১.৯
চেতনা ও
রূপ
আমি'র চেতনায় আছে জগৎ সংসার। তাই 'আমি' আছে বলেই জগৎ আছে। 'আমি'র চেতনার ভিতরে আছে জগতের রূপ। এই বিপুল বিশ্বচরাচর জুড়ে এত আয়োজন। 'আমি' আছে বলেই জগৎ সৃষ্টি সার্থক। বিষয়টি প্রতিটি মানুষের বোধের বিচারে সত্য। কিন্তু চরম সত্য নয়। কোনো মানুষের মৃত্যুর অর্থ যদি হয়, আত্মার বিনাশ। অর্থাৎ একটা চেতনার বিনাশ। সেই মানুষটির বিচারে, সে নাই তো জগৎ নাই। কিন্তু জগৎ থেকে যায় অন্যের চেতনায়। একজন জীবিত মানুষ অন্য একজন মানুষের মৃত্যুর পরও জগতের অস্তিত্ব খুঁজে পায় তার নিজের চেতনার ভিতর দিয়ে।
প্রতিটি মানুষ এই জগৎকে যে চেতনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধি করে, সেটা তার একান্তই নিজস্ব উপলব্ধি। প্রতিটি মানুষের ভিতরে জগতের যে রূপ অবস্থান করে তা এক রকম নয়। ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার বিচারে এবং উপলব্ধি করার প্রক্রিয়ার ভিতরে জগতের রূপ নানাভাবে প্রকাশ পায়। একজন আদর্শ দৃষ্টি শক্তির অধিকারীর কাছে জগতের রূপ একরকম, জন্মান্ধের কাছে অন্যরকম। এরূপ পঞ্চেন্দ্রিয়ের গুণাগুণের বিচারে একই জগতের সকল মানুষের কাছে জগতের রূপ একরকম হয় না। এমন কি পাশাপাশি দুটি মানুষের কাছে জগতের রূপ একরকম হয় না। কিছু সাধারণ উপলব্ধির বিচারে সকল মানুষ কিছুটা একই রকম অনুভব করে। কিন্তু সেটা হলো সকলের অনুভবের গড় মান। কিন্তু বিশেষ মানের বিচারে প্রতিটি মানুষের জগৎ পৃথক।
প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যা অন্যান্য সত্তা থেকে ওই সত্তাকে পৃথকভাবে
উপস্থাপন করে। সত্তার এই বিশেষ গুণই হলো তার নিজস্ব রূপ।
এই
রূপ
প্রতিটি 'আমি'র
কাছে তার
অনুভবের একক বা সংমিশ্রিত একটি বিমূর্ত
ধারণা। এবং এই ধারণা
প্রতিটি 'আমি'র কাছে
চেতনার সৃষ্টি করে এবং
তার
চেতনাতেই অবস্থান করে।
প্রতিটি
মানুষ যে 'আমিত্ব' নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, শৈশব থেকেই সে 'আমিত্ব' নানা ধরনের
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির দ্বারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠে। নানা রকমের অনুভূতির সংমিশ্রণে
ক্রমান্বয়ে মিশ্র অনুভূতির জন্ম হয়, এই অনুভূতি জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং চেতনার মধ্য
দিয়ে একটি বিমূর্ত অনুভবের সৃষ্টি করে। এই অনুভবের
ভিতরে
রূপ
প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
এইভাবে যত ধরনের রূপ, আমাদের
মনোলোকে সৃষ্টি হয় এবং তা মনোলোকেই রয়ে যায়। এই রূপের স্বরূপ বিবেচনা করলে
৪টি বিষয় প্রাধান্য পায়। এগুলো হলো−
১. সত্তার রূপবৈচিত্র্য: চারপাশের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল সত্তাই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজ করে। এটি হলো সত্তার রূপধর্ম। এই রূপ এককভাবে বা অন্য রূপের সমন্বয়ে প্রকাশিত হতে পারে। যেমন একখণ্ড লোহা, এর নিজস্ব ধর্ম-রূপ আছে। লোহা দিয়ে তৈরি হয় দা। এতে থাকে লোহার রূপ এবং দা-এর রূপ। আকার অনুসারে দা আবার নানা ধরনের হয়। প্রতিটি সত্তা যতধরমের রূপ পরিগ্রহ করে, তার সামাগ্রিক অবস্থাই হলো তার রূপবৈচিত্র্য।
২. আমি'র রূপ বিচার: একটি সত্তার কী রূপ, তা অনুভব করে 'আমি' নামক সত্তা। এক্ষেত্রে 'আমি'র অনুভবটাই মূখ্য। স্বাভাবিক দেখার ক্ষমতা আছে এমন লোকের কাছে আগুনের রূপটা, আগুনের একটি বিশিষ্ট ধর্মকে প্রকাশ করবে। অন্ধজনের কাছে এ রূপের কোনো মূল্য নেই। এখানে আগুনের পূর্ণরূপ ধ্রুব। কিন্তু নানা আমির বিচারে ধ্রুব নয়। এমন কি একজন আদর্শ ইন্দ্রিয়ক্ষমতাধারী মানুষের বিচারে কোনো সত্তার প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে না। মূলত মানুষ ইন্দ্রিয় দ্বারা যা অনুভব করে, তার বাইরের সকল রূপই অতীন্দ্রিয়। কোনো অগ্নিকুণ্ড থেকে যদি অতি-বেগুনি-রশ্মি নির্গত হয়, তাহলে মানুষ তা দেখতে পায় না। এই কারণে আমরা বস্তু জগতের যা দেখি সেটাই সব দেখা নয়। মানুষের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার বিচারে, কোনো সত্তারই পূর্ণ রূপ দেখা হয়ে উঠে না। পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ যা অনুভব করে এবং যা অনুভব করতে পারে না, তার সম্মিলিত মানই হবে সত্তার প্রকৃত রূপ্।
৩. আমি'র অভিজ্ঞতা: মানুষের রূপগত ধারণা হলো তার ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধির সামগ্রিক বিচার। মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপগত ধারণা জন্মলগ্নে খুব একটা বেশি থাকে না। মাতৃগর্ভের স্মৃতি মানুষ স্মরণ করতে পারে না। তাই সে সেখানকার কোনো ধরনের রূপকেই অনুভবের ভিতরে আনতে পারে না। এখানে মস্তিষ্কের পূর্ণবিকাশের বিষয়টা জড়িত থাকে। মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে ধরে রাখার মতো মস্তিষ্ক ক্ষমতা অর্জন করে না বলে, মানব শিশুর অনুভব চিরতরে হারিয়ে যায়।
জন্মের পর থেকে মানবশিশু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে। এরপর সকল অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে মনের ভিতর মিশ্র অনুভব সঞ্চিত হতে থাকে। আর এই অনুভূতির মধ্য দিয়ে নানা ধরনের রূপের জন্ম হয়। ধরা যাক, একটি শিশু মোমবাতির আলো প্রথম দেখছে। তার কাছে আলো দেখার একটি অনুভব তৈরি হবে। এই আলোকশিখার একটি দৈহিক আকার আছে এবং আলোটা স্থির না থেকে কাঁপছে। এই তিনটি অনুভূতি মিলিত হয়ে, তার মনের ভিতর একটি মিশ্র অনুভবের সৃষ্টি হবে। এই মিশ্র অনুভবের সূত্রে শিশুর মনে একটি উপলব্ধি ঘটবে। এই উপলব্ধি স্মৃতিতে থাকবে জ্ঞান হিসেবে। এই জাতীয় জ্ঞান থেকে সৃষ্টি হবে একটি ভিন্নতর মৌলিক অনুভব। এই অনুভবই প্রদান করবে মৌলিক রূপ।
৪. আমি'র সততা: 'আমি' তার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সত্তার যে রূপকে চিনতে শেখে, তার সাথে অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে তুলনা করে একটি সত্যে উপনীত হতে চায়। 'আমি' যেসকল মৌলিকরূপকে অনুভবে রাখে, তার মধ্য দিয়ে সে একটি সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। ধরা যাক, দূরের মাঠে একটি গরু এবং একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এমন একজন দর্শক যার স্মৃতিতে আগে থেকে মানুষ এবং গরুর মৌলিক রূপটি রক্ষিত আছে। তার কাছে রূপের একটি অবয়বগত মান হিসেবে গরু ও মানুষ উপস্থাপিত হবে। দর্শক মাঠের দুটি প্রাণীর মৌলিক রূপের পার্থক্য অনুসারে গরু এবং মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারবে। এখানে দর্শক হিসেবে যে মানুষটি দেখছে, তার ভিতরের 'আমি' এই মানুষ এবং গরুর পার্থক্য নিরুপণের জন্য মনোজগতে তুলনামূলক বিচারের মধ্য দিয়ে একটি সত্যে উপনীত হবে। প্রাথমিকভাবে এই সত্যের প্রধান রূপটিই প্রাধান্য পাবে। যেমন এক্ষেত্রে গরুর গায়ের রঙ, মানুষের উচ্চতা গায়ের রঙ ইত্যাদি প্রাধান্য পাবে না। প্রয়োজনে সে অন্যান্য উপকরণের মৌলিক রূপের দিকে নজর দেবে। 'মাঠের মানুষটি লম্বায় কতটা' যদি সেটা জানার প্রয়োজন হয়। একটি মাঠে সাদা ও কালো রঙের গরু যদি থাকে। গরুর অবয়গত রূপটি হবে মৌলিক রূপ। এই মৌলিক রূপ ধরে দুটি গরু চেনা যাবে। কিন্তু সাদা বা লাল রঙ, ওই দুটি গরুকে সুনির্দিষ্ট করবে। যদি গরু দুটি মৃত হয়। তাহলে জীবিত গরু দুটোর জীবিত থাকার বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনা করে মৃত গরুকে শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে গরুর মৌলিক অবয়বগত রূপই প্রাধান্য পাবে। এখানে আমি'র সততা নির্ভর করে কোনো সত্তা সম্পর্কে সে কতটুকু জানতে পেরেছে, তার উপর।
আমরা প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময়ই এমন অনেক সহায়ক উপাদানকে অগ্রাহ্য করি। পান করার জন্য এক গ্লাস পানি যদি আপনার প্রয়োজন হয়, আপনি কলস থেকে গড়িয়ে নিয়ে খেতে পারেন। খাওয়ার উপযোগী পানির সাধারণ পরিচয়ে আপনি যে সত্যটা উপলব্ধি করবেন, একজন রসায়ন বিজ্ঞানীর কাছে পানির সত্যটা হবে আরো ব্যাপক।
চেতনায় রূপের
ক্রমবিকাশ:
যে কোনো 'আমি'র ক্রমবিকাশ শুরু হয়, তার ভ্রূণ দশা থেকে। ভ্রূণ দশায় মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গরূপ
থাকে না বলে, আমি'র কোনো অনুভব স্থায়ী রূপ পায় না। আবার যেদিন থেকে থেকে মস্তিষ্ক
রূপ নির্ধারণের উপযোগী হয়ে উঠে, তখন থেকে সকল অনুভব যে স্থায়ী রূপ পায় তাও না। ভুল
ভাঙার খেলায় চলে রূপের ভাঙা গড়ার খেলা। শৈশবের দৈত্য-দানব, রাক্ষস-খোক্কশের যে রূপ
শিশুর মনে ধরা থাকে, বড় হয়ে তার একটা রূপ মনে থেকে থাকে, কিন্তু সত্যের বিচারে তার
অবস্থান হয় কল্পজগতে।
জন্মের পর পরই শিশুর কাছে মায়ের সামগ্রিক রূপ থাকে না। সে
মায়ের কণ্ঠস্বর শোনে, এটি তার কাছে কণ্ঠস্বরের একটি মৌলিক রূপ হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
যার দ্বারা সে অন্যান্য নারীকণ্ঠ থেকে মায়ের কণ্ঠকে পৃথক করতে পারবে। মায়ের নাক,
মুখ, চোখ, হাসি ইত্যাদি ছোটো ছোটো দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে শিশুর মনে তৈরি হবে একটি
মূর্তিমতী রূপ। এর সাথে যুক্ত হবে মায়ের স্নেহ-মমতা, স্পর্শ, অঙ্গসৌরভ, স্নেহ,
তিরস্কার, রাগ ইত্যাদি। এরূপ অজস্র
রূপের ভিতর দিয়ে মা ও শিশুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। যেকোনো মানুষকে তার মায়ের রূপ বর্ণনা
করতে বললে, সে অজস্র উপমা, গল্প দিয়ে তা উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু
তারপরে মনে হবে, মায়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ তার বলা হলো না। এটা শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়,
বোধ করি সকল ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে।
বহুবার শোনা গানের প্রারম্ভিক যন্ত্রসঙ্গীত শুনেই বলা যায়, কি গান শুনতে বসেছি। এটা এতটাই সোজা ব্যাপার যে, অনেকে এটাকে হয়তো অনুভবের উদাহরণ হিসেবে আনতেই রাজি হবেন না। কিন্তু রাগসঙ্গীতের ক্ষেত্রে? কোনো গায়ক যখন রাগসঙ্গীতের আসরে বসে কয়েকটি স্বর নিয়ে একটু আলাপ করেন, তখন অভিজ্ঞ শ্রোতা রাগরূপটি অনুভব করতে পারেন। এমনকি দেখা যায়, শিল্পী যে বন্দিশ পরিবেশন করবেন তা হয়তো, শ্রোতা আগে শোনে নি। কিন্তু শ্রোতার অনুভবে আছে বহু রাগের ছাঁচ। সে শিল্পীর কয়েকটি স্বর নিয়ে আলাপ শুনেই আগের ছাঁচের সাথে মিলিয়ে ঠিকই রাগ নাম উল্লেখ করতে পারবেন। তালজ্ঞান যাঁর আছে, তিন ত্রিতালের বোলবাণী ও চলন শুনেই বলে দিতে পারেন। তা সে তবলায় বাজুক আর খোলে বাজুক। তা একক বাদন হোক আর সঙ্গত হোক। মূলত এই কাজটি হয়, অনুভূতির ছাঁচে। এই ছাঁচ মূলত স্মৃতিতে থাকে একক দল গঠন করে। যে কোনো বিষয়ের শৈলী যখন কারো সামনে উপস্থিত হয়, তখন পুরো শৈলীকে সে অনুভব করে এবং স্মৃতিতে রক্ষিত ছাঁচের সাথে মিলিয়ে চেনার চেষ্টা করে।
প্রাপ্তবয়স্ক
মানুষের মনে অসংখ্য মৌলিক রূপ সঞ্চিত থাকে। তার অধিকাংশই সে স্বাভাবিক মনে করে।
এরূপ মনে হওয়ার পিছনে দুটি প্রধান কারণ থাকে। প্রথমটি হলো−
মানুষের জিন সঙ্কেতের ভিতরে রূপ
তৈরির প্রক্রিয়া থাকে। ফলে বহু অনুভব মিলে যখন কোনো রূপ তৈরি হয়, তখন
স্বাভাবিকভাবেই হয়। এর জন্য 'আমি'কে কোনো ইচ্ছা শক্তির দ্বারস্থ হতে হয় না। জিনসঙ্কেতে
থাকে মূলত কিছু অনুভবের ছাঁচ। যার দ্বারা একটি ধারণা তৈরির সুযোগ থাকে। বাস্তবে সে
যা অনুভব করে তার সাথে ওই ছাঁচের মিল ঘটিয়ে সত্যিকারের অনুভবের কাজটা হয়। পাশের
দুটি ছবি রয়েছে। ছবি দুটি যথাযথভাবে আঁকা না হলেও, একজন দর্শক অনুভব করবেন, এর একটা
ত্রিভুজ, অপরটি আয়তক্ষেত্রে। এই দুটি জ্যামিতিক কাঠামোর সাথে আগে পরিচয় থাকলে,
অনুভবটা দ্রুত ধরা পড়বে। এই অনুভবটা মনের ভিতরে মৌলিক রূপের জন্ম দেয়।
দ্বিতীয় কারণ হলো−
শৈশব থেকে মানুষ যত ধরনের
অনুভবের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠে, যত ধরনের রূপকে সে মনে ঠাঁই দেয়, তার সবগুলোর হদিস মানুষ নিজেই
স্মরণ করতে পারে না।
রূপ অনেকটা অধরা হয়ে থাকে স্মৃতিতে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে নানা ছলে রূপ ধরা দেয়।
কিন্তু ইন্দ্রিয়বাহিত অনুভূতি যখন 'আমি'র
কাছে পৌঁছায়, তখন মনের উপরিতলে যথাযথ রূপসমূহ ধরা পড়ে।
যখনই
কোনো ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতি 'আমি' অনুভব করে, তখন তার স্মৃতিতে থাকা রূপের সাথে সে
মেলাতে চায়। স্মৃতির রূপের সাথে নতুন রূপের সমন্বয় করতে গিয়ে, 'আমি' নতুন অভিজ্ঞতা
লাভ করে। তারও একটি রূপ তৈরি হয়। ধরা যাক একটি কিশোরের কাছে ডিঙি নৌকার একটি রূপ আছে। একদিন সে একটি পাল তোলা নৌকা দেখলো। সে আগের
দেখা ডিঙি নৌকার রূপের সাথে পাল তোলা নৌকার রূপকে মিলিয়ে নেবে। তারপর সেটাকেও নৌকা
হিসেবে চিনবে। একই সাথে পাল তোলা নৌকার একটি রূপের জন্ম নেবে এবং তা স্মৃতির
অন্তর্গত হবে। মূলত প্রতিটি রূপে একটি মৌলিক আদল থাকে। ওই মৌলিক আদলকে অনুসরণ করেই নতুন নতুন রূপের ভিতরেও মৌলিক রূপকে
ধরতে পারে। এক্ষেত্রে 'আমি' মিশ্র রূপের ভিতর দিয়ে একাধিক রূপকেও অনুভব করতে পারে,
আবার একই সাথে মিশ্ররূপকেও অনুভব করতে পারে।
মানুষ যে রূপকে কখনো দেখে নি, তার সংস্পর্শে এলে সে হতচকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তার কাছে নতুন রূপের প্রকৃতি অনুসারে অভিজ্ঞতার জন্ম নেয়। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই ওই রূপের দ্বারা মানুষ আনন্দ, দুঃখ বেদনা ইত্যাদির মতো অনুভবকে ধারণ করে। শিশু জ্বলন্ত মোমবাতির আলো দেখে, আলোর রূপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে। আবার ওই আলো ধরতে গিয়ে যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তার হবে, সে রূপ হবে ভিন্নতর। উভয় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তার মনের ভিতর একটি মিশ্র রূপের জন্ম নেবে। এরপর যখন সে আবার জ্বলন্ত মোমবাতি দেখবে, সে হাত বাড়িয়ে তা ধরতে যাবে না। কারণ, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে, জ্বলন্ত মোমবাতির আলোর রূপ তার জানা হয়ে গেছে। পূর্ব-অভিজ্ঞতার আলোকেই মানুষ রূপের প্রকৃতি বিচার করে। আর এই অভিজ্ঞতার দ্বারাই সে নির্বাচন করে, কোনো রূপকে সে গ্রহণ বা বর্জন করবে। এর ভিতর দিয়ে 'আমি'র ভিতরে ঔচিত্যের জন্ম নেয়।
রূপকে চেনার কাজটি মনের গভীর কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির বিচারে তা নানাভাবে হতে পারে। উপরের আলোচনা সাপেক্ষে রূপ অনুভব করার ক্ষেত্রকে দুটি পর্যায়ে ঘটে বলে অনুমান করা যায়। যেমন−
প্রথম ধাপ: ইন্দ্রিয় দ্বারা
কোনো বিশেষ অনুভূতিকে চিহ্নিতকরণ। যেমন দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা, 'আমি' মেঘকে
অনুভব করবে এবং তা চেনার চেষ্টা করবে। একইভাবে শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা কোনো
সুরকে অনুভব করবে তারপর তা চেনার চেষ্টা করবে।
মানুষের মস্তিষ্কের
বাম লিম্বিক খণ্ড (Limbic
lob) এই কাজটি করে থাকে।
এই সব অনুভব স্মৃতিতে থেকে যায়। এরূপ প্রাথমিক ধাপের
উপাদানগুলো এককভাবে একটি রূপকে ধারণ করে, আবার বৃহৎ কোনো রূপের অংশ হিসেবে
সক্রিয় হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: 'আমি' তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা দ্বারা যতগুলো সত্তার সাথে পরিচিত হয় এবং এর ভিতর দিয়ে প্রাথমিক রূপের ধারণা লাভ করে, তার অন্যান্য রূপের সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করে। এই পর্যায়ে 'আমি' যে সত্তার সাথে মেলাতে পারবে, তাকেই সেই সত্তা হিসেবেই বিবেচনা করবে। যেমন সদ্য দেখা মেঘের যে সামগ্রিক রূপ সে দেখবে, তার সাথে আগের অভিজ্ঞতার সমন্বয় করে মেঘকে মেঘই বলবে। আবার রঙ নামক একটি রূপ মস্তিষ্কে থাকে, তার সাথে মেঘের মৌলিক রূপকে মিলিয়ে সে মেঘের নানা প্রকৃতির রূপকে 'আমি' স্মৃতিতে ধরে রাখবে। এই সকল বিচারে কিছু রূপকে 'আমি' অগ্রাহ্য করবে। যেমন প্রথম দেখা মেঘের আকার এক্ষেত্রে অগ্রাহ্য হবে। বরং তার চেয়ে মেঘের ঘন বা হাল্কা রূপকে বিবেচনায় রাখবে। একইভাবে একটি সুরকে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি বলা হবে, না কোলাহল বলা হবে, তা নির্ভর করবে, স্রোতার ধ্বনিরূপের বোধ থেকে। এরূপ নানা ধরনের পূর্বরূপকে বিবেচনায় এনে, 'আমি' রূপের বিচার করে।
অনেক সময়, কোনো রূপকে 'আমি' যথাযথভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে 'আমি'র স্মৃতিতে ওই সত্তার কোনো রূপগত নিদর্শন নেই। অনেক সময় কোনো সত্তাকে চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু ঠিকঠাক চেনা যায় না। এক্ষেত্রে 'আমি' একটি সত্তার ভিতরে চেনা-অচেনা দুটি রূপই যুগপৎ কাজ করে, ফলে 'আমি' চেনা-অচেনার সংশয়ে ঘুরপাক খায়। বা স্মৃতি-বিভ্রাটের কারণে আগের অভিজ্ঞতালব্ধ রূপকে 'আমি' চিনতে পারে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির বিচারে রূপের প্রকরণে পার্থক্য সৃষ্টি করে। ইন্দ্রিয়ভেদ সংবেদনের মাধ্যমে এই রূপ গড়ে উঠে। দেখার ভিতর দিয়ে যে রূপের আদল পাওয়া যায়― শ্রবণ, আঘ্রাণ, স্পর্শন বা আস্বাদনে তার রূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। যেমন−
দর্শনেন্দ্রিয়ের রূপ: দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা 'আমি' যা কিছু দেখে, তার রূপ তৈরি হয়, তার পিছনে থাকে দুটি অভিজ্ঞতা লব্ধ রূপ। যেমন-
অবয়বগত রূপ: প্রতিটি মৌলিক রূপের
বাইরের কাঠামো দিয়ে নির্ধারিত। এই অবয়বে থাকে জ্যামিতিক মান। আমাদের চারপাশের
বহু বস্তুসত্তাকে আমরা জ্যামিতিক অবয়বগত রূপ ধরেই চিহ্নিত করে থাকি। চেয়ার, টেবিল, বল, মানুষ, গাছ ইত্যাদি। অবয়গত রূপের ক্ষেত্রে আকারের পাশাপাশি রঙ তথা
আলোর একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। 'চকচক করলেই সোনা হয় না' এই ধারণার পিছনে রঙের
একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ধারণাগত রূপ: পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে
দর্শনযোগ্য কোনো সত্তার ধারণা থেকে এই রূপের জন্ম হয়। জ্যামিতিক রূপ দিয়ে এর
বিচার হয় না। যেমন ঝড়ের ভয়ঙ্কর রূপ, পূর্ণিমার স্নিগ্ধরূপ।
এই দুটি রূপ নানাভাবে মিলেমিশে সত্তাসমূহ নতুন নতুন রপে প্রকাশিত হয়।
একখণ্ড লোহা যে আকারেই থাক, তাকে
লোহা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, এটি হলো লোহার ধারণাগত রূপ। একটি লোহার টেবিল।
একই সাথে ধারণাগত এবং অবয়গত রূপকে ধারণ করে। মেঘ চেনার ক্ষেত্রে জ্যামিতিক আকারের চেয়ে ভূ-প্রকৃতির জ্ঞান
বা ধারণা বিশেষভাবে সহায়তা করে।
বিষয়টা একটু ভিন্নভাবে দেখা যাক। ধরা
যাক একখণ্ড মেঘ আকাশে ভাসছে। এর প্রাথমিক বাহ্যিক আকার ছিল আফ্রিকার মানচিত্রের
মতো। কিছুক্ষণ পর তা পাল্টে অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্রের মতো হলো। উভয় ক্ষেত্রেই
'আমি' তাকে মেঘ হিসেবেই চিহ্নিত করবে। মেঘকে সে চিনবে বা অনুভব করবে শাশ্বত
ধারণাগত রূপ-পরিচিতির মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ওই মেঘের রঙ সাদা, ধূসর, লালচে,
ঘোলাটে ইত্যাদি যে রঙেরই হোক, 'আমি' তাকে মেঘ হিসেবেই শনাক্ত করবে। এর অর্থ হলো
'আমি' আগে থেকে মেঘ নামক সত্তার সাথে পরিচিত।
শ্রবণেন্দ্রিয়ের রূপ: ত্রিমাত্রিক
বস্তুজগতের বিচারে শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা শনাক্তকৃত সত্তা মাত্রেই বিমূর্ত।
বিমূর্ত হলো এই কারণে যে, শব্দের ওজন নেই জায়গা দখল করে না। পদার্থবিজ্ঞানে এর
পরিচয় হলো 'শক্তি'। জৈবিক বিচারে শব্দ হলো অনুভূতি মাত্র। এই অনুভূতির মাধ্যমে
শব্দ মানুষের কাছে বিশেষভাবে ধরা পড়ে। আর এর ভিতর দিয়ে মানুষের মনে শব্দের রূপ
ফুটে উঠে। ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতে শব্দ বিমূর্ত হলেও শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছে
বিমূর্ত নয়। এছাড়া শব্দের উৎস্থানের বিচারে একটি পরিমাপের রূপ রয়েছে। এই বিচারে
আমার শব্দের মান নির্ধারণ করি দূরে, কাছে, বামে, ডানে, উপরে, নিচে ইত্যাদি
অবস্থানে।
শব্দের রূপ ধরা পড়ে শব্দের ভৌতগুণ এবং মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়ের রূপবিশ্লেষণী
ক্ষমতার সমন্বয়ে। এর শুরুটা হয় শব্দ নামক শক্তির ভৌত ধর্মের ভিত্তিতে। এর মূলে
রয়েছে শব্দের কম্পাঙ্ক। তাই শব্দের মূল রূপটিও তৈরি হয় শব্দের কম্পাঙ্কের
বিচারে। শব্দজগতের সকল মৌলিক শব্দের রয়েছে নিজস্ব কম্পাঙ্ক। এই কম্পাঙ্কের
দ্বারা তৈরি হয় শব্দ তরঙ্গ। শব্দ
তরঙ্গের
তীব্রতা
(Intensity),
শব্দ-তীক্ষ্ণতা
(Pitch),
শব্দের ব্যতিচার
(Interference
of sound)
ইত্যদি মূলরূপকে ভিন্ন ভিন্ন মানে নতুন রূপের জন্ম দেয়। শব্দের
রূপপ্রকাশক এই সব বৈশিষ্ট্যের বিচারে আমরা শব্দের মোটা চিকনের রূপ উপলব্ধি করি।
একই সূত্রে নারীকণ্ঠের সাথে পুরষকণ্ঠের পার্থক্যটা বুঝা যায় উভয় কণ্ঠস্বরের একটি সামগ্রিক
তুলনামূলক রূপের বিচারে। আবার বহু নারীকণ্ঠের ভিতরে
একটি নারীর কণ্ঠস্বরকে চিনতে পারাটা হলো একটি সুনির্দিষ্ট রূপকে চিনতে পারা।
সেটাও তুলনামূলক। এর সবই উপলব্ধিতে আসে শ্রবণেন্দ্রিয়ের রূপবিশ্লেষণী ক্ষমতার
দ্বারা।
একটি শব্দের রূপ হতে পারে এক বা একাধিক কম্পাঙ্কের। মূলত মানুষ প্রতিদিন
যতধরণের শব্দের অভিজ্ঞতা পায়, তার সবই বহুকম্পাঙ্কের শব্দসমূহের মিশ্ররূপে।
গবেষণাগারে ব্যবহৃত একক কম্পাঙ্কবিশিষ্ট 'টিউনিং ফর্ক' প্রকৃতিতে নেই। তাই
মানুষ প্রাকৃতিকভাবে মিশ্রধ্বনির রূপটিকে মৌলিক রূপ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে
সহজাত প্রবৃত্তিতে। আবার একাধিক মৌলিক শব্দ যখন মিলেমিশে
এমন একটি ধ্বনি মান তৈরি করে, যা শ্রোতা একক ধ্বনি হিসেবে বিচার করে। ধ্বনির এই
রূপকে বলা হয় যৌগিক। প্রতিটি যৌগিক ধ্বনির রয়েছে নিজস্ব রূপ। এই রূপ তৈরি হয়,
যৌগিক ধ্বনির ভিত্তি ধ্বনি ও উপধ্বনির বিচারে। উল্লেখ্য, যৌগিক ধ্বনির ভিতরে
সবচেয়ে কম কম্পাঙ্কের ধ্বনিকে বলা হয় ভিত্তি ধ্বনি এবং এর চেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের
ধ্বনিগুলোকে বলা হয় উপধ্বনি। এই উপধ্বনিগুলোর সংখ্যা এবং এদের কম্পাঙ্কের কারণে
যৌগিক ধ্বনির রূপ পাল্টে যায়। এই কারণে মানুষের কণ্ঠস্বর, বেহালা, হারমোনিয়াম,
মেঘের শব্দ, নূপুরের ধ্বনি পৃথক পথক ধ্বনি রূপের জন্ম দেয়। আবার যখন একই সময়
ভিন্ন ধ্বনি পৃথকভাবে শুনতে পায়, তখন তাকে বলা হয় মিশ্র ধ্বনি। যেমন গানের আসরে
কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠস্বর, হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি একই সময় শুনিতে পায়। সময়ের
বিচারে এগুলো মিশ্র ধ্বনি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সব মিলিয়ে শ্রবণেন্দ্রিয়ে মিশ্র
অনুভবের সৃষ্টি হয়, তা সাধারণভাবে আমরা ধ্বনি মিশ্র রূপটাই শুনি।
অনেক সময় একটি ধ্বনি অন্য ধ্বনির মিশ্রণ সুচারুরূপে পাওয়া
যায় না। এক্ষেত্রে একটি ধ্বনির উপর একটি ধ্বনি পতিত হয়ে নতুন ধ্বনিরূপ তৈরি করে।
একে বলা হয় শব্দের উপরিপাতন। উপরিপাতনের ফলে যখন
শব্দের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, বা মূল শব্দ শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটে- শব্দবিজ্ঞানে একে বলে শব্দের ব্যতিচার
(Interference
of sound)।
আস্বাদনের রূপ:
আস্বাদনের রূপ
অনুভূত হয় মুখগহ্বরে। মুখগহ্বরে কিছু প্রবেশ করালে, 'আমি' জিহ্বা ও তালুর
সমন্বয়ে নানারকমের অনুভূতি লাভ করে। ভারতীয় দর্শনে এই অনুভূতিগুলিকে ছয়টি নামে
অভিহিত করা হয়। এই নামগুলো হলো কটু, তিক্ত, কষায়, লবণ, অম্ল, মধুর। এর বাইরে
আস্বাদনের একটি বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে ঝালের অনুভূতি। বিজ্ঞানীরা ঝালকে আলাদা
স্বাদের পর্যায়ে ফেলবেন না। কিন্তু ধানি মরিচের ঝাল যে কি জিনিস, তার স্বাদ
পেলে, আলাদা অনুভূতি ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না। আরও রয়েছে একাধিক স্বাদের
মিশ্র অনুভূতি। প্রতিটি স্বাদের একটি রূপ রয়েছে। যা থেকে একটি থেকে আরেকটিকে
পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়। অনেক সময় 'আমি' দেখা বা গন্ধের অনুভূতি থেকে কোনো বস্তুর
স্বাদ সম্পর্কে অনুমান করে নেয়। এক্ষেত্রে 'আমি'র একটি পূর্ব প্রস্তুতি থেকে।
ফলে একটি মিষ্টদ্রব্য মুখে দিলে স্বাদটাকে দ্রুত অনুভব করে এবং মনের ভিতরে
মিষ্টত্বের যে রূপটি রয়েছে, তার সাথে মিলিয়ে মিষ্টির প্রকৃতি বলে দিতে পারে।
অনেক সময় গন্ধ এবং দর্শন প্রতারিত করতে পারে। কিন্তু মুখ দেওয়ার পর আসল সত্যটি
বেরিয়ে পড়ে। অনেক আম জাতীয় ফলের আস্বাদন নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকে। আমের রঙ
এবং গন্ধ অনুযায়ী যে আমটিকে মিষ্টি মনে হয়, মুখে দেওয়ার পরে দেখা যায় তা খুব
টক।
ঘ্রাণের রূপ:
ঘ্রাণের রূপ অনুভূত হয় নাকের মধ্য দিয়ে। বায়ু
বা অন্যকোনো মাধ্যমের দ্বারা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের অনুভূতি জেগে ওঠে। প্রতিটি গন্ধের
পৃথক রূপ রয়েছে। চেনা গন্ধের রূপ মানুষের স্মৃতিতে থাকে। সে রূপ দিয়ে বুঝতে
পারে কোনটি ফুলের গন্ধ বা কোনটি কোন ফুলের গন্ধ।
স্পর্শের রূপ: মানুষ স্পর্শের ভিতর দিয়ে যে বস্তুর কোমল-কর্কশ, তরল-কঠিন, ঠান্ডা-গরম অনুভব করে। এসবের রূপের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ প্রতিটি স্পর্শকে পৃথকভাবে শনাক্ত করতে পারে।
রূপের ভাবমূর্তি:
প্রতিটি অনুভূতির একক রূপ থাকে।
আবার অনেকগুলো রূপ মিলে একটি বড় রূপ তৈরি হয়। প্রতিটি রূপ মনোজগতে বিরাজ করে। অনুভবের
ভিতরে রূপের মূর্তমান দশাই হলো ভাবমূর্তি। যেমন আগুনের একটি সাধারণ রূপ আছে। মোমবাতির আগুন, দিয়াশলাইয়ের আগুন, চুলার আগুনে
একটি সাধারণ রূপ থাকে। এটি আগুনের
ভাবমূর্তি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ আগুনের সাধারণ রূপের সাথে বাড়তি কিছু উপদান যুক্ত
হয়ে পৃথক পৃথক রূপও তৈরি হয়। ফলে মোমবাতির আগুন, দিয়াশলাইয়ের আগুন, চুলার আগুনের
পৃথক পৃথক রূপ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে মূল রূপের সাথে
ছোটো ছোটো রূপ একীভূত হয়ে জন্ম নেয়, একটি অখণ্ড
রূপ। এক্ষেত্রে আগুনের সাধারণ রূপ হবে ভিত্তি। আর এর সাথের অন্যান্য ছোটো ছোটো রূপ
নিয়ে তৈরি হবে, পৃথক পৃথক আগুনের রূপ। এই রূপ অনুভবের ভিতর দিয়ে যে পূর্ণাঙ্গ
ধারণার জন্ম নেয় প্রতিটি সত্তার
ভাবমূর্তি। ভাবমূর্তি নানা ভাবে তৈরি
হতে পারে।
যেমন―
প্রত্যক্ষ: বাস্তব জগতের
প্রত্যক্ষ অনুভবের ভিতর দিয়ে এই রূপ গড়ে উঠে। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের সংবেদনে
আমাদের চারপাশের জগতের যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়, তাই হলো প্রত্যক্ষ ভাবমূর্তি। এই
ভাবমূর্তি একেবারে আনকোড়া হতে পারে। যেমন যখন কোনো শিশু প্রথম পাখি দেখে। তার
মনের ভিতরে পাখির অবয়বের ছোটো রূপগুলো একীভূত হয়ে একটি অখণ্ড ভাবমূর্তি তৈরি
করে। যখন পাখিটি ডাকে, তখন দৈহিক রূপের সাথে ডাকার শব্দের রূপ মিলেমিশে তৈরি হয়
একটি ভাবমূর্তি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাবমূর্তি তৈরি হয় ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা
অনুসারে। দেখার, শোনার, আস্বাদন নেওয়ার, স্পর্শ পাওয়ার বা দেয়ার, গন্ধ পাওয়ার
সূত্রে তৈরি হবে ভিন্নভিন্ন রকমের ভাবমূর্তি। বা একাধিক ভাবমূর্তির সমন্বয়েই একটি
মিশ্র ভাবমূর্তি তৈরি হতে পারে।
পরোক্ষ ভাবমূর্তি: অন্যের
বর্ণনা শুনে বা বই পড়ে, অনেক সময় আমাদের ভিতরে একটি ভাবমূর্তি তৈরি হয়। এগুলো
পরোক্ষ ভাবমূর্তি। যেমন সাইবেরিয়ার শীতকালে ঘটে যাওয়া তুষার ঝড়,
সাহারার মরু ঝড় ইত্যাদি।
পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভাবমূর্তি:
চলচ্চিত্রে বা সচিত্র সংবাদের মধ্য দিয়ে এই ভাবমূর্তি তৈরি হয়।
এক্ষেত্রে দর্শক সাইবেরিয়া বা সাহারায় সরাসরি উপস্থিত থাকেন না, সেই কারণে
পরোক্ষ ভাবমূর্তির তৈরি হয়। আবার দেখাটা বাস্তবের মতো হয় বলে, প্রত্যক্ষ
ভাবমূর্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়।
স্মৃতিগত ভাবমূর্তি: প্রত্যক্ষ
ভাবমূর্তি স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। তাই পূর্বের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে কোনো ভাবমূর্তি
কখনো মানসপটে ভেসে উঠে। এর দ্বারা তৈরি হয় পরোক্ষভাব মূরতি। কিন্তু দূর কিম্বা
অদূর অতীতের স্মৃতিগত ভাবমূর্তি জাগ্রত হয়ে উঠে। এই ভাবমূর্তিতে কবিয়াল গান
বাঁধেন 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম'।
কল্প ভাবমূর্তি: মানুষের
কল্পনায় যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠে, তাই হলো, কল্পভাবমূর্তি।
ধরা যাক একটি অচেনা
মানুষ আপনার বাসায় আসবে। এক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ আগন্তুকের বিবরণ শুনে তার ছোটো
রূপ মনোলোকে তৈরি হবে।
এরই ভিতর দিয়ে অচেনা
লোকটির একটি ভাবমূর্তি তৈরি হবে। এই ভাবমূর্তি তৈরি হবে, কল্প-বাস্তবের
সংমিশ্রণে। যেমন পরী শব্দটি শোনার সাথে সাথে মনোজগতে তৈরি হবে পাখাযুক্ত তরুণীর
ছবি। যার থাকবে সুন্দর মুখশ্রী, জ্যোৎস্নার মতো গায়ের রঙ, শুভ্র পোশাক
ইত্যাদি। পরীর এই রূপের আদল তৈরি হয় রূপকথার গল্প পড়ে, শুনে বা চিত্রকর্মের
মাধ্যমে।
পরা ভাবমূর্তি: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো সংবেদন আমাদের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যেমন কোনো বস্তু দেখার পর ১/১০ সেকেন্ড সময়, দর্শনেন্দ্রিয়ে থেকে যায়। স্বল্প সময়ের জন্য সৃষ্ট ভাবমূরতি হলো পরা ভাবমূর্তি। একটু বেশি সময় ধরে সাদা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকার পর, চোখ সরিয়ে নিলেও, ওই সাদা রঙের আবেশ থেকে যায়। পরা ভাবমূরতি সৃষ্টির জন্য এটা হয়।
রূপের আশ্রয়েই জগতের প্রকাশ। স্বস্তি-অস্বস্তির প্রাথমিক রূপের উন্নততর দশায় আনন্দরূপ প্রস্ফুটিত হয়। আবার সুসমন্বিত বহুবিধ আনন্দের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে যা, তাই হলো সুন্দরের রূপ। এর সাথে যুক্ত হয় অলঙ্কার, ভাবরস ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রূপের রূপান্তর ঘটে। আবার সৃজনশীল কল্প-বাস্তব দশায় এসে যে মঙ্গলময় রূপের প্রকাশ ঘটে তা হয়ে যায় শিল্প। অকল্যাণকর রূপের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে বর্জ্য-শিল্পের। আর কল্যাণকর নান্দনিক রূপের ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় সুকুমার শিল্প। সুকুমার শিল্প নানা ভাগে বিভক্ত। যেমন কাব্য, নাট্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদি সবই সুকুমার কলা এবং এদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব রূপ।