সত্তার সত্য

নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে যা স্বতন্ত্র পরিচয় ধারণ করে, তাই হলো সত্তা। একটি সত্তা যে সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাই ওই সত্তার বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম। ব্যাকরণের সূত্রে ধর্ম হলো- ধৃ (ধারণ করা+ ম (মন্) প্রত্যক্ষ অনুভবের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, সত্তার গুণ (Quality)এই সূত্রেই আমরা বলে থাকি আগুনের ধর্ম, পানির ধর্ম বাতাসের ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু বস্তুকে অনুভব করা হয়, শুধু এর নিজস্ব গুণ দিয়ে নয়। অন্য কোনো সত্তার কাছে তা কিভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, তার দ্বারা। এই বিচারে প্রত্যক্ষ সংবেদন হয়ে উঠে কোনো বিশেষ সত্তার দ্বারা অন্য সত্তার দ্বারা অনুভবের বিষয়। এই অনুভবের বিষয়টি নানা ভাবে সংঘটিত হতে পারে।  

প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য বস্তু থেকে পৃথক করে। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয় অন্য সত্তার শনাক্ত করার ক্ষমতার দ্বারা।
সত্তার ধর্মের প্রকাশ ঘটে সত্তা এবং সত্তা পর্যবেক্ষকের পারস্পরিক তথ্য-যোগাযোগের সূত্রে। একটি সত্তা যত ধরনের গুণাবলি ধারণ করে, তার সবটুকু পর্যবেক্ষকের কাছে যদি ধরা না পড়ে, তাহলে পর্যবেক্ষক ওই সত্তার ধর্ম সম্পর্কে আংশিক ধারণা করতে পারে মাত্র। সেই কারণে একাধিক ব্যক্তি একই সত্তা একই রকমভাবে অনুভব করতে পারে না। ধরা যাক একটি আলোকিত ঘর। এই ঘরের একটি গুণ হলো আলোকিত দশা। একজন অন্ধলোকের কাছে এই ঘরটির আলোকিত গুণটি ধরা পড়বে না।  অন্ধ লোকের বিচারে সবই অন্ধকার। তার অর্থ এই নয়, আলোকিত ঘর হতে পারে না। কোন বর্ণান্ধ মানুষ হয়তো লাল রঙ ধরতে পারে না। সুতরাং একজনের জন্য লাল ফুল, বর্ণান্ধের জন্য তা অন্য রঙের ফুল। সর্দি হলে, আমরা অনেক সময় অনেক গন্ধ পাই না। তার অর্থ এই নয় যে, ওই বস্তুটি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোনো সত্তার প্রকৃত গুণ কি, সেটা কোনো সুনির্দিষ্ট মান প্রদান করে না।  এই বিচারে মানুষ বা মানবেতর প্রাণী বাস্তবে অন্যকোনো সত্তার ধর্ম সম্পূর্ণ জানতে পারে না তার তথ্যগ্রহণের অক্ষমতার কারণে।

কোনো সত্তার ধর্ম যখন কারো কাছে প্রকাশিত হয়, তখন
সত্তার কিছু গুণ বা উপলব্ধি-কৃত গুণের মানের বিচার চলে আসে। একই সাথে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বিচারের বিষয়টি চলে আসে। সাধারণভাবে এই জাতীয় বিষয়গুলো যে ভাবে বিচার করা হয়, তাই হবে সত্তার গুণমানের বিচার। যেমন-

ধর্ম ও বিশ্বাস
যে কোনো সত্তা তার নিজস্ব ধর্ম নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিরাজ করে। অন্য সত্তার কাছে তার রূপের অংশবিশেষ ধরা পড়ে,
অনুভবের ভিতর দিয়ে। একটি সত্তার যতটুকু রূপ অন্য সত্তার কাছে ধরা পড়ে, তার সমন্বিত রূপ থেকে জন্ম নেয় ভাবমূর্তি। আর ভাবমূর্তির অনুভবকে গ্রহণ বা অগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে উৎপন্ন হয় সত্যাসত্যের ভাবমূর্তি। আর সেই ভাবমূর্তি থেকে জন্ম নেয় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় প্রতিটি সত্তার স্বতন্ত্র পরিচয়। এই বিশ্বাস থেকেই গাছপালা, নদী, গ্রহ, নক্ষত্র, ভাবনা চিন্তা, কল্পনা ইত্যাদি সবই এক একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবেই আমাদের কাছে মূর্তমান হয়ে উঠে। এর ভিতরে যে সকল সত্তার ওজন আছে এবং জায়গা দখল করে, সেগুলোকে মূর্ত সত্তা (ত্রিমাত্রিক জগতের বিচারে দৈহিক সত্তা)। এর বাইরের সব বিমূর্ত সত্তা। উভয় সত্তার স্বরূপ জানার চেষ্টার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় বিজ্ঞানমনস্কতা। এর ভিতর দিয়ে মানুষ যে ধারণা লাভ করে এবং ওই ধারণার ভিত্তিতে সে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। আর দৃঢ়তর সিদ্ধান্তই জন্ম দেয় বিশ্বাসের।

মানুষের বিশ্বাস সত্যাশ্রয়ী। অর্থাৎ মানুষের কাছে যখন কোনো বিষয় সিদ্ধান্তের বিচারে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, তখনই সে তা বিশ্বাস করা শুরু করে। যতদিন না নতুন কোনো সত্য আগের সত্যকে প্রতিস্থাপিত করে, ততদিন আগের বিশ্বাসেই সে থেকে যায়। মানুষ নানারকম সত্য ধারণ করে। নানারকম ছোটো ছোটোসত্যের সমন্বয়ে এক একটি মিশ্র সত্যের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি মিশ্র সত্যই একাধিক ক্ষুদ্র বিশ্বাসকে ধারণ করে। যেমন পানি তরল পদার্থ, এটি একটি সত্য। পানির আরেকটি বাষ্পীয় রূপ আছে এটি একটি সত্য। পানিকে উত্তপ্ত করলে পানি বাষ্পীভূত হয় এটিই আরও একটি সত্য। এই তিনটি সত্যই মানুষের কাছে পানির একটি সমন্বিত বা মিশ্র সত্যের প্রকাশ ঘটাবে। এবার অন্যদিক থেকে পানিকে দেখলে দেখা যাবে চিনি পানিতে গলে যায়, কিন্তু লোহা গলে না। পানির গলন-ধর্মের এই বৈপরীত্য নিয়েও একটি সত্য উৎপন্ন হবে। এইভাবে প্রতিটি বস্তুর ক্ষেত্রে যে সকল ধর্ম, মানুষের কাছে সত্য বলে স্বীকৃত হবে, তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে বিশ্বাস। মানুষের যে কোনো বিশ্বাস অর্জনের প্রক্রিয়া চারটি ধারায় সম্পন্ন হতে পারে। এই ধারা চারটি হলো

১. প্রত্যক্ষ বিশ্বাস: মানুষ তার ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে যে বিশ্বাস করে, তাই হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাস। যেমন আগুন গরম, এর নানারকম দ্রব্যকে দগ্ধ করার গুণ রয়েছে, এর দ্বারা পানিকে বাষ্পীভূত করা যায়, লোহাকে গলিয়ে ফেলা যায় ইত্যাদির ভিতর দিয়ে মানুষ আগুনের ধর্ম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে মানুষের ভিতরে আগুন সম্পর্কে একটি বিশ্বাসও জন্মেছে। আগুনে হাত পুড়ে যাবে, এই বিশ্বাস থেকে মানুষ আগুনে হাত দেবে না, কিন্তু লোহা গলানোর জন্য আগুন ব্যবহার করবে, পানি গরম করা বা বাষ্পীভূত করার জন্য আগুন ব্যবহার করবে। এরূপ বস্তুজগতের বিভিন্ন বস্তুর ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে জেনে মানুষ নানা ধরনের বিশ্বাসকে ধারণ করে এবং বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে। আদিমানবের প্রত্যক্ষ বিশ্বাসের জ্ঞান যা ছিল, তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নানা ধরনের বিষয় আবিষ্কার করেছে। এর ফলে সে অজর্ন করেছে নানাধরনের বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞান থেকে লাভ করেছে অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রত্যক্ষ বিশ্বাস।

২. পরোক্ষ বিশ্বাস: মানুষ তার নিজের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেমন প্রত্যক্ষ বিশ্বাস অর্জন করে, তেমনি অপরের বিশ্বাসকেও ধারণ করে থাকে। এই পিছনে থাকে একটি সত্যের আশ্বাস। পৃথিবী যে সূর্যের একটি গ্রহ এবং সূর্যের দিক থেকে এর অবস্থান তৃতীয়, তা নিজে পরীক্ষা করে দেখেছে ক'জন। কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সূত্রে সাধারণ মানুষ এই সত্যটাকে গ্রহণ করেছে। এখানে দুটি বিশ্বাস কাজ করে। একটি হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাসীর উপর বিশ্বাস, অপরটি হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে বিশ্বাস। যে সকল জ্যোতির্বজ্ঞানী সূর্য এবং পৃথিবীর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁদের সম্পর্কে এই বিশ্বাস থাকতে হবে যে, তাঁরা মিথ্যা বলছেন না। আর তাঁরা মিথ্য বলছেন না, তাই তাঁদের কথাও বিশ্বাস করা যায়। যেহেতু বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তাহলে তার বিবৃত্তিরও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। মানুষের বাস্তব জীবন চলে এই দুটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।

৩. উপপ্রেয়মূলক (hypothetical) বিশ্বাস: এই জাতীয় বিশ্বাসে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশ্বাস কাজ করে না। কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে এক ধরণের কল্প বিশ্বাস তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানীরা কোনো সত্য আবিষ্কার করার আগে এই রকম কিছু বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হন। অনেক সময় এই জাতীয় বিশ্বাস সুদূর-প্রসারী কোনো ফলাফল আনে না, কিন্তু গবেষাণার ধারাকে সচল রাখে। বাস্তব জীবনে এই জাতীয় উপপ্রেয়মূলক ভাবনা কখনো কখনো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। এর দ্বারা কখনো মানুষ সফল হয়, কখনো বিফল হয়। ধরা যাক, প্রতিবৎসর বর্ষায় পদ্মা নদীর একটি স্থানে সস্তায় ইলিশ মাছ বিক্রয় হয়। কোনো ব্যক্তির কাছে এই বিশ্বাসটি কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশ্বাস থেকে আসতে পারে। কোনো এক বর্ষা মৌসুমে একজন মানুষ এই বিশ্বাস নিয়ে পদ্মা নদীর ওই স্থানে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। ওই বছরের অবস্থা না জেনেই তিনি যে অনুমান নির্ভর বিশ্বাসের উপর ভর করে ওই স্থানে যাওয়ার যে উদ্যোগ নিলেন, সেটাকে বলা যাবে বিশ্বাসের বিশ্বাস। বাস্তব জীবনের এই জাতীয় বিশ্বাসকে ঠিক উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাস বলা যায় না। একে বলা যেতে পারে ধারণামূলক বিশ্বাস। উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের বিষয়টি দেখা যায়, গবেষণার ক্ষেত্রে। এমন একটি বিষয়, ঘটে চলেছে, কিন্তু এর প্রকৃত কারণটা অজানা। এই অজানা রহস্যকে উন্মোচন করার জন্য কিছু কাল্পনিক সত্যকে উপস্থাপন করা হয়, যুক্তিতর্ক দিয়ে। তবে এই কল্প-বিশ্বাস এতটাই সত্যের কাছাকাছি থাকে যে অনেক সময়, সমকালীন বিজ্ঞানীরা তার ত্রুটিই ধরতে পারেন না, বা পারলেও বিপরীত কোনো যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতে পারেন না। যেমন ১৮০৩-০৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইংরেজ পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানী জন ডাল্টন (John Dalton) পরমাণু সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রকাশ উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। তাঁর প্রদত্ত স্বীকার্য পাঁচটি সূত্রে গ্রথিত। একালের বিজ্ঞানীরা এই তত্তের নানাবিধ সমালোচনা করেন বটে। কিন্তু ১৮শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ডাল্টনের স্বীকার্যকেই বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তখন পর্যন্ত এই স্বীকার্য অস্বীকার করার মতো যথেষ্ঠ প্রমাণাদি উপস্থাপন করা যায় নি। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জে জে থমসন (J. J. Thomson,) ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেন।  এর ফলে ডাল্টনের তৃতীয় স্বীকার্যের অংশবিশেষ (পরমাণু বিভাজিত হতে পারে না) ভুল প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞানীদের প্রায় সব তাত্ত্বিক আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় এই জাতীয় উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের সূত্রে। তার চূড়ান্ত ধারণাটা আমরা জানতে পারি বটে, বিজ্ঞানীরা যে প্রাথমিক বিশ্বাসকে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না, তা অজানা থেকে যায়।

সাধারণভাবে আমরা যাদেরকে সাধারণ মানুষ বলি, এদের ভিতরেও এরূপ উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের জন্ম হতে পারে। তবে নিষ্ঠার সাথে তারা সে সকল বিশ্বাসের সত্যাসত্য যাচাই করেন না। ফলে তাদের উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসগুলো অমোঘ সত্যে পরিণত হয় না বা চূড়ান্ত ফলাফল বয়ে আনে না। 

৩. অলৌকিক বিশ্বাস: পার্থিব জগতের যা কিছু ঘটে তার একটি প্রকৃতি-নির্ভর সূত্র আছে। সেটা মানুষের শূন্যে ভেসে থাকা হোক, আর জলের উপরে আলোর নাচন হোক। মানুষ যখন প্রাকৃতিক বিধি অনুসারে এর ব্যাখ্য দিতে পারে, তখন তা হয়েছে যায় প্রাকৃতিক। আর লোক (মানুষ) যার সম্পর্কে আগে থাকেই জানে, তা হলো লৌকিক। এর বাইরে যা ঘটে, তা হলো অতিপ্রাকৃতিক বা অলৌকিক হিসেবে মানুষ চিহ্নিত করে। এর পিছনে একটি বিষয় মূখ্য ভূমিকা রাখে তা হলো সত্য। মানুষ যখন কোনো ঘটনাকে প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণ করে ব্যাখ্য দিতে পারে না বা  কোনো প্রাকৃতিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, তখন তাকে অলৌকিক বলে। যখনই কোনো প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন তা আর অলৌকিক থাকে না। বাংলাদেশের অনেক বদ্ধ জলাশয়ের উপরে রাতের বেলায় আলোর নাচানাচি দেখা যায়। কেন এটা ঘটে, মানুষ তার ব্যাখ্যা যতদিন দিতে পারে নি, ততদিন এটা ছিল আলেয়া নামক ভুতের আলো। এটা ছিল সম্পূর্ণ অলৌকিক বিশ্বাস। এখন আলেয়াকে কেউ অলৌকিক আলো বলে না।

মানুষের ধর্ম
প্রজাতিগতভাবে
Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) যে গুণাবলি ধারণ করে, তাই মানুষের ধর্ম। যেহেতু মনুষ্যজাতির সকল সদস্য একই রকম নয়, তাই একে চূড়ান্ত ধর্ম না বলে সেট তত্ত্বের সূত্রে বলা সাধারণ ধর্ম। প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ার মতো মানুষের ৩টি ধর্ম প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়। এই ধর্ম ৩টি হলো

আদিকালের মানুষের টিকে থাকার বা বেঁচে থাকার সমস্যা  স্থান এবং তার পরিবেশ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছিল। ফলে ঈশ্বরভাবনায় প্রকারভেদ চলে এসেছিল। আদিকালের মানুষ প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া বহু বিষয়ের ব্যাখ্যা লৌকিক জগতের বিচারে খুঁজে পায় নি। ফলে আশ্রয় নিতে হয়েছে অলৌকিক ভাবনার কাছে। চিরচেনা পাহাড়ের মুখ উপচে কেন আগুনে লাভা ছড়িয়ে পড়ে, কেনো রোগ মহামারী হয়, কেমন করে দিন-রাত্রির সংঘটন হয়, এরকম আরও কত কি। ফলে যথার্থ  ব্যাখ্যাহীন কৌতুহল ভিন্নঘাতে প্রবাহিত হয়েছে। প্রাকৃতিক যে সকল কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে পারে নি, সেকল বিষয়ের পিছনে একটি অলৌকিক শক্তির কথা ভেবেছে। ফলে বিষয়ানুসারে অলৌকিক শক্তির বিশ্বাসে বহুত্ব যুক্ত হয়েছে।

এরই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল অলৌকিক নানা উপখ্যান। এসকল উপাখ্যানে যুক্ত হয়েছিল নানা রকম উপাদান, কিন্তু তার ভিত্তি ছিল ভৌগোলিক পরিবেশ। আদিমানবগোষ্ঠী নানাভাগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলেই এমন কিছু প্রাকৃতিক বিষয় থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। মানুষ যখন এর প্রতিকার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর কারণ প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণে ব্যাখ্য দিতে পারে নি, তখনই তার উপর অলৌকিক বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এই সূত্রে মানুষ সৃষ্টি করেছিল দেবতাকূলের। বহু দ্বীপের গ্রিক উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র দেবতা পসেইডন যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভারতবর্ষের বিশাল স্থলভাগে জলের দেবতা বরুণ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বঙ্গদেশের স্থলচর মানুষের জন্য সমুদ্র দেবতার দরকার পড়ে নি। মধ্যপ্রাচ্যের পৌরাণিক কাহিনিতে বরফের দেবতা নেই। কিন্তু ীতপ্রধান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নর্স পৌরাণিক কাহিনিতে আছে বরফের দেবী স্কাদি (
Skadi)। বাংলাদেশে কোনো বরফের দেবতা নেই। কারণ, এখানে প্রচণ্ড শীতেও বরফ পড়ে না। জলাজঙ্গলার বাংলাদেশে সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য মনসা দেবী পূজিতা হন, কিন্তু উত্তর ভারতের মনসা অবহেলিতা। এরূপ ভৌগোলিক পরিবেশের বাইরেই রয়েছে কিছু সাধারণ চাহিদা বা বিষয়। তাই সম্পদ ও খাদ্যের দেবদেবী  নানাভাবে রয়েছে নানা পৌরাণিক উপাখ্যানে। রয়েছে যুদ্ধদেবতা বা যুদ্ধংদেহী বীরযোদ্ধার উপাখ্যান।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মানুষ পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেতো কিন্তু এর প্রতিকারে কোনো পথ জানা ছিল না। তাই তারা ভেবেছিল  'অলৌকিক শক্তি'র অধিকারী কেউ আছে, যে এই বিপর্যয় ঘটে। এই অলৌকিক শক্তির ভাবনা একসময় বিশ্বাসের সূত্রে দেবতা হয়ে গেছে। রাগান্বিত মানুষকে প্রশস্তি এবং উপহার দিয়ে শান্ত করা যায়, এই বোধ থেকে আদিম মানুষ দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, শ্লোক রচনা করেছে আবার উপহার দিয়ে পূজা করেছে। এর সাথে কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ পুরোহিতের ভূমিকায় নেমে, বিধি তৈরি করেছে। সে সময় সাধারণ মানুষ দেবতার জন্য যে, ভোগ নিবেদন করতো, মূলত তা ভোগ করতো দেবতার নামে পুরোহিতরা। কালক্রমে এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে পুরাণ-কথা।

এই অলৌকিক বিশ্বাস কালক্রমে বহুদেবতা নির্ভর ধর্মমতে পরিণত হয়েছিল। পৌরাণিক ধর্মের দেবতাদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য পুরোহিতরা তৈরি করেছিলেন পৌরাণিক কাহিনি। কিন্তু প্রতিটি কাহিনি গড়ে উঠেছিল স্থানীয় জীবনযাত্রার সাথে সমন্বয় করে। আরও পরে আরও বহু ঈশ্বরের একীভূত দশাকে সমন্বিত করে একটি অখণ্ড সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রকাশ ঘটেছিল একেশ্বরবাদী দর্শন। একালে মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসের যে রূপ পাওয়া যায়। তার শ্রেণি বিভাজনটা নিচের মতো হতে পারে।

জগতের সৃষ্টির সাথে সাথে স্বয়ম্ভূ আত্মার উদ্ভব হয়েছে, তাকে আল্লাহ বা ব্রহ্মা যাই বলা যাক না কেন, বিশ্বাসের বিচারে এক, কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার বিচারে পৃথক। ইসলামের সুফিবাদীরা জগৎ-আত্মার সাথে জগতের সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ধ্যানের ভিতর দিয়ে। এঁরা ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে ধ্যানের ভিতর দিয়ে জগৎ-আত্মার সন্ধান করেছেন। ব্রাহ্মধর্মও আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত। সকল ধর্মে জগৎ-আত্মা শুভ। এর বিপরীতে রয়েছে অশুভ শক্তি। ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম ধর্মে এই অশুভ শক্তি হলো শয়তান। অশুভ শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় সকল সনাতন ধর্মেও। বৌদ্ধধর্মেও অশুভ শক্তি 'মার'। জগতের সবই যদি জগৎ-আত্মার অংশ হয়, তাহলে শয়তান, মার তথা সকল অশুভ শক্তিও তো জগৎ-আত্মার অংশ। এই দ্বন্দ্বটা রয়েছে মূলত শুভ-অশুভ ভাবনার ভিতরে।

যা বিতর্কের জন্ম দেয়, যা বিভাজিত করে, তা কোনো সত্তার বিচারে পরম ধর্ম নয়। জীবধর্ম ও জড়ধর্মের বিচারে পৃথিবীর সকল মানুষ একই ধর্মের। কিন্তু বিশ্বাসের ধর্মের বিচারে মানুষ বিভাজিত। 'যত মত তত পথ' তার অর্থ বহু বিশ্বাসনির্ভর পথ। সকল মানুষের বিশ্বাস এবং জড় ও জীব ধর্ম নিয়ে যদি কোনো অখণ্ড সত্তা হিসেবে মানুষকে বিবেচনা করা যায়, তাহলে সেটাই হবে মানুষের ধর্ম। ধর্মমতগুলো মানুক আর না মানুক, প্রতিটি ধর্মমতই মানুষের ধর্মের অংশ মাত্র। 'আমার ধর্মমতই শ্রেষ্ট' এর চেয়ে কোনো বড় অহঙ্কার নেই। ধর্ম বিশ্বাস থেকেই বলি, আপনার মতই যদি শ্রেষ্ঠ তবে, ঈশ্বর আপনার ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন কেন? এর উত্তর আপনি জানেন না, বলেই আপনার মতই শ্রেষ্ঠ মত বলে বিবেচনা করেন।

এসব তর্ক বাদ দিলে, বিশ্বাসের বিচারে তাহলে মানুষের ধর্ম ভিত্তি কি। মূলত ধর্মে ভিত্তি হলো কল্যাণ। এর ভিতরেই নিহিত আছে পবিত্র-অপবিত্র, শুভ-অশুভ ইত্যাদি নানা বিষয়। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার বিচারে, জগতের সবকিছু কল্যাণকর নয়। মূলত যা দেহ ও মনের জন্য কল্যাণকর তাই পবিত্র, তাই শুভ। একই অর্থে অকল্যাণকর যা কিছু, তার সবই অশুভ। মানুষের বিচারে জগৎ-আত্মার ক্ষতিকারক অংশই হলো শয়তান। প্রতিটি সত্তা তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। তাই শুভ শক্তির বিচারে যা কিছু অকল্যাণকর তা এমন তাই অশুভ শক্তি। আবার অন্য দিক থেকে বলা যায়, অশুভশক্তিও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। এই টিকে থাকার স্বপক্ষে যা কিছু আছে, তা অশুভ শক্তির জন্য কল্যাণকর। সেখানে মানুষ যাকে শুভ বলে, শয়তানের জগতে সেটাই অশুভ বা অকল্যাণকর। ধরা যাক, শয়তানের শক্তি প্রতিষ্ঠা পেলো। তখন শয়তানের নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যে যা কিছু করবে তার সবই ওই রাজ্যের জন্য কল্যাণকর হবে। সেটা না পেলে শয়তানের রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই টিকে থাকার জন্য যার যার ক্ষেত্রে শুভ ইচ্ছাটারই জয় হতেই হবে, এরই তাগিদে জন্ম নেয় নিজস্ব বোধ।

মানবিক বোধ শব্দটা প্রায়ই শুনতে হয়। মানুষের চৈতন্যে দ্বারা যে ভাবের সৃষ্টি হয়, তার উপলব্ধি হলো মানবিক বোধ। এর কোনো আদর্শ মাপকাঠি নেই। মানুষে মানুষে চৈতন্যের পার্থক্য যদি থাকে, তাহলে মানিবক বোধেরও পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। মূলত মানবিক বোধ হলো মানুষের বোধের একটি গড় মান। মানবিক বোধ-এর এই আক্ষরিক অঙ্গন ছেড়ে বাইরের দিকে তাকালে মানবিকবোধের ব্যাপ্তী ঘটে। এই ব্যাপ্তীর মূলে থাকে কল্যাণ। এই কল্যাণের লক্ষ্য হতে পারে মানুষ, পশু, প্রকৃতি ইত্যাদি । সব মিলিয়ে মানবিক বোধের গড়মান গড়ে উঠে একটি সমাজের সমমনা চৈতন্যবোধের ভিত্তিতে। এর বাইরের বিপরীত অবস্থানে যা থাকে, তার গড় মান অমানবিক বোধ। বিষয়টা স্থান-কাল-পাত্রের সামগ্রিক বোধের বিচারে নিরূপিত হয়। একটি সমাজের সবাই মনে করে, শিশু হত্যাটা অমানবিক। ওই সমাজে শিশুরা রক্ষা পাবে ওই সমাজের মানিবিক বোধ থেকে। ইসলাম-পূর্বযুগে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ওই সময় ওই সমাজে ওই রীতিটাই ছিল মানবিকবোধের অংশ। একালের বিচারে তা অমানবিক। স্থান ও কালের বিচারে মানবিক বোধ পাল্টায়। আবার একই সময়ে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মানবিক বোধ কাজ করতে পারে। অনেক সময় এই ভিন্নতা এতটাই প্রকট থাকে যে, একটির বিচারে অন্যটি অমানবিক হয়ে যায়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়, পাকিস্তানীরা যতটা পাকিস্তান ইসলামের মূল্যবোধ নিয়ে ভেবেছে, তার চেয়ে বেশি ভেবেছে কিভাবে বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালি হত্যাটা ছিল তাদের তথাকথিত মানবিকবোধের অংশ। বাঙালিদের কাছে ছিল তা ছিল অমানবিকতার প্রকাশ। অনেক মানবিক বোধ সমগ্র মানবসত্তার বিচারে আদর্শ মানদণ্ডে দাঁড়ায়। এরূপ যুদ্ধের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করাটা অপরাধ। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই এই বোধটা ধারণ করে। কিন্তু ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে যখন হত্যা করে, তখন এটা যে মানবিক মূলবোধের কাতারে পড়ে না, সেটা ধর্মান্ধদের মনে হয় না। তবে এই জাতীয় কাজটা ভালো তা কিন্তু এরা প্রকাশ করে না। যেমন ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যখন বিচার শুরু হলো, তখন অপরাধীরা তাদের কর্মকাণ্ড প্রথমেই অস্বীকার করেছে। তার অর্থ হলো যুদ্ধাপরাধকে তারা তাদের মানবিক বোধ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি।

মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তার চর্চাই হলো মানুষের ধর্ম চর্চা। এই ধর্মে রয়েছে নিজের, পরিবারের, সমাজের, জগতের ইত্যাদির কল্যাণ। প্রতিটি কল্যাণ আবার স্তর থেকে স্তরে ভিন্ন রূপ লাভ করে। এই কল্যাণমূলক ধাপগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়ের বিচারে তৈরি হয় মানুষের ধর্ম। বড় মাপে এই ধাপগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন

মনুষ্য সত্তার ধর্ম
মনুষ্য সত্তা হলো এমন একটি শাশ্বত ধর্ম, যা তার জড় ধর্ম, জৈবিক ধর্ম এবং বিশ্বাসের ধর্মের সমন্বয়ে সৃষ্ট। জড় কাঠামো আছে বলে, মানুষ একটি বিশেষ অবয়ব পেয়েছে। সেই অবয়ব সজীব, কারণ তার জৈবিক ধর্ম আছে। আর জৈবিক ধর্মকে ভিত্তিক করে বিশ্বাসের ধর্মকে ধারণ করে।

মনুষ্য সত্তা জীব হিসেবে প্রথম সে নিজেকে রক্ষা করবে। এই বাসনা তার ধর্মের অংশ। প্রতিটি মানুষের নিজেকে রক্ষা করার বাসনা পূরণের জন্য খাদ্য গ্রহণ-সহ যাবতীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হবে। এর ভিতরে রয়েছে জগতের সকল প্রজাতির সাধারণ ধর্ম। এক্ষেত্রে আণুবীক্ষিক জীব থেকে মানুষ তেমন কোনো উন্নতর প্রজাতি নয়। জীবজগতের এই প্রবণতায় প্রতিটি জীবই স্বার্থপর। মানুষের মানসিকতার বিচারে  প্রতিটি মানুষের ভিত্তি হলো তার প্রবৃত্তির জৈবস্তর। সেখানে সে একটি প্রজাতি ছাড়া আর কিছু নয়।

জীবজগতের বিশেষ করে প্রাণিজগতের প্রজাতিসমূহ প্রথম স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল, যখন তাদের ভিতরে অপত্যস্নেহের বিকাশ ঘটেছিল। দেখা গেল নিজের কল্যাণকে বিসর্জন সন্তানকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা সন্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা করা শুরু হলো। তারপরেও দেখা গেল এসব প্রজাতিরা তাদের সন্তানদের শৈশব দশা পেরিয়ে গেলে, সন্তানদেরকে প্রকৃতি কাছে ছেড়ে দিচ্ছে। এরপর আবার সে স্বার্থপর হয়ে উঠেছে।

প্রাণীজগতের কিছু কিছু প্রজাতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করা শুরু করেছিল। এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতার জন্ম হয়েছিল। এ সকল প্রজাতিগুলো দলবদ্ধ হয়ে শিকার করা বা আত্মরক্ষা করা শিখেছিল। ফলে দলের অন্যের প্রতি বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল। জীবের ক্রমবিবর্তনের ধারায় যখন হোমো গণের প্রজাতিসমূহের আবির্ভাব হয়েছিল, তখন দলগত বন্ধন আরও দৃঢ়তর হয়েছিল। এদের ভিতরে অপত্যস্নেহটা আমৃত্যু রয়ে গেল। দলগত প্রীতি প্রবলতর হয়ে, শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। হোমো গণের সর্বশেষ প্রজাতি হিসেবে যখন মানুষের যখন আবির্ভাব হলো, তখন তাদের ভিতরে স্নেহ-মমতার বিকাশ ঘটেছিল বটে। এরা নিজ দলের জন্য যতটা স্বার্থ ত্যাগ করার মনোভাব অর্জন করলেও, অপর দলের প্রতি  তা রইলো না। আদিম মানুষের এই স্বার্থপরতার কারণে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এরা নির্বিবাদে জঙ্গল ধ্বংস করছিল। দুর্বল বা সবল অন্য সকল প্রজাতির প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। আবার কুকুর, হাতি, ঘোড়া, উট প্রভৃতিকে দাসে পরিণত করেছিল। পশু নির্যতনের অধ্যায় তাদের মনে তখনও স্থান পায় নি।

আদিম মানুষ ক্রমে ক্রমে আদিম দশা থেকে মধ্যযুগীয় দশায় পৌঁছিছিল। এরই ভিতর দিয়ে চলতে চলতে একসময় নিজের কল্যাণের বাইরে এসে মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল অন্যের কথা। কেউ কেউ প্রবলভাবে অনুভব করেছিল- 'অন্ধজনে দেহ আলো- মৃতজনে দেহো প্রাণ'। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল- 'প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'। এখন মানুষ ভাবে, আমি নিজে বাঁচবো, অন্যকে বাঁচাবো। এই ভাবনায় রয়েছে  'অন্য' শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর সকল প্রজাতি এবং আমি পৃথিবীর পরিবেশ। এ সবই সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। এসব নিয়েই মানুষের ধর্ম। এ এমন একটি ধর্ম, যা মানুষকে সাম্প্রদায়িক করবে না, পক্ষপাতদুষ্ট করবে না। আমাদের প্রথাগত বিশ্বাসের ধর্মগুলো মানুষের এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে। এসকল ধর্মে মনুষ্যধরমের অংশ বিশেষ কিছু কল্যাণকরী দর্শনকে ধারণ করে বটে, কিন্তু সমগ্র মনুষ্য ধর্মকে গ্রহণ করতে পারে না। তাই এ সকল ধর্ম হলো- মনুষ্য ধর্মের উপধর্ম।