১.৮
চেতনা ও ধারণা
চেতনার আভিধানিক অর্থ– জ্ঞান, সংবিৎ, অনুভূতি, সচেতন অবস্থা, জীবিত অবস্থা ইত্যাদি। এই পাঠের 'চেতনা' পারিভাষিক শব্দ হিসেবে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চেতনা হলো 'আমি'র উপলব্ধি এবং 'আমি'র সাড়া দেওয়ার সমন্বিত দশা। 'আমি' সাড়া দেয় যখন সে কোনো সত্তার সংস্পর্শে আসে। এই সংস্পর্শের মাধ্যমে 'আমি' নামক সত্তার গুণমান অনুসারে পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। উল্লেখ্য, সত্তার গুণগতবৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তৈরি হয় সত্তাগুণ (attribute)। আর সত্তাগুণের সংস্পর্শে এসে 'আমি'র নানা ধরনের অনভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মনোগত দশার (state) সৃষ্টি করে। মনোগত দশায় তৈরি হয় প্রজ্ঞাদশা (cognitive state)। এই প্রজ্ঞাদশার মধ্য দিয়ে আরও উন্নততর যে দশায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে বলা যায় 'চেতনা (consciousness)'। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ধারণারও বিকাশ ঘটে চেতনার ভিতর দিয়ে।
জড়জগতে সাড়া দেওয়ার বিষয় রয়েছে, কিন্তু তাতে 'আমি'র উপলব্ধি নেই। তাই জড়ের সাড়া দেওয়াটা নিতান্তই আবেশিত দশা মাত্র। লোহার টুকরোর কাছে চুম্বক আনলে, লোহা চুম্বকের দিকে সরে আসে। এতে লোহার টুকরোর ভিতরে আবেশিত সাড়া লক্ষ্য করা যায়। মনের সাথে যার যোগ নেই বলে, তা চেতনা নয়। তাই ধরেই নিতে পারি, চেতনা জীবের জন্য, জড়ের জন্য নয়।
জীবের চেতনার অস্তিত্বের সাথে দেহের ও মনের সাড়া যেমন রয়েছে, তেমনি দেহধারীর মনোগত উপলব্ধিও রয়েছে। জীবজগতের সকল প্রজাতির চেতনা আছে কি? এই কৌতুহল প্রথম হোচট খায় উদ্ভিদের ক্ষেত্রে। কারণ, চেতনার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আছে আমরা এমনটা ভাবতেই অভ্যস্থ। উদ্ভিদের মস্তিষ্ক নামক কোনো পৃথক দেহাংশ নেই বলে, চেতনা শব্দটি উদ্ভিদের আলোচনায় আনা হয় না। উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আছে একথা মানলে, উদ্ভিদের চেতনা আছে এটা মানতেই হয়। মূলত দেহের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উদ্ভিদের কোনো কেন্দ্রীয় অংশ নেই। উদ্ভিদের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তার সমগ্র দেহের জৈবিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। স্থানান্তরের ক্ষমতা নেই বলে, উদ্ভিদের জৈবিক কার্যক্রমের জটিলতা প্রাণীর চেয়ে কম। প্রাণীর উন্নত স্তর বিবেচনা করা হয়, তার মস্তিষ্কের সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিচারে। মানুষের অহঙ্কার তার বুদ্ধিমত্তায়। তাই মানুষ নিজেকে প্রজাতিগত পরিচয় দেয় 'হোমো স্যাপিয়েন্স' নামে। মানুষের দেহগত কার্যক্রমের একটি অংশ পরিচালিত হয়, দেহের স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রমের দ্বারা। সেখানে মনের হাত নেই, কিন্তু মনের মাতবরি আছে। মন এই মাতবরি চালায় দেহের কোনো কোনো অংশের উপর। দেহের বাইরে মনের যে একটি জগৎ আছে। সে জগৎ বিমূর্ত। কিন্তু কাজ তার বিমূর্ত-মূর্ত উভয় জগৎ নিয়ে। বাইরের জগতের অনুভবের ভিতর দিয়ে মানুষের চৈতন্য ঘটে নানাভাবে।
দেহ ও মনের বিচারে প্রাথমিকভাবে মোটা দাগে চেতনাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভাগ দুটি হলো−
দেহগত চেতনা:
দেহগত চেতনা হলো, দেহের যান্ত্রিক নিয়মের ভিতর দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা এবং
প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া। কাউকে যদি দুহাত তুলে নমস্কার করতে ইচ্ছা করে, তাতে মনের
সাড়া তাতে থাকবে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুহাত তোলার যান্ত্রিক ক্ষমতাও থাকতে হবে।
অবশ হাতে যান্ত্রিক ক্ষমতা থাকে না। ফলে মনের সাড়া থাকলেও হাতের সাড়া মেলে না।
পক্ষাঘাতের রোগীর মনের চেতনা থাকে, কিন্তু শরীরের চেতনা থাকে না।
মনোগত চেতনা:
মানুষের মনোগত চেতনার সাথে দেহগত চেতনার তুলনা করলে দেখা যায়, মনোগত চেতনার
ক্ষেত্র বিশাল। কিন্তু মানুষের উভয় চেতনার অনেক বিষয় পরস্পরের সাথে গভীরভাবে
সম্পর্কিত হয়ে, চেতনার নানা প্রকরণ তৈরি করে।
মানুষের মনোগত চেতনার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের সকল
সমন্বিত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রাণশক্তি সক্রিয় থাকে। তাই মস্তিষ্কের সজীবতার
উপর নির্ভর করে প্রাণের সজীবতা। প্রাণীর ভ্রূণদশায় মনও ভ্রূণ দশায় থাকে।
জিনসঙ্কেতের তাড়নায় কোষ বিভাজিত হয় যান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং একসময় পূর্ণাঙ্গ
প্রাণীতে পরিণত হয়। এই ক্রমবিকাশের সূত্রে মস্তিষ্ক পূর্ণাঙ্গতা পায়, মনও পূর্ণ
কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। এর পিছনে থাকে প্রাণীর বেড়ে উঠার সাথে নানা ধরনের
অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। প্রাণীবিশেষে জ্ঞানের যে হেরফের দেখা যায়, তা মস্তিষ্কের
রকমফেরের জন্যই। মানুষের এইভাবে বেড়ে উঠার ভিতরে চেতনার বিকাশ ঘটে দুটি অনুভবের
সূত্রে। এর একটি হলো দৈহিক অনুভব, অপরটি ভাবগত অনুভব। এই ভাবগত অনুভব হলো
বোধের একটি স্তর বিশেষ।
দৈহিক অনুভবজাত
চেতনা:
দেহের নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে, যা মনে
চেতনার জন্ম দেয়। শরীরের সকল ধরনে স্বস্তি-অস্বস্তির সূত্রে এই চেতনার সৃষ্টি
হয়। যেমন ক্ষুধার অনুভব, ক্ষুধা নিবৃত্তের অনুভব। উভয় অনুভবই দেহগত, কিন্তু
এই অনুভব উপলব্ধি করে মন। দৈহিক
চেতনা তিনটি ধারায় হতে পারে। যেমন―
অবচেতন সাড়া: মানুষ অনেক
সময় তার সচতেনতার ভিতরে না থেকেও সাড়া দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে চেতনার
অনেকাংশ নিষ্ক্রিয় থাকলেও কিছু অংশ সংক্রিয় থাকে। সেই সক্রিয়ের দ্বারাই
মানুষ অচেতন অবস্থাতেই সাড়া দেয়। সেই কারণে ঘুমন্ত মানুষকে ডাকলে,
অচেতন অবস্থাতেই সহজাত প্রবৃত্তিতে উত্তর দেয়। কিম্বা ঘুমন্ত মানুষের
হাতে পায়ে গরম বা বেশি ঠাণ্ডা বস্তু ছোঁয়ালে, হাত-পা সরিয়ে নেয়।
প্রতিক্রয়াজাত তাৎক্ষণিক সাড়া:
অনেক সময় কিছু বুঝে উঠার আগেই মানুষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
চোখের পাতায় হঠাৎ পোকা স্পর্শে করলে, দেহের স্বয়ংক্রিয়
প্রতিক্রিয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর কোনো কিছু হঠাৎ অনুভব করে,
মানুষ চিৎকার করে বা উদ্ভ্রান্তের মতো সরে যায়। এই সবই
প্রতিক্রয়াজাত তাৎক্ষণিক সাড়া।
বিচারযোগ্য সাড়া: এই জাতীয় অনুভূতিতে সাড়া দেওয়ার আগে মানুষ কিছুটা বিচার বিশ্লেষণ করে। তারপর তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। যখন কেউ কারো নাম জিজ্ঞাসা করে, তখন প্রথমে প্রশ্নটা শোনে, তারপর উত্তর দেয়। এর ভিতরে থাকে যথার্থ উত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টা। এমনকি কোনো অপরাধী যদি পুলিশের কাছে ভুল নাম বলতে চায়, তাহলে তাকে বিশেষ চেষ্টা করতে হয়। অভ্যস্থতার কারণে এই জাতীয় সাড়া দ্রুত হতে পারে, বা বিষয়ের গভীরতা ও গুরুত্বের বিচারে দীর্ঘ সময় হতে পারে। যদি কাউকে বলা হয়, 'আগামী সপ্তাহে আমাদের সাথে বনভোজনে যাবে না কি?' এর উত্তর হতে পারে, 'একটু ভেবে দেখি, যেতে পারবো কিনা, তা কালকে বলতে পারবো'।
ভাবগত অনুভবজাত
চেতনা: দেহের চাহিদা বা অস্বস্তিজনিত চেতনার বাইরে, অন্যান্য সকল
চেতনাই ভাবগত অনুভবের। যেমন সন্তানের প্রতি তীব্র ভালোবাসার চেতনা জাগ্রত
হয় মনে। কিম্বা সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ জন্মে ভাবগত অনুভবজাত চেতনার সূত্রে।
এই চেতনা অনেক সময় দেহগত চেতনা-অনুভবের জন্ম দেয়। একটি সুন্দর ফুল দেখে
মনের গভীরে যে চেতনার জন্ম হয়, তা থেকে ওই ফুল ছুঁয়ে দেখার চেতনাও জাগ্রত
হয়। এর মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় মানুষের দেহগত ও মনোগত আচরণ। ভাবগত চেতনার ভিতর
দিয়ে জন্ম নেয় হিংসা, ভালোবাসা, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি নানা রকম মানসিক চেতনা।
ভাবগত চেতনার আদি স্তর হলো,
'আমি'র জন্মলগ্নের প্রাথমিক স্তর। এই স্তরে 'আমি' নিজে গঠিত হয় ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়।
ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠার ভিতর
দিয়ে 'আমি' যত ধরনের উপলব্ধি লাভ করে, তা সম্মিলিতভাবে 'আমি'কে অভিজ্ঞ করে তোলে।
প্রাথমিক স্তরে 'আমি' নিজের গড়ে তোলার কর্মকাণ্ডের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে বটে,
কিন্তু দেহগঠনে তার কোনো ইচ্ছা শক্তি কাজ করে না। এই স্তরে চেতনা থাকে
দেহগঠনের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার ভিতরে। এর ভিতরেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় মনোজগৎ। সে জগৎ চলে
'আমি'র নিজের ভাঙা-গড়ার খেলায়। এর ভিতরে এক
সময় তার ভিতরে স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের জন্ম হয়। মাতৃগর্ভে শিশুর নড়াচড়া সেই চেতনারই
প্রকাশ মাত্র। অন্যান্য প্রাণীর ভিতরেও এই চেতনার প্রকাশ দেখা যায়। তবে প্রজাতিভেদে
তা ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়, এমনি
কিছু বোধ নিয়ে; যেখানে তার মনের গভীরে এমন এক জগৎ তৈরি হয়,
যে জগতে সে আপন মনে হাসে,
ঘুমের ভিতর চমকে ওঠে। অবশ্য দেহগত অসুবিধায় কখনো সে কাঁদে বা হাসে তার
স্বস্তি-অস্বস্তিবোধ থেকেও।
জৈবিক কার্যক্রমের অংশ
হিসেবে, মানুষ ঘুমায়। ঘুমের ভিতরে তার দেহের স্বয়ংক্রিয় অংশগুলো চলতে থাকে। যার
ভিতর দিয়ে জীবনের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সে সময়ে ঘুমন্ত মানুষের চেতনার একটি অংশ
নিষ্ক্রিয় দশায় চলে যায়। কিন্তু কিছু অংশ সক্রিয় থাকে। ঘুমন্ত মানুষকে ডাকলে যে
জেগে উঠে এই সক্রিয় অংশের জন্যই। অজ্ঞান দশায় এই অংশ সাড়া দিতে পারে না। এই দশাকে
বলা হয় অচেতন দশা। নেশাগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিকভাবে সাড়া দেয় না। এদের চেতনা একটি
বিকৃত দশায় থাকে।
প্রাণীকূলের স্বস্তি বা অস্বস্তিবোধের প্রকাশ এবং মনের নিজস্ব জগৎ মিলের
তৈরি হয়, বোধের জগৎ। সে জগতের কিছুটা দেখা যায়, কিছুটা অনুভব করা যায়,
বাকিটা মনের গভীরতলে লুকিয়ে থাকে। গভীরতল থেকে কখনো কখনো কিছু কিছু বোধ
জেগেও ওঠে। এই জেগে উঠা বোধের সমষ্টিগত রূপই হয়ে ওঠে মনের চেতনা। বলাই
বাহুল্য, মনের
পাশাপাশি দেহগত চেতনাও সক্রিয় থাকে ।
মানুষ বুদ্ধির বিচারে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ট। তাই
তার মনোজগতের অনুভবের ভিতর দিয়ে নতুভাবে জেগে উঠে। একে বলা যেতে পারে
'চেতনার ভিতরে চৈতন্য'। যে কোনো কিছুর গভীরভাবে দর্শন এবং আত্মজিজ্ঞাসার
মীমাংশার সূত্রে চৈতন্য জেগে উঠতে পারে। এর ফলে মানুষের রূপান্তর ঘটে। বয়স
বাড়ার সাথে সাথে, মানুষের চেতনার পরিবর্তন ঘটে অভিজ্ঞতা এবং জীবনের
মূল্যবোধের সূত্রে। এই পরিবর্তনের সূত্রে দেখা যায়, অতি নিষ্ঠুর প্রকৃতির
মানুষও একসময় সদয় মানুষে পরিণত হয়েছে।
দেহগত ও মনোগত চেতনার ভিতর দিয়ে যে প্রাপ্তিই
ঘটুক না কেন, তার প্রাথমিক স্তরে কাজ করে অনুভব। অনুভব আছে বলেই চেতনার মূল্য আছে।
মূলত অনুভবের ভিতর দিয়েই জন্ম নেয় চেতনা।
চেতনার দ্বারাই সজীব প্রাণী তার দেহগত কার্যক্রম চালিয়ে যায়। প্রাণীকূলের
এই চেতনা সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা। গান গাওয়া পাখিরা গান গায়, তার সহজাত
প্রবৃত্তিতে। এ চেতনার ভিতরে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা নেই। মানুষের আছে। এই
প্রেরণা যোগায় 'আমি'র ইচ্ছায়। আর এই ইচ্ছা জাগে বা তা পূরণের চেষ্টা
তাগিদে। এই ইচ্ছা জাগে
তার সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে। পাখি নতুন গান তৈরি করতে পারে না, তার সত্তার
ভিতরে নতুন সৃষ্টির ব্যবস্থা নেই। মানুষের আছে বলেই সে পারে, কিন্তু তার
ক্ষমতার বাইরে যেতে পারে না। দেহগত বা মস্তিষ্কজাত ক্ষমতার বাইরে কিছু করতে
না পারাটা জীবের সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার
ভিতরে যে চেতনার জন্ম হয়, তার কিছু অংশ জীব নিজেই উপলব্ধি করে। এর কিছু অংশ আছে
নিজের জন্য, কিছুটা অন্যের জন্যেও। সঙ্গীতের যে গভীর রূপ শিল্পীর চেতনায় জেগে উঠে, তার
অপ্রকাশ্য অংশ শিল্পীর নিজের এবং যেটুকু সে অন্যকে শোনায় তা শ্রোতাদের জন্য।
সবদিক বিচার করলে দেখা যায়, মানুষের অনুভবজাত চেতনার সূত্রে কিছু বিশ্বাসের
জন্ম হয়। এই বিশ্বাস ব্যক্তি বা সমষ্টিগত পর্যায়ে বিকশিত হতে পারে। এর সবই
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। মানুষভেদে চেতনার যে
পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তা ঘটে জিনসঙ্কেত, পরিবেশ শিক্ষা ইত্যাদির
দ্বারা। চেতনায় বিশ্বাস উৎপন্ন হতে পারে নানাভাবে। যেমন–
প্রত্যক্ষবোধজাত
চেতনা: মানুষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে যে সকল বিষয় অনুভব করে,
তার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ চেতনার সৃষ্টি করে। বরফ শীতল, আগুন গরম এই জাতীয়
অভিজ্ঞতাগুলো থেকে মানুষ দেহগত চেতনা লাভ করে। কিন্তু শীতল দশা এবং উত্তপ্ত দশার
দ্বারা কি হতে পারে, তার বোধ মানুষের ভিতরে থাকে। উচিৎ অনুচিতের ভিতর দিয়ে
যে জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, তা মানুষের মনে বিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং তা চেতনার
অংশ হয়ে যায়। আগুনে হাত পুড়ে যাবে, এটা যদি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হয়, তাহলে
আগুন থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার বোধ হবে চেতনা।
প্রজ্ঞাজাত চেতনা: প্রকৃষ্টরূপে প্রাপ্ত জ্ঞান কোনো কোনো বিষয়ে বিশ্বাসী করে
তোলে। এই বিশ্বাস থেকে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। মেঘের রঙ এবং প্রকৃতি দেখে
মানুষ মনে করে ঝড় হবে বা হতে পারে, এর পিছনে থাকে মানুষের অভিজ্ঞাজাত প্রজ্ঞা। প্রত্যক্ষবোধজাত
চেতনা এবং নানা ধরনের ঝড় দেখে এই প্রজ্ঞার জন্ম হয়। এই প্রজ্ঞাই তাকে
বিশ্বাসী করে তোলে। এর ভিতর দিয়েই প্রজ্ঞাজাত চেতনার উদ্ভব হয়। এই চেতনায়
সাড়া দিয়ে মানুষ সতর্ক হয়। প্রত্যাহিক জীবনে প্রজ্ঞাজাত চেতনা মানুষকে
যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অনেক প্রজ্ঞাজাত চেতনা জন্মে
অপ্রত্যক্ষ বিষয় থেকেও। আধুনিক কালের মানুষ বিশ্বাস করে, পৃথিবী গোল। কজন
আছে তা নিজে পরীক্ষা করে বিশ্বাস করছে? কিছু গবেষক বা প্রতিষ্ঠান এতটা
দৃঢ়ভাবে 'পৃথিবী যে গোলাকার' অনেকভাবে উপস্থাপন করছে। এই জাতীয় বিশ্বাস
অপ্রত্যক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে বিশেষ বিশ্বাস জন্মায়। এবং তা এতটাই গভীরভাবে
মনে গেঁথে যায়, যা অবিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই বলে মানুষ ভাবে।
অপ্রমাণ্য চেতনা: কিছু কিছু বিশ্বাস আছে, যা ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষবোধ এবং প্রজ্ঞাজাত বোধের বাইরে থেকেও বিশ্বাসের জন্ম দেয়। ঈশ্বরের প্রতি হলো এমন বিশ্বাস। সকল ধর্মীয় চেতনার সাথে জড়িয়ে আছে এমনি কোনো না কোন অপ্রামাণ্য বিশ্বাস। এমনি রয়েছে আত্মা সম্পর্কিত ধর্মীয় জ্ঞান।
যেকোনো সত্তার গুণমান অনুসারে একটি সত্তার পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সত্তার গুণগতবৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তৈরি হয় সত্তাগুণ। আর সত্তাগুণের সংস্পর্শে মানুষের নানা ধরনের অনভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মানুষের মনোগত দশার সৃষ্টি করে। মনোগত দশায় তৈরি হয় প্রজ্ঞা দশা।
বোধ ও সংবেদন
বোধ চেতনার মনোগত অংশ এবং একটি বিশেষ স্তর।
বাংলাতে
অনেক সময় চেতনা এবং বোধকে সমার্থক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে
আমার তা ব্যবহারও করি। যেমন- ঠান্ডায় আঙুলে চেতনা নাই, ঠান্ডায় আঙুলের বোধ নাই'।
আরও বলে থাকি 'ঠান্ডায় আঙুলে সাড়া নাই'। এক্ষেত্রে ভাষায় ব্যবহৃত এই সকল সমার্থক
শব্দের বিচারে 'বোধ'-কে না দেখে, বিশেষ পারিভাষিক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই
আলোচনায় বোধের বিশেষ অর্থ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, চেতনার মনোগত অংশের একটি বিশেষ
স্তর হিসেবে।
মানুষের বোধের সাথে থাকে সহজাত চেতনাগুণ। এই
চৈতন্যের সাথে যখন যুক্ত হয় প্রজ্ঞাজাত সত্যাসত্য, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদির অনুভব
এবং সেখান থেকে জন্ম নেয় মিশ্র উপলব্ধি। এই মিশ্র উপলব্ধির সূত্রে জন্ম নেয় নানা
রকম খণ্ডিত বোধ। হতে পারে সেটা দুঃখবোধ বা নান্দনিক বোধ। জীবনের নানাবিধ বোধের
সমন্বিত রূপ হলো জীবনবোধ। মানুষের সকল বোধই এই জীবনবোধের অংশ। কোনো কোনো বোধ
অন্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বোধের রূপান্তর ঘটায়। কখনো কখনো একাধিক বোধ সাংঘর্ষিক
রূপ নেয়।
এই জীবনবোধের জগৎ হলো প্রতিটি মানুষের নিজস্ব জগৎ। সেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। ভাষা বা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমে সে জগতের উপলব্ধিকে অন্যের কাছে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না। একজন মানুষ তার সুখ-দুঃখের অংশভাগী হতে পারে, কিন্তু বোধের অংশভাগী হতে পারে না। একজনের বোধ দ্বারা অন্য কেউ প্রভাবিত হতে পারে। কিন্তু দুইজন মানুষের বোধ কখনো একই রকম হয় না। এই বোধের সূত্রে প্রতিটি 'আমি' যে বিশেষ গুণের অধিকারী হয়ে উঠে, তা ব্যক্তিগত বলেই, ব্যক্তি হিসেবে সে স্বতন্ত্র এবং সেটাই তার ব্যক্তিত্ব। তবে একজনের বোধের জগৎ অন্যজনের বোধের জগতের সাথে অংশবিশেষের সাথে কিছুটা হলেও মিলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু অন্য বোধের বিচারে সাংঘর্ষিক হলে, শত্রুও হয়ে যেতে পারে। যেমন― দুজন মানুষ ইসলামী দর্শনে বা বোধের বিচারে একমত হলেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর প্রেক্ষাপটে দুজনে পরস্পরের শত্রু হয়ে যেতে পারে।
জীবনকে টিকিয়ে রাখার বোধ থেকে মানুষ বাঁচতে
চায়, জীবনকে সাজানোর বোধ থেকে মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়। প্রকৃত জীবনবোধ হলে,
উভয়ের সমন্বিত রূপ। শরীর টিকিয়ে রাখার বোধে বেঁচে থাকার একটি গড় মান। মানুষ সর্বভুক
প্রাণী বলে সব খায়, কিন্তু সব মানুষ সব কিছু খায় না। এক্ষেত্রে কি খায়, তার চেয়ে বড়
বিষয় হলো, যা খায় তা তার জীবন টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত কিনা। স্বাভবিক
জীবনযাত্রায় খাদ্যাখাদ্যের বিচারে মানুষ বিষ খাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটার কোনো গড়
মান নেই। কিন্তু ভাত খাবে না গমের রুটি খাবে তার গড় মান হলো শর্করা জাতীয় খাদ্য।
শুকর খাবে না কি গরু খাবে, এ নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে, কিন্তু মূল বিষয়
আমিষের অভাব পূরণ। সেটা অন্য কোন খাদ্য থেকে গ্রহণ করতেই পারে। দেহ টিকিয়ে রাখার
জন্য যে বোধ সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে আছে, তার তাড়নায় ক্ষুধার উদ্রেক হয় এবং মানুষ
খাদ্যগ্রহণ করে।
ধারণা
মানুষের অনুভব থেকে চৈতন্যের বিকাশের ভিতর দিয়ে যে বোধের জন্ম হয়, সেই বোধের ভিতর
দিয়ে মনের ভিতর যে নিজস্ব পরিমণ্ডল তৈরি হয়, সেখানে যে অনুভব স্থিতি লাভ করে,
সেটাই ধারণা। ধারণায় থাকে অজ্ঞাত বিষয়কে বোধের দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌছার চেষ্টা। ফলে
মনের ভিতরে মনের নানা ধরনের ধারণার জন্ম হয়। ফলে ধারণা সত্যের পথে চললেও সত্যকে
চূড়ান্ত রূপে উপস্থাপিত করে না। তারপরেও ধারণার জন্ম না হলে সত্যের দিকে অগ্রসর
হওয়া যায় না। এর শুরু কিন্তু অনুভবের প্রাথমিক সিদ্ধান্তের সূত্রেই। অনুভব যখন
বোধের স্তরে পৌঁছায়, তখন ধারণা এবং সিদ্ধান্তের ব্যাপকতা বাড়ে।
যে কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক যে বোধের জন্ম হয়, তা সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরেই ঘটে। যেমন― দূর থেকে হেঁটে আসা একজন মানুষকে দেখে মনে হলো, একটি মেয়ে হেঁটে আসছে। এই মনে হওয়াটা প্রাথমিক ধারণা। মানুষের মনে বোধের যে পূর্বরূপ রয়েছে, তার বিচারে সহজাত প্রবৃত্তিতে এই জাতীয় বোধের জন্ম হয়। দূরের মানুষকে দৃষ্টির অনুভবের ভিতর দিয়ে, সিদ্ধান্ত নেওয়া লোকটি নারী না পুরুষ, লম্বা না বেঁটে ইত্যাদি। লোকটি যতই কাছে আসতে থাকবে, ধারণার কিছু কিছু অংশ বাতিল হয়ে যাবে একই সাথে সিদ্ধান্তও পাল্টাতে থাকবে। তাই ধারণার সূত্রে যে সিদ্ধান্ত জন্মে, তা পরিবর্তনশীল। লোকটি কাছে এলে, একটি চূড়ান্ত সিদ্ধন্তের ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত বোধের সৃষ্টি হয়। চেতনা, ধারণা এবং সিদ্ধান্তের সূত্রে জন্ম নেয় রূপের। এই সূত্রে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো 'চেতনা ও রূপ' সম্পর্কে। তাই পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো চেতনা ও রূপ।