করুণ বেহাগ
সিয়ারসোল রাজ স্কুলের শিক্ষক হরিশঙ্কর মিশ্র বিএ মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে ( ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ) নজরুল রচনা করেছিলেন 'করুণ-বেহাগ' শিরোনামে কবিতা রচনা করেছিলেন। এই শিক্ষকের বিদায়-অনুষ্ঠান কবে হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।
(ওগো) বিদায়-বেদনা-বিজড়িত এই সেদিনের সেই স্মৃতি
না মুছিতে হায় পুন জেগে ওঠে- জেগ জেগে ওঠে নিতি।
মুরছি মুরছি সেই মূর্ছনা-বিনায়ে করুণ সুরে,
হৃদি নিঙাড়িয়া রক্ত-অশ্রু বক্ষ বহিয়া ঝরে!
কিশোর দীর্ণ ভাঙা পঞ্জরে লুকাল জিয়ারি ক্ষীণ
শ্বসিয়া শ্বসিয়া উঠিছে গো আজি, কাঁপিছে মর্মবীণ
থামে না, হুদি-স্পন্দন ঘন দু'হাতে বক্ষ চাপি,
আকুলিবিকুলি দুরুদুরু ওগো থরথর ওঠে কাঁপি।
আজো সেদিনের করুণ গভীর রাগিণীটি বাজে বুকে
ওই অনুলোমে বিলোবে গো তবে উতল বাতাস মুখে।
ভেসে আসে কার ভগ্নবীণার চূর্ণ বিলাপ-গান?
কর্ণে পশিয়া মরম ছুঁইয়া আকুল করে গো প্রাণ !
মেশে নাই আজও (কাঁদিও না আর কাঁদায়ো না) ভাঙা গীতি,
বিদায়-বেদনা-বিজড়িত এই সেদিনের সেই স্মৃতি।
(আজি) ছাড়ি যান একজন,
ভাইরে বড়ই স্নেহের সে গুরু, বড় যতনের ধন!
আকাশের মতো উদার হৃদয় রাখি-পূর্ণিমা রাতে,
তারকার মতো অমনি অযুত গুণ যুথ ফোটা তাতে।
ঝষি-নিন্দিত সুন্দর মুখে স্লেহ-বিজড়িত হাস,
যূথির চেয়েও চিঠিটা পেলব, বোল বোল সম ভাষ!
কুঞ্চিত কালো কেশ আধ-ঢাকা কুঞ্চিত জোড়া ভুরু
চাঁদিমা-শুক্ল স্নিগ্ধ-কান্তি, পারুল চেয়েও চারু !
রুচির এ-সব স্মৃতির প্রীতি! যেয়ো না ভুলায়ে চলি,
পারিবে কি যেতে স্নেহের অযুত বাহু-বন্ধন খুলি?
যাও যদি ওগো লঙ্ঘিতে হবে শিশুর আঁসুর স্রোত,
পারিবে কি? তবে যাও দেব, আর রুখিব না তব পথ !
বক্ষ চিরিয়া রুধির-রক্ত কলিজা টানিয়া মুখে
দাঁড়াই যদি গো পথ আগুলিয়া, চাপি অঞ্চল চোখে,
চলে যেতে পারো? চলে যাও, দেব ! কিছু বলিব না আর,
হাসিতে হাসিতে ঢেলে দেব শিরে প্রাণের অধ্যভার !
বনফুলহার দেবতার গলে সাজিবে না ওগো ভালো,
আনিয়াছি তাই মন-ফুলে ছোট সাজিখানি করি আলো।
কি দিব গো আর, কি দেবার আছে, আমরা বড়ই দীন,
বিনা এ হৃদির করুণ গভীর আসার-বিন্দু তিন!
একটি মিনতি, নূতনের মাঝে ভুলি চির পুরাতন
দিয়ো নাকো ব্যথা দরদের বুকে ! বিশেষ আকিঞ্চন!
নে ভাই চক্ষে বসন চাপিয়া, অথবা উপাড়ি দে,
চলে যান আজি মোদের একটি শ্রেষ্ঠ গুরু যে রে!
নে ভাই চক্ষে বসন চাপিয়া অথবা উপাড়ি দে!!