১.
স্মৃতি ও বিস্মৃতি

স্মৃতি হলো মস্তিষ্কে সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার। মানুষের যে কোনো ক্ষুদ্র অনুভব মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে জমা হয়। মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারে রয়েছে বহু স্মৃতিকোষ। এই সকল কোষের উপাদানগুলোর একটি প্রাথমিক বিন্যাস থাকে। কোনো তথ্য তাতে পৌঁছালে তথ্যকোষের তথ্যধারণ-বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে। তথ্যসমূহ ছোটো ছোটো ভাগে কোষে কোষে জমা থাকে। আর প্রতিটি তথ্যের ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে তৈরি হয় একটি বড় একক। তথ্যের বিষয় যত বড় হয়, এই তথ্য-রক্ষক কোষের সংখ্যাও ততই বেশি হয়, বিন্যাসও জটিল হয়।

তথ্য স্মৃতিতে থাকাটা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা উত্তোলিত হওয়াটাও জরুরি। পূর্বের জমাকৃত অনুভবের স্মৃতি  প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মন নামক সত্তার উদ্দীপনায় উত্তোলিত হয়। মনের এই প্রচেষ্টা হলো মনে করা
(recall)মনে করার এই প্রক্রিয়াটি নানাভাবে ঘটে থাকে। মনে করার ক্ষমতাকে বলা হয় স্মরণ শক্তি। যাঁর যত মনে করার ক্ষমতা বেশি, তাঁর স্মরণশক্তি তত বেশি। স্মরণ করার বিষয়টি নানাভাবে হতে পারে। যেমন

স্মরণ-গতি ও বিস্তার
একটি জানা বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে যে সময় ব্যয় হয়, তার মানকে বলা হয় স্মরণ-গতি। যেভাবে হোক স্মরণ করার সাথে, স্মরণ-গতির একটি বিশেষ ব্যবহারিক মূল্য আছে। গুরুত্বের বিচারে মানুষের স্মরণ করার গতি বিশেষ মর্যাদাও পেয়ে থাকে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে, একটি প্রশ্ন করার পর তার উত্তর দিতে যদি একদিন লাগে, তাহলে উত্তরের গুরুত্ব নষ্ট হয়। প্রয়োজনও মেটায় না।

ফরাসি মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট মিকোট (
Albert Michotte) স্মরণ করার গতির উপর একটি পরীক্ষা করেছিলেন। যথার্থ উত্তর প্রাপ্তির সূত্রে তিনি দেখেছিলেন, অধিকাংশ মানুষ কোনো বিষয় জানার ১.৫ সেকেন্ড পরে প্রশ্ন করলে, যথার্থ উত্তর দিতে পারে। সেই বিষয় সম্পর্কে যদি তাকে একদিন পরে জিজ্ঞাসা করা যায়, তা হলে উত্তর আসে ২.৪ সেকেন্ড পরে। আর এক সপ্তাহ পরে উত্তর দিতে সময় লাগে ৩ সেকেন্ড। দেখা যায় সরাসরি স্মরণ প্রক্রিয়া স্মরণ-গতি বেশি থাকে, পক্ষান্তরে পরোক্ষ স্মরণ-গতি সময় বেশি হয়। স্মরণগতির মান মূলত গড় মান। অতি দুর্বল স্মরণ শক্তির অধিকারীর ক্ষেত্রে অবশ্য এই মান আদর্শ রূপ প্রদান করে না।

প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ একবারে কতটুকু মানে রাখতে পারে। একবার শুনেই বা দেখেই মানুষ যতটুকু মনে রাখতে পারে, তাকে বলা হয় স্মৃতির বিস্তার (Memory Span)। এই ভাবে মনে রাখাটার সাথে স্মরণ-গতিও বিবেচনায় আনা হয়। পরীক্ষায় বসে সুনির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে মনে করে লিখতে হয়, এর সাথে স্মরণগতির যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি রয়েছে যা পড়েছে তার কতটুকু মনে আছে।

স্মরণ-রূপ
প্রতিটি স্মৃতির একটি নিজস্ব রূপ আছে। এই রূপের সাথে থাকে বহুবিধ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্মরণযোগ্য বিষয়। যেমন
কেউ যদি কিছু দিন আগে দেখা সমুদ্রকে স্মরণ করতে চায়, তাহলে তাঁর স্মরণের রূপের ভিতরে থাকবে সাগরের ঢেউ, বায়ুপ্রবাহ, সাগরের বেলাভূমি, বেলাভূমির লোকজন এবং অদূরের কোনো জলযান ইত্যাদি। যদি এই দেখাটা দিনের আলোতে ঘটে, তাহলে তাঁর স্মৃতিতে রাতের সমুদ্রের কোনো স্মৃতি ভেসে উঠবে না। আলো, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি অনুভূতিগুলোর সমন্বয়ে প্রতিটি স্মৃতি নিজস্ব রূপ নিয়ে স্মরণে আসে। চোখ বন্ধ করে আগুন, জল, বরফ, মেঘ ইত্যাদি নিয়ে ভাবলে, প্রতিটি বিষয় নিজস্ব রূপ নিয়েই স্মৃতিতে উঠে আসে।

স্মৃতির রূপ তৈরি হয় এর ছোটো ছোটো উপাদান দিয়ে। এই সকল উপাদান বিষয়ের ব্যাপ্তির বিচারে বড় বড় রূপ তৈরি করে। যেমন
ব্যক্তি বিশেষের কাছে 'শীতল' নামক অনুভূতির যে রূপ আছে, তা স্মৃতিতে ধরা আছে। এই অনুভূতি যুক্ত হতে পারে জল, বাতাস, শীতকালের ধাতব পদার্থ ইত্যাদির সাথে। কেউ যখন শুধু বরফের কথা ভাববে তখন 'শীতল'-এর অনুভব যুক্ত হবে, সেই সাথে এর কাঠিন্য, রঙ  ইত্যাদিও যুক্ত হবে। যদি এই বরফ 'আইসক্রিম' হয় তাহলে তার একটি রূপ তৈরি হবে, আর যদি বরফের ঘর 'ইগলু' হয়, তাহলে অন্য রূপ তৈরি হবে। একটি বিষয়ের ক্ষুদ্র স্মৃতিগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ হয়ে যায়। যেমন- উষ্ণতা, শীতলতা, কার্কশ্য ইত্যাদি। বড় পরিসরের কোনো বিষয়ের সবকিছু স্মৃতিতে আনতে পারে না। এর পিছনে থাকে মূলত দুটি বিষয়।

১. অগ্রাহ্যতা: যা কিছু ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে, আমরা তার সবকিছুতে মন দেই না। ফলে অনেক সময়ই তাকানো হয়, দেখা হয় না। এরূপ অনেক কিছু কানে আসে কিন্তু শোনা হয় না। এই অগ্রাহ্যতার কারণে আমাদের অনেক কিছু স্মৃতিতে বিশেষ রূপে ধরা পরে না। ধরা যাক আপনি একটি ব্যস্ত রাস্তার পাশে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এরপর আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, সাদা রঙের গাড়ি কয়টা দেখেছেন? অধিকাংশ মানুষ এসব ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু সে যদি সাদা গাড়ি দেখবে বলেই দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারবে। অগ্রাহ্যতার বিপরীত রূপ হলো মনোযোগ।

২. বিস্মৃতি: অনেক বিষয়ই মানুষ ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়াটা অখণ্ড একটি বিষয়ের হতে পারে বা অংশ বিশেষও হতে পারে। সাধারণত কোনো বিস্তৃত বিষয়ের অসংখ্য উপাদান থাকে। এর ভিতরে ছোটো ছোটো বহু স্মৃতি চাপা পড়ে যায়। একটি ৯০ মিনিটের ফুটবল খেলা দেখার পর মানুষ উল্লেখযোগ্য এবং কিছু কিছু ছোটো ছোটো দৃশ্য মনে করতে পারে, কিন্তু পুরো খেলার অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। এর ফলে অসম্পূর্ণ স্মৃতি রূপ তৈরি হয়। অনেক সময় এর কিছু অংশ অন্য কেউ ধরিয়ে দিলে মনে পড়ে, অনেক সময় তাও মনে পড়ে না। আবার কোনো কোনো বিষয়কে মানুষ ভুলে যায় না, কিন্তু সূত্রটা ভুলে যায়। ধরা যাক, আগামীকাল সকাল ১০টায় সভা আছে। কোনো ব্যক্তি সভার বিষয়টা মনে রেখেছে কিন্তু সময়টা ভুলে গিয়েছে। ফলে সভায় উপস্থিত হবে না। এক্ষেত্রে বিষয়টা মনে থাকা সত্ত্বে সময়টা ভুলে গিয়ে সভার কথা ভুলে থাকবে।

তাৎক্ষণিকভাবে যে স্মৃতি মনে উত্তোলন করা যায়, তা হলো পুরো স্মৃতি আংশিকরূপ। বড় বড় তথ্যের ক্ষেত্রে পূর্ণরূপের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। অন্যকোনো সূত্রের আলোকে যতটুকু স্মৃতি উত্তোলন হয়, তা ওই প্রাপ্ত স্মৃতির আংশিক রূপকে বৃদ্ধি করে, কিন্তু তা পূর্ণরূপে পৌঁছাতে পারে না।

স্মৃতিজাত রূপের অনুভবের বিচারে আমরা যখন কোনো কিছুকে উপলব্ধি করতে পারি, তখন সাধারণভাবে বলে থাকি চেনা
(Recognition) আমাদের স্মৃতিতে সত্তার রূপ থাকে, তাকে স্মরণ করে এবং উপস্থিত রূপের সাথে সমন্বয় করে চেনার কাজটি সম্পন্ন হয়। একটি দ্রব্য কাঠ না লোহা, একজন পর্যবেক্ষক তা চিনতে পারে তার স্মরণ করার ক্ষমতার বিচারে। এই ক্ষমতাকে অনেক সময় অভিজ্ঞতা বলা হয়। কিন্তু এর পুরোটাই সম্পন্ন হয় স্মরণ-রূপ উপলব্ধি করার ক্ষমতার দ্বারা। অনেক সময় আমাদের স্মৃতি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কাছাকছি মানের দুটি তথ্য, স্মৃতি বিভ্রাট তৈরি করে থাকে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস কোনটি? উত্তর যদি লেখা থাকে ১৪ই আগষ্ট ও ১৫ই আগষ্ট। ভারতবর্ষের বাইরের মানুষের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। অনেকই বলবেন, আগষ্ট মাস ঠিক আছে, কিন্তু তারিখটা কত মনে করতে পারছি না। এই জাতীয় প্রশ্নের সুবিধাও আছে। হয়তো কারো তারিখটা মনে ছিল কিন্তু মাসের নামটা মনে ছিল না। কিন্তু ঐচ্ছিক উত্তরমালা দেখে তা মনে পড়ে যেতে পারে। আজকাল টেলিভিশনের 'কুইজ' প্রতিযোগিতায় এরূপ ঐচ্ছিক উত্তর মালার ভিতর দিয়ে স্মৃতি-জাগরণের কাজটি করা হয়।

স্মরণ-প্রক্রিয়ার শ্রেণি বিভাজন
অনুভব তথ্য হিসেবে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে। তাকে ব্যবহারের জন্য উত্তোলন করার ভিতর দিয়ে তথ্য স্মৃতিজাত তথ্য হয়ে যায়। ব্যবহারের বিচারে তথ্যের উত্তোলন, গ্রহণ, ধারণ, উপস্থাপন ইত্যাদি সক্রিয় হয়ে উঠে। ব্যবহারিক এই কার্যক্রম ঘটে থেকে দুই ধরনের স্মৃতির মাধ্যমে।

১. যান্ত্রিক স্মৃতি (Rote memory): কিছু কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো বার বার চর্চা করতে করতে মানুষ এতটাই অভ্যস্থ হয়ে যায় যে, এগুলোও স্মৃতি হতে পারে তা বিবেচনাই করতে চায় না। যেমন নামতা পাঠ। শৈশবে মুখস্থ করা নামতা, প্রয়োজনীয় মূহূর্তে ব্যবহার করা হয়, যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। বহুবার গাওয়া হয়েছে এমন গান, বহুপঠিত কবিতা, বহুল ব্যবহৃত টেলিফোন নম্বর ইত্যাদি চট করে বলা যায় যান্ত্রিক স্মৃতির কল্যাণে। 

২. উত্তোলিত স্মৃতি (Recalling memory): স্মৃতি হাতরে যে সকল তথ্য মনে আনা হয়। পরীক্ষার খাতায় লেখা, অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ইত্যাদি স্মৃতি থেকে উত্তোলন করে মনে করা হয়। উত্তোলনের প্রক্রিয়ার বিচারে এই জাতীয় স্মৃতি নানা রকম হতে পারে। কোনো বিশেষ স্মৃতিকে মনে করতে গেলে এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য স্মৃতি জাগরিত হয়। যেমন কোনো বিশেষ একটি ঘটনা দেখে অতীতের কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। এই জাতীয় স্মৃতিকে অনুষঙ্গমূলক স্মৃতি (Associative memory) বলা হয়।

বিস্মৃতি (Forgetting): মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে সঞ্চিত সকল তথ্য জমা থাকে, তা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মনের অস্থায়ী স্মৃতি ভাণ্ডারে তুলে আনতে পারাটাই হলো বিস্মৃতি। নানাভাবে বিস্মৃতি ঘটতে পারে। যেমন

১. মানসিক আঘাত: বড় ধরনের মানসিক আঘাতের কারণে, অনেক সময় মস্তিষ্কের তথ্য সরবরাহ অংশ অক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে বিস্মৃতি ঘটতে পারে।

২. মস্তিষ্কের অক্ষমতা: যেকোনো কারণে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ যথাযথ তথ্যপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে এই জাতীয় বিস্মৃতি কাজ করে। যেমন মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে মানুষ স্মৃতির একটি অংশ মনে নাও আনতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মস্তিষ্ক অবশকারী বা ভিন্নতর অনুভূতি উৎপাদক নেশা দ্রব্য ব্যবহার করলে, তথ্যপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। 

৩. অচর্চাজাত প্রক্রিয়া: দীর্ঘদিন ধরে চর্চা না থাকার কারণে, একটি তথ্য অন্যান্য তথ্যের নিচে চাপা পড়ে যায়। চাপা পড়া তথ্য কিছুদিন কষ্ট করে মনে করা যায়, কিন্তু সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে তা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। অনেক যান্ত্রিক-স্মৃতিই চর্চার অভাবে দুর্বল হয়ে যায়। সেকারণে বহুবার আবৃত্তি করা হয়েছে এমন কবিতা বহুদিন পর পাঠ করতে গেলে দু একজায়গায় ভুল হয়ে যায়।

৪. অবদমন: কোনো কোনো বিষয় মানুষ ভুলে যেতে যায়। কিন্তু সহসা ভুলতে পারে না। মূলত জোর করে ভুলার চেষ্টা করলে, সেটাই বেশি করে মনে পড়ে। ফ্রয়েডের মতে যে মন জাগ্রত থাকে, চেতন-মন। আর যা চেতনার বাইরে চলে যায় এবং উত্তোলিত স্মৃতির বাইরে চলে যায়, তা অবচেতন মন। অবদমিত ভাবনার সূত্রে অবচেতন তথ্যের জন্ম দেয়। কখনো কখনো ঘটনাক্রমে আকস্মিকভাবে এই তথ্য উত্তোলিত হতে পারে।

মানুষের স্মৃতিতে জমা হয় নানা ধরনের ক্ষুদ্রাদি ক্ষুদ্র তথ্য। এই তথ্যের সাথে অনুভবের বিষয়। তাৎক্ষণিকভাবে যে অনুভবের জন্ম হয়, তা তথ্য হিসেবে থেকে যায় স্মৃতি-ভাণ্ডারে। এই বিচারে স্মৃতিভাণ্ডারে সঞ্চিত থাকে, তথ্যের সাথে আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, হাস্য-কৌতুকের মতো অনুভব। এই সকল অনুভব মনে ধারণ করার ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় উপলব্ধি, অভিজ্ঞা, জ্ঞান, বিবেচনা ইত্যাদি নানা বিষয়। স্মৃতির সূত্রে ধরে তাই পরবর্তী অধ্যায়ে (উপলব্ধি থেকে প্রজ্ঞা) এই আলোচনাকে সম্প্রসারিত করবো।