মহাভারত
আদিপর্ব
ষড়্ বিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
হস্তিনায় পাণ্ডুর শব-আনয়ন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, এইরূপে রাজর্ষি পাণ্ডুরকলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক লোকান্তর-গমন করিলে দেবতুল্য মহর্ষিগণ ও মন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণগণ একত্র হইয়া মন্ত্রণা করিলেন যে, “মহাযশাঃ মহাত্মা মহারাজ পাণ্ডু রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া এ স্থানে আমাদের শরণগত হইয়া বহুদিবস তপোনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি শিশুপুৎত্রগণ ও ভার্য্যাকে আমাদিগের নিকটএ রাখিয়া সুরলোকে গমন করিয়াছেন, অতএব তাঁহার পুৎত্র-কলত্র ও মৃতদেহ লইয়া ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সমর্পণ করা আমাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য”। মহর্ষিগণ এইরূপ পরামর্শ করিয়া কুন্তী, যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ বালক এবং পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃতকলেবর লইয়া হস্তিনানগরে গমন করিলেন। পুৎত্রবৎসলা কুন্তী পতিবিহীনা হইয়াও পুৎত্রমুখ-নিরীক্ষণে এবং স্বদেশগমনে নিতান্ত ঔৎসুক্যপ্রযুক্ত সর্ব্বাগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অতি অল্পদিনের মধ্যেই কুরুজাঙ্গলে উপনীত হইয়া রজনী প্রভাত হইবামাত্র রাজদ্বারে সমুপস্থিত হইলেন। তখন তাপসগণের বাক্যানুসারে দ্বারবান্ তৎক্ষণাৎ রাজসভায় তাঁহাদের আগমনবার্ত্তা নিবেদন করিলেন। হস্তীনাপুরনিবাসী যাবতীয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ তাপসদিগের আগমনবার্ত্তাশ্রবণে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং আপন আপন পুৎত্র ও কলত্রগণ-সমভিব্যাহারে বিবিধ যানে আরোহণ করিয়া তাঁহাদিগকে দর্শন করিতে চলিলেন। তাপসসন্দর্শনার্থিনী জনতা রাজমার্গ আচ্ছন্ন করিয়া চলল। তৎকালে তাঁহাদের সকলেরই অন্তঃকরণ ঈর্ষাশূন্য ও ধর্ম্মপ্রবণ হইল। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, সোমদত্ত, বাহ্লীক, রাজর্ষি ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, দেবী সত্যবতী, যশস্বিনী কৌশল্যা ও অন্যান্য রাজপত্নীগণে পরিবৃতা গান্ধারী এবং বিচিত্রাভরণবিভূষিত দুর্য্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের দায়াদগণ তাপসদর্শনে ব্যগ্রচিত্ত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। তদন্তর পুরোহিত-সহিত কৌরবগণ ও অন্যান্য পৌর জানপদগণ তপস্বীদিগকে দর্শন করিয়া দণ্ডবৎ প্রণিপাত করিলেন। পরে সেই সকল লোক ঋষিদিগের আদেশানুসারে উপবেশন করিলে মহাত্মা ভীষ্ম সমস্ত দর্শনার্থিগণকে নিস্তব্ধ দেখিয়া মহর্ষিগণকে পাদ্য ও অর্ঘ্য দ্বারা যথাবিধি পূজা করিয়া রাষ্ট্র ও রাজ্যের সংবাদ নিবেদন করিলেন। তখন তাপসগণের মধ্যে পরিণতবয়াঃ এক মহর্ষি গাত্রোত্থান করিয়া অন্যান্য তপোধনের মত গ্রহণপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে মান্যবরগণ! যে কৌরবদায়াদ পাণ্ডুনামক নরপতি সমস্ত ভোগসুখে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক শতশৃঙ্গ পর্ব্বতে গমন করিয়া ব্রহ্মচর্য্যব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাঁহার জ্যেষ্ঠা ধর্ম্মপত্নী কুন্তীর গর্ভে সাক্ষাৎ ধর্ম্মের ঔরসে এই যুধিষ্ঠিরনামা পুৎত্র জন্মিয়াছেন, ভগবান বায়ু হইতে এই মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সমুৎপন্ন হইয়াছেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে এই ধনঞ্জয় নামে পুৎত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। অর্জ্জুনের যশোরাশি সমস্ত মেদিনীমণ্ডলে বিস্তীর্ণ হইয়া অন্যান্য মহাধনুর্দ্ধর বীরপুরুষগণের কীর্ত্তি বিলুপ্ত করিবে। আর এই যে দুই মহাধনুর্দ্ধর নরশ্রেষ্ঠকে দেখিতেছে, ইহারা সেই রাজর্ষির কনিষ্ঠা ধর্ম্মপত্নী মাদ্রীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারযুগলের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। হে কুরুকুলাগ্রগণ্য! এইরূপে পরম-ধর্ম্মাত্মা মহাযশস্বী পাণ্ডুা মহীপাল বনে বাস করিয়া নষ্টপ্রায় পৈতামহ বংশের পুনরুদ্ধার করিয়াছেন। তোমরা এই পাণ্ডুপুৎত্রগণের বেদাধ্যয়নের বিষয় জ্ঞাত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইবে। সেই মনুজসত্তম রাজর্ষি পাণ্ডু অভিলষিত পুৎত্র লাভ করিয়া অদ্য সপ্তদশ দিবস হইল পরলোকে গমন করিয়াছেন। পতিব্রতা মাদ্রীও পতির লোকান্তরপ্রাপ্তি দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া তাঁহার মৃতদেহ আলিঙ্গনপূর্ব্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া পতিলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন। তোমরা পাণ্ডু ও মাদ্রীর এই শবশরীরদ্বয় লইয়া কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতার সহিত তাঁহাদিগের অগ্নিকার্য্য প্রেতক্রিয়া এবং শ্রাদ্ধাদি সম্পাদন কর।” কুরুগণকে এই কথা বলিয়া তাপসগণ দেখিতে দেখিতে গুহ্যকদিগের সহিত অন্তর্হিত হইলেন। তাঁহাদের সমাগমে হস্তিনাপুর গন্ধর্ব্বাধিষ্ঠিতের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছিল। এক্ষণে তাঁহারা অন্তর্দ্ধান করাতে পুরের আর সেরূপ শোভা রহিল না। সমাগত পৌর ও জানপদগণ সিদ্ধমহর্ষিগণ-দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।
সপ্তবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
পাণ্ডুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
তদনন্তর ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “পাণ্ডুর ও মাদ্রীর সমুদয় প্রেতকার্য্য যাহাতে পরম সমারোহপূর্ব্বক সুচারুরুপে সম্পন্ন হয়, তদ্বিষয়ে তুমি যত্নবান হও এবং তাঁহাদের দুজনের যাবতীয় পশু, বস্ত্র, রত্ন ও ধন আছে, অর্থিগণের প্রার্থনানুসরে তৎসমুদয় প্রদান কর। কুন্তী দ্বারা মাদ্রীর সৎকার করাও। মাদ্রীকে এইরূপ সুসংবৃত করিবে যে, অন্যের কথা দুরে থাকুক, যেন বায়ু বা সূর্য্যও তাঁহাকে দেখিতে না পান। মহারাজ পাণ্ডুর নিমিত্ত আর শোক করিবার আবশ্যকতা নাই, বরং তিনি অতিমাত্র প্রশংসনীয়, যেহেতু, সেই মহাত্মা মহাবলপরাক্রান্ত পঞ্চপুৎত্র রাখিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন”।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভরতকুলতিলক জনমেজয়! বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য-শ্রবণানন্তর ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া ভীমকে সমভিব্যাহারে লইয়া অতি-পবিত্র প্রদেশে পাণ্ডুর অগ্নি-সংস্কার করিতে চলিলেন। কুরু-পুরোহিতগণ পাণ্ডুরাজের আজ্য (ঘৃত) গন্ধপরিপূত প্রদীপ্ত জাতাগ্নি (সংস্কৃত অগ্নি-সংস্কারকালে যে অগ্নিস্থাপিত হয়) লইয়া সত্তর গমন করিতে লাগিলেন। অমাত্য, জ্ঞাতি ও বান্ধবগণ একত্র হইয়া বিবিধ গন্ধদ্রব্য ও নানাজাতীয় পুষ্প দ্বারা পাণ্ডু ও মাদ্রী্র মৃত-কলেবর বিভূষিত করিলেন। পরে মহার্ঘবস্ত্রাচ্ছাদিত শিবিকার মধ্যে সেই দুই মৃত-শরীর সংস্থাপন করিয়া সকলে স্কন্ধে লইয়া চলিলেন। তৎকালে কেহ বা শ্বেতচ্ছত্র-ধারণ, কেহ বা চামর-ব্যজন করিতে আরম্ভ করিল। চতুর্দ্দিকে নানাপ্রকার বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। শত শত ব্যক্তি পাণ্ডুর পূর্ব্বসঞ্চিত বিবিধ ধনরত্ন লইয়া যাচকগণকে প্রদান করিতে লাগিল। শুক্লাম্বরধারী যাজকগণ প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে করিতে তাঁহাদের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র “হায়! কি হইল! মহারাজ! আমাদিগকে অপার দুঃখার্ণবে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিলেন,"এই বলিয়া করুণস্বরে রোদন করিতে করিতে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। তদনন্তর পাণ্ডু ও মাদ্রীর শিবিকাবাহী পাণ্ডবগণ ভীষ্ম ও বিদুর অশ্রুপূর্ণনয়নে বনোদ্দেশে রমনীয় ভাগীরথীতীরে সমুপস্থিত হইয়া স্কন্ধস্থিত শিবিকা অবতারণ করিলেন এবং তন্মধ্য হইতে মহারাজের মৃত-কলেবর বহিষ্কৃত করিয়া তাহাতে কালাগুরু ও চন্দন প্রভৃতি বিবিধ গন্ধদ্রব্য লেপনপুর্ব্বক সুবর্ণ-কলস দ্বারা জলসেচন করিতে লাগিলেন। তৎপরে সেই মৃতদেহে পুনর্ব্বার নানাবিধ গন্ধদ্রব্য লেপন করিয়া স্বদেশীয় শুভ্র বস্ত্র পরিধান করাইলেন। মহারাজ পাণ্ডু শুভ্র বসনাচ্ছন্ন ও চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধি গন্ধদ্রব্য দ্বারা অনুলিপ্ত হওয়াতে জীবিতের ন্যায় পরম রমণীয় শোভা ধারণ করিলেন। তদন্তর তাঁহারা যাজকদিগের আজ্ঞানুসারে সমস্ত প্রেতকার্য্য সুসম্পন্নকরণানন্তর মাদ্রীর সহিত রাজাকে ঘৃতাভিষিক্ত করিয়া চন্দন প্রভৃতি বহুবিধ সুগন্ধি কাষ্ঠ দ্বারা দাহ করিতে লাগিলেন। কৌশল্যা (অম্বালিকার নামান্তর) চিতাগ্নিস্থ পুৎত্র ও পুৎত্রবধু মৃত-কলেবরদর্শনে শোকে নিতান্ত অধীর হইয়া ‘হা পুৎত্র! হা পুৎত্র! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে ধরাতলে পতিত ও মূর্চ্ছিত হইলেন। তাঁহাকে ভূতলে পতিত দেখিয়া রাজভক্তিপরায়ণ প্রজাগণ ‘হায়! কি হইল!'বলিয়া করুণস্বরে রোদন করিতে লাগিল। কুন্তী ধূলিধূসরিতকলেবর হইয়া কাতরস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন। তাঁহার ক্রন্দনধ্বনি-শ্রবণে মনুষ্যের কথা দুরে থাকুক, তির্য্যগ্যোনিগত পশুপক্ষীরাও রোদন করিতে লাগিল। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, মহামতি বিদুর কৌরবগণ সাতিশয় দুঃখিত হইয়া অশ্রুমোচন করিতে লাগিলেন। তদনন্তর ভীষ্ম, বিদুর, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, ষুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা ও অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ এবং সমস্ত কৌরব-বনিতাগণ একত্র হইয়া ক্রন্দন করিতে করিতে মহারাজ পাণ্ডুর উদকক্রিয়া (প্রেততর্পণ) সম্পাদন করিলেন। উদককার্য্য সমাপন হইলে রাজ্যস্থ প্রজাগণ পিতৃশোকবিমূঢ় পাণ্ডবগণকে অশেষ-প্রকারে সান্ত্বনা করিতে লাগিল। পাণ্ডবগণ শোকে অধীর হইয়া সবান্ধবে ভূতলে শয়ন করিলেন, নগরবাসী ব্রাহ্মণাদি বর্ণেরাও ভূমিশয্যায় শয়ান হইলেন। নগরবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা প্রভৃতি সকলেই সেই দিবসাবধি দশ দিন নিতান্ত নিরানন্দ ও শোকসাগরে নিমগ্ন রহিল।