১.৫
অনুভব ও সংবেদন
ইন্দ্রিয়
দ্বারা বাহিত সঙ্কেতসমূহ, মস্তিষ্কের দ্বারা প্রক্রিয়াকরণের
মধ্য দিয়ে যে চূড়ান্ত ফলাফল (output)
হিসেবে প্রকাশিত হয়, 'আমি'
নামক সত্তা তা গ্রহণ করে।
প্রতিটি সত্তার বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রকাশ পায় সত্তাগুণ (attribute)। এই সত্তাগুণের সাথে যখন
মানুষের পরিচয় ঘটে, তখন মনের ভিতরে যে ভাবের আবেশ তৈরি হয়, সাধারণভাবে তাকে বলা হয়
অনুভব (feeling)।
এর দ্বারা
মনোজগতের ভাবগত অবস্থার সৃষ্টি হয়। দশাটি হলো মনোগত দশা। এই দশায় নানা ধরনের নেতিবাচক, ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ ভাবের সৃষ্টি হতে
পারে। ফলে অনুভবকে কখনো বিচার করতে হয়, মনোগত দশার বিচারে, কখনো ইন্দ্রিয় দ্বারা
বাহিত অনুভূতির ভিতর দিয়ে। কার্যত অনুভবের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় এই দুই ধরনের
অনুভূতির সমন্বয়ে। এই আলোচনার প্রাথমিক ধাপে এই দুটি অনুভবকে পৃথকভাবে চেনার চেষ্টা
করবো।
ইন্দ্রিয়-অনুভূতি
মানুষের
জীবনযাত্রায় ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা প্রবল।
ইন্দ্রিয়ভেদে অনুভবের প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন।
অর্থাৎ 'আমি'র কাছে প্রতিটি অনুভূতি পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়।
ধরা যাক, কোনো বস্তুকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা হলো। প্রাথমিকভাবে স্পর্শেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে
বস্তুটি সম্পর্কে কিছু সঙ্কেত মস্তিষ্কে পৌঁছে যাবে। এই সঙ্কেত মস্তিষ্কের বিভিন্ন
তথ্য প্রক্রিয়কের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ফলাফল প্রকাশ করবে। আর এই ফলাফল 'আমি' গ্রহণ
করবে। 'গ্রহণ করবে' কথাটা এই জন্যই বলা যে, অনেক সময় 'আমি' অনেক ফলাফলকে অগ্রাহ্য
করে। যেমন কোনো একজন গভীরভাবে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবছেন, সে সময় তাঁর কাছে আশপাশের
শব্দ, দৃশ্য স্পর্শ ইত্যাদি গৃহীত হয় না। এমন কি চোখ খোলা রেখেও কেউ কিছু দেখে না।
তাই 'আমি' যতক্ষণ না ইন্দ্রিয়বাহিত এবং মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াজাত কোনো তথ্যকে গ্রহণ
করে, ততক্ষণ তা উপেক্ষিত তথ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যা 'আমি' গ্রহণ করবে, তার
মাধ্যম অনুভবের সৃষ্টি হবে।
ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাথমিকভাবে যে সকল বার্তা মস্তিষ্কে পাঠায় তার সমন্বয়ে মনোজগতে
জ্ঞানের উদ্ভব হয়। এর প্রক্রিয়াগত নাম জ্ঞান-প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে
মনোজগত মৌলিক জ্ঞান প্রক্রিয়ায় উন্নীত হয়
(basic cognitive process)। মানুষের ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত বা
জ্ঞাত সকল উপলব্ধি এই প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে উঠে। সাধারণভাবে একে বলা হয় সংবেদন (sensation)।
সংবেদনের প্রক্রিয়াটি চলে মানুষের
স্নায়ুতন্ত্রের সোমাটিক অংশে
(somatic nervous system)।
উল্লেখ্য এটি মানুষের
স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশ। এই অংশের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অংশের সাথে
কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক যোগাযোগ রক্ষা করে। এর ফলে কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক দেহের বিভিন্ন
অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই সংবেদনের কারণে মানুষ
যতধরনের অনুভব লাভ করে, তার সাধারণ নাম অনুভব। কিন্তু এর অন্যান্য অনুভব থেকে একে
পৃথক করার জন্য স্নায়ু-অনুভব বললে সুষ্পষ্ট হয়।
মানুষের দেহের বাইরে থেকে আগত তথ্যের গ্রহণ এবং তা মস্তিষ্কে প্রেরণের যে জৈবিক পদ্ধতি, তারই সমন্বিত নাম হলো ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়ের প্রকরণ বিভাজনে এদের নামগুলো হলো— দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, আস্বাদন ও ঘ্রাণ। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, তাদের উপযোগী কোনো সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছালে, প্রাথমিকভাবে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাই হলো সংবেদন (sensation)। তাই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সূত্রে সৃষ্ট সংবেদনের সংখ্যাও ৫টি। নিচে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সূত্রে পাঁচটি সংবেদনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো।
দর্শন সংবেদন
(vision, visual sensation):
দর্শনেন্দ্রিয়ে সংবেদন তৈরি করে আলোকতরঙ্গ। এই ইন্দ্রিয়ের প্রান্তীয় অংশ চোখ।
বাইরের আলো চোখের
আলোক-প্রবেশ-রন্ধ্র দিয়ে ভিতরের রেটিনা নামক অংশে পতিত হয়। এর ভিতরে কিছু আলো
মানুষের রেটিনাতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রেটিনার এই উত্তেজনার অবস্থাকে বলা হয় আলোকসংবেদন দশা। এই আলো স্নায়ুকোষ দ্বারা বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছালে,
মস্তিস্কে যে অনুভূতির সৃষ্টি করে, তাকে আমরা সাধারণভাবে বলি দেখা। এই দেখার সূত্রে
সৃষ্টি হয় দর্শন-সংবেদন। আলোক তরঙ্গাকারে চলে। এই তরঙ্গের গুণমান অনুসারে আমদের
দর্শন-সংবেদন অংশ নানা রঙের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা
বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একাধিক বর্ণের
আলোকরশ্মির সমাহারকে বর্ণালি (spectrum)
বলে থাকেন।
সকল ধরনের বর্ণ মানুষ শনাক্ত করতে পারে না। মানুষের যে সকল
তড়িৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি দেখতে পারে তাদেরকে বলা হয় দৃশ্যমান বর্ণালি (visibale
spectrum)।
উল্লেখ্য মানুষের চোখ ৭৯০ টেরাহার্জ থেকে ৪০০
টেরাহার্জ কম্পাঙ্ক এবং ৩৮০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সাড়া দেয়।
এটা মানুষের দেখার গড় মান। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী এর বাইরের রঙ দেখতে পারে। যেমন—
মৌমাছি, অনেক পাখি অতিবেগুনী আলো দেখতে পারে। নিচে দৃশ্যমান বর্ণালির উল্লেখযোগ্য
কয়েকটি রঙের কম্পাঙ্গ ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেওয়া হলো।
দৃশ্যামান বর্ণালি সারণী | ||
---|---|---|
|
||
রঙ | কম্পাঙ্ক | তরঙ্গদৈর্ঘ্য |
বেগুনি | ৬৬৮-৭৮৯টেরাহার্জ | ৩৮০-৪৫০ ন্যানোমিটার |
নীল | ৬০৬-৬৬৮টেরাহার্জ | ৪৫০-৪৯৫ ন্যানোমিটার |
সবুজ | ৫২৬-৬০৬ টেরাহার্জ | ৪৯৫-৫৭০ ন্যানোমিটার |
হলুদ | ৫০৮-৫২৬ টেরাহার্জ | ৫৭০-৫৯০ ন্যানোমিটার |
কমলা | ৪৮৪-৫০৮টেরাহার্জ | ৫৯০ -৬২০ ন্যানোমিটার |
লাল | ৪০০-৪৮৪ টেরাহার্জ | ৬২০-৭৫০ ন্যানোমিটার |
আলোকবিজ্ঞানের মতে, বস্তুর পরমাণুর ইলেক্ট্রন এক স্তর থেকে অন্যস্তরে স্থানান্তরের সময় আলোকরশ্মি হিসাবে শক্তি শোষিত বা বিকিরিত হয়। এর ফলে বর্ণালির সৃষ্টি হয়। শক্তি শোষিত হওয়ার জন্য সৃষ্ট বর্ণালিকে বলা হয় অনুজ্জ্বল বর্ণালি (dark spectrum) বা শোষিত বর্ণালি (absorption spectrum)। পক্ষান্তরে শক্তি বিকিরিত হওয়ার জন্য সৃষ্ট বর্ণালি কে বলা হয় বিকিরণ বর্ণালি (emission spectrum) বা উজ্জ্বল বর্ণালি (hight spectrum)।
রঙ (colour, color)
দৃশ্যমান বর্ণালি সারণীতে আমরা যে রঙের নমুনা পাই, তার সবই আমরা কোনো বস্তুর রঙ হিসাবে দেখতে পারি। কোনো বস্তু দেখার জন্য প্রয়োজন তিনটি মৌলিক উপাদান। এই তিনটি বিষয় হলো—
১. যে বস্তুটি দেখা হবে তার উপস্থিতি
২. দেখার জন্য আদর্শ দৃষ্টিশক্তি
৩. দেখার উপযোগী পর্যাপ্ত আলো
প্রথম দুটি শর্ত পূরিত হলে তৃতীয় শর্তটি বিবেচনায় আসবে। রঙের প্রকৃতি নির্ভর করে আলো এবং বস্তুর প্রকৃতির উপর। একটি আপতিত আলো কোনো সুনির্দিষ্ট রঙের হতে পারে। দৃশ্যমান আলোর আদর্শ রূপ হলো— দৃশ্যমান বর্ণালির সকল সদস্য মিলে যে আলো তৈরি করে, তার মিশ্র রূপ। এই বিচারে সূর্যের আলোকেই আদর্শ আলো হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ের বিচারে এর নাম সাদা।কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে— চোখে এসে পড়লে, তখন উক্ত বস্তু দেখা যায়। আর একটি আদর্শ আলো কোনো বস্তু দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে, তখন ওই বস্তু যে রঙে দেখাবে, তাই হবে ওই বস্তুর রঙ। অর্থাৎ বস্তুর রঙই হলো— প্রতিফলিত আলোর রঙ। প্রকৃতিতে আমার বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন রঙে দেখি, এর মূলে রয়েছে বস্তুর নিজস্ব ধর্ম। প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুর আলো প্রতিফলন ও শোষণের ক্ষমতা আছে। যখন একটি আদর্শ আলোর কিছু রঙকে কোনো বস্তু শোষণ করে এবং কিছু রঙকে প্রতিফলিত করে এবং ওই প্রতিফলিত রঙ যখন আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ে অনুভূতি জাগায়, তখন প্রতিফলিত রঙের বিচারে আমরা বস্তুকে ওই রঙে দেখে থাকি। ধরা যাক, একটি বস্তু একটি আদর্শ আলোর নীল রঙ ছাড়া বাকি সকল রঙ শোষণ করছে। এক্ষেত্রে নীল আলো উক্ত বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে চোখে এসে পড়বে। সে কারণে উক্ত বস্তুকে নীল রঙ হিসাবে দেখা যাবে। কোনো রঙই যখন প্রতিফলিত হয় না, তখন তার রঙ হয় কালো। আর সকল রঙের প্রতিফলনে যে অনুভূতির তৈরি হয়, তাকে বলা হয় সাদা।
মূল লাল =FF0000 |
পরিবর্তিত লাল=FE0000 | আরও একটু পরিবর্তিত লাল=FD0000 |
মানুষ তার দর্শনেন্দ্রিয়ের ক্ষমতার দিয়ে যত রঙ দেখে, তার সবগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে নামকরণ করতে পারে না। রঙের সামান্য হেরফের চোখ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত কাছাকাছি দুটি রঙের পার্থক্য মানুষ বুঝতে পারে না। পাশের চিত্রে কাছাকাছি মানের লাল রঙের তিনটি নুমনা দেখানো হলো।
চোখের দেখায় যে সকল রঙকে একই রঙ মনে হয়, বর্ণালি বিশ্লেষণে তা এক নয়। এমন কি একই রঙে ছাপানো কাপড় বা কাগজের রঙ সর্বত্র একই মানের নাও হতে পারে। তারপরেও মানুষ বহু রঙকে আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত করে থাকে। চোখের দেখায় মানুষ মূলত একটি রঙের গড় মানকেই বিচার থাকে। বিভিন্ন ভাষায় এই সকল রঙকে নানা রকম নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে লাল, সবুজ, হলুদ, নীল ইত্যাদি নামে রঙের নামকরণ করার পাশাপাশি কোনো বস্তুর রঙের সাথে তুলনা করে রঙের নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন— কাঠ রঙ, জলপাই রঙ, সোনালি রঙ ইত্যাদি।
রঙচক্র
(colour
wheel)
বর্ণালি অনুসারে রঙের
ক্রম পরিবর্তনের ধারায় যত রঙ পাওয়া যায়, এদের খুব কাছাকাছি রঙ মানুষ আলাদা করে
শনাক্ত করতে পারে না। কিন্তু এই ধারায় অনেকখানি দূরত্ব পেরিয়ে মানুষ আলাদা আলাদা রঙ
হিসেবে শনাক্ত করতে। অবশ্য কিছু কিছু বর্ণান্ধ মানুষ অনেক রঙকে দেখতেই পায়
না। মানুষের দেখার গড় মান অনুসারে রঙের ক্রম পরিবর্তনের ধারাকে চক্রাকারে সাজালে
রঙচক্র পাওয়া যায়। রঙ চক্রে সমদূরত্বে ৩টি রঙ পাওয়া যায়। এই রঙ তিনটি হলো নীল, হলুদ
ও লাল। এই কারণে এই তিনটি রঙকে বলা হয় প্রাথমিক রঙ। বাকি সকল রঙকে বলা হয় মিশ্র রঙ।
হলুদ আর নীল রঙ মিলে তৈরি হয় সবুজ রঙ। অন্যদিকে লাল আর হলুদ মিলে তৈরি হয় কমলা।
রঙিন টেলিভিশনে মৌলিক রঙ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তিনটি রঙকে। এই রঙ তিনটি হলো লাল-সবুজ-নীল [RGB (Red-Green-Blue)]। এইমান বিচার করা হয় ২৫৬টি গাণিতিক মানে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানটি হলো—২৫৫, আর সর্বনিম্ন মান হলো ০। ষোড়শাঙ্কিক (Hexadecimal) মানে এই সঙ্কেত ধরা হয়, যথাক্রমে 0 1 2 3 4 5 6 7 8 9 A B C D F। প্রতিটি রঙের জন্য মোট ৬ অঙ্কের মান ব্যবহার করা হয়। এর ভিতর ৩ জোড়া অঙ্ক ব্যবহার করা হয়, মৌলিক রঙের জন্য। এক্ষেত্রে রঙের সর্বোচ্চ মান ধরা হয় FF। রঙের শূন্যতা অর্থে ব্যবহার করা হয় 00। এক্ষেত্রেও RGB (Red-Green-Blue) সূত্রই অনুসরণ করা হয়।
রঙের মনস্তাত্ত্বিক
বিশ্লেষণ
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে রঙকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ ৩টি হলো−
উষ্ণরঙ: রঙচক্রের হলুদ থেকে থেকে লাল পর্যন্ত পর্যন্ত সকল রঙকে উষ্ণ রঙ বলা হয়। এর কেন্দ্রে রয়েছে লাল। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়। এই কারণে বাহ্যিক দৃষ্টিতে কাছে নিয়ে আসে এবং বড় দেখায়। এর ফলে মনে উদ্দীপনা ও উত্তাপের সৃষ্টি করে। এই কারণে একে উষ্ণ রঙ বলা হয়। মনে সাহস সঞ্চারে লাল রঙ বিশেষ ভূমিকা রাখে। উত্তেজনা সৃষ্টিতে লালকে ব্যবহার করা যায়। লাল থেকে হলুদ পর্যন্ত কমবেশি এই ভাব বজায় থাকে। তবে লাল থেকে রঙটা নীলের বিপরীত দিকে যতটা অগ্রসর হয়, ততটাই লালের সামগ্রিক প্রভাব কমতে থাকে। এই শ্রেণির অন্যান্য রঙগুলোকে যেভাবে বিচার করা হয়, তা হলো−
লালচে কমলা: উষ্ণ, অগ্রগামী, সাহসী এবং শক্তিশালী
কমলা: উষ্ণ, প্রাণবন্ত, আনন্দপূর্ণ, এবং উৎফুল্লপূর্ণ
হলুদাভ কমলা: উষ্ণ, প্রাণবন্ত, আনন্দপূর্ণ এবং প্রফুল্ল
হলুদ: উষ্ণ, প্রাণবন্ত, আনন্দপূর্ণ, সুখদায়ক, বন্ধত্বপূর্ণ এবং প্রফুল্ল
শীতল রঙ: রঙচক্রের বেগুনি থেকে সবুজ পর্যন্ত সকল রঙকে শীতল রঙ বলা হয়। এর কেন্দ্রে রয়েছে নীল। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত ছোট। এই কারণে এই রঙ বস্তুকে দূরবর্তী করে তোলে এবং আকারে ছোটো করে। এই উভয় বৈশিষ্ট্যের ভিতর দিয়ে এই রঙ মনে শান্তভাব জাগিয়ে তোলে। ফলে মন সংযত হয়। ধ্যানের জন্য নীল রঙ মনের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। নীলরঙ মনে রহস্যময়তারও সৃষ্টি করে। নীলের উভয় পাশের দুটি রঙ-এ এর প্রভাব থাকে। তবে তাতে হেরফের থাকে। এই শ্রেণির অন্যান্য রঙগুলোকে যেভাবে বিচার করা হয়, তা হলো−
নীলচে বেগুনি: শীতল, পরিপক্ব, শান্ত ও রক্ষণশীল
বেগুনি: শীতল, মর্যাদাপূর্ণ, রহস্যময়, অবসাদপূর্ণ
নীলচে সবুজ: শীতল, শান্ত, আনন্দময় এবং সংযত
সবুজ: শীতল, শান্ত, আনন্দময়, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সংযত
মিশ্রভাবাপন্ন রঙ: উষ্ণ এবং শীতল রঙের মধ্যবর্তী দুটি রঙকে মিশ্রভাবাপন্ন রঙ বলা যায়। এই দুটি রঙ হলো হলুদাভ সবুজ এবং লালচে বেগুনি। এর ভিতরে লালচে বেগুনি রঙ নীল থেকে বেশি দূরে এবং লালের নিকটবর্তী হওয়ায় উষ্ণতার প্রভাব বেশি থেকে। কিন্তু নীলভাব থাকার কারণে এই উষ্ণতা তীব্রতর হয়ে উঠে না। এতে লালের উত্তেজনা থাকে আবার নীলের রহস্যময়তাও থাকে। উভয় মিলে রঙটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
হলুদাভ সবুজ রঙটি লাল থেকে বহু দূরে। সেই তুলনায় এই রঙটি নীলের কাছে অবস্থিত। এই রঙে নীলের প্রভাব না থাকলেও সবুজের প্রভাব থাকে, ফলে এটি প্রশমিত উষ্ণ রঙে পরিণত হয়। এই রঙটি উত্তেজনাপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক। সবুজের প্রভাবে এই রঙে শান্তভাব থাকে।
রেখা ও রঙ ছবির ছন্দের মূল উপাদান। সচল দৃশ্যের গতি বোঝা যায়, তার চলনের মধ্য দিয়ে। মন না চাইলেই বলতেই হয়, দৃশ্যটির ভিতরে গতি আছে। কিন্তু অচল দৃশ্যের গতি লুকিয়ে থাকে। গতির কারণেই দৃশ্য থাকে অচল, কিন্তু মন থাকে গতিময়। চোখের দেখার গতির স্থিরচিত্রের লুকানো গতি ক্রিয়াশীল থাকে।
শ্রবণ সংবেদন
(auditory
sensation):
শ্রবণেন্দ্রিয়ে সংবেদন
তৈরি করে শব্দতরঙ্গ। সাধারণ অর্থে ধ্বনি হলো শব্দের
(sound)
প্রতিশব্দ মাত্র। এক্ষেত্রে ধ্বনির উৎপত্তি স্থান কোথায় তা বিবেচ্য নয়।
বাংলাতে ধ্বনি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে অবিকৃতভাবে। প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ
অনুসারে তৎসম শব্দ। ধ্বনি {সংস্কৃত
√ধ্বন্
(শব্দ করা) +ই, ভাববাচ্য}। শব্দবিজ্ঞানীদের অভিমত হলো―
কোনো কারণে যখন কোন বস্তু কম্পিত হয়, তখন তার পার্শ্বস্থ মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে।
উক্ত মাধ্যমে এই চাপের কারণেই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে উৎপন্ন তরঙ্গ তার
উৎপত্তি-স্থানের সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের উপর ভর করে কানে এসে আঘাত করলে―
শব্দের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ শব্দতরঙ্গ কান পর্যন্ত পৌঁছায় মাধ্যমের ভৌত
ধর্মকে অবলম্বন করে। কিন্তু এই ভৌতধর্মী সঞ্চালন থেকে প্রাপ্ত শব্দের অনুভূতি হয়ে দাঁড়ায়
জৈবিক ধর্মের অংশ। কানে শব্দতরঙ্গ আঘাত করলে, তা অন্তঃকর্ণ হয়ে মস্তিষ্কের শব্দ
প্রক্রিয়াকরণ অংশে পৌঁছায়। মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াজাতের ফলে যে সার্বিক ফলাফল পাওয়া
যায়, তাকেই আমরা শব্দ হিসাবে বিবেচনা করে থাকি। এক্ষেত্রে বস্তুজগতে ‘শব্দ’ শক্তি
হিসাবে বিবেচিত হলেও, মানুষের কাছে তা একটি অনুভূতি মাত্র।
শব্দ তৈরি এবং তা শোনার জন্য প্রয়োজন তিনটি প্রাথমিক শর্ত পূরণ। এই তিনটি শর্ত
হলো―
শব্দের উৎস, শব্দ প্রবাহের মাধ্যম ও শ্রবণেন্দ্রিয়। একে প্রাথমিক শর্ত বলছি এই জন্য
যে, কোন বস্তু কম্পিত হলেই যে শব্দ শুনতে পাবেন এমন কোন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
এই বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে হলে শব্দের ধর্ম ও মানুষের কানের ক্ষমতা সম্পর্কে জানাটা
আবশ্যক। শব্দতরঙ্গ কানে আঘাত করলে যে, সংবেদনের সৃষ্টি করে, তা হলো শব্দসংবেদন। আর
এই শব্দ যখন মস্তিষ্কের শব্দপ্রক্রিয়ার দ্বারা অনুভূতির জন্ম দেয় এবং তা শ্রবণ
অনুভবে আলোড়িত করে, তখন তা শ্রবণ সংবেদনে পরিণত হয়। এর সাথে যুক্ত থাকে
শব্দ-প্রকৃতি তথা শব্দকম্পাঙ্ক এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা।
স্পর্শন সংবেদন (tectual
sensation):
মানুষের বহিরাবরণ এবং এর সাথে যুক্ত নখ, চুল স্পর্শ করলে, যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়,
তাকেই বলা হয় স্পর্শ সংবেদন। যেহেতু নখ বা লোম ত্বকের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে, তাই
একে অনেক সময় বলা হয় ত্বকজাত সংবেদন
(cutaneous
sensation)।
এই সংবদেনের বাইরের কোনো কিছুর সংস্পর্শে এসে ত্বকের সাথে যুক্ত স্নায়ুকোষ দ্বারা
বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। তাই সংস্পর্শ হলো আদি স্পর্শন সংবেদন। স্পর্শের
প্রকৃতি অনুসারে মস্তিষ্কে এই সংবেদন নানা ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়। এর সাথে যুক্ত
থাকে ভিন্ন ভিন্ন স্পর্শন-মান। এই মান নির্ধরিত হয়, স্পর্শের স্থানের চাপ,
তামামাত্রার মান, বেদনা বা সুখানুভূতি।
কঠিন, কোমল, বায়বীয়, মসৃণ,
কর্কশ ইত্যাদির অনুভূতি। এরূপ রয়েছে, ত্বকের চুলকানি, সুরসুরি ইত্যাদির অনুভূতি। এ
সবই স্পর্শন সংবেদনের অংশ। বেশিরভাগ সময় একাধিক অনুভূতি একসাথে ঘটে। এর পিছনে দেখা
যায় ত্বকের স্নায়ুকোষে আনন্দ, বেদনা, তাপ ও শৈত্য, শুষ্ক ও সিক্তের পৃথক পৃথক বিন্দু আছে। কোনো গরম
দ্রব্য শৈত্যবিন্দুতে স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে না। তাই মস্তিষ্কে যে অনুভূতির
জন্ম দেয় সেটাই বড় কথা। এবং সেটাই স্পর্শন সংবেদন।
এই স্পর্শন সংবেদন থেকে মনোজগতে সৃষ্টি হয় স্পর্শানুভূতি
(touch feeling )।
মানুষের ত্বকে সবচেয়ে বেশি আছে বেদনার বিন্দু। মূলত যে কোনো অস্বস্তিকর অনুভূতির
বিপদজনক অবস্থাকে জানান দেওয়ার জন্য এই বিন্দুগুলি কাজ করে। দেহের নিরাপত্তার জন্য
এই বিন্দুর সংখ্যা বেশি। এর পরে আছে চাপের বিন্দু। এর দ্বারা ত্বকের উপর যে কোনো
ধরনে চাপকে অনুভব করে। বেদনার বিন্দু বেশি বলে, সূক্ষ্ম কোনো কিছুর স্পর্শে মানুষ
চাপ অনুভব করে না বটে, কিন্তু বেদনা অনুভব করে। ত্বকের অনুভবের তৃতীয় অবস্থানে আছে
শৈত্য-অনুভব। আর সবচেয়ে কম অনুভূতি বিন্দু হলো তাপ-বিন্দু। এই কারণে শীতল দ্রব্যের
অনুভব যত গভীরভাবে অনুভব করে, গরমবস্তুর অনুভব ততটা গভীর হয় না।
আস্বাদন
(Gustatory
Sensation):
মুখবিবরের স্বাদ গ্রহণের উপকরণ, খাদ্যদ্রব্যের স্বাদসংবেদী তথ্য সঞ্চালক পথ এবং
স্বাদসঙ্কেত প্রক্রিয়াকরণ ডিভাইস। মূলত মুখের লালা এবং মুখের ভিতরে আগত দ্রব্যের
সাথে রাসায়নিক সম্পর্কের ভিতর দিয়ে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তার সংবাদ জিহ্বার সংবেদন
সৃষ্টিকারী স্নায়ুকোষের দ্বারা সঞ্চালিত হয়ে মস্তিষ্কে অনুভবের সৃষ্টি করে। এই
অনুভবকে স্বাদ বলা হয়। মানুষ খাদ্যগ্রহণের সময় নানা ধরনের স্বাদ অনুভব করে। এর
ভিতরে মৌলিক স্বাদ হলো চারটি। এই চারটি স্বাদ হলো- মিষ্টি, তিতা, লোনা ও টক। এই
চারটি মৌলিক স্বাদের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের যৌগিক স্বাদ। যেমন― মিষ্টি আর
লোনা স্বাদ একত্রে কষা স্বাদ তৈরি করে। ঝাল কোনো স্বাদ নয়। মূলত ঝালের উপাদান মুখের
ভিতরে একধরনের বেদনাদায়ক অনুভবের জন্ম দেয়।
ঝালের উপাদান শুধু মুখে নয়,
দেহের অন্য অংশেও এই উপাদান যুক্ত হলে
বেদনাদায়ক অনুভবের জন্ম দেয়।
স্বাদের প্রধান অঙ্গ হলো- জিহ্বা। এর অগ্রভাগে থাকে মিষ্টি
ও স্নেহ (চর্বিজাত), দুই পাশে থাকে লোনা ও
টক। জিহ্বার গোড়ার দিকে থাকে তিতা। জিহ্বার উপরিভাগে অসংখ্য ছোটো ঊঁচু ঢিপির মতো
থাকে। একে বলা হয় প্যাপিলি
(Papillae)।
কার্যকলাপের বিচারে একে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো―
পিলফর্ম প্যাপিলি (Pilform Papillae): এই প্যাপিলিগুলোতে কোনো স্বাদের বোধ নাই।
ফাঙ্গিফর্ম প্যাপিলি (Fungiform Papillae): এই প্যাপিলিগুলো জিহ্বার সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকে। এই প্যাপলিতে থাকে মিষ্টি স্বাদবোধক কোরক।
ফ্যালিয়েট প্যাপিলি (Faliate Papillae): এই প্যাপিলিগুলো থাকে জিহ্বার দুই পার্শ্ব জুড়ে। এই প্যাপিলিতে থাকে টক ও লোনা স্বাদ-গ্রাহক কোরক।
সারকামভ্যালেট প্যাপিলি (Circumvallate Papillae): এই প্যাপিলিগুলো থাকে জিহ্বার গোড়ার দিকে। এই প্যাপিলিতে থাকে তিতা স্বাদ-গ্রাহক কোরক।
পিলফর্ম প্যাপিলি ছাড়া সকল প্যাপিলিতে স্বাদ কোরক (Taste Bud) থাকে। স্বাদকোরকে থাকে তথ্য সংগ্রাহক কোষ। এই কোষ থেকেই স্বাদ-তথ্য স্নায়ুকোষ দ্বারা বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জিহ্বার মধ্যভাগে কোনো স্বাদের কোরক থাকে না। অন্যান্য স্বাদগ্রাহক কোরক যুক্ত প্যাপিলির দ্বারা যখন স্বাদ-তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখন একই সাথে সকল স্বাদের অনুভব সৃষ্টি হয়। এরপর সকল স্বাদের সম্মেলনে যে যৌগিক স্বাদের অনুভব সৃষ্টি হয়, সেটাই মানুষ অনুভব করে।
ঘ্রাণ সংবেদন
(Olfactory Sensation)
ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে তথ্য সংগ্রাহক উপকরণ হলো নাসিকা। নাকের উপরের দিকে
যে দুটি ছোটো ছিদ্র থাকে, তাতে ঘ্রাণ-তথ্য সংগ্রাহক থাকে, এপিথেলিয়াম নামক থলথলে
পদার্থ দিয়ে আবৃত অংশের ভিতরে। মানুষ যখন নাসিকা পথে বাতাস টেনে নেয়, তখন
ঘ্রাণ-তথ্য সংগ্রাহক স্নায়ুকোষগুলো সেখান থেকে ঘ্রাণ-তথ্য সংগ্রহ করে।
মূলত বস্তুর সূক্ষ্ম উদ্বায়ু অংশ বাতাসের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। যে সকল বস্তু থাকে এই
উদ্বায়ু অংশ বের হয় না, তাদের গন্ধ মানুষ পায় না। আবার উদ্বায়ু অংশ যখন অনেক কম
থাকে, তখনও মানুষ গন্ধ পায় না। সুদনির্দষ্ট পরিমাণের বাতাসের ভিতরে উদ্বায়ু অংশের
ঘনত্বের উপর গন্ধের তীব্রতা সৃষ্টি হয়। কোনো বস্তু থেকে আগত উদ্বায়ু অংশ ঘ্রাণ
সীমার এতটাই নিচে থাকে যে, মানুষ তা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু কুকুর জাতীয় প্রাণী
ওই সূক্ষ্ম পরিমাণ গন্ধও শনাক্ত করতে পারে, এদের ঘ্রাণ-সংগ্রাহক ক্ষমতার গুণে।
মানুষের গন্ধগ্রহণের ভালো মন্দের বিষয়টাও তার দৈহিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাজ
করে। খাবারের গন্ধ দিয়ে খাদ্যগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা যেমন জাগে, তেমনি খাদ্য গ্রহণের
অনাকাঙ্ক্ষাও জাগে। পচা খাবারের গন্ধই আমাদেরকে দৈহিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করার প্রথম
সাবধানবাণী পাঠায়। খাদ্যাখাদ্যের বাইরে গন্ধের সু বা কু ভাব মানুষকে নানাভাবে
উজ্জীবিত করে।
গন্ধ-সংগ্রাহক স্নায়ুকোষের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সাধারণত অবিরত গন্ধ-প্রবাহের
কারণে, ঘ্রাণ-সংগ্রাহক স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কোনো গন্ধের
অনুভব প্রথমে যতটা তীব্রভাবে অনুভূত হয়, ক্রমে ক্রমে তার তীব্রতা কমতে থাকে। অনেক
সময় এই তীব্রতা কমে গিয়ে গন্ধহীন দশায় উপনীত হয়। ধূমপানের গন্ধ পাশের মানুষ যতটা
তীব্রভাবে পায়, ধূমপায়ী তার গন্ধটা প্রায় অনুভবই করে না। কারণ, ধূমপানের কিছুক্ষণের
মধ্যেই তামাকের গন্ধ-গ্রাহী স্নায়ু অবশ হয়ে যায়।
মনোগত
অনুভব
অনুভূতি দ্বারা মনোজগতে নানা
মনোগত-দশার সৃষ্টি হয়। এই দশাসমূহের উদ্ভব ঘটতে পারে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বা
অতীন্দ্রয় কোনো ভাব থেকে। মূলত যে কোনো বিষয় জানার বা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে মনোজগতে
এই দশার (state)
সৃষ্টি হয়। মনোগত এই দশা থেকে কখনো বিশ্বাসজাত বা পরিবেশগত অনুভবের
জন্ম দেয়।
বিশ্বাসজাত অনুভব (impression, feeling, belief, notion, opinion)। প্রকৃষ্টরূপে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানাটা হলো প্রজ্ঞা। এর মধ্য দিয়ে এক বা একাধিক ধারণার জন্ম হয়। এই ধারণা মনোজগতে বিশ্বাসের জন্ম দেয়। এই বিশ্বাস মনোজগতে যে অনুভব সৃষ্টি করে, তাই হবে বিশ্বাসজাত অনুভব।
অনুভাবন-সৌরভ (spirit, tone, feel, feeling, flavor, flavour, look, smell): এই অনুভব পরিবেশের প্রভাবে সৃষ্টি হয়। মনোগত দশা সময়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। মানুষ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। প্রতিটি মানুষ বর্তমান সময়ের পরিস্থিতর ভিতর দিয়ে যায়। এই সময়ের অনুভব বর্তমান কালের দশা। এরূপ হতে পারে বর্ষার অনুভব, যা বর্ষাকালের দশা। এরূপ হতে পারে অতীত কালের দশা। এই দশার সূত্রে একধরনের সার্বিক পরিস্থিতিগত অনুভবের সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মানুষকে কখনো তীব্রভাবে আবেশিত করে। শরৎকালে বসে শীতকালের অনুভাবন-সৌরভ।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নানা ধরনের অনুভব মানুষ পায়। এছাড়া মানুষের দেহাভ্যন্তরীণ অনুভূতি থাকে। এর সাথে থাকে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য নয় এমন অনুভূতি। এই বিচারে অনুভবকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। এই ভাগ দুটি হলো- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ অনুভব ও অতীন্দ্রিয় অনুভব।
জ্ঞাত অনুভব গ্রহণের সময় মানুষ অনেক সময় প্রতারণার শিকার হয়। এক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন: এককাপ চা আপনাকে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আপনি জানেন চা গরমই হবে। সেই কারণে আপনি সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিলেন। দেখলেন, চা-টা ঠান্ডা। এক্ষেত্রে আপনি বিরক্ত হবেন প্রতারিত হওয়ার জন্য। কিম্বা একটি বস্তু যথেষ্ট ভারি মনে করে সজোরে তুললেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় বস্তুটি যথেষ্ট হাল্কা। ফলে আপনার সজোরে তুলবার প্রচেষ্টায় বস্তুটি অনেকটা বেশি তুলে ফেলবেন। এই জাতীয় অনুভব মানুষকে কিছুটা বিব্রত করে।
জ্ঞাত অনুভব
আকাঙ্ক্ষার হেরফেরে নতুন অনুভবের জন্ম দেয়।
ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে লোভনীয় খাবার পরিবেশন করলে আনন্দের অনুভব জাগে।
এক্ষেত্রে ক্ষুধা-অনুভব এবং তার পরিসমাপ্তি তথা
আকাঙ্ক্ষাপূরণ তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দের অনুভূতির জন্ম দেয়। এরপরে জন্ম দেয় তৃপ্তি
ও প্রশান্তি।
স্বাভাবিক ক্ষুধা নিবৃত্তের অনুভব আর প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্ষুধা
নিবৃত্তের অনুভব একই তৃপ্তি ও প্রশান্তি দান করে না। তাই জ্ঞাত
অনুভবই, আকাঙ্ক্ষার হেরফের-এ বিচিত্র অনুভবের জন্ম দেয়। জ্ঞাত অনুভব মানুষের চলার পথকে সহজ করে। কিন্তু
জ্ঞাত অনুভব তীব্রতর হয়ে ধরা দিলে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। কী হবে কী
হতে পারে এ কথা জানার পরও, মানুষ যখন কোনো অনিশ্চয়তার ভিতরে থাকে, তখন
মানুষের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। যদি এর সাথে ভালো-মন্দের কোনো
সম্পর্ক থাকে, তাহলে তা কখনও কখনও মানুষকে সাময়িকভাবে স্থবির করে দিতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেকেরই স্বাভাবিক বুদ্ধি
লোপ পায়। এক্ষেত্রে জ্ঞাত অনুভবের সাথে কিছুটা অনিশ্চিত অনুভব কাজ করে। কী
প্রশ্ন করা হবে, আর সেটা পারবে কিনা, সেটা অজ্ঞাত অবস্থায় থাকে বলেই পরীক্ষার্থী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
অনিশ্চিত অনুভবের ভিতর যখন চিরতরে হারানোর অনুভব কাজ করে, তখন মানুষ অসহায় হয়ে
পড়ে। এর চরমতম অনুভব হলো, মৃত্যুর চিন্তা। মত্যুর পরে স্বর্গ-নরকভোগ হবে কিনা,
বা মৃত্যুর সাথে সাথে তার সত্তার বিলুপ্ত হবে কিনা এসব নিয়ে ভাবার পরিবর্তে
মানুষের কাছে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ
প্রাপ্ত মানুষের ক্ষেত্রে 'সে আর রইবে না' এই অনুভবটাই তাকে স্থবির করে দেয়।
অনিশ্চিত অনুভবের ভিতরে এমন কিছু অনুভব থাকে, যার ভিতরে তার
নতুন করে পাওয়ার অনুভব জাগ্রত হতে পারে। যেমন চোখের সামনে তার বসতবাড়ি পুড়ে
যাচ্ছে সেটা যখন দেখে, তখন তার ভিতর চিরতরে হারানোর অনুভব কাজ করে বটে, কিন্তু
আবার নতুন একটি বাড়ি করার স্বপ্নেরও জন্ম হয়। এই জাতীয় হারানোর অনুভবের তীব্রতাকে হ্রাস
করে দেয় 'আশা'। 'আশা'র মৃত্যু হলে, মানুষ সজীব দেহধারী কফিনে বসবাস করে
মাত্র।
জ্ঞাত অনুভবের ভিতর দিয়ে যে মানুষ বাস্তব স্বপ্ন দেখে, সে বাস্তবতাকে মূল্য
দেয়। কিন্তু মানুষ কল্পনার ভিতর দিয়েও বাস্তবের অনুভবকে পেতে পারে। এই জাতীয়
বাস্তব অনুভব মানুষের চলার পথকে স্থির করে যেমন, তেমনি অবাস্তব স্বপ্ন নিতান্তই
কল্পনা বিলাসী করে তোলে। একজন শিক্ষার্থীর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে থাকে
বাস্তবতার অনুভব। কিন্তু সুপারম্যান হওয়ার স্বপ্ন হলো 'কল্পনা-বিলাস'।
উৎসের বিচারে যেকোনো ধরনের অনুভব তিন ধরনের হতে পারে। এই ধরন ৩টি হলো−
প্রতিটি অনুভবই একটি বার্তা ধারণ করে। এই বার্তা যখন মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়, তখন তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। পরে প্রয়োজন মতো সেই বার্তা স্মৃতি থেকে উত্তোলিত হয়। ধারাবাহিক এই আলোচনার পরবর্তী ধাপে আলোচনা করবো স্মৃতি নিয়ে।