ভাব ও রস

মনোজগতের অন্য একটি প্রধান অধ্যায় হলো ভাব। সংস্কৃত ক্রিয়ামূল Öভূ -এর ভাবগত অর্থ হলো 'হওয়া'। অ (ঘঞ্) প্রত্যয় দ্বারা সম্পাদিত ভাব শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় কোনো কিছু হওয়া।

যে কোনো কারণে মনে যে বিশেষ অনুভবের জন্ম হয়, সেটাই হলো ভাব। মানুষের মনোজগতে যে বিচারালয়
ের সিদ্ধান্তে মনোজগতে নবতর অনুভবের সৃষ্টি হয়। এই অনুভব থেকে জন্ম হয় 'ভাব' নামক দশার। যেমন হাত কেটে যাওয়াটা একটি ঘটনা। এর ফলে মস্তিষ্কে একটি অনুভূতির জন্ম হবে। এই অনুভূতিকে যদি আমার 'বেদনা' বলি, তা হবে একটি অনুভূতির নাম মাত্র। এর ফলে মনে যদি দুঃখবোধের জন্ম হয়, তাহলে তা হবে দুঃখভাব। অনুভব থেকে ভাবের সঞ্চারে ঘটে থাকে কয়েকটি পর্যায়ে। সব সময় যে একই ভাবে সঞ্চার ঘটে তা নয়, তবে ঘটে।

প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো অনুভব একটি নিরপেক্ষ দশায় থাকে। অর্থাৎ একটি অনুভব মস্তিষ্কে একটি মাত্র অনুভূতির জন্ম দে। এর তীব্রতার কম-বেশি হলেও মৌলিকত্বের বিচারে একই থাকে। এর মূলে থাকে স্বস্তি বা অস্বস্তি বোধ। এই বোধের তীব্রতার হেরফেরে স্বস্তি বা অস্বস্তি হেরফের ঘটে। আবার বোধের প্রকৃতি অনুসারে স্বস্তি বা অস্বস্তির প্রকৃতিও পাল্টায়। ধরা যাক একটি বিশেষ দিনে কোনো বিশেষ স্থানে খুব গরম লাগছে। এটি এক ধরণের অস্বস্তি বোধের জন্ম দেবে। আবার কোথাও খুব শব্দ হচ্ছে, সেটা অন্যরকম অস্বস্তির জন্ম দেবে। আবার দুটো ঘটনাই একই সাথে হতে পারে। অর্থাৎ গরমও লাগছে আবার শব্দও বেশি। এক্ষেত্রে অস্বস্তির মিশ্র দশা তৈরি হবে। যে কোনো কারণেই হোক না, বা যতগুলো কারণেই হোক না- ক্ষেত্রে মূল স্তরটি হবে অস্বস্তি। একইভাবে অস্বস্তির বিপরীতদশায় সৃষ্টি হতে পারে স্বস্তিবোধ।

প্রাথমিক স্তরের অনুভবজাত স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের মধ্য দিয়ে ভাবের ভিন্নতর দশা সৃষ্টি হয়। শব্দোচ্চতা দিয়ে বিষয়টি দেখা যাক। প্রতিটি মানুষের শব্দোচ্চতার একটি সাধারণ মান থাকে। এই মানে অভ্যস্থ থাকে বলে, সে একে স্বাভাবিক মান হিসেবে বিবেচনা করে। এর সামান্য হেরফেরকেও সে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে। কিন্তু শব্দোচ্চতা বা শব্দ-নিম্নতা যদি স্বাভাবিক মানের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তাহলে শ্রোতার মনে অস্বস্তিভাবের জন্ম হবে। কিন্তু এখানে শ্রোতা বিষয়ানুসারে স্বস্তি-অস্বস্তিবোধকে বিবেচনা করতেই পারে । প্রেয়সীর কথা ফিস্‌ফিসানিতে ভালো লাগে, আর কনসার্টের গান উচ্চশব্দমানে ভালো লাগে। এর উল্টো হলেই বরং অস্বস্তির জন্ম নেবে। এরূপ দুলাভাই শালা ডাকলে মানা যায়, বন্ধুরা বললে হয়তো আরও ভালো মানিয়ে যায়, কিন্তু শত্রু বললে আর মানা যায় না। এরপর যদি 'শালার বেটা শালা' বলা যায়, তাহলে মাথায় বাড়ি দেওয়ার দশায় চলে যেতে হয়।

স্বস্তি-অস্বস্তির সূত্রে যে আনন্দ-বেদনার জন্ম হয়, তার সমন্বিত রূপে যে সুন্দর -অসুন্দরে অনুভবের জন্ম হয় তার সার্বিক বিচারে মাপকাঠিতে ভিন্নস্তরের ভাবের জন্ম হয়। যদিও এই মাপকাঠি সকল ব্যক্তির জন্য এক নয়। কিন্তু সবার জন্য মাপকাঠি আছে। এই মাপকাঠির হেরফেরে একজন অল্প শোকে কাতর হয়, অন্যজন অল্পশোকেই পাথর হয়ে যায়।

যখন কেউ তার প্রিয় খাবার খায়, তখন সার্বিক অনুভূতির বিচারে তার মনে একটি পরিতৃপ্তির ভাব আসে। সেখানে আলাদা করে খাবারের উপাদানগুলোর চেয়ে সামগ্রিক খাদ্যের গুণমানটা বিচার করা হয়। এর সাথে অতীতের এই জাতীয় খাদ্যগ্রহণের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ইত্যাদি মিলেই পরিতৃপ্তির ভাবটা আসে। অনেক সময় কোনো খাবারের আসর ছেড়ে যাওয়ার পর শোনা যায়, 'খাবারটা ভালো ছিল, কিন্তু গরমের জন্য মজা করে খেতে পারলাম না'। এখানেই পরিতৃপ্তির ঘাটতি ঘটবে।
ভাবের এই দশায় অনুভবটা গৌণ, ঘটনার সার্বিক মূল্যায়নটাই মূখ্য।

এই সার্বিক মূল্যায়নের সূত্রে যে বিশেষ অনুভূতির জন্ম হয়, তা ভাবের একটি রূপ। কখনো কখনো একাধিক ভাব যুগপৎ কাজ করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে, বিজয় দিবসে একজন মানুষ কাঁদছে স্বাধীনতা লাভের আনন্দে। একই সাথে কাঁদছে কিছু প্রিয় মানুষের মৃত্যুর বেদনায়। কখনো কখনো বড় বড় সুখবোধের কাছে ছোটো ছোটো দুঃখ বোধ ম্লান হয়ে যায়। ছোটো বেলায় গ্রামের এক লোককে দেখেছেলাম, বিলে দল ধরে মাছ ধরতে গিয়ে সে বিশাল এক বোয়াল মাছ ধরেছে। কিন্তু লুঙ্গিটার অনেক খানি ছিড়ে গেছে। কিন্তু তার মাছ ধরার আনন্দ যে সুখবোধের জন্ম দিয়েছিল, তা লুঙ্গি ছেঁড়ার দুঃখবোধকে ম্লান করে দিয়েছিল।
 

মানুষের যে সকল গুণাবলি নিয়ে মানুষ হিসেবে বিরাজ করে, তার সব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মনুষ্য-ধর্ম। মানুষের চেতনার জগতে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, তা মনুষ্য ধর্মের অংশ। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তার অস্তিত্ব ধারণ করে আছে জিন সঙ্কেত। এর ভিতর দিয়ে মানুষ যত ভাব পায়, তা তার অস্তিত্বেরই অংশ। ক্রমবিবর্তনের ধারায়, মানুষের ভাবের জগৎ সম্প্রসারিত হয়েছে। আধুনিক মানুষের কাছে ভাবের প্রাপ্তি ঘটে নানাভাবে। তবে কিছু ভাবকে প্রধান বা মৌলিকভাব হিসেবে ভাবা যায়। যেমন

অনুভবের ভিতর দিয়ে মনে তৈরি হয় স্বস্তি-অস্বস্তির ভাব। এই ভাবের একটি দশা হলো আনন্দ। বহুবিধ আনন্দের সংমিশ্রণে যে সৌন্দর্যের সৃষ্টি, তা গ্রহণ করার চেতনাগত বোধই হলো সৌন্দর্যবোধ। অনুভব ও চেতনা, সত্য, রুচি ইত্যাদি নিয়ে যে সৌন্দর্যের জগৎ তৈরি হয়, তার ভিতরেই আমাদের বাস। সে জগতে কখনো 'আমি' স্রষ্টা, কখনো ভোক্তা। এরই ভিতরে রয়েছে 'আমি'র সৌন্দর্যবোধ। অন্যভাবে বলা যায় সুন্দর করে জীবনকে উপভোগ করার বোধই হলো সৌন্দর্যবোধ। প্রকৃতির কোনো উপাদানই সুন্দর নয়। সুন্দর বলে 'আমি' যাকে গ্রহণ করে তাই সুন্দর। প্রতিটি মানুষের ভিতরে আনন্দ পাওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা আছে, তার ভিতরেই রয়েছে সৌন্দর্যবোধের প্রাণভোমরা। তাই আনন্দের এবং আনন্দসমূহের সংমিশ্রণে সৃষ্ট সৌন্দর্যের সবকিছুই সৌন্দর্যবোধের ভিত্তি গড়ে দেয়। এর কিছু সহজাত, বাকিটা অর্জিত বা চর্চিত।

বাস্তবে বা সৃজনশীল কর্মে মানুষের মনে অসংখ্য ভাবের জন্ম হতে পারে। এর সবগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে নামকরণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। প্রাচীন ভারতেরা ঋষিরা ভাবকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগ তিনটি হলো- সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। এর ভিতরে সকল ভাব মনে স্থায়ীভাবে থাকে না। প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকাণ্ডের ভিতরে সৃষ্ট অসংখ্য ভাবের ভিতরে কিছু ভাব মনে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ভাব ও রসের বিচার
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ্বিতীয় শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দের মধ্য ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে আকর গ্রন্থাদির ভিতরে- নাট্যশাস্ত্রকে প্রাচীনতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থটির প্রধান বিষয় নাট্যাভিনয় এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিবিধ বিষয়। অভিনয়ের অংশ হিসেবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সঙ্গীতের মৌলিক কিছু ধারণা। এই গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ির নাম রসবিকল্প এবং সপ্তম অধ্যায় ভাবব্যঞ্জক।

এই দুটি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের পারিভাষিক শব্দ। এই শব্দগুলোর সংজ্ঞাভিত্তিক অর্থ জানা না থাকলে, এই দুটি অধ্যায় বুঝতে গেলে পদে পদে বাধা পেতে হয়। বিশেষ করে যখন এই পারিভাষিক শব্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ নিয়ে উপস্থিত হয় তখন, বিষয়টা আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠে। তাই শুরুতে আমি এই পারিভাষিক শব্দগুলোর বিশেষ অর্থ এবং এর শ্রেণিকরণ করার চেষ্টা করবো।

নাট্যশাস্ত্রের রসবিকল্প
নাট্যশাস্ত্রের ষষ্ঠ অধ্যায়টি রসবিকল্প। এর সম্পূরক অধ্যায়টি হলো- 'সপ্তম অধ্যায়, ভাবব্যঞ্জক। এই দুটি অধ্যায় থেকে রস এবং এর প্রাসঙ্গিক অংশসমূহকে বিশেষভাবে জানা যায়। ষষ্ঠ অধ্যায়ের অষ্টরস অংশে নাট্যশাস্ত্রকার উল্লেখ করেছেন- 'শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত সংজ্ঞক এই আটটি নাট্যরস বলে কথিত'। এই রসগুলো আটি স্থায়িভাব (রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, জুগুপ্সা ও বিস্ময়) থেকে উদ্ভব হয়। 

কাব্যশাস্ত্রের রসসমুহের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১. শৃঙ্গার: শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার। ভরতমতে রতি নামক স্থায়ীভাব থেকে শৃঙ্গার রসের উদ্ভব। শৃঙ্গার থেকে হাস্য রসের উৎপত্তি হয়। এই মতে শৃঙ্গারের যে অনুকরণ, তাই হাস্য। এই রসের দেবতা বিষ্ণু আর বর্ণ শ্যাম।

এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই
সাধারণভাবে শৃঙ্গার ভাব তাকেই বলা হয়। বাস্তবজগতে নায়ক-নায়িকার প্রেম নিবেদন বা প্রকাশে অনুভবের সঞ্চার হয়। কিন্তু শিল্পজগতে নায়ক-নায়িকার প্রেম নিবেদন বা প্রকাশক উপস্থানে যে ভাবের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে শৃঙ্গার রসের উদ্ভব হয় উল্লেখ্য, এসবই ঘটে শিল্পের সৃজনশীল অঙ্গনে।

নৃত্যে, গানে, কাব্যে
শৃঙ্গার রস উপস্থাপিত হয়ে থাকে রতি-কামনার তীব্রতায়। যা শ্রোতা-দর্শকের মনোজগতে দ্বিতীয় স্তরে কামনার ভাবকে জাগ্রত করে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কাব্য, মদনদেবতার করুণায় চিত্রাঙ্গদা সর্বাঙ্গসুন্দরী হয়ে উঠার পর, অর্জুনের মনে যে ভোগের তৃষ্ণা জাগ্রত হয়, তা তার স্বগোক্তির ভিতর দিয়ে ফুটে উঠে, এ ভাবেই-

   এ কী তৃষ্ণা, এ কী দাহ!

এ যে অগ্নিলতা পাকে পাকে

    ঘেরিয়াছে তৃষ্ণার্ত কম্পিত প্রাণ।

                   উত্তপ্ত হৃদয়

ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া

আপাত দৃষ্টিতে একে শৃঙ্গার রসের একটি রূপ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু নাট্যশাস্ত্রে শৃঙ্গার আরও মহত্তম বিষয়। নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে- যা কিছু শুভ্র, পবিত্র, সুদর্শন তার সাথে শৃঙ্গারের তুলনা করা হয়। তাই যদি হয়, তাহলে শৃঙ্গার হবে নরনারী তীব্র ভালোবাসার ভিতর দিয়ে উদ্ভুত রস। যখন শুভ বা কল্যাণ অর্থে 'ভালো' আর বাসনা বা কামনা অর্থে 'বাসা'। এই অনুভবের ভিতর দিয়ে ভালোবাসা হয়ে উঠে কল্যাণকর কামনা। নরনারীর ভিতরে পরস্পরের কল্যাণকর কামনার ভিতর দিয়ে যখন ভালোবাসা নামক অনুভবের উদ্ভব হয়, তখন তা রতিকামনা একটি অংশ হয়ে ওঠে । মানুষের সহজাত জৈবিক কামনাকে সুন্দরভাবে উপভোগ হয়ে উঠে শৃঙ্গারের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা স্বার্থযুক্ত যৌনাচার শৃঙ্গার নয়। একই কারণে ধর্ষণ, বেশ্যবৃ্ত্তি, পর্ণচিত্র ইত্যাদি যৌনতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ বটে, বাস্তবতার নিরিখে তা শৃঙ্গার রসে অধিষ্ঠান পায় না। একই বিষয় িল্পের সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে রতি ভাবই শৃঙ্গার রসে পরিণত হয়। শুভ্রতার বিচারে রসের অধিষ্ঠান হয় সম্ভোগ এবং বিপ্রলম্ভ দশায়। 

ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রে কামভাবের সূত্রে নরনারীর যৌন-আচরণ বা যৌন-ইচ্ছাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নায়ক-নায়িকা। অলঙ্কারশাস্ত্রের মূল বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, সহজাত প্রবৃত্তির সূত্রে মনের ভিতর জেগে উঠতে পারে, নানা ধরনের অনুভব। যৌবনের প্রারম্ভে যে যৌনকামনা দেহ এবং মনে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠে, তা ঘটে জীবের ক্রবমিকাশের ধারায়। এই ধারায় জীবের ভিতরে কামভাব স্বাভাবিকভাবেই জাগ্রত থাকে। কখনো কখনো সুপ্ত কামনা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় জাগ্রত হয়ে উঠে। সুদর্শনা কোনো নারীকে দেখে যে কামভাব জাগে, তা প্রত্যক্ষ। কিন্তু কোনো কাব্য পাঠের ভিতর দিয়ে নারীর যে রূপ ওঠে এবং এর দ্বারা যে কামভাব জাগে তা সহজাত এবং অপ্রত্যক্ষ। ভরত মুনির একে বলেছেন 'বিভাব'। বিভাবের বিষয়টি ঘটে অপ্রত্যক্ষভাবে, তাই অতীন্দ্রিয়। মানুষের ভাবনা কল্পজগতের সম্ভব-অসম্ভবের ধার ধারে না। গল্পের রাজকন্যার প্রেমে পড়ে, তার সাথে মনে মনে অনেক কিছু করা সম্ভব। যে নারীকে অবলম্বন করে কামভাব জাগ্রত হয়, সে নারী আবলম্নন। আর এর সাথে যে সকল উপাদান সহায়ক ভূমিকা রাখে, তা হলো উদ্দীপন। বাসর ঘরে নববধূ আবলম্বন, আর নিরাপদ নিভৃত কক্ষ,পুষ্পশয্যা ইত্যাদি হলো উদ্দীপন। আবলম্বন বা নায়িকার সৌন্দর্যকে চিত্তগ্রাহী করার জন্য যে সকল উপাদনকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করার কথা বলা হয়, তাকে বলা হয়, সাত্ত্বিক অলঙ্কার। আলঙ্করিক ধনঞ্জয় অলঙ্কারকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো

  • দৈহিক অলঙ্কার: 

    • ভাব (সম্ভোগের জন্য নায়িকার চিত্তে যা মনোবিকার ঘটে। যার ভিতর দিয়ে নায়িকার আগ্রহ প্রকাশ পায়)

    • হাব (চক্ষু, গ্রীবা, ভুরু ইত্যদির বিকারের দ্বারা নায়িকা কামনাকে প্রকাশ করে। কিন্তু নায়িকা উদ্যোগী হয়ে অগ্রগামী হয় না)

    • হেলা (এই ক্ষেত্রে সপ্রেম হাসি, খেলাচ্ছলে কম্পিত স্পর্শ ইত্যাদির দ্বারা সম্ভোগ ইচ্ছার প্রকাশ)

  • স্বভাবজাত:

    • শোভা (আভরণ এবং অন্যান্য সাজসজ্জা দ্বারা নায়িকার যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়)

    • শান্তি (কাম নিবৃত্তিতে চিত্তে সহজাত প্রশান্তি জন্মে)

    • দীপ্তি (নায়িকার স্বাভাবিক যৌবনশ্রী )

    • মাধুর্য (নায়িকার স্বাভাবিক যৌবনলাবণ্য)

    • প্রগভলতা (নায়িকার বাক্যচাতুর্য্য, অগম্ভীর আচরণ, হেয়ালি ইত্যাদি)

    • ঔদার্য (নায়িকার ক্ষমাগুণ, সামান্য ত্রুটিকে মেনে নেওয়া ইত্যদি গুণ)

    • ধৈর্য (যে কোনো সঙ্কটে নায়িকার স্থির দশা, বা সুসময়ের অপেক্ষা করার ক্ষমতা)

  • মনোভাব সঞ্জাত: লীলা, বিলাস, বিভ্রম, ললিত, প্রণয়ভাব, কৃত্রিম ক্রোধ, ঔদাসিন্য। এই অলঙ্কারগুলো মনোজগতে নানা ধরনের বিকারের প্রকাশ। অন্যান্য আলঙ্করিকদের মতে, মনোভাব-সঞ্জাত অলঙ্কারের সংখ্যা আরও বেশি।

. হাস্য:  হাস স্থায়িভাব থেকে উদ্ভব হয়ে থেকে হাস্য রস। কৌতুকজনক বাক্য, অঙ্গভঙ্গী, সাজসজ্জা, ইত্যাদির দ্বারা মনে হাস্য-কৌতুকের দশা সৃষ্টি হয়। এর স্থায়ী ভাব হাস।  ভরতমতে শৃঙ্গার থেকে হাস্য রসের উৎপত্তি হয়। এই মতে শৃঙ্গারের যে অনুকরণ, তাই হাস্য। এর বর্ণ সাদা এবং দেবতা প্রমথ। হাস্য রসের প্রকাশ ঘটে দুই ভাবে। এর একটি আত্মস্থ, অপরটি পরস্থ।

  • আত্মস্থ: যখন নায়ক-নায়িকা নিজেই হাসেন, তখন তা হয় আত্মস্থ।
  • পরস্থ: যখন নায়ক-নায়িকা অপরকে হাসান, তখন তা হয় পরস্থ।

হাসি একটি ক্রিয়াত্মক বিষয়। নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটতে পারে। ভারতীয় শাস্ত্রে এর বাহ্যিক প্রকাশকে ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো- স্মিত, হসিত, বিহসিত, উপহসিত, অপহসিত, অতিহসিত। মনুষ্য প্রকৃতি অনুসারে এই হাসিগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো- উত্তম, মধ্যম এবং অধম।

হাস্যের প্রকরণগত তালিকা

  • স্মিত: এই জাতীয় হাসিতে গণ্ডস্থল ঈষৎ বিকশিত হয়, সৌষ্ঠবযুক্ত কটাক্ষ লক্ষ করা যায় হাসির সময় এদের দাঁত দেখা যায় না। এই হাসি উত্তম প্রকৃতির মানুষের।
  • হসিত: মুখমণ্ডল উৎফুল্লিত থাকে, চোখ ও গণ্ড হাসির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। হাসির সময় সামান্য দাঁত দেখা যায় এই হাসি উত্তম প্রকৃতির মানুষের।
  • বিহসিত: চক্ষু ও গণ্ডস্থল আকুঞ্চিত হয়। হাসির সময় মধুর আনন্দ-ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই হাসিটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। মুখমণ্ডলে উৎফুল্ল ভাব থাক। এই হাসি মধ্যম প্রকৃতির মানুষের।
  • অবহসিত: হাসির সময় নাসিকা উৎফল্ল হয়, হাসির সময় বক্রদৃষ্টিতে অবলোকন করে। একই সাথে মস্তক ও স্কন্ধ অবনত হয়। এই হাসি মধ্যম প্রকৃতির মানুষের।
  • অপহসিত: অস্থানে হাস্য (যেখানে হাসার কথা নয়, সেখানে হাস্য করা), চক্ষু অশ্রুপূর্ণ (হাসির সময় চোখে জল চলে আসে), স্কন্ধ ও মস্কক অতিমাত্রায় কম্পিত হয়। এই হাসি অধম প্রকৃতির মানুষের।
  • অতিহসিত: চক্ষু সংরব্ধ (ক্রোধ, উৎসাহ, অহঙ্কার প্রকাশ পায়), ণ্ঠস্বর তীব্র ও উদ্ধত হয়। এই হাসির সময় হাত পার্শ্বদেশে স্থাপিত হয় এই হাসি অধম প্রকৃতির মানুষের।

বাস্তবে হাসির সাথে মুখভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটে এবং কোনো কোনো হাসিতে অঙ্গের কম্পন ও বিক্ষেপ ঘটে। কিন্তু হাসির সাথে শব্দ ও শব্দহীনতার বিষয়টি আসে। হাস্য শব্দটি শুনলে মধুর হাসির কথা মনে হয়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তেমনটা নাও হতে পারে। হাসি কর্কশও হতে পারে। আমরা তো হাসির শব্দের বিচারে অনেক সময় বলি ভুতের মতো হাসি, দানবের মতো হাসি, খলনায়কের হাসি ইত্যাদি। আচরণের বিচারে অনেক সময় বলি চোরের মতো হাসি। নাট্যশাস্ত্রকার এই বিচারে কিছু হাস্যকে বিপরীত অলঙ্কার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিকৃত আচার, কথা, বেষ, বিকৃত, অঙ্গভঙ্গী'র কারণে সৃষ্ট রসকে হাস্য হিসেবে গণ্য করেছেন।

তাই নাট্যশাস্ত্রকার হাস্যরসের বিভাব, অনুভাব, ব্যভিচারী হিসেবে নানা কিছু উল্লেখ করেছেন।

হাস্যের বিভাব: বিকৃত বেষ, অলঙ্কার, ধৃষ্টতা, লোভ, কুহক, অসৎ প্রলাপ, বিকলাঙ্গদর্শন, দোষখ্যাপন প্রভৃতি।

হাস্যের অনুভাব: ওষ্ঠদংশন, নাসিকা ও গণ্ডস্থলের কম্পন, নেত্রের বিস্তার ও আকুঞ্চন, ঘর্ম, মুখরাগ, পার্শ্বদেশে হস্তস্থাপন প্রভৃতি।

হাস্যের ব্যভিচারী: আলস্য, অবহিত্থা, তন্দ্রা, নিদ্রা, স্বপ্ন, জাগরণ ও অসূয়া।

  • তনু ব্যভিচার: অশ্রু, বিবর্ণ, হাস, স্বরভঙ্গ।
  • মন-ব্যভিচার:  আবেগ, গর্ব, চপলতা, বিতর্ক, মতি, মদ, স্মৃতি হর্ষ।
৩. করুণ: শোক স্থায়িভাব থেকে করুণ রসের উদ্ভব হয়। এই শোক হতে পারে প্রিয়জনের হত্যা দর্শন, অপ্রিয় বাক্য ইত্যাদির থেকে। মূলত শোকের ভাব এতে প্রকাশ পায়। 
  • করুণ রসের অনুভাব: স্বেদ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ, বিবর্ণ ও অশ্রু।
  • করুণ রসের ব্যভিচার:
    • তনু ব্যভিচার: অশ্রু, ঘাম, বিবর্ণ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ ।
    • মন-ব্যভিচার:  অবহিত্থা, অসূয়া, উৎকণ্ঠা, ক্রীড়া, চিন্তা, ত্রাস, দৈন্য, বিষাদ, ব্যাধি, মরণ, শঙ্কা, শ্রম, স্মৃতি, স্বপ্ন। 

কাব্য করুণ রসের নমুনা

কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা
সজল আঁখি সখীরে;
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
           -মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন

৪. রৌদ্র: ক্রোধ স্থায়িভাব থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। তাই ক্রোধকে বলা হয় রৌদ্রের স্থায়ীভাব। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। ভরতমতে এর বর্ণ রক্ত ও দেবতা রুদ্র। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: কম্প, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, প্রলাপ।
  • মন-ব্যভিচার:  অমর্ষ, অসূয়া, আবেগ, উগ্রতা, গর্ব, বিতর্ক, বিরোধ, মতি, মদ, স্মৃতি।

শিল্পের নানা মাধ্যমে রৌদ্র রসের উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। নৃত্যে ও নাটকে এর উপস্থাপন করেন দৈহিক অভিনয়ের মাধ্যমে। সঙ্গীতে এর উপস্থাপন হয় শব্দের মাধ্যমে। কণ্ঠসঙ্গীতে এই রস পাওয়া যায় বাণী ও সুরের সংমিশ্রণে। কাব্যে এর রূপ ধরাপড়ে ছন্দেবন্ধে।  যেমন

কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা
সজল আঁখি সখীরে;
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
           -মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন

"কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
                -মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন

. বীর: উৎসাহ স্থায়িভাব েকে এই রসের উৎপত্তি হয়। দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়। ভরতমতে বীরের কর্মফলই অদ্ভুদ রস। এর বর্ণ গৌর এবং দেবতা মহেন্দ্র।

এই রসে একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা।  ভয়ানক, শান্ত রস বিরোধী। এর স্থায়ীভাব উৎসাহ। 

বীররসকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো
দান, ধর্ম, যুদ্ধ ও দয়া। মূলত এই চারটি হলে বীরের প্রধাম গুণাবলি। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: অশ্রু, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, সংমোহ।
  • মন-ব্যভিচার:   অমর্ষ, আবেগ, উগ্রতা, ধৃতি, বিতর্ক, বিরোধ, মতি, মদ, স্মৃতি, হর্ষ। 

কাব্যে বীররসের নমুনা

বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
সুগ্রীব; "মরিব, নহে মারিব রাবণে,
এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
                -মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদন

৬. ভয়ানক: ভয় স্থায়িভাব থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, সে ভাব থেকেই ভয়ানক রসের উদ্ভব হয়। ভরতমতে বীভৎস থেকে ভয়ানক রসের উৎপত্তি হয়। ভরত মতে যা বিভৎস তাই ভয়ানক। এর বর্ণ কৃষ্ণ, দেবতা কাল।  সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: অশ্রু, কম্প, ঘাম, স্তম্ভ, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, প্রলাপ।
  • মন-ব্যভিচার:  অপস্মার, আবেগ, ক্রীড়া, চিন্তা, ত্রাস, দৈন্য, বিষাদ, শঙ্কা, শ্রম, স্মৃতি।

৭. বীভৎস: জুগুপ্সা স্থায়িভাব েকে বিভৎস রসের সৃষ্টি হয়।  ভরত মতে যা বিভৎস তাই ভয়ানক। বীভৎস রসের বর্ণ নীল এবং দেবতা মহাকাল। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: রোমাঞ্চ, প্রলাপ।
  • মন-ব্যভিচার:   অমর্ষ, আবেগ, উগ্রতা, ব্যাধি।

৮. অদ্ভুত: বিস্ময় স্থায়িভাব থেকে এই রসের উদ্ভব হয়। আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভূত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ অলৌকিক বা অসমাঞ্জস্য বিষয় থেকে এই রস উজ্জীবিত হয়। এর বর্ণ পীত ও দেবতা ব্রহ্মা।

এর স্থায়ী ভাব বিস্ময়।  সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: কম্প, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ।
  • মন-ব্যভিচার:  অসূয়া।

কাব্যে অদ্ভুত রসের নমুনা

"সবিস্ময়ে রঘুনাথ নদীর উপরে
হেরিলা অদ্ভুত সেতু, অগ্নিময় কভু,
কভু ঘন ধূমাবৃত, সুন্দর কভু বা
সুবর্ণে নির্ম্মিত যেন! ধাইছে সতত
সে সেতুর পানে প্রাণী লক্ষ লক্ষ কোটি
হাহাকার নাদে কেহ; কেহ বা উল্লাসে!
                -মেঘনাদ বধ, অষ্টম সর্গ। মধুসূদন

৯. শান্ত: এর স্থায়ীভাব শম। চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়। এর বর্ণ কুন্দেন্দুসুন্দর, দেবতা নারায়ণ। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো

  • তনু ব্যভিচার: অশ্রু, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ।
  • মন-ব্যভিচার:  ধৃতি, নিদ্রা, নির্বেদ, মতি, স্মৃতি, হর্ষ।

১০. বাৎসল্য: সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য রস।

বর্তমানে অনেকেই শান্ত ও বাৎসল্যকে প্রধান রস হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন।

চৈতন্য ও তাঁর শিষ্যদের রস ভাবনা
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টরস দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকলে, শ্রীচৈতন্য একটি নতুন রসের অবতারণ করেছিলেন। চৈতন্য অনুসারীরা একে বলে থাকেন ভক্তিরস। কথিত আছে প্রয়াগে অবস্থানকালে চৈতন্য রূপ গোস্বামীকে এই বিশেষ রসের শিক্ষা দিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যে ভক্তিরস সম্পর্কে বলেছিলেন- শুদ্ধ ভক্তি থেকে প্রেম উৎপন্ন হয়। শুদ্ধভক্তিতে-  হরি ছাড়া অন্য আকাঙ্ক্ষা বা পূজা করা যাবে না। শুষ্ক জ্ঞানকর্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে এই রসের সাধনা করতে হয়। চৈতন্যের মতে- ইক্ষুরস যেমন ঘনীভূত হয়ে গুড় তৈরি করে। তেমনি সাধন ভক্তি থেকে রতির উদয় হয়। রতি গাঢ় হলে প্রেমের উদ্ভব হয়। আবার প্রেমের বৃদ্ধিতে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব. মহাভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে। এগুলো ভক্তিরসের স্থায়ভাব। এর সাথে যখন বিভাব, অনুভাব এবং মনের একাগ্রতা মিলিত হয়, তখন তা অমৃত মধুর হয়ে ওঠে। রতি নামক স্থায়ীভাব থেকে ভরতের শৃঙ্গার রসের উদ্ভব হয়। কিন্তু রতির গাঢ়তর ভাব থেকে উদ্ভব হয় ভক্তি রস।

ভক্তের প্রকৃতি ভেদে রতিভেদ পাঁচ প্রকার। এগুলো হলো- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মাধুর্য। চৈতন্যদেবের মতে- হাস্য, অদ্ভুত, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস রস গৌণ। ভক্তি রসের এই পাঁচটি প্রকরণই প্রধান।
[তথ্যসূত্র: চৈতন্য ও তাঁহার শিষ্যগণ। তত্ত্ববোধিনী 'পৌষ ১৮১২ সংখ্যা]
১৫৯ পৃষ্ঠা

নন্দনতত্ত্বে রস
নন্দনতত্ত্বের বিচারে বলা যায়,
রস হলো সৃজনশীল কর্মের এমন একটি বার্তা, যা তথ্যগ্রাহকের কাছে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উপস্থাপিত হয়। রসনার বিচারে
রসের আক্ষরিক অর্থ হলো আস্বাদনীয় বা রসনাগ্রাহ্য গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। এগুলো হলো মধুর, অম্ল, লবণ, কটু, কষায়, তিক্ত। বাস্তব জগতের এই ভাব রসনার বাস্তব অনুভূতি উপস্থাপন করে। সৃজনশীল কর্মে রসের রূপ ভিন্নতর। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি দশা মাত্র। বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের অধীন। ওই আনন্দসমূহের সুসমন্বিত তরঙ্গপ্রবাহে সৃষ্টি হয় সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মনোজগৎকে নানাভাবে আলোড়িত করে। ফলে মনোজগতে নানা ধরনের ভাবের সৃষ্টি হয়। এই ভাবের অস্তিত্বগত অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব। এই ভাব যদি সৃজনশীলকর্মের মাধ্যমে শ্রোতার মনকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে যায় রস।

ধরা যাক, একটি শব্দ কেউ শুনছেন। প্রাথমিকভাবে এই শোনাটা হবে শ্রোতার কাছে শ্রবণেন্দ্রিয়ের ভিতর দিয়ে শব্দের অনুভব। এই অনুভবটা মনে কি ধরনের অনুভূতির জন্ম দেবে, তা নির্ভর করবে 'আমি'র গ্রহণ করার ক্ষমতার উপর। এই শব্দ 'আমি'র কাছে স্বস্তিকর বা অস্বস্তিকর হতে পারে। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি অনুভব 'আমি'কে যে অনুভূতি প্রদান করে, এর ফলে মন যে দশায় উপনীত হয়, তাই হবে ভাব। কোনো শব্দ শোনার পর, তা যদি অস্বস্তিকর মনে হয় এবং এর দ্বারা মনে রাগ, ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদির জন্ম হয়, তাহলে তা থেকে এক একটি ভাবের জন্ম দেবে। আবার স্বস্তিকর শব্দের সূত্রে শ্রোতার মনে আনন্দের আনন্দ, উল্লাস ইত্যাদির জন্ম দেবে।
এক্ষেত্রে ভাব এবং রস সমন্বয়ে শিল্পের সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। নাট্যশাস্ত্রকারের মতে- 'ভাবশূন্য রস হয় না, রসশুন্য ভাব হয় না'। [ষষ্ঠ অধ্যায়, রসবিকল্প, ৩৬]

মানব মনের রসস্তর
মানুষ শুধু বস্তুজগতের বাস্তবতা নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে বাঁচার আশায়। যে যুদ্ধে পরাজিত হয়, সে জয়ের আশা জিইয়ে রাখে মনের গভীরে। সে আশাকে চেষ্টার দ্বারা কার্যকর করতে নানা ধরনের ভাবনা ভাবে। মনের ভিতরে তৈরি করে সে, জয়ের জন্য নানারকম পরিকল্পনা। পরিকল্পনা পরিচালিত হয় নানা ধরনের কল্পনার হিসেব-নিকেশে। কখনো মানুষ তৈরি করে বাস্তবের আদলে নানা ধরনের কল্পকথা। এই কল্পকথা থেকে জন্ম নেয়, গল্প, কবিতা, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত। আর কল্প-জগতের বহির্প্রকাশের ভিতর যা উপস্থাপিত হয় যে সৃজনশীল কাজ, তাই হলো শিল্পকর্ম। সকল মানুষ শিল্পী হয়ে উঠে না সত্য, কিন্তু শৈল্পিক ভাবনাটা থেকেই যায় অবচেতন মনে।

শিল্পকর্মের সূত্রে মনের ভিতরে যে ভাবে সঞ্চার ঘটে, সেটাই সেখানে সৃষ্টি হয় শিল্পের সৌন্দর্য জগৎ। আর প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক ঘটনায় যে ভাবের জন্ম নেয়, তা নিতান্তই জৈবিক দশা। এই দশা জন্ম দেয় বাস্তব-সৌন্দর্য-জগৎ। মূলত ভাব থেকেই নানবিধ বোধের জন্ম হয়। বাস্তব জীবনের অনুভূতি থেকে পাওয়া যায় বাস্তব জগতের বোধ। আর শিল্পকর্মের ভিতর দিয়ে যে নান্দনিক বোধের জন্ম হয় তারই অপর নাম  সৌন্দর্যবোধ। ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের দার্শনিকরা এর নাম দিয়েছিলেন রস। এঁরা এর সন্ধান করেছেন নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রের উপস্থাপনের ভিতরে। বাস্তববোধ এবং রসবোধ, উভয়ই জাগ্রত হয় মানুষের মনোজগতে। এই জগতের নিয়ন্ত্রক হলো 'আমি' নামক সত্তা। ভাবের সূত্রে উৎপন্ন বোধ মনোজগতে তিনটি স্তরে অনুভূত হয়। এই স্তরগুলো হলো উপরিতল, মধ্যতল এবং গভীরতল।

রসাস্বাদনের স্বরূপ
প্রতিটি রসের রয়েছে নিজস্ব রূপ। ছোটো ছোটো মৌলিক রূপের সমন্বয়ে রস পূর্ণরূপ লাভ করে। আবার এই রসের অনুভব সবার ভিতরে সমান উদ্দীপনা জাগায় না বলে রসের কোনো সর্বজনীন আদর্শ রূপ নেই। তবে ব্যক্তি বিশেষের কাছে কোনো আদর্শ রূপ গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা যায়, প্রতিটি ব্যক্তির কাছে রসের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু রসের অনুভব অনেকের সাথে প্রায় এক হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। এর ফলে সমমনা মানুষের কাছে রসের একটি গড় মান তৈরি হয়। এই গড় মানের বিচারে সমমনা মানুষগুলো সমস্বরে বলতে পারে ওই গানটি করুণ। একই নাটক দেখে কেউ কাঁদে কেউ ততটা বেদনার্ত হয়ে ওঠে না। তাই একই শিল্পকর্ম কাউকে রসে সিক্ত করে, আবার কাউকে রসোত্তীর্ণ করে।

শিল্পকর্মের রসের আস্বাদনে কতকগুলো বিধি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এই সকল বিধি গড়ে ওঠে কিছু অবস্থার উপর, যা রসগ্রাহীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। এই সকল বিধিই মানুষকে রসজগতে বা রসোত্তীর্ণ জগতে টেনে নিয়ে যায়। যেমন

১. সংবেদনশীলতা: সংবেদনশীলতা হলো সাড়া দেওয়ার গুণ। অর্থাৎ দুঃখের গল্প শুনে দুঃখ অনুভব করা, হাসির গল্প শুনে হাসা। বিষয়টির সাথে ব্যক্তি বিশেষের মানসিকতার সম্পর্ক নিবিড় রয়েছে। কিন্তু কিছু রস রয়েছে, যা সহজজাত। এই বিচারেও রসাস্বদেনের প্রকৃতি দুই ভাগে ভাগ করা যায়।