সত্যসন্ধ

বিশেষণবাচক এই শব্দের সমার্থক শব্দাবলী হলো- সত্যপ্রতিজ্ঞ, স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আভিধানিক অর্থকে সম্প্রসারিত করতে হলে, বলা যায়- প্রথমত সত্যের (ঠিক যা তাই) সন্ধানকরণ এবং দ্বিতীয়ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিজ্ঞাকরা।

মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তিতে যে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। এর ফলে কোনো বিশেষ বিষয় এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের সত্তাধর্মের সন্ধান করে। এরই মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যসন্ধ হয়ে ওঠে। আর সত্যসন্ধের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। এই বিচারে মানুষ মাত্রেই জানতেই চায়, কিন্তু সকল মানুষ সত্যসন্ধের অনুসারী হয়ে ওঠে না। কারণ মানুষ মাত্রেই সত্যের সন্ধান এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রতিজ্ঞায় নিজেকে তৈরি করে না। এখানেই সাধারণ মানুষ এবং একজন বিজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। কারণ একজন বিজ্ঞানী সত্যের অনুসন্ধান করেন এবং এবং সে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট থাকেন।

 

যে কোনো সত্যকে আবিষ্কারে মধ্য দিয়ে, মানুষের মনোজগতে স্বস্তি বা অস্বস্তি দশার সৃষ্টি হয়। এই স্বস্তি বা অস্বস্তি তীব্রতার দশার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আনন্দ-বেদনার জন্ম দেয়। যেমন গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে দেখি, ইডিপাস তার পরিচয় জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে সত্যকে জানার চেষ্টা করেছিলেন। এবং সত্যটা জানার পর কী তীব্র বেদনার গভীর আবর্তে নিপতিত হয়েছিলেন সেটা আমরা জানতে পারি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমন কোনো সত্য আবিষ্কারের পর মনে হয়, জানার চেয়ে না জানাটাই ভালো ছিল।

কোনো সত্য যখন আনন্দময় হয়ে ওঠে এবং তার সাথে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ও ওই অানন্দের অংশভাগী হয়ে ওঠে, তখন সকল আনন্দের সুসমন্বয়ে সত্য হয়ে ওঠে সৌন্দর্যময়। এর বিপরীতার্থক দশায় একইভাবে উদ্ভব হয় অসুন্দরের। যিনি সত্যসন্ধ, তাঁকে অবশ্য প্রস্তুত থাকতে হয়- আনন্দ-বেদনার জন্য।


প্রশ্ন সত্যসন্ধানের উৎস কি? বহু আগে থেকে জ্ঞানাগ্রজরা বলে আসছেন 'নিজেকে জানো'। প্রতিটি মানুষের সত্যসন্ধানের প্রাথমিক উৎস 'নিজ'। নিজের 'দোষ-গুণ'-এর সন্ধান হলো- নিজেকে জানা। কিন্তু মানুষ শুধু নিজের মধ্যে থাকে না। সহজাত প্রবৃত্তির বশে- মানুষের নিজেকে অতিক্রম করে অন্যকে জানতে চায়। এর ভিতর দিয়ে সে নিজের অবস্থানটাও নির্ণয় করে। সে উপলব্ধি করে- সে জড় নয়, সে শক্তি নয়, সে জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতি থেকে ভিন্ন। এসবের ভিতর দিয়ে তার কাছে নিজের ক্ষমতার স্বরূপ প্রতিভাত হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে- বাইরের জগতের কোনটি তার জন্য শুভ বা অশুভ। এর ভিতর দিয়ে সে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে কিম্বা অভিযোজিত করে। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় সত্যসন্ধের অভিপ্রায়।

মানুষ এককভাবে দুর্বল কিন্তু সমষ্টিগত প্রবল। তাই আদিম মানুষ একক দশা থেকে সমাজবদ্ধ হয়েছিল, নিজের অস্তিত্বকে সুদৃঢ় করার জন্য। মানুষের মতো বহু প্রজাতি দলবদ্ধভাবে বাস করে। প্রকৃতিগতভাবে তাদের এই দলবদ্ধ থাকার ভিতরে রয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার প্রত্যয়।

মানুষ দলবদ্ধ হয়ে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তবুও সে '
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা' সেখানে সে সঙ্গহীন, সঙ্গীহীন। মানুষের নিজস্ব জগত তৈরি হয় মনোলোকে। প্রতিটি মানুষের এ জগৎ একান্ত ব্যক্তিগত। কখনো কখনো মানুষ তার ব্যক্তি জগতের কথা অন্যকে বলে। এক্ষেত্রে যতটা সে বলে, তার চেয়ে 'না-বলা কথা' থেকে যায় অনেক বেশি। এই সূত্রে প্রতিটি মানুষের ভিতরে জন্ম নেয় পৃথক পৃথক সত্যসন্ধ।

 

সত্যসন্ধ্যের লক্ষ্য 'সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা'।
একালের শিশুদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, বড় হয়ে তোমরা কি হবে? উত্তর দেয় পুলিশ হবো, মিষ্টিওয়ালা হবো, বাদামওয়ালা হবো ইত্যাদি। কেন তারা এসব পেশার প্রতি আগ্রহ দেখায়, তারা যথাযথ উত্তর মনোবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন। আমরা সাদা চোখে দেখি, শিশুরা বড় হয়ে উঠার সাথে সাথে শৈশবের লক্ষ্য থেকে সরে আসে। অভিভাবকরা শিশুর তুষ্টির জন্য প্রথমদিকে তাদের ইচ্ছাগুলোকে সায় দেয় বটে, কিন্তু যতই তারা বড় হয়ে উঠতে থাকে, অভিভাবকরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণের পরিমাণ ততই বাড়িয়ে দিতে থাকে। অভিভাবকদের সে প্রচেষ্টার সূত্রে বড় হয়ে উঠা শিশুরা বেড়ে উঠে তথাকথিত মানুষ হয়ে। আর্থ-সামাজিক নিষ্পেষণের জন্য সভা-সমিতি আছে, জাতিসত্তা বিলুপ্তি কিম্বা ভাষার মৃত্যুরোধে হাহাকার আছে, কিন্তু প্রতিভার নিষ্পেষণ বা অবদমনের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কি কোনো দায় নেই? যদি দৈহিক আঘাতের জন্য যদি শিশুদের পাশে দাঁড়াই, তবে শিশুর শৈশবের আনন্দ কেড়ে নির্যাতিত করার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াবো না কেন?

একালের শিশুদেরকে বড় করে তোলা হয়, অর্থোপর্জনের যন্ত্র হিসেবে। এর সাথে কোনো কোনো শিশু সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদির পাঠ নেয় বটে, কিন্তু মূল পাঠ হিসেবে নেয় না। জীবন বাঁচানোর জন্য শিল্প-কলকারখানা দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়, জীবন সাজানোর জন্য শিল্পকলার দিকে ততটাই কম নজর দেওয়া হয়। দুইয়ের দরকার আছে। তবে তার অনুপাতটাও জানা দরকার। এই দরকার-অদরকারের দ্বন্দ্বের ভিতরে বড় হয়ে উঠা মানুষরা, বড় হয়ে অনেক বেশি অর্থোপর্জনের জন্য ঘুষের চাকরি নেবে কিনা, অনৈতিকভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিতে আসক্ত হবে কিনা- এসব অমূল্য বা মূল্যহীন ভাবনা দুর্মূল্যের বাজারে পাত্তা পায় না। অর্থোপর্জনের যন্ত্র হিসেবে যে যতটা সার্থক, তার মানবজন্মও ততটাই সার্থক, তেমনটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এর ভিতর দিয়ে এইসব অভিভাবকেরা আবার নতুন প্রজন্মের কাছে সততা বা নৈতিকতার মতো ক্রমান্বয়ে দুর্লভ হয়ে ওঠা গুণগুলোরও প্রত্যাশা করে।

মানুষ যেমন তার জন্মের জন্য দায়ী নয়, তেমনি এই সমাজের তরুণরাও বলতে পারে তাদের এইভাবে বেড়ে উঠার জন্য তারা দায়ী নয়। সৌভাগ্যের বিষয় এর ভিতরেও কিছু তরুণ এই জাতীয় বড় মানুষ হয়ে উঠে না। আবার অনেক তরুণ বিদ্রোহ করে বসে বড় মানুষ না হয়ে উঠার জন্য। আমাদের এখন দরকার এই রকম অনেক বিদ্রোহী মানুষ। যারা বড় মানুষ না হয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার সাধনা করতে পারে।

সত্যিকারের মানুষ হতে সত্যের সাধনা দরকার। এই সততার সাধনা নিজের জন্য, অন্যের কাছে জাঁক করে বলার জন্য নয়। দেখা যায়, যাঁরা আড়ম্বরের সাথে বলেন 'আমি কখনো মিথ্যা বলি না'- সেটাই হয় তাদের বড় মিথ্যাচার। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে প্রথম দরকার আত্মসমালোচনা। আমি কি পারি আর কি পারি না, সেটা দিয়েই শুরু হতে পারে; যা পারি তা যেন আরও ভালোভাবে পারি, এই প্রতিজ্ঞার ভিতর দিয়ে।

মানুষের দৈহিক গুণাগুণের মতই তার কর্মগুণও তার কোষস্থ জিনসঙ্কেতে থাকে। এই জিনসঙ্কেতের কারণেই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিরাজ করে এবং তা অনেক সময়ই প্রচ্ছন্ন থাকে বা প্রচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করা হয়। অথচ এই প্রচ্ছন্ন গুণের চর্চার ভিতর দিয়েই সে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। মানুষ তার গড় ক্ষমতায় অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারে। ধরা যাক, একজন মেধাবী ছাত্র ডাক্তার হতেও পারবে আবার প্রকৌশলীও হতে পারবে। কিন্তু হয়তো সে জানে না, আইনজীবী হলে সবচেয়ে ভালো হতে পারতো। এই সত্যটি মেনে নিলে, আইনজীবী হতো তার অধিকতর সত্যিকার মানুষ হওয়ার চর্চা। আবার এই তিনটি বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে হয়তো সে আরও বেশি সাফল্য পেতে পারতো। সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠার জন্য প্রথম দরকার নিজেকে চেনা। সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠার সাথে নানারকম প্রলোভনও থাকে। কোনো শিল্পীর গান শেখার জন্য কেউ মরিয়া হয়ে উঠে, অথচ হয়তো সে জানেই না, সেটা তার নিজের ক্ষেত্রই নয়। তার উচিৎ সঙ্গীতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য যতটুকু সঙ্গীত শেখা, ততটুকুই। তাছাড়া ভালো শ্রোতা হওয়ার জন্যও সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

তরুণদের কাছে একটি বড় প্রশ্ন থাকে, 'নিজের ক্ষেত্রটি চিনব কি ভাবে'? এই প্রশ্নের সাথের উত্তরটাও তার নিজের কাছেই থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই পারিপার্শ্বক অবস্থা এবং প্রলোভন তরুণদের বিভ্রান্ত করে। দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের কিছু সহজাত ক্ষমতা থাকে, সেটা সে যত ভালোভাবে পারে অন্যেরা তা পারে না। নিজের ক্ষেত্র চেনার এটা একটি প্রাথমিক স্তর। সে হয়তো মাটির পুতুল তৈরি করে সহজাত দক্ষতায়, হয়তো খুব ভালো গান করে সহজাত গুণে, হয়তো গাছ বা প্রাণীর প্রতি অপরিসীম আগ্রহ আছে। সেটাই তার ক্ষেত্র। সে ভালো অঙ্ক পারে না, কিম্বা ছবি আঁকতে পারে না, তার জন্য হীনমন্যতায় ভোগার কারণ নেই। বরং অহঙ্কারের সাথে তার বলা উচিৎ- 'আমি যা পারি, তোমরা তা পার না'। কখনো দেখা যায় কারও ভিতরে একাধিক বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকে। এক্ষেত্রেও তাকেই বেছে নিতে হবে কোনটি তার জন্য অধিকতর প্রযোজ্য। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে নিজের ক্ষেত্রকেই আগে চেনা দরকার।

আবার মানুষের প্রত্যাহিক জীবনে নানারকম বিষয়ের সাথে জড়িত থাকে। নিজের ক্ষেত্রের চর্চার ভিতর দিয়ে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু জীবনের অন্যান্য উপাদানকে তুচ্ছ করে বা অগ্রাহ্য করে নয়। তা যদি করে তবে সে বড় মানুষ হতে পারবে কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে না। অন্যান্য উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধার ভিতরে থাকবে তার মহত্বের পরিচয়। একথা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়, মানুষ সামাজিক জীব। এককভাবে প্রতিটি মানুষ দুর্বল, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল। প্রবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিতে হবে। প্রতিটি মানুষ হবে নিজের রাজত্বের রাজা, আর অন্যান্য রাজার সাথে মিলে তৈরি করবে একটি অখণ্ড রাজত্ব। সমাজের অন্যান্য রাজার সাথে মিলে যে রাজত্ব গড়ে উঠবে, তার ক্ষমতা হবে অনেক অনেক বেশি।

সত্যিকারের মানুষ হবে বিনয়ী। কারণ মানুষ পরম সত্যের সাধনা করতে পারে, কিন্তু লাভ করতে পারে না। যদি কেউ পারে তবে সে হয়ে উঠবে ঈশ্বর। সে আর যাই হোক অন্তত মানুষ থাকবে না। অন্য কোনো বিশেষ মানুষের তুলনায় সে হয়তো কোনো কিছু খুব ভালো পারে, কিন্তু সত্যকার অর্থে সে পরম মানে পৌঁছাতে পারে নি বা পারবে না, এই অপারগতার কারণে তাঁর বিনয়ী হতে হবে। বিনয় মানুষকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যায় এবং সত্যিকারের মানুষ হওয়ার পথে চালিত করে। অহঙ্কার বড় মানুষ করে, কিন্তু সত্যিকারের মানুষের পথ থেকে বিচ্যুত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সে ভালো গান করে সে সুগায়ক আর যে ভালো গান করে কিন্তু বিনয়ী, সে সঙ্গীতশিল্পী। আমাদের সুগায়কের চেয়ে অনেক বেশী  দরকার শিল্পীর। সকল ক্ষেত্রেই শিল্পীর দরকার। যিনি নিজেকে সাজাতে পারেন, অন্যকে সজ্জিত করতে পারেন।

সত্যিকারের মানুষ হবে আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বমানব সভায় সে অনাহুতও নয়, রবাহুতও নয়। জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে তার আবির্ভাব। এ আমন্ত্রণে সে ধন্য, কিন্তু যজ্ঞসভাকে ধন্য করতে হবে তাকেই। যে ক্ষমতা তার আছে তা দিয়েই সম্ভব। অলৌকিক কোনো প্রপঞ্চে আসক্ত বা বিশ্বাসী হওয়ার দরকার নেই। কর্মের ভিতর দিয়েই সে সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠবে। তবেই সে প্রবহমান অনন্ত আনন্দধারায় স্নাতক হতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় তোলা জলে স্নান করার দরকার পড়বে না।

মানুষের উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা দেয় ধারণা আর বহুবিধ ধারণা থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান। জ্ঞানের ব্যবহারিক কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে পাওয়া যায় বুদ্ধিমত্তা। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে বুদ্ধিমত্তার সাথে দরকার বোধ। বুদ্ধিমত্তার দ্বান্দ্বিক দশা থেকেই জন্ম নেয় বোধ। বোধই ধারণ করে ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বোধের রূপ পাল্টা বটে, কিন্তু কিছু বোধ থাকে যা চিরায়ত, যা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠার জন্য অপরিহার্য। যেমন সততার বোধ, অহিংসার বোধ, পরশ্রীকাতরতা-মুক্ত বোধ ইত্যাদি।

এসবের ভিতর দিয়েই একজন মানুষ হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানুষ। এই মানুষ সাদাকে সাদা বলার সাহসিকতা দেখাবে, পক্ষপাতদুষ্টতার দ্বারা নিজেকে কলুষিত করবে না। আত্মসমালোচনা এবং আত্ম-সংশোধনের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠবে সত্যিকারে মানুষ। তা যেদিন হবে, সেদিনই আমরা গাইতে পারবো মানুষের জয় গান।

সত্যিকারের মানুষ অবগাহন করবে জীবনের অমিয় ধারায়
শৈশবের কোনো এক বৈশাখী মেলায়, কোনো এক লোকশিল্পীর কণ্ঠে শুনেছিলাম 'নিরিখ বান্ধ রে দুই নয়ানে (নয়নের আঞ্চলিক শব্দরূপ)'। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। শৈশবের অজস্র স্বপ্নের ভিতরে ভাসতে ভাসতে কোনো স্বপ্নকেই নিরিখে বাঁধা হলো না। তাই দিক্‌ভ্রান্তের মতো দিক্‌চক্রবালের দিকে শুধুই চেয়ে থাকা। মুক্তি-আস্বাদনের স্বপ্ন সুদূরে রয়ে গেছে, জীবনে তার স্নিগ্ধ পরশ মেলে নি। পরীক্ষায় পাশের জন্য 'আমার জীবনের লক্ষ্য' কতবার পড়তে হয়েছে। তাতে, পরীক্ষায় পাশের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বটে, কিন্তু জীবনের লক্ষ্যে ফেলমারা ছাত্রই রয়ে গেছি। নিরখি বাঁধা হলো না, তাই মুক্ত জীবনের আনন্দও জুটলো না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনটা এমনই। নয়ান নিরিখে বাঁধতে বাঁধতে জীবন ফুরিয়ে যায়। জীবনের চলার পথে, যে সকল সহযাত্রী নিরিখ বাঁধতে পেরেছেন, তাঁরাই নমস্য হয়েছেন। মূলত, সাধারণ আর অসাধারণ মানুষের মধ্যে যে পার্থক্যটা গড়ে উঠে, বোধ করি তার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে এই বন্ধন।

এই মহাবিশ্বের বিপুল কর্মযজ্ঞশালা যে নিগড়ের বাঁধা, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন শৃঙ্খলা। জগতের প্রবহমান এই শৃঙ্খলাকে প্রাচীন ভারতের ঋষিরা নাম দিয়েছিলেন প্রপঞ্চ। তাঁদের কাছে প্রপঞ্চ হলো মায়া। তাঁরা এই মায়ার বাঁধনকে উপেক্ষা করার ভিতরে মুক্তির সন্ধান করেছেন। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন 'কা তব কান্তা'।
ধুনিক মানুষ মনে করেন, 'জগৎ প্রপঞ্চময়' বলে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে আছে পলায়নপর মনোবৃত্তি। মূলত মানুষের লক্ষ্য পূরণের ভিতর দিয়ে ঘটে মুক্তি। আর সে লক্ষ্যকে স্থির করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হলো 'মুক্তি সংগ্রাম'। প্রপঞ্চময় বলে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে, এগিয়ে যাওয়ার বা জয় করার আস্বাদন পাওয়া সম্ভব নয়। সত্যের বন্ধনে যে শ্বাশত জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়, সে পথ ধরে চলতে গেলে, শুধু সত্য নয় লোভ, ঈর্ষা, ক্রোধ ইত্যাদি ত্যাগ করতে হয়। যিনি পারেন, তিনি প্রকৃত মুক্ত- জীবনের আনন্দধারায় স্নাতক হন। বৌদ্ধ দর্শনে একেই বলে  নির্বাণ লাভ। 'ত্যাগেই মুক্তি' একথা তখনই যথার্থ হয়ে উঠে, যদি তা হয় জগতের কল্যাণের জন্য হয়। 'জগতে কে কাহার' বলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্য নিজের কল্যাণও নেই, জগতের কল্যাণও নেই। এর ভিতরে আছে হয় আত্মপ্রবঞ্চনা নয়তো স্বার্থপরতা।

যে ধর্মবিশ্বাস আমাদেরকে শেখায় আত্মা দেহের কারাগারে বাঁধা, এ কারাগার ভেঙে আত্মা মুক্তির পথ খুঁজে পায়। সেই ধর্মই বলে, আত্মার মুক্তির জন্য আত্মহত্যা পাপ। কারণ, ঈশ্বরে বিচারে আত্মহত্যার ভিতরে রয়েছে অবৈধভাবে বাঁধ-ভাঙাজনীত অপরাধ। ঈশ্বর যে বিধির অধীনে মানুষকে জীবিত রাখেন, তার পূর্ণতা না দেওয়াটাই হলো বিধি-লঙ্ঘন। আত্মহত্যা কতটা পাপ, তার পরিমাপ ধর্মানুশাসনে যাই থাক, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলা যায় আত্মহত্যা, জীবনযুদ্ধে পলায়নপর মনোবৃত্তিরই প্রকাশ। দেহের বন্ধনে মানুষ বন্দী হয়, আর বোধের বন্ধনে আমিত্ব মুক্তি পায়। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষদেরকে দীর্ঘদিন দৈহিকভাবে বন্দী করে রাখা যায়, কিন্তু বোধের দিক থেকে একটি মুহূর্তও রাখা যায় না। কারাগারে থেকেও তিনি মুক্ত। বোধ থেকে জন্ম নেয় আদর্শ। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে বহুজনকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। আদর্শের বন্ধনের ভিতরে মানুষের মুক্তির স্বাদ পায়। বোধের মৃত্যু হলেই মানুষের প্রকৃত মৃত্যু ঘটে। বিষপানে সক্রেটিস মৃত্যু ঘটেছিল বহুদিন আগে, কিন্তু বোধের রাজ্যে তিনি অমর। দৈহিকভাবে টিকে থাকার মধ্যে আছে প্রাণে বেঁচে থাকার কসরৎ, আর বোধের অধিকার নিয়ে নিজেকে মেলে ধরার মধ্যে আছে জীবনের সার্থকতা। 

সবার লক্ষ্য এক নাও হতে পারে, কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই নিরিখ বাঁধতে হয়। জীবনের লক্ষ্য যদি একমুখী হয়, তাহলে তার মুক্তি ঘটে একদিকে। বহুমুখী মানুষের মুক্তির পথ বহুদিকে প্রসারিত। জগতের সকল ক্ষেত্রে যদি কারো মুক্তি ঘটে, তবে তিনি হয়ে উঠবেন ঈশ্বর। সেটা সম্ভব হয় না বলেই মানুষ অনেক চেষ্টায় অসাধারণ হয়েও ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন না।

লক্ষ্য পুরণের জন্য শুধু বন্ধন নয়, সমন্বয়টাও দরকার। এই কারণেই, ছন্দোবন্ধে বাণী হয়ে উঠে কবিতা, সুরের বন্ধনে সাধারণ কথা হয়ে উঠে গান, আর দেহের ছন্দোবদ্ধ দোলায় সৃষ্টি হয় নৃত্য। এসবেরই মূলে থাকে সুসমন্বয়। যে অসীম আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের শুরু, তার অনেক কিছুই পাওয়া হয়ে ওঠে না, লক্ষ্যের যাত্রাপথকে ঠিক মতো না বাঁধার কারণে। বিশ্বচরাচরের বন্ধনে ছন্দ আছে বলেই তা আনন্দময়। এই আনন্দ আবার বহুবিধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের সমন্বয়ে সৃষ্ট। যেখানে সকল আনন্দ মিলে মিশ্র আনন্দের রূপ ফুটে ওঠে, সেখানেই বিশ্ব-প্রকৃতির সৌন্দর্য। ছন্দের বিকাশ ঘটে সুসমন্বয়ে। সমন্বয়হীনতার কারণে যে কর্মকাণ্ড ছন্দবিহীন অবাধ, উপস্থাপনের বিচারে তাই উচ্ছৃঙ্খলতা। তানপুরায় যে সুরের খেলা চলে, তা ঘটে তার বাঁধার সুসমন্বিত বিধিতে। নইলে এমন সুরের যন্ত্রও যন্ত্রণায় পরিণত হয়। 

মানুষ সামাজিক প্রাণী। বহুজনের ভিতরে একাকী থাকার ভিতরে যে যন্ত্রণা আছে, বোধ করি মনোবিকারগ্রস্থ কিছু মানুষ ছাড়া আর সবাই তা অনুভব করেন। এক্ষেত্রে অন্তর্মুখী মানুষের যন্ত্রণা আরও বেশি। কারণ, তিনি অন্যের সাথে বন্ধন গড়ে তুলতে পারেন না। বহুজনের সাথে বন্ধন গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন অন্যান্যদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। যাঁরা অন্যের ত্রুটি ধরে বেড়ান, সেটা যে তাঁর নিজেরেই একটি বড় ত্রুটি সেটা ভাবেন না। যিনি অন্যের কথা শুনতে চান না, তাঁর কথাও অন্যেরা শুনবে কোন দায়ে। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হলে, অন্যান্যদের সাথে অন্তত সুসম্পর্কটা রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। সুসম্পর্ক রয়েছে এমন মানুষদের সবাই বন্ধু হয়ে উঠে না। মনের বন্ধনে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। এর জন্য মনের সাথে মনের সেঁতুবন্ধ তৈরি করতে হয়। এ কারণেই বন্ধনের শৈথিল্যে নিজের পরিবারের লোকও বন্ধু হয়ে উঠে না। দীর্ঘদিনে এক সাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটাবার পরও তাঁদের ভিতর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না।

মানবশিশুর বোধের বিকাশ ঘটে বাইরের জগত চেনার ভিতর দিয়ে। এর ভিতর দিয়ে নিজেকে জানার প্রাথমিক কাজটুকু ঘটে যায় পরিবেশগত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়ায় সে নিজেকে লিঙ্গের বিচারে চেনে, পরিবারের বিচারে চেনে, গোষ্ঠীর বিচারে চেনে। তারপর সে বাইরের জগতের নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে জানতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ বাইরের জগৎ নিয়ে এতটাই মেতে ওঠে, কখনো যে নিজেকে চেনার চর্চাটা হারিয়ে ফেলে, সে বুঝতে পারে না। ফলে ক্রমে ক্রমে সে নিজগৃহে পরাবাসী হয়ে যায়।

নিজেকে জানার ভিতর দিয়ে ঘটে আত্ম-উপলব্ধি। এজন্য নিজের মনের তারকে আগে বাঁধতে হয়। নইলে জীবনসঙ্গীত হয়ে যাবে হট্টগোলের মেলা। সামাজিক হতে গেলে সমাজের সাথে নিজেকে বাঁধতে হয়। বহুজনের ভিতরে নিজেকে চিনতে গেলে এর বিকল্প নেই। একইভাবে জাতি সত্ত্বার সাথে গড়ে উঠা বন্ধনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে জাতীয়তা বোধ। যিনি এই বন্ধনকে অগ্রাহ্য করেন, তিনি নিজ দেশেই বিদেশী। স্বজাতির সাথে নিজেকে বাঁধতে গেলে, প্রয়োজন নিজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।  মানুষের বৃহত্তর গোষ্ঠীগত যত ধরনের বন্ধন আছে, তার ভিতরে সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন হলো, সাংস্কৃতিক বন্ধন। এর ভিতরেই রয়েছে যে কোনো জাতির মুক্তির মূলমন্ত্র। এই মন্ত্রের জোরেই ভাষা-আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে এবং বিজয়ের ইতিহাস তৈরি হয়।

বন্ধকে মুক্ত করার জন্য বন্ধন। কারণ, বন্ধনে আছে মুক্তির অঙ্গীকার, আর মুক্তিতে আছে জীবনানন্দ। আসুন সে জীবনানন্দের প্রবহমান অমিয় ধারায় আমরা সবাই স্নাতক হই।

সত্যসন্ধের পথ সখ্যের। হাত বাড়ালেই বন্ধু
সংস্কৃতি হলো একটি নৃগোষ্ঠীর ভিতরে গড়ে উঠা একটি গড় সাধারণ জীবনযাপনের বিমূর্ত দশা। এর শুরুটা হয় ব্যক্তি পর্যায়ে বন্ধুত্ব থেকে। এই বন্ধুত্বের বন্ধনই নৃগোষ্ঠীর ভিতরে সংস্কৃতির অবয়ব তৈরি করে। মানুষের আদিম দশাতেই অনুভব করেছিল বন্ধুত্বের গুরুত্ব।

হাত বাড়ালেই বন্ধু
মানুষ জন্মগত সূত্রে একক, কিন্তু বন্ধুসঙ্গমে বহু। এই বহুত্বই একক দুর্বল মানুষকে সবল করে। মানুষের যা কিছু, তার সবটুকই মহ হয়ে উঠে, যদি সে আপন হতে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে, সবাইকে আপন করে নিতে পারে। যিনি সবাইকে আপন করে নিয়ে সবার ভিতরে এসে দাঁড়াতে পারেন, তিনিই মহৎ বন্ধু হতে পারেন। মানুষ দুটি হাত নিয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু যত তার বন্ধু বাড়ে, তার হাতের সংখ্যাও ততটাই বাড়ে। আর যত হাত বাড়ে তার ক্ষমতাও ততটাই বাড়ে।

মানুষের মনোজগৎ হলো একটি মুক্ত প্রান্তরের মতো। সে প্রান্তরে আনন্দ-বেদনার লীলা চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে জন্ম নেয় অজস্র স্বপ্ন, অজস্র কামনা এবং সেই সাথে জন্ম নেয় অজস্র দ্বন্দ্ব। এতসব হট্টগোলের ভিতরে সেই মনের এক কোণে একটি ক্ষুদ্র ঘর তৈরি হয়। সে ঘর নিতান্তই নিজের ঘর। সে ঘরের অনেক গোপন কথা। সে এমনই গোপন, যে কাউকে বলা যায় না। প্রতিটি মানুষ সে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে। এই ঘরের সত্ত্বার সাথে অন্য কারো বন্ধুত্ব হয় না। সে ঘরের মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসকারী সঙ্গহীন, সঙ্গীহীন।

মানব শিশুর বুদ্ধির উন্মেষলগ্নে এই ঘরটি থাকে না। তাই শিশু অকপট, শিশু সকলের বন্ধু হয়ে ওঠে। যখন একটু একটু করে বাইরের জগতের সাথে তার পরিচয় ঘটতে থাকে, তখন তার ভিতরে স্বতন্ত্র সত্তা জেগে উঠতে থাকে। সে বুঝতে থাকে, সে আলাদা, একটি একক সত্তা। এর কিছুটা সে তার সহজাত বোধ থেকে জানে, কিছুটা বার বার বলে বা দেখিয়ে বড়রা জানিয়ে দেয়। এরই ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় মনের কোণের লুকানো সত্তা। প্রাথমিকভাবে একই সাথে জন্ম নেয় আরও দুটি আবরণ। এর একটিতে থাকে এমন কিছু কথা, যা সে তার মা বা নিকটজনদের বলতে পারে, সবাইকে বলতে পারে না। এই দ্বিতীয় ঘরে এসে তার সৃষ্টি হয় গুটি কয়েক বন্ধু। ঘরের অবশিষ্ট যে ঘরটি থাকে, সে ঘরের কথা সবাইকে বলা যায়। সে ঘরের চারদিক খোলা, পৃথক কোনো দরজা জানালা নেই।

মানুষ বয়সে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে, সে ছোট্ট ঘরকে কেন্দ্র করে বহু আবরণ তৈরি হতে থাকে। নিজের গড়া এসকল আবরণের আড়ালে শিশু ক্রমাগত তার সরলতা হারাতে থাকে। নানা ধরনের প্রতিপত্তিতে সে হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক বড় মানুষ। অর্থ, বংশ, জ্ঞান, বয়স ইত্যাদির দ্বারা আবরণটা হয়ে উঠে তার নিত্য সঙ্গী। এসকল সঙ্গীকে ভেঙে মানুষসঙ্গীকে বন্ধু হিসেবে পেতে হলে, নিজেকেই মেলে ধরতে হবে অকৃপণভাবে। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গানে বলেন- 'আপনারে দিয়ে রচিলি কি এ আপনারই আবরণ/খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন', তখন তিনি অহমিকার আবরণ ভেদ করে, জগতের আনন্দযজ্ঞে মিলিত হওয়ার কথাই বলেন।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিঃসঙ্গ মানুষ, যখন অপরের সাথে সেঁতুবন্ধ তৈরি করে, তখন তার অসংখ্য আবরণের একটিকে অপরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ওই একটি সেঁতু দিয়ে তাঁর বন্ধন ঘটে অন্যজনের সাথে। এই বন্ধনেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এক্ষেত্রেও মানুষ অনেকটাই রক্ষণশীল। প্রথমে দেখে তার মনের সাথে অন্যের মনের মনের মিল কোথায়। যদি কোনো ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পায়, তাহলে সেই বিশেষ ক্ষেত্রের আবরণ খুলে দেয়। ফলে দুটি মানুষের মধ্যে একটি সঙ্কীর্ণ সেঁতু তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বন্ধুত্বও হয় স্বল্প পরিসরে। যার সাথে একাধিক বিষয়ে মনের মিল ঘটে, তার সাথে বন্ধুত্বের সেঁতু তৈরি হয় একটু বড় পরিসরে। সকল বিষয়ে মিল রয়েছে এমন দুজন মানুষের সন্ধান পাওয়াটা বিরল, তাই প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের নিদর্শনও বিরল।

হাত বাড়ালেই প্রকৃষ্ট বন্ধু নাই বা জোটে, চেষ্টা করলে ভালো বন্ধুর অভাব হয় না। এক্ষেত্রে নিজেকে আগে ভালো হতে হয়। এই ভালো হওয়াটার জন্য ঈশ্বরের মতো নির্মল হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ভালোটা হলো কল্যাণকর। কল্যাণকর ইচ্ছা বা বাসনা রয়েছে যার ভিতর, তাই ভালোবাসা। মনের সাথে মিল হলে যে সেঁতুবন্ধ তৈরি হয়, তার সাথে ভালোবাসা না থাকলে বন্ধুত্ব হয় না। এক্ষেত্রে ভালো বলতে বুঝানো হয়েছে শুভ, আর বাসা হলো বাসনা বা কামনা। যখন কারো প্রতি শুভ ইচ্ছা জেগে উঠে, তখনই সৃষ্টি হয় ভালোবাসা। এর ভিতরে প্রতিদানের বিষয় নেই। সম্ভবত মানুষের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার পাত্র হলো তার সন্তান। কল্যাণ কামনায় পিতাকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু পরমপিতার জন্য একেবারেই নয়। কারণ, পরমপিতার কল্যাণ কামনা ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে।

ভালোবাসার অধিকারে যদি বন্ধুকে কিছু দিতেই হয়, তাহলে প্রতিদানের আশা না করেই দেবো। দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, বন্ধুত্ব হয় না। যদি বন্ধুর কাছে নিই, তাতে গ্লানি নেই। বন্ধুর কাছে যা পাবো তা বন্ধুত্ব, অন্যের কাছে যা নেবো, তা হবে কাঙালিপনা। যদি বন্ধুই হই, তা হলে না চাইতে তাকে দেবো। যদি বন্ধুর কাছ থেকে কিছু নিতেই হয়, তা বন্ধুত্বের জোরেই নেবো। বিনিময়ের মধ্য দিয়ে যে সহযোগিতা দেওয়া হয়, তা হলো পরিসেবা। প্রতিদানহীন যে সহযোগিতা তাই হলো সেবা। রোগীকে হাসপাতালে অর্থের বিনিময়ে সেবিকা যা দেন, সেটা তার পরিসেবা। ঘরের প্রিয়মানুষ যা দেন, সেটাই সেবা। পরিসেবা প্রচারে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেবা প্রতিষ্ঠিত হয় নিভৃতে। বন্ধুর জন্য সেবার হাত, অন্যের জন্য পরিসেবার হাত। সেবার লক্ষ্য আমাদের দক্ষিণ হাত হোক দাক্ষিণ্যে পূর্ণ। আমাদের সকল দক্ষিণ হাত মিলিত হোক সকলের দক্ষিণ হাতের সাথে।

যখন বন্ধুর জন্য হাত বাড়াবো, তখন মনের আবরণ ভেঙেই হাত বাড়াবো। গাড়ির উভয় পাশের চাকা সমান না হলে যেমন গাড়ি চালানো যায় না, উভয় মনের চাকা সমান না হলে, বন্ধুত্ব চলে না। বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ, সেটা অর্থের হোক কিম্বা প্রতিপত্তির হোক। বড়র কাছে নিজেকে উচ্চতর করা যায় না, তাই বন্ধু্ত্ব হয় না। সে ক্ষেত্রে বড় যদি ছোটো হয়ে আসে, তা হলে বন্ধুত্বটা হতে পারে। কিন্তু বড় যদি পদে পদে মনে করিয়ে দেয়, আমি ছোটো হয়েছি করুণা করে; যদি মনে করে বন্ধু হও কিন্তু একটু মান্য করো। তাহলে, সত্যিকার বন্ধু হ্‌ওয়া হয়ে উঠে না।

বন্ধনের মধ্য দিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করবো বলেই হাত বাড়িয়েছি। যদি সম্মত হও, তা হলেই বন্ধু। বন্ধু যদি হও, থাকবো সকল কর্মযজ্ঞে পাশাপাশি; থাকবো সঙ্কটে, সম্পদে, সৌভাগ্যে, সাধনায়, ব্রতে। বন্ধু যদি হও, তাহলে জগতের কল্যাণে একীভূত হবো, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো একসাথে। বন্ধু যদি হও সকল ত্রুটিকে স্বীকার করবো নিজের ত্রুটি মনে করে, বন্ধুর কৃতিত্বকে মনে করবো নিজের।

আমাদের নানা ধরনের সঙ্কট আছে। তার ভিতরে অন্যতম সঙ্কট হলো বন্ধুত্বের। কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয়ে সমমনা মানুষ একত্রিত হয় বটে, প্রগাঢ় বন্ধুত্বের অভাবে ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমাদের অনেক মহৎ কর্মযজ্ঞের মধুর সমাপন ঘটে না। গঠনমূলক সমালোচনা যেমন কর্মযজ্ঞের ফললাভকে ত্বরান্বিত করে, স্বার্থন্বেষী কর্মকাণ্ড তেমনি কর্মযজ্ঞকে অসুরের মতো ধ্বংসও করে। বৃহৎকর্মকাণ্ড সম্পাদনে যেমন বন্ধুসভার দরকার, তেমনি সে কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য বন্ধুসভা টিকিয়ে রাখারও দরকার।

রবীন্দ্রনাথ প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁর ঘরের চাবি ভেঙে, কে নিয়ে যাবে বাইরের আনন্দনিকেতনে। সে চাবি নামক বন্ধন-পদ্ধতিতে আমরা সবাই আপন ঘরে আবদ্ধ। কিন্তু আমাদের প্রতীজ্ঞা হওয়া উচিৎ, সহৃদয় বন্ধুর দেখা মেলে নি বলে, ঘরের কোণে বসে রইবো না। নিজের ঘরের চাবি নিজেই ভাঙবো, সবার রঙে রঙ মিশিয়ে মনের বিশাল আঙিনাকে রঙিন করে তুলবো। সে ক্ষমতা আমাদের আছে। শুধু দরকার নিজের ইচ্ছা এবং উদ্যোগ। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে বন্ধু। আর বন্ধুসঙ্গমে সফল হয়ে উঠবে আমাদের সকল কর্মকাণ্ড।

বন্ধু, সমাজ ও সংস্কৃতি
রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, বা বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ জনসমষ্টি নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। যে পরিবারে বন্ধুত্ব নেই সে পরিবার ভাঙতে সময় লাগে না। অনেক সময় পরিবারের মানুষের চেয়ের বাইরের মানুষ বন্ধু হয়। এক্ষেত্রে পারস্পরিক কল্যাণের বিচারটা অগ্রাধিকার পায়। তাই বন্ধু না হয়েও পরিবারের মানুষও কাছের হয়ে উঠে একত্রে বসবাস করার সূত্রে এবং পরিবারের কাছে দায়বদ্ধতার কারণে। এই কারণে পরিবারের পরবাসী সদস্যের চেয়ে প্রতিবেশি বড় হয়ে উঠে না।

একই অঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর ভিতর দিয়ে সমাজের সৃষ্টি হয়। সমাজের প্রতিটি পরিবার এবং প্রতিটি সদস্য, নিজেদের কল্যাণের জন্য কিছু অলিখিত বিধি তৈরি করে। যার ভিতর দিয়ে সামাজিক আচরণের সৃষ্টি হয়। এই আচরণ সমাজের পরিবারগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আর বন্ধুত্বের তাগিদেই তৈরি হয় সামাজিক নিরাপত্তা। বড় বড় শহরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা সক্রিয় থাকলেও অস্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না। তাই শহুরে জীবনে সামাজিক বন্ধনের চেয়ে সাংস্কৃতিক বিধি অনেক বেশি সক্রিয়।

একটি অঞ্চলের সূত্রে মানুষের জীবনযাপনের গড় মানই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। এই জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে শিল্পকলা, সামাজিক আচরণ, ধর্মবিশ্বাস। এ সবই বিমূর্ত। খাদ্যাভ্যাসের প্রকৃতি, পোশাকের প্রকৃতি, বসবাসের প্রকৃতি এসবের সাথে জড়িয়ে থাকে কিছু না কিছু বস্তুবাচক উপাদান। এসব উপাদানের সাথে জড়িত থাকে সংস্কৃতির নিবিড়তর সম্পর্ক। তবে এটাও স্মরণে রাখা উচিৎ যে পোশাক পড়া, বাসস্থান তৈরি করে বাস করা ইত্যাদি সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু পোশাক তৈরির কারখানা বা বাসগৃহ প্রত্যক্ষভাবে সংস্কৃতির অংশ নয়। সমাজের কোনো বসবাসের পরিবার ইউরোপী ধাঁচের বাড়িতে তৈরি করে থাকে। তাই বলে ওই ব্যক্তির ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে ধারণ নাও করতে পারে। এখানে বাড়িটা ইউরোপীয় সভ্যতার অংশ, আর ওই পরিবার যে সংস্কৃতি অনুসরণে বাস করে, তা তার নিজস্ব সংস্কৃতি।

সভ্যতা হলো বহু সভ্যের সম্মিলিত রূপ। এখানে সভ্য হলো একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের একাধিক মনুষ্য গোষ্ঠী। এক বা একাধিক মানবগোষ্ঠী সমন্বয়ে যে সাধারণ জীবনযাপন প্রণালী সৃষ্টি হয়, তা দ্বারাই সভ্যতার পত্তন ঘটায়। মানুষের জীবন-প্রণালী বা আচরণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলেও, তা বস্তু জগতের বিচারে বিমূর্ত দশায় থাকে। সাধারণভাবে এই বিমূর্ত সত্তাই সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি অঞ্চলের একাধিক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকবেই। মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণের ভিত্তিতে তৈরি হয় নানাবিধ বস্তুগত উপাদান এবং বিধি। এসকল উপাদনের দ্বারা সৃষ্টি হয় পরিকাঠামোগত বিভিন্ন উপকরণ। যেমন-  ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, নগর-বন্দর, অফিস-আদালত, আইন বা সংবিধান। ফলে এক বা একাধিক সংস্কৃতির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত পরিকাঠামোর সমন্বিত রূপ সভ্যতা, তাই যে কোনো সংস্কৃতি একটি সভ্যতার অংশ হিসেবে সক্রিয় থাকে।

সংস্কৃতি হলো মানুষ সম্পূর্ণই আচরণগত বিষয়। বিধির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে তা সভ্যতার অংশ হয়ে যায়। যেমন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাই বাংলা ভাষা বাঙালির সংস্কৃতির অংশ। আর বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা, এটা বিধি দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাই বাংলাভাষা বাংলাদেশের সভ্যতার অংশ। যে কোনো জীবন্ত ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃতির বিচারে ভাষা পরিবর্তনশীল উপাদান। কিন্তু বিধি দ্বারা নির্ধারিত রাষ্ট্রভাষা যখন বাংলা, তখন তা অপরবর্তনীয় দশায় থাকবে। বাংলাদেশের প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিচারে এদের পৃথক কোনো সভ্যতার নেই। কিন্তু সকল জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সৃষ্ট বস্তুবাচক এবং বিধি মিলিত হয়ে বাংলাদেশের সভ্যতা বলা যেতে পারে। অনেক সময় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি দ্বারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অবদমিত হয়। ফলে মোটা দাগে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি একটি সভ্যতার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে। কোনো সুনির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠীর সভ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে প্রয়োজন তার সুদৃঢ় সাংস্কৃতিক বিকাশ। সাংস্কৃতিক বিষয় অন্যকে শেখানো যায়, সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করা যায়, কিন্তু সভ্যতা শেখানোর বিষয় নয়। অন্য সভ্যতার সাংস্কৃতিক উপাদান দ্বারা অন্য একটি একটি নৃগোষ্ঠী প্রভাবিত হতে পারে। একটি সভ্যতা ওই সংস্কৃতিকে ধারণ করে মাত্র।

সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ হলো ভাষা। এই সূত্রে এর প্রমিত মান প্রদান করে সাহিত্য। সুর ও ছন্দের অনুষঙ্গে ভাব হয়ে উঠে গীত। আবার গীতের অনুষঙ্গ হিসেবে আসে বাদ্য যন্ত্র। আর গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় সঙ্গীত। সৃজনশীল ভাবনার সূত্রে মানুষের মনে যে অরূপ মূর্তি তৈরি হয়, অনেক সময় বস্তু জগতে তার প্রকাশ ঘটে বস্তগত রূপাশ্রয়ী হয়ে। যেমন ভাস্কর্য।

সংস্কৃতির সাথে সমাজের মূল্যবোধের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে গ্রহণযোগ্যতার বিচার। মূল্যবোধ মূলত আবর্তিত হয় সমাজের কল্যাণের বিচারে। মানুষ লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ  ইত্যাদি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে না নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই

মানুষের জীবন-প্রণালীর ক্রমবিবর্তনে তথা সংস্কৃতির ধারায় সভ্যতা পাল্টায়। আগে যে সমাজ মাটির ঘরে বাস করতো তারা হয়তো পড়ে ইটের তৈরি পাকা ঘরে বাস করে। আগের দিনের মাটির রাস্তার পরিবর্তে মানুষ পাকা রাস্তা তৈরি করেছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ পাথরের যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতো। আমরা সে সভ্যতাকে বলি পাথুরে সভ্যতা। একই ভাবে এসেছে তাম্র সভ্যতা, লৌহ সভ্যতা ইত্যাদি। উন্নত যন্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষ যান্ত্রিক সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছে।

মানুষ উন্নত জীবনযাপনের জন্য নানা দেশ থেকে নানা ধরনের উপাদান সংগ্রহ করে এবং ব্যবহার করে। যেমন মোটরগাড়ি বাংলাদেশে এসেছে ভিন্ন দেশ থেকে। ফলে মানুষের চলাচল ও মালামাল পরিবহনে পরিবর্তন নেই। বাংলাদেশে গরুর গাড়ির সভ্যতা থেকে মোটর গাড়ির সভ্যতায় অভ্যস্থ হয়ে গেছে। সভ্যতা মানুষের জীবন প্রণালী পাল্টায় বাহ্যিকভাবে, কিন্তু মানুষের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ, আচরণ, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে বটে কিন্তু আমুল পাল্টায় না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করাটা উন্নত সভ্যতার পরিচায়ক হতে পারে। কিন্তু একই সাথে গুরুজনদের অশ্রদ্ধা করাটা হবে সংস্কৃতিকে বিকৃত করা। একই দেশে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, যানবাহন, যোগাযোগ, প্রশাসন ইত্যদির বস্তুগত উপাদনের বিচারে বিবেচনা করা হয় নগর সভ্যতা, গ্রামীণ সভ্যতা বা আরণ্যক সভ্যতা। 

সভ্যতার উপাদান
মানবগোষ্ঠীর সভ্যতা সৃষ্টির পিছনে সহায়ক ভূমিকা রাখে কিছু উপকরণ। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ভৌগলিক অবস্থানের বিষয়। এই বিচারে সভ্যতা বিকাশের  ক্ষেত্রে কতকগুলো ভৌগোলিক বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন-

ক. ভূপ্রকৃতি: মানুষ যে স্থানে বসতি গড়ে তোলে, তার উপর ভিত্তি করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং জীবন ধারণের অন্যান্য সহায়ক উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। সমতল ভূমি, বনভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চলভেদে স্থাপত্য কৌশল এবং নির্মাণ সামগ্রীর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। একটি বিশেষ ধরনের ভূপ্রকৃতির বিচারে, দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে একটি সাধারণ স্থাপত্যকৌশল গড়ে উঠে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ আদিতে গুহায় বাস করতো। প্রয়োজনের গুহা সংরক্ষণে সংস্কার করেছে। আবার জঙ্গলে বসবাসকারীরা গাছের উপরে বাড়ি তৈরি করেছে।

খ. আবহাওয়া: শীতপ্রধান বা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের ঘরবাড়ি একরকম হয় না। যে সব এলাকায় শীতকালে বরফ পড়ে, সে সকল অঞ্চলে বাড়ির ছাদের সাথে বৃষ্টিপাত প্রধান এলাকার বাড়ির ছাদ ভিন্ন রকম হয়।

গ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, ঝড়, ধুষারপাত, সুনামি, ভূমিকম্প ইত্যাদির বিচারে অঞ্চলভেদে স্থাপত্য-কৌশলে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তাই ভূমিকম্প-প্রবণ জাপানে তৈরি হয় কাঠের বাড়ি, আর প্রবল তুষারপাতে টিকে থাকার জন্য আলাস্কায় তৈরি হয় বরফের ঘর।

ঘ. খাদ্য ও খাদক: আফ্রিকার মানুষ সিংহ হায়নার মতো প্রাণীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বা খাদ্যের জন্য প্রধান অবলম্বন ছিল বড় বড় বর্শা জাতীয় অস্ত্র। আর জঙ্গলের শিকারীরা পাখি বা খরগোশ জাতীয় প্রাণী হত্যার জন্য প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয় তীর। সমুদ্র উপকূলের মানুষ তৈরি করে নৌকা, আলাস্কায় তৈরি করে কুকুরে টানা 'স্লেজ গাড়ি'। জীবনধারণের জন্য মানুষ প্রাকৃতিক উপাদানগুলোক নিজের প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করেছে। সেই সাথে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের হাতিয়ার। জীবিকার সূত্রে তৈরি হয়েছে কৃষকের লাঙল, জেলের জাল, তাঁতির তাঁত, কুমোরের চাকা।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা জাতের মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। কিন্তু সকল অঞ্চলে মানুষের উৎপত্তি ঘটে নি। ধারণা করা হয় প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো (Homo) গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরক্কো অঞ্চলে। আর ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে মূল প্রজাতি থেকে একটি উপ-প্রজাতি পৃথকভাবে বিকশিত হয়। এই প্রজাতিটি হলো Homo sapiens idaltu। আধুনিক মানুষ বলতে মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়-  Homo sapiens sapiens উপ-প্রজাতি হিসেবে। হোমো স্যফিয়েন্স-এর প্রথম জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়েছিল ইজ্রাইলের কাফ্‌জেহ অঞ্চলে। এই জীবাশ্মগুলোর বয়স ছিল ১ লক্ষ থেকে ৮০ হাজার বৎসরের পুরানো।

গোড়ার দিকে মানুষ জীবন রক্ষার তাগিদে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে গেছে। এই বিচারের আদি মানবগোষ্ঠীর বর্ধিত অংশ যাযাবর হয়ে পড়েছিল। এদের যে অংশ কোনো জায়গায় স্থায়ীভাবে থেকে গেছে, সেখানেই নতুন সভ্যতার পত্তন ঘটেছে। কিন্তু স্থান ত্যাগকারী মানবগোষ্ঠী অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে নতুন করে। নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে তাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। ফেলে আসা ভূমির মানুষের সাথে ক্রমে ক্রমে প্রভেদ ঘটেছে, ভাষা, ঘরবাড়ি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি।

আদিমযুগের মানুষ পাহাড়ি এলাকায় পাথরকে নানা কাজে ব্যবহার করে, আদি পাথুরে যুগের সৃষ্টি করেছিল। এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, পাথরবিহীন জঙ্গল পরিবেষ্টিত অঞ্চলেও পাথুরে যুগের সূত্রপাত ঘটেছিল। অরণ্য-প্রাধন অঞ্চলে মানুষ গাছের কাণ্ড বা বাঁশজাতীয় দ্রব্য বেশি ব্যবহার করতো। এছাড়া গাছের শক্ত লতা দিয়ে বাঁধার কৌশলের ভিতর দিয়ে শিখেছিল দড়ির ব্যবহার। দীর্ঘদিন ধর পাথরের উপকরণ প্রকৃতিতে টিকে থাকে। তাই বহু দিনে আগের ব্যবহৃত পাথরের নমুনা পাওয়া যায়, কিন্তু কাঠ বা লতার ব্যবহারে অরণ্যচারী মানুষ যে, সভ্যতা গড়ে তুলেছিল তার নমুনা পাওয়া যায় না। তাই আদি-মধ্য-অন্ত্য পাথুরে যুগের উদাহরণ সভ্যতার নমুনাকেই মানসভ্যতা বিকাশের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।  একই ভাবে বলা যায়, গুহাবাসী মানুষের আঁকা ছবি দীর্ঘদিন ধরে সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু অরণ্যচারী মানুষ কাঠ খড় দিয়ে মূর্তি বানাতো না, সেটা ভাবার কারণ নেই।