প্রতিভাষণ
[১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর মোতাবেক ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ১৯শে অগ্রহায়ণ রবিবার
কলিকাতা এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু মুসলমানের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে
বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতা সহকারে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সংবর্ধনা-সভার সভাপতি
বিজ্ঞানাচার্য শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অভিভাষণের পর জাতির পক্ষ থেকে 'নজরুল-সংবর্ধনা
সমিতির সভ্যবৃন্দ কবিকে একটি মানপত্র প্রদান করেন। সভায় মানপত্রটি পাঠ করেন মি. এস. ওয়াজেদ
আলি। অভিনন্দনের উত্তরে কবি নিম্নলিখিত 'প্রতিভাষণ', দান করেন। কির প্রত্যুত্তরের পর
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু আবেগোচ্ছ্বল কণ্ঠে কবির স্বদেশী-সঙ্গীত ও দেশাত্ববোধমূলক কবিতার
প্রশংসা করে এক বক্তৃতা দেন।]
বন্ধুগণ!
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম।
আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটিমাত্র সুর
ধ্বনিত হয়ে উঠছে, আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম।
এক-বন ফুল মাথা পেতে নেবার মতো হয়তো মাথায় আমার চুলের অভাব নেই,
কিন্তু এত হৃদয়ের এত প্রীতি গ্রহণ করি কী দিয়ে? আমার হৃদয়-ঘট যে ভরে উঠলো !
নদীর জল মঙ্গল অভিষেকের ঘটে বন্দি হয়ে তার ভাষা হারিয়েছে। আজ যদি
আমি কিছু বলতে না পারি, আপনারা আমার সে অক্ষমতাকে ক্ষমা করবেন। আমি যে-
নদীর জলধারা, সেই নদীকুলে যাবেন আপনারা, তবে না চাইতেই আমার ভাষা, আমার গান সেখানে শুনতে পাবেন।
আজ বলবার দিন আপনাদেরই, আমার নয়। তাছাড়া, আপনাদের ভালোবাসার অতিশয়োক্তিকে অন্তত আজকের
দিনে যে হারিয়ে দিতে পারব, সে ভরসা আমার নেই।
আজ আমার ভাষা শুভদৃষ্টির বধূর মতো লাজকুণ্ঠিতা এবং অবগুণ্ঠিতা। সে যদি নাচুনে
মেয়েই হয়, অন্তত আজকের দিনে তাকে নাচতে বলবেন না।
আজ হয়তো সত্যি-সত্যিই আমার অভিনন্দন হয়ে গেল। এ শুধু আপনাদের-
যাঁরা এ-সভায় এসেছেন ফুলের সওগাত নিয়ে, তাঁদের বলছিনে। আমি নেপথ্যের সেই
বড় বন্ধুদের কথা বলছি, যাঁরা এখানে না এলেও আমার কথা ভুলতে পারছেন না এবং
হয়তো একটু বেশি করেই স্মরণ করছেন,- ফুল-ফোটানোর চেয়ে হুল-ফোটানোতেই
যাঁদের আনন্দ !
ও-দিক দিয়ে আমার ভাগ্যলক্ষ্মী সত্যিই একটু বেশি রকমের প্রসন্ন । যাঁরা আমার
বন্ধু, তাঁরা যেমন সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমায় ভালোবাসেন, যাঁরা বন্ধুর উল্টো. তাঁরা তেমনি
চুটিয়ে বিপক্ষতা করেন। ওতে আমি সত্যি-সত্যিই আনন্দ উপভোগ করি। পানসে
বন্ধুত্বের চেয়ে চুটিয়ে শত্রুতা ঢের ভালো। বড় বন্ধুত্ব আর বড় শত্রুতা বেশ বাগসই
করে জড়িয়ে ধরতে না পারলে হয় না। যিনি আমার হৃদয়ের এত কাছাকাছি থাকেন, তিনি
আমার নিশ্চয়ই পরম অথবা চরম আত্মীয়। আজকের দিনে তাঁদেরও আমার অন্তরের
শ্রদ্ধা-নমস্কার নিবেদন করছি।
আমার বন্ধুরা যেমন পাল্লার একধারে প্রশংসার পর প্রশংসার ফুলপাতা চড়িয়েছেন,
অন্য পাল্লায় অ-বন্ধুর দল তেমনি নিন্দার ধুলো-বালি-কাদামাটি চড়িয়েছেন, এবং এ
দুই তরফের সুবিবেচনার ফলে দুই ধারের পাল্লা এমন সমভার হয়ে উঠেছে যে, মাঝে
থেকে আমি ঠিক থেকে গেছি, এতটুকু টলতে হয়নি।
আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের
ভালো লেগেছে। সেই 'ভালো লেগেছে'-টাকে ভালো করে বলতে পারার এই উৎসবে
আমার একটিমাত্র করণীয় কাজ আছে, সে হচ্ছে সবিনয়ে সুস্মিত মুখে সশ্রদ্ধ প্রতি-
নমস্কার নিবেদন করা। আমার কাছে আজ সেইটুকুই গ্রহণ করে মুক্তি দিন। আমাকে
বড়-বলার বড়-বলি করবেন না। সভার যূপকাষ্ঠে বলি হবার ভয়েই আমি সভার এবং
সবার অন্তরালে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমি পলাতক বলেই যদি আমায় ধরে এনে শাস্তির
ব্যবস্থা করে থাকেন, তাহলে আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে, প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে
কলঙ্কী চাঁদকে ধরে এনে তাঁকে যথেষ্ট লজ্জা দিয়েছেন।
শুধু লেখা দিয়ে নয়, আমায় দিয়ে যাঁরা আমায় চেনেন, অন্তত তাঁরা জানেন যে,
সত্যি-সত্যিই আমি ভালো মানুষ। কোনো অনাসৃষ্টি করতে আসিনি আমি। আমি
যেখানে ঘা দিয়েছি, সেখানে ঘা খাবার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল।
পড়-পড় বাড়িটাকে কর্পোরেশনের যে-কর্মচারী এসে ভেঙে দেয়, অন্যায় তার নয়,
অন্যায় তার যে এ পড়-পড় বাড়িটাকে পুষে রেখে আরো দশজনের প্রাণনাশের ব্যবস্থা
করে রাখে।
আমাকে “বিদ্রোহী” বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ
নিরীহ জাতিটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনো দিনউ নেই।
তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরণ তাদের তাড়া করে নিয়ে ফিরছে। আমি
অতে এক-আংটু সাহায্য করেছি মাত্র।
এ-কথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে, আমি শক্তি-সুন্দর রূপ-
সুন্দরকে ছাড়িয়ে আজো উঠতে পারিনি। সুন্দরের ধেয়ানী দুলাল কিটসের মতো আমারও
মন্ত্র-'Beauty is truth is beauty'।
আমি যেটুকু দান করেছি, তাতে কার কতটুকু ক্ষুধা মিটেছে জানিনে ; কিন্ত আমি
জানি, আমাকে পরিপূর্ণরপে আজো দিতে পারিনি, আমার দেবার ক্ষুধা আজো
মেটেনি। যে উচ্চ গিরি-শিখরের পলাতকা সাগর-সন্ধানী জলস্রোত আমি, সেই গিরি-
শিখরের মহিমাকে যেন খর্ব না করি। যেন মরুপথে পথ না হারাই। এই আশীর্বাদ
আপনারা করুন।
বিংশ-শতাব্দীর অসন্তবের সম্ভাবনার যুগে আমি
জন্মগ্রহণ করেছি। এরই
অভিযান-সেনাদলের তৃর্য-বাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড়
পরিচয়। আমি জানি, এই পথযাত্রার পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিলফণা ভূজঙ্গ প্রখর-
দর্শন শার্দুল পশুরাজের ভ্রূকুটি ! এবং তাদের নখর-দশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে
অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব।
ঈশান-কোণের যে কালো মেঘ পাহাড়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকে, তাকে অভিশাপ দেবেন
না তার তুষারঘন প্রশান্তি দেখে, নির্লিপ্ততা দেখে। ঝড়ের বাঁশি যেদিন বাজবে, ও
উন্মাদ সেদিন আপনি ছুটে আসবে তার পূর্ব-পরিচয় নিয়ে। নব-বসন্তের জন্য সারা শীতকাল
অপেক্ষা করে থাকতে হয়।
যাঁরা আমার নামে অভিযোগ করেন তাঁদের মতো হলুম না বলে, তাঁদেরকে
অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তাঁরা যেন সকলের করে
দেখেন। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই
নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার
উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে
আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি। বনের পাখি নীড়ের ঊর্ধের
উঠে গান করে বলে বন তাকে কোনোদিন অনুযোগ করে না। কোকিলকে অকৃতজ্ঞ ভেবে
কাক তাড়া করে বলে কোকিলের কাক হয়ে যাওয়াটাকে কেউই হয়তো সমর্থন করবেন
না। আমি যেটুকু দিতে পারি, সেইটুকুই প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করুন। আমগাছকে চৌ-
মাথায় দাঁড় করিয়ে বেধে যতই ঠেঙান, সে কিছুতেই প্রয়োজনের কাঠাল ফলাতে পারবে
না। উল্টো এ ঠ্যাঙানি খেয়ে তার আম ফলাবার শক্তিটাও যাবে লোপ পেয়ে।
যৌবনের রক্ত-শিখা মশাল ধরে মৃত্যুর অবগুণ্ঠন মোচন করতে চলেছে যে বরযাত্রী,
আমি তাদের সহযাত্রী নই বলে যাঁরা অনুযোগ করেন, তাঁরা জানেন না__আমিও
আছি তাঁদের দলে; তবে হাতের মশাল হয়ে নয়, কণ্ঠের কৃষ্ঠাহীন গান হয়ে।
ফুল-মেলার নওরোজে আমায় খরিদদাররূপে না দেখতে পেয়ে যাঁরা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন,
তাঁদেরও বলি, আমার ভাবী তাজমহলের ধ্যানমূর্তি আজো পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি।
যেদিন উঠবে সেদিন আমিও আসব ঐ মেলায় শাহজাদা খুররমের মতোই আমার চোখে
তাজের স্বপ্ন নিয়ে।
আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা
জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাঁকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত
পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকৃপে তাঁকে
দেখেছি, ফাসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ
করে দেখার স্তব-স্তুতি।
কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই
নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা
করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে-হাত মিলানো
যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে,
আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের
হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি। ...
বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে ধুলো-বালি, এত, ধোঁয়া, এত কোলাহল উঠেছে যে,
ওর মাঝে সামান্য দীপবর্তিকা নিয়ে পথ খুজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে,
আমিও মরব।
কিন্তু এ যদি বেদনা-সাগর মন্থনের হলাহলই হয় তা হলে ঐ সমুদ্র-মন্থনের
সব দোষ অসুরদেরই নয়, অর্ধেক দোষ এর দেবতাদের। তাঁদের সাহায্য ছাড়া
তো এ সমুদ্র-মন্থন-ব্যাপার সহজ হত না। তবু তাঁদের বলি, আজকের
হলাহলটাই সত্য নয়, অসহিষ্ণু হবেন না দেবতা- র'সে খান, অমৃত আছে, সে
উঠল বলে।
আমি আবার আপনাদের আমার সমস্ত অন্তরের শ্রদ্ধা-প্রীতি-নমস্কার জানাচ্ছি।
আমি ধন্য করতে আসিনি, ধন্য হতে এসেছি আজ । আপনাদের আমার
অজস্র ধন্যবাদ।