বাঁধন হারা ছ সালার, ভাগ্যবতীসু, শুভাকাঙ্ক্ষিণী – তোর ভাবিজান
উপন্যাস
কাজী নজরুল ইসলাম
১২ই ফাল্গুন
আমার বুক-ভরা স্নেহ-আশিস নাও। তারপর কীগো সব ‘কলমিলতা’ ‘সজনে
ফুল’-এর দল, বলি – তোমরা যে-লতা যে-দলই হও তাতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই, কিন্তু পথের
পাশের এই ‘আলোক-লতা’, ‘ঘলঘসি ফুল’ দু-একটারও তো সেই সঙ্গে খবর নিতে হয়। তাতে তোমার
হয়তো কলসিভরা ভালোবাসাতে খাঁকতি পড়বে না। পোড়াকপাল আমাদের ভাই, তাই আমাদের আর কোনো
লতা-পাতা ফুল-ফল জুটল না। সে যা-ই হোক, এখন তোমার গুর্বী এই গরিব “ভাবিজি’কে কি
এক-আধখানা চিঠি-পত্তর দেবে? না, তাতে তোমার সখা-সখীর মধু-চিন্তায় বাধা পাবে? এখন
তোমাদের সই-এ সই-এ কত কথাই না হবে, আমাদের মতো তৃতীয় ব্যক্তির তাতে শুধু হাঁ করে
চেয়ে থাকাই সার। এখন ‘সজন সজন মিল গিয়া, ঝুট পড়ে বরিয়াত!’ আচ্ছা, দেখা যাবে, – এক
মাঘে শীত পালায় না! যদি তোমায় এই ঘরে আনতে পারি, তা হলে এই একচোখোমির হাড়ে-হাড়ে শোধ
তুলব। মনে থাকে যেন, আমি এখন এই ঘরের কর্ত্রীঠাকুরণ!
...আহা, যাক, ও-সব কথা। ‘ভাবি’র দাবি নিয়ে ননদের সাথে একটু
রঙ্গ-রসিকতা করে নিলাম বলে তুমি রাগবে না হয়তো? মনে কোরো না যেন যে, তুমি পত্র দাওনি
বলে আমি সত্যি-সত্যিই রেগেছি বা অভিমান করেচি। আমি এখানে সুখে দুটো ভাত গিলছি বলে
যে অন্যের বেদনও বুঝব না, খোদা আমায় এমন মন দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি। তুমি যে-কষ্ট
পাচ্চ সেখানে, তাতে আমায় পত্র না দিতে পারাটাই স্বাভাবিক। তবে ফিরতি বারে কোনো লোক
যদিই আসে আর তুমি সুবিধে করতে পার, তবে অন্তত গোটাকতক জরুরি কথাও লিখে পাঠিয়ো। সে
জরুরি কথা আর কিছু নয়, কেবল নূরুল পলটনে যাওয়ার আগে পরে কোনো চিঠি-পত্তর খবরাদি রাখ
কিনা, তাই একবার লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আমায় জানিয়ো। অবশ্য, এরকম অনুরোধ করাটা
বেজায় বেহায়াপনা, এর উত্তর দেওয়াটাও তোমার পক্ষে আরও বেশি লজ্জাকর ব্যাপার সন্দেহ
নেই, তবু বোন, বড়ো দায়ে পড়েই এরকম বেহুদা অনুরোধ করতে হচ্চে তোমায়। তুমি আমাদের আর
নূরুর সমস্ত অবস্থাটাই বুঝচ, কাজেই এ সময় – এই মরণ-বাঁচনের কথায় লজ্জা করলে চলবে
না। এখন নূরুকে ফিরিয়ে বাঁচিয়ে আনার জন্যে আমাদের চেয়ে তোমার দায়িত্বটাই বেশি, –
কেমন? যদি পার, একবার একটা চিঠি দিতে পার তাকে? ইস্, এতক্ষণ বোধহয় শরমে লাল হয়ে
উঠেছিস? ওগো, এমন ‘পেটে ভুখ্ মুখে লাজ’ করলে চলবে না! নিজের জিনিসকে যদি নিজে অবহেলা
করে হারাও, তা হলে আখেরে পস্তাতে হবে বলে দিচ্চি! তোমার মনের সত্যিকে বাইরে প্রকাশ
করবার শক্তি যদি থাকে, তাহলে এই লোক-দেখানো লৌকিকতার মুখ রাখতে গিয়ে কি নিজে
ভিখারিনি সাজবে? অবশ্য, আমি তোমাকে প্রেমের চিঠি লিখতে বলছিনে, শুধু দু-চারটি লাইনে
সোজা কথা, – ‘কেমন আছেন, খবর না পেয়ে বড্ড ছটফট করছি!’ ব্যস! তা হলে দেখবি, আমি বলে
রাখলাম, এতেই সে খুশির চোটে একেবারে দশ লাফ মেরে উঠবে।
সব কথা বলবার আগে এইখানে আমার দোষটা আগে প্রকাশ্যে কবুল করে ফেলি,
নয়তো তুমি আমার কথার ধরন-ধারণ দেখে গোলকধাঁধায় পড়ে যাবে। দোষটা আর কিছু নয়, কেবল
সোফিরা বাক্স থেকে তোমার চিঠিটা অতি কষ্টে চোরাই করে পড়ে ফেলেছি! অবশ্য, অন্য কাউকে
তা দেখাইনি বা শুনাইনি। এটা পড়বার পরে হয়তো দোষের বলে ভাবতে পারি, কিন্তু অন্তত
চিঠিটা গাপ করবার সময় এ কথাটি মনে হয়নি। পাছে আমার এ রকম ত্রুটি স্বীকারে ‘ঠাকুর ঘরে
কে রে, – না, কলা খাইনি’- রূপ হাস্যাস্পদ কৈফিয়তের সন্দেহ তোমার মনটাকে সশঙ্ক চঞ্চল
করে তোলে, তাই এই আগে থেকেই কৈফিয়ত কাটলাম। তুমি এতে রেগো না বোন। কারণ আমি
নিঃসন্দেহে ঘোষণা করতে পারি যে, মেয়েদের এই চুরি স্বভাবটা কিছুতেই যাবে না, তা তাঁরা
এটা এড়িয়ে চলবার যতই কেন কসরত দেখান না। ‘ইল্লত যায় না ধুলে, আর খসলৎ যায় না মলে এই
ডাক-পুরুষে কথাটি একদম খাঁটি সাচ্চা বাত। গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতিতে যে-সব
বাছা-বাছা চিজ চুরি করার অপরাধে অপরাধিনী করা হয় (যেমন কী, মন চুরি, প্রাণ চুরি
ইত্যাদি) আমি সে-সব চুরির কথা বলছিনে, কিন্তু মেয়েদের এই চুরি করে আড়ি পেতে অন্যের
কথা শোনা, চুরি করে দেখা, চুরি করে অন্যের পত্রটি বেমালুম গাপ করে নিদেনপক্ষে একবার
পড়ে নেওয়া, এই চুরিগুলো যে ভদ্র-মহিলা ঝুটা বলে উড়িয়ে দেবেন তিনি যে সত্য কথা বলছেন
না, এ আমি কারুর মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি! এ বিদ্যা যে আমাদের মজ্জাগত, জন্মগত।
যাক –।
তোমার চিঠিতে যা সব লিখেছ, তা নিয়ে আর তোমায় লজ্জা-রাঙা করে
তুলব না। আমার পক্ষে ও আলোচনা অন্যায়, কেননা আমি নাকি তোমার মহামাননীয়া ভাবি সাহেবা,
পূজনীয়া শিক্ষয়িত্রী অর্থাৎ একাধারে দুটো মস্ত আদব-কায়দা দাবি-দাওয়াকারিণী। তোমাদের
মতো এরকম বিশ্রী হলেও কই আমি তো তোমাদের কখনও এরকম বিশ্রী শিক্ষা দিইনি। আমি
ভালোবাসতে স্নেহ দিতে শিখিয়েচি, কিন্তু ভয় করে ভক্তি করাটা কখনও শিক্ষা দিইনি।
অবশ্য আমায় ভালোবাস, না ভক্তি কর, জানি না। যদি কোনোদিন ওরকম পাঠশালের ছেলের
গুরুমশাইকে ভক্তি করার মতো আমাকে ভয়-ভক্তি করে থাক, তবে এখন থেকে আর তা কোরো না!
এটুকু না লিখে পারলাম না বলে তুমি যেন কষ্ট পেয়ো না।
তোমার দুঃখ-কষ্টের কথাগুলি আমার বুকে তিরের ফলার মতো এসে বিঁধেচে।
তুমি কি বুঝবে মাহ্বুবা, আমি যখন আসি তুমি তখন ছিলে পাড়াগাঁয়ের সাদাসিদে অশিক্ষিতা
সরলা বালিকা, আমিই যে তোমায় এত কষ্ট করে এতদিন ধরে মনের মতোটি করে গড়ে তুলেছি।
তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে আমার নববধূ কালটা বড্ড আনন্দেই কেটে গিয়েছে। সোফিটা বড়ো
দুষ্টু, সে তো আর তেমন শিখতে পারলে না, কিন্তু তোমার ওই বিদ্রোহ-অভিমান-মাধুর্যের
সাথে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ আমায় তোমাকে একটু বেশি করেই ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল। তার পর
যখন শুনলাম তুমি আমাদেরই ঘরের বউ হয়ে থাকবে, তখন সে কী যে আনন্দে আর গর্বে আমার
প্রাণ শতধারে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, সে বললে তুমি হয়তো বাড়াবাড়িই মনে করবে। আগে যখনই মনে
হত, আমার পোষা-পাখি-তুমি হয়তো অন্য কারু সোনার খাঁচায় বন্দিনী হয়ে কোন্ দূরে দেশে
চলে যাবে, তখন একটা হিংসুটে বেদনায় যেন আমি বড্ড অসুস্থতা অনুভব করতাম। এ ভাবটা
কিন্তু আমার মনে জেগেছিল নূরুল হুদা আমাদের বাড়ি আসবার পর থেকে। তোমাদের দুজনকে
দেখলেই আমার মনে মধুর একটা আকাঙ্ক্ষা রঙিন হয়ে দেখা দিত, কিন্তু নূরুর খাম-খেয়ালির
ভয়ে, আর বনের পাখি পাছে আবার বনে উড়ে যায় এই শঙ্কায় আমি কোনো দিনই এ কথাটা পাড়তে
সাহস করিনি। আমার এ মন-গুমরানি শেষে যখন অসহ্য হয়ে দাঁড়াল, তখন সবাইকে বলে-কয়ে
বুঝিয়ে এক রকম ঠিক করলাম, কিন্তু বনের পাখি পোষ মেনেও মানলে না। সে চলে গেল! মিঠা
আর আঠা এই দুটোর লোভকেও সে সামলাতে পারছিল না, কিন্তু শেষে ডানা-কাটার ভয়টাই তার হয়ে
উঠল সবচেয়ে বেশি, তাই সে উড়ে গেল! আমার এই অতিরিক্ত স্নেহের বাড়াবাড়ির জন্যে আজ
আমার যা কষ্ট, তা এক আল্লাই জানেন বোন, আর আমিই জানি। এক এক দিন সব কথা আমার মনে হয়,
আর বুক ফেটে পড়বার মতন হয়ে যায়! তোদের দুইজনের কাকে যে বেশি স্নেহ করতাম, তা
কোনোদিন আমি নিজেই বুঝতে পারতাম না, তাই তোরা দুটিতেই আমার চোখের সামনে থাকবি,
আমোদ-আহ্লাদ করবি আর আমারও দেখে জান ঠান্ডা হবে, চোখ জুড়াবে ভেবেই এমন কাণ্ড করতে
গিয়েছিলাম, কিন্তু হয়ে গেল আর এক! এই যে মধ্যে গোলমাল হয়ে এত বড়ো একটা তাল পাকিয়ে
গেল এতেও আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, আমার যেন আশা হচ্চে খোদা তোদের দু-হাত এক করবেন।...
কিন্তু এইখানে একটা মস্ত কথা মনে পড়ে গেল ভাই, সত্যি কথা বলবি বোন আমার? নূরুর পলটনে
চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তোকে যেন কেমন মন-মরা দেখাচ্চিল, – কী যেন চাপা ব্যথা
তোর দেহে কাজে-কথায় অলস-ম্লান হয়ে তোকে মুষড়ে দিচ্ছিল, – আচ্ছা, আমার এ ধারণাটা
সত্যি নয় কি? আজ এত দিনে এ কথাটা বলছি, তার কারণ তখন আহ্লাদের আবেশে ওটা আমি দেখেও
দেখিনি। দেখলেও ভুল মনে হয়েছিল যে, বিয়ের আগে জোয়ান মেয়ের ওরকম হওয়াটা বিচিত্র নয়।
তাই তখন যেন তোর ও মলিনমূর্তি দেখেও বেশ আলাদা রকমের একটা সুখ অনুভব করতাম। মানুষ
কাছে থাকলে তাকে ঠিক বুঝে উঠবার অবসর হয়ে ওঠে না, তার নানান কাজ নানা হাব-ভাব
কথা-বার্তা ইত্যাদি বাইরের জিনিসগুলোই মনকে এমন ভুলিয়ে রাখে যে, সে তার ভিতরকার কাজ
অন্তরের আসল মূর্তিটার কথা একেবারেই ভেবে দেখতে পায় না। তার পর সে যখন চলে যায়, তখন
তারই ওই কাজের সমস্ত খুঁটিনাটিগুলি অবসর-চিন্তায় এসে বাধা দেয়, আর তখন একে একে
বদ্ধফুলের হঠাৎ পাপড়ি-খোলার মতন তার অন্ধদৃষ্টিও যেন খুলে যেতে থাকে এবং ক্রমেই সে
তার অন্তরের অন্তরতম ভাবগুলিকে যেন বুঝতে পারে। তাই আজ তোরা দুজনেই যখন আমার কাছ
থেকে দূরে সরে গেলি তখনই বুঝলাম যে, নাঃ, তোদের দুজনেরই মাঝে কী যেন একটা বেদনার
ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে চলেছিল, যেটার সীমা আজ কেউ দেখতে পাচ্চিনে। কী সে ব্যবধান? কী
হয়েছিল তোদের? বলবি বোন আমার? বলবি ভাই আমায়?
জানি না বোন, তোদের এই বেহেশ্তের ফুল দুটির পবিত্র ভালোবাসায়
কার অভিশাপ ছিল। তোরা যে উভয়ে উভয়কে হৃদয়ের নিভৃততম মহান আসনে বসিয়ে বুকের সমস্ত
ঐশ্বর্য দিয়ে অর্ঘ্য বিনিময় করতিস, তা আমার চক্ষু কোনোদিনই এড়ায়নি। তোরা হাজার
ছল-ছুতো আসিলা করে খুব মস্ত মাথা নাড়া দিয়ে ‘না – না’ বললেও – ওরে, তোদের প্রাণের
ভাষা যে চোখে-মুখে লাল অক্ষরে লেখা হয়ে ধরা পড়ত! পুরুষদের কথা বলতে পারিনে, কিন্তু
এ জিনিসগুলো মেয়েদের চোখ এড়ায় না, তা তারা যতই উদাসীন ভাসা-ভাসা ভাব দেখাক। তার
কারণ বোধ হয়, এদিক দিয়ে অধিকাংশ মেয়েই ভুক্তভোগী। তাছাড়া, মেয়েদের আবার মন নিয়েই
বেশির ভাগ কারবার। স্নেহ-ভালোবাসা – সোহাগ-যত্ন রাতদিন তাদের ঘিরে রয়েছে, তাদের
বুকের ভেতর ঝরনাধারার মতো নানান দিকে পথ কেটে বিচিত্র গতিতে বয়ে চলেছে আর সহস্র
ধারায় বিলিয়েও এ অফুরন্ত স্নেহ-দরদ তাদের এতটুকু কমেনি। সে-কোন্ অনন্ত স্নেহময়ী
মহানারীর স্নেহ-প্রপাত যেন এ নিঝর-ধারা উৎস! আমরা মা বোন স্ত্রী কন্যা বধূ হয়ে
সংসার-মরুর আতপতপ্ত পুরুষ-পথিকের পথে মরূদ্যান রচনা করছি, তাদের গদ্যময় জীবনকে
স্নেহ-কবিতা সৌন্দর্য-মাধুর্যে মণ্ডিত করে তুলছি, তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রাকে
সুনিয়ন্ত্রিত করে দিচ্ছি, – ভালোবাসা দিয়ে সব গ্লানি সব ক্লান্তি সব নৈরাশ্য
দৈন্য-আলাই-বালাই মুছে নিচ্ছি, – আমাদের কাছে তাই ফাঁকি চলে না! আমরা সবজান্তার জাত।...
তাই, আমি তোদের এই চোরের মতো সন্ত্রস্তভাব দেখে (আর, বড়ো লজ্জার কথা, সেই সঙ্গে তোর
বেহায়া ভাইঝিও) মুখ টিপে হাসতাম। মানব-প্রাণের এই যে বাবা-আদমের কাল থেকে
সৌন্দর্যের প্রতি প্রাণের প্রতি মানুষের টান, প্রাণের টান, গোপন পূজা – একে মানুষ
কখনও ঘৃণা করতে পারে না ; অবশ্য নীচমনা লোকেদের কথা বলছি না। তাই তোদের দুজনারই
মধ্যে ওই যে একটা মজার টানা-হেঁচড়ার ভাব, লাজ-অরুণ সংকোচ আর সবচেয়ে ওই
ঘটি-বাটি-চুরি-করা ছেঁচকি চোরের মতো ‘এই বুঝি কেউ দেখে ফেললে রে – এই ধরা পড়লাম রে’
ভাব আমাদের যে কী আনন্দ দিত, তা ঠিক বোঝানো যায় না। বিপুল একটা তৃপ্তির গভীর
স্বস্তিতে আমাদের দুজনারই বুক ভরে উঠত। তোর সদানন্দ ভাইটির তো দু-এক দিন চোখ ছলছল
করে উঠত। আর পাছে আমার কাছে ধরা পড়ে অপ্রতিভ হয়ে যান, তাই তাড়াতাড়ি ‘ধ্যেৎ, চোখে
কী-ছাই পড়ে গেল’ বলে চোখ দুটো কচলাতে থাকতেন, নয়তো এসরাজটা নিয়ে সুর বাঁধায় গভীর
মনোনিবেশ করতেন। আহা, খাপছাড়া আশ্বিনের এক টুকরো শুভ্র সজল চপল মেঘের মতো নূরু, যা
কভু জমে হয়ে যায় শক্ত তুহিন, আবার গলে ঝরে পড়ে যেন শান্ত বৃষ্টিধারা, –
মন্দার-পারিজাতের চেয়েও কোমল, পাহাড়-ছোটা-ঝরনা-মুখের চেয়েও মুখর, শিশুর চেয়েও সরল
হাসিভরা, পবিত্রতা-ভরা প্রাণ, স্নেহহারা বাঁধন-হারা নূরু, – সে আবার সংসারী হবে,
তোর কিরণ-ছটায় তার সজল মেঘলা জীবনে ইন্দ্রধনুর সুষমা-মহিমা আঁকা যাবে, – ওঃ, সে কী
দৃশ্য বেহেশ্তে হুর-গেলেমান, বা স্বর্গে অপ্সরি-কিন্নরী বলে কোনো প্রাণী থাকলে এ
খোশখবরের ‘মোজদা ’ তারা স্বর্গের দ্বারে দ্বারে বিলিয়ে এসেছিল, মেওয়া-মিষ্টির খাঞ্চা
ঘরে ঘরে ভেট দিয়েছিল!
আমরা তোদের এই পূর্বরাগকে কেন প্রশ্রয় দিতাম জানিস? হাজার
অন্দরমহলের আড়াল-আবডালের ছাপা থাকলেও আমাদের অনেকের জীবনেই এমন একটা দিন-ক্ষণ আসে,
যখন একজনকে দেখেই প্রাণের নিভৃত পুরে কোনো অনুরাগের গোলাবি ছোপের দাগ লেগে যায়। এ
অনুরাগ আবার অনেক সময় ভালোবাসাতেও পরিণত হতে দেখা যায়, আর সেটা কিছুই বিচিত্র নয়।
অবশ্য তা কারুর হয়তো সফল হয়, কারুর বা সে আশা মুকুলে ঝরে পড়ে, আবার কেউ হয়তো সাপের
মানিকের মতন মর্মর মর্মে তাকে আমরণ লুকিয়ে রাখে, – তার অন্তর্যামী ভিন্ন অন্য কেউ
ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারে না। আমার কথা তো জানিস। আমার বাবাজান যখন সাবজজ হয়ে
বাঁকুড়ায় বদলি হলেন, তখন আমার বয়স পনেরো-ষোলোর বেশি হবে না। তখনও আমি থুবড়ো। তাই
মাজানের চাড়ে আমার শাদির জন্যে বাবাজান একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আজকাল বাপ-মা-রা
মহাজন-বিদায় বা ঘরের আবর্জনা ঝেঁটিয়ে ফেলার মতোই যেন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চায়,
ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমাকে ওরকম অনহেলা হেনেস্থা সইতে হয়নি। বড্ড আদরেই মানুষ হয়েছিলাম
বোন, বাপের একটি মেয়ে – বাবাজান তো আমায় ‘আম্মাজান’ আম্মাজান’ করে আদর-সোহাগ দিয়ে
হয়রান করে ফেলতেন। সবচেয়ে তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল আমায় লেখাপড়া শেখাবার। এর জন্য কত টাকা
যে খরচ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমার ঘরই তো একটি জবরদস্ত লাইব্রেরি ছিল, তার ওপর
আবার এক ব্রাহ্ম শিক্ষয়িত্রী রেখে আমায় নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। লোকে, বিশেষ
করে গোঁড়া হিন্দুরা, কেন যে ভাই ব্রাহ্মদের ঠাট্টা করে, আমি বুঝতে পারিনে! আমার বোধ
হয় ও শুধু ঈর্ষা আর নীচ-মনার দরুন। ভালো-মন্দ সব সমাজেই আছে, তাই বলে যে অন্যের
বেলায় শুধু মন্দের দিকটাই দেখে ছোটোলোকের মতো টিটকিরি মারতে হবে এর কোনো মানে নেই।
আমার পূজনীয়া শিক্ষয়িত্রী ওই ব্রাহ্ম মহিলার কথা মনে পড়লে এখনও একটা বুক-ভরা পবিত্র
ভক্তিতে আমার অন্তর মন যেন কানায় কানায় ভরে ওঠে। এত মহিমান্বিতা মাতৃশ্রী- মণ্ডিতা
যে ধর্মের নারী, এত অনবদ্য পূত শালীনতা ও সংযমবিশিষ্টা যে সমাজের নারী সে ধর্মকে সে
সমাজকে আমি সালাম করি। আমি তাঁকে মায়ের মতোই ভক্তি করতে পেরেছিলাম, ভালোবাসতে
পেরেছিলাম এমনই স্নেহ-মাধুর্যে পবিত্র স্নিগ্ধতায় ভরা ছিল তাঁর ব্যবহার! মা কত দিন
এসে হেসে বলতেন, – ‘দিদি, তুমি আমার রেবাকে মা ভুলিয়ে দিলে দেখচি।’ তিনিও হেসে
বলতেন, – ‘তা বোন, আজকালকার মেয়েগুলোই নিমকহারাম, আজ তোমাকে ছেড়ে আমাকে মা বলচে,
আবার দু-দিন বাদে শাশুড়ি গতরখাকিকে মা বলবে গিয়ে। আর তাছাড়া আমার সাহসিকাও তোমার
নাম করতে পাগল। সে আবার আপশোশ করে যে, কেন তোমার পেটে সে জন্মায়নি। এখন এক কাজ করি
এসো, আমরা মেয়ে বদল করি।’ তুই বোধহয় শুনেছিস যে, ওঁর সাহসিকা বলে আমারই বয়সি একটি
মেয়ে ছিল। তাতে আমাতে এত গলায়-গলায় মিল ছিল, তা যদি শুনিস তো তুই অবাক হয়ে যাবি।
আমার সে শিক্ষয়িত্রী-মা আজ আর নেই, – আজ এই কথাটি মনে হতেই দেখেছিস টস টস করে আমার
চোখ দিয়ে জল বেয়ে পড়ল! সাহসিকা বি. এ. পাস করে এখন এক স্কুলের প্রধানা শিক্ষয়িত্রীর
কাজ করছে। প্রথম জীবনেই সে বুকে মস্ত এক দাগা পেয়ে বিয়ে-টিয়ে করেনি, চিরকুমারী থাকবে
বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। সে এখনও মাঝে মাঝে আমায় চিঠি দেয়, সে চিঠিগুলোর এক একটা অক্ষর
যেন বুক ফাটা কান্নার অশ্রুফোঁটা। তুই যদি আসিস তা হলে এবার সব চিঠিগুলো তোকে দেখাব।
আঃ, সে কতদিন তাতে আমাতে দেখা নেই. তবু তার কথাটা যখনই মনে হয় তখনই যেন জানটা
সাতপাক মোচড় খেয়ে ওঠে। আমার বিয়ের সময় তার কী আমোদ! তাঁরা সবাই আমার বিয়েতে
এসেছিলেন। আজ আমার মাও নেই, তারও মা নেই, তাঁরা বোধ হয় বেহেশ্তে গিয়ে আবার একসঙ্গে
মিলেছেন, তাঁদের এই অভাগি মেয়েদের জন্যে সেখানেও জান খাঁ খাঁ করে কিনা, কান্না পায়
কিনা, তা কে জানে? অন্য কোনো জাতির কোনো ধর্মের কোনো সমাজের নারীর মধ্যে কই
নারীত্বের এমন পূর্ণ বিকাশ তো দেখিনি। এই সমাজের যত নারী দেখেছি, সবারই ব্যবহার
কথাবার্তা এত সুন্দর আর মিষ্টি যে, তাতে বনের পাখিরও ভুলে যাওয়ার কথা, এঁদের বুকে
যেন স্নেহের ভরা গঙ্গা বয়ে যাচ্চে! যারা একে বাড়াবাড়ি বলে বা মানে না, উলটো নিন্দা
করে, তারা বিশ্বনিন্দুক। আমার বোধহয় এঁরাই এদেশে সর্বাগ্রে সামাজিক পারিবারিক যত
অহেতুক খামখেয়ালির বন্ধনকে কেটে স্বাধীন উচ্চশির নিয়ে মহিমময়ী রানির মতো দাঁড়িয়েছেন
বলেই দেশের অধীনতা-পিষ্ট বন্ধন-জর্জরিত লোকের এত বুক-চড়চড়ানি। এঁদের সঙ্গে যে খুব
সহজ সরল স্বচ্ছন্দে প্রাণ খুলে মিশতে পারা যায়, এইটেই আমাকে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি।
এঁদের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগ বা ছুতমার্গের ব্যামো নেই, কোনো সংকীর্ণতা, ধর্মবিদ্বেষ,
বেহুদা বিধি-বন্ধন নেই। আজ বিশ্ব-মানব যা চায় সেই উদারতা সরলতা সমপ্রাণতা যেন এর
বাইরে ভিতরে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো রয়েছে। আমরা বড়ো বড়ো হিন্দু পরিবারের সঙ্গেও মিশেছি,
খুব বেশি করেই মিশেছি এবং অনেক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে খুব ভাবও হয়েছিল, কিন্তু এমন
দিল-জান খোলসা করে প্রাণ খুলে সেখানে মিশতে পারিনি। কোথায় যেন কী ব্যবধান থেকে
অনবরত একটা অসোয়াস্তি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। আমরা তাঁদের বাড়ি গেলেই, তাঁরা হন আর
না হন, আমরাই বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি, – এই বুঝি বা কোথায় কী ছোঁয়া গেল, আর অমনি
সেটা অপবিত্র হয়ে গেল। আমরা যেন কুকুর বেড়াল আর কী! তাঁরাও আমাদের বাড়ি এসে পাঁচ-ছয়
হাত দূরে দূরে পা ফেলে ড্যাং পেড়ে পেড়ে আসেন, পাছে কোথায় কী অখাদ্য কুখাদ্য মাড়ান।
এতে মানুষকে কত ছোটো হয়ে যেতে হয়, তার বুকে কত বেশি লাগে। এখনও দেশে পনেরো আনা
হিন্দুর সামাজিকতা এই রকম আচার-বিচারে ভরা। যাঁরা শহরে থেকে বাইরে খুব উদারতার ভান
দেখান তাঁদের পুরুষরা যাই হন, মেয়েদের মধ্যে এখনও তেমনই ভাব। ভিতরে এত অসামঞ্জস্য
ঘৃণা-বিরক্তি চেপে রেখে বাইরের মুখের মিলন কি কখনও স্থায়ী হয়? এ মিথ্যা আমরা উভয়েই
মনে মনে খুব বুঝি কিন্তু বাইরে প্রকাশ করিনে। পাশাপাশি থেকে এই যে আমাদের মধ্যে এতো
বড়ো ব্যবধান, গরমিল – এ কী কম দুঃখের কথা? আমাদের আত্মসম্মান আর অভিমান এতে দিন
দিনই বেড়ে চলেছে। আমরা আর যাই হই, কিন্তু কেউ হাত বাড়িয়ে দিলে বুক বাড়িয়ে তাকে
আলিঙ্গন করবার উদারতা আমাদের রক্তের সঙ্গে যেন মেশানো। তাই এই অবমাননার মধ্যে হঠাৎ
এই ব্রাহ্মসমাজের এত প্রীতিভরা ব্যবহার যেন এক-বুক অসোয়াস্তির মাঝে স্নিগ্ধ শান্ত
স্পর্শের মতো নিবিড় প্রশান্তি নিয়ে এসেছে। আমাদের ঘরের পাশের হিন্দু ভগিনীগণ যখন
এমনি করে মিশতে পারবেন, তখন একটা নতুন যুগ আসবে দেশে। আমি জোর করে বলতে পারি, এই
ছোঁয়া-ছুঁয়ির উপসর্গটা যদি কেউ হিন্দুসমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই
হিন্দু-মুসলমানের একদিন মিল হয়ে যাবে। এইটাই সবচেয়ে মারাত্মক ব্যবধানের সৃষ্টি করে
রেখেছে, কিন্তু বড়ো আশ্চর্যের বিষয় যে, হিন্দু-মুসলমানে মিলনাকাঙ্ক্ষী বড়ো বড়ো
রথীরাও এইটা ধরতে পারেননি, তাঁরা অন্য নানান দিক দিয়ে এই মিলনের চেষ্টা করতে গিয়ে
শুধু পণ্ডশ্রম করে মরচেন। আদত রোগ যেখানে, সেখানটা দেখতে না পেয়ে কানা ডাক্তারের
মতন এঁরা একেবারে মাথায় স্টেথিস্কোপ বসিয়ে গম্ভীরভাবে রোগ ও ওষুধ নির্ণয়ের চেষ্টা
করছেন। এই ‘ছুতমার্গ’ দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বের করতে আমাদের হিন্দু মা-বোনদেরই চেষ্টা
করতে হবে বেশি। কেননা পুরুষদের চেয়ে এঁদেরই এ বদ-রোগটা ভয়ানক মজ্জাগত। আজকাল অনেক
হিন্দু ভদ্রলোক, বিশেষ করে নব্য সম্প্রদায় (যুবক প্রৌঢ় দুই) খুব প্রাণ খুলে একসঙ্গে
আমাদের পুরুষদের সঙ্গে বসে আহার করেন, আলাপ করেন, এতটুকু ছোঁয়া যাওয়ার ভয় নেই।
কিন্তু আমাদের হিন্দু ভগিনীরা হাজার শিক্ষিতা হলেও অমনটি পারে না। এটা তাদের ধর্মের
অঙ্গ কিনা জানি না, কিন্তু আমার বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ধর্মই এত অনুদার হতেই পারে না,
এ নিশ্চয়ই সমাজের সৃষ্টি। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সমাজের সংস্কার হওয়া উচিত নয় কি? –
হায় কপাল! দেখেছিস কী লিখতে গিয়ে কী সব বাজে বকলাম! আমি এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম, যে
তোকে চিঠি লিখছি। এ কথাগুলো লিখবার সময় আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি সাহসিকাকে চিঠি
লিখচি, কারণ, তাতে আমাতে এই মতো আলোচনাই হয় বেশি। থাক যা লেখা গেল ঝোঁকের মাথায়,
তাকে অনর্থক ছিঁড়ে ফেলেই বা কী হবে? ভালো লাগে তো পড়িস, নয়তো ও জায়গাটুকু বাদ দিয়েই
পড়িস। এখন আমার সেই হারানো কাহিনিটা আবার ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করি।
হাঁ, তারপর ঠিক সেই সময় কী সব জমিদারি ব্যাপার নিয়ে না কী জন্যে
আমার শ্বশুর সাহেব মরহুম তখন বাঁকুড়াতেই সপরিবারে বাস করছিলেন। আর তোমার এই গুণধর
ভাইজি বাঁকুড়ার কলেজে পড়ছিলেন। আমাদের বাসা একরকম কাছাকাছিই ছিল, কাজেই অল্প দিনের
মধ্যেই আমাদের সঙ্গে এঁদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়, আর তখনই আমার বিয়ের কথা ওঠে।
আমাদের ‘ইনি’ (বর্তমানে ‘খুকির বাপ’) অর্থাৎ তোমার ভাইজি তখন কী জানি কেন আমাদের
বাড়ি ঘন ঘন যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। ওঁর নানা অসিলা করে হাজারবার আমাদের বাড়ি আসা আর
একবার আড়চোখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ফস করে চারিদিকে চেয়ে-নেওয়া দেখে আমার খুব হাসিও
পেত, আবার বেশ মজাও লাগত। তিনি এক-আধ দিন বিশেষ কাজে আসতে না পারলে ক্রমে আমারও মনটা
যেন কেমন উড়ু উড়ু উদাসীন ভাব বোধ হত। দুষ্ট সাহসিকা তো এই নিয়ে আমায় গান শুনিয়ে
টিপনি কেটে একেবারে অস্থির জ্বালাতন করে ফেলত! অবশ্য, তখনও আমাদের দেখা-শোনা হয়নি,
– আমাদের বললে ভুল হবে, কেননা আমি নানা রকমে তাঁকে দেখে নিতাম, কিন্তু পুরুষদের
দুর্ভাগ্যই এই যে, কোনো সুন্দর মুখ আড়াল থেকে তাকে দেখচে কিনা বেচারা ঘুণাক্ষরেও তা
জানতে পারে না। সাহসিকা দু-এক দিন দুষ্টুমি করে আমার ঘরে বেশ একটু জোর গলায়, যাতে
উনি শুনতে পান, গান জুড়ে দিত –
সখী, প্রতি দিন হায় এসে ফিরে যায় কে?
তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে।
তখন যদি তোমার এই শান্তশিষ্ট ভাইটির ছটফটানি দেখতে! আল্লাহ! হাঁ করে তাকিয়ে এদিক
ওদিক দেখচেন, কখনও বা গভীর মনোনিবেশ সহকারে চুপ করে বসে গম্ভীর হয়ে পড়ছেন, আবার
কখনও বা কবির মতো মাথার চুলগুলো খামচে ধরে মস্ত লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন! আমরা তো
দু সই-এ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে লুটিয়ে পড়তাম! বাবা, এত বেহায়াও হয় পুরুষে? ছিঃ
মা! এখন তোর ভাইজিকে সে কথা বললে, তিনি বলেন যে, গানটা বড্ড বেসুরো শুনাতো বলে তিনি
ওরকম করে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন! হায় আল্লাহ! এত মিথ্যাবাদীও হয় মানুষে। আজকাল
আমাদের অনেক মিয়াঁ-সাহেবরাই জোর গলায় বলচেন, অনেকে আবার লিখেও জানাচ্ছেন যে, আমাদের
এ হেরেমের পাঁচিল পেরিয়ে পূর্বরাগ এ জেনানা ঘরে ঢুকতেই পারে না। হায় রে অন্ধ
পুরুষের দল! এঁরা ঠিক যেন চোখে ঠুলি-পরা কলুর ঘানির বলদ। এঁরা খালি সামনেটাই দেখতে
পান, আশে-পাশের খবর একদম রাখেন না। এঁদের এই দৃষ্টিহীনতা দেখে আমার মতো অনেকেই
লুকিয়ে হাসে। আমি এঁদের লক্ষ করে জোর গলায় বলতে পারি, – ‘ওগো কানা বলদের দল! বিয়ের
আগেও হেরেমের বা অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের মনে পূর্বরাগের সৃষ্টি হওয়াটা কিছুই বিচিত্র
নয়!’ তোমরা তো আর জোয়ান মেয়ের বা যুবক ছোকরার মন বোঝ না, সোজা খাও দাও আর উপর দিকে
হাঁ করে তাকিয়ে তারা গোনো। তবে তোমাদের ভাগ্যি বলতে হবে যে, অনেক পোড়ারমুখিরই এই
পূর্বরাগটা অধিকাংশ সময় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়, নইলে এমনই একটা কেলেঙ্কারির সৃষ্টি
হত যে, এ পুরুষরা এ কথার ঠিক উলটো বলতেন। কত অভাগির মনে যে ওই অঙ্কুর আবার মহিরূহে
পরিণত হয়ে ওঠে, আবার কত জনা যে মনের বেদন মনেই চেপে তুষের আগুনের মতন ধিকি ধিকি করে
পুড়ে ছাই হয়, কে তার খবর রাখে? কে তা জানতে চায়? জানলেও কার বুকে তার বেদন বাজে?
একটা কাচের বাসন ভাঙলেও লোকে ‘আহা’ করে, কিন্তু বুক ভাঙলে, হৃদয় ভাঙলে, জেনেও কেউ
জানতে চায় না, ‘আহা উহু’ করা তো দূরের কথা। কিন্তু কোনো ‘মুখপুড়ি’ যদি কুলে কালি
দিয়ে ভেসে যায়, তখন এদের আস্ফালনে গগন বিদীর্ণ হয়ে যায়। পুরুষরা এত সুবিধে করে উঠতে
পেরেছেন, তার কারণ মেয়েরা মুখ থাকতে বোবা, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না! – এই নে, ফের
কোথায় সরে পড়েছি।-
তারপর বোন, সত্যি বলতে কী, তোর এই সোজা মানুষ ভাইটিকে ক্রমেই
আমার বেশ ভালো লাগতে লাগল। বিশেষ করে এঁর কণ্ঠ-ভরা গান আমার কানে বড্ড মিষ্টি শুনাত।
পরে জেনেছি, এই ভালো লাগাটাই হচ্চে পূর্বরাগ। এখন মনে হয়, পুরোপুরি ভালোবাসার চেয়ে
এই পূর্বরাগের গোলাবি রাগটারই মাদকতা আর মাধুর্য বেশি, এর পাতলা অরুণ ছোপ বুকে
নিবিড় হয়ে না লাগলেও এর তখনকার রঙটা বেশ চমকদার। যদিও আমি থাকতাম অন্তঃপুরের
অন্তরতম কোণে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে, তবুও ওঁর পায়ের ভাষা আমি অতি সহজেই বুঝে ফেলতাম।
রোজ সন্ধ্যা হওয়ার অনেক আগে থেকেই তাঁর গান শোনবার জন্যে আমি উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম, –
কেননা তিনি মনুকে গান শিখানোর অসিলাতেই অন্য সময় ছাড়া সন্ধেটাতে রোজ আসতেন আর
শেখানোর চেয়ে নিজে গাওয়াটা বেশি পসন্দ করতেন : কেননা নিশ্চয়ই তাঁর এ আশা থাকত যে
একটি তরুণ প্রাণী লুকিয়ে থেকে তার গান শুনছে। ... আমার এই উন্মনা ভাবটা অন্তত মায়ের
চক্ষু এড়ায়নি, এটাও আমি বুঝতে পারতাম। এইখানে আর একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক, –
আমাদের পূর্বরাগটা একতরফা হয়নি অর্থাৎ শুধু আমি নয়, তোমার ভাইজিকেও নাকি ওই একই
রোগটায় বেশ একটু বেগ পেতে হয়েছিল। কেননা আমাদের বিয়ে হওয়ার পর এই সত্যবাদী ভদ্রলোক
মুক্তকণ্ঠে আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, কোনো এক গোধূলি-লগ্নে সদ্যস্নাতা
আলুলায়িতা-কেশা আমায় তিনি আমাদের মুক্ত বাতায়নে উদাস আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন,
তা ছাড়া আরও দু-একদিন – কোনো দিন বা আঁচলের প্রান্ত, কোনো দিন বা চুলের একটি গোছা,
কোনো দিন বা ঈষৎ ‘আবছা’ চোখের চাওয়া, আবার অভাবে কোনো দিন বা চাবির রিং-এর বা রেশমি
চুড়ির রিনিঝিনি – এই রকম যত সব ছোটো-খাটো পাওয়ার আনন্দেই তিনি একেবারে ‘রাশি রাশি
ভাঙা হৃদয়ের মাঝারে’ তাঁর হৃদয় হারিয়ে ফেলেছিলেন! তা নাহলে তিনি এতদূর নিঃস্বার্থ
পরোপকারী হয়ে ওঠেননি যে, পরের বাড়ি গিয়ে এতবার এতক্ষণ ধরে ধন্না দিয়ে আসেন। তাঁর
অবস্থা নাকি আবার আমার চেয়েও শোচনীয় হয়ে পড়েছিল এই বিরহ-ভোগের ঠেলায়, আর তারই
প্রমাণস্বরূপ এমন ভালো ছেলে হয়েও সেবার তিনি বি.এ. ফেল করলেন। অগ্রেই সত্যিকার বিয়ে
পাশ করে ফেলার দরুণেই নাকি তিনি সেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ.টা পাশ করতে পারেননি।
সাহসিকাই এই কথাটা ওঁকে লিখে জানিয়েছিল, সে আরও লিখেছিল যে, আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ে
ডবল ‘অনার্স’ উঠে গিয়েছে কিনা, তাই ‘বিয়ে’ অনার্সের পর আর একটা অনার্স মঞ্জুর হল
না! – এইখানে আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো! আমাদের অনেক ঘরের কথা তোকে
জানিয়ে দিলাম এই জন্যে যে, তোর উপন্যাস আর গল্প পড়ার ভয়ানক সখ। আর এটা নিশ্চয় জানিস
যে, গল্প-উপন্যাস সব মনগড়া কথা, তাই আমাদের এই সত্যিকার ঘটনাটা তোকে উপন্যাসের
চেয়েও হয়তো বেশি আনন্দ দেবে। এতে আমার লজ্জার কিছুই নেই, আর এরকম করে বলা বা লেখাও
মেয়েদের পক্ষে কিছুই কঠিন নয়। মেয়েরা যা একটু লজ্জাশীলা থাকে বিয়ের আগেই, তারপর বিয়ে
হয়ে গেলেই (তাতে যদি ছেলের মা হল, তাহলে তো কথাই নেই) তাদের সামনে দিকটার এক হাত
ঘোমটা পিছন দিকে দু-হাত ঝুলে পড়ে। তাছাড়া এ আমাদের ননদ-ভাজের ঘরোয়া গোপন চিঠি, এ তো
আর অন্য কেউ দেখতে আসছে না।...
এইবার অন্যান্য দরকারি কথা কটা বলে ফেলি। তিন দিন থেকে একটু একটু
করে যতই চিঠিটা লিখছি, কথা ততই বেড়েই চলেছে দেখছি।
তুই বোধ হয় শুনেছিস যে, তোর সই সোফিয়ার বিয়ে। কিন্তু তোর চিঠিতে
ওর কোনো উল্লেখ না দেখে বোঝাও তো যায় না যে তুই এ-খবর জানিস। আর জানবিই বা কী করে
বোন? আমিই জানতাম না এতদিন। তোমার এই সোজা শেওড়া গাছ ভাইটি তো কম নন ‘নিম্নমুখো
ষষ্টি, ছেলে খান দশটি!’ এ মহাশয়-লোকটির কুঠে কুঠে বুদ্ধি। তিনি তলে তলে এসব মতলব
পাকিয়ে ‘চুনি বিল্লু’র মতো চুপসে বসেছিলেন, অথচ ঘরের কাউকে এমনকী এ-বান্দাকেও কখনও
এতটুকু ইশারায়ও জানতে দেননি। – একদিন গম্ভীরভাবে এসে বললেন কী, – “ছেলেটি দেখতে
শুনতে বেশ, এ-বছর বি.এ. দেবে, স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধেও জোর ‘সাট্টিফিস্টি’ পাওয়া
গেছে, তার সম্বন্ধে কোনো খটকা নেই, আর যা দু-একটু দোষ-ঘাট আছে তা তেমন নয় –
নিষ্কলঙ্ক চাঁদই বা আর কোথায় পাওয়া যাবে!” ইত্যাদি। আমি তো বোন প্রথমে ভেবেই পাইনে
উনি কী বলছেন। পরে মনে করলাম, হতেও পারে। পরে কত ‘নখরা্ তিল্লা’ করে বলা হল যে,
আমাদের মনুয়রের সঙ্গেই সম্বন্ধ তিনি অনেকদিন থেকে মনে এঁটে রেখেছেন। আমাকে তাক
লাগিয়ে দেওয়ার জন্যই এত দিন তা বলা হয়নি।... সে যাই হোক, এইবার কিন্তু দুই
বাঁদর-বাঁদরি মিলবে ভালো। মনুটা যেমন বাঁদর বেলেল্লা, সোফিও তেমনই
আফলাতুন
কাহারবা মেয়ে! ঝ্যাঁটার চোটে বিষ নামিয়ে দেবে সে! বিয়ের পর ওদের যদি রোজ
হাতাহাতি না হয়, তো আমার নাম আর-কিছু রাখিস! ... এইখানে আর একটা কথা, – এ-বিয়ের
কথাবার্তা হওয়ার পর থেকেই সোফি যেন কেমন গুম হয়ে গিয়েছে! সামনা-সামনি হলে কেবল যেন
একটা টেনে-আনা হাসির আভা সে তার গম্ভীর মুখে ফুটিয়ে তুলতে চায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে
সেটা সকলের আগে তারই কাছে ধরা পড়ে যায়, আর সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরটাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে!
তার চোখের নিচে প্রচ্ছন্ন বেদনার একটা স্পষ্ট দাগ যেন দিন দিন কালো হয়ে ফুটে উঠচে!
আমি তো হয়রান হয়ে গেছি বোন ওকে জিগগেস করে করে। সে শুধু হেসেই আমার কথা উড়িয়ে দেয়,
আবার দু-একবার বেশি জিগগেস করলে রাগের চোঠে ঠোঁট ফুলিয়ে আমার পায়ে মাথা কুটে মরে,
নয়তো নিজের চুলগুলোকে নিজে নিজেই ছিঁড়ে পাড়িপাড়ি করে ফেলে। তার চিল্লানি শুনে আর
‘তিখানি’ দেখে বোন এখন আমার তার কাছে যেতেও ভয় হয়। মা গো মা! এমন ‘ঢিট’ মেয়ে আমি আর
কখনও দেখিনি। ওর এরকম গতিক দেখে তোমার ভাইজিও যেন কেমন ক্ষুণ্ণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন,
অথচ যার ব্যথা তার কোথায় যে কী ব্যথা, তা আর বুঝবার কোনোই উপায় নেই। আমি নাচার হয়ে
এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার মতন মাঝি যার মন-দরিয়ায় কূল-কিনারা পেলে না, সে সহজ
পাত্তর নয়! ওর মতলবটা কী বা কেন যে সে অমন করচে তুই কি কিছু জানিস রে? তোতে ওতে
মানিক জোড়ের মতন দিন-রাত্তির এক জায়গায় থাকতিস কিনা, তাই শুধোচ্চি, যদি তুই ওর
মন-দরিয়ার কোনো মণি-মুক্তার খবর রাখিস। তোর মতন কাঁচা ডুবুরি যে কিছু তুলতে পারবে,
তার আশা নেই; তাই দেখিস মাঝে থেকে যেন কাদা ঘেঁটে জলটাকে ঘোলা করে দিসনে। আমি যে
এখন কোন্ দিক দেখি ছাই, তা আর ভেবে পাচ্ছিনে। এত ঝঞ্ঝাট, বাবাঃ! যা হোক, তুই এখানে
এলে যেন একটু তবু নিশ্বাস ফেলে বাঁচতে পারব মনে করছি। হাজার দিককার হাজার
জঞ্জাল-ঝক্কির মাঝে পড়ে জানটা যেন বেরিয়ে যাওয়ার মতোই হয়েচে! শিগগির তোর ভাইজি
যাবেন তোদের আনতে। এই কদিন তোদের না দেখে মনে হচ্চে যেন কত যুগ দেখিনি! দেখিস
অভিমান করে আবার ‘যাব না’ বলে বায়না ধরিসনে যেন।
তোর জন্যে চিন্তা করিনে, তুই কেন তোর ঘাড় আসবে ; না এলে ধরে
পালকিতে পুরবো, বলব এ আমাদের ঘরের বউ, এর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নূরুর সাথে! ভয় যত তোর
আম্মাজানকে নিয়ে! তাঁকেও মা চিঠি দিলেন। তিনি কিছু আপত্তি করলে আমরা সবাই গিয়ে পায়ে
ধরে তাঁকে নিয়ে আসব। ... খুকি তো তোর আসবার কথা শুনে এই দু-দিন ধরে ঘন্টায় হাজার
বার করে শুধোচ্ছে, – ‘মা, লাল ফুপু কখন আসবে?’ কত রকম কৈফিয়ত দিয়ে তাকে ফুসলিয়ে
রাখতে হয়, নইলে সে কেঁদে চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলে! তাকে তোর যেরকম
ন্যাওতা করে ফেলেচিস, তাতে এখন তাকে যে ভুলিয়ে রাখা দায়। একটু কিছু হলেই ‘লাল ফুপু
গো’ বলে ডাক ছেড়ে কাঁদা হয়। মেয়েটা এমন নিমকহারাম, মাকে ছেড়ে তোকেই এত করে চিনলে!
এখন তোর মেয়ে তুই সামলে রাখ ভাই এসে! নয়তো সাথে নিয়ে যা। এই দু মাসেই মেয়েটা যেন
শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে।...
সেখানে আর যতদিন থাকিস, একটু সংযত হয়ে থাকিস বোন। কী করবি, পরের
বাড়ি দুটো মুখনাড়া সইতেই হবে।
তোর কথামতো গত মাসের সমস্ত মাসিক পত্রিকাগুলি পাঠিয়ে দিলাম। দেখবি,
আমাদের মেয়েরাও এবারে বাংলা লিখছেন, যা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।...
খালাজির পাক কদমানে হাজার হাজার আদাব দিবি। ইতি
রাবেয়া