গীতিকার: লালন ফকির
শিরোনাম: অকূল পাথার দেখে মোদের লাগেরে ভয়
অকূল পাথার দেখে মোদের লাগেরে ভয়।
মাঝি ব্যাটা বড় ঠ্যাটা, হাল ছেড়ে বগল বাজায়॥
উজান ভেটেন দুটি নালে দমদমাদম বেদম কলে।
পবন
গুরু সর্বময়॥
প্রেমানন্দে সাঁতার খেলে তাইতে সুধানিধি মেলে।
তার ঘটে পটে এক সত্য হয়॥
সামনে অপার নদী পার হয়ে যায় ছয়জন বাদী
শ্রীরূপ লীলাময় ।
লালন বলে ভাব জানিয়ে ডুব দিয়ে সে রত্ন উঠায়॥
- ভাবার্থ: এই গানে মানব জীবনকে কূলকিনার বিহীন সাগরের একটি নৌকার যাত্রীর সাথে তুলনা করা
হয়েছে। একই সাথে সাধন-পথের রহস্য এবং প্রাণপবনের গুরু গুরুত্বকে উপস্থাপন করা
হয়েছে।
এই গানের যাপিতজীবনের ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ অন্তহীন চলার পথই হলো আদি-অন্তহীন 'অকূল পাথার',
যা সাধারণ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখে। যাপিতজীবনের চালক হলো- মনমাঝি। যে
সংসারের মোহে সে মাতোয়ারা। সে ভালোমন্দের ধার ধারে না। সে ঠ্যাট (এক গুঁয়ে),
তাই জীবনের লক্ষ্যবিচ্যুত হয়ে আনন্দে বগল বাজায়। অর্থাৎ মানুষ তার মনকে বশে
না এনে বা জীবনের মূল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে কেবল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ,
মাৎসর্য —এই ষড়রিপুর বশবর্তী হয়ে কেবল ভোগে মত্ত থাকে। ফলে জীবন-নদী
পার হওয়ার ভয় বাড়তে থাকে।
উজান-ভেটেন দুটি নালে হলো- মানবদেহে প্রবাহিত ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুটি
প্রধান নাড়ি। এগুলি হলো শ্বাস-প্রশ্বাস বা জীবনীশক্তির প্রবাহ পথ। অবিরাম দম সাধনার (শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়াম)
কলে (কলা-কৌশলে), প্রাণবায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহের ভেতরে একটি বিশেষ স্পন্দন সৃষ্টি
করে, যা সাধনকালে অনুভব করা যায়।
'পবন' অর্থাৎ প্রাণবায়ু বা শ্বাস-প্রশ্বাস গুরু হয়ে হয় মানে আধ্যাত্মিক
সর্বস্তরের । লালনের মতে, এই প্রাণবায়ুই দেহের মধ্যে গুরুরূপে অবস্থান করে এবং সমস্ত সাধন প্রক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি
হিসেবে বিরাজ করে।
প্রেমের আনন্দ ও সত্যের উপলব্ধিই পরম সত্য। যখন সাধক মনকে (মাঝিকে) বশীভূত করে প্রেম এবং ভক্তি দিয়ে সাধন পথে চালিত করে, তখন সে আনন্দের সাগরে ডুব দেয়।
আর এই সাধনার ফলে তার 'সুধা' বা পরম সত্য বা আত্ম-উপলব্ধি লাভ হয়।
ফলে ঘটে (দেহ) এবং পটে মনে সত্যের প্রকাশ ঘটে। এই পর্যায়ে এসে সাধক উপলব্ধি করেন যে দেহ এবং জগতের মধ্যে যে সত্য বিরাজমান, তা
সত্য এবং এক ও অভিন্ন। বাইরে যা আছে, তা-ই ভেতরে আছে, অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের সত্য মানবদেহের মধ্যেই লুকানো।
এই গানটি মানুষকে জাগিয়ে তুলতে চায় যে, এই জীবন-সমুদ্রে ভয় পেও না। তোমার মন (মাঝি) যেন হাল ছেড়ে না দেয়। গুরু বা প্রাণবায়ুর দেখানো পথে প্রেম ও দমের সাধনা করলে দেহের ভেতরেই পরম সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং জীবন সার্থক হয়।
সংসার বা ভব নদী—যা পার হওয়া সাধকের পরম লক্ষ্য। এই নদী পার হয়ে ছয় জন বাদী (ছয়
রিপু- কাম ক্রোধ, লোভ, মোহ. মাৎসর্য), এরা প্রতিদ্বন্দ্বী বা বাধাদানকারী শক্তি
হিসেবে বিরাজ করে এবং মানবজীবনের আধ্যাত্মিক পথে প্রধান বাধা। এই ষড়রিপু
সর্বক্ষণ মানুষের মনকে বিভ্রান্ত করে, ফলে নদী পার হওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।
'শ্রীরূপ' বা পরম সত্তার রূপ-এর লীলা। এই শ্রীরূপ লীলাময়েরই অংশ হয়ে সাধককে
পরীক্ষা করে। সাধক যদি এই রিপুদের আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারে, তবেই সে প্রকৃত
লীলার অংশ হতে পারে। লালনের অভিমত 'ভাব' অর্থাৎ গভীর উপলব্ধি, প্রেম ও ভক্তির
মাধ্যমে জীবনের গভীরে ডুব (কঠোর সাধন-ভজন) দিয়ে প্রকৃত রত্ন পাওয়া যায়। এই রত্ম
হলো পরম পুরুষ হলো- আত্মজ্ঞান বা সেই অধরা মানুষ। যখন সাধক দেহ-তত্ত্ব এবং মনের
রহস্য বুঝে ভাব-সাধনা করে, তখনই সে এই মূল্যবান রত্নটি লাভ করতে পারে, অর্থাৎ
আত্ম-উপলব্ধি বা মুক্তি লাভ করে।
- পর্যায়: আত্মতত্ত্ব
তথ্য
- অখণ্ড, লালনসঙ্গীত। আবদেল মাননান সম্পাদিত। রোদেলা
প্রকাশনী। পৃষ্ঠা: ৩৩১