বাঁধন হারা ঘ শাহ্পুর ভাই সোফি! বাহা রে! চিঠিটা শেষ না করেই দেখচি দিব্যি
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ... তোর ‘কলমিলতা’- পুনশ্চ – সালার সই মাহ্বুবা! তোর ‘সজনে ফুল’ করাচি সেনানিবাস ভাবি সাহেবা! নরপিশাচ –
উপন্যাস
কাজী নজরুল ইসলাম
১০ই ফাল্গুন
(নিঝুম রাত্তির)
অভিমানিনী, তুমি হয়তো এতদিনে আমার ওপর রাগ করে ভুরু কুঁচকে,
ঠোঁট ফুলিয়ে, গুম হয়ে বসে আছ! কারণ আমি আসবার দিনে তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি
করেছিলাম যে গিয়েই চিঠি দেব। আমার এত বড়ো একটা চুক্তির কথা আমি ভুলিনি ভাই, কিন্তু
নানান কারণে, বারো জঞ্জালে পড়ে আমায় এরকমভাবে খেলো হয়ে পড়তে হল তোমার কাছে।
সোজাভাবেই সব কথা বলি – এখানে পৌঁছেই বোন, আমার যত কিছু যেন ওলট পালট হয়ে গেছে, কী
এক-বুক অসোয়াস্তি যেন বেরোবার পথ না পেয়ে শুধু আমার বুক-জোড়া পাঁজরের প্রাচীরে ঘা
দিয়ে বেড়াচ্চে। কদিন থেকে মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরচে আর মনে হচ্চে, সেই সঙ্গে যেন
দুনিয়ার যতকিছু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন এক রকম কান্না কাঁদচে, আর সেই অকরুণ কান্নার
যতির মাঝে মাঝে একটা নির্মম জিনের কাঠ-চোটা বিকট হাসি উঠচে হো – হো – হো! সামনে তার
নিঝুম গোরস্থানের মতো ‘সুম-সাম’ হয়ে পড়ে রয়েচে আমাদের পোড়ো-বাড়িটা। তারই জীর্ণ
দেয়ালে অন্ধকারের চেয়েও কালো একটা দাঁড়কাক বীভৎস গলাভাঙা স্বরে কাতরাচ্চে, ‘খাঁ –
আঃ! – আঃ!’ দুপুর রোদ্দুরকে ব্যথিয়ে ব্যথিয়ে তারই পাশের বাজ-পড়া অশথ গাছটায় একটা
ঘুঘু করুণ-কণ্ঠে কূজন কান্না কাঁদচে, ‘এসো খুকু – উ – উ- উঃ!’ বাদলের জুলুমে আমাদের
অনেক দিনের অনেক স্মৃতি-বিজড়িত মাটির ঘরটা গলে গলে পড়চে, – দেখতে দেখতে সেটা একটা
নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেল – চারিধারে তার তেশিরে কাঁটা, মাঝে চিড়চিড়ে, আকন্দ,
বোয়ান এবং আরো কত কী কাঁটাগুল্মের ঝোপ-ঝাড়ু তাদের আশ্রয় করে ঘর বেঁধেচে বিছে, কেউটে
সাপ, শিয়াল, খটাস, – ওঃ, আমার মাথা ঘুরচে, আর ভাবতে পারচিনে!... যখন মাথাটা বড্ড দপ
দপ করতে থাকে আর তারই সঙ্গে এই বীরভূমের একচেটে করে-নেওয়া ‘মেলেরে’ জ্বর (ম্যালেরিয়ার
আমি এই বাংলা নাম দিচ্চি!) হু-হু করে আসে, তখন ঠিক এই রকমের সব হাজার এলোমেলো বিশ্রী
চিন্তা ছায়াচিত্রের মতো একটার পর একটা মনের ওপর দিয়ে চলে যায়! আজ তাই ভাই সোফিয়া
রে! বড়ো দুঃখেই বাবাজিকে মনে করে শুধু কাঁদচি – আর কাঁদচি! খোদা যদি অমন করে, তাঁকে
আমাদের মস্ত দুর্দিনের দিনে ওপারে ডেকে না নিতেন, তা হলে কি আজ আমাদের এমন করে
বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পরের গলগ্রহ হয়ে ‘অন্হেলা’র ভাত গিলতে হত বোন? আজ এই
নিশীথ-রাতে স্তব্ধ মৌন-প্রকৃতির বুকে একা জেগে আমি তাই খোদাকে জিজ্ঞাসা করচি –
নিঃসহায় বিহগ-শাবকের ছোট্ট নীড়খানি দুরন্ত বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর কী লাভ? ‘পাক’
তিনি, তবে একী পৈশাচিক আনন্দ রয়েচে তাঁহাতে? হায় বোন, কে বলে দেবে সে কথা?
তুই হয়তো আমার এসব ‘পাকামো’ ‘বুড়োমি’ শুনে ঝংকার দিয়ে উঠবি,
“মাগো মা! এত কথাও আসে এই পনেরো ষোলো বছরের ছুঁড়ির! যেন সাতকালের বুড়ি আর কি!”
কিন্তু ভাই, যাদের ছেলেবেলা হতেই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে মানুষ হতে হয়, যাদের জন্ম
হতেই টাল খেয়ে খেয়ে, চোট খেয়ে খেয়ে বড়ো হতে হয়, তারা এই বয়সেই এতটা বেশি গম্ভীর আর
ভাবপ্রবণ হয়ে ওঠে যে, অনেকের চোখে সেটা একটা অস্বাভাবিক রকমের বাড়াবাড়ি বলেই দেখায়।
অতএব যে জিনিসটা জীবনের ভেতর দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করিসনি,
সেটাকে সমালোচনা করতে যাস নে যেন। যাক ওসব কথা। ...
মা তাঁর বাপের বাড়ি বলে এখানে এসে এখন নতুন নতুন বেশ খুশিতেই
আছেন। আমি জানি, তাঁর এ হাসি-খুশি বেশিদিন টিকবে না। তবুও কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না।
আমার মনে সুখ নেই বলে অন্যকেও কেন তার ভাগী করব? তাছাড়া চির-দুঃখিনী মা আমার যদি
তাঁর শোকসন্তপ্ত প্রাণে এই একটুখানি পাওয়া সান্ত্বনার স্নিগ্ধ প্রলেপ শুধু
একটুক্ষণের জন্যেও পান, তবে তাঁর, মেয়ে হয়ে কোন্ প্রাণে তাঁকে সে আনন্দ হতে বঞ্চিত
করব? এ-ভুল তো দু-দিন পরে ভাঙবেই আপনি হতে! – আর এক কথা, মায়ের খুশি হবার অধিকার আছে
এখানে, কেননা এটা তাঁর বাপের বাড়ি। আর তারই উলটো কারণে হয়েচে আমার মনে কষ্ট। অবশ্য
আমিও নতুন জায়গায় (তাতে মামার বাড়ি) আসার ক্ষণিক আনন্দ প্রথম দু-একদিন অন্তরে অনুভব
করেছিলাম, কিন্তু ক্রমেই এখন সে আনন্দের তীব্রতা কর্পূরের উবে যাওয়ার মতো বড়ো
সত্বরই উবে যাচ্ছে। হোক না মামার বাড়ি, তাই বলে যে সেখানে বাবার বাড়ির মতো
দাবি-দাওয়া চলবে, এ তো হতে পারে না। মানি, মামার বাড়ি ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয় আর
লোভনীয় স্থান, কিন্তু যদি স্রেফ দু-চার দিনের মেহ্মান হয়ে শুভ পদার্পণ হয় সেখানে।
যাঁরা মামার বাড়িতে স্থায়ী বন্দোবস্ত করে বা একটু বেশিদিনের জন্যে থেকেচেন, তাঁরাই
একথার সারবত্তা বুঝতে পারবেন। অতিথিস্বরূপ দু-একদিন থেকে যাওয়াই সঙ্গত কুটুম বাড়িতে।
আমি এখানে অতিথি মানে বুঝি যাঁদের স্থিতি বড়ো জোর এক তিথির বেশি হয় না। যিনি অতিথির
এই বাক্যগত অর্থের প্রতি সম্মান না রেখে শার্দুলের লুব্ধা মাতৃষ্বসার মতো আর নড়তেই
চান না, তিনি তো স-তিথি। আর, তাঁর ভাগ্যে সম্মানও ওই বাঘের মাসি বিড়ালের মতো চাটু
আর হাতার বাড়ি, চেলাকাঠের ধুমসুনী! এঁরাই আবার অর্ধচন্দ্র পেয়ে চৌকাঠের বাইরে এসে,
আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি দেখিয়ে বেইজ্জতির অজুহাতে চক্ষু দুটো উষ্ণ কটাহের মতো গরম করে
গৃহস্বামীর ছোটোলোকত্বের কথা তারস্বরে যুক্তিপ্রমাণসহ দেখাতে থাকেন আর সঙ্গে সঙ্গে
ইজ্জতের কান্নাও কাঁদেন। আহা! লজ্জা করে না এসব বেহায়াদের? এ যেন ‘চুরি কে চুরি উলটো
সিনাজুরি!’ থাক এসব পরের ‘গিল্লে’ -চর্চা, এখন বুঝলি, মেয়েদের এই ‘ধান-ভানতে শিবের
গীত’ – এক কথা বলতে গিয়ে আরও সাত কথার অবতারণা করা আর গেল না। কথায় বলে ‘খস্লৎ যায়
মলে।’ – আমি বলছিলাম যে, আমার মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কেউ যদি মামাদের ঘাড়ে ভর করে
এসে বসে, তবে সেখানে সে বেচারির আবদার তো চলেই না, স্নেহ-আদরের ও দাবি-দাওয়ার একটা
সপ্রতিভ অসংকোচ আর্জিও পেশ করা যায় না। একটা বিষম সংকোচ, অপ্রতিভ হওয়ার ভয়, সেখানে
কালো মেঘের মতো এসে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। যার ভেতরে এতটুকু আত্মসম্মান-জ্ঞান আছে, সে
কখনই এরকমভাবে ছোটো আর অপমানিত হতে যাবে না। ওই কী বলে না, ‘আপনার ঢিপেয় কুকুর রাজা।’
কুকুরের স্বভাব হচ্ছে এই যে, যত বড়োই শত্রু হোক আর পেছন দিকে হাঁটবার সময় নেজুড় যতই
কেন নিভৃততম স্থানে সংলগ্ন করুক, যদি একবার যো-সো করে নিজের দরজার সামনে এসে
দাঁড়িয়েছে, তবে আর যায় কোথা! আরে বাপরে বাপ! অমনি তখন তার বুক সাহসের চোটে দশ হাত
ফুলে ওঠে। তাই তখন সে তার নেজুড় যতদূর সম্ভব খাড়া করে আমাদের মর্দ বাঙালি
পুরুষ-পুঙ্গবদেরই মতো তারস্বরে শত্রুকে যুদ্ধে আহ্বান করতে থাকে, কিন্তু সেই সঙ্গে
এটাও অবশ্যস্বীকার্য যে, এমন বীরত্ব দেখাবার সময়ও অন্তত অর্ধেক শরীর তার দোরের ভিতর
দিকেই থাকে আর ঘনঘন দেখতে থাকে যে, তাড়া করলে ‘খেঁচে হাওয়া’ দেওয়ার মতো লাইন
ক্লিয়ার আছে কিনা। এই সারমেয় গোষ্ঠীর মতো আমাদের দেশের পুরুষদেরও এখন দুটি মাত্র
অস্ত্র আছে, সে হচ্ছে ষাঁড় বিনিন্দিত কণ্ঠের গগনভেদী চিৎকার আর মূল্য-বিনিন্দিত বড়ো
বড়ো দন্তের পূর্ণ বিকাশ আর খিঁচুনি! তাই আমরা আজও মাত্র দুই জায়গায় বাঙালির
বীরত্বের চরম বিকাশ দেখতে পাই; এক হচ্চে, যখন এঁরা যাত্রার দলে ভীম সাজেন, আর দুই
হচ্চে, যখন এঁরা অন্দরমহলে এসে স্ত্রীকে ধুমসুনি দেন। হাঁ-হাঁ, আর এক জায়গায়, – যখন
এঁরা মাইকেলি ছন্দ আওড়ান!... আর এঁরা এসব যে করতে পারেন, তার একমাত্র কারণ, তাঁদের
সে সময় মস্ত একটা সান্ত্বনা থাকে যে, যতই করি না কেন, এ হচ্চে ‘হামারা আপনা ঘর!’
এইখানে আর একটা কথা বলে রাখি ভাই! আমার চিঠিতে এই যে কর্কশ
নির্মম রসিকতা নীরসতা আর হৃদয়হীন শ্লেষের ছাপ রয়েচে, এর জন্যে আমায় গালাগালি করিসনে
যেন। আমার মন এখন বড়ো তিক্ত – বড়ো নীরস –শুষ্ক। সেই সঙ্গে অব্যক্ত একটা ব্যথায় জান
শুধু ছটফট করচে। আর কাজেই আমার অন্তরের সেই নীরস তিক্ত ভাবটার ও হৃদয়হীন ব্যথার
ছটফটানির ছোপ আমার লেখাতে ফুটে উঠবেই উঠবে। – যতই চেষ্টা করি না কেন, সেটাকে
কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারব না। এরকম সকলের পক্ষেই স্বাভাবিক। এই দ্যাখ না, আমার মনে
যখন যে ভাব আসচে বিনা দ্বিধায় অনবরত লিখে চলেচি, – কোথাও সংযম নেই, বাঁধন নেই,
শৃঙ্খলা – ‘সিজিল’ কিচ্ছু নেই, – মন এতই অস্থির, মন এখন আমার এতই গোলমাল! –
হাঁ, মামার বাড়ির সকলে যেই জানতে পেরেচে যে, আমরা খাস-দখল নিয়ে
তাঁদের বাড়ি উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো জড় গেদে বসেছি, অমনি তাঁদের আদর আপ্যায়নের তোড়
দস্তুরমতো ঠান্ডা হয়ে গেছে! এটাও স্বাভাবিক। নতুন পাওয়ার আনন্দটা, নতুন পাওয়ার
জিনিসের আদর তত বেশি নিবিড় হয়, সেটা যত কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। কারণ, নতুন ও
হঠাৎ-পাওয়া আনন্দেরও একটা পরিমাণ আছে, আর সেই পরিমাণের তীব্রতাটা জিনিসের স্থিতির
কালানুযায়ী কম-বেশি হয়ে থাকে। যেটার স্থিতিকাল মাত্র একদিন, সে ওই আনন্দের সমগ্র
তীব্রতা ও উষ্ণতা একদিনেই পায়। যেটা দশদিন স্থায়ী, সে ওই সমগ্র আনন্দটা দশদিনে একটু
একটু করে পায়। আমি এখন এই কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে বুঝচি। কারণ, অন্য সময় যখন এখানে
এসেচি, তখন এই বাড়ির সকলে উন্মুক্ত হয়ে থাকত কীসে আমাদের খুশি রাখবে, দিন-রাত ধরে
এত বেশি আদর-সোহাগ ঠেসে দিত যে, তার কোথাও এতটুকু ফাঁক থাকবার জো ছিল না। তাই তখন
মামার বাড়ির নাম শুনলে আনন্দে নেচে উঠতাম। এখানে এসে দু-দিন পরে এখানটা ছেড়ে যেতেও
কত কষ্ট হত! মামানি, নানি, মামু, খালাদের কোল থেকে নামতে পেতাম না। গায়ে একটু আঁচড়
লাগলে অন্তত বিশ গন্ডা মুখে জোর সহানুভূতির ‘আহারে! ছেলে খুন হয়ে গেল!’ ইত্যাদি কথা
উচ্চারণ হত! তাই বলে মনে করিসনে যেন যে, আজও আমি তেমনি করে কোলে চড়ে বেড়াবার জন্যে
উসখুস করচি, এখন আমি আর সে কচি খুকি নই। এখানকার মেয়েমহলের মতে – একটা মস্ত থুবড়ো
ধাড়ি মেয়ে! এই রকম কত যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয় দিনের মাথায়, তার আর সংখ্যা নেই।
আর, যেখানকার পৌনে ষোলো আনা লোকের মুখে-চোখে একটা স্পষ্ট চাপা বিরক্তির ছাপ নানান
কথায় কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, সেখানে নিজেকে কতটুকু ছোটো করে রাখতে হয়, জানটা
কীরকম হাঁপিয়ে ওঠে সেখানে, ভাব দেখি! এই উপেক্ষার রাজভোগের চেয়ে যে ঘরের মাড়ভাত ভালো
বোন! মামুজিরা আমায় খুবই স্নেহ করেন, কিন্তু তাঁরা তো দিন-রাত্তির ঘরের কোণে বসে
থাকেন না যে সব কথা শুনবেন। আমার তিনটি মামানি তিন কেসেমের! তার ওপর আবার এক এক
জনের চাল এক এক রকমের। কেউ যান ছার্তকে, কেউ যান কদমে, কেউ যান দুলকি চালে। কথায়
কথায় টিপ্পনী, কিন্তু মামুজিদের ঘরে দেখলেই আমাদের প্রতি তাঁদের নাড়ির টান ভয়ানক
রকমের বেড়ে ওঠে, আমাদের পোড়া কপালের সমবেদনায় পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বা উনুনে কাঁচা
কাঠ দিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদেন! মামুজিরা বাইরে গেলেই আবার মনের ঝাল ঝেড়ে পূর্বের
ব্যবহারের সুদসুদ্ধ আদায় করে নেন। আমি তো ভাই ভয়েই শশব্যস্ত। তাঁদের এক একটা চাউনিতে
যেন আমার এক এক চুম্বন রক্ত শুকিয়ে যায় । দু-এক সময় মনে হয়, আর বরদাস্ত করতে পারিনে,
সকল কথা খুলে বলি মামুজিদের, তারপর আমাদের সেই ভাঙা কুঁড়েতেই ফিরে যাই। কিন্তু
এতটুকু টুঁ শব্দ করলেই অমনি রং-বেরঙের গলায় মিঠেকড়া প্রতিবাদ ঝংকার দিয়ে ওঠে। ঘরের
আণ্ডাবাচ্চা মায় বাড়ির ঝি পুঁটি বাগদি পর্যন্ত তখন আমার ওপর টীকা-টিপ্পনীর বাণ
বর্ষণ করতে আরম্ভ করেন। এঁদের সর্ববাদীসম্মত মত এই যে, থুবড়ো আইবুড়ো মেয়ের সাত চড়ে
রা বেরোবে না, কায়াটি তো নয়ই, ছায়াটি পর্যন্ত কেউ দেখতে পাবে না, গলার আওয়াজ
টেলিফোন যন্ত্রের মতো হবে, কেবল যাকে বলবে সেই শুনতে পাবে, – বাস্! খুব একটা বুড়োটে
ধরনের মিচকেমারা গম্ভীর হয়ে পড়তে হবে, থুবড়ো মেয়ে দাঁত বের করে হাসলে নাকি কাপাস
মহার্ঘ হয়! কোনো অলংকার তো নয়ই, কোনো ভালো জিনিসও ব্যবহার করতে বা ছুঁতেও পাবে না,
তাহলে যে বিয়ের সময় একদম ‘ছিরি’ (শ্রী) উঠবে না। ঘরের নিভৃততম কোণে ন্যাড়া বোঁচা
জড়-পুঁটুলি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে চুপসে বসে থাক! – এই রকম সে কত কথা ভাই, ওসব বারো
‘ভজকট’ আমার ছাই মনেও থাকে না আর শুনতে শুনতে কানও ভোঁতা হয়ে গেছে। ‘কান করেচি ঢোল,
কত বলবি বোল!’ তাছাড়া একথা অন্যকে বলেই বা কী হবে? কেই বা শুনবে আর কারই বা মাথা
ব্যথা হয়েচে আমাদের পোড়াকপালিদের কথা শুনতে! খোদা আমাদের মেয়ে জাতটাকে দুঃখ-কষ্ট
সহ্য করতেই পাঠিয়েছেন, আমাদের হাত-পা যেন পিঠমোড়া করে বাঁধা, নিজে কিছু বলবার বা
কইবার হুকুম নেই। খোদা-না-খাস্তা একটু ঠোঁট নড়লেই মহাভারত অশুদ্ধ আর কী! কাজেই, আছে
আমাদের শুধু অদৃষ্টবাদ, সব দোষ চাপাই নন্দ-ঘোষস্বরূপ অদৃষ্টেরই ওপর! সেই মান্ধাতার
আমলের পুরোনো মামুলি কথা, কিন্তু অদৃষ্ট বেচারা নিজেই আজতক অ-দৃষ্ট! ... আমাদের
কর্ণধার মর্দরা কর্ণ ধরে যা করান তাই করি, যা বলান তাই বলি! আমাদের নিজের ইচ্ছায়
করবার বা ভাববার মতো কিছুই যেন পয়দা হয়নি দুনিয়ায় এখনও – কারণ আমরা যে খালি
রক্ত-মাংসের পিণ্ড! ভাত রেঁধে, ছেলে মানুষ করে আর পুরুষ দেবতাদের শ্রীচরণ সেবা করেই
আমাদের কর্তব্যের দৌড় খতম! বাবা আদমের কাল থেকে ইস্তকনাগাদ নাকি আমরা ওই
দাসীবৃত্তিই করে আসচি, কারণ হজরত আদমের বাম পায়ের হাড্ডি হতে প্রথম মেয়ের উৎপত্তি।
বাপরে বাপ! আজ সেই কথা টলবে? এসব কথা মুখে আনলেও নাকি জিভ খসে পড়ে। কোন্ কেতাবে নাকি
লেখা আছে, পুরুষদের পায়ের নীচে বেহেশ্ত, আর সেসব কেতাব ও আইন-কানুনের রচয়িতা পুরুষ!...দুনিয়ার
কোনো ধর্মই আমাদের মতো নারীজাতিকে এতটা শ্রদ্ধা দেখায়নি, এত উচ্চ আসনও দেয়নি, কিন্তু
এদেশের দেখাদেখি আমাদের রীতি-নীতিও ভয়ানক সংকীর্ণতা আর গোঁড়ামি ভণ্ডামিতে ভরে উঠেচে।
হাতে কলমে না করে শুধু শাস্ত্রের দোহাই পাড়লেই কি সব হয়ে গেল?
আর শুধু পুরুষদেরই বা বলি কেন, আমাদের মেয়েজাতটাও নেহাত ছোটো হয়ে
গেছে, এদের মন আবার আরও হাজার কেসেমের বেখাপ্পা বেয়াড়া আচার-বিচারে ভরা, যার কোনো
মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই! এই ধর না এই বাড়িরই কথা। ভয়ানক অন্যায় আর অত্যাচার যেটা,
চির-অভ্যাস মতো সেটার বিরুদ্ধে একটু উচ্চবাচ্য করতে গেলেই অমনি গুষ্টিসুদ্ধ মেয়ে
দঙ্গল আমার ওপর ‘মারমূর্তি’ হয়ে উঠবে আর গলা ফেড়ে চেঁচিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলবে, –
“মাগো মা, মেয়ে নয় যেন সিংগিচড়া ধিঙ্গি! এ যে জাঁদরেল জাহাঁবাজ মরদের কাঁধে চড়ে যায়
মা! আমরা তো দেখে আসচি, সাত চড়ে থুবড়ো মেয়ের রা বেরোয় না, আর আজকালকার এই কলিকালের
কচি ছুঁড়িগুলো – যাদের মুখ টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, তাদের কিনা সবতাতেই মোড়লি সাওকুড়ি
আবার মুখের ওপর চোপা! মুখ ধরে পুঁয়ে মাছের মতো রগড়ে দিতে হয়, তবে না থোঁতা মুখ ভোঁতা
হয়ে যায়! আমাদেরও বয়েস ছিল গো, আজ নয়তো বুড়ি হয়েছি, কই বলুক তো, কে বাপের বেটি আছে,
– ছায়াটি পর্যন্ত দেখতে পেয়েছে! তাতে আর কাজ নেই! একটু জোরে কাশলেও যেন শরমে শরমে
মরে যেতাম, আর এখনকার ‘খলিফা’ মেয়েদের কথায় কথায় ফোঁপরদালালি, – যেন, অজবুড়ি! যত
বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা!”...সময় কাটবে বলে ভাবিজির কাছ হতে দু-চারটে বই আর মাসিকপত্র
সঙ্গে এনেচি, এই না দেখে এরা তো আর বাঁচে না! গালে হাত দিয়ে কতরকমেরই না অঙ্গভঙ্গি
করে জানায় যে, রোজকেয়ামত এইবারে একদম নিকটে! একটু পড়তে বসলে চারিদিক থেকে ছেলেমেয়ে
বুড়িরা সব উঁকি মেরে দেখবে আর ফিসফিস করে কত কী যে বলবে তার ইয়ত্তা নেই। আমি নাকি
আমার বিদ্যে জাহির করতে তাদের দেখিয়ে বই পড়ি, তাই তারা রটনা করেচে যে, আমি দু-দিন
বাদে মাথায় পাগড়ি বেঁধে কাছা মেরে জজ ম্যাজিস্টর হয়ে য়্যা চেয়ারে বসব গিয়ে! আমি তো
এদের বলবার ধরন দেখে আর হেসে বাঁচিনে! মেয়েদের চিঠি লেখা শুনলে তো এরা যেন আকাশ থেকে
পড়ে! মাত্র নাকি এই কলিকাল, এরা বেঁচে থাকলে কালে আরও কত কী তাজ্জব ব্যাপার চাক্ষুষ
দেখবেন! তবে এঁরা যে আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এই একটা মস্ত সান্ত্বনার কথা! আমাদের
এই ধিঙ্গি মেমগুলোই নাকি এদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে; এইসব ভেবে ভেবে ওদের
রাত্তির বেলায় ভালো করে নিদ হয় না, আর তারই জন্যে তাদের অনেকেরই চোখে ‘গোগাল’ পড়ে
গেছে!...এই রকম সব অফুরন্ত মজার কথা – যেসব লিখতে গেলে আর একটা ‘গাজি মিয়াঁর বস্তানি’
না মধু মিয়াঁর দফতর হয়ে যাবে! তবু এতগুলো কথা তোকে জানিয়ে আমি আমার মনটা অনেক হালকা
করে নিলাম। আমার শুধু ইচ্ছে করচে, তোর সঙ্গে বসে তিনদিন ধরে এদের আরো কত কী মজার
গল্প নিয়ে আলোচনা করি, তবে আমার সাধ মেটে! তাই যা মনে আসচে, যতক্ষণ পারি লিখে যাই
তো! কেননা, জানি না আবার কখন কতদিন পরে এঁদের চক্ষু এড়িয়ে তোকে চিঠি লিখতে পারব।
এখনও মনের মাঝে আমার লাখো কথা জমে রইল। ডাকে চিঠি দিলাম না, তাহলে তো লঙ্কাকাণ্ড
বেধে যেত! তাই এই পত্রবাহিকা এলোকেশী বাগদির মারফতেই খুব চুপি চুপি চিঠিটা পাঠালাম।
আমাদের গাঁয়ের ও পাড়ার মালকা বিবিকে মনে আছে তোর? ইনি সেই ‘পাড়া-কুঁদুলি মালকা’ যিনি
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মেয়েদের সাথে ছেলেবেলায় কোঁদল করে বেড়াতেন। আমার এক মামাতো ভাইয়ের
সাথে এঁর বিয়ে হয়েচে, তুই তো সব জানিস। এঁর ভাইয়ের নাকি বড্ড ব্যামো, তাই এলোকেশী
ঝিকে খবর নিতে পাঠাচ্ছেন। তাঁকে বলেই এই চিঠিটা এমন লুকিয়ে পাঠাতে পারলাম! মালকা
প্রায়ই আমার কাছে এসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে, আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বেচারি এখন
বড্ড শায়েস্তা হয়ে গেচে। তার মস্ত বড়ো সংসারের মস্ত ভার ওই বেচারির একা ঘাড়ে। ...চিঠিটা
যত বড়োই হোক না কেন, আমি আজ আমার জমানো সব কথা জানিয়ে তবে ছাড়ব। দশ ফর্দ চিঠি দেখে
হাসিসনে, বা ফেলে দিসনে যেন। এই চিঠি লিখতে বসে আর লিখে কী যে আরাম পাচ্চি, সে আর
কী বলব! আমার মনের চক্ষে এখন তোর মূর্তিটি ঠিক ঠিক ভেসে উঠছে।
সত্যি বলতে কী ভাই, – রাত্তির-দিন এই দাঁত-খিঁচুনি আর চিবিয়ে
চিবিয়ে গঞ্জনা দেখে শুনে এই সোজা লোকগুলোর ওপর বিরক্তি আসে বটে, তবে ঘেন্না ধরেনি।
এদের দেখে মানুষের দয়া হওয়াই উচিত! এর জন্য দায়ী কে? – পুরুষরাই তো আমাদের মধ্যে
এইসব সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি ঢুকিয়ে দিয়েচেন। এমন কেউ কি নেই আমাদের ভেতর যিনি এইসব
পুরুষদের বুঝিয়ে দেবেন যে, আমরা অসূর্যম্পশ্যা বা হেরেম-জেলের বন্দিনী হলেও নিতান্ত
চোর-দায়ে ধরা পড়িনি। অন্তত পর্দার ভিতরেও একটু নড়ে চড়ে বেড়াবার দখল হতে খারিজ হয়ে
যাইনি। আমাদেরও শরীর-রক্ত-মাংসে গড়া; আমাদের অনুভবশক্তি, প্রাণ, আত্মা সব আছে। আর
তা বিলকুল ভোঁতা হয়ে যায়নি। আজকাল অনেক যুবকই নাকি উচ্চশিক্ষা পাচ্চেন, কিন্তু আমি
একে উচ্চ শিক্ষা না বলে লেখাপড়া শিখচেন বলাই বেশি সঙ্গত মনে করি। কেননা, এঁরা যত
শিক্ষিত হচ্ছেন, ততই যেন আমাদের দিকে অবজ্ঞার হেকারতের দৃষ্টিতে দেখচেন, আমাদের মেয়ে
জাতের ওপর দিন দিন তাঁদের রোখ চড়েই যাচ্চে। তাঁরা মহিষের মতো গোঙানি আরম্ভ করে
দিলেও কোনো কসুর হয় না, কিন্তু দৈবাৎ যদি আমাদের আওয়াজটা একটু বেমোলায়েম হয়ে
অন্তঃপুরের প্রাচীন ডিঙিয়ে পড়ে, তাহলে তাঁরা প্রচণ্ড হুংকারে আমাদের চৌদ্দ পুরুষের
উদ্ধার করেন। ওঁদের যে সাত খুন মাফ! হায়! কে বলে দেবে এঁদের যে, আমাদেরও স্বাধীনভাবে
দুটো কথা বলবার ইচ্ছে হয় আর অধিকারও আছে, আমরাও ভালমন্দ বিচার করতে পারি। অবশ্য,
অন্যান্য দেশের মেয়ে বা মেমসাহেবদের মতো মর্দানা লেবাস পরে ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বেড়াতে
চাই নে বা হাজার হাজার লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে গলাবাজিও করতে রাজি নই, আমরা চাই আমাদের
এই তোমাদের গড়া খাঁচার মধ্যেই একটু সোয়াস্তির সঙ্গে বেড়াতে চেড়াতে ; যা নিতান্ত
অন্যায়, যা তোমরা শুধু খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে করে থাক সেইগুলো থেকে রেহাই পেতে! এতে
তোমাদের দাড়ি হাসবে না বা মান-ইজ্জতও খোওয়া যাবে না, আর সেই সঙ্গে আমরাও একটু মুক্ত
নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচব, রাত্তির দিন নানান আগুনে সিদ্ধ আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগবে!
তোমরা যে খাঁচায় পুরেও সন্তুষ্ট নও, তার ওপর আবার পায়ে হাতে গলায় শৃঙ্খল বেঁধে
রেখেচ, টুঁটি টিপে ধরেচ, – থামাও, এ সব জুলুম থামাও! তোমরা একটু উদার হও, একটু
মহত্ত্ব দেখাও, – এতদিনকার এইসব একচোখা অত্যাচারের, সংকীর্ণতার খেসারতে এই এক বিন্দু
স্বাধীনতা দাও, – দেখবে আমরাই আবার তোমাদের নতুন শক্তি দেব, নতুন করে গড়ে তুলব।
দেশ-কাল-পাত্রভেদে, যেটুকু দরকার, আমরা কেবল তাই-ই চাইছি, তার অধিক আমরা চাইবই বা
কেন আর চাইলেই তোমরা দেবে কেন?...যাক বোন, আমাদের এসব কথা নিয়ে, অধিকার নিয়ে বেশি
ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে শেষে কি ‘আয়রে বাঘ – না গলায় লাগ’-এর মতো কোনো সমাজপতির এজলাসে
পেশ হব গিয়ে, অতএব এইখানেই এসব অবান্তর কথায় ধামাচাপা দিলাম।
আমার এইসব যা-তা বাজে বকুনির মধ্যে বোধ হয় আমার বক্তব্যের মূল
সূত্রটা ধরতে পেরেছিস। দিন-রাত্তির মনটা আমার খালি উড়ু উড়ু করচে, অথচ মনের এ
ভাব-গতিকের রীতিমতো কারণও খুঁজে পাচ্চিনে। এমন একটা সময় আসে, যখন মনটা ভয়ানক অস্থির
হয়ে ওঠে – অথচ কেন যে অমন হয়, কীসের জন্যে তার সে ব্যথিত ছটফটানি, তা প্রকাশ করা তো
দূরের কথা, নিজেই ভালো করে বুঝে উঠা যায় না! সে বেদনার কোথায় যেন তল, কোথায় যেন তার
সীমা! অবশ্য রেশ কাঁপচে তার মনে, কিন্তু সে কোন্ চিরব্যথার অচিন-বন পারিয়ে আসচে এ
রেশ, আর কোন্ অনন্ত আদিম বিরহীর বীণের বেদনে ঝংকার পেয়ে? হায়, তা কেউ জানে না!
অনুভব করবে কিন্তু প্রকাশ করতে পারবে না!...আমার এরকম মন খারাপ হওয়ার যথেষ্ট কারণ
রয়েচে বলবে তুমি, কিন্তু ভাই, আমি যে কোনো লোকের মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি যে, সেসব
মামুলি ব্যথা-বেদনার জন্যে অন্তরে এমন দরদ আসতেই পারে না। এ যেন কেমন একটা মিশ্র
বেদনা গোছের; জানের আনচান ভাব, মরমের নিজস্ব মর্মব্যথা যা মনেরও অনেকটা অগোচর। একটা
কথা আমি বলতে পারি; – যিনি যতই মানব চরিত্রের ঘুণ হন, তিনি নিশ্চয়ই নিজের মনকে
পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেন না। স্রষ্টার এইখানেই মস্ত সৃজন-রহস্য ছাপানো রয়েচে। আর এ
আমাদের মনের চিরন্তন দুর্বলতা, – একে এড়িয়ে চলা যায় না!...আহ্! আহ্!! দাঁড়া বোন, –
আবার আমার বুকে সে-কোন্ আমার চির-পরিচিত সাথির তাড়িয়ে দেওয়া চপল-চরণের ছেঁড়া-স্মৃতি
মনের বনে খাপছাড়া মেঘের মতো ভেসে উঠচে! সে কোন্ অজানার কান্না আমার মরমে আর্ত
প্রতিধ্বনি তুলচে! দাঁড়া ভাই, একটু পানি খেয়ে ঠান্ডা হয়ে তবে লিখব! কেন হয় ভাই এমন?
কেন বুকভরা অতৃপ্তির বিপুল কান্না আমার মাঝে এমন করে গুমরে ওঠে? কেন? – আঃ, খোদা!
* * *
হাঁ, – এখন, ভাবিজিকে বলিস, যেন ও মাসের আর এ মাসের সমস্ত মাসিক
পত্রিকাগুলো এরই হাতে পাঠিয়ে দেন। ভুললে চলবে না। আর, তাঁকে বলবি, যেন আমায় মনে করে
চিঠি দেন। সকলকে চিঠি লিখবার সময় কই, আর সুবিধাই বা কোথা। নইলে সকলকে আলাদা আলাদা
চিঠি দিতাম। তুই ওঁদের সব কথা বুঝিয়ে বলবি, যেন কেউ অভিমান না করেন। আমি কাউকে
ভুলিনি। সবাই যেন আমায় চিঠি দেন কিন্তু – হেঁ! আমার মতন তাঁদের তো এরকম
জিন্দান-কুঁয়ায় পড়ে থাকতে হয়নি! কাজেই কারুর আর কোনো ওজর শুনচিনে। ভাবিজি, ভাইজি,
মা, সবাই আমায় আর মনে করেন কি? – তারপর, এসব তো হল, এখনও যে আদত মানুষটিই বাকি!
আমার পিয়ারের খুকুমণি ‘আনারকলি’ কেমন আছে? এখানে কোনো ছেলেমেয়ে দেখলেই আমার
খুকুরানির কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে চোখও ছলছল করে ওঠে! আমার এই দুর্বলতায় আমার
নিজের কত লজ্জা পায়। কারণ তোরা হয়তো মনে করবি এ একটা বাড়াবাড়ি। ওই এক টুকরো ছোট্ট
মেয়েটাকে আমি যে কত ভালোবেসেছি, তা তোরা বুঝবি কী ছাই-পাঁশ? কথায় বলে, ‘বাঁজায় জানে
ছেলের বেদন!’ অবিশ্যি আমিও যদিচ এখনও তোদেরই মতো ন্যাড়া বোঁচা, কিন্তু আমার মন তো
আর বাঁজা নয়! এরই মধ্যে তোর গোলাবি গাল হয়তো শরমে লাল হয়ে গেছে! কিন্তু রোসো, আরও
শোন! মনে কর, আমি যদি বলি যে, আমার নিজের একটা মেয়ে থাকলে আমি ভাবিজির সঙ্গে
অদল-বদল করতাম,তাহলে তুই বিশ্বাস করিস? দাঁড়া,এখনই ধেই ধেই করে খেমটাওয়ালিদের মতো
নেচে দিসনে যেন রাগের মাথায়; আরও একটু শুনে যা – সত্যি বলতে কি সোফি, আমারও একটি
ওইরকম ছোট্ট আনারকলির মা হতে বড্ড সাধ হয়! কথাটি নিশ্চয়ই তোর মতন চুলবুলে ‘লাজের
মামুদ’-এর কাছে কাঁচা ছুঁড়ির মুখে পাকা বুড়ির কথার মতো বেজায় বেখাপ্পা শুনাল, না?
বুঝবি লো, তুইও বুঝবি দু-দিন বাদে আমার এই কথাটি! এখন শরমে তোর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠচে,
গোস্বায় তোর পাতলা রাঙা ঠোঁট ফুলে ফুলে কাঁপচে (আহা, ঠিক আমের কচি কিশলয়ের মতো!)
কিন্তু এই গায়েবি খবর দিয়ে রাখলাম, এ গরিবের কথা বাসি হলে ফলবেই ফলবে! মেয়েদের যে
মা হওয়ার কত বেশি শখ আর সাধ, তা মিথ্যা না বললে কেউ অস্বীকার করবে না! কী একটা ভালো
বইয়ে পড়েছিলাম যে, আমাদেরই মা আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েচেন! তলিয়ে বুঝে দেখলে কথাটা
সুন্দর সত্যি আর স্বাভাবিক বোধ হয়। – হাঁ, কিন্তু দেখিস ভাই লক্ষ্মীটি, তোর পায়ে
পড়চি, ভাবিজিকে এসব কথা জানতে দিসনে যেন। শ্রীমতী রাবেয়া যার নাম, তিনি যে এসব কথা
শুনলে আমায় সহজে ছেড়ে দেবেন, তা জিবরাইল এসে বললেও আমি বিশ্বাস করব না। একে তো
দুষ্টু বুদ্ধিতে তিনি অজেয়, তার ওপর একাধারে তিনি আমার গুরু বা ওস্তাদ আর ভাবিজি
সাহেবা! (সেই সঙ্গে রামের সুগ্রীব সহায়ের মতো তুমিও পিছনে ঠেলা দিতে কি কসুর করবে?)
নানাদিক দিয়ে দেখে আমি চাই যে, আমার সবকিছু যেন চিচিং-ফাঁক না হয়ে যায়! কেননা এ
হচ্চে স্রেফ তোতে-আমাতে দু-সই-এ গোপন কথা। এখানে বাজে লোকের প্রবেশ নিষেধ।
এতটা বেহায়াপনা করে সাত কালের বুড়ি মাগির মতো এত কথা এমন করে
খুলে কী করে লিখতে পারলাম দেখে হয়তো তুই ‘আই – আই – গালে কালি মা!’ ইত্যাদি
অবাক-বিস্ময়ের বাণী উচ্চারণ করচিস; কিন্তু লিখতে বসে দেখবি যে, মেয়েতে-মেয়েতে (তার
ওপর আবার তারা তোর আমার মতো সই হলে আর দূর দেশে থাকলে তো কথাই নেই!) যত মন খুলে সব
কথা অসংকোচে বলতে বা লিখতে পারে, অমনটি কেউ আর পারে না। পুরুষরা মনে করে, তাদের
বন্ধুতে-বন্ধুতে বসে যত খোলা কথা হয়, অমন বোধ হয় আমাদের মধ্যে হয় না; কিন্তু তারা
যদি একদিন লুকিয়ে মেয়েদের মজলিসে হাজিরা দিতে পারে, তাহলে তারা হয়তো সেইখানেই
মেয়েদের পায়ে গড় করে আসবে। ওসব কথা এখন যেতে দে, কিন্তু আমি ভাই সত্যি সত্যি মনের
চোখে দেখচি, তুই এতক্ষণ লাফিয়ে-চিল্লিয়ে তোর সেই বাঁধা বুলিটা আওড়াচ্চিস,
‘মাহ্বুবাকে বই পড়িয়ে পড়িয়ে ভাবিজি একদম লজঝড় করে তুলেচেন!’ আর সেই সঙ্গে আমার
দুঃখও হচ্চে এই ভেবে যে, তুই এখন আর কাকে আঁচড়াবি কামড়াবি? পোড়াকপাল, বরও জুটল না
এখনও যে, বেশ এক হাত হাতাহাতি খামচা-খামচি লড়াইটা দেখেও একটু আমোদ পাই! আল্লারে
আল্লাহ্! আমাদের এই তথাকথিত শরিফের ঘরে শুধু ঝুড়ি-ঝুড়ি থুবড়ো ধাড়ি মেয়ে! বর যে কোথা
থেকে আসবে তার কিন্তু ঠিক-ঠিকানা নেই!...
তারপর, আমি চলে আসবার পর খুকি আমায় খুঁজেছিল কি? আমার কেবলই মনে
হচ্চে, যেন খুকি খুব বায়না ধরেচে, মাথা কুটে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদচে, আর তোরা কেউ এই
দুলালি আবদেরে প্রাণীটির জিদ থামাতে পারচিসনে। আমায় দেখলেই কিন্তু কান্নার মুখে
পূর্ণ এক ঝলক হাসি ফুটে উঠত এই মেয়ের মুখে, ঠিক ছিন্ন মেঘের ফাঁকে রোদ্দুরের মতো!
কেন অমন হত জানিস? আমি মানুষ বশ করার ওষুধ জানি লো, ওষুধ জানি। বশ করতে জানলে
অবাধ্য জানোয়ারকে বশ করাই সবচেয়ে সহজ!
আরও কত কথা মনে হচ্ছে, কিন্তু লিখে শেষ করতে পারচিনে। তাছাড়া,
একটা কথা লিখবার সময় আর একটা কথার খেই হারিয়ে ফেলচি। মনের স্থৈর্যের দরকার এখানে।
কিন্তু হায়, মন যে আমার ছটফটিয়ে মরচে! ঘুমুই গিয়ে এখন, ভোর হয়ে এল। কেউ কোথাও জাগেনি,
কিন্তু একটা পাপিয়া ‘চোখ গেল, উহু চোখ গেল’, করে চেঁচিয়ে মরচে। কে তার এই কান্না
শুনচে তার সে খবরও রাখে না।
খুব বড়ো চিঠি দিস যদি, তাহলে আমার মাথা খাস! বুঝলি?
মাহ্বুবা
নুরুল হুদা ভাইজির কোনো খবর পেয়েছিস কী? তিনি চিঠিতে কী সব কথা
লেখেন? – মাহ্বুবা।
১৩ই ফাল্গুন
এলোকেশী দূতীর মারফত তোর চিঠিটা পেয়ে যেন আমার মস্ত একটা বুকের
বোঝা নেমে গেল। বাস্রে বাস্! এত বড়ো দস্যি মেয়ে তুই! কী করে এতদিন চুপ করে ছিলি?
জানটা যেন আমার রাত-দিন আই-ঢাই করত। এখন আমার মনে হচ্চে যেন আসমানের চাঁদ হাতে
পেলাম। যেদিন চিঠিটা পাই, সেদিনকার রগড়টা শোন আগে। তারপর সব কথা বলচি! – পরশু
বিকেলে তোর ওই বিন্দে দূতী মহাশয়া যখন আমাদের বাড়ির দোরে শুভ পদার্পণ করচেন, তখন
দেখি, এক পাল দুষ্টু ছেলে তার পিছু নিয়েচে আর সুর-বেসুরের আওয়াজে চিৎকার করচে,
‘আকাশে সরষে ফোটে, গোদা ঠ্যাং লাফিয়ে ওঠে!’ আর বাস্তবিকই তাই – ছেলেদেরই বা দোষ কী!
বুড়ির পায়ে যে সাংঘাতিক রকমের দুটি গোদ, তা দেখে আমারই আর হাসি থামে না। আমার সবচেয়ে
আশ্চর্য লাগল যে, আল্বোর্জ-পাহাড়-ধ্বংসী রুস্তমের গোর্জের মতো এই মস্ত ঠ্যাং দুটো
বয়ে এই মান্ধাতার আমলের পুরানো বুড়ি এত দূর এল কী করে! ভাগ্যিস বোন, ভাইজি তখন দলিজে
বসে এসরাজটা নিয়ে ক্যাঁ কোঁ করছিলেন, নইলে এসব পাখোয়াজ ছেলেরা বুড়িকে নিশ্চয়ই সেদিন
‘কীচকবধ’ করে দিত। মাগি রাস্তা চলে যত না হয়রান হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেরেশান
হয়েছিল ওই ছ্যাঁচড় ছেলে-মেয়ের দঙ্গলকে সপ্তস্বরে পূর্ণ বিক্রমে গালাগালি করাতে আর
ধূলা-বালি ছুঁড়ে তাদের জব্দ করবার বৃথা চেষ্টায়। ঘরে এসে যখন সে বেচারি ঢুকল, তখন
তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠচে, ভিজে ঢাকের মতো গলা বসে গেছে! ভাবিজি তাড়াতাড়ি তাকে শরবত
করে দেন, মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে তেল দিয়ে পাখা করে দেন, তবে তখন বেচারির ধড়ে জান
আসে! ওর সে সময়কার অবস্থা দেখে আমার এত মায়া হতে লাগল! কিন্তু কী করি, আমি তো আর
বেরোতে পারিনে ভাই, কেউ আর আমায় অচেনা লোকের কাছে বের হতে দেয় না। ভাইজান বলেন বটে,
কিন্তু তাঁর কথা কেউ মানে না। ও নিয়ে আমি কত কেঁদেছি, ঝগড়া করেছি ওঁদের কাছে। লোকে
আমায় দেখলে বোধ হয় আমার ‘উচকপালি’ ‘চিরুনদাঁতি’র কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে! না? যাক, –
আমি প্রথমে তো তাকে দেখে জানতে পারিনি যে, সে তোদের শাহপুর থেকে আসচে। পরে ভাবিজির
কাছে শুনলাম যে, সে তোদের ওখান থেকে জবরদস্ত একখানা চিঠি নিয়ে এসেচে। ভাবিজি প্রথমে
তো কিছুতেই চিঠি দিতে চান না, অনেক কাড়াকাড়ি করে না পেরে শেষে যখন জানলাটায় খুব জোরে
জোরে মাথা ঠুকতে লাগলাম আর ভাইজান এসে ওঁকে খুব এক চোট বকুনি দিয়ে গেলেন, তখন উনি
রেগে চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আমার দিকে। আমার তখন খুশি দেখে কে! রাগলেনই বা, ওঃ উনি
রাগলে আমার বয়েই গেল আর কী! তাই বলে আমার চিঠি ওইসব বেহায়া ধাড়িকে পড়তে দিই, –
আবদার! এইসব কলহ-কেজিয়া করতেই সাঁঝ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে দোর বন্ধ করে
তোর চিঠিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম খানিকটা পড়ে আর পড়তে পারলাম না। আমারও ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে কান্না আসছিল। আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই মনে ভাবচিস হয়তো যে, আমি এখানে
খুবই সুখে আছি। তা নয় সই, তা নয়। তোকে ছেড়ে আমার দিনগুলো যে কীরকম করে কাটচে, তা যদি
তুই জানতিস, তাহলে এত দুঃখেও তোর আমার জন্যে কষ্ট হত। আমি যে তোদের ওই শূন্যপুরী
ঘরটার দিকে তাকালেই কেঁদে ফেলি বোন! আমাদের ঘরের সব কিছুতেই যে তোর ছোঁয়া এখনও লেগে
রয়েছে। তাই মনে হয়, এখানের সকল জিনিসই তোকে হারিয়ে একটা মস্ত শূন্যতা বুকে নিয়ে
হা-হা করে কাঁদচে। সেই সঙ্গে আমারও যে বুক ফেটে যাওয়ার জো হয়েছে! – পোড়া কপাল তোর!
মামার বাড়িতেও এই হেনস্থা, অবহেলা! যখন যার কপাল পোড়ে, তখন এমনই হয়। তোর পোড়ারমুখি
আবাগি মামানিদের কথা শুনে রাগে আমার গা গিসগিস করচে! ইচ্ছে হয়, এই জাতের হিংসুটে
মেয়েগুলোর চুল ধরে খুব কষে শ-খানিক দুমাদ্দম কিল বসিয়ে দিই পিঠে, তবে মনের ঝাল মেটে!
জানি, ও দেশের মেয়েরা ওইরকম কোঁদুলে হয়। দেখেছিস তো, ও পাড়ার শেখদের বউ দুটো? বাপরে
বাপ, ওরা যেন চিলের সঙ্গে উড়ে ঝগড়া করে! মেয়ে তো নয়, যেন কাহারবা! তোদের কথা শুনে
মা, ভাবিজি, ভাইজান কত আপশোশ করতে লাগলেন। তোদের উঠে যাওয়ার সময় মা এত করে বুঝালেন
তোর মাকে, তা খালাজি কিছুতেই বুঝলেন না। কেন বোন, এও তো তাঁরই বাড়ি! মা-জান সেদিন
তোদের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন, আর কত আর্মান করতে লাগলেন যে, আমি তো তাদের
নিজের করতে চাইলাম, আর জানতামও চিরদিন নিজের বলেই, তা তারা আমাদের এ দাবির তো খাতির
রাখলে না। মাহ্বুবাকে তো নিজের বেটিই মনে করতাম, তা ওর মা ওকেও আমার বুক থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কী করি, জোর তো নেই!...এই রকম আরও কত আক্ষেপের কথা! এখানে ফিরে
আসবার জন্যে মাও ফের চিঠি দেবেন খালাজিকে, আজ ওই নিয়ে ভাইজানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
তোর পায়ে পড়ি ভাই, তুই যেন কোনো ল্যাঠা লাগাসনে আর ওরই সাথে। বরং খালাজিকে বুঝিয়ে
বলিস, যাতে তিনি থির হয়ে সব কথা ভালো করে বুঝে দেখেন। সত্যি করে বলচি ভাই, তোকে ছেড়ে
থাকলে আমি একদম মরে যাব। এই কদিনেই আমার চেহারা কীরকম শুকিয়ে গেচে, তা যদি আসিস,
তখন নিজে দেখবি। ভাইজান বলছিলেন, তিনি নিজেই যাবেন পালকি নিয়ে তোদের আনতে। তাই আমার
কাল থেকে এত আনন্দ হচ্চে, সে আর কী বলব! এখন, এ-কদিন ধরে যে তোর জন্যে খুবই
কান্নাকাটি করেছিলাম, তা মনে হয়ে আমার বড্ড লজ্জা পাচ্চে। সত্যি সত্যিই, ভাবিজি যে
বলেন, আমার মতো ধাড়ি মেয়ের এত ছেলেমানুষি আর কাঁদাকাটা বেজায় বাড়াবাড়ি, তাতে কোনোও
ভুল নেই। এখন তুই ফিরে আয় তো, তারপর দেখব। তোর ওই এক পিঠ চুলগুলো ধরে এবার আর রোজ
রোজ বেঁধে দিচ্ছিনে, মনে থাকে যেন। থাকবি রাত্তির দিন ওই সেই বই-এ পড়া কপালকুণ্ডলার
মতো এলো চুলে। তুই যাওয়ার পর থেকে গল্প করতে না পেয়ে জানটা যেন হাঁপিয়ে উঠচে আমার।
মর পোড়াকপালিরা, কেউ যদি গল্প করতে চায়! সারাক্ষণই ছাই-পাঁশ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মাগো
মা ! এই রকম গুম হয়ে বসে থাকলে তো আমার মতন লোকের আর বাঁচাই হয় না দুনিয়ার। মা তো
আর ওসব ছেলেমানুষি ভালোবাসেন না! ভাবিজিও যত সব ছাই-ভস্ম রাজ্যের বই আর মাসিক
পত্রিকার গাদায় ডুবে থাকেন। নিজে তো মরেছেন, আবার আমাকেও ওইরকম হতে বলেন। কথা শুনে
আমার গা পিতপিতিয়ে ওঠে! পড়বি বাপু তো এক আধ সময় পড়, দিনের একটু আধটু কাজের ফাঁকে,
তা না হয়ে রাত্তির জেগে বই পড়া! অমন বই-পড়ার মুখে নুড়োর আগুন জ্বালিয়ে দিই আমি।
আমার তো ভাই দুটো গল্প পড়বার পরই যেন ছটফটানি আসে, মাথা ধরবার জোগাড় হয়। তার চেয়ে
বসে বসে দু-ঘন্টা গল্প করব যে কাজে আসবে! এই কথাটি বললেই আমাদের মুরুব্বি ভাবিটি
হেসেই উড়িয়ে দেন। তারপর, বুঝেছিস রে, আমাদের এই ভাবিজি আবার কবিতা গল্প লিখতে শুরু
করে দিয়েচেন রাত্রি জেগে। আমি সেদিন হঠাৎ তাঁর একটা ওইরকম খাতা আবিষ্কার করেছি। ওসব
ছাই-ভস্ম কিছুই বুঝতে পারা যায় না, শুধু হেঁয়ালি। তবে, আমাদের খুকিকে নিয়ে যেসব
কবিতাগুলো লেখা, সেগুলো আমার খুব ভালো লেগেচে। এখন দেখছি, এই লোকটিকে রীতিমতো আদব
করে চলতে হবে।
তারপর ‘আনারকলি’র কথা বলি শোন! আমার এই ক্ষুদে ভাইঝিটিই হয়েছে
আমার একমাত্র সাথি। তাছাড়া বাড়ির আর কারুর সঙ্গে বনে না আমার। গল্প করায় কিন্তু খুকি
আমাকেও হার মানিয়েছে। এই কচি খুকিটি যেন একটা চঞ্চল ঝরনা। অনবরত ঝরঝর ঝরঝর বকেই
চলেচে। আর, সে বকার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। এখন দায়ে পড়ে, ওর ওইসব হিজিবিজি
কথাবার্তাই আমাকে অবলম্বন করতে হয়েচে আর ক্রমে ভালোও লাগচে। তুই চলে যাওয়ার পর সে
‘ফুপুদি দাবো, ফুপুদি দাবো’ বলে দিনকতক যেন মাথা খুঁড়ে মরেছিল, এখনও সময় সময় জিদ ধরে
বসে। যখন ‘না, – ফুপুদি দাবো’ বলে এ খামখেয়ালি মেয়ে জিদ ধরে, তখন কার সাধ্যি যে
থামায়। যত চুপ করতে বলব, তত সে চেঁচিয়ে-চিল্লিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে ধুলো-কাদা মেখে একাকার
করবে। বাড়িসুদ্ধ লোক মিলে তাকে থামাতে পারে না। কোনোদিন গল্প করতে করতে বা
আবোল-তাবোল বকতে বকতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ঘাড়টি কাত করে বলে, ‘লাল ফুপু নেই – মলে দেছে!’
সঙ্গে সঙ্গে মুখটি তার এতটুকু, চুন হয়ে যায় আর একটি ছোট্ট নিশ্বাসও পড়ে, আমার জানটা
তখন সাত পাক মোচড় দিয়ে ওঠে বোন! ভাবিজির চোখ দিয়ে তো টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি
তাকে সেদিন যখন জানিয়ে দিলাম যে, তাঁর লাল ফুফু সাহেবা মামুবাড়ি সফর করতে গেছেন,
তখন থেকে লাল ফুফুর আল্লাদি দরদি এই ভাইঝিটি হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে আর বলে, –
‘তাই তাই তাই, মামা-বালি দাই, মামিমাজি ভাত দিলে না দোরে হেদে পালাই!’ তোর চিঠিতে
এই যে পেনসিলের দাগগুলো দেখচিস, এগুলো এই দুষ্টু মেয়েরই কাটা। আমি যখন চিঠি লিখতে
বসি, তখন সে আমার ঘাড়ে চড়ে পিঠে কিল মেরে জোর আপত্তি করতে শুরু করে দিল, সে কিছুতেই
আমায় চিঠি লিখতে দেবে না, এখন তাকে ছবি দেখাও। তারপর যেই বলা যে, এ চিঠি তাঁরই
প্রিয় মাননীয়া লাল ফুফু সাহেবার, তখন সে ঝোঁক নিলে, ‘আমি তিথি লিথ্বো ফুপুদিকে!’
ভালো জ্বালা বুন, সে কী আর থামে! কী করি, নাচার হয়ে একটা ভোঁতা পেনসিল তার হাতে দিয়ে
দুলালির মান রক্ষে করা গেল, না দিলে সে চিঠিটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিত, যা মেয়ের
রাগ! এই মেয়েটা কী পাকাবুড়ি বুন, তোর চিঠিটা হাতে করে সে মুখকে মালসার মতো গম্ভীর
করে আধঘন্টাখানিক ধরে যা তা বকতে লাগল আর পেনসিলটা যেখানে সেখানে বুলিয়ে প্রমাণ করতে
লাগল যে, সেও লেখা জানে! আমার তো আর হাসি থামে না। হাসলে আবার তিনি অপমান মনে করেন
কিনা, কারণ তাঁর আত্মসম্মানবোধ এই বয়সেই ভয়ানক রকম চাগিয়ে উঠেচে, তাই তাঁর কাণ্ড
দেখে হাসলে তিনি একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ঠোঁট ফুলিয়ে, কেঁদে কেটে খামচিয়ে
কামড়িয়ে একেবারে তস-নস করে ফেলবেন! এই চিঠি লেখবার সময়ও ঠিক ওইরকম জোগাড় হয়েচিল,
হয়তো আজকে আর এটা লেখাই হত না – ভাগ্যি সেই সময় আমাদের সেই বেঁড়ে বেড়ালিটা তার
নাদুস-নুদুস বাচ্চা চারটে নিয়ে সপরিবারে আমার কামরায় দুর্গতিনাশিনীর মতো এসে হাজির
হল, তাই রক্ষে। নইলে হয়েছিল আর কী! বেড়াল-ছানাগুলো দেখে খুকি একেবারে আত্মহারা হয়ে
সব ছেড়ে তার পেছন পেছন দে ছুট। শ্রীমতী বিড়াল-গিন্নি সে সময়ের মতো সে স্থান থেকে
অন্তর্ধান হওয়াই সমীচীন বোধ করলেন। খুকি বেড়াল বাচ্চাগুলোর কানে ধরে ধরে বুঝাতে
চেষ্টা করে যে সে ওই বাচ্চা চতুষ্টয়ের মাসি-মা বা খালাজি। অবশ্য, বাচ্চাগুলো বা
তাদের মা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কিছু মত প্রকাশ করতে সাহস করেনি! উলটে, খুকি যখন
তাদের কান ধরে ঝুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘পুছু, আমি – আমি তোল কালাজি! না? বেচারি বেড়াল
বাচ্চা তখন করুণ সুরে বলে ওঠে, ‘মিউ!’ অর্থাৎ না স্বীকার করে করি কী? এই গরিব
বাচ্চাগুলির ওপর খুকির আমাদের যে মাসির মতোই নাড়ির টান টনটনে সে বিষয়ে আমার আর এই
গরিব বেচারিদেরও ঘোর সন্দেহ আছে। মার্জার-পত্নী মহাশয়া তো সেটা স্বীকার করতে একদম
নারাজ, – তবু সন্তান-বাৎসল্য অপেক্ষা যে লাঠির বাড়ির গুরুত্ব অনেক বেশি, তা বিড়ালির
বিলক্ষণ জানা আছে, তাই তার বুবু সাহেবা অর্থাৎ কিনা আমাদের খুকুমণি সেখানে এলেই সে
ভয়ে হোক নির্ভয়ে হোক – সে স্থান সত্বরই ত্যাগ করে! খুকুও তখন বাচ্চাগুলোকে টেনে
হিঁচড়ে চাপড়িয়ে লেজ দুমড়ে, কান টেনে যেরকম নব নব আদর-আপ্যায়ন দেখায়, তা দেখে ‘মা মরে
মাসি ঝুরে’ কথাটা একদম ভুয়ো বলে মনে হয়।... আমি বুন কিন্তু এসব দেখতে পারিনে। এইসব
অনাছিষ্টি, বেড়ালছানা নিয়ে রাত্তির-দিন ঘাঁটাঘাঁটি, হতভাগা ছেলেপিলের যেন একটা উৎকট
ব্যামো। এই বেড়ালছানাগুলোর গায়ে এত পোকা যে ছুঁতেই ঘেন্না করে, তাকে নিয়ে এই দুলালি
মেয়ে সারাক্ষণই ঘাঁটবে নয়তো কোলে করে এনে বিছানায় তুলবে। সেদিন দেখি, – ছি, গাটা
ঝাঁকরে উঠচে! – ওর গা বেয়ে বেয়ে ঝাঁকড়া চুলের ভিতর ঢুকচে কত বেড়াল-পোকা! ওর মা তো
রাগের চোটে ওকে ধুমসিয়ে একাকার করে ফেললে! আমি শেষে সে কত কষ্টে গা ধুইয়ে চুল
আঁচড়িয়ে পোকাগুলো বের করে দিলাম। আর এই হারামজাদা বেড়ালছানাগুলোও তেমনি, খুকিকে
দেখলেই ওদের ঝুনঝির নাড়িতে টনক দিয়ে ওঠে, আর তাই লেজুড় খাড়া করে সকুরণ মিউ মিউ সুরে
ওদের এই মানুষ খালাটির কাছে গিয়ে হাজির হবে। রাগে আর ঘেন্নায় আমার গা হেলফেলিয়ে ওঠে
এইসব জুলুম দেখে! অন্য কেউ এসে এই বাচ্চাগুলোকে ছুঁতে গেলেই তখন গায়ের ‘রোঁয়া খাড়া
করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, সামনের একটি পা চাটুর মতো করে তুলে এমন একটা ফোঁৎ ফোঁৎ শব্দ
করতে থাকে যে, আমি তো হেসে লুটিয়ে পড়ি। বাচ্চাগুলোর চেহারা দেখেই তো একে হাসি পায়,
তার ওপর এক মুঠো প্রাণীর এই এতবড়ো কেরদারি দেখে আরও হাসতে ইচ্ছা করে। দাঁড়া, আর দু-দিন
দেখি, তারপর ঝাঁটা মেরে বিদেয় করব এসব আপদগুলোকে! ... তোর শেখানো মতো খুকি এখন তার
নাম বলতে শিখেচে, ‘আনান্কলি’!
ভাবিজিও তোকে চিঠি দিলেন। দেখচি, এই দু-দিন ধরে তিনি আমায় দেখিয়ে
দেখিয়ে লিখচেন। আমি তাঁকে তোর চিঠিটা দেখতে দিইনি কিনা এই হয়েচে তাঁর রাগ। কিছুতেই
আমাকে তাঁর চিঠিটা দেখালেন না। না-ই দেখালেন, – আমার বয়েই গেল! আমার সঙ্গে ভাবিজির
আড়ি! দেখি এইবার কে সেধে ভাব করতে আসে! আচ্ছা মাহ্বুবা, তুই আমায় ওঁর সব কথা লুকিয়ে
জানিয়ে দিতে পারিস? তাহলে ওঁর সব গুমোর ফাঁক করে দিই আমি।
মাল্কার কথা লিখেছিস। ওকে আবার চিনতে পারব না। ক-বছরই বা আর সে
আসেনি, এই বোধ হয় বছর পাঁচেক হল, না? আচ্ছা, মেয়েদের ওপর একী জুলুম? পাঁচ পাঁচটা
বছর ধরে বাপের বাড়ি আসতে দেবে না, সামান্য একটু ঝগড়ার ছুতো নিয়ে। ... যদি পারিস, তবে
মাল্কাকে বলে এই মাগিকে দিয়ে আর একখানা চিঠি পাঠিয়ে দিস। তাহলে খুব ভালো হয়, কেননা
ওই সঙ্গে ভাবিজির চিঠিটাও পাব।... আচ্ছা ভাই, এ মাগির নাম এলোকেশী রাখলে কে? এর যে
আদতেই চুল নেই, তার আবার এলোকেশ হবে কী করে? যা দু-চারিটা আছে ঝাঁটিগাছের মতো এখনও
মাথায় গজিয়ে, তাও আবার এলো জরা নয়, মাথার ওপর একটি ক্ষুদ্রাদপিক্ষুদ্র বড়ির মতো করে
বাঁধা। আমার এত হাসি পাচ্চে! এ যেন যার ঘরে একটা ম্যাচ বাক্স নাই, তার নাম দেদার
বাক্স্যা। দিনকানা ছেলের নাম নজর আলী!
তারপর, তোর ভয় নেই লো ভয় নেই! তোর কুলের কথা কাউকে বলে দিইনি।
তবে, আমার খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে, আর এত লজ্জাও হচ্চে তোর এইসব ছিষ্টিছাড়া কথা শুনে।
– ছিঃ মা! তোমার গলায় দড়িও জোটে না? এক ঢাকুন জলে ডুবে মরতে পার না ধিঙ্গি বেহায়া
ছুঁড়ি? আমি কাছে থাকলে তোর মুখ ঠেসে ধরতাম। থুবড়ো মেয়ের আবার মা হওয়ার সাধ! তাতে
আবার যে সে মেয়ের নয়, ভাই-এর মেয়ের মা! আ-তোর গালে কালি! আয় তুই একবার পোড়ারমুখি
হতভাগি, তার মজাটা ভালো করেই টের পাবি আমার কাছে
পুরুষদের বিরুদ্ধে তোর যে মত, তাতে আমারও মতদ্বৈধ নেই॥ আমিও তোর
বক্তিমেয় সায় দিচ্চি। উকিল-‘মুখ-তৈয়ার’-এর মতো তুই যেসব যুক্তিতর্ক এনেচিস তাতে
আমার হাসিও পায় দুঃখও হয়, আবার রাগও হয়। কারণ, আমি নির্ভয়ে বলতে পারি, তোর এই
মর্দানা হম্বিতম্বিতে কোনো পুরুষপুঙ্গবের কিছুমাত্র আসে যায় না, – এরকম কলিকালের
মেয়েদের তারা থোড়াই কেয়ার করে। এর বিহিত ব্যবস্থা করতেও পারেন তাঁরা, তবে কিনা তাঁরা
পৌরুষসম্পন্ন পুরুষ, তাই ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চান না। যার গোঁফ আছে, তিনি তাতে
চাড়া দিয়ে বলবেন, ‘কত কত গেল রতি, ইনি এলেন আবার চকরবতী!’ আর, আমিও বলি, দু-দিন পরে
যে পুরুষসোপর্দ হবি তা বুঝি মনে নেই! পড়িস, খোদা করে, আচ্ছা এক কড়া হাকিমের হাতে,
তাহলে দেখব লো তাঁর এজলাসে তুই কত নথনাড়া আর বক্তিমে দিতে পারিস। তখন উলটো এই
অনধিকার চর্চার জন্যে তোর যা কিছু আছে, তার সব না বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, দেখিস!...তোর
মোকদ্দমা যে হঠাৎ একতরফা ডিগ্রী হয়ে গেল অর্থাৎ কিনা বিয়েটা মুলতুবি রয়ে গেল,
তজ্জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। ওঃ, তোর তরফের উকিল ভাবিজি সাহেবা কি তজ্জন্য কম
লজ্জিত আর মর্মাহত? তাই তিনি এখন তাঁর জবর জবর কেতাব ঘেঁটে, মস্ত মস্ত আইন সংগ্রহ
করে, অকাট্য যুক্তি-তর্ক প্রয়োগে পুনরায় আপিল রজু করেছেন (তোর বরের নামে!) আসামির
নামে জোর তলব ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। তবে এখন দিন বাড়বে কিছুদিন, এই যা। তা হোক, মায়
খরচা তুই ডিক্রি পাবি, এ আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তুই ইত্যবসরে একটা ক্ষতি-খেসারতের
লিস্টি করে রাখিস, আমি না হয় পেশকার হয়ে সেটা পেশ করে দেব হুজুরে। তাই বলে ঘুষ নেওয়া
ছাড়চিনে। কিছু উপুড়হাত না করলে, বুঝেছিস তো একেবারে মুলতুবি! ভালোই হল, এ মোকদ্দমাটা
হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়ে একটু বৈচিত্র্য, একটা রগড়ও দেখা গেল! – তুই হয়তো অবাক
হচ্চিস, আমি এত কথা শিখলাম কী করে। কী করি, না শিখলে যে নয়; – না-রে কাল
সন্ধ্যেবেলায় ভাইজিতে আর ভাবিজিতে এই কথাগুলো হচ্চিল, আমি আড়াল থেকে শুনে সেগুলো
খুব মনে করে রেখেছিলাম। এখন তোর চিঠিতে সেই কথাগুলোই মজা দেখতে লাগিয়ে দিলাম। কী মজা!
... সে যাক, তুই এখন তৈরি হয়ে থাকিস। বুঝেছিস আমার এই ‘বীণা-পঞ্চমে বোল’? – দাঁড়া
তো আসুক সে মজার দিন, তবে না তোর এ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার গুড়ে বালি পড়বে? দেখব তখন,
খালাজিও তোকে কী করে ধরে রাখেন। তখন হবি আমাদের ঘরের বউ, বুঝেচিস? আমার ওই বদরাগি
খালাজিটিকে একবার খুব দু কথা শুনিয়ে দেব তখন। হেঁ, আমি ছাড়বার পাত্তর নই, যতই কেন
মুখরা বলুন তিনি। তার পর, তোর গুপ্ত খবর – যা শেষ ছত্রে পুনশ্চে লিখেছিস, তার অনেকটা
বোধ হয় আমার লেখায় জানতে পেরেছিস। নূরু ভাইজান নাকি বসরা যাবেন শিগগির, লিখেছেন।
বাঙালি পলটন নাকি এইবার যুদ্ধে নামবে। তিনি লিখেচেন, কোনো ভয় নেই, তবু আমাদের প্রাণ
মানবে কেন বোন? মা তো কেঁদে সারা। ভাইজান মন-মরা হয়ে পড়েছেন। ভাবিজি তো শুধু লুকিয়ে
লুকিয়ে কাঁদচেন এ কদিন ধরে। আমার মনও কেমন এক রকম করে এক আধ সময়। তবু আমি বলতে চাই
কী, আমার কিন্তু ওতে এতটুকু ভয় হয় না। পুরুষের তো কাজই ওই। আজকালকার পুরুষরা যা
হয়েছেন তাতে ওদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে। ওদের হুবহু মেয়ে হওয়ার সাধ, –
সাজ-সজ্জা ধরন-ধারণ সবেতেই! কাজেই শরীরটা হচ্চে আমাদেরই মতো ননীর ঢেলা, যাকে শুধু
বিলাস-ব্যসনেই লাগানো যেতে পারে, কোনো শক্ত কাজে নয়; আর বাক্যবাগীশ এত হয়ে পড়েচেন
যে, মেয়ের জাত মুখ গুটোতে বাধ্য হয়েছে। ছিঃ, বোন, এই কি পুরুষের কাজ? যে পুরুষের
পৌরুষ নেই, তারা সত্যি সত্যিই গোঁফ কামিয়ে দেয় দেখে আর দুঃখ হয় না। আমাদের বাড়ির
দারোয়ানটাকে গোঁফ কামানোর কথা বললে সে রাগে একেবারে দশ হাত লাফিয়ে ওঠে, কেননা ওদের
আর কিছু নাই থাক, গায়ে পুরুষের শক্তি আছে; উলটো আমাদের দেশে গোঁফ রাখতে বললেই অনেকে
ওইরকম লাফিয়ে উঠবেন, কেননা তাঁদের গায়ে মেয়েদের ঝাল আছে! এঁরাই আবার বাড়ির চৌহদ্দির
ভিতরে মেয়েদের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে যাত্রার দলের ভীমের চেয়েও জোরে লাফ-ঝাঁপ জুড়ে দেন!
একেই বলে, ‘নির্গুণো সাপের কুলোপানা ফণা’। আমার কেন মনে হচ্ছে, নূরু ভাইজি আবার
বেঁচে ফিরে আসবেন, আর তুই হবি তাঁর – আমার এই পুরুষ ভাই-এর – অঙ্কলক্ষ্মী। তুই হবি
এক মহাপ্রাণ বিরাট পুরুষের সহধর্মিণী! আমার মনে এ জোর যে কে দিচ্চে তা বলতে পারিনে,
তবে কথা কী, আমার মন তোদের মতো শুধু অলক্ষুণে কথাই ভাবে না। ... এইখানে কিন্তু তোর
সঙ্গে একটা মস্ত ঝগড়া আছে। বলি, হ্যাঁ লো মুখপুড়ি বাঁদরি! তোর আর বুদ্ধি হবে কখন?
সে কী কবরে গিয়ে? দু-দিন বাদে যে নূরু ভাইজির সাথে তোর বিয়ে হবে, কোন্ লজ্জায় তুই
তাঁর নাম নিস, আবার ভাইজি বলে লিখিস? ওরে আমার ভাই-এর দরদি বোনরে! দূর আবাগি
হতচ্ছাড়ি, তুই একদম বেহায়া বেল্লিক হয়ে পড়েছিস!
আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই আমার নূরু ভাইজানকে খুব জান থেকে
ভালোবাসিস, না? সত্যি করে লিখিস ভাই, – নইলে আমার মাথা খাস! যদি ঝুট বলিস তাহলে তোর
সাথে (এই আঙুল ফুটিয়ে বলচি) আড়ি – আড়ি – আড়ি! তিন সত্যি করলাম একেবারে। আর,
বাস্তবিক সই, আমার এ ভাইটির কাউকে শত্রু হতে দেখলাম না। কেই বা ওঁকে ভালোবাসে না? –
যাকে খোদায় মারে, তাকে বুঝি সবাই এমনই একটা স্নেহের, বেদনাভরা দৃষ্টি দিয়ে দেখে! মনে
হয়, আহা রে, হতভাগা, কী করে তুই এত দুঃখ হাসিমুখে বইছিস। অথচ সবচেয়ে মজা এই যে, যার
জন্যে আমরা এত বেদনা, ব্যথা অনুভব করি, সে ভুলেও সেকথার উল্লেখ করে না, নিজের ভাবে
নিজেই মশগুল। উলটো তার দুঃখে কেউ এই সহানুভূতির কথা জানাতে গেলে তার সঙ্গে সে
মারামারি করে বসে। এ মানুষ বড়ো সাবধান, যেই বুঝতে পারে যে, অন্যে তার বেদনা বুঝতে
পেরেছে অমনি সে ছটফটিয়ে ওঠে; তার ওপর তার ওই অত বড়ো দুর্বলতাটা ধরে আহাম্মকের মতো
তাতে হাত দিতে গেলে তো আর কথাই নাই, সে একেবারে ক্ষিপ্ত সিংহের মতো তার ওপর লাফিয়ে
পড়ে। – আমার তো এই রকমই মনে হয়। নূরু ভাইজিকে যেন আমি অনেকটা এই রকমই বুঝি, অবশ্য
এক আধটু গরমিলও দেখা যায়। তুই কী বলিস? ...
থাকগে, এসব বারো কথা। শিগগির উত্তর দিস। ইতি –
সোফিয়া
১৫ই ফেব্রুয়ারি (দুপুর)
হাজার হাজার আদাব। আপনার চিঠি পেয়েচি। সব কথা বুঝে উত্তর দেওয়ার
মতো মনের অবস্থা নেই আর সময়ও নেই। পরে যদি সময় পাই আর ইচ্ছা হয়, তবে আপনার সব
অনুযোগের একটা মোটামুটি কৈফিয়ত ভেবেচিন্তে দিলেও দিতে পারি। কিন্তু বলে রাখচি আমি,
– আর আপনারা আমায় এরকম করে আঘাত করবেন না। মানুষ মাত্রেরই দুর্বলতা থাকে, কিন্তু
সেটাকে প্রকাশ করাও যে একটা মস্ত বড়ো দুর্বলতা তা আজ আমি হাড়ে হাড়ে বুঝচি। তা নাহলে
আজ আমি এত কষ্ট পেতাম না। আপনাদের এ আঘাত দেওয়ার অধিকার আছে বটে, আমারও সইবার
অধিকার আছে, কিন্তু সইবার শক্তি নেই আমার। এটা তো বোঝা উচিত ছিল। আমার এই কথা কটি
বুঝতে চেষ্টা করে আমার এই নির্দয় কঠোরতাকে ক্ষমা করবেন।
দেখুন, মানুষের যেখানে ব্যথা, সেইখানটা টিপেও যে আরাম পায়।
অন্তরের বেদনাও ঠিক ওই রকমের। তাই, জেনে হোক – না জেনে হোক, কেউ সেই বেদনায় ছোঁয়া
দিলে এমন একটা মাদকতা-ভরা আরাম পাওয়া যায়, যেটার পাওয়া হতে হাজার চেষ্টাতেও নিজেকে
বঞ্চিত করা যায় না, বা এড়িয়ে চলবারও শক্তি অসাড় হয়ে যায়, এমনই ভয়ানক এর প্রলোভন।
তাই আমি মুক্তকণ্ঠে বলচি, আপনাদের দেওয়া এই আমার বেদনার আঘাত মধুর হলেও আমার কাছে
অকরুণ – ভীষণ দুর্বিষহ। এ আমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। এ প্রলোভনের মুখে একটু ঢিলে
হয়ে পড়লেই পদ্মার ঢেউ-এ খড়-কুটাটির মতো ভেসে যাব। – সে কী ভয়ানক! আমার অন্তর শিউরে
উঠচে! পায়ে পড়ি আপনাদের, আর আমায় এমন করে খেপিয়ে তুলবেন না। আমার বেদনাভরা
দুর্বলতার মূল কোথায় জেনে ঠিক সেইখানে কসাইয়ের মতো ছুরি বসাবেন না। রক্ষা করুন –
মুক্তি দেন আপনাদের এই স্নেহের অধিকার হতে। আমার প্রকাশ-করা দুর্বলতা আমারই ক্ষুব্ধ
বুকে পলটনের জল্লাদের হাতের কাঁটার চাবুকের আঘাতের মতো বাজচে। তাই এ চিঠিটা লিখচি
আর রাগে আমার অষ্টাঙ্গ থরথর করে কাঁপচে! আমার মতন বোকাচন্দ্র বোধ হয় আর দুনিয়ায় দুটি
নেই!
আমাদের ‘মোবিলিজেশন অর্ডার’ বা যুদ্ধ-সজ্জার হুকুম হয়েচে। তাই
চারিদিকে ‘সাজ সাজ’ রব পড়ে গেছে। খুব শীঘ্রই আরব সাগর পেরিয়ে মেসোপটেমিয়ার আগুনে
ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে গিয়ে, তাই আমার আনন্দ আর আমাতে ধরচে না। আমি চাচ্ছিলাম আগুন – শুধু
আগুন – সারা বিশ্বের আকাশে-বাতাসে, বাইরে-ভিতরে আগুন, আর তার মাঝে আমি দাঁড়াই আমারও
বিশ্বগ্রাসী অন্তরের আগুন নিয়ে, আর দেখি কোন্ আগুন কোন্ আগুনকে গ্রাস করে নিতে পারে,
আরও চাচ্ছিলাম মানুষের খুন! ইচ্ছা হয়, সারা দুনিয়ার মানুষগুলোর ঘাড় মুচড়ে চোঁ চোঁ
করে তাদের সমস্ত রক্ত শুষে নিই, তবে আমার কতক তৃষ্ণা মেটে! কেন মানুষের ওপর আমার এত
শত্রুতা? কী দুশমনি করেছে তারা আমার? তা আমি বলতে পারব না। তবে, তারা আমার দুশমন নয়,
তবুও আমার তাদের রক্তপানে আকুল আকাঙ্ক্ষা। সবচেয়ে মজার কথা হচ্চে এখানে যে, এই
মানুষেরই এতটুকু দুঃখ দেখে সময় সময় আমার সারা বুক সাহারার মতো হা হা করে আর্তনাদ করে
ওঠে! হৃদয়ের এই যে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত দুশমনিভাব, এর সূত্র কোথায়, – হায়, কেউ জানে
না। অনেক অনধিকারী আমার এ জ্বালা, এ বেদনা বুঝবে না ভাবিসাহেবা, বুঝবে না। বড্ড
ব্যস্ত, খালি ছুটোছুটি, – তারই মধ্যে তাড়াতাড়ি যা পারলাম, লিখে দিলাম। চিঠিটা দু-তিনবার
পড়ে আমার বক্তব্য বুঝবার চেষ্টা করবেন।
তারপর আপনি মাহ্বুবার কথা লিখেছেন। সে অনেক কথা। এর সব কথা খুলে
বলবার এখনও সময় আসেনি। তবে এখন এইটুকু বলে রাখচি আপনায় যে, মানুষকে আঘাত করে হত্যা
করেই আমার আনন্দ! আমার এ নিষ্ঠুর পাশবিক দুশমনি মানুষের ওপর নয়, মানুষের স্রষ্টার
ওপর। এই সৃষ্টিকর্তা যিনিই হন, তাঁকে আমি কখনই ক্ষমা করতে পারব না, – পারব না! আমাকে
লক্ষ জীবন জাহান্নামে পুড়িয়েও আমায় কবজায় আনবার শক্তি ওই অনন্ত অসীম শক্তিধারীর নেই।
তাঁর সূর্য, তাঁর বিশ্ব গ্রাস করবার মতো ক্ষুদ্র শক্তি আমারও অন্তরে আছে। আমি তাঁকে
তবে ভয় করব কেন? ... আপনি আমায় শয়তান বলবেন, আমার এ ঔদ্ধত্য দেখে কানে আঙুল দেবেন
জানি, – ওহ, তাই হোক! বিশ্বের সবকিছু মিলে আমায় ‘শয়তান পিশাচ’ বলে অভিহিত করুক, তবে
না আমার খেদ মেটে, একটু সত্যিকার আনন্দ পাই। আঃ! ... যে মানুষের স্রষ্টাকে ভয় করিনে
আমি, সেই মানুষকে ভয় করে আমার অন্তরের সত্যকে গোপন করব কেন? আমি কি এতই ছোটো, এতই
নীচ? আমার অন্তর মিথ্যা হতে দেব না!... হাঁ, কী বলছিলাম? আমি বিশ্বাসঘাতক – জল্লাদ!
বাঁশির সুরে হরিণীকে ডেকে এনে তার বুকে বিষমাখা তলওয়ার চালিয়ে আর ‘জহর-আলুদা’ তির
হেনেই আমার সুখ। সে কী আনন্দ ভাবিসাহেবা, সে কী আনন্দ এই হত্যায়! আমার হাত-পা-বুক
বজ্রের মতো শক্ত হয়ে উঠছে!
কী আমায় মাতাল করে তুলচে আর সঙ্গে সঙ্গে যে কোন্ অনন্ত যুগের
অফুরন্ত কান্না কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠচে বিষের মতো – তীব্র হলাহলের মতো! – আর
লেখার শক্তি নেই আমার! – ইতি।
নূরুল হুদা