ভাব ও রস
মনোজগতের অন্য একটি প্রধান অধ্যায় হলো—
ভাব।
সংস্কৃত ক্রিয়ামূল Öভূ
-এর ভাবগত অর্থ হলো 'হওয়া'।
অ (ঘঞ্) প্রত্যয় দ্বারা সম্পাদিত ভাব শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় কোনো কিছু হওয়া।
যে কোনো কারণে মনে যে বিশেষ অনুভবের জন্ম হয়, সেটাই হলো ভাব।
মানুষের মনোজগতে যে বিচারালয়ের সিদ্ধান্তে মনোজগতে নবতর অনুভবের সৃষ্টি
হয়। এই অনুভব থেকে জন্ম হয় 'ভাব' নামক দশার। যেমন হাত কেটে যাওয়াটা একটি ঘটনা। এর ফলে মস্তিষ্কে একটি অনুভূতির
জন্ম হবে। এই অনুভূতিকে যদি আমার 'বেদনা' বলি, তা হবে একটি অনুভূতির নাম মাত্র। এর
ফলে মনে যদি দুঃখবোধের জন্ম হয়, তাহলে তা হবে দুঃখভাব। অনুভব থেকে ভাবের সঞ্চারে
ঘটে থাকে কয়েকটি পর্যায়ে। সব সময় যে একই ভাবে সঞ্চার ঘটে তা নয়, তবে ঘটে।
প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো অনুভব একটি নিরপেক্ষ দশায় থাকে। অর্থাৎ একটি অনুভব মস্তিষ্কে একটি মাত্র অনুভূতির জন্ম দেয়। এর তীব্রতার কম-বেশি হলেও মৌলিকত্বের বিচারে একই থাকে। এর মূলে থাকে স্বস্তি বা অস্বস্তি বোধ। এই বোধের তীব্রতার হেরফেরে স্বস্তি বা অস্বস্তি হেরফের ঘটে। আবার বোধের প্রকৃতি অনুসারে স্বস্তি বা অস্বস্তির প্রকৃতিও পাল্টায়। ধরা যাক একটি বিশেষ দিনে কোনো বিশেষ স্থানে খুব গরম লাগছে। এটি এক ধরণের অস্বস্তি বোধের জন্ম দেবে। আবার কোথাও খুব শব্দ হচ্ছে, সেটা অন্যরকম অস্বস্তির জন্ম দেবে। আবার দুটো ঘটনাই একই সাথে হতে পারে। অর্থাৎ গরমও লাগছে আবার শব্দও বেশি। এক্ষেত্রে অস্বস্তির মিশ্র দশা তৈরি হবে। যে কোনো কারণেই হোক না, বা যতগুলো কারণেই হোক না- এক্ষেত্রে মূল স্তরটি হবে অস্বস্তির। একইভাবে অস্বস্তির বিপরীতদশায় সৃষ্টি হতে পারে স্বস্তিবোধ।
প্রাথমিক স্তরের অনুভবজাত স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের মধ্য দিয়ে ভাবের ভিন্নতর দশা সৃষ্টি হয়। শব্দোচ্চতা দিয়ে বিষয়টি দেখা যাক। প্রতিটি মানুষের শব্দোচ্চতার একটি সাধারণ মান থাকে। এই মানে অভ্যস্থ থাকে বলে, সে একে স্বাভাবিক মান হিসেবে বিবেচনা করে। এর সামান্য হেরফেরকেও সে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে। কিন্তু শব্দোচ্চতা বা শব্দ-নিম্নতা যদি স্বাভাবিক মানের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তাহলে শ্রোতার মনে অস্বস্তিভাবের জন্ম হবে। কিন্তু এখানে শ্রোতা বিষয়ানুসারে স্বস্তি-অস্বস্তিবোধকে বিবেচনা করতেই পারে । প্রেয়সীর কথা ফিস্ফিসানিতে ভালো লাগে, আর কনসার্টের গান উচ্চশব্দমানে ভালো লাগে। এর উল্টো হলেই বরং অস্বস্তির জন্ম নেবে। এরূপ দুলাভাই শালা ডাকলে মানা যায়, বন্ধুরা বললে হয়তো আরও ভালো মানিয়ে যায়, কিন্তু শত্রু বললে আর মানা যায় না। এরপর যদি 'শালার বেটা শালা' বলা যায়, তাহলে মাথায় বাড়ি দেওয়ার দশায় চলে যেতে হয়।
স্বস্তি-অস্বস্তির
সূত্রে যে আনন্দ-বেদনার জন্ম হয়, তার সমন্বিত রূপে যে সুন্দর -অসুন্দরে অনুভবের
জন্ম হয়−
তার সার্বিক বিচারে মাপকাঠিতে ভিন্নস্তরের ভাবের জন্ম হয়। যদিও এই মাপকাঠি সকল ব্যক্তির
জন্য এক নয়। কিন্তু সবার জন্য মাপকাঠি আছে। এই মাপকাঠির হেরফেরে একজন অল্প শোকে কাতর
হয়, অন্যজন অল্পশোকেই পাথর হয়ে যায়।
যখন কেউ তার প্রিয় খাবার খায়, তখন সার্বিক অনুভূতির বিচারে তার মনে একটি
পরিতৃপ্তির ভাব আসে। সেখানে আলাদা করে খাবারের উপাদানগুলোর চেয়ে সামগ্রিক
খাদ্যের গুণমানটা বিচার করা হয়। এর সাথে অতীতের এই জাতীয় খাদ্যগ্রহণের
অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ইত্যাদি মিলেই পরিতৃপ্তির ভাবটা আসে। অনেক সময় কোনো খাবারের
আসর ছেড়ে যাওয়ার পর শোনা যায়, 'খাবারটা ভালো ছিল, কিন্তু গরমের জন্য মজা করে
খেতে পারলাম না'। এখানেই পরিতৃপ্তির ঘাটতি ঘটবে।
ভাবের এই দশায় অনুভবটা
গৌণ, ঘটনার সার্বিক মূল্যায়নটাই মূখ্য।
এই সার্বিক মূল্যায়নের সূত্রে যে বিশেষ অনুভূতির জন্ম হয়, তা ভাবের একটি রূপ। কখনো
কখনো একাধিক ভাব যুগপৎ কাজ করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের স্বাধীনতা
যুদ্ধের শেষে, বিজয় দিবসে একজন মানুষ কাঁদছে স্বাধীনতা লাভের আনন্দে। একই সাথে কাঁদছে কিছু
প্রিয় মানুষের মৃত্যুর বেদনায়। কখনো কখনো বড় বড় সুখবোধের কাছে ছোটো ছোটো দুঃখ
বোধ ম্লান হয়ে যায়। ছোটো বেলায় গ্রামের এক লোককে দেখেছেলাম, বিলে দল ধরে মাছ
ধরতে গিয়ে সে বিশাল এক বোয়াল মাছ ধরেছে। কিন্তু লুঙ্গিটার অনেক খানি ছিড়ে গেছে।
কিন্তু তার মাছ ধরার আনন্দ যে সুখবোধের জন্ম দিয়েছিল, তা লুঙ্গি ছেঁড়ার দুঃখবোধকে
ম্লান করে দিয়েছিল।
মানুষের যে সকল গুণাবলি নিয়ে মানুষ হিসেবে বিরাজ করে, তার সব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মনুষ্য-ধর্ম। মানুষের চেতনার জগতে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, তা মনুষ্য ধর্মের অংশ। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তার অস্তিত্ব ধারণ করে আছে জিন সঙ্কেত। এর ভিতর দিয়ে মানুষ যত ভাব পায়, তা তার অস্তিত্বেরই অংশ। ক্রমবিবর্তনের ধারায়, মানুষের ভাবের জগৎ সম্প্রসারিত হয়েছে। আধুনিক মানুষের কাছে ভাবের প্রাপ্তি ঘটে নানাভাবে। তবে কিছু ভাবকে প্রধান বা মৌলিকভাব হিসেবে ভাবা যায়। যেমন−
সহজাত ভাব: জন্মগত সূত্রে মানুষ
কিছু অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এই সূত্রে সে কিছু ভাবের অধিকারী
হয়েই জন্মগ্রহণ করে। এই অধিকার পায় জিনসংকেতের সূত্রে। তাই আনন্দভাব, রাগের
ভাব, ভয়ের ভাব শিশুদেরও থাকে। এই ভাবকে বলা যায়, সহজাত ভাব। এই ভাব 'আমি' ধারণ
করে আজীবন। সৃজনশীল কর্মের ক্ষেত্রে এই স্থায়ীভাবই হলো এই সহজাত ভাব। এই ভাব প্রচ্ছন্ন থাকে।
পরিস্থিতি সাপেক্ষে এর প্রকাশ ঘটে।
অভিজ্ঞতালব্ধ ভাব: মানুষ বড় হয়ে
উঠার সাথে সাথে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এর ফলে অজস্র ভাব মানুষের মনে
বাসা বাধে। ক্ষুধাভাব মানুষের সহজাত। কিন্তু লোভনীয় খাবারের আকাঙ্ক্ষা অভিজ্ঞতা
লব্ধ। পিৎজা নামক বিদেশী খাবার খেয়ে কারো ভালো লাগলে, তার ভিতরে আবার এই খাবার
গ্রহণের জন্য মনে আকাঙ্ক্ষা জাগবে। কখনো যদি পিৎজা খাবার ইচ্ছা মনে জাগ্রত হয়,
তা হলে তাকে অভিজ্ঞতা লব্ধ ভাব বলা যাবে। এরূপ মৃত্যুর ভয়টা সহজাত। কিন্তু
প্রবল ঝড়ে বাড়ি ধ্বসে মৃত্যু হতে পারে এই ভয়টা অভিজ্ঞতালব্ধ।
অনিশ্চিত ভাব: এই ভাবটা মূলত নানা
ধরনের ভাবে সংমিশ্রত রূপ। এই বিষয়টা সবসময়ই থাকে। এটি অনেকটা স্থায়ীভাবের মতই।
তবে জন্মগতভাবে এই ভাবের জন্ম হয় না বলে, এটি সহজাত নয়। আবার অভিজ্ঞতা নাই, এই
অভিজ্ঞতা থেকে এই ভাবের উদ্ভব হয়। বলা যায় সহজাত এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তৈরি হয়
অনিশ্চিতভাব। 'পরীক্ষাটা ঠিক মতো দিতে পারবো তো' এই জাতীয় ভাবনা থেকে অনিশ্চিত
ভাবের জন্ম হয়। অনিশ্চিৎভাবে সহজাত বা অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবের আধিক্যে নানা রূপ লাভ
করতে পারে। যেমন- অনিশ্চিত ভাবে আনন্দ, বেদনা, দুঃখ ভয় ইত্যদির আধিক্য থাকতে
পারে। বিষয়টি নির্ভর করে অনিশ্চিত অবস্থাটা অনুকূলে না প্রতিকূলে।
সাত্ত্বিক ভাব: সহজাত, অভিজ্ঞতা
লব্ধ ভাবকে অবলম্বন করে, মানুষের অনুভূতি লাভ করে। এর ফলে ভাবের
প্রকাশ ঘটে নানা আঙ্গিকে। ভরত মুনি নাট্যশাস্ত্রে এই জাতীয় ফলাফল নির্ভর ভাবকে সাত্ত্বিকভাব
বলেছেন। স্থানকালপাত্র বা আধিক্যের বিচারে এই ভাবের রূপান্তর ঘটে। এর সাথে
যুক্ত থাকে নানাবিধ কার্যকারণ। এই ভাব থেকে জন্ম নেয়, আনন্দ-বেদনার অশ্রু,
রোমাঞ্চ। জন্ম নিতে পারে ঘাম, কণ্ঠস্বর কম্পিত বা বিকৃত হতে পারে।
সংপ্রশ্নভাব: মানুষ নানাভাবে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য দৃঢ়তা দেখায়। এই দৃঢ়তার ভিতরে থাকে তার আত্মবিশ্বাস। কিন্তু প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয় না যে, উদ্ভুত সমস্যাটির সে সমাধান করতে পারবে কিনা, বা ওই সমস্যা সমাধানের যোগ্য কিনা। এই ভাবটিই হলো সংপ্রশ্ন (challange)। ধরা যাক, একটি বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য, কেউ দৃঢ়তা দেখালো। এই বিষয়ে তার যতই দৃঢ়তা থাক, কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার নিজের কাছে এবং অন্যান্যদের কাছে তা সংশয় হিসেবেই থাকবে। 'পারা না পারা'র এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া যাবে, তার কার্যক্রমের পর। এই সংশয় দূর করার জন্য মনের ভিতর যে 'পারা না পারা'র সম-প্রশ্নের ভাবটি জাগ্রত হয়, তাই হলো সংপ্রশ্নভাব।
অনুভবের ভিতর দিয়ে মনে তৈরি হয় স্বস্তি-অস্বস্তির ভাব। এই ভাবের একটি দশা হলো আনন্দ। বহুবিধ আনন্দের সংমিশ্রণে যে সৌন্দর্যের সৃষ্টি, তা গ্রহণ করার চেতনাগত বোধই হলো সৌন্দর্যবোধ। অনুভব ও চেতনা, সত্য, রুচি ইত্যাদি নিয়ে যে সৌন্দর্যের জগৎ তৈরি হয়, তার ভিতরেই আমাদের বাস। সে জগতে কখনো 'আমি' স্রষ্টা, কখনো ভোক্তা। এরই ভিতরে রয়েছে 'আমি'র সৌন্দর্যবোধ। অন্যভাবে বলা যায় সুন্দর করে জীবনকে উপভোগ করার বোধই হলো সৌন্দর্যবোধ। প্রকৃতির কোনো উপাদানই সুন্দর নয়। সুন্দর বলে 'আমি' যাকে গ্রহণ করে তাই সুন্দর। প্রতিটি মানুষের ভিতরে আনন্দ পাওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা আছে, তার ভিতরেই রয়েছে সৌন্দর্যবোধের প্রাণভোমরা। তাই আনন্দের এবং আনন্দসমূহের সংমিশ্রণে সৃষ্ট সৌন্দর্যের সবকিছুই সৌন্দর্যবোধের ভিত্তি গড়ে দেয়। এর কিছু সহজাত, বাকিটা অর্জিত বা চর্চিত।
বাস্তবে বা সৃজনশীল কর্মে
মানুষের মনে অসংখ্য ভাবের জন্ম হতে পারে।
এর সবগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে নামকরণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। প্রাচীন ভারতেরা ঋষিরা ভাবকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগ তিনটি হলো-
সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। এর ভিতরে সকল
ভাব মনে স্থায়ীভাবে থাকে না। প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকাণ্ডের ভিতরে সৃষ্ট অসংখ্য
ভাবের ভিতরে কিছু ভাব মনে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ভাব ও রসের বিচার
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়
শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দের মধ্য ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্র
প্রণয়ন করেছিলেন। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে আকর গ্রন্থাদির ভিতরে- নাট্যশাস্ত্রকে
প্রাচীনতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থটির প্রধান বিষয় নাট্যাভিনয় এবং এর সাথে
সম্পর্কিত বিবিধ বিষয়। অভিনয়ের অংশ হিসেবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সঙ্গীতের মৌলিক কিছু
ধারণা। এই গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়টির
নাম
রসবিকল্প এবং সপ্তম অধ্যায় ভাবব্যঞ্জক।
এই দুটি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের পারিভাষিক শব্দ। এই শব্দগুলোর সংজ্ঞাভিত্তিক
অর্থ জানা না থাকলে, এই দুটি অধ্যায় বুঝতে গেলে পদে পদে বাধা পেতে হয়। বিশেষ করে
যখন এই পারিভাষিক শব্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ নিয়ে উপস্থিত হয় তখন, বিষয়টা
আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠে। তাই শুরুতে আমি এই পারিভাষিক শব্দগুলোর বিশেষ অর্থ এবং
এর শ্রেণিকরণ করার চেষ্টা করবো।
অভিনয়: কোনো বিশেষ চরিত্রের স্বরূপ যখন বাক্য, অঙ্গভঙ্গী এবং মনোভাবের অনুকরণ করে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা অভিনয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অভিনয়ের এই তিনটি উপাদান অভিনয়ের অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নাট্যশাস্ত্রে এই তিনটি অঙ্গকে বলা হয়েছে- বাচিক, আঙ্গিক ও সাত্ত্বিক।
বাচিক: প্রতিটি মানুষের রয়েছে নিজস্ব উচ্চারণ প্রকৃতি, বাচনভঙ্গী, কণ্ঠস্বরের উচ্চতা-সামান্যতা। অবস্থানুসারে তার কথন রীতিরও হেরফের ঘটে। অভিনয়ের মাধ্যমে তা যথাযথ ফুটিয়ে তোলাই হলো- বাচিক অভিনয়।
আঙ্গিক: প্রতিটি মানুষ বাক্যের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশের পাশাপাশি কিছু না কিছু অঙ্গভঙ্গী করে। যেমন কথা বলার সময় হস্তসঞ্চালন করে, কাঁধ ঝাঁকায়, মাথা ঝাঁকায়। চরিত্র রূপায়নে অভিনেতাকে তা অনুকরণ করতে হয়। এ সবই আঙ্গিক অভিনয়।
সাত্ত্বিক: বাচিক এবং অভিনয়ের পিছনে থাকে মনোভাব। মানুষের মনের নানা দশায় যে ভাবের উদ্ভব হয়, তাকে অভিনয়ের দ্বারা উপস্থাপনই হলো সত্ত্বিক।
ভাব
বাচিক, আঙ্গিক ও সাত্ত্বিক অভিনয়ের সাহায্যে
নাট্যকার যে মনোভাব ব্যক্ত করতে চায়, তাই হলো ভাব। এই ভাব দর্শককে বিষয়ের
ভাবজগতে নিয়ে যায়, অর্থাৎ দর্শককে ভাবায়। ভাবের সাথে বিভাব এবং অনুভাবের রয়েছে
গভীর সম্পর্ক। নাট্যশাস্ত্রকারের মতে- 'বিভাবের দ্বারা
আহৃত ও অনুভাবের দ্বারা জ্ঞাত হয় তা ভাব নামে অভিহিত হয়।
[সপ্তম অধ্যায়,
ভাবব্যঞ্জক। ১ ]
নাট্যশাস্ত্রকার সকল
রসের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে 'ভাব'কে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে 'ভাবসমূহ থেকে
রসসমূহের উদ্ভব দেখা যায়, কিন্তু রসসমূহ থেকে ভাবসমূহের উদ্ভব হয় না'। [ষষ্ঠ অধ্যায়,
রসবিকল্প, ৩২-৩৩]
এখানে বিশেষভাবে 'অভিনয়ের সাহায্যে'
শব্দদ্বয়ের দ্বারা নাট্যশাস্ত্রকার শিল্পকর্মের দিকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন।
অর্থাৎ বাস্তব জীবনের যে মনোগত দশা তাকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাটাই হবে
নাট্যশাস্ত্রের ভাব। মূলত শিল্পের ভাব কল্পবাস্তব জগতের। কল্প-বাস্তবের এই ভাব শিল্পের
মাধ্যমের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন হবে। যেমন নাটকের ভাবের উপস্থাপন হবে অভিনয়ের মাধ্যমে।
ভরতের মতে তাতে থাকবে-
বাক্য, অঙ্গভঙ্গী,
মুখরাগ ও সাত্তিক ভাব। যা দর্শককে কল্পবাস্তব জগতের অঙ্গনে টেনে নেবে এবং তাকে
ভাবাবে। আর এই 'ভাব'-এর ভিতর দিয়ে দর্শক রসের জগতে প্রবেশ করবে।
নাট্যশাস্ত্রকার ভাবকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগ তিনটি হলো- স্থায়ী,
ব্যাভিচারী এবং সাত্ত্বিক।
স্থায়িভাব:
ভরতমুনি স্থায়ীভাবকে ৮ ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো−
রতি: হাস শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা ও
বিস্ময়। [[ষষ্ঠ অধ্যায় ১৭]
সঞ্চারী বা ব্যভিচারী ভাব: এই ভাবগুলো স্থায়ীভাবে পৃথকরূপে মনে
বিরাজ করে না এবং বিবিধ দিকে মনকে চালিত করে, এই কারণে একে ব্যভিচারী বলা হয়। নাট্যশাস্ত্রে
৩৩টি ব্যভিচারী ভাবের নাম পাওয়া যায়। এগুলোর হলো (বর্ণানুক্রমে)- অপস্মার,
অবহিত্থ, অমর্ষ, অসূয়া, আবেগ, আলস্য, উগ্রতা, উন্মাদ, ঔৎসুক্য, গর্ব, গ্লানি,
চপলতা, চিন্তা, জড়তা, ত্রাস, দৈন্য, ধৃতি, নিদ্রা, নির্বেদ, প্রবোধ, বিতর্ক,
বিষাদ, ব্যাধি, ব্রীড়া, মতি, মদ, মরণ, মোহ, শঙ্কা, শ্রম, সুপ্ত, স্মৃতি, ও
হর্ষ। [ষষ্ঠ
অধ্যায় ১৮-২১]
নিচে সাধারণভাবে প্রচলিত ৩৩টি সঞ্চারীভাবের পরিচিত সংক্ষেপে বর্ণানুক্রমে দেওয়া হলো−
১.অপস্মার: গ্রহাদির প্রভাবে কিম্বা স্নায়ুবিকারের কারণে মনে যে বিকলতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ঘাম, কম্পন, পাগলের ন্যায় অঙ্গভঙ্গি করার ঘটনা ঘটে।
২. অবহিত্থ: যে কোন আনন্দ, লজ্জা, ভয় ইত্যাদি গোপন করার প্রচেষ্টা অবহিত্থা। এর ফলে ব্যস্ততা, অস্ফুট কথা বলা, মাটির দিকে চেয়ে থাকা ইত্যাদি ঘটনার জন্ম হয়।
৩. অমর্ষ: অপমান, আক্ষেপ, নিন্দার কারণে অমর্ষ ভাবের জন্ম হয়। এর ফলে চক্ষুরক্রবর্ণ হওয়া, শিরঃকম্পন, তাড়ন, শাসন ইত্যাদির অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৪. অসূয়া: অপরে সমৃদ্ধি বা গুণের কথা শুনে বা জেনে মনে যে অস্থিরতার জন্ম দেয়। এর ফলে অবজ্ঞা, পরচর্চা, ক্রোধভাব, ভ্রূকুটি প্রভৃতির জন্ম দেয়।
৫. আবেগ: কোনো ঘটনার সূত্রে মনে যে অস্থিরতার জন্ম নেয়। যেমন- কাঙ্ক্ষিত বস্তুর প্রাপ্তি ঘটনায় আনন্দ হয়, নে পেলে দুঃখ হয়। এই বিচারে আবেগের সংখ্যা বহু ধরনের হতে পারে।
৬. আলস্য: কোনো ঘটনার জন্য দেহ এবং মনে যে জড়তার সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা কর্মস্পৃহা লোপ পায়। শ্রমজনিত কারণে, গর্ভধারণে, যে কোনো শারীরীক অসুস্থতার জন্য আলস্যের জন্ম হতে পারে। এর ফলে হাই ওঠা, বসে থাকা, শুয়ে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া ইত্যাদি ঘটনার জন্ম দেয়।
৭. উগ্রতা: বীরত্ব বা কোনো ঘটনার প্রতিবাদে যখন উত্তপ্ত ভাব প্রকাশ করা হয়। এর ফলে ঘাম, শিরকম্পন, তর্জন, তাড়ন ইত্যাদির মতো ঘটনা ঘটে।
৮. উন্মাদ: অপ্সমারের মতো। তবে ঠিক মস্তিষ্ক বিকার নয়। অর্থাৎ পাগল নয়, পাগলের মতো। কাম, ভয়, শোক প্রভৃতির কারণে পাগলের ন্যায় আচরণই হলো উন্মাদ। এর ফলে হাসি, প্রলাপ, চিৎকার ইত্যাদির ঘটনার জন্ম দেয়।
৯. ঔৎসুক্য: কাঙ্ক্ষিত বিষয় পাওয়ার জন্য উদগ্রীব দশা। এর ফলে অসহিষ্ণুতার জন্ম হয় এবং ঘাম, ব্যস্ততা, দীর্ঘশ্বাস ইত্যাদির জন্ম দেয়।
১০. গর্ব: বিদ্যা, রূপ, বংশকৌলিন্য ইত্যাদির দ্বারা মনের ভিতরে যে উচ্চাসনের ভাব জন্মে। এর ফলে অবজ্ঞা, উন্নাসিকতার জন্ম হয়।
১১. গ্লানি: যেকোন কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের জন্য মনের ভিতরে যে নিষ্প্রাণতার জন্ম হয়। রমণেচ্ছা, ক্ষুধা, পিপাসা, পরিশ্রম ইত্যাদি থেকে গ্লানি তৈরি হয়। এর ফলে মুখের বিবর্ণতা, কৃশতা, অবসাদ, উদ্যমহীনতার জন্ম হয়।
১২. চপলতা: অনুরাগ, দ্বেষ, পরশ্রীকতারতা প্রভৃতি থেকে যে অস্থিতার জন্ম হয়। এর ভলে ভর্ৎসনা, লঘু আচরণ, লঘু কথন ইত্যাদির জন্ম দেয়।
১৩. চিন্তা: প্রয়োজনীয়, কাঙ্ক্ষিত ইত্যাদি বিষয় পাওয়ার আকাঙক্ষা থেকে মনে যে ভাবনার উদয় হয়। এর ফলে দীর্ঘশ্বাস, অন্তর্জালা ইত্যাদির জন্ম হয়।
১৪. জড়তা: অনাকাঙ্ক্ষিত, কাঙ্ক্ষিত, অকল্পনীয় ইত্যাদি কোনো ঘটনার কারণে, কিছুক্ষণের জন্য মনে যে স্থবিরতা নেমে আসে। এর ফলে মূর্তির মতো স্থির হয়ে যাওয়া, অনিমেষে তাকিয়ে থাকা, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনার জন্ম দেয়।
১৫. জাগরণ: যে কোনো কারণে নিদ্রাহীন দশায় থাকা হলো জাগরণ।
১৬. ত্রাস: যে কোনো কারণে মনে যখন ভয়ের উদ্রেক করে। এই ভয়ের সাথে নিজের বিপর্যয়ের বা মৃত্যর সম্ভাবনা থাকে। যেমন- যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এর উৎপত্তি হয়। এর ফলে দেহে কম্পনের সৃষ্টি হয়।
১৭. দৈন্য: যে কোন দুর্দশা থেকে যে দৈহিক প্রকাশযোগ্য ঘটনা ঘটে। এর ফলে মুখ বিষাদগ্রস্ত হয়।
১৮. ধৃতি: জ্ঞানচর্চা, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির আগমন ইত্যাদি ধৃতির জন্ম দেয়। এর ফলে আনন্দ-উল্লাস, হাস্যময়তা ইত্যাদির জন্ম দেয়।
১৯. নিদ্রা: স্বাভাবিক ভাবে বা শ্রমজনিত ক্লান্তিতে, মদ্যপানজনিত কারণে ঘুমিয়ে পড়ার দশা। এর ফলে হাই তোলা, আলস্য ইত্যাদির জন্ম দেয়।
২০. নির্বেদ: আপদ, ঈর্ষা, তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা যখন কোনো আত্মাবমাননা'র সৃষ্টি হয়। এর ফলে মনে দৈন্য, অশ্রু, নিঃশ্বাস, বিবর্ণতা ইত্যাদি দৈহিক ঘটনার জন্ম দেয়।
২১. বিতর্ক: কোনো বিষয়ে এক মত হতে না পারলে, কথোপকথনের মাধ্যমে বিতর্কের জন্ম হয়। এর ফলে, হাত, পা, মাথা, আঙ্গুল ইত্যাদির সঞ্চালন ঘটে।
২২. বিবোধ: ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে যে চেতনার অবস্থা। হাইতোলা, আড়মোড়া ভাঙা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে।
২৩. বিষাদ: কোনো বিষয়ে সফল হতে না পারার সূত্রে বিষাদের জন্ম হয়। চিরতরে হারানোর অনুভব থেকেও বিষাদের জন্ম হয়। এর ফলে উদ্যমহীনতার জন্ম হয়। দীর্ঘশ্বাস, চিত্তসন্তাপ ইত্যাদির জন্ম হয় বিষাদ থেকে।
২৪. ব্যাধি: সাধারণ অর্থে শরীরের যেকোন অসুখ। কম্পন, মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদির ঘটনার জন্ম দেয়।
২৫. ব্রীড়া: ধৃষ্টতার অভাবকে ব্রীড়া বলা হয়। মাথা নত করে থাকা এর প্রধান লক্ষণ।
২৬. মতি: উচিৎ এবং অনুচিৎ নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া হলো মতি। এর থেকে ধৈর্য, সন্তোষ, হাসি প্রভৃতি দশার জন্ম হয়।
২৭. মদ: মাদক দ্রব্য পানের ফলে যে দেহগত বিকার ঘটে। ঢুলুভাব, অশ্রু, কম্প, স্তম্ভ, ইত্যাদি ঘটনা ঘটে।
২৮. মরণ: জীবননাশ হয়েছে এমন অবস্থা। তবে রসশাস্ত্রে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুকে মরণ বুঝায়। শীতলতা, কাঠিন্য, ভূমিতে পতন ইত্যাদি ঘটনার জন্ম হয়।
২৯. মোহ: আবেগ, ভয়, শোক, গভীর চিন্তা ইত্যাদির ফলে মোহের জন্ম হয়। এরই ফলে চক্ষু ঘূর্ণন, মাটিতে বসে পড়া বা পড়ে যাওয়া, চেতনাহীনতার ভাব প্রকাশ পায়।
৩০. শঙ্কা: নিজের ত্রুটি অপরাধ, শত্রুর ক্ষমতাবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে শঙ্কার জন্ম হয়। এর ফলে মুখের বিবর্ণতা, কম্পন, স্বরবিকৃতি প্রকাশ পায়।
৩১. শ্রম: যে কোনো দৈহিক পরিশ্রমে দেহে যে শ্রমজনিত বিকার দেখা যায়। যেমন- ভ্রমণক্লান্ত দশা, রমণক্লান্ত দশা। এর ফলে প্রকাশ পায়, হাই তোলা, নিদ্রাভাব ইত্যাদি।
৩২. স্মৃতি: কোনো কিছুর পূর্ব-অনুভূতি থেকে যে বোধ জন্মেছিল তা স্মরণে আনার ভিতরে স্মৃতির উপস্থিতি প্রকাশ পায়। ভ্রূ-তোলার ভাব দিয়ে এর প্রকাশ করা হয়।
৩৩. হর্ষ:
কাক্ষিত বিষয় অধিগত হওয়ার সূত্রে মনে যে আনন্দের সঞ্চার হয়। অশ্রু, অস্ফুট
গদগদভাব ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে।
সাত্ত্বিকভাব: মনের বিকারে যে ভাব প্রকাশ পায়। নাট্যশাস্ত্রে ৮টি সাত্ত্বিকভাবের কথা বলা হয়েছে। এই ভাবগুলো হলো- স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরসসাদ (স্বরভঙ্গ), বেপুথ (কম্প), বৈবর্ণ্য, অশ্রু, প্রলয় ও (মূর্ছা)। [ষষ্ঠ অধ্যায় ২২]
অশ্রু: মনের বিকারে যখন চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।
প্রলয় (মূর্ছা): মনের বিকারে যখন মূর্ছা যাওয়ার ভাব সৃষ্টি হয়।
বেপুথ (কম্প): মনের বিকারে যখন দেহে কম্পনের সৃষ্টি হয়।
বৈবর্ণ: মনের বিকারে যখন মুখবর্ণ বিকৃত হয়ে যায়।
রোমাঞ্চ: মনের বিকারে যখন দেহে শিহরণ সৃষ্টি হয়।
স্তম্ভ: মনের বিকারে যখন দেহ স্তম্ভিত হয় এবং জড়ের মতো অচল হয় যায়।
স্বরস্বাদ (স্বরভঙ্গ): মনের বিকারে যখন কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়।
স্বেদ:
মনের বিকারে
দেহে যখন ঘামের সঞ্চার হয়।
বিভাব:
যাকে অবলম্বন করে ভাবের জন্ম হয় এবং যে সকল উপাদান ভাব
সৃষ্টিতে উদ্দীপনা যোগায়, তাই হলো বিভাব।
এই বিচারে বিভাবকে দুটি ভাগে ভাগ করা
হয়। এই ভাগ দুটি হলো- আলম্বন বিভাব ও উদ্দীপন বিভাব
আলম্বন বিভাব: যার উপর ভিত্তি করে ভাবের সৃষ্টি হয়। যেমন নাটকে নায়ক-নায়িকা হবে আবলম্বন বিভাব।
উদ্দীপন বিভাব: যে সকল উপাদান আলম্বন বিভাবের উপাদানকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করে, তাই উদ্দীপন বিভাব। আলম্বন বিভাব না থাকলে উদ্দীপন বিভাব যুক্ত করা যায় না। যেমন− নায়ক-নায়িকা হবে আবলম্বন বিভাব, আর তার পোশাক, সাজসজ্জা হবে উদ্দীপন বিভাব।
অনুভাব: বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ের দ্বারা প্রকাশ করার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে অনুভাবের প্রকাশ ঘটে। মূলত অঙ্গীয় উপাদান এবং আচরণগত অভিনয় দ্বারা অনুভাবের সৃষ্টি হয়। যেমন, শৃঙ্গারের অনুভাবগুলো হলো- নেত্রচাতুর্য, ভ্রূবিক্ষেপ, কটাক্ষ, সুন্দর গতি, মধুর অঙ্গহার, বাক্যাদি। এসবের ভিতর দিয়ে নায়ক-নায়িকা প্রত্যক্ষাভাবে সম্ভোগের উদ্দীপনা লাভ করে। রস সৃষ্টিতে অনুভাব বিশেষ ভূমিকা রাখে।
নাট্যশাস্ত্রের
রসবিকল্প
নাট্যশাস্ত্রের ষষ্ঠ অধ্যায়টি রসবিকল্প। এর সম্পূরক
অধ্যায়টি হলো- 'সপ্তম অধ্যায়, ভাবব্যঞ্জক। এই দুটি অধ্যায় থেকে রস এবং এর
প্রাসঙ্গিক অংশসমূহকে বিশেষভাবে জানা যায়। ষষ্ঠ অধ্যায়ের অষ্টরস অংশে
নাট্যশাস্ত্রকার উল্লেখ করেছেন- 'শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর ভয়ানক, বীভৎস ও
অদ্ভুত সংজ্ঞক এই আটটি নাট্যরস বলে কথিত'। এই রসগুলো আটি স্থায়িভাব (রতি, হাস, শোক,
ক্রোধ, উৎসাহ, জুগুপ্সা ও বিস্ময়) থেকে উদ্ভব হয়।
কাব্যশাস্ত্রের রসসমুহের
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
১. শৃঙ্গার: শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার। ভরতমতে রতি নামক স্থায়ীভাব থেকে শৃঙ্গার রসের উদ্ভব। শৃঙ্গার থেকে হাস্য রসের উৎপত্তি হয়। এই মতে শৃঙ্গারের যে অনুকরণ, তাই হাস্য। এই রসের দেবতা বিষ্ণু আর বর্ণ শ্যাম।
এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই সাধারণভাবে শৃঙ্গার ভাব তাকেই বলা হয়। বাস্তবজগতে নায়ক-নায়িকার প্রেম নিবেদন বা প্রকাশে অনুভবের সঞ্চার হয়। কিন্তু শিল্পজগতে নায়ক-নায়িকার প্রেম নিবেদন বা প্রকাশক উপস্থানে যে ভাবের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে শৃঙ্গার রসের উদ্ভব হয়। উল্লেখ্য, এসবই ঘটে শিল্পের সৃজনশীল অঙ্গনে।
নৃত্যে, গানে, কাব্যে শৃঙ্গার রস উপস্থাপিত হয়ে থাকে রতি-কামনার তীব্রতায়। যা শ্রোতা-দর্শকের মনোজগতে দ্বিতীয় স্তরে কামনার ভাবকে জাগ্রত করে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কাব্য, মদনদেবতার করুণায় চিত্রাঙ্গদা সর্বাঙ্গসুন্দরী হয়ে উঠার পর, অর্জুনের মনে যে ভোগের তৃষ্ণা জাগ্রত হয়, তা তার স্বগোক্তির ভিতর দিয়ে ফুটে উঠে, এ ভাবেই-এ কী তৃষ্ণা, এ কী দাহ!
এ যে অগ্নিলতা পাকে পাকে
ঘেরিয়াছে তৃষ্ণার্ত কম্পিত প্রাণ।
উত্তপ্ত হৃদয়
ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া॥
আপাত দৃষ্টিতে একে শৃঙ্গার রসের একটি রূপ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু নাট্যশাস্ত্রে শৃঙ্গার আরও মহত্তম বিষয়। নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে- যা কিছু শুভ্র, পবিত্র, সুদর্শন তার সাথে শৃঙ্গারের তুলনা করা হয়। তাই যদি হয়, তাহলে শৃঙ্গার হবে নরনারী তীব্র ভালোবাসার ভিতর দিয়ে উদ্ভুত রস। যখন শুভ বা কল্যাণ অর্থে 'ভালো' আর বাসনা বা কামনা অর্থে 'বাসা'। এই অনুভবের ভিতর দিয়ে ভালোবাসা হয়ে উঠে কল্যাণকর কামনা। নরনারীর ভিতরে পরস্পরের কল্যাণকর কামনার ভিতর দিয়ে যখন ভালোবাসা নামক অনুভবের উদ্ভব হয়, তখন তা রতিকামনা একটি অংশ হয়ে ওঠে । মানুষের সহজাত জৈবিক কামনাকে সুন্দরভাবে উপভোগ হয়ে উঠে শৃঙ্গারের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা স্বার্থযুক্ত যৌনাচার শৃঙ্গার নয়। একই কারণে ধর্ষণ, বেশ্যবৃ্ত্তি, পর্ণচিত্র ইত্যাদি যৌনতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ বটে, বাস্তবতার নিরিখে তা শৃঙ্গার রসে অধিষ্ঠান পায় না। একই বিষয় শিল্পের সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে রতি ভাবই শৃঙ্গার রসে পরিণত হয়। শুভ্রতার বিচারে রসের অধিষ্ঠান হয় সম্ভোগ এবং বিপ্রলম্ভ দশায়।
- সম্ভোগ: নায়ক-নায়িকার পরস্পরে সপ্রেম দর্শন, স্পর্শ, কথোপকথন ইত্যাদির দ্বারা দর্শকের মনে কামের সঞ্চচার ঘটে তখন সম্ভোগের অধিষ্ঠান হয়। সম্ভোগ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ো্জন, বিভাব এবং অনুভাবের।
- সম্ভোগের বিভাব: যে সকল বিষয়কে অবলম্বন করে সম্ভোগ ভাবের উদ্ভব হয়, তার সবই বিভাব। নাট্যশাস্ত্রকারের মতে- সম্ভোগের বিভাবগুলো হলো- ঋতু, মালা, অনুলেপন, অলঙ্কার, প্রিয়জনসঙ্গ ও অতি সুন্দর গৃহের উপভোগ, প্রমোদোদ্যানে গমন, অনুভূতি, শ্রবণ, দর্শন, ক্রীড়া, লীলা ইত্যাদি। ভরতমুনির আমলে এই বিভাবগুলোই প্রধান ছিল। একালে এসে বিভাবের জগৎ সম্প্রসারিত হয়েছে। একালের সম্প্রসারিত বিভাব হতে পারে এক সাথে স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখা, বিদেশ ভ্রমণ, ফেসবুক ইত্যাদি।
- সম্ভোগের অনুভাব: নাট্যশাস্ত্রকারের মতে- শৃঙ্গারের অনুভাবগুলো হলো- নেত্রচাতুর্য, ভ্রুবিক্ষেপ, কটাক্ষ, সুন্দর গতি, মধুর অঙ্গহার, বাক্যাদি। এসবের ভিতর দিয়ে নায়ক-নায়িকা প্রত্যক্ষাভাবে সম্ভোগের উদ্দীপনা লাভ করবে।
- সম্ভোগের ব্যাভিচারী ভাব: শৃঙ্গারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নায়ক-নায়িকার মনে প্রতিকূল দশার সৃষ্টি করে। এসকল দশায় নায়ক-নায়িকার মন সম্ভোগ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়। ফলে শৃঙ্গার রসে পৌঁছাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ভয়, আলস্য ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ব্যাভিচারী ভাব দুই ভাবে ঘটতে পারে। এই ভাব দুটি হলো-
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ।
- মন-ব্যভিচার: আবেগ, উন্মাদ, গর্ব, গ্লানি, চপলতা, ধৃতি, নিদ্রা, মদ, হর্ষ।
- বিপ্রলম্ভ ভাব: নায়ক-নায়িকার মধ্যে যখন তীব্র কাম-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়, তখন সেই আকাঙ্ক্ষা অপূরণের মধ্য দিয়ে যে অনুভবের সৃষ্টি হয়, তাকেই শৃঙ্গারের বিপ্রলম্ভ বলা হবে। এগুলো হলো- নির্বেদ, গ্লানি, শঙ্কা, অসূয়া, শ্রম, চিন্তা, ঔৎসুক্য, নিদ্রা, স্বপ্ন, জাগরণ, রোগ, উন্মাদ, অপস্মার, জড়তা, মোহ, মরণাদি অনুভাবের দ্বারা বিপ্রলম্ভকৃত শৃঙ্গারের উদ্ভব হয়। এই ভাবের দ্বারা সৃষ্ট ব্যভিচারী ভাবগুলো হলো−
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, ঘাম, স্তম্ভ, প্রলাপ, স্বরভঙ্গ।
- মন-ব্যভিচার: অবহিত্থা, অমর্ষ, অসূয়া, আবেগ, আলস্য, উৎকণ্ঠা, উন্মাদ, চিন্তা, জড়তা, ত্রাস, দৈন্য, নিদ্রা, নির্বেদ, বিতর্ক, বিষাদ, ব্যধি, মদ, মরণ, শঙ্কা, শ্রম, স্বপ্ন, স্মৃতি।
ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রে কামভাবের সূত্রে নরনারীর যৌন-আচরণ বা যৌন-ইচ্ছাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নায়ক-নায়িকা। অলঙ্কারশাস্ত্রের মূল বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, সহজাত প্রবৃত্তির সূত্রে মনের ভিতর জেগে উঠতে পারে, নানা ধরনের অনুভব। যৌবনের প্রারম্ভে যে যৌনকামনা দেহ এবং মনে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠে, তা ঘটে জীবের ক্রবমিকাশের ধারায়। এই ধারায় জীবের ভিতরে কামভাব স্বাভাবিকভাবেই জাগ্রত থাকে। কখনো কখনো সুপ্ত কামনা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় জাগ্রত হয়ে উঠে। সুদর্শনা কোনো নারীকে দেখে যে কামভাব জাগে, তা প্রত্যক্ষ। কিন্তু কোনো কাব্য পাঠের ভিতর দিয়ে নারীর যে রূপ ওঠে এবং এর দ্বারা যে কামভাব জাগে তা সহজাত এবং অপ্রত্যক্ষ। ভরত মুনির একে বলেছেন 'বিভাব'। বিভাবের বিষয়টি ঘটে অপ্রত্যক্ষভাবে, তাই অতীন্দ্রিয়। মানুষের ভাবনা কল্পজগতের সম্ভব-অসম্ভবের ধার ধারে না। গল্পের রাজকন্যার প্রেমে পড়ে, তার সাথে মনে মনে অনেক কিছু করা সম্ভব। যে নারীকে অবলম্বন করে কামভাব জাগ্রত হয়, সে নারী আবলম্নন। আর এর সাথে যে সকল উপাদান সহায়ক ভূমিকা রাখে, তা হলো উদ্দীপন। বাসর ঘরে নববধূ আবলম্বন, আর নিরাপদ নিভৃত কক্ষ,পুষ্পশয্যা ইত্যাদি হলো উদ্দীপন। আবলম্বন বা নায়িকার সৌন্দর্যকে চিত্তগ্রাহী করার জন্য যে সকল উপাদনকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করার কথা বলা হয়, তাকে বলা হয়, সাত্ত্বিক অলঙ্কার। আলঙ্করিক ধনঞ্জয় অলঙ্কারকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো−
দৈহিক অলঙ্কার:
ভাব (সম্ভোগের জন্য নায়িকার চিত্তে যা মনোবিকার ঘটে। যার ভিতর দিয়ে নায়িকার আগ্রহ প্রকাশ পায়)
হাব (চক্ষু, গ্রীবা, ভুরু ইত্যদির বিকারের দ্বারা নায়িকা কামনাকে প্রকাশ করে। কিন্তু নায়িকা উদ্যোগী হয়ে অগ্রগামী হয় না)
হেলা (এই ক্ষেত্রে সপ্রেম হাসি, খেলাচ্ছলে কম্পিত স্পর্শ ইত্যাদির দ্বারা সম্ভোগ ইচ্ছার প্রকাশ)
স্বভাবজাত:
শোভা (আভরণ এবং অন্যান্য সাজসজ্জা দ্বারা নায়িকার যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়)
শান্তি (কাম নিবৃত্তিতে চিত্তে সহজাত প্রশান্তি জন্মে)
দীপ্তি (নায়িকার স্বাভাবিক যৌবনশ্রী )
মাধুর্য (নায়িকার স্বাভাবিক যৌবনলাবণ্য)
প্রগভলতা (নায়িকার বাক্যচাতুর্য্য, অগম্ভীর আচরণ, হেয়ালি ইত্যাদি)
ঔদার্য (নায়িকার ক্ষমাগুণ, সামান্য ত্রুটিকে মেনে নেওয়া ইত্যদি গুণ)
ধৈর্য (যে কোনো সঙ্কটে নায়িকার স্থির দশা, বা সুসময়ের অপেক্ষা করার ক্ষমতা)
মনোভাব সঞ্জাত: লীলা, বিলাস, বিভ্রম, ললিত, প্রণয়ভাব, কৃত্রিম ক্রোধ, ঔদাসিন্য। এই অলঙ্কারগুলো মনোজগতে নানা ধরনের বিকারের প্রকাশ। অন্যান্য আলঙ্করিকদের মতে, মনোভাব-সঞ্জাত অলঙ্কারের সংখ্যা আরও বেশি।
২. হাস্য: হাস স্থায়িভাব থেকে উদ্ভব হয়ে থেকে হাস্য রস। কৌতুকজনক বাক্য, অঙ্গভঙ্গী, সাজসজ্জা, ইত্যাদির দ্বারা মনে হাস্য-কৌতুকের দশা সৃষ্টি হয়। এর স্থায়ী ভাব হাস। ভরতমতে শৃঙ্গার থেকে হাস্য রসের উৎপত্তি হয়। এই মতে শৃঙ্গারের যে অনুকরণ, তাই হাস্য। এর বর্ণ সাদা এবং দেবতা প্রমথ। হাস্য রসের প্রকাশ ঘটে দুই ভাবে। এর একটি আত্মস্থ, অপরটি পরস্থ।
- আত্মস্থ: যখন নায়ক-নায়িকা নিজেই হাসেন, তখন তা হয় আত্মস্থ।
- পরস্থ: যখন নায়ক-নায়িকা অপরকে হাসান, তখন তা হয় পরস্থ।
হাসি একটি ক্রিয়াত্মক বিষয়। নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটতে পারে। ভারতীয় শাস্ত্রে এর বাহ্যিক প্রকাশকে ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো- স্মিত, হসিত, বিহসিত, উপহসিত, অপহসিত, অতিহসিত। মনুষ্য প্রকৃতি অনুসারে এই হাসিগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো- উত্তম, মধ্যম এবং অধম।
হাস্যের প্রকরণগত তালিকা
- স্মিত: এই জাতীয় হাসিতে গণ্ডস্থল ঈষৎ বিকশিত হয়, সৌষ্ঠবযুক্ত কটাক্ষ লক্ষ করা যায়। হাসির সময় এদের দাঁত দেখা যায় না। এই হাসি উত্তম প্রকৃতির মানুষের।
- হসিত: মুখমণ্ডল উৎফুল্লিত থাকে, চোখ ও গণ্ড হাসির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। হাসির সময় সামান্য দাঁত দেখা যায়। এই হাসি উত্তম প্রকৃতির মানুষের।
- বিহসিত: চক্ষু ও গণ্ডস্থল আকুঞ্চিত হয়। হাসির সময় মধুর আনন্দ-ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই হাসিটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। মুখমণ্ডলে উৎফুল্ল ভাব থাক। এই হাসি মধ্যম প্রকৃতির মানুষের।
- অবহসিত: হাসির সময় নাসিকা উৎফল্ল হয়, হাসির সময় বক্রদৃষ্টিতে অবলোকন করে। একই সাথে মস্তক ও স্কন্ধ অবনত হয়। এই হাসি মধ্যম প্রকৃতির মানুষের।
- অপহসিত: অস্থানে হাস্য (যেখানে হাসার কথা নয়, সেখানে হাস্য করা), চক্ষু অশ্রুপূর্ণ (হাসির সময় চোখে জল চলে আসে), স্কন্ধ ও মস্কক অতিমাত্রায় কম্পিত হয়। এই হাসি অধম প্রকৃতির মানুষের।
- অতিহসিত: চক্ষু সংরব্ধ (ক্রোধ, উৎসাহ, অহঙ্কার প্রকাশ পায়), কণ্ঠস্বর তীব্র ও উদ্ধত হয়। এই হাসির সময় হাত পার্শ্বদেশে স্থাপিত হয়। এই হাসি অধম প্রকৃতির মানুষের।
বাস্তবে হাসির সাথে মুখভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটে এবং কোনো কোনো হাসিতে অঙ্গের কম্পন ও বিক্ষেপ ঘটে। কিন্তু হাসির সাথে শব্দ ও শব্দহীনতার বিষয়টি আসে। হাস্য শব্দটি শুনলে মধুর হাসির কথা মনে হয়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তেমনটা নাও হতে পারে। হাসি কর্কশও হতে পারে। আমরা তো হাসির শব্দের বিচারে অনেক সময় বলি− ভুতের মতো হাসি, দানবের মতো হাসি, খলনায়কের হাসি ইত্যাদি। আচরণের বিচারে অনেক সময় বলি− চোরের মতো হাসি। নাট্যশাস্ত্রকার এই বিচারে কিছু হাস্যকে বিপরীত অলঙ্কার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিকৃত আচার, কথা, বেষ, বিকৃত, অঙ্গভঙ্গী'র কারণে সৃষ্ট রসকে হাস্য হিসেবে গণ্য করেছেন।
তাই নাট্যশাস্ত্রকার হাস্যরসের বিভাব, অনুভাব, ব্যভিচারী হিসেবে নানা কিছু উল্লেখ করেছেন।হাস্যের বিভাব: বিকৃত বেষ, অলঙ্কার, ধৃষ্টতা, লোভ, কুহক, অসৎ প্রলাপ, বিকলাঙ্গদর্শন, দোষখ্যাপন প্রভৃতি।
হাস্যের অনুভাব: ওষ্ঠদংশন, নাসিকা ও গণ্ডস্থলের কম্পন, নেত্রের বিস্তার ও আকুঞ্চন, ঘর্ম, মুখরাগ, পার্শ্বদেশে হস্তস্থাপন প্রভৃতি।হাস্যের ব্যভিচারী: আলস্য, অবহিত্থা, তন্দ্রা, নিদ্রা, স্বপ্ন, জাগরণ ও অসূয়া।
৩. করুণ: শোক স্থায়িভাব থেকে করুণ রসের উদ্ভব হয়। এই শোক হতে পারে প্রিয়জনের হত্যা দর্শন, অপ্রিয় বাক্য ইত্যাদির থেকে। মূলত শোকের ভাব এতে প্রকাশ পায়।
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, বিবর্ণ, হাস, স্বরভঙ্গ।
- মন-ব্যভিচার: আবেগ, গর্ব, চপলতা, বিতর্ক, মতি, মদ, স্মৃতি হর্ষ।
- করুণ রসের অনুভাব: স্বেদ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ, বিবর্ণ ও অশ্রু।
- করুণ রসের ব্যভিচার:
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, ঘাম, বিবর্ণ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ ।
- মন-ব্যভিচার: অবহিত্থা, অসূয়া, উৎকণ্ঠা, ক্রীড়া, চিন্তা, ত্রাস, দৈন্য, বিষাদ, ব্যাধি, মরণ, শঙ্কা, শ্রম, স্মৃতি, স্বপ্ন।
কাব্যে করুণ রসের নমুনা−
কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা− সজল আঁখি সখীরে;−
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
-মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন৪. রৌদ্র: ক্রোধ স্থায়িভাব থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। তাই ক্রোধকে বলা হয় রৌদ্রের স্থায়ীভাব। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। ভরতমতে এর বর্ণ রক্ত ও দেবতা রুদ্র। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: কম্প, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, প্রলাপ।
- মন-ব্যভিচার: অমর্ষ, অসূয়া, আবেগ, উগ্রতা, গর্ব, বিতর্ক, বিরোধ, মতি, মদ, স্মৃতি।
শিল্পের নানা মাধ্যমে রৌদ্র রসের উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। নৃত্যে ও নাটকে এর উপস্থাপন করেন দৈহিক অভিনয়ের মাধ্যমে। সঙ্গীতে এর উপস্থাপন হয় শব্দের মাধ্যমে। কণ্ঠসঙ্গীতে এই রস পাওয়া যায় বাণী ও সুরের সংমিশ্রণে। কাব্যে এর রূপ ধরাপড়ে ছন্দেবন্ধে। যেমন−
কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা− সজল আঁখি সখীরে;−
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
-মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন"কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
-মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন৫. বীর: উৎসাহ স্থায়িভাব থেকে এই রসের উৎপত্তি হয়। দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়। ভরতমতে বীরের কর্মফলই অদ্ভুদ রস। এর বর্ণ গৌর এবং দেবতা মহেন্দ্র।
এই রসে একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা। ভয়ানক, শান্ত রস বিরোধী। এর স্থায়ীভাব উৎসাহ।
বীররসকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো− দান, ধর্ম, যুদ্ধ ও দয়া। মূলত এই চারটি হলে বীরের প্রধাম গুণাবলি। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, সংমোহ।
- মন-ব্যভিচার: অমর্ষ, আবেগ, উগ্রতা, ধৃতি, বিতর্ক, বিরোধ, মতি, মদ, স্মৃতি, হর্ষ।
কাব্যে বীররসের নমুনা−
বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
সুগ্রীব; "মরিব, নহে মারিব রাবণে,
এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
-মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদন৬. ভয়ানক: ভয় স্থায়িভাব থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, সে ভাব থেকেই ভয়ানক রসের উদ্ভব হয়। ভরতমতে বীভৎস থেকে ভয়ানক রসের উৎপত্তি হয়। ভরত মতে যা বিভৎস তাই ভয়ানক। এর বর্ণ কৃষ্ণ, দেবতা কাল। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, কম্প, ঘাম, স্তম্ভ, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, প্রলাপ।
- মন-ব্যভিচার: অপস্মার, আবেগ, ক্রীড়া, চিন্তা, ত্রাস, দৈন্য, বিষাদ, শঙ্কা, শ্রম, স্মৃতি।
৭. বীভৎস: জুগুপ্সা স্থায়িভাব থেকে বিভৎস রসের সৃষ্টি হয়। ভরত মতে যা বিভৎস তাই ভয়ানক। বীভৎস রসের বর্ণ নীল এবং দেবতা মহাকাল। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: রোমাঞ্চ, প্রলাপ।
- মন-ব্যভিচার: অমর্ষ, আবেগ, উগ্রতা, ব্যাধি।
৮. অদ্ভুত: বিস্ময় স্থায়িভাব থেকে এই রসের উদ্ভব হয়। আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভূত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ অলৌকিক বা অসমাঞ্জস্য বিষয় থেকে এই রস উজ্জীবিত হয়। এর বর্ণ পীত ও দেবতা ব্রহ্মা।
এর স্থায়ী ভাব বিস্ময়। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: কম্প, ঘাম, বিবর্ণ, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ।
- মন-ব্যভিচার: অসূয়া।
কাব্যে অদ্ভুত রসের নমুনা−
"সবিস্ময়ে রঘুনাথ নদীর উপরে
হেরিলা অদ্ভুত সেতু, অগ্নিময় কভু,
কভু ঘন ধূমাবৃত, সুন্দর কভু বা
সুবর্ণে নির্ম্মিত যেন! ধাইছে সতত
সে সেতুর পানে প্রাণী লক্ষ লক্ষ কোটি
হাহাকার নাদে কেহ; কেহ বা উল্লাসে!
-মেঘনাদ বধ, অষ্টম সর্গ। মধুসূদন
৯. শান্ত: এর স্থায়ীভাব শম। চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়। এর বর্ণ কুন্দেন্দুসুন্দর, দেবতা নারায়ণ। সৃষ্ট ব্যভিচার হলো−
- তনু ব্যভিচার: অশ্রু, রোমাঞ্চ, স্তম্ভ।
- মন-ব্যভিচার: ধৃতি, নিদ্রা, নির্বেদ, মতি, স্মৃতি, হর্ষ।
১০.
বাৎসল্য: সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের
উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য রস।
বর্তমানে অনেকেই শান্ত ও বাৎসল্যকে প্রধান রস হিসেবেই বিবেচনা
করে থাকেন।
[তথ্যসূত্র: চৈতন্য ও তাঁহার শিষ্যগণ। তত্ত্ববোধিনী 'পৌষ ১৮১২ সংখ্যা]
১৫৯ পৃষ্ঠা
নন্দনতত্ত্বে রস
নন্দনতত্ত্বের বিচারে বলা যায়,
রস হলো সৃজনশীল কর্মের এমন একটি বার্তা, যা তথ্যগ্রাহকের কাছে
বিশেষ অর্থবহ হয়ে উপস্থাপিত হয়। রসনার বিচারে
রসের আক্ষরিক অর্থ
হলো−
আস্বাদনীয় বা রসনাগ্রাহ্য গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। এগুলো হলো−
মধুর,
অম্ল, লবণ, কটু, কষায়, তিক্ত।
বাস্তব জগতের এই ভাব রসনার বাস্তব
অনুভূতি উপস্থাপন করে। সৃজনশীল কর্মে রসের
রূপ ভিন্নতর। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি দশা মাত্র।
বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ
স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা প্রত্যক্ষভাবে
ইন্দ্রিয়ের অধীন। ওই আনন্দসমূহের সুসমন্বিত
তরঙ্গপ্রবাহে সৃষ্টি হয় সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মনোজগৎকে নানাভাবে আলোড়িত করে। ফলে
মনোজগতে নানা ধরনের ভাবের সৃষ্টি হয়। এই ভাবের অস্তিত্বগত অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব।
এই ভাব যদি সৃজনশীলকর্মের মাধ্যমে শ্রোতার মনকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে যায় রস।
ধরা যাক, একটি শব্দ কেউ শুনছেন। প্রাথমিকভাবে এই শোনাটা হবে শ্রোতার কাছে শ্রবণেন্দ্রিয়ের ভিতর দিয়ে
শব্দের অনুভব। এই অনুভবটা মনে কি ধরনের অনুভূতির জন্ম দেবে, তা নির্ভর করবে 'আমি'র
গ্রহণ করার ক্ষমতার উপর। এই শব্দ 'আমি'র কাছে স্বস্তিকর বা অস্বস্তিকর হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে প্রতিটি অনুভব 'আমি'কে যে অনুভূতি প্রদান করে, এর ফলে মন যে দশায়
উপনীত হয়, তাই হবে ভাব। কোনো শব্দ শোনার পর, তা যদি অস্বস্তিকর মনে হয় এবং এর
দ্বারা মনে রাগ, ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদির জন্ম হয়, তাহলে তা থেকে এক একটি ভাবের
জন্ম দেবে। আবার স্বস্তিকর শব্দের সূত্রে শ্রোতার মনে আনন্দের আনন্দ, উল্লাস
ইত্যাদির জন্ম দেবে।
এক্ষেত্রে ভাব এবং রস
সমন্বয়ে শিল্পের সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। নাট্যশাস্ত্রকারের মতে- 'ভাবশূন্য রস হয়
না, রসশুন্য ভাব হয় না'। [ষষ্ঠ অধ্যায়, রসবিকল্প, ৩৬]
মানব মনের রসস্তর
মানুষ শুধু বস্তুজগতের বাস্তবতা নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে বাঁচার আশায়। যে যুদ্ধে
পরাজিত
হয়, সে জয়ের আশা জিইয়ে রাখে মনের গভীরে। সে আশাকে চেষ্টার দ্বারা কার্যকর করতে নানা
ধরনের ভাবনা ভাবে। মনের ভিতরে তৈরি করে সে, জয়ের জন্য নানারকম পরিকল্পনা।
পরিকল্পনা পরিচালিত হয় নানা ধরনের কল্পনার হিসেব-নিকেশে। কখনো মানুষ তৈরি করে
বাস্তবের আদলে নানা ধরনের কল্পকথা। এই কল্পকথা থেকে জন্ম নেয়, গল্প, কবিতা,
চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত। আর কল্প-জগতের বহির্প্রকাশের ভিতর যা উপস্থাপিত হয় যে সৃজনশীল
কাজ, তাই হলো
শিল্পকর্ম। সকল মানুষ শিল্পী হয়ে উঠে না সত্য, কিন্তু শৈল্পিক ভাবনাটা থেকেই যায় অবচেতন
মনে।
শিল্পকর্মের সূত্রে মনের ভিতরে যে ভাবে সঞ্চার ঘটে, সেটাই
সেখানে সৃষ্টি হয় শিল্পের সৌন্দর্য জগৎ। আর প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক ঘটনায় যে ভাবের জন্ম নেয়, তা নিতান্তই জৈবিক
দশা। এই দশা জন্ম দেয় বাস্তব-সৌন্দর্য-জগৎ। মূলত
ভাব থেকেই নানবিধ
বোধের জন্ম হয়। বাস্তব জীবনের অনুভূতি থেকে পাওয়া যায় বাস্তব জগতের বোধ। আর শিল্পকর্মের
ভিতর দিয়ে যে নান্দনিক বোধের জন্ম হয় তারই অপর নাম সৌন্দর্যবোধ।
ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের
দার্শনিকরা এর নাম দিয়েছিলেন রস। এঁরা এর সন্ধান করেছেন
নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রের
উপস্থাপনের ভিতরে।
বাস্তববোধ এবং রসবোধ, উভয়ই
জাগ্রত হয় মানুষের মনোজগতে।
এই জগতের নিয়ন্ত্রক হলো 'আমি'
নামক সত্তা।
ভাবের সূত্রে উৎপন্ন বোধ মনোজগতে তিনটি স্তরে অনুভূত হয়। এই স্তরগুলো হলো উপরিতল,
মধ্যতল এবং গভীরতল।
মনোজগতের উপরিতল
(বাস্তবজগৎ): এই স্তরের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নির্ভর। এই কারণে এই স্তরটি
বাস্তব ঘটনা বা প্রপঞ্চের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। ধরা যাক, একটি
ফুলের গন্ধ কাউকে আনন্দ দান করে। এই আনন্দটি প্রত্যক্ষভাবে
মনকে আলোড়িত করবে। এই বিষয়টি ঘটবে মনের উপরিতলে। আবার 'আমি' যদি বাস্তব
জগতের কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়, তাহলে সে প্রথমে ইন্দ্রিয় দ্বারা তথ্য
সংগ্রহ করবে। এই বিষয় সম্পর্কে যদি সে তুলনা করতে চায়,
তাহলে স্মৃতিতে রক্ষিত তথ্যের সাহায্যে বর্তমান বিষয়ের তুলনা করবে। এই ঘটনাটি
ঘটবে মনের উপরিতলে।
এই তলে মানুষ কোনো কল্পলোক
তৈরি করতে পারে না বা করে না।
মনোজগতের মধ্যতল
(কল্প-বাস্তব জগৎ): এই তল বাস্তব জগৎ থেকে আংশিক বিচ্ছিন্ন একটি স্তর, আবার
একই সাথে তা বাস্তবতার সাথে তুলনাযোগ্য।
এই স্তরের জ্ঞান একটি ভিন্নতর সত্যের
আলোকে অর্জিত হয়। এই জগতে মানুষ একটি কল্পজগতের ভিতর সত্যের সন্ধান করে।
ধরা যাক, আপনার একজন প্রিয় মানুষের
উপর কেউ অত্যাচার করছে। এই বিষয়টি মনের উপরিতলকে আলোড়িত করবে। এই ঘটনা আপনাকে
উত্তেজিত করবে। এর বহিঃপ্রকাশ হবে রাগ, দুঃখ ইত্যাদি ভাবপ্রকাশের দ্বারা। যদি
আপনার ওই প্রিয়মানুষটি একটি নাটকে অংশগ্রহণ করে, এবং সেই নাটকে, নাটকের কিছু
চরিত্র আপনার প্রিয়মানুষটির উপর অত্যাচার করে; আর আপনি যদি ওই নাটকটি দেখার
জন্য দর্শকের সারিতে থাকেন, তাহলে প্রথমেই আপনার মন, মনোজগতের দ্বিতীয় স্তরে
প্রবেশের উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে আপনি যা কিছু দেখবেন তা মনোজগতের দ্বিতীয়
স্তরে প্রবেশ করবে। আপনি আগে থেকে জানেন যে, নাটকের একটি দৃশ্যে আপনার
প্রিয়মানুষটি অত্যাচারিত হবে। তারপরেও এই দৃশ্য দেখার জন্য বসবেন এবং এই দেখা
থেকে আনন্দ লাভ করতে চাইবেন। শুধু তাই নয়, আপনি আপনার সৌন্দর্যবোধ এবং
বাস্তবজ্ঞানের ভিতর দিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করবেন। তাই নাকটের ওই
দৃশ্য দেখে আপনি বাস্তব জগতের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। নাটকে আপনার প্রিয়
মানুষটি যখন অত্যাচারিত হতে থাকবে, তখন সে আপনার পরিচিত কেউ নেয়, সে তখন একটি
চরিত্র। তখন আপনি বিচার করতে বসবেন করবেন- অত্যাচারীরা অত্যাচার করছে তার ধরন
বাস্তব অত্যাচারের মতো হয় কিনা। আপনি বিচার করবেন, আপনার প্রিয় মানুষটি অত্যাচারিত হওয়ার সময়,
যথাযথভাবে বা বাস্তবসম্মত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন কিনা। যদি সবই বাস্ততার
অনুরূপ হয়, তা হলে আপনি তাঁকে বাহবা দেবেন। না হলে আপনি তার মুণ্ডুপাত করবেন।
কল্পলোকের ভাবনার সাথে বাস্তবজগতের
সাযুজ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টার ভিতরে সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা জরুরি। সততা এবং
সামঞ্জস্যের ভিতর দিয়ে শিল্পীমাত্রেই ছোটো ছোটো আনন্দ তৈরি করেন। এই সব আনন্দের
সুসমন্বয়ে গড়ে ওঠে সুন্দর উপস্থাপন, আর এর ভিতর দিয়ে মনের গভীরে যে নানারূপ সৌন্দর্যের
অনুভব জাগ্রত হবে এবং মনকে দ্রবীভূত করবে, তাই হবে রস। এখানে দ্রবীভূত হলো
বিষয়ের সাথে নিজেকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করা।
মনোজগতের গভীরতল
(রসোত্তীর্ণ জগৎ):
এই তলে মানুষ অনেকাংশেই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
মূলত দেহটা থাকে ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতে, কিন্তু মন থাকে নিজের বা অন্যের গড়া
বিমূর্ত-জগতে, তাতে বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থাকে, কিন্তু সে অভিজ্ঞতা নব নব রূপে
প্রকাশ পায় একান্তই আপনার মতো করে, আপনার জন্য। মনোজগতের উপরিতলের আনন্দ
মধ্যতলে পরিণত হয় রসে। আর গভীরতলে তা হয়ে ওঠে রসোত্তীর্ণ। তাই এই জগতে মানুষ
নাটক দেখে কাঁদে।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয়তলে সৃষ্ট সৌন্দর্য
রসগ্রাহীকে এতটাই গভীরে টেনে নেয় যে, সে রসজগতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে কারণে
অভিনয় দেখে মানুষ কাঁদে, হাসে, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শোনা যায়
ইতালি অভিযান শেষ নেপোলিয়ানের একদল সৈন্য,
লিওনার্দো দ্যা ভিন্সি
যে ঘরটিতে
The Last Supper
ছবিটি এঁকেছিলেন, সেই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। যিশুখ্রিষ্টের পরম ভক্তদের কেউ
কেউ তখন, যিশুর সাথে প্রতারণাকারী জুডাথের উদ্দেশ্য জুতো ছুঁড়ে মারে। ফলে সে
সময়ও ছবিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত এই সৈনিকরা প্রথমে মনোজগতের দ্বিতীয় স্তরে
প্রবেশ করে একটি রৌদ্ররস দ্বারা দ্রবীভূত হয়েছিল। এরপর এরা ছবিটির বিষয়বস্তুটির
সাথে এতটাই গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল যে, তাদের কাছে ছবির জুডাথ মনের গভীরতলে
বাস্তব হয়ে উঠেছিল। এখানে ছবির সৌন্দর্য নিয়ে সৈনিকরা মাথা ঘামায় নি। ছবিটি
নষ্ট হয়ে যাবে এটা নিয়ে তারা ভাবে নি। এই ছবিটি ঘটনাক্রমে একদল মানুষের সুকুমার
প্রবৃত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। এই কারণে একে নষ্ট ছবিও বলা যেতে পারে। কিন্তু
একটি কারণে ছবিটি সৌন্দর্যের দাবিদার হয়ে ওঠে। তা হলো এর সততা এবং উপাদানের
সমন্বয়ে যে সত্যটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা সৈনিকদের বাস্তব জগত থেকে ভুলিয়ে ঠেলে
দিয়েছিল কল্পজগতে এবং একই সাথে কল্পজগতের ভিতরে বাস্তব সত্যের সন্ধান লাভ
করেছিল। সবমিলিয়ে ছবিটি ওই সৈনিকদের কাছে রসোত্তীর্ণ মানে পৌঁছেছিল।
রসাস্বাদনের স্বরূপ
প্রতিটি রসের রয়েছে নিজস্ব রূপ।
ছোটো ছোটো মৌলিক রূপের সমন্বয়ে রস পূর্ণরূপ লাভ করে। আবার এই রসের অনুভব সবার
ভিতরে সমান উদ্দীপনা জাগায় না বলে রসের কোনো সর্বজনীন আদর্শ রূপ নেই। তবে
ব্যক্তি বিশেষের কাছে কোনো আদর্শ রূপ গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা যায়, প্রতিটি
ব্যক্তির কাছে রসের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু
রসের অনুভব অনেকের সাথে প্রায় এক হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। এর ফলে
সমমনা মানুষের কাছে রসের একটি গড় মান তৈরি হয়। এই গড় মানের বিচারে সমমনা
মানুষগুলো সমস্বরে বলতে পারে ওই গানটি করুণ। একই নাটক দেখে কেউ কাঁদে কেউ ততটা
বেদনার্ত হয়ে ওঠে না। তাই একই শিল্পকর্ম কাউকে রসে সিক্ত করে, আবার কাউকে
রসোত্তীর্ণ করে।
শিল্পকর্মের রসের আস্বাদনে কতকগুলো বিধি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এই সকল বিধি গড়ে ওঠে কিছু অবস্থার উপর, যা রসগ্রাহীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। এই সকল বিধিই মানুষকে রসজগতে বা রসোত্তীর্ণ জগতে টেনে নিয়ে যায়। যেমন
১. সংবেদনশীলতা: সংবেদনশীলতা হলো সাড়া দেওয়ার গুণ। অর্থাৎ দুঃখের গল্প শুনে দুঃখ অনুভব করা, হাসির গল্প শুনে হাসা। বিষয়টির সাথে ব্যক্তি বিশেষের মানসিকতার সম্পর্ক নিবিড় রয়েছে। কিন্তু কিছু রস রয়েছে, যা সহজজাত। এই বিচারেও রসাস্বদেনের প্রকৃতি দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১.১. সহজাত সংবেদনশীলতা: কাম, ভয়ের মতো কিছু সহজাত অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। এই অনুভূতি যখন কোনো শিল্পকর্মের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়, তখন মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা আনন্দ বেদনা লাভ করে।
১.২. অভিজ্ঞতা সঞ্চাত সংবেদনশীলতা: রসিক জনের কাছে রসিকতা করলে, হাসতে হাসতে তার মৃত্যু হতে পারে। বে-রসিকের কাছে রসিকতা করলে, তার হাতে রস পরিবেশকেরই মৃত্য ঘটতে পারে। দুটি বিষয়ই ঘটবে রসবোধের হেরফেরের জন্য। একটি নাটক দেখে কেউ চোখের জলে ভাসে, কেউ বা চোখ পাকিয়ে বলে যত সব আদিখ্যেতা। রাগ-সঙ্গীত শুনে যার মনে রসের পরিবর্তে রাগের জন্ম হয়, তার কাছে রাগ করেও রাগসঙ্গীতের কথা বলাটা বিপজ্জনক হবে।
রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণ, উভয় ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা গড়ে উঠবে বিশেষ ধরনের মাধ্যমের দ্বারা সৃষ্ট রসের প্রকৃতি অনুসারে। যেমন রাগসঙ্গীত একটি মাধ্যম। রাগের মাধ্যমে রস সৃষ্টির অভিজ্ঞতা যেমন শিল্পীর থাকা দরকার তেমনি শ্রোতারও থাকা দরকার। মূলত রসের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় রসিক মন। এই মনের অধিকর্তা 'আমি'। তাই 'আমি'-ই হলো মূল রসিক। আমি'র ভাণ্ডারে থাকে নানা ধরনের আনন্দের অনুভূতি। আবার নানা ধরনের আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট নানা ধরনে সৌন্দর্যের স্মৃতিও আমি স্মরণ করতে পারে। মনের দ্বিতীয় স্তরে যে রসের জন্ম হয়, কিন্তু তার মৃত্যু নেই। মনের গভীরে তার রূপ ঘুমিয়ে থাকে। যখনই 'আমি' কোনো সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ায়, মনের ভিতরের রসের অভিজ্ঞতা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। মনের গভীরে ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো নতুন সৌন্দর্যের সংস্পর্শে সে জেগে ওঠে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়কের সাথে দ্রুত ভাব বিনিময় হয়। 'আমি' তুলনা আগের সৌন্দর্যকে আদর্শ ধরে বর্তমান সৌন্দর্যকে বিচার করে। একজন শিল্পীর প্রথম সাফল্যের পর, দ্বিতীয় বারের সাফল্য সংপ্রশ্নের মুখে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রথম বারের পরিবেশন মানের কাছাকাছি থাকার জন্য শিল্পীকে সচেষ্ট থাকতে হয়। শিল্পীর তৈরি আগের সৌন্দর্যকে অতিক্রম করে নতুন সৌন্দর্য স্থাপন করার মধ্য দিয়ে নিজেকেই সংপ্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়।
১.৩. নিবিড় নৈকট্য: রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণের জন্য শিল্পী এবং রসগ্রহণকারী উভয়েরই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকাটা জরুরি। শিল্পী যদি নিজে রসকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এবং ওই অনুভব অনুসারে যথাযথ রসকে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে তাঁর নিবিড় নৈকট্য ঘটে নি। যাচ্ছে-তাইভাবে রসের উপস্থাপন করাটা শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক। একইভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে শিল্পকে গ্রহণ করাটা উচিত নয়। বরং এটা অনেক সময় অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যায়, সঙ্গীতানুষ্ঠান চলাকালে অনেকে নিজেদের ভিতর অন্য বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এটি শিল্পীকে অপমান করার পর্যায়ের অপরাধ। এই জাতীয় শ্রোতারা সারাজীবনে অসংখ্য আসরে বসেও সঙ্গীতের রস নিতে পারেন না। এঁরা মূলত নিজেকে সঙ্গীতবোদ্ধা বা সঙ্গীতরসিক হিসেবে জাহির করার জন্য আসরে আসেন। এটা তাদের একটি অহঙ্কারের বিষয় হয়ে ওঠে এই ভাবে 'আমিও ওই আসরে ছিলাম।'
১.৪. কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসন: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো বিষয়ের সাথে বাস্তব কোনো বিষয়ের নিকট সম্পর্ক থাকে। শিল্পের প্রয়োজনে শিল্পী বাস্তবতাকে অনেক সময় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কাহিনি ফুটিয়ে তুলবার জন্য নাট্যকার নানারকম সংলাপ ব্যবহার করেন। বাস্তবে ঐতিহাসিক চরিত্রটি হয়তো ওইভাবে কথা বলতেন না। এক্ষেত্রে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংলাপ রচিত হয়েছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। ঐতিহাসিক নাটকের পোশাক, আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে সততা থাকা দরকার। কিন্তু সংলাপ, সঙ্গীত, অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদির ভিতরে বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়াটা রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটায়। এক্ষেত্রে বাস্তবে সত্য আর শিল্পের সত্য একটি বিন্দুতে মিলিত হয় বটে, কিন্তু কোথাও কোথাও বাস্তব সত্যকে শিল্পের সত্য অতিক্রম করে যায়। আর এই অতিক্রমের দ্বারাই মনের দ্বিতীয় স্তরে রসের সৃষ্টি হয়। এই রস সৃষ্টির জন্য নাট্য পরিচালক আলো, শব্দ ব্যাবহার করেন নানা ভাবে। মঞ্চকেও ব্যবহার করেন নান্দনিক অনুভূতি থেকে। নাটকের রসকে দর্শকের মাঝে ফুটিয়ে তোলার জন্য এগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সংলাপের দ্বারা যে করুণ রসের সৃষ্টি হবে, একটি বাঁশি বা বেহালার সুর তাকে আরও তীব্রতর করে থাকে। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি মঞ্চে দেখানো হয়। বাস্তবতা অনুসরণ করে, মঞ্চে গিয়ে বৃষ্টির ফোটা খোঁজাটা বোকামি। বাস্তবের অনুভূতি প্রদানের ভিতরই রয়েছে রস সৃষ্টির সার্থকতা। আবার শিল্পের নামে যথেচ্ছাচারও চলে না। যার জন্য যতটুকু, তাতে ততটুকু সৌন্দর্যই মেশাতে হয়। কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজন পরিমিতি বোধ। এই সংমিশ্রণে থামতে জানতে হয়। গল্পের গরু গাছে ওঠে রূপকথায়। সেখানে মানায়, কিন্তু শরৎচন্দ্রের মহেষ নামক গল্পের গরুকে গাছে চড়ালে, নাট্যকার নিজেই নাট্যগুরু না হয়ে নাট্যগরু হয়ে যাবেন।
১.৫. সামঞ্জস্য: রস সৃষ্টির জন্য শিল্পের ছোটো সৌন্দর্যকে সুসমন্বিত করা প্রয়োজন। কোনো কোনো অভিব্যক্তি একাধিক রসকে জাগ্রত করে থাকে। চোখের জল কান্নার প্রতীক আবার তীব্র আনন্দেরও প্রতীক। শুধু চোখের জল ফেললেই হয় না, সাথে মুখভঙ্গী, সামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী না থাকলে, অভিনয়টাই নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ রয়েছে পাগলের হাসি আর রসিকের হাসি, বেদনার আহ্ আর শীৎকারের আহ্, গোগ্রাসে খাওয়া আর শান্ত হয়ে খাওয়া ইত্যদির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকা রস সৃষ্টির জন্য জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কণ্ঠসঙ্গীতের সাথে উৎকট সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহার। বাদ্যযন্ত্রের যথাযথ ব্যবহারে সঙ্গীতের রসকে উজ্জীবিত করে, নইলে যন্ত্রের যন্ত্রণা বাড়ে। শিল্পী একই সাথে স্রষ্টা এবং রসিক। তাই তাকে শুধু সৃষ্টির কথা ভাবলে হয় না, রসের কথাও ভাবতে হয়। নইলে সৃষ্টিতে ভেজাল ঢুকে পড়ে।