মহাভারত
আদিপর্ব


ভাষাংশ>মহাভারত >আদিপর্ব>


চতুর্ব্বিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
নকুল-সহদেবের জন্ম

    বৈশম্পায়ন কহিলেন, কুন্তীপুত্রগণের ও ধৃতরাষ্ট্রতনয়দিগের জন্ম হইলে মদ্ররাজদুহিতা নির্জ্জনে পাণ্ডুকে কহিলেন, “মহারাজ ! দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি ঋষিশাপে সন্তানোৎপাদনে বঞ্চিত হইয়াছেন, তাহাতে আমার কোনো সন্তাপ নাই; আমি বরার্হা হইয়াও হীনাবস্থায় রহিয়াছি, তাহাতেও আমার পরিতাপ নাই কিংবা গান্ধারী শতপুৎত্রের মাতা হইয়াছেন বলিয়া আমার এক মুহূর্ত্তের নিমিত্তও ঈর্ষা হয় না; কিন্তু মহারাজ ! আমার অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কুন্তী ও আমি এই দুইজনই আপনার ভার্য্যা, উভয়েই সমান; কিন্তু কুন্তী পুৎত্রবতী হইলেন, আমি পুৎত্রমুখ-নিরীক্ষণে বঞ্চিত রহিলাম। হে রাজন্ ! যদি কুন্তী আমার আমার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলেই আমার পুৎত্র হয়,আপনারও অধিক অপত্যলাভ দ্বারা মহৎ উপকার জন্মে; কিন্তু কুন্তী আমার সপত্নী, আমি কোনক্রমেই তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে পারিব না। তবে যদি আপনি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে অনুরোধ করেন, তাহা হইলেই আমি চরিতার্থ হইতে পারি।” রাজর্ষি পাণ্ডু তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! উত্তম বলিয়াছ, ইহা আমার নিতান্ত অভিলষিত; কেবল তোমার মত হয় কি না, এই সন্দেহপ্রযুক্ত তোমাকে বলি নাই। এক্ষণে ইহা তোমার অনুমোদিত জানিতে পারিয়াছি; অবশ্যই আমি তোমার মনোরথসিদ্ধির নিমিত্ত কুন্তীকে এ বিষয়ে অনুরোধ করিব। কুন্তী কখনই আমার বাক্য উল্লঙ্ঘন করিবে না।”
    পাণ্ডু মাদ্রীকে এই কথা বলিয়া কুন্তীর নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে নির্জ্জনে কহিতে লাগিলেন, হে পৃথে ! দেখ, ইন্দ্র ত্রিদশাধিপত্য লাভ করিয়াও যশোলিপ্সায় যজ্ঞানুষ্ঠান করেন; তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন মন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণগণ কেবল যশের নিমিত্তই গুরুকরণ করিয়া থাকেন এবং রাজর্ষিগণ ও তপোধন ব্রহ্মণগণ যশোভিলাশে নানাবিধ সৎকর্ম্মের অনুষ্টানে যত্নবান হয়েন; অতএব হে প্রিয়ে! তুমি আমার বংশবৃদ্ধির নিমিত্ত, আমার ও পুর্ব্বপুরুষগণের পিণ্ডরক্ষার নিমিত্ত, পতির প্রয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত এবং আপনার যশোবর্দ্ধনের নিমিত্ত একবার মাদ্রীর প্রতি অনুকম্পা করিয়া উহাকে পুৎত্রবতা কর। হে পৃথে! পুৎত্রদান দ্বারা মাদ্রীকে পরিত্রাণ কর, ইহাতে তোমার যশোবৃদ্ধি হইবে।” কুন্তী পাণ্ডুনৃপতির বাক্য-শ্রবণান্তর মাদ্রীকে কহিলেন, “তুমি কোন দেবতকে আহ্বান কর, তাহা হইলে অচিরকালমধ্যে তোমার অনুরূপ পুৎত্রলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।”
    মাদ্রী কুন্তীর আদেশক্রমে কিয়ৎক্ষণ মনে মনে বিচার করিয়া অশ্বিনীকুমারযুগলকে স্মরণ করিলেন। অশ্বিনীকুমারযুগল তৎক্ষণাৎ তথায় সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার গর্ভে যমজ পুৎত্র উৎপাদন করিলেন। ঐ পুৎত্রদ্বয়ের নাম নকুল ও সহদেব। তাঁহারা ভুমিষ্ঠ হইবা মাত্র দৈববাণী হইল, “ হে কুমারদ্বয়! তোমরা অশ্বিনীকুমার অপেক্ষা সমধিক-সত্ত্বসম্পন্ন, রূপবান, গুণাশালী ও তেজস্বী হইয়া পরমসুখে কালযাপন কর।” শতশৃঙ্গবাসী মহর্ষিগণ যথাবিধি আশীর্ব্বচন বিধানপূর্ব্বক প্রীতমনে তাঁহাদের নামকরণ করিলেন। কুন্তীর পুৎত্রত্রয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম যুধিষ্ঠির, মধ্যমের নাম ভীম, কনিষ্ঠের নাম অর্জুন হইল। মাদ্রীর পুৎত্রদ্বয়ের মধ্যে পূর্ব্বজনের নাম নকুল, দ্বিতীয়ের নাম সহদেব হইল। পাণ্ডুপুৎত্রগণ প্রত্যেক এক এক সংবৎসর অনন্তর জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তথাপ তাহাদিগকে সমবয়স্ক বোধ হইত। তাঁহারা সকলেই মহাসত্ত্ব, মহাবীর্য্য, মহাবল ও পরাক্রান্ত ছিলেন। রাজর্ষি পাণ্ডু সেই দেবতুল্য রূপবান্, মহাতেজস্বী পুৎত্রগণকে দেখিয়া আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন। পাণ্ডুপুৎত্রগণ ক্রমে ক্রমে শতশৃঙ্গবাসী মুনি ও মুনিপত্নীগণের সাতিশয় প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন।
    কিয়দ্দিনানন্তর রাজর্ষি পাণ্ডু পুনর্ব্বার মাদ্রীর গর্ভে সুতোৎপাদনের নিমিত্ত কুন্তীকে অনুরোধ করাতে তিনি কহিলেন, “মহারাজ! মাদ্রী অতিশয় ধূর্ত্ত; সে একবার দেবতাহ্বান করিয়া দুই পুৎত্র উৎপন্ন করিয়াছে। আমি পূর্ব্বে জানিতাম না যে, দুইজনকে একেবারে আহ্বান করলে দুই ফললাভ হয়, তন্নিমিত্ত আমি ঐ ফলে বঞ্চিত হইলাম, অতএব হে মহারাজ! আমি কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতেছি, আর আমাকে ও বিষয়ে অনুরোধ করিবেন না।” কুন্তীবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজর্ষি পাণ্ডু অগত্যা তাহাতে সম্মত হইয়া নিরস্ত রহিলেন। হে ভরত বংশাবতংশ জনমেজয়! এইরূপ দেবত্তপাণ্ড পুৎত্রগণ হৈমবত পর্ব্বতে থাকিয়া কিয়দ্দিনের মধ্যে বীর্যবান্, যশস্বী, শুভলক্ষণাসম্পন্ন, চন্দ্রতুল্য প্রিয়দর্শন, সিংহের ন্যায় দর্পশালী, সর্ব্বধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য ও দেবতুল্য বিক্রমশালী হইয়া উঠিলেন। তত্রত্য মহর্ষিগণ তাঁহাদিগের লক্ষণ, পরাক্রম ও রূপলাবণ্য দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। এদিকে দুর্য্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের পুৎত্রগণ অতি অল্পদিনের মধ্যে জলাশয়স্থ কমলের ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্বিত হইতে লাগিল।

পঞ্চবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
পাণ্ডুর পরলোক

    বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহীপতি পাণ্ডু এইরূপে দেবতুল্য প্রিয়দর্শন পঞ্চপুৎত্র লাভ করিয়া পরমসুখে কিয়ৎকাল অতিবাহিত করিলেন। ইতিমধ্যে সর্ব্বভূতের সম্মোহনকারী ঋতুরাজ বসন্ত আবির্ভূত হইল। রাজা বনবিহার করিতে গমন করিলেন, মদ্ররাজদুহিতা দিব্যাম্বর পরিধানপূর্ব্বক তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। ঐ বন পলাশ, তিলক, আম্র, চম্পক, পারিভদ্রক প্রভৃতি ফলপুষ্পশোভিত নানাবিধ বৃক্ষজালে সমাকীর্ণ; পদ্ম, কুমুদ, কহ্লার প্রভৃতি জলজ-পুষ্প দ্বারা সমাবৃত এবং বহুবিধ জলাশয়ে ব্যাপ্ত ছিল। একে বসন্তকাল ও বনের অলৌকিক সৌন্দর্য্য, তাহাতে আবার অসামান্য রূপলাবণ্যাসম্পন্না রাজীবলোচনা মদ্রাধিপতনয়া একাকিনী সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করিতেছেন, এই সমস্ত দর্শন করিয়া রাজার অন্তঃকরণ চঞ্চল হইল। তিনি ক্রমে ক্রমে অনঙ্গশরে অবশচিত্ত হইয়া বলপূর্ব্বক মাদ্রীকে আলিঙ্গন করিলেন। মাদ্রী বারংবার নিষেধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু রাজা কোনক্রমেই নিবৃত্ত হইলে না। তিনি কামশরে বিমোহিত হইয়া মৃগরূপধারী ঋষিকুমারের শাপ একেবারে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। দৈবনির্ব্বন্ধ অখণ্ডনীয়, রাজা বারংবার মাদ্রী কর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও কোনক্রমে নিরস্ত হইলেন না; সুতরাং অনুলঙ্ঘনীয় মৃগশাপবশতঃ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। মাদ্রী তাঁহাকে তদবস্ত দেখিয়া তাঁহার মৃতদেহ আলিঙ্গনপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন। কুন্তী দুর হইতে সেই আর্ত্তনাদ শ্রবণ করিয়া অতীব আকুলিতচিত্তে স্বীয় পুৎত্রগণ ও মাদ্রীকুমারদ্বয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া শব্দানুসারে গমন করিতে লাগিলেন। মাদ্রী অনতিদুরে কুন্তীকে কুমারগণ সমভিব্যাহারে আসিতে দেখিয়া কাতর-স্বরে কহিলেন, “ভদ্রে! তুমি একাকিনী এই স্থানে আগমন কর। বালকগণ ঐখানেই থাকুক।” কুন্তী মাদ্রীর বচনানুসারে কুমারগণকে রাখিয়া একাকিনী ‘হা হতোস্মী’ বলিয়া রোদন করিতে করিতে তথায় গমনপূর্ব্বক দেখিলেন, মাদ্রী রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গন করিয়া ভূমিতলে শয়ানা আছেন । তখন তিনি শিরে করাঘাত করিয়া বিলাপ করিতে করিতে মাদ্রীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি রাজাকে সর্ব্বদা রক্ষা করিতাম; ইনি অতিশয় জিতেন্দ্রিয় ছিলেন; তবে ইনি মৃগশাপ জানিয়া শুনিয়াও কি নিমিত্ত তোমাকে বলাৎকার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন? দেখ, আমি যেরূপ ইহাকে রক্ষা করিতাম, তোমারও সেইরূপ করা কর্ত্তব্য ছিল । তবে কেন ইহাকে নির্জ্জনে আনিয়া প্রলোভিত করিলে? মৃগশাপবিষয়িণী চিন্তা ইহার হৃদয়ে সর্ব্বদা জাগরূক থাকিত, তন্নিমিত্ত নিয়তই যৎপরোনাস্তি দুঃখিত থাকিতেন; অদ্য তোমাকে নির্জ্জনে পাইয়া কি নিমিত্ত ইঁহার মন চঞ্চল হইল? মদ্ররাজনন্দিনি ! তুমি ধন্যা ও আমা হইতে অধিকতর সৌভাগ্যবতী; যেহেতু, তুমি অদ্য মহারাজের প্রসন্ন বদন দেখিয়াছ ।” মাদ্রী কুন্তীর এইরূপ পরিবেদন (শোক-বিয়োগবেদনা) বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “দেবি! এ বিষয়ে আমার কোন অপরাধ নাই । রাজর্ষি বলাৎকারে উদ্যত হইলে, আমি অতি করুণস্বরে তাঁহাকে ভূয়োভূয়ঃ নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমাদের দুরদৃষ্টক্রমেই হউক বা ঋষিশাপের অনুল্লঙ্ঘনীয়তাপ্রযুক্তই হউক অথবা দুর্দ্দান্ত মদনের অনিবার্য্যতাবশতঃই হউক, আমার বাক্যে একবার কর্ণপাতও করিলেন না ।”
    পতিব্রতা কুন্তী মাদ্রীর বচনাবসানে কহিলেন “ভদ্রে! যাহা হইবার হইয়াছে। এক্ষণে তোমার নিকট এক প্রার্থনা করি, শ্রবণ কর। আমি রাজর্ষির জ্যেষ্ঠা ধর্ম্মপত্নী, সুতরাং শ্রেষ্ঠ ধর্ম্মফল আমারই প্রাপ্য; অতএব আমি পরলোকগত ভর্ত্তার সহগমন করিব, তুমি এ বিষয়ে আমাকে নিবারণ করিও না, তুমি গাত্রোৎথান কর। অতি সাবধানে এই সকল সন্তানগুলি প্রতিপালন করিও। আমি মহারাজের মৃতদেহ লইয়া চিতারোহণ করি”। মাদ্রী কহিলেন, “আর্য্যে! আমি স্বামিসহবাসে অদ্যাপি পরিতৃপ্ত হই নাই, অতএব আমিই ইহার সহগমন করিব। অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এ বিষয়ে অনুমতি করিতে হইবে। আরও দেখ, মহারাজ আমাতেই আসক্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তিন্নিমিত্ত যমভবনে গমন করিয়া তাঁহার অভিলাষ পরিপূর্ণ করা আমার প্রধান ধর্ম্ম ও অত্যন্ত অবশ্য-কর্ত্তব্য কর্ম্ম। বিশেষতঃ যদি আমি জীবিত থাকিয়া আপনার পুৎত্রদ্বয়ের ন্যায় তোমার পুৎত্রগণকে স্নেহ করিতে না পারি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাকে ইহকালে লোক নিন্দায় ও পরোকালে ঘোরতর নরকে নিপতিত হইতে হইবে; অতএব সহগমন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়কল্প। এক্ষণে তোমার নিকট আমার এই ভিক্ষা যে, মহারাজের মৃতদেহের সহিত আমার কলেবর দগ্ধ কর। আমার পুৎত্রদ্বয়কে আপনার পুৎত্রগণের ন্যায় স্নেহ ও অপ্রমত্তচিত্তে প্রতিপালন করিও; ইহা ব্যতীত আমার আর কিছুই বক্তব্য নাই”। মদ্ররাজদুহিতা কুন্তীকে এই কথা কহিয়া রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গনপূর্ব্বক কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।