করুণ গাথা
সিয়ারসোল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষক: বাবু ভোলানাথ স্বর্ণকার বি.এ. মহাশয়ের
বিদায়-উপলক্ষে, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জুলাই (বৃহস্পতিবার ২৯ আষাঢ় ১৩২৪) নজরুল
ইসলাম তাঁর স্বরচিত এই পত্রটি পাঠ করেছিলেন। এই সময় নজরুল এই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
নয়ন গলিয়া বয় তপ্ত অশ্রুনীর,
অশ্রু নয়, সে যে ভগ্ন মরম-রুধির।
নয় গো চোখের দেখা হৃদয়ে হৃদয়ে আঁকা
ভিজায়ে সেনেহ-ক্ষীরে তুষিত সোহাগভরে
ভকতি উথলি চিত করিত অধীর
মিহির-কিরণে ওগো শুষিল শিশির।
জলদি শুকায়ে যাও অনিল বয়ো না,
বসিয়া তমাল ডালে পাপিয়া গেয়ো না।
নিঝুম নিঝুম সব, থেমে যাক কলরব,
থামুক শিশুর হাসি, গোলোকে বেজো না বাঁশি,
সেনেহ মমতা আর ধরায় রয়ো না।
অপত্য পিতার কোলে যেয়ো না যেয়ো না।
রুদ্ধ বেদনা গো ছুটিছে মথিয়া হিয়া
কাঁদিতে জনম, মোরা কাটাব কাঁদিয়া।
সন্তানে ফেলিয়া পিতা, কখন যায় কি কোথা?
দিব না দিব না যেতে, কাঁদিয়া দাঁড়াব পথে;
দেখিব কেমনে যায় মোদের ঠেলিয়া;
হৃদয় বিদীর্ণ হও মরম চাপিয়া।
ললাটে লিখনবিধি এত কি কঠোর,
নিমেষে ছিঁডিয়া ফেলে দৃঢ় স্নেহ-ডোর।
কল্পিয়া কতই আশা, বাঁধিনু সুখের বাসা
সহসা বহিল বায়, কোথায় উড়িয়া যায়,
সে বাসা; নিরাশা শুধু হেরি এবে ঘোর।
সাধ না মিটিতে হলো সুখনিশি ভোর।
এতই উদার তুমি তরুণ বয়সে,
হৃদয় গলিয়া যেত মমতা পরশে।
সুধীকুল শিরোমণি, সেনেহ হীরক-খনি,
অটল করম-ক্ষেত্রে করুণা খেলিছে নেত্রে,
কর্তব্য সাধনে বীর বীর সু-সাহসে;-
ভোলানাথ! যেয়ো না গো ত্যজি এ কৈলাসে।
সকলি ভুলিব কালে, রহিবে কীরিতি,
তোমার মহিমা গাথা গাউক ভারতী !
ধাও গো উন্নতি পথে চড়িয়া কীরিতি-রথে,
বরষি বিমল যশ ধরার কলুষ নাশ,
হও আঁধারে চির ইরম্মদ জ্যোতি-
তোমার রুচির বাসে মাতৃক এ-ক্ষিতি।
লাবণ্য শুকাল আজ সকলি ফুরাল,-
মঞ্জু-কুঞ্জবনে কলি ঝরিয়া পড়িল
আড়ালে লুকাল চাঁদ, ধৈরয ভাঙিল বাধ,
থামিল সাগর জল, উড়ে গেল পরিমল;
ক্ষণপ্রভা হেসে কোথায় লুকাল।
সাধ না মিটিল হায়, আশা না পুরিল।
মধুর স্বপন ভাঙি স্তব্ধ নিশীথে
করুণ বিলাপ গান গাহিল বাঁশিতে
উঠ রে বালকদল মুছিয়া আঁখির জল
করে নে বরণ-ডালা দে গলে পরিয়ে মালা
চরণ ঢাকিয়ে দে রেপ্রসূনরাশিতে ;
পাবি নাআর যে কভু এ ভালোবাসিতে।