১.৭
উপলব্ধি থেকে প্রজ্ঞা

মানুষ ইন্দ্রিয় বা অতীন্দ্রয় দশার ভিতরে যে অনুভব করে, তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। এই অংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টি হয় উপলব্ধি, অভিজ্ঞা, জ্ঞান, বিবেচনা  অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও চেতনা।

উপলব্ধি ও অভিজ্ঞা

যেভাবেই যে ধরনের অনুভূতি উৎপন্ন হোক, তা গ্রহণ করে '
আমি' নামক সত্ত্বা। এবং সে কিভাবে গ্রহণ করছে, তাই হলো যে কোনো অনুভূতির পরিচয়।  ইন্দ্রিয়সমূহের কাজ হলো তার আওতাধীন তথ্যাদি তার বিভাগের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ ডিভাইসের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই ডিভাইসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে 'আমি' উজ্জীবিত হয়। এই উজ্জীবনের সূত্রেই 'আমি'র 'উপলব্ধি' নামক অনুভূতির জন্ম নেয়। এই 'উপলব্ধি' মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়। উপলব্ধির দ্বারা প্রতিটি অনুভূতিকে জানা হয়, আর এই জানাটা স্মৃতিতে রক্ষিত হয়। এই কারণে উপলব্ধিকে প্রাথমিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞা বলা যায়।  

অভিজ্ঞা মস্তিষ্ক নামক ডিভাইসে সংরক্ষিত হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে নানা রকমের অভিজ্ঞা সঞ্চিত হয়। সম্মিলিত অভিজ্ঞাকে প্রয়োজনে সঞ্চয়ভাণ্ডার থেকে উত্তোলন করে 'আমি'। স্মরণ করার যোগ্য ভাণ্ডার বলেই একে বলা হয় স্মৃতিভাণ্ডার। মানুষের মস্তিষ্কের লিম্বিক খণ্ড (Limbic lob) -এ আবেগ এবং স্মৃতি নিয়ন্ত্রক অংশ থাকে। এই স্মৃতিভাণ্ডারে থাকে মানুষের সকল অভিজ্ঞা। মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক হিসেবে রক্ষিত অভিজ্ঞা-দল তৈরি হয়।

ধরা যাক কোনো একজন ব্যক্তি একটি কঠিন বস্তুকে হাত দিয়ে ধরে সে গরম অনুভব করলো। এখানে দুটি অভিজ্ঞা সৃষ্টি হবে, একটি কঠিন বস্তুর অভিজ্ঞা, অপরটি গরমের অভিজ্ঞা। কঠিন বস্তুটি কাঠ না ধাতু। এই অনুভব আবার দুটি পৃথক অভিজ্ঞা। একই ভাবে একটু গরম, বেশি গরম, ইত্যাদিও পৃথক পৃথক অভিজ্ঞা। এই জাতীয় সকল অনুভবের ক্ষুদ্রাদি ক্ষুদ্র দশাগুলোর প্রত্যেকটি অভিজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই কারণে অনুভবের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষুদ্র অভিজ্ঞাকে জ্ঞানের প্রাথমিক এবং ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এরপর আসে সিদ্ধান্তের বিষয়।

সিদ্ধান্ত ও যুক্তি: সিদ্ধান্ত হলো- কোনো বিষয় সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছার দশা। তাই সিদ্ধান্তকে বলা যায়, মনের ক্রিয়াশীল কার্যক্রমের ফলাফল নির্ধারক একটি মান। এই মান অন্য সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে বা অন্য সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করতে পারে। আগের উদাহরণ দিয়ে বলা যাক, 'একজন একটি কঠিন বস্তুকে হাত দিয়ে ধরে সে গরম অনুভব করলো'। এক্ষেত্রে সে দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। একটি হলো বস্তুটি গরম, দ্বিতীয়টি হলো কঠিন। এই দুটি সিদ্ধান্ত মিলে তৈরি হবে মিশ্র সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হবে 'গরম বস্তু'। আবার 'গরম'-এর অনুভবের সূত্রে যে অভিজ্ঞা স্মৃতিতে জমা থাকে, তা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। কেউ যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দশায় পৌঁছাতে পারে না। তখন সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। মনের অনুভব স্তরে কিছু প্রাথমিক সিদ্ধান্তের জন্ম দেয়। তাই মনের নানা স্তরে বা দশায় সিদ্ধান্ত নানা ভাবে ঘটে থাকে। মানুষ যখন কোনো সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়, তখন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির মাধ্যমে বিচার করতে বসে। মনের আদালতে কোনো বিচার  যখন উত্থাপিত হয়, তখন বিষয়ের বিচারে নানা ধরনের সঙ্গত-অসঙ্গত ভাবনার উদয় হয়। এই ভাবনাগুলো মনের ভিতরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস তৈরি করে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাসের জোরেই বলি এটাই হবে বা হওয়া উচিৎ। এর পিছনে থাকে আত্মসমর্থনের যুক্তি। যুক্তির সাথে যুক্ত থাকে বহুবিধ সত্য, যা সে বিশ্বাস করে। সকল সত্য একটি শৃঙ্খলায় এনে একটি সুদৃঢ় দশায় পরিণত করা হয়। এরপর তা মনের আদলতে উপস্থাপিত হয়। অনেক সময়ই কোনো বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপনের সাথে একাধিক যুক্তি থাকে। সকল যুক্তির ভিতর সুসমন্বয় না হলে, যুক্তিগুলো দুর্বল হয়ে যায়।

জ্ঞান (cognition, knowledge, noesis)
স্মৃতিতে রক্ষিত উপলব্ধিই জাত অভিজ্ঞার মিলিত রূপ হলো জ্ঞান। এই স্মৃতি মস্তিষ্কের কোনো একক অংশে থাকতে পারে বা একাধিক অংশে ছড়িয়ে থাকতে পারে। মানুষের স্মৃতিতে এরূপ অসংখ্য তথ্য, জ্ঞান হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। এর প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশ থাকে স্মৃতিভাণ্ডারের কোনো একক অংশে। একই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নানা ধরনের অভিজ্ঞার সংমিশ্রণে একটি সমন্বিত জ্ঞ (জানা)-এর জন্ম হয়। তাই  সমন্বিত জ্ঞ-ই হয়ে উঠে জ্ঞান। জানার প্রকৃতি অনুসারে জ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. অনুভবজাত জ্ঞান: এই জ্ঞান মানুষ অনুভবের মাধ্যমে প্রথম অর্জন করে।  প্রতিটি মৌলিক অনুভূতি জন্ম দেয়, এই অনুভূতি থেকে জন্ম নেয় উপলব্ধি এবং সবশেষে তা অভিজ্ঞা হিসেবে স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়। আর অনুভবের নানা রূপ অবলম্বনে জন্ম নেয় অনুভবজাত জ্ঞান।

২. মিশ্র জ্ঞান: একাধিক অনুভবের দ্বারা অভিজ্ঞাসমূহ জন্ম দেয় জ্ঞান। সে জ্ঞান আবার অন্যান্য জ্ঞানের সংমিশ্রণে সৃষ্টি করে একটি মিশ্র জ্ঞান। যেমন 'আগুনে হাত দিলে পুড়ে যায়' এটা যদি জ্ঞান হয়। তাহলে এর ভিতরে রয়েছে আগুন এবং এর হাত পুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ের দুটি জ্ঞান।
মানুষ যত ধরনের জ্ঞান অর্জন করে, তাকে প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ দুটি হলো

যেভাবেই হোক না কেন, যখন কোনো বিষয় কোনো মানুষের কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হবে, তখনই তার কাছে তা জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হবে। সত্যাশ্রয়ী জানার তারতম্যের কারণে মানুষে মানুষে জ্ঞানের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। জগতের যে কোনো বিষয়ের তথ্য নানাবিধ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। সার্বিকভাবে একজন মানুষের পক্ষে কোনো সত্তার পূর্ণপরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। সেই অর্থে কোনো মানুষই জ্ঞানী নয়। কোনো কোনো বিষয়ে কোনো একজন অনেকখানি জানতে পারে। এই অনেকখানি জানা হলো পরম জ্ঞানের অংশ মাত্র। এই অংশমাত্র জ্ঞান দিয়ে যে বিশ্বাসের জন্ম হয়, তা দিয়ে অনেককে মুগ্ধ করা যায়, কিন্তু পরমজ্ঞানের বিচারে তা ফাঁকি হয়েই থেকে যায়। এই কারণে 'আমি জানি' বলতে বুঝায় 'আমি যা জানি'। এক্ষেত্রে 'আমি জানি'-এর বদলে 'আমার মনে হয়', 'আমার মতে', 'আমার বিশ্বাস' ইত্যাদি অনেকটা নিরাপদ শব্দ।

প্রজ্ঞা (cognitive content)
প্রকৃষ্টরূপে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানাটা হলো প্রজ্ঞা। প্রকৃষ্টরূপে জানার জন্যই প্রজ্ঞার ক্ষেত্রটি অনেক বড়। একটি বিষয়ের জানার ক্ষুদ্র অংশ হলো অভিজ্ঞা, একটি বিষয়ের একটি অংশের অভিজ্ঞার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় জ্ঞান। কোনো বিষয়ের সকল জ্ঞানের সমন্বিত রূপটি প্রকাশ পায় প্রজ্ঞার ভিতর দিয়ে। একটি বিষয় সম্পর্কে কতটুকু জানা গেছে, এই জানার ভিতর দিয়ে অনাবিষ্কৃত কোনো বিষয় গোচরে এসেছে কিনা, এসবের ভিতর দিয়ে সে নতুন কি শিখতে পেরেছে, এসবের যোগফল হলো প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা থেকে জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা।

প্রজ্ঞা আমাদেরকে সামগ্রিক মূল্যবোধের বিচারে সত্যপথের সন্ধান দেয়। আত্মোপলব্ধির দিকে থেকে এই সত্যপথ থেকে জন্ম নেয় সততার মূল্যবোধ। কারণ প্রজ্ঞা সত্য ও মিথ্যার মধ্য সুষ্পট সীমারেখা তৈরি করে দেয়। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞা হয়ে ওঠে পক্ষপাতহীন নির্মোহ উপলব্ধি। যা সত্য এবং সুকঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি এই প্রজ্ঞা বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ইত্যাদিকে সত্যপথের সন্ধান দেয়।  প্রাথমিক অবস্থায় প্রজ্ঞাকে বলা  যায় 'সত্যের প্রজ্ঞা'। অধিকতর সত্যের সন্ধানে এই প্রজ্ঞার মান পাল্টে যেতে পারে। এই কারণেই সত্যের প্রজ্ঞার উন্নত-রূপান্তর ঘটে, প্রজ্ঞার
অবনতি ঘটে না।

বাস্তব জীবনে প্রজ্ঞা  হতে পারে কল্যাণকর অমঙ্গল। এক্ষেত্রে সত্য প্রজ্ঞাকে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। বিষয়টাকে আমার দুটি দশার ভিতর দিয়ে দেখতে পারি। যেমন-

শিল্পের প্রজ্ঞা: নন্দনতত্তের বিচারে প্রজ্ঞা হয়ে ওঠে শিল্পের সৌন্দর্য সাধনার প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা অনেক সময় যথার্থ বাস্তবতার সত্য থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে কল্প-বাস্তবের জগতের অঙ্গনে উপস্থাপিত হয়। এখানে বাস্তবতার বিচারে সত্য আংশিক বা সম্পূর্ণ অলীক মনে হতে পারে, কিন্তু শিল্পের বিচারে যথার্থ সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করার দক্ষতার পিছনে থাকে প্রজ্ঞার প্রগাঢ় সম্পৃক্ততা। শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য হলো শিল্পের সত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এর মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগের আনন্দ দেওয়া। এই মহৎ উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে মহৎ-কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা। তাই নির্মোহ প্রজ্ঞা ও সামাজিক কল্যাণকর বা অকল্যাণকর প্রজ্ঞার বাইরে এসে শিল্পের প্রজ্ঞা স্বতন্ত্র স্থান করে নেয়।

অভিজ্ঞতা (experience): প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষ স্মৃতিতে ধারণ করে। নতুন কোনো বিষয় যখন উপস্থাপিত হয় তখন আগের জ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়। জ্ঞানের বিশেষ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বিশেষ ভূমিকা রাখে। ধরা যাক একবার গরম লোহায় হাত দিয়ে হাত পুড়ে গিয়েছিল। এর ফলে যে জ্ঞানের জন্ম হয়েছিল। তা স্মৃতিতে জ্ঞান হিসেবেই থাকবে। পরের বার গরম লোহায় হাত দেওয়ার আগে মন, এর সাথে সম্পর্কিত জ্ঞানকে ক্রিয়াত্মক অস্থায়ী স্মৃতি অংশে উত্তোলিত করবে। এখানে 'আমি' আগের ফলাফল অনুসারে বিবেচনা করবে 'কি করা উচিৎ'। এই বিবেচনার পিছনে যে জ্ঞান সক্রিয় হয়ে উঠবে তা প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা ব্যবহৃত হবে নতুন পথের সন্ধান দিতে। আর এই  কার্যক্রমের সমন্বিত রূপ হবে অভিজ্ঞতা। এই বিচারে অভিজ্ঞতা তুলনামূলক। আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মনে করা যাক, একটি জ্বলন্ত মোমবাতি আপনার সামনে রয়েছে। আপনি যখন প্রথম মোমবাতির আলো দেখেছিলেন, তখন প্রাথমিক কিছু অভিজ্ঞার মাধ্যমে জ্বলন্ত মোমবাতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক অভিজ্ঞাগুলো ছিল মোমবাতির শিখার আলোর রঙ, আকার, মৃদু বাতাসের তাড়নায় কম্পিত আলো, মোমবাতির দণ্ডের মাথায় এর অবস্থান ইত্যাদি। এসকল অভিজ্ঞার সম্মিলনে আপনার মনে জ্বলন্ত মোমাবাতি সম্পর্কে জ্ঞান জন্মেছিল। এরূপ আপনি জলন্ত পাঠকাঠি, জ্বলন্ত কাগজ, জ্বলন্ত দিয়াশলাই ইত্যদি সম্পর্কে জ্ঞান যদি আপনার আগে থেকেই থাকে, তবে এতগুলো জ্বলন্ত দৃশ্যমান বিষয়ের মধ্য থেকে জ্বলন্ত মোমবাতি ও অন্যান্য জ্বলন্ত বস্তুকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারবেন তুলনামূলক জ্ঞানের বিচারে। এর ভিতর দিয়ে প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটবে। আর ফলাফল অনুসারে আপনি যা করবেন, তা হবে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা।

জ্ঞান-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা চক্র
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা চক্রাকারে আবর্তিত হতে হতে উচ্চতর স্তরে উন্নীত হতে থাকে। ধরা কেউ একজন ১, ২, ৩ অঙ্ক আলাদা আলাদা চিনলো। এটা তার জানা হলো বলে জ্ঞান। এবার সমুদয় সংখ্যা-জ্ঞান তৈরি হবে সংখ্যা-প্রজ্ঞা। ধরা যাক, অঙ্কগুলোর বড় ছোটো অনুক্রমটাও তার জানা আছে। এবার ৫, ২, ১, ৮ অঙ্কগুলোকে যদি তাকে অনুক্রমে সাজাতে বলা হয়, এবং তা যদি সে পারে, তাহলে বলতেই হবে বড় ছোটো অনুক্রমের অভিজ্ঞতা থেকে সে সাজিয়েছে। এর ফলে তার ভিতরে নতুন জ্ঞানের সঞ্চার হবে। মূলত আদিকাল থেকে মানুষের যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে তার প্রাথমিক স্তরে ছিল এই জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার চক্রের ভিতর দিয়ে।

সাধারণভাবে অধিকাংশ নিত্যদিনের যে কাজ করে, তা অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞান দিয়ে। যেকোনো জ্ঞান এর ভিতর দিয়ে সাধারণ জ্ঞানে পরিণত হয়। জ্ঞান চর্চার কারণে মানুষের মনোজগতে যে প্রক্রিয়া সচল হয়ে উঠে, তাকে সাধারণভাবে বলা হয় জ্ঞান-প্রক্রিয়া (cognitive process)। কিছু মানুষ সাধারণ জ্ঞানের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু ভাবে। সেই ভাবনা থেকে জন্ম নেয়, উচ্চতর জ্ঞান চর্চা। সত্তাতত্ত্বে একে বলা হয় উচ্চতর জ্ঞান প্রক্রিয়া (higher cognitive process)। জ্ঞানী এই প্রক্রিয়ায় সাধারণজ্ঞানকে অবলম্বন করে উচ্চতর জ্ঞানমার্গে পৌঁছাতে চায়। মূলত পূর্বলব্ধ জ্ঞানের ব্যবহার করে নতুন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার দ্বারা সৃষ্ট উচ্চতর জ্ঞান-প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় প্রজ্ঞার সঞ্চার হয় এবং এর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় মৌলিক জ্ঞানগত প্রক্রিয়া (basic cognitive process)। এই প্রক্রিয়ার সূত্রে মানুষের ইন্দ্রিগ্রাহ্য বিষয়ে উপলব্ধি করার অভিজ্ঞতা হয়। এই পর্যায়ে শুরু হয় মনোজগতের প্রত্যক্ষ অনুভব উপলব্ধি প্রক্রিয়া।

উচ্চতর জ্ঞান প্রক্রিয়া ভিতর দিয়ে নানাধরনের সিদ্ধান্তের জন্ম হয়। সিদ্ধান্ত ভুল বা শুদ্ধ হতে পারে। উভয়ক্ষেত্রে জন্ম নেয় নতুন জ্ঞান, নতুন প্রজ্ঞা, নতুন অভিজ্ঞতা। উচ্চতর জ্ঞান প্রক্রিয়া মনোজগতে তিনটি দশার সৃষ্টি করে। এই দশা তিনটি হলো
চিন্তন, সিদ্ধান্ত এবং সুপ্রজ্ঞা

উচ্চতর জ্ঞান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ধরা যাক, একটি ছোটো নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। এখানে সমস্যা হলো ওপারে যাওয়া। কিভাবে তাড়াতাড়ি ওপারে যাওয়া যায়, এই সূত্রে চিন্তন কার্য শুরু হলো তার মনোজগতে। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলো কোনো নৌকার জন্য অপেক্ষা করা, সিদ্ধান্ত নিলো সাঁতরে পার হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ আপাতত তার কাছে দুটি সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য মনে হলো। এবার সে অপেক্ষাকৃত ভালো সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করবে। এইভাবে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি হবে বিচার-প্রক্রিয়া (judging)

মানুষ প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নেয় এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেই কোনো কাজ করতে পারে। অজস্র সিদ্ধান্তের সাগরে মানুষ কখনো ঠিক কাজটি করে, কখনো চরম ভুল করে। কর্মক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকে, বিষয়ানুসারে অভিজ্ঞতার আলোকে যথাযথ বিচার-বিবেচনা না করার কারণে। অনেক সময়ই একজনের কার্যক্রম অন্যের কাছে যথার্থ মনে হয় না।  সিদ্ধান্তের এই ভিন্নতার পিছনের কারণে, একে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়। যেমন

শিক্ষাব্যবস্থার প্রক্রিয়া, পারিবারিক ইচ্ছা, আর্থিক স্বচ্ছলতা ইত্যাদির দ্বারা তাড়িত হয়ে, পরিবারের অভিভাবকরা অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেয়। এর ফলে এই সব সন্তানদের স্বাভাবিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। কোনো সুনির্দিষ্ট ইচ্ছায় আবদ্ধ থেকে সন্তানের কল্যাণ কামনায় যা সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা সন্তান এবং জাতির জন্য পরম কল্যাণ বয়ে আনে না।

যে কোনো সত্তার গুণমান অনুসারে একটি সত্তার পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সত্তার গুণগতবৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে তৈরি হয় সত্তাগুণ। আর সত্তাগুণের সংস্পর্শে মানুষের নানা ধরনের অনভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভব মানুষের মনোগত দশার সৃষ্টি করে। মনোগত দশায় তৈরি হয় সুপ্রজ্ঞা দশা (cognitive state)। এই সুপ্রজ্ঞাদশার মধ্য দিয়ে আরও উন্নততর যে দশায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয় 'চেতনা (consciousness)'। বলে রাখা ভালো- consciousness-এর বাংলা সচেতনতা এবং চেতনা। দুটো বিষয় এক নয়। মূলত ধারণার বিকাশ ঘটে চেতনার ভিতর দিয়ে। আর চেতনা মানুষকে সচেতন করে তোলে। এই সূত্রে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো  'চেতনা ও ধারণা' নিয়ে।