্দনিক বিষয় উপভোগ করার জন্য কেউ আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠে, তখন তার মনের ভিতরে এক ধরনের আকৃষ্টজনিত টানের সৃষ্টি হয়। এই টানই হলো আনন্দলাভের প্রতি আকর্ষণ।
গড় স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের
সূত্রে আমরা স্বাভাবিকভাবে 'ভালো আছি' বলি, সে ভালো থাকাটা স্বাভাবিক স্বস্তিবোধের
চেয়ে একটু উঁচু স্তরের।
ধরা যাক কোনো একজন, একটি গড়
স্বস্তি-অস্বস্তিদায়ক তাপমাত্রায় আছে। এই তাপমাত্রায় সে ভালো আছে বলছে। সময়টা যদি
গরমকাল হয়, তাহলে শরীর জুড়িয়ে দেওয়া হঠাৎ একটু শীতল বাতাস তার ভিতরে ভালোলাগা নামক বোধের জন্ম দেবে। এই বোধ খুব সামান্য
সময়ের জন্য হলেও মোহিত করবে। ফলে মনের ভিতর যে সুখানুভূতির জন্ম দেবে, তা উচ্চতর ইতিবাচক স্বস্তিবোধ থেকে জন্ম নেবে।
যে কোনো ইতিবাচক
উদ্দীপনামূলক অনুভূতি, মানুষের মনে বিশেষ সুখদায়ক
দশার সৃষ্টি করে। সুখ মুলত একটি প্রবহমান কার্যক্রম। কোনো অনুভূতি যখন অস্বস্তিদায়ক
দশা থেকে স্বস্তিদায়ক দশার দিকে অগ্রসর হয়, তখন যে চলমান অনুভূতির জন্ম হয়, তখন
তাকে সুখানুভূতি বলা হয়। যতক্ষণ এই স্বস্তিদায়ক দশার উন্নতি
হতে থাকে, ততক্ষণ সুখানুভূতি থাকে। যখন তা থামে, তখন সুখবোধও থেমে যায়। কিন্তু মনের
ভিতর এর রেশ থেকে যায়।
ঘটে যাওয়া
কোনো ঘটনার সূত্রে সৃষ্ট সুখবোধ মনের ভিতরে দীর্ঘক্ষণ বা দীর্ঘকাল
স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়, কিন্তু সুখ থাকে না। অবশ্য সুখবোধ স্মরণ করে নতুনভাবে
সুখের ভাব মনে আনা যায়। কিন্তু আগের সুখটি কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। বরং সুখের স্মৃতি
রোমন্থন করে নতুন সুখের জন্ম দেওয়া যায়।
সদ্য ঘটে যাওয়া সুখবোধ অতীত হলেও এর রেশটুকু এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, মনে হয়
এখনই ঘটলো। মনে হয় না, এটি ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা মনে যে
আবেশিত দশার সৃষ্টি হয়, তাই আনন্দ। অন্যভাবে বলা যায়, মনের ভিতর
ছড়িয়ে পড়া সুখবোধই হলো আনন্দ।
স্বস্তি-অস্বস্তির
জোয়ার-ভাটায় সুখের অবস্থান পাল্টায়। একটি
সুনির্দিষ্ট সুখদশা একটি উচ্চশিখরে পৌঁছার পর, তার গতি হয় নিম্নমুখী। যদিও সুখের
অনুভূতির প্রাবল্যে উঠাপড়ার ক্রিয়া চলে, তবুও সুখানুভূতি আন্দোলিত হয়। একসময় প্রবল
সুখানুভূতিও একঘেঁয়েমিতে পর্যবসিত হয়। ফলে মনের ভিতরে ছড়িয়ে পড়া সুখ মিলিয়ে যেতে
থাকে এবং একই সাথে আনন্দও হ্রাস পেতে থাকে। একসময় তা অস্বস্তির দিকে
অগ্রসর হয়।
আনন্দ
ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তার স্মৃতি প্রশান্তিরূপে মনে থাকতে পারে দীর্ঘদিন। আনন্দের
জন্ম ঘটমান সুখানুভূতির প্রবহমান ধারায়। তাই প্রতিমুহূর্তের আনন্দ সময়ের সুতোয় যে গিট
তৈরি করে, তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। এরই ভিতর দিয়ে একটি আনন্দদায়ক অনুভূতি ম্লান
হয়ে যায় এবং এক সময় তা নিরানন্দে পরিণত হয়। কিন্তু দীর্ঘ বা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তা আবার জাগ্রত হয়ে উঠতে পারে বা উঠে। কোনো
আনন্দদায়ক গান কয়েকবার বা কয়েকদিন শোনার পর আর শুনতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু তার
আনন্দদায়ক অনুভূতিটা থেকে যায় স্মৃতিতে। কিছুদিন পর আবার ওই গান শুনে পুরোনো
আনন্দটা ফিরে আসে। তবে সে শোনার সাথে কিছু স্মৃতিকাতরতাও থাকে।
ধরা যাক, একজন মানুষ স্বস্তি-অস্বস্তির নিরপেক্ষ দশায় আছে। এমন সময় একটি সুমিষ্ট সুর শুরু হলো। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে, ওই সুরটি ওই মানুষটির মনে স্বস্তিদায়ক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থায় তার ভিতরে ধ্বনির দ্বারা একটি স্বস্তিদায়ক দশার শুরু হবে। প্রাথমিক অবস্থায় সুরটি স্বস্তিদায়ক দশার উচ্চ স্তরের দিকে অগ্রসর হবে। এই অবস্থায় ওই মানুষের মনে একধরনের সুখানুভূতির জন্ম দেবে। এই সুখানুভূতি যদি তার মনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা আনন্দে পরিণত হবে। মানুষের মন যদি ধীরে ধীরে সাধারণ স্বস্তি দশা থেকে আনন্দ দশায় উন্নীত হতে থাকে, তখন সুখের ক্রমোন্নতির ধারায় বোধের দ্বারা আবেশিত হয়। কিন্তু হঠাৎ পাওয়া কোনো বিষয় বা দ্রুত ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা থেকে যখন মানুষ আনন্দ পায়, তখন কিছুক্ষণের জন্য সে তার আশ-পাশের সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে যায়। আনন্দের এই তীব্র অনুভূতি ম্লান হয়ে গেলে দেখা যায়, আনন্দ পাওয়ার মুহূর্তে তার কিছুই মনে নেই।
মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিতে আনন্দ
পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু এত সাধের আনন্দ বেশিক্ষণ থাকে না। যে সুর শুনে
শ্রোতা আনন্দে আপ্লুত হয়, সেই
সুরটি যদি অপরিবর্তিতভাবে
একটানা বাজতে থাকে― তাহলে শ্রোতার মনে একঘেয়ে অনুভূতির সৃষ্টি করবে। ফলে, তার ভিতরে জন্ম নেবে অস্বস্তি এবং শোনার আনন্দময় অনুভূতিটি ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী হয়ে
অস্বস্তির দিকে চলা শুরু করবে। আনন্দ প্রাপ্তির ক্রমধারায় যে সুখানুভূতি পাওয়া যায়,
আনন্দের নিম্নগামিতায় তা হ্রাস পেতে থাকে। একই সাথে মনের
ভিতরে ছড়িয়ে পড়া আনন্দ ম্লান হতে থাকবে।
কিন্তু যদি ওই
সুরের সাথে একটু পর তালযন্ত্রের সঙ্গত শুরু হয়, তখন শ্রোতার শ্রবণানুভূতিতে বৈচিত্র্য
আসবে, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তি পাবে এবং আরও একটু শুনবে। এই সুরটি যদি একই
সাথে নানা ধরনের ধ্বনির নকশা তৈরি করতে থাকে, তা হলে শ্রোতার মনে গতির সঞ্চার হবে। সুখের পরে
সুখের ঢেউয়ে সেই গতির সরলরেখায় আন্দোলিত অনুভূতির সঞ্চার হবে, এর ফলে সমগ্র শ্রবণ প্রক্রিয়ার ভিতর বিচিত্র আনন্দের
অনুভূতি সক্রিয় থাকবে।
কোনো শিল্পী যদি বৈচিত্র্য দিয়ে তার সুরকে উপস্থাপিত করতে না পারেন, তাহলে শ্রোতা
আনন্দ লাভ থেকে বঞ্চিত হবেন। শিল্পের বৈচিত্র্যের জন্য শুরুটাও জানতে হয়,
শেষ করাটাও জানতে হয়। মনকে ভরিয়ে দেওয়াও জানতে হয়, আবার
শূন্য করে দেওয়াটাও জানতে হয়।
আনন্দ গ্রহণকারীর বিচারে আনন্দের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন−
সহজাত আনন্দ: এই জাতীয় আনন্দ মানুষ
সহজাত উপলব্ধির দ্বারা
লাভ করে। যেমন−
ক্ষুধা নিবৃত্তের আনন্দ।
এক্ষেত্রে খাদ্যের বিষয় নিয়ে মত পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু খাদ্য গ্রহণের সময়
এবং খাদ্য গ্রহণের পর
ক্ষুধা নামক প্রবৃত্তি দূরীকরণের ফলে যে আনন্দ লাভ হয়, তা সহজাত। শুধু মানুষ
কেন, যে কোনো জীব নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। জীব নিজের জন্য কল্যাণকর
মনে করে, তার প্রাপ্তিতে যে আনন্দ লাভ হয়, তা তার জৈবিক ধর্মের অংশ হিসেবে
সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে পায়। জীবের এই ধর্ম, আছে বলেই আনন্দ পায়। মানুষের মতো
উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীর ভিতরে বেঁচে থাকার আনন্দ শুধু প্রাণধারণের
ভিতরেই থাকে নয়, তার কাছে পৃথিবীর রূপরসগন্ধের সৌন্দর্য অনুভবও কাঙ্ক্ষিত।
মানুষের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে চিত্তবিনোদন।
নৈর্বাচনিক আনন্দ:
প্রতিটি মানুষের রয়েছে নিজস্ব পছন্দের জগৎ। সে জগতের পছন্দের কোনো কোনো
উপাদানের সাথে অন্যের পছন্দের উপাদান মিলে যেতে পারে। কিন্তু এর বাইরে রয়েছে
প্রতিটি মানুষের ছোটো ছোটো নিজস্ব আনন্দের উপাদান। যেমন সবাই একই খাবার পছন্দ
করে না। ফলে কোনো বিশেষ খাবার দেখা বা ওই খাবার গ্রহণ করার আনন্দ সবাই পায় না।
কোনো বিশেষ খেলা দেখে কেউ আনন্দ পেতে পারেন, অন্যের কাছে ওই খেলা হয়তো কোনো
আগ্রহই সৃষ্টি করে না। ফলে তার কাছে ওই খেলা আনন্দজনক হয়ে উঠে না। এই জাতীয় আনন্দকে আমরা
নৈর্বাচনিক আনন্দ বলতে পারি। নৈর্বাচনিক আনন্দ সৃষ্টি হয়
অভিজ্ঞতা থেকে। আগে থেকে একই ক্ষেত্রের অনেক আনন্দের অনুভব না থাকলে, কোনো
বিশেষ আনন্দকে নির্বাচন করা যায় না। নৈর্বাচনিক আনন্দ অনেক
সময় অনুশীলনের মাধ্যমেও তৈরি হতে পারে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই দেখা যায়।
দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ সাধারণভাবে জনপ্রিয় গান শুনে গান শিখতে আসে। প্রাথমিক
অবস্থায় হয়তো রাগসঙ্গীত শুনলে তার রাগই ধরে। কিন্তু গুরুজি তাকে কণ্ঠ সাধনার
সূত্রে কিছু কিছু রাগশ্রয়ী সরগমগীত শেখান। এরপরে লক্ষণগীত শেখান। কিছুদিন পর দেখা যায়, রাগ
সঙ্গীতের প্রতি তার তীব্র অনুরাগ জন্মেছে। অনেক সময় এই অনুরাগ এতটা গভীরভাবে মনকে
আচ্ছন্ন করে থাকবে যে, হয়তো সে অন্যান্য গান বাদ দিয়ে শুধু রাগসঙ্গীত শোনার
প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করবে।
সাধারণভাবে নৈর্বাচনিক আনন্দলাভের বিষয়টি পায় তার পরিবেশ
থেকে। এই পরিবেশ হতে পারে পরিবার, এলাকার বিদ্যালয়, ব্যক্তি বিশেষের প্রভাব
ইত্যাদির সূত্রে। আবার কোনো কোনো মানুষের ভিতরে
বিশেষ কোনো বিষয়ের প্রতি বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়। কেউ কেউ বড় হয়ে ওই বিষয়ে অসাধারণ অবদান রাখতেও
পারেন। কারো কারো ক্ষেত্রে তীব্র ইচ্ছা এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ওই বিষয়ে
উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারে না। বিশেষ করে যার সাথে দৈহিক সামর্থ্যের বিষয় জড়িত
থাকে। যেমন সাঙ্গীতিক বোধ যথেষ্ঠ থাকা সত্তেও, জন্মগতসূত্রে প্রাপ্ত কণ্ঠস্বরের
অক্ষমতার জন্য অনেকে কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠেন না। তবে শিল্পী হওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেও
শ্রোতা হিসেবে সে সঙ্গীতের আনন্দ গ্রহণ করতে পারবে।
পরিবেশগত আনন্দ: আনন্দ অনেকক্ষেত্রে পরিবেশ নির্ভর। যে চুটকি শুনে একজন আনন্দে উদ্বেলিত হবে, সেই চুটকি তার প্রিয়জনের সদ্য মৃত্যুক্ষণে তাঁকে ক্রোধান্বিত করবে। ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়, ভালো পরিবেশে। দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তূপের পাশে বসে কি, লোভনীয় খাবার আনন্দ দিতে পারে? মনে কষ্ট পেলে অতিথি খাবার ফেলে উঠে পড়ে। এর সবই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
আনন্দ প্রাপ্তির প্রকৃতি
আনন্দের অনুভব 'আমি' গ্রহণ করে 'মন'-এর মাধ্যমে। তাই আনন্দের আধারও মন। মনের
কাছে আনন্দের উপাদানগুলো ইন্দ্রিয় দ্বারা বাহিত হয়ে। তাই ইন্দ্রিয়ভেদে আনন্দের
প্রকৃতি হয়ে উঠে ভিন্ন ভিন্ন। ইন্দ্রিয়ভেদে এদের নাম হয়ে থাকে, শোনার আনন্দ, দেখার
আনন্দ, ঘ্রাণের আনন্দ, স্পর্শের আনন্দ ও আস্বাদনের আনন্দ। এর বাইরে রয়েছে
অতীন্দ্রিয় আনন্দ। যেমন খাদ্যগ্রহণের পর মনে যে আনন্দের সঞ্চার হয়, তার অনুভুতি
শরীরের স্বয়ংক্রিয়-পদ্ধতির দ্বারা। এর বাইরে ঈশ্বর ভাবাবেশে মনে তৈরি হতে পারে
অলৌকিক আনন্দ। আনন্দের প্রকৃতি অনুসারে সবগুলো আনন্দ একই রকম হয় না। প্রকৃতির
বিচারে একে ৩টিভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটো হলো- মৌলিক আনন্দ, যৌগিক আনন্দ ও মিশ্র
আনন্দ।
মৌলিক আনন্দ: যে সকল আনন্দ অন্য
আনন্দ ছাড়াই এককভাবে উপস্থাপিত হয়। শিশু যখন শুধু চিনি খায়, তখন সে শুধু
মিষ্টির আনন্দ পায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিটি মৌলিক অনুভূতিই মৌলিক আনন্দের
সৃষ্টি করতে পারে।
যৌগিক আনন্দ: একাধিক মৌলিক আনন্দের
সংমিশ্রণে তৈরি হয় যৌগিক আনন্দ। যেমন―
দুধ মিশ্রিত চা। এর ভিতরে মিষ্টি, চা, দুধের ভিতরের সকল মৌলিক উপাদানের দ্বারা
যৌগিক আস্বাদনের রূপ তৈরি হয়। এরফলে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তাই মিশ্র আনন্দ। এ
সকল আনন্দ একক ইন্দিয়ের হতে পারে, আবার একাধিক ইন্দ্রিয়গত হতে পারে। যেমন
পায়েস। পায়েসের স্বাদ এবং এর গন্ধ উভ্য় মিলে মনে আনন্দের সঞ্চার করে।
মিশ্র আনন্দ: এমন কিছু ঘটনা থাকে, যাতে একই সাথে নানা ধরনের আনন্দ মিলে একাকার হলেও পৃথকভাবে প্রতিটি আনন্দ অনুভব করা যায়। যেমন তবলা-সহ কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশেন। তবলার ধ্বনি শোনার আনন্দ এবং কণ্ঠসঙ্গীতের আনন্দ মিলেমিশে মিশ্র আনন্দ তৈরি করে। মিশ্র আনন্দের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মন চঞ্চল থাকে। এর ফলে 'তবলা-সহ কণ্ঠসঙ্গীত' উপভোগের সময় শ্রোতা কখনও মন দিয়ে গান শোনে কখনও তবলা শোনে। এই শোনার ভিতরে একটি মূখ্য একটি গৌণ হলেও উভয় মিলে যে আনন্দের সঞ্চার করবে, তাই হয়ে উঠবে মিশ্র আনন্দ।
আনন্দের স্পর্শকাতরতা
মানুষের চলমানমান জীবনযাত্রা আনন্দ-বেদনার ধারায় প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে বেদনা
মানুষকে যত দ্রুত প্রভাবিত করে, ততটা আনন্দ করে না। মানুষ আনন্দের স্বস্তিদায়ক
অনুভূতি সহজাত জীবনপ্রবাহে ধরে রাখতে চায়। বেদনা চায় না বলেই তা দ্রুত মনের উপর
প্রভাব ফেলে। প্রাত্যহিক জীবনে আনন্দের চেয়ে বেদনার আবেদনও বেশি। ধরা যাক একটি
করিডোরে কিছু মানুষ হাসি ঠাট্টায় মগ্ন। আপনি দর্শক হিসেবে দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখে
সহজেই এড়িয়ে যেতে পারেন, বিষয়টা ওদের বলে। ওদের আড্ডায় খুব বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ
পেলে বড় জোর ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকাতে পারেন। হয়তো কিছুটা বিরক্তও হতে পারেন।
কিন্তু ওই দলের কেউ যদি চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সাথে সাথে আপনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা
বুঝার চেষ্টা করবেন। শুধু আপনি নন, আশপাশে আপানার মতো আরও অনেকেই সচকিত হয়ে একইভাবে
কান্নার কারণ জানার আগ্রহ প্রকাশ করবেন।
কখনও কখনও এমন কোনো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়, যা দেখে দর্শক
মাত্রেই তীব্র আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায় কিম্বা পরম দুঃখে ভেঙে পরে। যেমন
সুস্থ শিশুর জন্মটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং সেটাই হয় আনন্দের।
কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই
অস্বাভাবিক ঘটনা অপ্রত্যাশিত
এবং নেতিবাচক বলেই এই জাতীয় ঘটনা মনোবেদনার জন্ম দেয়।
এই কারণেই
বলা হয়, আনন্দের চেয়ে বেদনার স্পর্শকাতরতা অনেক বেশি।
আনন্দ নানাভাবে আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে। প্রাত্যহিক জীবন প্রবাহে স্বস্তি-অস্বস্তিবোধেরও একটি গড় মান আছে। এই মানটি নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের মানসিকতার উপর। আনন্দ-বেদনার গড় মান আছে। যে ব্যক্তি অল্প শোকে কাতর হয়ে যায়, তার জীবনের আনন্দের ভাগ কম। আবার যে ব্যক্তি জীবনের বেদনাগুলো সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে, তার জীবনে আনন্দের ভাগ বেশি। যে ব্যক্তি সবসময় আনন্দরসে জীবনকে আর্দ্র করে রাখতে পারেন, তাঁর জীবন হয়ে উঠে প্রায় সদানন্দের মেলা।
প্রবহমান জীবনযাত্রায় মানুষ বিচিত্রভাবে আনন্দ লাভ করে। এর একটি সহজাত জীবনযাত্রার ভিতরে পায় একটি সত্যের বিচারে। স্বাভাবিক সঙ্গীতের আনন্দ, স্বাভাবিক চিত্রকলার আনন্দ, স্বাভাবিক প্রেমের আনন্দ আমরা প্রত্যহিক জীবনের ঘটমান ঘটনাবলির ভিতরে পাই। এছাড়া প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য থেকেও আমরা যে আনন্দ পাই তাও স্বাভাবিক এবং সত্যাশ্রয়ী। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রায় এ সবের বাইরে এমন কিছু বিষয় যুক্ত হয়, যা স্বাভাবিক নয় কিন্তু সেসব থেকে আমরা আনন্দ পাই। এক্ষেত্রে কর্তা আনন্দ নিজে যতটা পায়, অন্যের সাথে ভাগাভগি করে যেন বেশি পায়। একে বলা যায় অস্বাভাবিক আনন্দ। এই অস্বাভাবিক আনন্দের প্রকৃতি হতে পারে নানা ধরনের। যেমন−
অস্বাভাবিক
ঘটনাজাত আনন্দ: বাক্য বা কর্মের ভিতর দিয়ে
যে ঘটনা ঘটে, তার অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে এই আনন্দের সৃষ্টি হয়। এখানে
অস্বাভাবিক শব্দটি অবিশ্বাস্য অর্থে নয়। এই অস্বাভাবিক হলো- যা স্বাভাবিকভাবে
ঘটে না, কিন্তু যা অপ্রত্যশিতভাবে ঘটে থাকে। এই অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে
প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বা কথোপকথনের মধ্যে। এই অস্বাভবিকতা মানুষের
জীবনে জন্য বিপজ্জনক নয়, কিন্তু মানুষকে সামান্য অপ্রস্তুত করে তোলে। এই জাতীয়
ঘটনা থেকে মানুষ প্রত্যক্ষভাবে আনন্দ পায় বা তা পরে অন্যের কাছ থেকে শুনেও আনন্দ পায়। জীবনের
এসব আনন্দের ভিতরে থাকে স্বাভাবিক ছন্দোপতনের এক ধরনের সুসমন্বিত
অনুভূতি। সে অনুভূতি ভিন্নতর ছন্দে চলে। অনেকটা সঙ্গীতের তালফেরতার মতো। যেনো
স্বাভাবিক চলার ছন্দের ভিতরে ভিন্নতর ছন্দে গিয়ে আবার আগের স্বাভাবিক ছন্দে
ফিরে আসা। এই অনুভূতি অস্বস্তিকর কিন্তু বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর। ফলে অনেক সময় এই
অস্বাভাবিকতা উপলব্ধি করে অন্যেরা শুধু নয়, ঘটনার অপ্রস্তুত নায়ক-নায়িকা নিজেও আনন্দলাভ করে
থাকে। এই বিষয়টি ঘটতে পারে সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির ক্ষেত্রেই। যেমন−
কথোপকথন এবং শ্রবণের অস্বাভবিকতাজাত আনন্দ: স্বাভাবিক মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ধরনের বাক্য বিন্যাস বা শব্দের উচ্চারণ হওয়া উচিৎ, তেমনটা না হয়ে অন্যরকম হয়। এই জাতীয় আনন্দ তৈরি হতে পারে, দুটি সূত্রে।
ভ্রমাত্মক: মানুষ তার
প্রাত্যহিক জীবনে নানা ধরনের ভুল করে। এর ভিতরে কিছু ভুল থাকে, যা মানুষের
জীবনে চরম বেদনা বয়ে আনে। যেমন― ঔষধের বড়ি মনে করে কেউ বিষের বড়ি খেয়ে ফেলেছে।
কিছু দক্ষতার অভাবে ভুল করা বা ভুল করে ভুল করা। যেমন অঙ্কে ভুল করা। এই জাতীয়
ভুলগুলো মানুষ প্রার্থনা করে না বলেই বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। কিন্তু মানুষ এমন
কিছু ভুল করে, যা তার ব্যক্তি জীবনে বা সামাজিক জীবনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব
ফেলে না। এই ভুলগুলোকে আনন্দের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করলে, জীবনটা সরস হয়ে উঠে।
কথায় আছে- বেরসিকের কাছে রসিকতা করার চেয়ে বিড়ম্বনা আর নেই। তবে সাধারণত মানুষ
সকল ক্ষেত্রে অতটা বেরসিক প্রাণী নয়। এই জাতীয় আনন্দময় ভুলের কিছু উদাহরণ দেওয়া
যাক। একটি শিশুদের পাঠকক্ষে শিক্ষিকা
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করলেন, 'কে কে গান জানো, হাত তোলো।' দেখা গেল প্রায় সকলেই
হাত তুলেছে। শিক্ষিকা এবার একজন শিক্ষার্থীকে বললেন, তুমি একটা গান শোনাও।
শিক্ষার্থী গান ধরলো−
'সূর্য দিগন্তে পূর্ব উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল রক্ত লাল'
শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থীরা হা হা, হু হু করে হাসিতে ফেটে পড়লো। কারণ,
স্বাভাবিক গানের পংক্তিটি হলো, 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে...।' এই
অস্বাভাবিকতাই এক্ষেত্রে আনন্দের সৃষ্টি করে। সঙ্গীতে সুর, তাল, লয়, বাণীর বিপর্যয় কখনো
কখনো আমাদের আমোদিত করে। তবে পরিবেশনকারীর কাছে তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দের হয় না।
বিশেষ করে গানের পরীক্ষার সময় ভুল হলে তা বেদনাদায়ক ফল বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে।
একটি অনুষ্ঠানের এরকম আর একটি
ভুল গান করার বিষয় বলা যাক। রবীন্দ্রনাথের 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে'
গানটির দ্বিতীয় অন্তরার একটি পংক্তিতে রয়েছে, 'চরবে গরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে'।
একজন সঙ্গীতশিল্পীর শব্দ বিপর্যয়ে তা গাইলেন−
' খেলবে গরু চরবে রাখাল ওই
মাঠে'।
এই জাতীয় বাক্য বা শব্দ বিপর্যয়ে শিল্পী প্রাথমিক পর্যায়ে লজ্জিত
এবং বিব্রত অবস্থায় পড়েন বটে, একসময় দেখা যায় শিল্পী নিজেই এই নিয়ে অন্যের সাথে আলোচনা
করে হাসাহাসি করছেন।
মানুষ জানা
বিষয়ও ভুল করতে পারে। তাতে অন্যরা যতটা আনন্দ পায়, অদক্ষ লোকের কাজে অন্যরা
আনন্দের সাথে আক্ষেপের অনুভূতি প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে অন্যের ব্যঙ্গও হজম করতে
হয়। সাধারণত এই জাতীয় কাজের জন্য কর্তা লজ্জিত হন, এবং তা সগৌরবে অন্যের
কাছে প্রকাশ করতে চান না। একটি ইংরেজি সংবাদ
'Police is
patroling the street'-এর
অনুবাদ যখন হয়- "পুলিশ রাস্তায় রাস্তায় পেট্রোল
ছিটাইতেছে", তখন তা পড়ে পাঠক যে আনন্দ পায়,
তার সাথে মিশে থাকে অনুবাদকের প্রতি অবজ্ঞা।
অপ্রত্যাশিত ঘটনাজাত
আনন্দ: যেসকল ঘটনাবলি অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে হাসির উদ্রেক করে, তা আমাদের
প্রাত্যহিক বা সমগ্র জীবনের বিচারে অপ্রতুল নয়। অস্বাভাবিক ঘটনার মধ্য দিয়ে
যে আনন্দ লাভ হয়, তাতে সাময়িকভাবে ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি বা
ব্যক্তিবর্গ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বটে, কিন্তু একসময় তার বা তাদের ভিতরেও
হাসির উদ্রেকও করে। আবার এই ঘটনা শুনেও শ্রোতারাও হাসিতে ফেটে পড়েন। এরকম
একটি ঘটনার কথা বলি। একবার কোনো একটি পরিবারে অনেক দিন পর একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এটি
ওই পরিবারে কাছে ছিল একটি প্রত্যাশিত আনন্দ, তাই তার নামও রাখা হলো 'আনন্দ'।
আনন্দের বয়স যখন ছয়-সাত মাস, তখন কোনো এক সকালে তার মা তাকে স্নান করানোর জন্য,
স্নানের পানি তৈরি করছেন। কিন্তু শিশুর চাঞ্চল্যে তার মা কাজটি
ঠিকমতো করতে পারছেন না। এমন সময় আনন্দের দাদিমা এসে বললেন, ওকে আমার কাছে দাও।
এরপর দাদিমা আনন্দকে দুই হাতে উঁচু করে তুলে ধরে দুর্বোধ্য শব্দে আনন্দকে নিয়ে মেতে
উঠলেন। পেটের কাছে নাক ঘষে, দাদিমা আনন্দকে উপরে তুলে ধরলেন। আর আনন্দ
পরমানন্দে উদ্বেলিত হয়ে, দাদিমার খোলা মুখের ভিতর কল ছেড়ে দিলেন। ঘটনার
আকস্মিকতায় দাদিমা এবং আনন্দের মা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর এদের হাসির
পালা। মুত্রপানে এবং মুত্রস্নানে অভিষিক্ত দাদিমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
পরমানন্দেই তা স্মরণ করতেন এবং অন্যের কাছে বলতেন সে আনন্দের স্বাদ বারবার
নিতেন।
পরিকল্পিত অস্বাভাবিক সৃজনশীল আনন্দ:
অনেক সময় রসিক জন পরিকল্পিতভাবে আনন্দ দেওয়ার জন্য বিষয়ের বিপর্যয় ঘটান।
এবং এর ফলে বাক্যের দ্বারা বা ঘটনার দ্বারা আনন্দের সৃষ্টি করেন। যাদুকরের
খেলাগুলো দেখে যা আনন্দ পাওয়া যায়, তা একটি অস্বাভাবিক ঘটনার সূত্রে ঘটে চলে
বলে আনন্দ পাওয়া যায়। এই জাতীয় আনন্দের ভিতরে উচ্ছ্বাস কম। কারণ বিস্ময়ের তীব্র
অনুভূতি, বিমোহিত করে রাখে। এই বিমোহনই আনন্দের জন্ম দেয়। কখনো আনন্দ পাওয়ার
জন্য সত্যকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে আনন্দ তৈরি করা হয়। স্বাভাবিক
আটপৌরে ভাষায় কথা বলে বা শুনে সাধারণ মানুষ অভ্যস্থ। কিন্তু এমন কিছু মানুষ
আছেন, যাঁরা কথা বলার ভঙ্গী এবং শব্দ নির্বাচনের ভিতর দিয়ে এমনভাবে তাঁর
বক্তব্য তুলে ধরেন যে, সেটা একটা শিল্পে পরিণত হয়। এদের সাধারণ বক্তৃতাও
শ্রোতাকে নির্মল আনন্দ দান করে। লিখিত সাহিত্য সৈয়দ মূজতবা আলী, শিবরাম
চক্রবর্তীর মতো কিছু লেখক এই জাতীয় রচনায় নমস্য হয়ে রয়েছেন আজও।
কেউ কেউ আবার আনন্দ দেওয়ার জন্যই মজাদার গল্প তৈরি করে মুখে মুখে বলেন।
যা বানানো কিন্তু আনন্দদায়ক। এই জাতীয় গল্পগুলো সাধারণ চুটিক নামে পরিচিত।
সবাই যে চুটিক শুনে আনন্দ পায় না, সেটাই অনেক সময় আনন্দের ব্যাপার হয়ে উঠে।
একটি ঘরোয়া আসরে একজন 'তেলাপোকা' কানে শোনার ক্ষমতা নিয়ে একটি চুটিক বলছেন।
চুটকিটা হলো- একবার এক গবেষক একটি তেলাপোকা ধরে এনে, তাঁর গবেষণার টেবিল বসলেন।
প্রথমেই তিনি তেলাপোকাটিকে ছেড়ে দিয়ে বললেন−
যা। তেলাপোকা পালানোর চেষ্টা করলে, গবেষক আবার সেটাকে ধরে এর একটি পা কেটে ফেলে
বললেন−
যা। তেলাপোকা এবার তার অবশিষ্ট পায়ের সাহায্যে পালানোর চেষ্টা করলো। গবেষক আবার
ধরে এনে তার দ্বিতীয় পা কেটে ফেললেন। এইভাবে প্রতিবার একটি করে পা কেটে গবেষক
পরীক্ষা করলেন, তার 'যা' শব্দ শোনার পর তেলাপোকা পালানোর চেষ্টা করে কিনা।
তেলাপোকার সবগুলো পা কেটে ফেলার পর, গবেষক যখন শেষবারের মতো বললেন−
যা, পদহীন তেলাপোকা পালানোর চেষ্টার পরিবর্তে বুকের উপর ভর করে শুধু শুঁড় নাড়তে
লাগলো। গবেষক এবার খাতায় লিখলেন, 'তেলাপোকার সবগুলি পা কাটিয়া ফেলিলে, তেলাপোকা
কানে শোনে না'। চুটকির সমাপ্তি ঘটে একটি মোক্ষম বাক্যে, যা শুনে শ্রোতারা হাসতে
থাকে। এই আসরে সবাই যখন মোক্ষমবাক্যটি শোনার পর হাসছে, তখন আসরের একজন গম্ভীর
মুখে প্রশ্ন করলো−
এরপর তেলেপোকাটির কি হলো?
কখনো কখনো সৃজনশীল আনন্দের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় তীব্র সাবলাইম উপাদান।
সার্কাসে প্রদর্শিত সিংহের মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দেওয়া, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে
যাওয়ার মতো খেলায় ভয়ঙ্কর অনুভূতির সাথে সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটে এবং তা দর্শকদের
বিমোহিত করে রাখে। সার্কাসের প্রায় সকল খেলাই কোনো না কোনো অস্বাভাবিকতাকে
পরিকল্পিতভাবে উপস্থাপন করা হয়।
স্বাভাবিক ও বিকৃত আনন্দ: মানুষের সহজাত
প্রবৃত্তির ভিতরে রয়েছে স্বাভবিক আনন্দ ও বিকৃত আনন্দ।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচারে যে আনন্দের উদ্ভব হয়, তাই হলো
শুদ্ধ আনন্দ, তার বাইরে সবই বিকৃত আনন্দ।
স্বাভাবিক আনন্দ: মানুষ সমাজবদ্ধ অবস্থায়
আসার ক্রমবিবর্তনের ধারায় কিছু আচরণকে মান্য করা শিখেছে। কালক্রমে মানুষের মনে
সেগুলো স্থায়ী আসন নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের ভিতরে কিছু মূল্যবোধের জন্ম
নিয়েছে। এই মূল্যবোধ থেকেই জন্ম নিয়েছে মানবিক বোধের। যেমন- শিশুর প্রতি সদয়
ব্যবহার। অসুস্থ বা অসহায় ব্যক্তির জন্য সেবা, এসবই মানবিক মূল্যবোধের আওতায়
বিচার করা হয়। এসকল আচরণের ভিতর দিয়ে মানুষ যে আনন্দ লাভ করে,
সেটা স্বাভাবিক এবং শুদ্ধ আনন্দ
হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিকৃত আন্দন্দ: অবশ্যই সমাজভেদে
স্বাভাবিক আনন্দের হেরফের ঘটে থাকে। কিন্তু
এমন কিছু আনন্দ আছে, যা স্বাভাবিক আনন্দের বিপরীত দশায় থাকে। যেমন-
ধর্ষকাম: অন্যকে দুঃখ দিয়ে
আনন্দ লাভ করার প্রবণতা। সমাজের কিছু মানুষ এই বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। কৈশোরে
অনেকে কুকুর বা অন্য প্রাণীকে আঘাত করে আনন্দ পায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ
প্রাপ্তমনষ্ক হয়ে উঠার সাথে সাথে বিকৃত আনন্দ দূর করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অনেকে
তা পারে না। সমাজে অনেকেই আছে, যারা জানেন না তাদের ভিতরে বিকৃত আনন্দ উপভোগ
করার প্রবণতা আছে। রাগে বা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে অনেকে আঘাত করে। এই জাতীয়
কার্যকলাপের পর, প্রায় সকলেরই মনে অনুশোচনা জাগে। কিন্তু কারো কারো ভিতরে তা
জাগে না। বরং অন্যের উপর অত্যাচার করেছে, এই অনুভব আনন্দময় মনে হয়। এই জাতীয়
লোকের ভিতরে বিকৃত আনন্দ যৎসামান্য হলেও সক্রিয় থাকে। বাড়ির কাজের লোককে শাসন
করতে গিয়ে যখন কেউ গরম খুন্তি দিয়ে সেঁক দেয়, তখন তা ক্রোধের ভিতর দিয়ে
অত্যাচার করার আনন্দ এবং সেই সাথে মানসিক শান্তি পায়। এই শান্তি বা আনন্দ বিকৃত
মনের বিকৃত আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
আত্মপীড়ন:
কখনো কখনো
মানুষ নিজেকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। এই ধরণের আনন্দ লাভের প্রবণতা মানুষকে ধীরে
ধীরে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এই বিকৃত আনন্দের একটি বিশেষ রূপ হলো- বিকৃত আনন্দের
একটি বিশেষ রূপ হলো দুঃখ-বিলাস।
মানুষ অনেক সময় কল্পলোকে দুঃখের জগত তৈরি করে। এরপর সেই জগতে বসে সে নিজের তৈরি
দুঃখবোধে বিলাপ করে। এর গভীর স্তরে কোনো কোনো মানুষ কাঁদে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে,
হা হুতাশ করে। দুঃখ-বিলাসীরা এই আনন্দের খেলা খেলেন নিজের সাথে। দুঃখ পাবেন
বলেই তাঁদের এই খেলা। এতে করে সাময়িকভাবে শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে। তবে
শিল্প-জগতে সৃজনশীল মানুষ কখনো কখনো দুঃখবিলাসের আশ্রয় নেন। বিশেষ করে গল্প
লেখকরা যদি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের বা পরিবেশের দুঃখকে গভীরভাবে ধারণ করতে পারেন,
কিম্বা তাহলে তা যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। একে আমরা সৃজনশীল
দুঃখবিলাস বলতে পারি।
মিশ্রপ্রাপ্তির আনন্দ: একাধিক মিশ্র আনন্দের
সূত্রে সৃষ্টি হয় এই আনন্দ। মূলত এই জাতীয় আনন্দের সৃষ্টি হয়, প্রত্যাশিত ও
অপ্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষার সূত্রে। এই জাতীয় আন্দের প্রকৃতি দুটি ভাগে ভাগ করা
যায়। এর একটি হলো প্রত্যাশিত মিশ্র আনন্দ, অপরটি অপ্রত্যশিত
মিশ্র আনন্দ।
প্রত্যাশিত মিশ্র আনন্দ:
এমন কিছু ঘটনা থাকে, মানুষ বেদনা আছে জেনেও
আনন্দ পাওয়ার জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মাতৃত্বের
আকাঙ্ক্ষা। গর্ভধারণ এবং সন্তানের জন্মদানের বেদনা নারী মাত্রেই জানেন। তারপরেও
মা হয়ে ওঠার জন্য তার ভিতরে তীব্র আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। বন্ধ্যা নারীর
বেদনা নারীসত্তার গভীরতলে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে চলে। যিনি মা হন, তাঁর কাছে
গর্ভকালীন শারীরিক অস্বস্তি এবং প্রসবকালীন যন্ত্রণা স্মৃতির অংশ হয়ে থাকে
মাত্র, সুস্থ সন্তানের জন্মদানে মায়ের আনন্দ প্রশান্তির জন্ম দেয়। নারী মাত্রেই
মা হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় গর্ভকালীন শারীরিক অস্বস্তিকেই অতিক্রম করে
আনন্দ-সাগরে ভাসে। দেখা যায়, পেটের ভিতরে শিশুর নড়চড়াকে গভীর আনন্দে
গর্ভবতী অনুভব করে থাকে।
অপ্রত্যাশিত মিশ্র আনন্দ: এমন কিছু ঘটনা থাকে যা মানুষ চায় না। ঘটনাটি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে বা কখনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হয়। কিন্তু সবশেষে ঘটনাটি যদি তার অনুকুলে আসে, তাহলে তা প্রশান্তির জন্ম দেয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলার মানুষ রাষ্ট্রীয় জীবনে তার ন্যায্য অধিকার চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা অন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য হত্যা-ধর্ষণ, লুটতরাজ চালিয়েছে প্রায় নয় মাস ধরে। সেসময়ে এই ঘটনায় বাংলার মানুষ যে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, তা ছিল সম্পূর্ণই অপ্রত্যাশিত। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ যে পরমানন্দ লাভ করেছিল। সেই আনন্দই স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে প্রশান্তির জন্ম দিয়েছে।
আনন্দাবেগ থেকে সৃষ্ট প্রক্ষোভ
মনে আনন্দের সঞ্চার হলে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানাভাবে। কেউ আনন্দে হাসে, কেউ চোখের জল ফেলে। কেউ চিৎকার আনন্দকে সবাইকে জানিয়ে দেয়। কোনো কোনো আনন্দ থাকে নিজের জন্য, এই আনন্দে আত্মতৃপ্তি থাকে এবং তা নিজের ভিতরে অনুভব করে। মানুষের মনে হতে পারে শারীরীক ও মানসিকভাবে।
শারীরিক আনন্দ ও প্রক্ষোভ: শরীরের
অস্বস্তি বোধ থেকে জন্ম নেয় স্বস্তি বোধের তাগিদ। এর ফলে সৃষ্ট হয় শারীরীক
চাহিদা। যেমন ক্ষুধা নামক অনুভূতি জন্ম দেয় অস্বস্তিবোধের। এই অস্বস্তিবোধের
কারণে খাদ্যগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের ভিতর দিয়ে সৃষ্টি
হয় আনন্দের। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে যে সকল চাহিদা নিয়মিতভাবে ঘটতে
থাকে, তাতে প্রক্ষোভটা ততটা তীব্রভাবে প্রকাশ পায় না। কিন্তু শারীরীক চাহিদার
কারণে সৃষ্ট অস্বস্তি যখন তীব্র হয়ে উঠে, তখন আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে প্রক্ষোভ
তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। যেমন সামান্য পিপাসায়, জল পানে যে আনন্দ লাভ হয়, তীব্র
জল পিপাসায় আনন্দ লাভ হয়, অনেক বেশি। অনেক সময় তীব্র পিপাসা পাওয়ার পর জল পান
করে, তৃপ্তি আহঃ ধ্বনি করি। অনেক সময় প্রক্ষোভটা বাইরে প্রকাশ না করলেও আনন্দের
প্রক্ষোভটা সংর্বাঙ্গে মধুর আমেজে ছড়িয়ে পড়ে। এরূপ আনন্দলাভের সূত্র হতে পারে
কঠোর পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম। হতে পারে যৌনানন্দের সময় তীব্র শীৎকার।
আনন্দের প্রবল প্রক্ষোভ হলো উচ্ছ্বাস (elation)।
প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়া, চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করা, যৌনাচারে শীৎকার করা,
এসবই প্রক্ষোভের উচ্ছাস।
মানসিক আনন্দ ও
প্রক্ষোভ: আনন্দ লাভের বিষয়টিই মনোজগতের। কিন্তু কিছু কিছু আনন্দ আছে যার
উৎপত্তিস্থল শরীর নয়। একটি সুন্দর গান শোনার ভিতর দিয়ে যে আনন্দলাভ হয়, তার
উৎপত্তিস্থল নিজের শরীর নয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত অনুভূতি মনের ভিতরে আনন্দের
সঞ্চার করে। এর ফলে প্রক্ষোভের জন্ম হয়। এই কারণে মানুষ চুটকি শুনে আনন্দ পায়
এবং হাসে। খেলাতে নিজ দলের জয়ে চিৎকার করে, রং ছিটায় এসব প্রক্ষোভের তীব্রতর
রূপ। এগুলো উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে অন্যকে জানান দেয়।
মানুষ সামাজিক জীব শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশের জন্য।
সেকারণে নিজের সাফল্যের কথা অন্যকে জানাতে চায়। টেলিফোন করে বন্ধুকে বলে, অমুক
চ্যানেলে ওই সময়ে আমার গান আছে শুনিস। তাই উচ্ছ্বাসটা শুধু নিজের জন্য নয়,
অন্যকে জানান দেওয়ার জন্যও।
সমাজের কোনো কোনো মানুষের ভিতর বিকৃত আনন্দ লাভের মানসিকতা থাকে। এর ভিতর দিয়ে
প্রকাশ পায় বিকৃত প্রক্ষোভ।
আনন্দের উত্তোরণ:
যেকোনো আনন্দই হলো একটি স্বস্তিদশা থেকে উচ্চতর স্বস্তিবোধে উত্তোরণের
প্রক্রিয়া। সকল আনন্দেরই রয়েছে একটি উত্তোরণ রেখা। একটি পর্যায়ে এসে উত্তোরণ থেমে
যায়। জীবনের ছোটখাটো আনন্দ দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। অনেকক্ষণ বাসস্ট্যান্ডে
দাঁড়িয়ে থাকার পর কাঙ্ক্ষিত বাস পেয়ে গেলে আনন্দ দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু
কিছু আনন্দ আছে যা দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছালে আনন্দের অপূর্ণতার সৃষ্টি হয়। এই বিশেষ
ধরণের আনন্দ পেতে হয় পর্যায়ক্রমে বা পর্যাক্রমেই আনন্দের সঞ্চারঘটে। এই জাতীয়
আনন্দকে বলা হয়, সঞ্চারমান বা পর্যায়ক্রমিক আনন্দ। যেমন খেয়াল গান শোনার আনন্দ ঘটে
পর্যায়ক্রমে। চট্জলতি শেষ করলে, খেয়ালগান শোনার আনন্দই নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের
যৌনমিলনও এই পর্যায়ের আনন্দ। এই জাতীয় আনন্দ প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ের এই আনন্দ মনে আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। এই আকাঙ্ক্ষা পূরেণের ভিতর
দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের আনন্দের জন্ম হয়। এই আকাঙ্ক্ষাই পর্যাক্রমে পূর্ণ
আনন্দ-পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।
প্রকৃতি ও আনন্দ
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। কেন মানুষ ঈশ্বরে সৃষ্টি না বলে প্রকৃতির সন্তান বলা হলো, এ নিয়ে মৌলবাদী চিৎকার উঠতেই পারে। এই চিৎকারে আবেগ থাকে, অন্ধবিশ্বাস থাকে কিন্তু যুক্তিটা থাকে না বা যুক্তি মানার মানসিকতা থাকে না। মৌলবাদীরা এই জাতীয় চিৎকারে নিজেদের বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। আস্তিকতাবাদে ঈশ্বর সবকিছুর স্রষ্টা। তাই প্রকৃতিও ঈশ্বরের সৃষ্টি। একই ভাবে মানুষও প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির সন্তান বলেই মানুষকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। টিকে থাকার সংগ্রামে মানুষ জয়ী বলেই, মানুষের প্রথম আনন্দ লাভ করে বেঁচে থাকার মধ্যে। এবার মানবতাবাদীরা প্রশ্ন তুলবেন বলবেন, শুধু কি বেঁচে থাকাটাই আনন্দ? একটি পর্যায়ে বেঁচে থাকাটাই আনন্দ। এই আনন্দের সূচনা হয়েছিল জীবজগতের আদিম সদস্যের সৃষ্টি লগ্ন থেকে। এখনও আছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের একটি কথা বলি। পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনা জেলার সুজানগর সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিরীহ ৩০০ শতাধিক পুরুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় স্কুল মাঠে হত্যা করে। এই সময় দু'চারজন মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পরও বেঁচে যায়। এই বেঁচে যাওয়া মানুষ এবং তাদের পরিবারের কাছে বেঁচে যাওয়াটাই আনন্দের ছিল।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো
মানবিক মৌলিক উপকরণ সংগ্রহ এবং এগুলোর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষ নানা ধরনের আনন্দ
পায়। বেঁচে থাকার আনন্দের প্রাথমিক ধাপের পরে প্রকৃতির প্রজাতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা
হয়ে যায় বটে, কিন্তু প্রজাতির বিলুপ্তিকে রক্ষা করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন প্রজনন।
জীবজগতের প্রজাতিভেদ প্রজননের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। এ সকল প্রজাতির একটি অংশ,
স্ত্রী-পুরুষ সত্তার দৈহিকমিলনে প্রজননের প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। এখানে প্রকৃতি
কৌশলী। প্রকৃতি প্রজাতির ভিতরে যৌনানন্দের আকাঙ্ক্ষা দিয়েছে। এই আনন্দ লাভের জন্য
প্রজাতি যৌনকর্ম করে। এর ফলে শিশুর জন্ম হয় এবং প্রজাতি প্রকৃতিতে টিকে থাকে।
এখানেও মূল লক্ষ্য টিকে থাকার। জীবজগতের সদস্য হিসাবে মানুষের প্রজনন প্রক্রিয়াও
প্রকৃতির অংশ। খাওয়ার আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষ দেহ টিকেয়ে রাখে, আর যৌনকর্মের ভিতর
দিয়ে প্রজাতি টিকে থাকে। মানুষ অন্যান্য মানবেতর প্রাণীদের চেয়ে চৈতন্যের বিচারে
উন্নত। তাই মানুষ শুধুই পশুর মতো যে কোনোভাবে যৌনকামনা চরিতার্থ করার ভিতর সার্বিক
আনন্দ পায় না। অবশ্য কোনো কোনো মানুষ ধর্ষণ করে। এর ভিতর দিয়ে তার মানবেতর
পশুচরিত্রের প্রকাশ পায়। ধর্ষণের প্রক্রিয়াটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ কর্ম নয়, কিন্তু
মনুষ্য প্রজাতির জন্য শোভন নয়, কাম্যও নয়।
প্রকৃতি ও যৌনানন্দ: মানুষ একলিঙ্গিক। প্রজাতি রক্ষা করার জন্য, মানুষের প্রধান ধারায় রয়েছে নারী ও পুরুষ। এর বাইরে অপ্রধান ধারায় রয়েছে নপুংশক। প্রধান ধারার মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষের ভিতরে রয়েছে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যার দ্বারা নারী-পুরুষ পরস্পরের সাথে দৈহিকভাবে মিলিত হতে পারে। জন্মসূত্রে দৈহিক এই বৈশিষ্ট্যের ব্যবস্থা অনুসারে উভয়ের ভিতরে মনোগত প্রকৃতিও তৈরি হয়ে যায়। নারীপুরুষের মনোগত এবং দেহগত বৈপরীত্য থাকলেও মনোগত আকাঙ্ক্ষা থাকে পরস্পরমুখী। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের কারণে নারী-পুরুষের মনে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে এবং এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রক্রিয়া আনন্দের উদ্ভব হয়। এই আনন্দটা যৌনকর্মে অংশগ্রহণকারী নারীপুরুষের। এর ভিতর দিয়ে প্রজাতি সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি প্রকৃতি করে নেয়। সন্তানের প্রতি স্নেহের সঞ্চারে মধ্য দিয়ে প্রকৃতি প্রজাতি সংরক্ষণের অপর একটি বড় অংশ সম্পন্ন করে।
যৌনানন্দের প্রাথমিক আবেদন সৃষ্টি হয়, দর্শন, শ্রবণ ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে। বিপরীত লিঙ্গের দর্শনের ভিতর দিয়ে প্রাথমিকভাবে মোহের সৃষ্টি হয়। মূলত স্বাভাবিক দেখার স্বস্তিবোধকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত হওয়ার সূত্র মন আবেশিত হয় এবং মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। বিপরীতলিঙ্গের কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ এই মোহের বিস্তার ঘটে। ফলে আনন্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। পুরুষোচিত দৈহিক গড়নের বলিষ্ঠতা, উচ্চতা, কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ নারীর মনে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করে। একই ভাবে নারীর মুখশ্রী, গাত্রবর্ণ, বক্ষসৌন্দর্য, কোমর, নিতম্ব, কণ্ঠস্বর, অঙ্গসৌরভ পুরুষের মনে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। এই আকাঙ্ক্ষার সূত্রে প্রাথমিকভাবে নারী-পুরুষ পরস্পরের অঙ্গ স্পর্শ করে। প্রাথমিকভাবে হাতের স্পর্শ বা আলিঙ্গনের মতো ঘটনা ঘটে। এইভাবে পরস্পরকে দৈহিকভাবে পাওয়ার আনন্দের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক এই আনন্দের ভিতর দিয়ে পরস্পরকে আরও গভীরভাবে দৈহিকভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। যৌনকামনা জাগ্রত হয়। এই আকাঙ্ক্ষা দ্বারা তাড়িত হয়ে, আলিঙ্গন, মুখচুম্বন, হাতের দ্বারা পরস্পরে দেহে হস্তসঞ্চালন, আলিঙ্গন, অঙ্গসৌরভের অনুভব যৌনকামনার দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছায়। পুরুষের স্পর্শে নারী আবেশিত হয়ে নিজের দেহের অধিকার পুরুষের হাতে তুলে দেয়। এই পর্যায়ে পুরুষ নারীদের বিভিন্ন স্থানে হাতের সঞ্চালন এবং চুম্বন করে। বিশেষ করে স্তন, নিতম্ব এবং যোনিসংলগ্ন স্থানে স্পর্শ করে। এরই ভিতর দিয়ে পুরুষাঙ্গ দৃঢ়তর হয়ে উঠে, নারী স্তনবৃন্ত দৃঢ়তর হয় এবং যোনির ভিতরে রসের সঞ্চার ঘটে। পুরুষের আগ্রাসন এবং নারীর সমর্পণের ভিতর দিয়ে যোনিতে শিশ্নের অনুপ্রবেশ ঘটে। নারীর পুরুষের রতিস্খলেনর ভিতর দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। একটি পর্যায়ক্রমিক আনন্দের ভিতর দিয়ে একটি সময় পর্যন্ত নারীপুরুষ অতিবাহিত করে। এরপর পুরো বিষয়টি স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। এই স্মৃতিতে আনন্দের স্মৃতিময় অনুভব থাকে আর থাকে পরস্পরকে পাওয়ার প্রশান্তি।
মানুষের আকাঙ্ক্ষিত আবেগ আনন্দ। কিন্তু সবচেয়ে স্পর্শকাতর আবেগ বেদনা। অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই বেদনা মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাই প্রতিদিনের আনন্দ-সংবাদ যতটা স্মৃতিতে ধরা থাকে, তার চেয়ে বেশি ধরা থাকে ছোটো ছোটো বেদনাগুলো। সবচেয়ে মধুর সঙ্গীত বেদনার, সবচেয়ে আবগে তাড়িত কাহিনি বিরহের কিম্বা বিচ্ছেদের। বেদনাকে সহ্য করতে পারে না, বলেই আনন্দাশ্রু কেউ মুছিয়ে দেয়না সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে। কিন্তু বেদনার অশ্রু যে মুছিয়ে দেয় এবং সে নিজেও অশ্রুপাত করে।