১.৮
চেতনা ও ধারণা

চেতনার আভিধানিক অর্থ জ্ঞান, সংবিৎ, অনুভূতি, সচেতন অবস্থা, জীবিত অবস্থা ইত্যাদি। এই পাঠের 'চেতনা' পারিভাষিক শব্দ হিসেবে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চেতনা হলো 'আমি'র উপলব্ধি এবং 'আমি' সাড়া দেওয়ার সমন্বিত দশা। 'আমি' সাড়া দেয় যখন সে কোনো সত্তার সংস্পর্শে আসে। এই সংস্পর্শের মাধ্যমে 'আমি' নামক সত্তার গুণমান অনুসারে পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। উল্লেখ্য, সত্তার গুণগতবৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তৈরি হয় সত্তাগুণ (attribute)। আর সত্তাগুণের সংস্পর্শে এসে 'আমি'র নানা ধরনের অনভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মনোগত দশার (state) সৃষ্টি করে। মনোগত দশায় তৈরি হয় প্রজ্ঞাদশা (cognitive state) এই প্রজ্ঞাদশার মধ্য দিয়ে আরও উন্নততর যে দশায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে বলা যায়  'চেতনা (consciousness)'। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ধারণারও বিকাশ ঘটে চেতনার ভিতর দিয়ে।

জড়জগতে সাড়া দেওয়ার বিষয় রয়েছে, কিন্তু তাতে 'আমি'র উপলব্ধি নেই। তাই জড়ের সাড়া দেওয়াটা নিতান্তই আবেশিত দশা মাত্র। লোহার টুকরোর কাছে চুম্বক আনলে, লোহা চুম্বকের দিকে সরে আসে। এতে লোহার টুকরোর ভিতরে আবেশিত সাড়া লক্ষ্য করা যায়। মনের সাথে যার যোগ নেই বলে, তা চেতনা নয়। তাই ধরেই নিতে পারি, চেতনা জীবের জন্য, জড়ের জন্য নয়।

জীবের চেতনার অস্তিত্বের সাথে দেহের ও মনের সাড়া যেমন রয়েছে, তেমনি দেহধারীর মনোগত উপলব্ধিও রয়েছে। জীবজগতের সকল প্রজাতির চেতনা আছে কি? এই কৌতুহল প্রথম হোচট খায় উদ্ভিদের ক্ষেত্রে। কারণ, চেতনার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আছে আমরা এমনটা ভাবতেই অভ্যস্থ। উদ্ভিদের মস্তিষ্ক নামক কোনো পৃথক দেহাংশ নেই বলে, চেতনা শব্দটি উদ্ভিদের আলোচনায় আনা হয় না। উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আছে একথা মানলে, উদ্ভিদের চেতনা আছে এটা মানতেই হয়। মূলত দেহের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উদ্ভিদের কোনো কেন্দ্রীয় অংশ নেই। উদ্ভিদের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তার সমগ্র দেহের জৈবিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। স্থানান্তরের ক্ষমতা নেই বলে, উদ্ভিদের জৈবিক কার্যক্রমের জটিলতা প্রাণীর চেয়ে কম। প্রাণীর উন্নত স্তর বিবেচনা করা হয়, তার মস্তিষ্কের সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিচারে। মানুষের অহঙ্কার তার বুদ্ধিমত্তায়। তাই মানুষ নিজেকে প্রজাতিগত পরিচয় দেয় 'হোমো স্যাপিয়েন্স' নামে। মানুষের দেহগত কার্যক্রমের একটি অংশ পরিচালিত হয়, দেহের স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রমের দ্বারা। সেখানে মনের হাত নেই, কিন্তু মনের মাতবরি আছে। মন এই মাতবরি চালায় দেহের কোনো কোনো অংশের উপর। দেহের বাইরে মনের যে একটি জগৎ আছে। সে জগৎ বিমূর্ত। কিন্তু কাজ তার বিমূর্ত-মূর্ত উভয় জগৎ নিয়ে। বাইরের জগতের অনুভবের ভিতর দিয়ে মানুষের চৈতন্য ঘটে নানাভাবে।

 

দেহ ও মনের বিচারে প্রাথমিকভাবে মোটা দাগে চেতনাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভাগ দুটি হলো

যেকোনো সত্তার গুণমান অনুসারে একটি সত্তার পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সত্তার গুণগতবৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তৈরি হয় সত্তাগুণ। আর সত্তাগুণের সংস্পর্শে মানুষের নানা ধরনের অনভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মানুষের মনোগত দশার সৃষ্টি করে। মনোগত দশায় তৈরি হয় প্রজ্ঞা দশা।

 

বোধ ও সংবেদন
বোধ চেতনার মনোগত অংশ এবং একটি বিশেষ স্তর।
বাংলাতে অনেক সময় চেতনা এবং বোধকে সমার্থক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমার তা ব্যবহারও করি। যেমন- ঠান্ডায় আঙুলে চেতনা নাই, ঠান্ডায় আঙুলের বোধ নাই'। আরও বলে থাকি 'ঠান্ডায় আঙুলে সাড়া নাই'। এক্ষেত্রে ভাষায় ব্যবহৃত এই সকল সমার্থক শব্দের বিচারে 'বোধ'-কে না দেখে, বিশেষ পারিভাষিক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই আলোচনায় বোধের বিশেষ অর্থ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, চেতনার মনোগত অংশের একটি বিশেষ স্তর হিসেবে।

মানুষের বোধের সাথে থাকে সহজাত চেতনাগুণ। এই চৈতন্যের সাথে যখন যুক্ত হয় প্রজ্ঞাজাত সত্যাসত্য, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদির অনুভব এবং সেখান থেকে জন্ম নেয় মিশ্র উপলব্ধি। এই মিশ্র উপলব্ধির সূত্রে জন্ম নেয় নানা রকম খণ্ডিত বোধ। হতে পারে সেটা দুঃখবোধ বা নান্দনিক বোধ। জীবনের নানাবিধ বোধের সমন্বিত রূপ হলো জীবনবোধ। মানুষের সকল বোধই এই জীবনবোধের অংশ। কোনো কোনো বোধ অন্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বোধের রূপান্তর ঘটায়। কখনো কখনো একাধিক বোধ সাংঘর্ষিক রূপ নেয়।

 

এই জীবনবোধের জগৎ হলো প্রতিটি মানুষের নিজস্ব জগৎ। সেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। ভাষা বা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমে সে জগতের উপলব্ধিকে অন্যের কাছে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না। একজন মানুষ তার সুখ-দুঃখের অংশভাগী হতে পারে, কিন্তু বোধের অংশভাগী হতে পারে না। একজনের বোধ দ্বারা অন্য কেউ প্রভাবিত হতে পারে। কিন্তু দুইজন মানুষের বোধ কখনো একই রকম হয় না। এই বোধের সূত্রে প্রতিটি 'আমি' যে বিশেষ গুণের অধিকারী হয়ে উঠে, তা ব্যক্তিগত বলেই, ব্যক্তি হিসেবে সে স্বতন্ত্র এবং সেটাই তার ব্যক্তিত্ব। তবে একজনের বোধের জগৎ অন্যজনের বোধের জগতের সাথে অংশবিশেষের সাথে কিছুটা হলেও মিলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু অন্য বোধের বিচারে সাংঘর্ষিক হলে, শত্রুও হয়ে যেতে পারে। যেমন দুজন মানুষ ইসলামী দর্শনে বা বোধের বিচারে একমত হলেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর প্রেক্ষাপটে দুজনে পরস্পরের শত্রু হয়ে যেতে পারে।

 

জীবনকে টিকিয়ে রাখার বোধ থেকে মানুষ বাঁচতে চায়, জীবনকে সাজানোর বোধ থেকে মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়। প্রকৃত জীবনবোধ হলে, উভয়ের সমন্বিত রূপ। শরীর টিকিয়ে রাখার বোধে বেঁচে থাকার একটি গড় মান। মানুষ সর্বভুক প্রাণী বলে সব খায়, কিন্তু সব মানুষ সব কিছু খায় না। এক্ষেত্রে কি খায়, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, যা খায় তা তার জীবন টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত কিনা। স্বাভবিক জীবনযাত্রায় খাদ্যাখাদ্যের বিচারে মানুষ বিষ খাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটার কোনো গড় মান নেই। কিন্তু ভাত খাবে না গমের রুটি খাবে তার গড় মান হলো শর্করা জাতীয় খাদ্য। শুকর খাবে না কি গরু খাবে, এ নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে, কিন্তু মূল বিষয় আমিষের অভাব পূরণ। সেটা অন্য কোন খাদ্য থেকে গ্রহণ করতেই পারে। দেহ টিকিয়ে রাখার জন্য যে বোধ সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে আছে, তার তাড়নায় ক্ষুধার উদ্রেক হয় এবং মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে

ধারণা
মানুষের অনুভব থেকে চৈতন্যের বিকাশের ভিতর দিয়ে যে বোধের জন্ম হয়, সেই বোধের ভিতর দিয়ে মনের ভিতর যে নিজস্ব পরিমণ্ডল তৈরি হয়, সেখানে যে অনুভব স্থিতি লাভ করে, সেটাই ধারণা। ধারণায় থাকে অজ্ঞাত বিষয়কে বোধের দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌছার চেষ্টা। ফলে মনের ভিতরে মনের নানা ধরনের ধারণার জন্ম হয়। ফলে ধারণা সত্যের পথে চললেও সত্যকে চূড়ান্ত রূপে উপস্থাপিত করে না। তারপরেও ধারণার জন্ম না হলে সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। এর শুরু কিন্তু অনুভবের প্রাথমিক সিদ্ধান্তের সূত্রেই। অনুভব যখন বোধের স্তরে পৌঁছায়, তখন ধারণা এবং সিদ্ধান্তের ব্যাপকতা বাড়ে।

 

যে কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক যে বোধের জন্ম হয়,  তা সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরেই ঘটে। যেমন দূর থেকে হেঁটে আসা একজন মানুষকে দেখে মনে হলো, একটি মেয়ে হেঁটে আসছে। এই মনে হওয়াটা প্রাথমিক ধারণা। মানুষের মনে বোধের যে পূর্বরূপ রয়েছে, তার বিচারে সহজাত প্রবৃত্তিতে এই জাতীয় বোধের জন্ম হয়। দূরের মানুষকে দৃষ্টির অনুভবের ভিতর দিয়ে, সিদ্ধান্ত নেওয়া লোকটি নারী না পুরুষ, লম্বা না বেঁটে ইত্যাদি। লোকটি যতই কাছে আসতে থাকবে, ধারণার কিছু কিছু অংশ বাতিল হয়ে যাবে একই সাথে সিদ্ধান্তও পাল্টাতে থাকবে। তাই ধারণার সূত্রে যে সিদ্ধান্ত জন্মে, তা পরিবর্তনশীল। লোকটি কাছে এলে, একটি চূড়ান্ত সিদ্ধন্তের ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত বোধের সৃষ্টি হয়। চেতনা, ধারণা এবং সিদ্ধান্তের সূত্রে জন্ম নেয় রূপের। এই সূত্রে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো 'চেতনা ও রূপ' সম্পর্কে। তাই পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো চেতনা ও রূপ।