১
নান্দনিক দশা
নন্দনতত্ত্বে সকল কিছুর মূলে রয়েছে বিচিত্র মানসিক দশার খেলা। এই খেলার এক প্রতিটি
অনুভবের পর্যায়কে আমরা ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে থাকি। ভালো, একটু ভালো, অনেক ভালো- এ
সবই অনুভবের পর্যায়গত নাম। আবার স্বস্তি-অস্বস্তি, আনন্দ-বেদনা, সুন্দর-অসুন্দর
ইত্যাদি অনুভবসমূহের দশাগত বিচারে স্বীকৃতি পায়, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত
অভিরুচির বিচারে। তাই সকল সৌন্দর্য সকলের কাছে সমান মানে স্বীকৃত হয় না।
যদি সাধারণভাবে দশার সংজ্ঞা খোঁজার চেষ্টা করা যায়, তাহলে দেখা যায় যে কোনো
বিষয়বস্তুর একটি স্থিতিশীল অবস্থার কথাই মনে আসে। যেমন ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা
একটি তাপমানগত স্থিতিশীল দশা। এরূপ যেকোনো তাপমাত্রার স্থিতিশীল অবস্থা একটি
স্থিতিশীল দশার সৃষ্টি করবে। কিন্তু যদি কোনো কিছুর তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হতে
থাকে, তখন তো তাকে আর স্থিতিশীল দশায় আছে, এমনটা বলা যাবে না। কিন্তু আমরা যদি এর
সাথে সময় মানকে বিবেচনায় আনি তা হলে, 'স্থিতিশীল দশা'র একটি আশ্রয় তৈরি হয়। ধরা যাক
১০ মিনিট ধরে তাপমাত্রার মান পরিবরর্তনশীল দশায় ছিল। তার অর্থ হলো- 'পরিবরর্তনশীল
দশা' স্থিতিশীল দশায় ছিল ১০ মিনিট।
প্রকৃতিতে একই সাথে বহু ঘটনা ঘটে। আমার যাকে স্থিতিশীল বলি, তখন তা একটি মানের
নিরিখে বলি। ফলে এর সাথে যে সকল পরিবর্তনশীল বিষয় সক্রিয় থাকে তা গ্রাহ্য করি না।
ধরা যাক আপনি ৫মিনিট ধরে একটি গান শুনছেন। অর্থাৎ গান শোনার একটি স্থিতিশীল দশায়
ছিলেন ৫ মিনিট। এই ৫ মিনিট ধরে শিল্পী স্বরের নানারকম পরিবর্তন করেছেন। স্বরের
বিচারে ৫ মিনিট ছিল স্বরের পরিবর্তনশীল দশা।
সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু ঘটে, তারই সবই মূলে থাকে দশার পরিবর্তনের ধারায়।
প্রাকৃতিক নিয়মে সংঘটিত এই দশা হলো প্রকৃত দশা। আর এই প্রকৃত দশার উপর ভিত্তি করে
মানুষের মনোগত পরিবর্তন সাধিত হয় এবং এর দ্বারা উদ্ভূত মানসিক অবস্থা হলো মানসিক দশা।
প্রকৃত দশা মানুষের মানসিক দশার পরিবর্তন ঘটায়। ধরা যাক কোন স্থানের তাপমাত্রা ৪০
ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি প্রাকৃতিক এবং প্রকৃত দশা। মানুষের কাছে এই দশা হবে- 'গরম' বা
অত্যধিক। এই 'গরম' দশা হবে মানুষের অনুভবগত মানসিক দশা। একই ভাবে প্রকৃত দশা যদি ১০
ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে মানসিক দশার মান হবে 'শীত'। ব্যক্তি বিশেষের অনুভূতির
ভিন্নতার কারণে অল্পবিস্তর তাপমাত্রাজনিত পার্থক্যে অনেক সময় মানসিক দশার মান ভিন্ন
হতে পারে। একই তাপমাত্রায় কেউ শীতে কম্পিত হয়, কেউ কেউ সেটাকে শীত হিসেবে গ্রাহ্যই
করে না।
মানসিক দশার নান্দনিক অনুভবগত দশা হলো- নান্দনিক দশা। অর্থাৎ যখন কোনো প্রকৃত দশা
কোনো মানুষকে আনন্দিত করে, তখন তা নান্দনিক হয়ে ওঠে। কিন্তু সকল প্রকৃত দশা সকলকে
সমানভাবে আনন্দ দান করে না। ফলে একই প্রকৃত দশা সমভাবে সকলের কাছে নান্দনিক দশার
সৃষ্টি করে না। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, গদ্যধর্মী কবিতা, প্রতীকী চিত্রকর্ম
ইত্যাদি অনেকের মনে নান্দনিক দশার সৃষ্টি করে না। এরূপ রয়েছে গৃহসজ্জা, খাদ্য,
পোশাক ইত্যাদি বহু বহু বিষয়।