বাঁধন হারা জ সালার বোন আয়েশা! তোমার বড়ো বোন বুবু সাহেবা! তোমার ভাগ্যহীনা ছোটো বোন সালার দুষ্টু সাহসিকা! তোর ভুলে-যাওয়া সই বিডন স্টিট, কলিকাতা ভাই রেবা! – কোটি কোটি নমস্কার করছি এই মহাঋষির শ্রীচরণারবিন্দে এইখানে! যাক,
এসব আলোচনা আপাতত এইখানেই ধামা-চাপা দিলাম। এই কেঁচো উস্কাতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ার
ভয়েই বোন আমি মনে করি এসব আলোচনা আর করব না ; কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! বাপ-মায়ে
বুঝেই যে আমার সাহসিকা নাম দিয়েছিলেন, তা আমিও আজ যেন বুঝতে পারচি। তোর চিঠি পেয়ে
আমার মনে যে ভাবের উচ্ছ্বাস বা সৃষ্টির বেদনা জেগেছিল, তার দরুণই হয়তো এত কথা লিখে
ফেললাম। যতক্ষণ এই ভাবাবেগ আছে ততক্ষণই লিখতে পারব, তারপর আর নয়। তাই ‘এই বেলা নে
ঘরে ছেয়ে’ কথাটার উপদেশ স্মরণ করেই যত পারচি লিখে চলেছি। তোর সাহসী সই শেঙান শ্রীচরণসরোজেষু! ইতি – বোগদাদ শ্রীচরণারবিন্দেসু! অভিশপ্ত
উপন্যাস
কাজী নজরুল ইসলাম
১৩ই ফাল্গুন
তুমি আমার হাজার ‘দোয়া’ জানবে। মা মাহ্বুবাকে আমার বুকভরা
স্নেহাশিস দেবে। এখানে খোদার ফজলে সব ভালো। সোফিয়া আর বহুবিবি মা-জানের কাছে
তোমাদের সব খবর জানতে পারলাম। আমায় চিঠি দেবে বলে গিয়েছিলে, তা বোধ হয় বাপের বাড়ি
গিয়ে ভুলেই গিয়েছ।... আমি যেন আভাসে বুঝতে পারছি তোমাদের সেখানে অনেক অসুবিধা ভোগ
করতে হচ্চে। তোমার না হলেও আমার মাহ্বুবা মায়ের যে খুবই কষ্ট হচ্চে, এ কথা কে যেন
আমার পোড়া মনে সারাক্ষণই উসকে দিচ্চে। আহা, খোদা তোমাদের সহি সালামতে রাখুন বোন!
আমার মাহ্বুবা মায়ের আলাই-বালাই নিয়ে মরি! এই কদিন মেয়েটাকে না দেখে আমার জান যে
কীরকম ছটফট করচে, তা তুমিও তো মেয়ের মা, সহজেই বুঝতে পার! মা-আমার সেই যে
কাঁদতে-কাঁদতে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিলে অথচ একটা কথাও বলতে পারলে না,
তাই আমার দিনে-রাতে হাজার বার করে মনে হচ্চে! সোফি আর ও দুইজনে মিলে ঘরটাকে যেন
মেছো-হাট করে রাখত, ওর যাওয়ার পর থেকে সোফিটা মন-মরা হয়ে শুধু নিজের ঘরটাতে পড়ে থাকে,
আর কিছু শুধোলে আমার কোলের ভিতর মুখ গুঁজে কাঁদে। সে কী ডুকুরে ডুকুরে কান্না বোন
ওর, দেখে চোখের পানি সামলানো দায়! মা আমার যেন দিন দিন শিকড়-কাটা লতার মতন নেতিয়ে
পড়চে। কী হল ওর, ওই জানে আর ওর খোদাই জানে। হাজার শুধোলেও কোনো কিছু বলচে না। এমন
চাপা মন তো ওর কোনো কালে ছিল না বোন। আমার এত ভয় হচ্চে! কাল দিন বাদে ওর বিয়ে, আর
এখন থেকেই কিনা এমন হয়ে শুকিয়ে পড়চে। হায় আমি যে কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিনে! মাহ্বুবাটা
থাকলেও বোধ হয় ও এমন হত না। যাক, খোদা যা লিখেচেন অদৃষ্টে তাই হবে, আর ভেবে কী ফল!
তার ওপর আবার তোমাদের এই কাণ্ড! তোমাদের এতটুকু কষ্টের কথা
ভাবতেও যে আমি মনে কত কষ্ট পাই, তা বলতে গেলে বলবে যে মায়াকান্না কাঁদচে। কেননা এখন
সেদিন আর নেই। কোথা থেকে কী একটা গোলমাল মধ্যে থেকে বেধে গিয়ে আমার না হোক তোমার যে
মন একেবারে ভেঙে গিয়েছে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। এই মন-ভাঙা-ভাঙির আগে কিন্তু এরই
পাশাপাশি বাড়িতে থেকে আমাদের অতকাল কেটে গেল, কিন্তু কোনোদিন কোনো মনান্তর তো দূরের
কথা, তেমন কোনো খুঁটিনাটিও হয়নি।... আজ যদি মাহ্বুবার বাপ (আল্লাহ্ তাকে জিন্নতে
জায়গা দেন!) বেঁচে থাকত, তাহলে কী তোমরা তার বাপ-দাদার ভিটে এমন করে ছেড়ে যেতে সাহস
করতে? এক দূরসম্পর্কের বোন না হয়ে তুমি যদি আমার মায়ের পেটের ‘সোদর’ বোন হতে, তাহলে
হয়তো আমার এতদিনের এত বড়ো অধিকারকে ‘পা’মাড়িয়ে যেতে পারতে না। মাহ্বুবার বাপ বেচারা
তো চিরটা কাল আমার আপন ছোটো ভাইটির মতোই আদর আবদার নিয়ে আসত, ওতে আমার যে কত আনন্দ
হত, আমার বুক যে কীরকম ভরে উঠত, তা আমিই জানি আর আল্লাহ্ জানেন। তুমি হয়তো বলবে যে,
সে অন্য সম্পর্কে আমার্ ছোটো দেবরই ছিল, কিন্তু সত্যি বলতে গেলে শুধু তার জন্যে নয়,
তোমার জন্যেও তার ওপর আমার স্নেহমায়াটা এত বেশি করে পড়েছিল। তোমার বিয়ের কথা আমিই
উঠাই তার সঙ্গে, সে সময় সে হাসতে হাসতে বলেছিল, – ‘ভাবিসাহেবা, আজকাল বউ পসন্দ করে
নেওয়ার একটা হুজুগ পড়েছে, কিন্তু দেখচি আমার হয়ে আপনিই সমস্ত করে দিলেন! তবে আমি এই
ভরসায় রাজি হচ্চি যে, আপনার মতো ঝুনো দালালের হাতে ঠকবার কোনো ভয় নেই!’ আর সে কী
হাসি! আজও আমার কানে ওর অমনি কত কথা কত হাসি মনে পড়চে। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর
সে আমায় সালাম করতে এসে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিল, – ‘ভাবিসাহেবা, আজ থেকে কিন্তু
আপনি আমার ‘জেড়শাস’ অর্থাৎ কিনা জ্যেষ্ঠা শ্যালিকা। আর আমাদের হিন্দুদের ঘরে
জ্যেষ্ঠা শ্যালিকারা ছোটো বোনের স্বামীর সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেও আমাদের সমাজে কিন্তু
উলটো নিয়ম, আর সে নিয়ম অনুসারে আপনার আমার সঙ্গে কথা কওয়া তো দূরের কথা, দেখা-শোনাও
হতে পারে না!’ আজ সে নেই, তার সে হাসিও নেই! ও আর নূরুটা গিয়ে আমাদের পাড়াটা যেন
দিন-দুপুরেই গোরস্থানের মতো সুনসান হয়ে রয়েছে!
তারই একটি কণা স্মৃতি মরণ-কালে আমার হাতে সঁপে-দেওয়া মাহ্বুবা
মা-জানকে যে তুমি এমন করে বেদিলের মতন আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, তা আমি
কোনোদিনই ভাবতে পারিনি। তোমার বোধ হয় মনে আছে, ছেলেবেলায় ও তোমার কোল থেকে ঝাঁপিয়ে
পড়ত আমার কোলে এসে আমার দুধ খেতে, আর সে সময় সোফিতে আর ওতে কীরকম খামচা-খামচি
চুলোচুলি হত! তুমি যদি বা ভোল, সে ভুলবে না ; আমার বুকের রক্ত যে তার রক্তে মিশে
রয়েছে!... আর তোমার কথাই বলি, – তুমি তো কোনোদিনই আমার মুখের ওপর একটি কথা কইতে
সাহস করনি, – কিন্তু সেই তুমি কিনা যেই তোমার ভাই তোমায় নিতে এলেন অমনি আমাদের
সবারই ঘরগুষ্টির এত কাঁদন পায়ে-পড়া অনুরোধ উপেক্ষা করে উলটো আরও পাঁচ কথা শুনিয়ে চলে
গেলে! কোনোদিন তো তোমার কাছ থেকে এমন ব্যাভার পাইনি, তাই সেদিনকার কথাগুলো আমার বুকে
যেন শেলের মতোই গিয়ে বেজেছে। তুমি যে এমন করে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে পারবে, তা
জানতাম না। তাই আগে থেকে প্রস্তুতও ছিলাম না। তুমি নূরুর ব্যাভারের যে খোঁচা দিয়ে
গেলে তা আমি অবশ্য স্বীকার করে নিলেও, ওতে যে আমাদের নিজের কতটা দোষ ছিল, তা নিয়ে
তুমিও তো আর কিছু অ-জানা ছিলে না। আমার পেটের ছেলে না হলেও আমার রবুর চেয়েও সে বেশি,
সুতরাং তার এই খ্যাপামো হঠকারিতায় কী তোমার চেয়ে আমি কম কষ্ট পেয়েছি, না, সে কি
আমারও বুক ভেঙে দিয়ে যায়নি? তোমার চেয়ে যে সে আমারই অপমান করেছে বেশি। আর মাহ্বুবাকে
কি আমি কোনোদিন সোফির চেয়ে কম করে দেখেচি? সে যে এইরকমই কিছু একটা পাগলামি করে বসবে,
বিয়ের কথা আরম্ভ হতেই কী-জানি-কেন আমার মনে কেবলই ওই শঙ্কা জাগছিল। কেন না এই পাগলা
ছেলে কতবার বিয়ের কথা শুনেই এক-দু মাস করে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। শুধু রবুর
আর বৌমার জিদের আর উৎসাহের জন্যে আমি কিছু বলে উঠতে পারিনি, পাছে তারা মনে করে যে
আমার মনটা শুধু অলুক্ষুণে কথাই ভাবে। মা ছেলেকে যেমন বোঝে তেমন আর কেউ বোঝে না। আমি
ওকে খুব ভালো করেই চিনেছিলাম যে, ও আমার বাউল উদাসীন ছেলে। তাই আমি কোনোদিনই তার
বিয়ের জন্যে এতটুকু চিন্তিত হইনি বা আশাও করিনি। মনে করতাম, আহা থাক আমার ও কোল-মুছা
খ্যাপা ছেলে হয়ে! দু-দিন বাদে সোফিয়া শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। রবু সংসারী হয়ে
ছেলে-মেয়েদের পেয়ে হয়তো বুড়ো মাকে আর মনে করবে না, কিন্তু চিরদিন থাকবে আমার কোল
ঠান্ডা করে, এই চিরশিশু নূরু – এই ঘর-ছাড়া উদাস ছেলে আমার! হায়, মানুষ ভাবে এক, আর
খোদা করেন আর এক! একটা হুজুগের মাতামাতিতেই ছেলে আমার এমন করে মালিক-উল-মউতের হাতে
গিয়ে জানটা সঁপে দিল – এই রাক্ষসী লড়াইয়ে চলে গেল। আর আমি কিছু চাইনে বোন এখন,
খোদার রহমে আর তোমাদের পাঁচ জনের দোয়াতে ছেলে আমার বেঁচে বাড়ি ফিরে আসুক – সে না হয়
চিরটা দিন থুবড়োই থাকবে। বউমার যেমন অনাসিষ্টি ঝোঁক, কী করতে গিয়ে শেষে কী হয়ে গেল।
কেন, আমার মাহ্বুবার মায়েরই কি বিয়ে হত না, যে এমন আকাল-হুড়োর মতন কাড়াকাড়ি? আমি
বি.এ-এম.এ পাশ করা সোনার চাঁদ ছেলে এনে তার বিয়ে দিতাম। তাতে যত টাকাই খরচ হোক।
জমি-জায়গা টাকা-কড়ি কাদের জন্যে? ছেলে-মেয়েদের সুখী করে তাদের মুখে হাসি দেখে তা
আমরা চোখ মুদি, তারপর খোদা তাদের নসিবে যা লিখেচেন হবে! তখন তো আমরা আর কবর থেকে উঠে,
তা দেখতে আসবো না। কথায় বলে – ‘চোখ মুদলে কেবা কার!’ ... যাক, যা হয়ে গেছে, তা
গিয়েছে ; নসিবের উপর চারা নাই। তা নিয়ে অনুতাপ করেও কোনো ফল হবে না। কী করি, মন
বালাই – কোনো মানা মানে না, তাই দুটো কথা না বলেও পারি না! দু-একবার মনে হয়, দূর
ছাই। পরের ছেলেকে আপনার করতে গিয়েও যখন আর হল না, তখন আর কেঁদেই কী হবে – মন খারাপ
করেই বা কী পাব? হায় বোন, কিন্তু মন সে কথা বুঝতে চায় না! রাত্তি-দিন রোজা নামাজ
নিয়ে ব্যস্ত আছি, আল্লার নাম নিয়ে দুনিয়ার মায়া কাটাতে চাচ্ছি, কিন্তু মেয়েদের
বিশেষ করে মাদের মনে যে খোদা কি দুর্বলতা দিয়ে দিয়েছেন যার জন্যে বেহেশ্তে গিয়েও
আমাদের জান চায়েন হয় না। শুধু বাচ্চা-হারা বাঘিনীর মতো অশান্ত মন কেঁদে কোঁকিয়ে মরে!
আমারই হয়েছে তাই মুশকিল। জিন্দেগির বাকি কালটা যে আল্লার নাম নিয়ে কাটিয়ে দেব, তাও
বুঝি তিনি কপালে লেখেননি!
যাক বোন, এখন আসল কথা হচ্চে তোমরা ফিরে এসো। বেশ হল, বুকে এত বড়ো
‘দেরেগে’ শোক পাওয়ার পর দু-দিন বাপ-মায়ের বাড়িতে বেরিয়ে মন বাহালিয়ে নিলে, এখন আবার
ঘরের বউ ঘরে ফিরে এস। বাপ-মায়ের বাড়িতে বেশি দিন থাকা ‘আয়েব’ ও বটে, আর তাতে
মান-ইজ্জতও থাকে না। এখন তোমাকে শ্বশুরকুলের আর মৃত স্বামীরই সম্মান রক্ষা করে চলতে
হবে। যে ঘরের বউ তুমি, সে ঘরের মাথা উঁচু রাখতে তুমি সব দিক দিয়ে বাধ্য। রবুকে
পাঠিয়ে দেব পালকি নিয়ে তোমাদের আনবার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু তাহলে ঘর দেখবে
কে? বউ-বেটি ছেড়ে কি আমার কোথাও যাওয়ার জো আছে! আর রাগ অভিমান করিসনে বোন। তোরা
সবাই মিলে যদি আমার মনে এমন করে কষ্ট দিস তা হলে দেখচি কোনো দিন বিষ খেয়ে আমাকে
হারামি মউত মরতে হয়। আর তা নইলে তো তোমাদের এই হাড়-জ্বালানো স্বভাব থামবে না। আমার
মাহ্বুবা মাকে নিয়ে আর বেশি দিন সেখানে থাকা মস্ত বড়ো দোষের কথা। আইবুড়ো মেয়ে –
হোক না মামার বাড়ি, লোকে তো দশটা কথা বলতে কসুর করবে না ; আর তা শুনে শুনে তুমিও
অতিষ্ঠ, তেতো-বেরক্ত হয়ে উঠবে। তোমরা যেদিন আসতে চাও, সেই দিনই শ্রীমান রবিয়ল
বাবাজীবন সেখানে পালকি নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। তোমরা এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে থেকো।
পত্রপাঠ উত্তর দিতে ভুলো না যেন, একথা আমি তোমার কান কামড়ে বলে দিচ্ছি।
খুকি যে তোর জন্যে “থোত দাদি দাবো – থোত দাদি দাবো’ বলে মাথা
খুঁড়চে এখানে! মাবুর জন্যেও কত কাঁদে। হায় রে কপাল, এমন বে-দরদ ছোটো দাদি যে একটা
চিঠি দিয়েও পুতিনের খবর নেয় না! আর সেই পুতিনের আবার ছোটো দাদির জন্যে এমন মাথা
খুঁড়ে খুঁড়ে কান্না!
হাঁ, আর একটা মস্ত বড়ো জরুরি কথা, – ছাই ভুলেও যাচ্ছিলাম। আমার
কি কিছু মনের ঠিক-ঠাক আছে বোন! এখন মরণ হলেই বাঁচি!... বলছিলাম কী আমাদের সোফিয়ার
বিয়ে বউমার ছোটো ভাই মনুয়রের সঙ্গেই ঠিক করেছি। রবু বোধ হয় চিঠি দিয়ে আগেই সেকথা
জানিয়েছে। তুই একবার এসে সব কাজ দেখে শুনে গুছো এসে; সোফি তোরই তো মেয়ে। আর, মাহ্বুবা
মা না এলে সোফি বোধ হয় বিয়েই করবে না। আমি বোন এ-সব ঝামেলা সইতে পারব না এ মন নিয়ে।
সেখানকার সকলকে দর্জামতো সালাম দোয়া দেবে। হাঁ, আর একবার তোর হাত ধরে বলছি বোন আমার,
দেখিস নূরুকে কোনো আহা-দিল বদ-দোয়া দিসনে যেন, বাছা আমার কোথায় কোনো দেশে পড়ে রয়েচে,
হয়তো এতে তার অকল্যাণ হবে। ইতি –
রকিয়া
শাহপুর
১লা চৈত্র
তোমার চিঠি পেয়েছি। নানান কারণে উত্তর দেওয়া হয়নি।
মাহ্বুবাটাও বোধ হয় বউমার কিংবা সোফিয়ার চিঠি পেয়েচে, তাই এই
কদিন ধরে শুধু তার কাঁদো-কাঁদো ভাব দেখা যাচ্চে।
আজকালকার ছেলে-মেয়েরা এমনই বেইমান! আমার মেয়ে কিনা আমাকে ফাঁকি
দিয়ে চলতে চায়। মাহ্বুবা এখন আমাকে দেখলেই একপাশে সরে যায়, চোখ মুখে তার কান্না
থমথম করে ওঠে! বাপরে বাপ, এ কলিকালে আরও কত দেখব বুবুজান, – দশ মাস দশদিন গর্ভে-ধরা
বুকের লোহু দিয়ে মানুষ-করা একমাত্র মেয়ে সেও কিনা দুঃখিনী মায়ের বিদ্রোহী হয়?
গরিবের মেয়ের – যার দিন-দুনিয়ায় আপনার বলতে কেউ নেই, তার আবার এত গরব কীসের! এসব
দেখে আমার বোন দুঃখও হয়, হাসিও পায়!
তোমরা আমাদের খুবই উপকার করেছ বুবুজান, আমরা গরিব হলেও সে উপকার
ভুলে যাওয়ার মতন বেইমানি আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের গায়ের চামড়া দিয়ে তোমাদের পায়ের
জুতো বানিয়ে দিলেও সে ধার শোধ হয় না। তবে কথা কি জানো আমরা গরিব, তাই হয়তো লোকের
ভালো কথাও এসে অপমানের মতন আমাদের বুকে বাজে। আর বোধ হয়, সেই জন্যেই মনে করচি তোমরা
উপকার করে মায়ামমতা দেখিয়ে আজ আবার তারই খোঁটা দিচ্ছ! বড়ো দুঃখেই লোকে অন্যের কাছ
থেকে সাহায্য নেয়। আমি যদি সমান দরের লোক হতাম তা হলে হয়তো খুব সহজেই তোমার ও উপকার,
অত স্নেহ-মায়া অসংকোচে নিতে পারতাম ; কিন্তু আমি গরিব বলেই মনে করি, ও তোমাদের বড়ো
মনের অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি আর দয়া ভিন্ন কিছুই নয়। আর, ও নিতে আমার মন তাই চিরটা
দিনই লজ্জায় ক্ষোভে অপমানে এতটুকু হয়ে যেত। মাহ্বুবার বাপ যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন
আমি ও কথা তোমায় বলি-বলি করেও বলতে পারিনি, আর বলতে গেলেও উনি বলতে দিতেন না । এতে
হয়তো তুমি মনে বড়ো কষ্ট পাবে বুবুজান, কিন্তু আর সত্যি কথাটা লুকিয়ে নিজের মনের
দংশন-জ্বালা সইতে পারছিনে বলেই বড়ো কঠিন হয়েই এ কথাটা জানাতে হল। আমার এত
আত্মসম্মান থাকাটা কিন্তু আশ্চর্য নয়, কেননা আমি গরিবের ঘরে বউ হলেও আমার বাপ মস্ত
শরিফ। এইসব অপ্রিয় কথাগুলো বলে তোমাকে খুবই কষ্ট দিচ্চি বুঝি, কিন্তু কত দুঃখে যে
আমার মুখ দিয়ে এসব নির্মম কথাগুলো বেরোচ্ছে তা এক আল্লাই জানেন। উনি তো বেহেশ্তে
গিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন কিন্তু এ -অভাগিকে তুষের আগুনে একটু একটু করে পুড়ে মরতে রেখে
গেলেন! এখন এই যে আইবুড়ো ধিঙ্গি মেয়ে বুকের ওপরে, এ তো মেয়ে নয় – আমার বুকের ওপর
যেন কুলকাঠের আগুনের খাপরা। ওকে নিয়েই আমার যত ভাবনা, তা নইলে আমার আজ চিন্তা কী?
উনি যে দিন চলে গেলেন, সেই দিনই এ পোড়া জানের ল্যাঠা চুকিয়ে দিতাম।
আমাদের এখানে কোনো কষ্টই নেই। ওই হতভাগি মেয়ে বোধ হয় লিখে
জানিয়েছে সব দরদি বন্ধুদের, না? ও মেয়ে দেখচি দিন দিন আমারই দুশমন হয়ে দাঁড়াচ্চে।
হাড় কালি করে ছাড়লে হতচ্ছাড়ি পোড়ারমুখি, তবু তার আশ মিটল না। এখন আমার কলজেটা বের
করে খেলেই ওর সোয়াস্তি আসে। এই ঢিবি বেয়াড়া মেয়ে নিয়ে রাত-দিন ঘরে-বাইরে মুখনাড়া
হাতনাড়া সহ্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। য়্যা বড়ো-মান্ষি চাল, যেন কোনো নবাবের
মেয়ে! সত্যি বোন, তোমরাই ওকে অমন আমিরজাদির মতন শাহানশাহি মেজাজের করে তুলেছ। এখন
আমায় সর্বদাই পাহারা দিয়ে থাকতে হয় তাকে, পাছে কখন কোন্ অনাছিস্টি করে বসে থাকে বা
কারুর মুখের ওপর চোপা করে একটা ঝগড়া-ঝাঁটির পত্তন করে বসে। খোদা আর কোনো দিকে সুখ
দিলেন না।
ওঁর মরবার আগে আমি মুখরা ছিলাম না বলে যে তুমি আমাকে দোষ দিয়েছ
বুবুজান, সে তোমার বুঝবার ভুল। আমি চিরদিনই এমনই কাঠ চোটা কথা কয়ে এসেচি, তবে তখন
ছিল একদিন আর আজ একদিন। তখন আমাদের এ মন ভাঙাভাঙিও হয়নি আর তোমার ভালোবাসাটাও হয়তো
সত্যিকারই ছিল, তাই আমার ও ঝাঁজানো কথা শুনেও শুনতে না। আজ যেই মনের মিথ্যা দিকটা
ধরা পড়েছে, অমনি তোমারও চোখে পড়ে গিয়েছে যে মাগি চশমখোর মুখরা! এবার আরও কত শুনব।
খামোখা রবিয়ল বাবাজিকে কষ্ট করে এখানে পাঠিয়ো না বোন, আমি এখন
যাব না। আইবুড়ো জোয়ান মেয়েকে যদি এমনি করে নালতে শাকের মতন হাট-বাজারে নিয়ে ঘুরে
বেড়াই, তাহলে সবারই বদনাম। তা ছাড়া, এখন মাহ্বুবাকে এখান থেকে নিয়ে গেলে আমার
বাপ-মায়ের বা ভাইদের অপমান করা হয় না কি? তাঁরা কি এতই ছোটোলোক যে, তাঁদের ঘরের আবরু
এমন করে নষ্ট হতে দেখে বসে বসে হুঁকো টানবেন? আরও একটা সত্যি কথা বলছি বুবু, রেগো
না যেন। আমরা গরিব হলেও মানুষ, আমাদের মান-অপমান জ্ঞান আছে। এত অপমানের পরও আমরা
কোন্ মুখে সেখানে আবার মুখ দেখাব গিয়ে? এখানে যদি কুকুর বিড়ালের মতোও অনহেলা হেনস্তা
হয় তাও স্বীকার, তবু আর খোদা যেন ও সালার-মুখো না করেন। আমি দূর থেকেই সালারকে
হাজার হাজার সালাম করচি বোন,। তুমি শুধু নিজের দিকটা দিয়েই ওই কুকুর-কুণ্ডলি কাণ্ডটা
নিয়ে বিচার করেছ, কিন্তু এ গরিবদের বেদনাটুকু বুঝতে হয় বোন সেই সঙ্গে। কথায় বলে, –
তাঁতি তাঁত বোনে, আপনার দিকে ভাঁড় টানে। তোমারও দেখচি তাই। আচ্ছা, এই যে মাহ্বুবার
বাপ হঠাৎ মারা গেলেন, এটা কার দোষে, কোন্ বেদনার ঘা সামলাতে না পেরে? তা কী জানো?
আমি তক্ষুনিই বলেছিলাম, দড়াতে দড়িতে গিঁঠ খায় না, তা তোমাদের ঝোঁকে উনি সোজা মানুষ
আমার কথাই কানে উঠালেন না। তার পর সত্যি সত্যিই ‘তেলি, না, হাত পিছলে গেলি’ করে নূরু
আপনার এক দিকে পালিয়ে গেল – পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু মাঝে পড়ে সর্বস্বান্ত হলাম আমরা –
গরিবরা। মাহ্বুবার বাপ সে আঘাত সে অপমান সহ্য করতে না পেরে দুনিয়া থেকে সরেই পড়লেন,
মেয়েরও আমার বুক ভেঙে গেল! মা আমি, আমার কাছে তো আর মেয়ে মন লুকিয়ে চলতে পারে না।
মাহ্বুবা যতই চেষ্টা করুক আমার আজ এটা বুঝতে বাকি নেই যে হতভাগি মরেছে। কিন্তু এও
আমি বলে রাখলাম যে, আমি বেঁচে থাকতে যদি আমার এই মেয়ের ফের নূরুর সঙ্গে বিয়ে হতে
দিই, তবে আমার জন্ম শাহজাদ মিয়াঁ দেননি! মাহ্বুবার বাবার উঁচু মন, তিনি মরণকালে
তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে গিয়েছেন, কিন্তু আমি আজও তোমাদের কাউকে ক্ষমা করতে পারিওনি
আর পারবও না। এ সত্যি কথা আজ মুখ ফুটে বলে দিলাম। নূরুকে আমি বদ দোয়া করব না, সে
যুদ্ধ থেকে সহি-সালামতে ফিরে আসুক আমিও প্রার্থনা করছি, কিন্তু তাকে ক্ষমা করতে
পারব না তাই বলে। যে অপমান, যে আঘাতটা আমাদের সইতে হয়েছে তা অন্য কেউ হলে এতদিন তার
হাজার গুণ বদলা নিয়ে তবে ছাড়ত!... যাক সে সব কথা, এ-ভাঙা মন আর জুড়বেও না, আমি
সেখানে যেতে পারব না, ‘ও মন আমার কাঁচের বাসন, ভাঙলে ও-মন আর জোড়ে না!’ সালারেরও
দানা-পানি আমার কপালে আর নেই বোন ; তা সেই দিনই ফুরিয়েছে যেদিন মাহ্বুবার বাপ মারা
গিয়েছেন। আমি সব ভুলতে পারি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা আমি ভুলতে পারি না – শুধু এই
কথাটা মনে রাখবে।
আমার ভায়েরা বীরভূম জেলার শেঙানের এক খুব বড়ো জমিদারের সঙ্গে
মাহ্বুবার বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করেছেন। তিনি এক মস্ত হোমরা-চোমরা বুনিয়াদি খান্দানের,
তবে বয়েসটা চল্লিশ পেরিয়ে পড়েছে এই যা। কিন্তু তাঁর আগের তরফে বিবির এক মেয়ে ছাড়া
আর কেউ নেই। তারও আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারও ঘরে ছেলে মেয়ে। বরের বয়েসটা একটু বেশি,
তা হলে আর কী করব! গরিবের মেয়ের জন্য কোন্ নওয়াবজাদা বসে আছে বলো! এই মাসেই বিয়ে হয়ে
যাবে। মাহ্বুবাও মত দিয়েছে ; – এ শুনে তোমরা তো আশ্চর্য হবেই, আমি নিজেই আশ্চর্য
হয়ে গিয়েছি। ... আল্লাহ্ এত দুঃখও লিখেছিল অভাগির কপালে! আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বুবু
সাহেবা, বুক ফেটে যাচ্ছে!
যাক, তোমাদের দাওত করলাম, এসে এই দুঃখের বিয়ে দিয়ে যেয়ো – মায়ের
আমার বিসর্জন দেখে যেয়ো বোন! যদি না আসতে পার, তবে সবাই মিলে দোয়া কোরো যেন পোড়ামুখি
সুখী হয়।
মা সোফিয়ার বিয়েতে যেতে পারব তা আর মনে হয় না বুবুজান। তাহলে
আমার ঘরের এ কাজ দেখবে কে? আমি আমার জান-দিল থেকে দোয়া করচি, খোদা আমার সোফি মাকে
রাজরানি করুন। তার মাথার সিঁদুর হাতের পঁইচি অক্ষয় হোক! বেশ সুন্দর হবে, মনুয়রের
সাথে ওকে মানাবেও মানিক-জোড়ের মতন। আমি এ দৃশ্য দেখতে পারলাম না বলে ছটফট করছি।
আবার লিখছি বোন খামোখা রবু বাবাজিকে আমাদের নিতে পাঠিয়ো না,
পাঠিয়ো না! অনর্থক হাল্লক হয়ে ফিরে যাবে। আমি জান থাকতে সেখানে যেতেও পারব না, আর
মাহ্বুবার এ বিয়েও বন্ধ করতে পারব না।
বহুমাকে আর সোফিয়াকে আমার বুক-ভরা স্নেহ-আশিস দেবে। খুকিকে আমার
চুমো দেবে, আমি বাস্তবিকই তার বে-দরদ দাদি!
আসি বুবুজান, মাথাটা ঘুরে আসছে! আবার আমার পুরোনো ভিরমি রোগটা
কদিন থেকে কষ্ট দিচ্ছে! –
আয়েশা
২৭শে চৈত্র, রাত্রির
তোর সাথে এবার দেখচি সত্যিকার আড়ি দিতে হবে। বাহা রে, দুষ্টু
ছুঁড়ি। আমি না হয় সংসারের ঝঞ্ঝাটে পড়ে তোকে কিছুদিন চিঠি দিতে পারিনি, তাই বলে তুইও
যে গুমোট মেঘের মতো অভিমানে মুখ ভারি করে বসে থাকবি – হায় রে কপাল তা কি আর জানতাম?...
আজ আমাদের সেই ছেলেবেলা, সে অভিমানে অভিমানে ‘কান্না-হাসির পৌষ-ফাগুনের পালা’ সেই
মা-দের সোহাগ, – সব কথা মনে পড়ছে রে বোন, সব কথা আজ যেন চোখের জলে ভিজে বেরিয়ে আসতে
চাইছে! দুনিয়ায় কেমন করে কার সাথে সহসা যে চেনা-শুনা হয়ে যায়, দুইটি হিয়াই কেমন করে
কপোত-কপোতীর মতো সারাক্ষণ অন্তরের নিভৃততম কোণে মুখোমুখি বসে গোপন কূজনে হিয়ার গগন
ভরিয়ে তোলে, তা সবচেয়ে সেই সময় চোখের জলে লেখা হয়ে দেখা দেয়, যখন তাদের এক ব্যথিত
অজানা দিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
দ্যাখ সই, আজ যখন আমার বড়ো কষ্ট বড়ো দুঃখ, সেই সময় একটি
ব্যথা-পাওয়া সখীকে কাছে পেতে যেন আমার আশা দিকে দিকে ঘুরে মরছে। আমার বুকে যে আজ
কথার ব্যথা জমে পাহাড়-পারা হয়ে উঠেচে বোন, কেননা, আমার খেলার সাথিটিও মূক হয়ে গিয়েছে।
পরের বেদনায় নিজের বুক ভরে আমরা দুটি চিরপরিচিত জনও কেমন যেন পরস্পরকে হারিয়ে ফেলেছি।
এই হঠাৎ-পাওয়া বেদনার বিপুলত্ব আমাদের দুজনকেই কেমন স্তম্ভিত করে ফেলেছে, যাতে করে
এ নিবিড় বেদনার অতলতা আর কিছুতেই আমাদের সহজ হতে দিচ্ছে না। কী হয়েচে, সব কথা বলি
শোন।
তোর পথিক-ভাই নূরুটার সব কাণ্ড-কারখানা তো জানিস। – আজ কিন্তু
তোর ওপরেও আমার কম রাগটা হচ্ছে না রে ‘সাহসী’! তুই তাকে রাতদিন ‘পাগল-ভাই আমার’
‘পথিক-ভাই আমার’ বলে বলে যেন আরও খেপিয়ে তুলেছিলি, দোলা দিয়ে দিয়ে তার জীবন-স্রোতকে
আর চল-চঞ্চল করে তাতে হিন্দোলের উদ্দাম দোল এনে দিয়েছিলি। আমি তার বেদনায় এতটুকু
নাড়াছোঁয়া না দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করবার মতলব আঁটছি, এমন সময় তুই তোর বুক-ভরা
বেদনা-ঝঞ্ঝা এনে তার ব্যথার প্রশান্ত মহাসাগরে দুরন্ত কল্লোল জাগিয়ে গেলি। সেই
ঝঞ্ঝার ঝাঁকানি আর ঢেউ-এর হিন্দোল উচ্ছ্বাসই তাকে ঘর-ছাড়া ডাক ডেকে শেষে আগুনের মাঝে
গলা জড়াজড়ি করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই চির-বঞ্চিতের জীবন-যাত্রা, বড়ো দুর্বিষহ রে ৱোন, বড়ো
দুর্বিষহ! এই বিড়ম্বিত হতভাগ্যেরা যেমন রাক্ষসের মতো স্নেহ-বুভুক্ষু, তেমনই
অস্বাভাবিক অভিমানী।
এই খ্যাপার শিরায় শিরায় রক্ত যেমন টগবগ করে ফুটচে,
স্পর্শালুতাও তেমনই তীব্র তীক্ষ্মতা নিয়ে ওত পেতে রয়েছে। সকল দুঃখ-বেদনা-আঘাতকে
হাসি-মুখে সহ্য করবার বিপুল শক্তি এদের আছে, এদের নাই শুধু স্নেহ সহ্য করবার ক্ষমতা।
স্নেহ-সোহাগের একটু ছোঁয়ার আবছায়াতেই এদের অভিমান-মথিত বুকে বিরাট ক্রন্দন জাগে।
এইখানেই এরা সাধারণ মানুষের চেয়েও দুর্বল।
নূরুর ব্যথার সরসীতে যেই শৈবালের সর পড়ে আসছিল, অমনি তুই এসে
একেবারে তার বেদন-ঘায়ে পরশ বুলিয়ে তাকে ক্ষিপ্ত করে তুললি। তার ঘুম-পাড়ানো চিতাকে
সজাগ করে দিলি। নিজে তো গৃহবাসিনী হলিনে সাথে সাথে আর এক মুগ্ধ হরিণকে তার মনের কথা
মনে করিয়ে দিলি।... তোর ও দুরন্তপনা দেখে দেখে তাই আমার ভয় পাচ্ছে, পাছে তুইও না
মাথায় পাগড়ি বেঁধে যুদ্ধে চলে যাস। যেমন দুষ্ট সরস্বতী মেয়ে, তেমনই নামও হয়েছে –
সাহসিকা।
কিন্তু বিয়ের বেলায় তো সাহস হয় না লো! ইস! গা-টা হেলফেলিয়ে উঠচে,
– না?
হাঁ, কী হয়েছে শোন।
নূরুর সাথে মাহ্বুবার সেই বিয়ের সমস্ত বন্দোবস্তের পর তো নূরুটা
যুদ্ধে চলে গেল – বনের চিড়িয়া বনে উড়ে গেল , কিন্তু তার শূন্য পিঞ্জরটি বুকে নিয়ে
একটি বালিকা নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। এ হতভাগি আর কেউ নয় বোন, এ হচ্চে তোর
বাচ্চা-সই মাহ্বুবা।
মাহ্বুবার বাবাজান হঠাৎ মারা পড়লেন দেখে তার মামারা এসে তাদের
নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, অনেক কাঁদা-কাটি করে পায়ে ধরেও রাখতে পারলাম না। মাহ্বুবার
মাজান যে এমন বে-রহম তা আগে জানতাম না ভাই।
এই রাক্ষুসি মায়ের পরের কাণ্ডটা শোন। এখান থেকে নিয়ে গিয়ে মাহ্বুবাকে
ধরে-বেঁধে এক চল্লিশ বছরের বুড়ো জমিদারের সাথে তিনি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। খবর পেয়ে
আমরা সকলে সেখানে গিয়ে কেঁদে পড়ি, তাঁর পায়ে আমরা ঘর-গুষ্টি মিলে মাথা কুটে-কুটেও
তাঁর মত ফেরাতে পারিনি। জোর করে বিয়ে থামাতে গিয়েছিলাম কিন্তু তাতেও কোনো কিছু হয়নি!
মারামারি করতে গিয়ে তোর সয়া হাতে খুব জখম হয়েছেন। তবে একেবারে ঘায়েল নয়। ঘায়েল হয়েছে
ওই মন্দভাগি মাহ্বুবাটা। সে এখন শ্বশুরবাড়িতে – শেঙানে। আহ্ – আহ্, বিয়ের দিনে সে
কী ডুকরে ডুকরে তার কান্না রে ‘সাহসি’, তা দেখে পাষাণও ফেটে যায়! তবু ওই বে-দিল-মায়ের
জানে একটু রহম হল না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আবার কান্না কত!... এই গোলমালে
সোফির আর মনুর চার হাত এক হতে দেরি হয়ে গেল।
এ বিয়েতে তোকে আমরা ধরে আনব গিয়ে। আসতেই হবে কিন্তু। কোনো মানা
শুনছিনে, বুঝলেন শিক্ষয়িত্রী মহাশয়া!
তোর পথিক-ভাই পাগলা নূরুটাও আসতে পারে এই বিয়েতে। তুই এলে এবার
বনবে ভালো। জানিনে হতভাগা এ-আঘাত সইতে পারবে কিনা!... আচ্ছা হয়েছে – খুব হয়েছে,
যেমন অনহেলা, তেমনই মজা! এখন মতির মালা বানরে নিয়ে গেল। কথায় বলে, – ‘কপালে নেই ঘি,
ঠক-ঠকালে হবে কী?’
নূরুটা ক্রমেই স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠচে দেখছি, আবার এ-খবর
শুনলে তো সে বিধাতা পুরুষের হপ্তা-পুরুষ উদ্ধার করবে। আমাদের বুক কাঁপে রে ভাই ভয়ে
দুরু দুরু করে পাছে কোনো অমঙ্গল হয়। তার চিঠির যদি ঝাঁজ দেখতিস। উঃ, যেন একটা বিপুল
ঘূর্ণিবায়ু হু-হু-হু-হু করে ধুলো উড়িয়ে সারা দুনিয়াটাকে আঁধার করে তুলতে চাইছে। ...
আমি তার চিঠির এক বর্ণও বুঝে উঠতে পারিনে বোন, এক বর্ণও না। শুধু বুঝি, একটা তিক্ত
কান্নার তীব্রতা যেন তাকে ক্রমেই শুষ্ক তীক্ষ্ণ করে ফেলচে।... খোদা ওকে শান্তি দিন।
চারিদিককার এই গোলমালে আমার মনে শান্তি একেবারে উবে গিয়েছে।
আমার এই সাজানো ঘর যেন আজ আমাকেই মুখ ভ্যাংচাচ্চে।
মা আর সোফিও আলাদা জীব হয়ে উঠেছেন আজকাল। মায়ের দুঃখ অনেক,
কিন্তু এই কচি মেয়ে সোফিটা – ? তুই এলে তবে একবার ওর গুমোর ভাঙে। মাগো মা, রাত-দিন
মুখ যেন ভার হয়েই আছে। ছুঁতে গেলেই নাকে-কান্না। এমন ছিঁচকাঁদুনে ছুঁড়ি তো আমি আর
জন্মে দেখিনি, যেন রাংতার টেকো আর কী!
আর লজ্জার কথা শুনেছিস রে ‘সাহসি’? আজকাল সে তোর ভয়ানক ভক্ত হয়ে
উঠেছে। এখন কথায় কথায় তোর নজির দেওয়া হয় – ‘সাহসিদিই তো ভালো কাজ করেছেন – বিয়ে করা
একবারে বিশ্রী কাজ, আমিও চিরকুমারী থাকব’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার তো চক্ষুস্থির! ওরে
বাপরে, – এখন তুই এসে একে তোর কাছে নিয়ে গিয়ে এক-আধটা শিক্ষয়িত্রীর পদ-টদ খালি থাকে
তো দিয়ে দে! বেশ চেলা জোটাচ্ছিস কিন্তু ভাই। আমি বলি কী, তোরা যত সব চিরকুমারী আর
চিরকুমারের দল মিলে একটা নেড়া-নেড়ির দল বের কর। কেমন লো, – কী বলিস?
তোর বর না হয় তোর রূপ-গুণের জৌলুস দেখে ভয়েই পিঠটান দিল, কিন্তু
আমাদের এই শ্রীমতী সোফিয়া খাতুনের ঝগড়া-করা আর নাকে-কাঁদা ছাড়া অন্য কী গুণ আছে,
যাতে করে তাঁর ‘অচিন-প্রিয়তম’ তাঁকে ত্যাগ করে গেলেন? কিন্তু এইখানে কথা হচ্চে যে,
এই ঝগড়াটে ছুড়ির আবার ‘প্রিয়তম’ই বা কে? সে কি কোনো পরিস্থানের শাহজাদা উজিরজাদাকে
খোয়াবে-টোয়াবে দেখেছে নাকি? এসব কথা তুই-ই এসে জিজ্ঞেস করবি ভাই, আমি বলতে গেলে এখন
আমায় সে লাঠি নিয়ে তাড়া করে আসে। জানি না, ওঁর ‘পীতম’ কোন্ গোকুলে বাড়ছে। কিন্তু
দেখিস ভাই, এসে ওকে যেন আবার চেলা বানিয়ে নিসনে।
আর, তুই নিজে কি এমনই সন্ন্যাসিনীই রইবি? হায় রে শ্বেতবসনা
সুন্দরী, তোর বসন্ত বৃথাই গেল! চোরের সঙ্গে ঝগড়া করে ভুঁই-এ ভাত খাবি নাকি? আয় তো
এখানে একবার, তারপর মনে করেছি কী, তোকেও একটা বুড়ো হাবড়া বর জুটিয়ে দিয়ে ‘নেকা’ দিয়ে
দেব! কী বলিস, বিবি হতে পারবি তো? তবে আজ এখন আসি। ইতি–
রাবেয়া
প্রথম বৈশাখ (সকাল)
আজ যে নতুন বছরের প্রথম দিনের প্রথম সকালে তোর নামটিই সর্বপ্রথমে
আমার মনের কোণে উঁকি মারল, আমার এ বিপুল আনন্দের নিবিড় মাধুরী তুই হয়তো বুঝবিনে ;
কেননা, তুই এখন ঘরের লক্ষ্মী, তোর ভালোবাসা পাওয়ার আর দেওয়ার অনেক লোক আছে, কিন্তু
আমাদের তো আর পোড়াকপালে সেসব কিছু জুটল না। আমার বন্ধু আছেন অনেক, কিন্তু সেসব
মামুলি ; তাঁদের সঙ্গে শুধু লৌকিকতার খাতিরটুকু মাত্র, প্রাণের সঙ্গে কারুর কোথাও
এতটুকু মিল নেই। তোকে যেমন অসংকোচে একেবারে সেই ছেলেবেলাটির মতন সহজ হয়ে আমার
অন্তরের বাইরের সবকিছু জানাতে পারব, এমনটি তো আর কাউকে পারব না ভাই! আমার ভেতরটা এই
নীরস সামাজিকতার আর লোক-দেখানো প্রীতির চাপে যখন ক্রমেই শুকনো কাঠ হয়ে উঠছিল, তখন
তোর এই হঠাৎ-পাওয়া ছোট্ট চিঠিখানি যে কত অন্তরতম বন্ধুর মতন সেই শুকনো হিয়ায় পরশ
বুলিয়ে তাকে আবার ফুলের ফসলে ভরিয়ে তুললে, তা আমার এই ভাবাবেগময়ী লিপি-দূতীর চেহারা
দেখেই বুঝতে পারবি।
এতদিন তোর ‘সাহসি’ সই ‘পুয়াল-চাপা’ ছিল, তার কাঠামোটা নিয়ে যিনি
এতদিন এই কলকাতা শহরের মহিলাদের পর্দাপার্কে, মাঝে মাঝে রাস্তায়, বোর্ডিং-এ স্কুলে
গম্ভীরা হয়ে বেড়িয়ে বেড়াতেন, তিনি হচ্চেন মিস সাহসিকা বোস! বুঝলি? শুধু কী তাই! এক
প্রখ্যাত ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক
হোমরা-চোমরা গ্রাজুয়েট, তদুপরি অনুপমা সুন্দরী, বিদূষী, কলা-সরস্বতী! আমার আরও
অনেকগুলো বিশেষণ আছে, সেগুলো আর চিঠিতে লিখে জানাচ্চিনে, তোকে একবার আমার এই
কুঞ্জ-কুটিরে এনে হাতে-কলমেই দেখানো যাবে! তুই এতক্ষণ বোধ হয় তোর দুষ্টু
হাড়-জ্বালানো ননদিনি সোফিকে ডেকে এনে খুব কুটি-কুটি হয়ে হাসচিস, নয়? সত্যি বলচি ভাই
রেবা, এ আর আমি কী বললাম, আমার সব মহিলা বন্ধুরা আমাকে কোনো নতুন-দেখা সুন্দরীর
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এইরকম যে কত পাঁয়তারা কসরত করে যে অহম সুর-সুন্দরীর
গুণ-ব্যাখ্যা ও কীর্তন করেন, তা শুনে শুনে আমারও অনেক সময় মনে হয়, – নাঃ, আমি আর
এখন কেউকেটা নই! যেই ভাবা, আর যায় কোথা, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রাবৃট-মেঘের মতন
গুরু-গম্ভীর হয়ে পড়া! প্রথম প্রথম দিন কতক একটু অসোয়াস্তি বোধ হত, কিন্তু এখন দিব্যি
সয়ে গিয়েছে ; শুধু সয়ে গিয়েছে বললে ভুল হবে, এখন বরং কোনো জায়গায় ওইরকম
বিশেষণ-বিশেষিত অভ্যর্থনা না পেলে মনে একটু রীতিমতোই লাগে! দেখেছিস এইসব মিথ্যা বাজে
জিনিসের ওপরও আমাদের মায়া কত বেশি!
আজ যে আমি তবে হালকা বা খেলো হয়ে পড়েছি তোর কাছে, তার কারণ, আমি
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে যে দিকে যতই বাড়ি, তোর কাছে ওই বাঁদরি ছুড়ি, লো, টে, খুব জোর
‘সাহসি’র বেশি বিশেষণে তো আর জীবনে কখনও বিশেষিত হলামও না, আর ভবিষ্যতে যে হবও না
তার প্রমাণ তোর এই এতদিন পরের চিঠিটা! তাই আমার অতগুলো মর্দানি লেবাস সত্ত্বেও এবং
এক মস্ত ধিঙ্গি আইবুড়ো মাগি হয়েও আজ শুধু মনে হচ্চে আমাদের সেই বাঁকুড়ার
ছেলেবেলাকার কথাটা! এখন আর আমাতে আমি নেই, এখন বাঁকুড়ার চুলবুলে সাহসী ছুঁড়ি এসে
আমার মনের আসনে জোর জড় গেড়ে বসেচে! এখন আমার কী মনে হচ্চে বুঝলি লো ‘খুকির-মা’? এখন
বড্ড সাধ যাচ্ছে যে, সেই আমাদের কিশোরী জীবনের মতন দুই সই-এ পা ছড়িয়ে চুল এলিয়ে
পাশাপাশি বসি আর খামচা-খামচি নুচোনুচি খুনসুড়ি মস্তানি করি এবং সঙ্গে সঙ্গে খুব পেট
ভরে মা-দের গাল খাই! নয়তো তোর ওই এক বোঝা চুল নিয়ে বেণি গাঁথতে তেমনি মশগুল হয়ে যত
সব রাজ্যের ছিষ্টি-ছাড়া গপপো করি। এখন আমি এই চিঠি লিখচি তোকে আর আপনাতে আপনিই
বিভোর হয়ে গিয়েছি! আঃ, কেমন করে মানুষের কত পরিবর্তন হয় বোন। আমার এত আনন্দের বাজার
কে ভাঙলে, আর কেমন করেই বা ভাঙল তাই ভাবতে গিয়ে অনেক দিন পরে আমার চোখের পাতা ভিজে
এল!
দ্যাখ, ভাই রেবা, নারীর নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়, এ কথাটা আজ
আমি খুবই বুঝতে পাচ্চি। তার কারণ বলচি তোকে, শোন।... নানান দিক থেকে নানা রকমের ঘা
আর আঘাত খেয়ে খেয়ে যখন আমার ভিতরে নারীর মাধুরী, সমস্ত পেলবতা – নমনীয়তা ক্রমেই হিম
জমাট হয়ে আসতে লাগল, তার রাত-দিন মর্দানি কায়দা-কানুনের চাপে চাপে অন্তরের নারী
আমার অহল্যার মতোই পাষাণ হয়ে গেল, তখন আমি সব বুঝতে পারলাম মাত্র, কিন্তু না পারলাম
কাঁদতে, না পারলাম তেমন কিছু বেদনা অনুভব করতে! হায় রে বোন, তখন যে আমি পাষাণী!
আমার কি আর তখন কোনো কোমল অনুভূতি জমে পাথর হতে বাকি আছে, যে তার সাড়া পেয়ে বাকি
অনুভূতিগুলো একটু নড়া-চড়া করেও উঠবে! ওই পাষাণ-বুক নিয়ে শুধু শুকনো অশ্রুহীন কাঁদন
কেঁদেচি যে, হায়, আমার আর মুক্তি নেই – মুক্তি নেই! অহল্যারও মুক্তি হয়েছিল, আমার
মুক্তি নেই – নেই। আমার মনে হল, ওই অহল্যা নারী যখন পাষাণ হয়েছিল, তখন তার মাঝে যে
আমিও ছিলাম! আজ আবার এই আমার মাঝে সেই অহল্যা তার পাষাণী মূর্তি নিয়ে এসেচে, কিন্তু
এবার যেন মুক্তিটাকে বাদ দিয়ে। এই আমির মাঝে আমার সেই বহুযুগ আগের আমি তো নেই, তার
যে মৃত্যু হয়েচে!... এত দুঃখ আমার বোন, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারিনি!
জীবনের যত দুর্ঘটনা যত রকম সম্ভব করুণ করে মনে করে কাঁদতে চেষ্টা করেচি ; মার,
বাবার ফটোগুলি, তাঁদের হাতের লেখা ইত্যাদি সামনে ধরে, আমার জীবন-ভরা হারানো প্রিয়
মুখগুলি মনে করে করে যতই কাঁদতে গিয়েছি, ততই খালি কাপাস-হিম-হাসি ঠোঁটের কোণে এক
রেখা ম্লানিমার মতো মাত্র ফুটে উঠেচে! ভাব দেখি একবার এই দুর্বিষহ যাতনার বিড়ম্বনা!
নারী, বিশ্বের সব কিছু কোমলতা আর মাধুর্য-সুষমা দিয়ে গড়া নারী, হাজার করেও তার বুকে
কান্না জাগে না, বেদনাও আঘাত দিতে পারে না! এর যাতনা আর ছটফটানি বুঝিয়ে বলবার নয় রে
বোন, এ – কষ্টে যার হৃদয় কখনও এমনি শুকিয়ে ঠনঠনে পাথর হয়ে গিয়েছে সেই বুঝবে!...
বৈশাখের কান্না দেখেছিস? তার ওই হু-হু-হু-হু রোদ্দুরে, ধু-ধু-ধু-ধু গোবি-সাহারায়
ধুলো-বালি, শন-শন-শন-শন শুকনো ঝড়-ঝঞ্ঝা, পাহাড়-ফাটা শুষ্কতার বিপুল চড়চড়ানি,
দীর্ণ-বিদীর্ণ রুক্ষ খোঁচা খোঁচা উলঙ্গ মূর্তির রুদ্র বীভৎসতা আর খাঁ খাঁ নগ্নতার
হাহাকার ক্রন্দন শুনেচিস? তার ওই কঠোর কাঠচোটা অট্টহাসির খনখনে কাংস্য আওয়াজের মাঝে
সারা বিশ্বের বিধবার অশ্রুহারা সকরুণ কান্নার নীরব ধ্বনি শুনেচিস? এ-বিষাক্ত তিক্ত
কাঁদন বুঝিয়ে বলবার নয় রে বোন, এর লক্ষ ভাগের এক ভাগও বাইরে প্রকাশ করে দেখানোর
ক্ষমতা আমার নেই! এ শাস্তি যেন অতি বড়ো দুশমনেরও না হয়! এই তো সবচেয়ে বড়ো
নরক-যন্ত্রণা! এই তোদের ‘বাবিয়া দোজখ’। এতে মানুষ মরে না বটে, কিন্তু এই কূট
হলাহল-যন্ত্রণা তাকে নিশিদিন জবাই-করা অসহায় প্রাণীর মতন ছট-ফটিয়ে কাতরিয়ে কাতরিয়ে
মারে! শিব নাকি সমুদ্র-মন্থনের সমস্ত বিষ পান করে নীলকণ্ঠ নাম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি
যত বড়ো দেবতাই হন, তাঁর শক্তি যত বেশি অনির্বচনীয় হোক, আমি জোর করে বলতে পারি যে,
এই অশ্রুহীন কান্নার তিক্ত বিষ এক ফোঁটা গলাধঃকরণ করলেই তাঁর কণ্ঠ ফেটে খান খান হয়ে
যেত! তবে আমরা যে এখনও বেঁচে আছি? হায় রে বোন! আমরা যে মানুষ – রক্ত মাংসের মানুষ!
আমাদের শরীরে যা সয়, তা যদি দেবতাদের শরীরেও সইত, তবে তাঁরা এতদিন দেবতা না থেকে
মানুষ হয়ে জন্মে মুক্তিলাভ করতেন! কেননা দেবতাদের চেয়ে মানুষ ঢের ঢের, অনেক – অনেক
উঁচু! তাঁদের যে একটা অমানুষিক শক্তিই রয়েচে সমস্ত সহ্য করবার। কিন্তু মানুষের এই
ক্ষুদ্র বুকের ক্ষুদ্র শক্তির সহ্যগুণ ক্ষমতা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বিপুল বহু বিরাট
দুঃখ-কষ্ট ব্যথা-বেদনা আঘাত-ঘা যে সহ্য করতে হয়! এত কষ্টেও কিন্তু সে সহজে মরে না।
মরণ এ-দুঃখীদের প্রতি বাম! তার রথ এসব আর্তদের পথ দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, এ
বিড়ম্বিত হতভাগাদের কর্ণে তার দূরাগত চাকার ধ্বনিও শ্রুত হয় না! বৃথাই সে হাঁক-ডাক
মারে, – ‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান। কিন্তু শ্যাম ততক্ষণে অন্ধকার পথ দিয়ে
মরণ-ভীতুদের কানে গিয়ে তাঁর মৃত্যু-বাঁশির বেলাশেষের তান শুনান!...
হাঁ, কীজন্য তোকে এত কথা জানিয়ে বা বাজে বকে বিরক্ত করলাম তা পরে
জানাচ্ছি। এখন, কী কথা থেকে এতসব প্রাণের কথা এসে পড়ল? ... আমি বলছিলাম যে, নারীর
নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়। সত্যি-সত্যিই বোধ হয় অহল্যা নারী চিরকাল পাষাণী থাকতে
পারে না! নারীই যদি পাষাণী হয়ে যায়, তবে যে বিশ্ব-সংসার থেকে লক্ষ্মীর কল্যাণী
মূর্তিই উবে যায়, আর বিশ্বও তখন কল্যাণ-হারা হয়ে তৈলহীন প্রদীপের মতোই এক নিমিষে
নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়! এই কল্যাণী নারীই বিশ্বের প্রাণ! এ-‘নারী’ হিম হয়ে গেলে
বিশ্ব-প্রাণের স্পন্দনও এক মুহূর্তে থেমে যাবে!... আমি যখন নিজেকে নারীত্ব-বিবর্জিতা
এক পাষাণী প্রতিমা মনে করে অমনি অশ্রুবিহীন মৌন ক্রন্দনে আমার মর্মর পাষাণ
মর্ম-কন্দরের আকাশ-বাতাস নিয়ত বিষাক্ত তিক্ত আর অতিষ্ঠ ভারি করে তুলেছিলাম, তখন তোর
ওই চিঠির লেখার গোটা কয়েক মাত্র আঁচড় কী করে বুকের এক দিককার এত ভারি পাষাণ তুলে
ফেলে অশ্রুর একটি ক্ষীণ ঝরনাধারা বইয়ে দিলে? কী করে আজ আমার অনেক দিনের বাঞ্ছিত
কান্না তার মধুর গুঞ্জনে আমার মূক মন-সারীর মুখে বাক ফুটালে? তাই ভাবচি আর বড়ো
প্রাণ ভরেই এই কান্নার মৃদুল মধুর বুদ্বুদ্-ভাষা প্রিয়তমের বাঁশির পাতলা গিটকিরির
মতোই আবেশ-বিহ্বল প্রাণে শুনচি! তোর চিঠিটা এতদিন পরে এমনি না-চাওয়ার পথ দিয়ে হঠাৎ
আমার পাষাণ-দেউলের খিড়কিতে এসে আচমকা ঘা না দিলে তা এত সহজে খুলত না, তা আমি এখন
বেশ বুঝতে পারছি। এ যেন দোর-বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রিয়জনের মুখে
ডাকনাম ধরে আহ্বান শুনে চমকে দোর খুলে দিয়ে পুলক-লাজে অপ্রতিভ হওয়া! কিন্তু এখন
আবার ভয় হচ্চে বোন যে, এ-দোর অভিমানে আবার বন্ধ হতেও তো দেরি না হতে পারে। অনেক
কালের পরে ফিরিয়ে-পাওয়া প্রিয়জনকে দেখে বুকে হরষণ যেমনই জাগে, তার পিছু পিছু
অভিমান-ক্রন্দনও তেমনই জলভরা চোখ নিয়ে এসে সে দাঁড়ায়! তাই বলি কী, তুই এমনি
অপ্রত্যাশিত পথ দিয়ে এমনি করে আচমকা কুক দিয়ে দিয়ে আমার মর্মর-মন্দিরের পাষাণ অর্গল
খুলে ফেলিস! এখন আমার যা মনের অবস্থা, তাতে যদি তুই রোজ এসে এমনি করে দেখা দিস তাহলে
হয়তো আবার আমার মনের খিড়কি বন্ধ হয়ে যাবে। কী বলিস ভাই? লক্ষ্মীটি, এতে যেন অভিমানে
তোর পাতলা অধর ফুলে না ওঠে! তোর সেই হারিয়ে-যাওয়া ‘সাহসি’ সইটিকে আগে এই গম্ভীরা
শিক্ষয়িত্রী মহাশয়ার মাঝে জাগিয়ে তোল, তাহলে আবার নয়তো শিং ভেঙে বকনা হওয়া
যাবে!উপমাটা নেহাত ওঁচা হয়ে পড়ল, না লো? সে যেই হোক, তোমার সেই চির-কিশোরী সাহসিটা
যে মরেছে, একদম মরেছে লো! তাকে বাঁচতে হলে কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় রস আনতে হবে! বুঝলি?
পারবি তো? দেখিস বেহায়া ছুঁড়ি, তুই যেন এই অবসরে আমার জন্যে বরাদ্দ করা চোখে
চালসে-লাগা বুড়ো-হাবড়া বলদ বরের দোহাই পাড়িস নে! হাঁ, লো! আমার এখনও বিয়েই হল না,
আর এরই মধ্যে নিকের জন্যে কোনো হাবড়া-বুড়োকে মোতায়েন করলি? তা ভাই, তোর যদি কোনো
নানাজি বা দাদাজি থাকেন তা হলে খবর দিস, এক দিন বর পসন্দ করতে নাহয় যাওয়া যাবে।
তাঁকে এখন থেকে চুলে কলপ দাড়িতে খেজাব আর চোখে সুরমা লাগানো অভ্যেস করতে বলবি কিন্তু!
কন্যা-পক্ষের কিন্তু একটা কথা ভাই, দেখিস, সে নানা-বরের যেন ওই সেই বাঁকুড়ার শুকলাল
বুড়োর মতো (মনে আছে তাকে?) য়্যা এক-কুলো দাড়ি না থাকে! মা গো মা! সে যে আমার মাথার
চুলের চেয়েও বড়ো রে! বুড়ো চলেছে তো চলেছে, যেন রাজসভার বন্দিনী চামর ঢুলোতে ঢুলোতে
চলেছে! এত যে বলছি তার কারণ দাড়ির ওই জটিল জটিলতার মধ্যে হাত-মুখ জড়িয়ে গেলে একেবারে
জবর-জং আর কী, নড়ন-চড়ন নাস্তি।
দাঁড়া, আগে আমার নিজের রামপটের আরও একটু না বললে আর মনের
উতপুতোনি মিটচে না। এইটে বলে বাকি দরকারি কথা কটা সেরে ফেলতে হবে। কেননা, এরই মধ্যে
প্রায় নটা বেজে গেল। যদিও আমি গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি, কিন্তু আমার এই প্রিয়জনদের
চিঠি লেখবার সময় আর কিছুতেই সব কথা বেশ গোছালো করে লিখতে পারিনে। সব কেমন এলোমেলো
হয়ে যায়। কিন্তু তা যেন অন্তত আমার কাছে ভাই বেশ মিষ্টি লাগে। এতে কেরদানি করে
লেখবার চেয়ে যে আসল প্রাণটুকুর – সত্যের সত্য-মিথ্যা ধরা পড়ে যায়! এই জন্যে খুব বেশি
ভাবাবেগ থাকা আমার বিবেচনায় খারাপের চেয়ে ভালোই বেশি। তাছাড়া, এতে লাগাম-ছাড়া ঘোড়ার
(যেমন তোদের নূরুল হুদা বাঁধন-হারা) মতন একটা বন্ধনহীন উচ্ছৃঙ্খল আনন্দ বেশ গাঢ় করে
উপভোগ করা যায়। এ আনন্দ কিন্তু বন্ধন-দশাপ্রাপ্ত বেচারিদের কাছে একটা অনাসৃষ্টি
চক্ষুশূলের মতোই বাজবে। আহা, এ-বেচারাদের প্রাণে যে আনন্দই নেই, তা তারা আনন্দের
মুক্তির মাধুর্য বুঝবে কী করে? একটু সাংসারিক সামান্য মামুলি সুখের মায়াতেই এরা মনে
ভাবে, কেন এই তো আনন্দ! সেই দাড়িওয়ালা রাজার দাড়িতে তেঁতুল-গুড় লাগিয়ে সেই দাড়ি চুষে
আম খাওয়ার স্বাদ বোঝা আর কী!... যাক সে সব কথা, আমরা তো আর জোর করে মরা লোককে
বাঁচাতে পারব না! যার প্রাণে আনন্দই নেই তাকে বুঝাব কী – দু চুলোর ছাই আর পাঁশ?
দেখলি? কী বলতে গিয়ে ছাই ভুলেই গেলাম! যাক গে!...
আমার পরম স্নেহের পাগল পথিক-ভাই নূরুকে নিয়ে যখন আমায় খোঁচাই
দিয়েছিস রেবা, তখন তার দিক হয়ে আমায় রীতিমতো ওকালতি বাক্যুদ্ধ (দরকার হলে
মল্লযুদ্ধও অসম্ভব নয়!) করতে হবে দেখচি তোর সাথে। কেননা, আমিই এখন এ স্নেহ-হারার বড়ো
বোন, আর সে হিসাবে তুই আমার ভাই-এর ভাবি অর্থাৎ কি-না আমার ভাজ! অতএব আমি তোর ননদিনি!
তবে আয় একবার ননদ-ভাজে বেশ করে একটা কাজিয়া-কোঁদল পাকানো যাক, একেবারে কাহারবা
বাজার মতো জোর! আমি এই আমার আঁচলপ্রান্ত কোমরে জড়ালাম! তুইও তবে তোর মালসা-খ্যাংরা
নিয়ে বস।
সর্বপ্রথম পাগল নূরুর-কাণ্ড-কারখানা নিয়ে তোর এত রাগ হওয়া ভয়ানক
অন্যায়। যে বাঁধন নেবে না, তাকে জোর করে বাঁধতে গিয়েছিলি, সে কখনও সম্ভব হয় রে বোন?
পাগলা হাতি আর উদমো ষাঁড়কে জিঞ্জির বা দড়াদড়ি দিয়ে বাঁধলে হয় তারা বাঁধন ছিঁড়বে, নয়
আছাড় খেয়ে খেয়ে মরে বন্ধনমুক্ত হবেই হবে। আর যদিই ব্যতিক্রম স্বরূপ বেঁচে যায়, তবে
সে বাঁচা নয়, সে হচ্ছে জীয়ন্তে-মরা! মুক্ত আকাশের পাখিকে সোনার শিকল, মণি-মাণিক্যের
দাঁড়, দুধ-ছোলা দেখিয়ে হয়তো প্রলুব্ধ করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু তাকে কেউ বেঁধে
রাখতে তো পারবে না। সেও অমনি করে বন্ধনমুক্ত হবেই! যার রক্তে-রক্তে বাঁধন-হারার
ব্যাকুল ছায়ানটের নৃত্য-চপলতা নাচচে, শিরায়-শিরায় পূর্ণ তেজে নট-নারায়ণ রাগের
ছন্দ-মাতন হিন্দোল-দোল দিচ্ছে, তাকে থামাতে যাওয়া মানেই হচ্চে, তার ওই নৃত্য-চপলতা
আর হিন্দোল দোলে আরও আকুল চঞ্চলতা জাগিয়ে দেওয়া, আরও বিপুল দোল-উন্মাদনা দুলিয়ে
দেওয়া! তুই ওকে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করতিস? হাসি পায় তোর ছেলে-মানুষি কথা শুনে! আগ্নেয়
পর্বত দু-চার দিন শান্ত থাকলেও তার বুকের আগুন-দরিয়া যাবে কোথায়? আমরা বাইরে থেকে
তাকে শান্ত ভেবে খুব চাল চালতে পারি তার ওপরে,কিন্তু এটা যে আমরা ভুলে যাই যে, তার
বুকের অগ্নি-সিন্ধুতে অনবরত ঊর্মি-লীলার তাণ্ডব-নাচ চলেছে ; ওই তুঙ্গ তরঙ্গ-গতির
সমস্ত শক্তি জমে জমে এক এক বার যখন হু-হু করে আগুনের প্রতাপ-ফোয়ারা ছোটে, তখন আমরা
গালে হাত দিয়ে ভাবি, – ইস্ হল কী!... নয়? আমি তো তোকে হাজার বার মানা করেছিলাম যে,
মিছে বোন এ খ্যাপাকে গারদে পুরবার চেষ্টা, এ হচ্ছে বিশ্ব-মাঠে ছেড়ে-দেওয়া
চিরমুক্তের দাগ। উদ্মো ষাঁড়! গরিবের কথা বাসি হলে ফলে!... আমার বুক-ভরা বেদনা-ঝঞ্ঝা
এনে এই বাঁধন-হারার ব্যথার প্রশান্ত মহাসাগরে দুরন্ত তরঙ্গ-সংঘাত আর কল-কল্লোল
জাগিয়ে দেওয়ার যে বদনাম তুই আমার ওপর দিয়েছিস, তাতে সত্য হলে আমি সগৌরবেই সায় দিতাম।
কিন্তু আদতে যে সেটা ভুল বোন। এ ঘর-ছাড়া পাগলের দলকে কে যে কোন্ চিরব্যথার বন থেকে
ঘর-ছাড়া ডাক ডাকছে, তা আমিও বলতে পারব না, তুইও পারবিনে, এমনকি ওই ঘর-ছাড়া পাগল
নিজেই বলতে পারবে না!সে তো আজকের গৃহ-হারা নয় রে রেবা, সে যে চির উদাসী, চিরবৈরাগী!
সৃষ্টির আদিম দিনে এরা সেই যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, আর তারা ঘর বাঁধল না। ঘর দেখলেই এরা
বন্ধন-ভীতু চখা হরিণের মতন চমকে ওঠে। এদের চপল চাওয়ায় সদাই তাই ধরা পড়বার
বিজুলি-গতিতে ভীতি নেচে বেড়াচ্ছে! এরা সবাই কান খাড়া করে আছে, কোথায় কোন্ গহন-পারের
বাঁশি যেন এরা শুনছে আর শুনছে! যখন সবাই শোনে মিলনের আনন্দ-রাগ, এরা তখন শোনে
বিদায়ী-বাঁশির করুণ গুঞ্জরন! এরা ঘরে বারেবারে কাঁদন নিয়ে আসছে, আবার বারেবারে
বাঁধন কেটে বেরিয়ে যাচ্চে! ঘরের ব্যাকুল বাহু এদের বুকে ধরেও রাখতে পারে না। এরা
এমনি করে চিরদিনই ঘর পেয়ে ঘরকে হারাবে আর যত পরকে ঘর করে নেবে! এরা বিশ্ব-মাতার বড়ো
স্নেহের দুলাল, তাঁর বিকালের মাঠের বাউল-গায়ক চারণ-কবি যে এরা! এদের যাকে আমরা ব্যথা
বলে ভাবি, হয়তো তা ভুল! এ খ্যাপার কোনটা্ যে আনন্দ, কোনটান যে ব্যথা তাই যে চেনা
দায়! এরা সারা বিশ্বকে ভালোবাসছে, কিন্তু হায়, তবু ভালোবেসে আর তৃপ্ত হচ্ছে না!
এদের ভালোবাসার ক্ষুধা বেড়েই চলেছে, তাই এরা অতি সহজেই স্নেহের ডাকে গা ঘেঁষে এসে
দাঁড়ায়, কিন্তু স্নেহকে আজও বিশ্বাস করতে পারল না এরা। তার কারণ ওই বন্ধন-ভয়। এদের
ভালোবাসা এত বিপুল আর এত বিরাট যে, হয়তো তোমরা তাকে উন্মাদের লক্ষণ বলেই ভাব।... আর
অগ্নির কথা? আগুন যদি না থাকবে, তবে এদের চলায় এমন দুর্বার গতি এল কী করে? এরাই
পতঙ্গ, এরাই আগুন। এরাই আগুন জ্বালে, এরাই পুড়ে মরে। আগুন তো এদের খেলার জিনিস।
আগুনে এ যে কত বার ঝাঁপ দেবে, কত বার পুড়বে, কত বার বেরিয়ে আসবে,
তা তুই তো জানিসনে, আমিও জানিনে!
তোর সহজ বুদ্ধি দিয়ে তুই সহজভাবে নূরুকে যেরকমভাবে বুঝে আমায়
চিঠিতে লিখেচিস, তা দু-এক জায়গা ছাড়া সবই সত্যি। হয়তো আমার ভুল হতে পারে বুঝবার, তবে
কিনা, তোদের সংসারী লোকের চেয়ে সংসারের বাইরে থেকে নানান ব্যথা-বেদনার মধ্যে দিয়ে
আমরা মানব-চরিত্র বা মানুষের মন বেশি করে বুঝি আর সেই হিসাবেই আমি এই বাঁধন-হারাদের
সম্বন্ধে এত কিছু মনস্তত্ত্ব বা দর্শন লিখে জানালেম তোকে।
নূরুকে স্রষ্টার বিদ্রোহী বলে তোর ভয় হয়েছে বা দুঃখ হয়েছে দেখে
আমি তো আর হেসে বাঁচিনে লো! নূরুটাও স্রষ্টার বিদ্রোহী হল, আর অমনি স্রষ্টার
সৃষ্টিটাও তার হাতে এসে পড়ল আর কী!... এখন ওর কাঁচা বয়েসে, গায়ের আর মনের দুই-এরই
শক্তিও যথেষ্ট, তার শরীরে উদ্দাম উন্মাদ যৌবনের রক্ত হিল্লোল বা খুন-জোশি তীব্র
উষ্ণ গতিতে ছোটাছুটি করচে, তার ওপর আবার এই স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল বাঁধন-হারা সে,
– অতএব এখন রক্তের তেজে আর গরমে সে কত আরও অসম্ভব সৃষ্টি-ছাড়া কথাই বলবে! এখন সে
হয়তো অনেক কথা বুঝেই বলে, আবার অনেক কথা না বুঝেই শুধু ভাবের উচ্ছ্বাসেই বলে ফেলে!
একটা বলবান জোয়ান ষাঁড় যখন রাস্তা দিয়ে চলে, তখন খামখাই সে কত দেওয়ালকে কত গাছকে
ঢুঁস দিয়ে বেড়ায় দেখেছিস তো? এটা ভুলিসনে যেন রেবা যে, এ-ছেলে বাংলাতে জন্ম নিলেও
বেদুইনদের দুরন্ত মুক্ত-পাগলামি, আরবিদের মস্ত গোর্দা, আর তুর্কিদের রক্ত-তৃষ্ণা
ভীম শ্রোতাবেগের মতো ছুটছে এর ধমনিতে-ধমনিতে। অতএব এসব ছেলেকে বুঝতে হলে এদের আদত
সত্য কোন্খানে, সেইটেই সকলের আগে খুঁজে বের করতে হবে। এত বড়ো যে ধর্ম, তারও তো
সামাজিক সত্য, লৌকিক সত্য, সাময়িক সত্য ইত্যাদি-ইত্যাদি কত রকমের না বাইরের
খোলস-মুখোশ রয়েছে, তাই বলে কি এই সব অনিত্য সত্যকে ধর্মের চিরন্তন সত্য বলে ধরতে হবে?
অবিশ্যি সত্য কখনও অনিত্য বা নৈমিত্তিক হতে পারে না, শুধু কথাটা বোঝাবার জন্যে আমাকে
ওরকম করে বলতে হল। প্রত্যেক ধর্মই সত্য – শাশ্বত সত্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত এবং কোনো
ধর্মকে বিচার করতে গেলে তার এই মানুষের গড়া বাইরের বিধান শৃঙ্খলা দিয়ে কখনও বিচার
করব না ; আর তা করতে গেলে কানার হাতি দেখার মতোই ঠকতে হবে ; তেমনি মানুষকে – তার
চির-অমর আত্মাকে – তার সত্যকে বুঝতে হলে তার অন্তর-দেউলে প্রবেশ করতে হবে ভাই! তার
বাইরের মিথ্যা আচার-ব্যবহারকে সত্য বলে ধরব কেন?
হয়তো আমি কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বলতে পারছিনে, আর পারবও না, কেননা,
আমার মনের সে-শান্ত স্থৈর্য নেই। মন শুধু বাইরে বাইরে ছুটে বেড়াচ্চে। তবে এরই মধ্যে
আমার বলবার আদত সত্যটুকু খুঁজে বের করে নিয়ো।... হাঁ, আদত মানুষটাকে বুঝতে হলে
অবিশ্যি তার এই আচার-ব্যবহারগুলোকেই প্রথমে ঘেঁটে দেখতে হবে। কিন্তু এ ঘেঁটে সব সময়
মুক্তি পাওয়া যায় না, অনেক সময় কাদা-ঘাঁটাই সার হয়। যাক, তাহলেও মানুষ মাত্রেরই
নানান ভুল-ভ্রান্তি আছে দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। যারা এই সব ‘স্রষ্টার বিদ্রোহী’
তরুণদের গালি দেয়, তারাই বা ‘স্রষ্টার রাজভক্ত’ প্রজা হয়ে সে স্রষ্টা-রাজা সম্বন্ধে
কোনো খবরাখবর রাখে কি? আর পাঁচ জনের মতন শুধু চোখ বুঁজে অন্ধবিশ্বাসে অন্ধের মতন
হাতড়িয়ে বেড়ানোতেই কি সে অনাদি অনন্ত সত্যকে তারা পাবে? যারা এইরকম বিদ্রোহীদের
নাস্তিক ইত্যাদি বলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে, তারা আস্তিক হয়েই সে পরম পুরুষের
কতটুকু খবর রাখে? তাঁর খবর রাখা, তাঁকে ভাবা তো অন্য কথা, তাঁকে – সত্যকে যে অহরহ
এই আস্তিকের দল প্রতারণা করচে, এ ভণ্ডামি কি তারা নিজেও বোঝে না? মন্দিরে গিয়ে পূজা
করা আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াটাই কি ধর্মের সার সত্য? এগুলো তো বাইরের বিধি। কিন্তু
এগুলোকেই কি তারা ভালো করে মেনে চলতে পারে? মন্দিরে গিয়ে দেবতার মুখস্ত মন্ত্র
আওড়ায়, কিন্তু মন থাকে তার লোকের সর্বনাশের দিকে! মসজিদে গিয়ে নামাজের ‘নিয়ত’ করেই
ভাবে যত সব সংসারের পাপ দুশ্চিন্তা! এই ভণ্ডামি এই প্রতারণাই তো এদের সত্য! অতএব
এদের মতো এমনই করে আত্মাকে বিনাশ না করে তাদেরই একজন যদি সত্যকে পাওয়ার জন্যে নিজের
নতুন পথ কেটে নেয়, তবে এরা লাটি-সোঁটা নিয়ে যে তাকে তাড়া করবেই – কিন্তু নিবীর্যের
মতো! একজন সত্যান্বেষী বিদ্রোহীকে তাড়া করবার মতো শক্তি এ-মিথ্যুক ভণ্ডদের যে
বিলকুল নাস্তি! ও কেবল ভীত সারমেয়ের দাঁত-খিঁচুনি মাত্র। এরা যে মিথ্যাকে,
প্রতারণাকে কেন্দ্র করেই আত্মাকে ক্রমেই নীচের দিকে ঠেলচে, তা এটা বুঝলেও কিছুতেই
স্বীকার করবে না। সত্যকে স্বীকার করবার মতো সাহসই যদি থাকবে, তবে এদের এমন দুর্দশাই
বা হবে কেন? মনসুর যখন বিশ্বের ভণ্ড-মিথ্যুকদের মাথায় পা রেখে বলেছিল, – ‘আনাল হক’
– আমিই সত্য – সোহহম, তখন যেসব বক-ধার্মিক তাঁকে মারবার জন্যে হই-হই রই-রই করে
ছুটেছিল, এ লোকগুলো যে তাদেরই বংশধর! এ মিথ্যা ধার্মিকের দলই তো সে দিনে ওই মহর্ষি
মনসুরের কথা, তাঁর সত্য বুঝতে পারেনি, আজও পারচে না, আর পরেও পারবে না ; এদের এই
রকম একটা দল থাকবেই! কিন্তু যারা সত্যকে পেতে চলেছে, যাদের লক্ষ্য সত্য, যারা
সত্যের হাতছানি দেখচে তাদের এই সব শক্তিহীন হীনবীর্য লোক কি থামাতে পারে? সত্য যে
চির-বিজয়ের মন্দারমালা গলায় পরে শান্ত-সুন্দর হাসি হাসবে।... তাছাড়া, বিদ্রোহী
হওয়াও তো একটা মস্ত শক্তির কথা। লক্ষ লক্ষ লোক যে জিনিসটাকে সত্য বলে ধরে রেখে
দিয়েচে, চিরদিন তারা যেপথ ধরে চলেছে তাকে মিথ্যা বলে ভুল বলে তাদের মুখের সামনে বুক
ফুলিয়ে যে দাঁড়াতে পারে, তার সত্য নিশ্চয়ই এই গতানুগতিক পথের পথিকদের চেয়ে বড়ো। এই
বিদ্রোহীর মনে এমন কোনো শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত চাওয়া চাইছে যার সংকেতে সে
যুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা, সব-কিছুকে গা-ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্যে আলাদা
পথ তৈরি করে নিচ্ছে! কই, হাজারের মধ্যে আর নয়শো নিরানব্বই জন তো এমন করে দাঁড়াতে
পারে না? তুমি কী বল, এই নয়শো’ নিরানব্বই জনই তা হলে সত্যকে পেয়ে বসে আছে? যে মরণকে
ধ্বংসকে পরোয়া না করে না-চলার পথ দিয়ে চলে, কত বড়ো দুর্জয় সাহস তার? আর সত্যের শক্তি
অন্তরে না থাকলে তো সাহস আসে না। ... তাছাড়া, প্রত্যেকের আত্মারও তো এক-একটা
স্বতন্ত্র গতি আছে। আর সকলের মতো একজন গড্ডলিকা-প্রবাহে যদি না চলে, তা বলে কি তার
পথ ভুল? বিশেষ করে বিদ্রোহী হওয়ার যেমন শক্তি থাকা চাই, তেমনই অধিকারও থাকা চাই। কই,
আমি তো বিদ্রোহী হতে পারিনে, তুমি তো হতে পার না ; আমাদের মাঝে যে সে বিপুল
সহ্য-শক্তি নেই। ... বিদ্রোহটা তো অভিমান আর ক্রোধেরই রূপান্তর। ছেলে যদি রেগে বাপকে
বাপ না বলে, বা মা-কে মা না বলে, কিংবা বলে যে এরা তার বাপ-মা নয়, তাহলে কি
সত্যি-সত্যিই তার পিতার পিতৃত্ব, মাতার মাতৃত্ব মিথ্যা হয়ে যায়? যে ক্ষুব্ধ অভিমান
তার বুকে জাগে, তার শেষ হলেই মায়ের খ্যাপা ছেলে ফের মায়ের কোলেই কেঁদে লুটিয়ে পড়ে!
কিন্তু এই যে অভিমান, এই যে আক্রোশের অস্বীকার, তা দিয়ে হয় কী? – না, সে তার
বাপ-মাকে আরও বড়ো করে চেনে, বড়ো করে পায়। এই রকম করে হঠাৎ একদিন চিরন্তনী মাকেও হয়তো
তার পক্ষে পাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া তার যে অধিকার আছে এই অভিমান করবার, এই বিদ্রোহী
হওয়ার, কেননা, সে তার মায়ের স্নেহটাকে এত নিবিড় করে পেয়েছে যা দিয়ে সে জানে যে, তার
সমস্ত বিদ্রোহ সমস্ত অপরাধ মা ক্ষমা করবেনই। যে স্নেহে যে ভালোবাসায় অভিমান জাগতে
পারে, রাগ জন্মাতে পারে, সে স্নেহ-ভালোবাসা কত বড়ো কত উচ্চ একবার ভাব দেখি ! এতে
মা-র অপমান না হয়ে তাঁকে যে আরও বড়ো করে দেওয়া হয় রে! তাই মা ঝোঁক-নেওয়া খ্যাপা
ছেলের ঝোঁক নেওয়া দেখে ছেলের হাতের মার খেয়েও গভীর স্নেহে চেয়ে চেয়ে হাসেন! এ-দৃশ্য
বলে বোঝাবার নয়! ছেলের হাতের এ-মার খাওয়াতে যে মায়ের কত আনন্দ কত মাধুরী তা তো
বাইরের লোকে বুঝতে পারে না। তারা মনে করে, কী বদমায়েশ দুরন্ত ছেলে বাবা! কিন্তু যে
ছেলে মায়ের এত স্নেহ পায়নি, এমন অধিকার পায়নি, সে মাকে মারা তো দূরের কথা, তাঁর কাছে
ভালো করে কাছ ঘেঁসে একটা আবদারও করতে পারে না! ... তাই প্রথমেই বলেছিলাম যে, এই
বাঁধন-হারা নূরু যেন বিশ্ব-মাতার বড়ো স্নেহের দুলাল – ঠিক ‘কোল-পোঁছা’ ছেলের মতন
আবদেরে একজিদ্দে একরোখা – আর তোদের কথায় বিদ্রোহী! অনেক ছেলে মরে মরে যাওয়ার পর যে
এই খ্যাপাই মায়ের মড়াচে ঝোঁকদার ছেলে! দেখবি, এ-শিশু আবার হাসতে-হাসতে মায়ের
স্তন্য-ক্ষীর পান করচে আর আপন মনেই খেলচে!... মা যখন তাঁর দুষ্টু ছেলেকে স্নান
করবার সময় সাবান দিয়ে তোয়ালে দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেন, তখন তার কান্না আর রাগ
দেখেছিস তো? সে তখন হাতে-দাঁতে মায়ের চুল ছিঁড়তে থাকে, কিল-চাপড় বর্ষণ করতে থাকে আর
চেঁচিয়া আকাশ ফাটিয়ে ফেলে। মা কিন্তু হাসতে হাসতে তাঁর কাজ করে যান। তাকে ধুয়ে-মুছে
সাফ করে নীলাম্বরী ধুতিটি পরিয়ে দিয়ে চোখে কাজল টিপটি দিয়ে যখন মুখে ঘন ঘন চুমো খান
তখন আবার সেই দুরন্ত ছেলের প্রাণ-ভরা হাসি দেখেছিস? – নূরুটারও এখন হয়েছে তাই।
বিশ্ব-মাতা এখন তাকে ধুয়ে-মুছে রগড়ে সাফ করে নিচ্ছেন, আর সেও তাই এই হাত-পা ছুঁড়ে
কান্না জুড়ে দিয়েচে। মা যেদিন কোলে নিয়ে চুমো খাবেন, সেদিন কোথায় থাকবে এর এই ভূতোমি
আর কোথায় থাকবে এই কান্না আর লাফালাফি। তখন সব সুন্দর – সুন্দর! সুন্দর! এ শুভ দিন
তার জীবনে জাগবেই ভাই, দেখে নিস তুই। তবে তার হয়তো এখন অনেক দেরি। তার জীবনে হৃত্য
রয়েচে, তবে রুদ্র মূর্তিতে! এর পরেই যখন কল্যাণ জাগবে জীবনে, তখন দেখবি সব সুন্দর
হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দে বোন, ওকে ছেড়ে দে! চলুক ও নিজের একরোখা পথ দিয়ে – কল্যাণকে
আপনিই ও খুঁজে নিবে। কল্যাণ নিজেই ওর পিছু পিছু মালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্চে, সময়
বুঝলেই সে এই পাগলার গলায় মালা দিয়ে ওকে ভুজ-বন্ধনে বেঁধে ফেলবে। তুই লাল কালিতে
ডগডগে করে লিখে রেখে দে এই কথা। আমি জানি, আমার এ ভবিষ্যদ্বাণী ফলবেই ফলবে, যদিও
আমি পয়গম্বর নই।
হাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই
বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের পর – যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও
রয়েছে এবং অন্ততেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে
পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিষ্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো
কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো
ওইখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এঁরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এঁরা
নিজের ধর্মের উপর এমনই অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে
ছোবল মারতে ছোটেন। কিন্তু এটুকু বোঝেন না তাঁরা যে, তাঁদের ‘ইমান’ বা বিশ্বাস,
তাঁদের ধর্ম কত ছোটো কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে
পারে না। ধর্ম কি কাচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙে যাবে? ধর্ম যে বর্মেরই মতন
সহ্যশীল, কিন্তু এ-সব বিড়াল তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তো তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে।
তাঁদের বিশ্বাস তো ওই এতটুকু বা সত্যের জোরও অমনই ক্ষুদ্র, যে, তার সত্যাসত্য
নিরূপণের জন্যে তোমায় আলাদা পথে যেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তা নিয়ে একটা প্রশ্নও করতে
দেবেন না। ... এই সব কারণেই, ভাই, আমি এই রকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি
ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী। তারা সত্যকে পায়নি বলে সোজা সেটা স্বীকার করে ফেলে বলে
বেচারাদের হয়েচে ঘাট! অথচ তারা এই সত্যের স্বরূপ বুঝতে, এই সত্যকে চিনতে এবং সত্যকে
পেতে দিবা-রাত্তির প্রাণপণ চেষ্টা করচে – এই তো সাধনা – এই তো পূজা, এই তো আরতি। এই
জ্ঞান-পুষ্পের নৈবেদ্য চন্দন দিয়ে এরা পূজা করবে আর করচে, তবু দেবতাকে অন্তরে পায়নি
বলে মুক্তকণ্ঠে আবার স্বীকারও করচে যে, কই দেবতা? কাকে পূজা করচি? আহা! কী সুন্দর
সরল সহজ সত্য! এদের ওপর ভক্তিতে আপনিই যে মাথা নুয়ে পড়ে। এরা যাই হোক, এরা তো
মিথ্যুক নয়, এরা বিবেকের বিরুদ্ধে কথা বলে না – এরা যে সত্যবাদী। অতএব এরা সত্যকে
পাবেই পাবে ; আজ না হয় কাল পাবে! আর এই বেচারারা অন্ধ বিশ্বাসীর দল? বেচারারা কিছু
না পেয়েই পাওয়ার ভান করে চোখ বুঁজে বসে আছে। অথচ এদের শুধোও দেখবে দিব্যি
নাকি-কান্না কেঁদে লোকে-দেখানো ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলবে, – ‘আঁ হাঁ হাঁ! – মঁরিঁ মঁরিঁ।
ওঁই ওঁই ওঁই দেঁখোঁ তিঁনিঁ!’ মিথ্যার কী জঘন্য অভিনয় ধর্মের নামে – সত্যের নামে!
ঘৃণায় আপনিই আমার নাক কুঁচকে আসে। তাই তো আমি বলি যে, এই পথ-হারানোটা পথ খুঁজে
পাওয়ারই রূপান্তর। তবে যা-কিছু বুঝবার ভুল। গুরুদেব সত্যি-সত্যিই গেয়েচেন, –
‘ভাগ্যে আমি
পথ হারালেম পথের মধ্যখানে!’
আমার বাচ্চা-সই মাহ্বুবা সম্বন্ধে যে ভয় করেছিস তুই, তার কোনো
কারণ নেই। আমি তাকে খুব ভালো করেই বুঝেছিলাম যে-কয়দিন ছিলাম তার সঙ্গে। সে সহজিয়া।
সেহজেই ওই খ্যাপাটাকে ভালোবেসেছিল, আর এমনই সহজ হয়েই সে তাকে চির-জনম ভালোবাসবে।
তার বুকে যদি কখনও যৌবনের জল-তরঙ্গ ওঠে, তবে সে খুব ক্ষণস্থায়ী। যে সহজিয়া অতি
সহজেই তার প্রিয়তমকে ভালোবাসতে পারে, তার মতো সুখী দুনিয়ায় আর কেউ নেই রে বোন। তার
শান্তি তার আনন্দ অনাবিল, পূত, অনবদ্য, – একেবারে শিশির-ধোয়া শিউলির মতো! সে তার
সমস্ত কিছু নৈবেদ্যের ডালি সাজিয়ে সেই যে এক মুহূর্তেই তার পীতমের পায়ে শেষ একরেখা
দীর্ঘশ্বাস আর আধ-ফোঁটা নয়ন-জলের অঞ্জলি অঞ্জলি করে ঢেলে দিয়েচে তার পরে তার আর কোনো
দুঃখই নেই! সে জেনেছে যে, সে সব পেয়েছে। সে জেনেছে যে, সে প্রাণ ভরে দিয়েছে আর সে
দান দেবতাও বুক পেতে নিয়েছেন। সে জানে – খুব সহজভাবেই জানে – তার এত বুক-ভরা পবিত্র
ফুলের দান, তার এমন সহজ পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয়। সহজভাবে দিতে জানলে যে অতি-বড়ো
পাষাণ-দেবতাও সেখানে গলে যান, নিজেকে রিক্ত করে সমস্ত কিছু ওই সহজ পূজারিকে দান করে
ফেলেন। গুরুদেবের ‘কে নিবি গো কিনে আমায় কে নিবি গো কিনে’ শীর্ষক কবিতাটা পড়েছিস
তো? তাতে তিনি দিন-রাত তাঁর পসরা হেঁকে হেঁকে বেড়াচ্চেন, – ওগো আমায় কে কিনে নেবে?
কত লোকই এল, – রাজা এল, বীর এল, সুন্দরী এল, কিন্তু হায়, সকলেই ‘ধীরে ধীরে ফিরে গেল
বন-ছায়ার দেশে।’ সকলেরই ‘মুখের হাসি ফুরিয়ে গেল নয়ন জলে শেষে!’ কিন্তু ধুলো নিয়ে
খেলা-নিরত একটি ছোট্ট ন্যাংটা শিশু যখন তুড়ুং করে লাফিয়ে উঠে তার কচি ছোট্ট দুটি
হাত ভরিয়ে ধুলো-বালি নিয়ে বললে – ‘আমি তোমায় অমনি নেব কিনে!’ তখন কবিও তাঁর পসরা
ওইখানে ওই সহজিয়ার সহজ চাওয়ার কাছে বিনামূল্যে বিকিয়ে দিয়ে মুক্তি পেলেন। আমাদেরও
নয়নপাতা তখন এই সহজের আনন্দে আপনিই ভিজে ওঠে! এমনি সহজ করে চাওয়া চাই, এমনি সহজ হয়ে
দেওয়া চাই রে বোন, আর তবেই যে পায় সেও বুক ভরে নেয়, যে দেয় তারও বুক ভরে যায়!... এই
সহজ আনন্দে তার সমস্ত কিছু দিতে পেরেছে বলেই তো মাহ্বুবা আজ ছোট্ট মেয়ে হয়েও নিখিল
সন্ন্যাসিনীর চেয়েও বড়ো। তাই সে বৈরাগিনীও হল না, সন্ন্যাসিনীও হল না ; ক্রুদ্ধা
জননি যখন তাকে এক বুড়ো বরের হাতে সঁপে দিলে, তখনও সে সহজেই তাতে সম্মতি দিল। এই
সহজিয়ার কিন্তু এতে কোনো দুঃখই নেই, সে যে জানে যে, তার যা দেওয়ার তা অনেক আগেই যে
নিবেদিত হয়ে গিয়েছে । অর্ঘ্য নিবেদিত হয়ে যাওয়ার পর শূন্য সাজি বা থালাটা যে ইচ্ছা
নিয়ে যাক, তাতে আর আসে যায় না। ... এই সহজিয়া পূজারিনির দল যে আমাদের ঘরে-ঘরে রয়েছে
বোন, তবে আমাদের চোখ নেই, – আমরা দেখেও দেখি না এই নীরব পূজারিনিদের। এই সহজিয়া
তপস্বিনীদের পায়ে আমি তাই হাজার হাজার সালাম করচি এইখানে! আমাদের বুকে কিন্তু এই
মূক মৌন সহজিয়াদের ব্যথাটাই চোখে পড়ে, আর বুকে বেদনার মতোই এসে বাজে। বাস্তবিক বোন,
কী করে এই হতভাগিনি (না, ভাগ্যবতী?)-দের বুক এমন সহজ সুখের নেশায় ভরে যায়? এমন
সর্বস্বহারা হয়েও কী করে এত জান-ঠান্ডা –করা তৃপ্তির হাসি হাসে? আমরা তা হাজার
চেষ্টা করেও বুঝতে পারব না ; কেননা, আগে যে অমনি সহজ হতে হবে ও বুঝতে হবে। ... সেই
জন্যেই বলেছিলাম যে, মাহ্বুবার জন্যে কোনো চিন্তা করিসনে। সে আনন্দকে পেয়েছে, সে
কল্যাণকে পেয়েছে, – সে মুক্তিও পেয়েছে এইখানে। কিন্তু সে এত বড়ো বড়ো কথা হয়তো
বুঝবেও না। আমরা যেটা বুঝি চেষ্টা-চরিত্তির করে সে সেটা সহজেই বুঝে নিয়েচে, এইখানেই
তো সহজিয়ারা সহজ আনন্দে মুক্ত।
এই সহজিয়া মাহবুবা হয়তো সহজেই বন্ধনের মাঝে মুক্তি দিতে পারত।
কিন্তু কেন যে তা হল না, সে একটা মস্ত প্রহেলিকা। আমি এখনও এর কিছুই বুঝতে পারছিনে।
এইখানটাতেই নূরুটাতে আজ মাহ্বুবাটাতে যে একটা কোনো গুপ্ত জটিলতা আছে, যেটার খেই আমি
আজও পাচ্ছিনে। আর, আমার মতন ওস্তাদ যেখানে হার মানলে সেখানে তোর মতন চুনো-পুঁটির তো
কর্মই নয়! তবে এর নিগূঢ় মর্ম আমি বের করবই করব, এই বলে রখলাম তোকে!
আমার বিশ্বাস, মাহ্বুবাটা এই বাঁধন-হারাকে সইতে পারবে না বলে
মিথ্যা ভয়ে তাকে মুক্তির নামে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য এটা আমার আন্দাজ
মাত্র। এটা না হওয়াই সম্ভব, কারণ সে মেয়ে যে সহজিয়া, তার তো এ ভয় হওয়ার কারণ নেই!
... দেখি, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
একা মাহ্বুবার মা বেচারিই রাক্ষুসি হবে কেন, রেবা? এ-রকম
রাক্ষুসি মা – যারা জেনে-শুনে মেয়ের সর্বনাশ করে – তোদের সমাজে, হিন্দুর সমাজে এমনকি,
আমাদের স্বাধীন সমাজেও তো কিছু আশ্চর্য নয় আর কমও নয়। এই তো সতীত্বনাশ! অবিশ্যি,
সতীত্ব বলতে মনের না দেহের বোঝেন এঁরা, তা জানিনে ; কিন্তু আমার কথায় সতীত্ব তো মনে।
মনে মনে যাকে স্বামিত্বে বরণ করলে মেয়ে, তা জেনে শুনেও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে দুটো
মন্ত্র আউড়িয়ে জোর করে এই বোবা মেয়েদের যে কসাই মা-বাপ হত্যা করে! তাহলে
প্রকারান্তরে মা-বাপেই মায়ের সর্বনাশ করলে না কি? উলটো আবার সম্প্রদানের সময় মেয়েকে
সীতা সাবিত্রী হতে বলা হয়? কী ভণ্ডামি দেখছিস
তোর শাশুড়ি সম্বন্ধে অভিমান করে যে অভিযোগ করেছিস, তা নেহাত
অন্যায় হয়নি তোর পক্ষে। কেননা, সংসারের গিন্নির এরকম ঝাল ছাড়তে হয় মাঝে মাঝে। তবে
যখন ঘরের গিন্নিও হয়েছিস লো, তখন ঘর-গেরস্থালির একটু ঝাঁঝ সইতে হবে বই কি! এখনও তোর
‘যৌবন’ বয়েস কিনা (অর্থাৎ ভোগের সময়!) তাই মাঝে মাঝে বিরক্তি আসে। তবে এও সয়ে যাবে।
জানিস তো, কাঁচা লঙ্কা গিন্নিদের বড্ড প্রিয়! এ ঝাল না থাকলে সংসার মিষ্টিও লাগে না
আর তাতে রুচিও হয় না।
তোর শাশুড়ি বেচারির একেবারে সাদা সরল মন। সারা-মন-প্রাণ তাঁর
মায়ের স্নেহে ভেজা। এসব লোক সংসারে থেকেও চিরদিন একটু উদাসীন গোছের। সংসারের বাজে
ঝক্কি এঁরা নিমের রস গেলা করেই গেলেন। যেই দেখেন, আর একজনের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে
একটু আরামে নিশ্বাস ফেলতে পারবেন অমনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। তাইতো তোর হাতে সব
কিছুর ভার সঁপে দিয়ে তিনি নিরিবিলির অত্যন্ত শান্তিতে ডুবতে চাইছেন। ওঁর খেলার সাথি
এখন তোর কচি মেয়ে আনারকলি, কেননা, উনিও যে এখন তোর আর একটি নেহাত ঠাণ্ডা মেজাজের
লক্ষ্মী মেয়ে আর সেইজন্যই তো তুই তাঁর লক্ষ্মী-মা। আহা, ওঁর এ-শান্তিতে বাধা দিসনে
বোন! এ তপশ্চারিণীর নীরব পূত তপোবনে গিয়ে গোলমাল করে আর তাঁর শান্তি ভাঙিসনে। জানি
ওঁর দুঃখ অনেক, আর তাইতেই তো তিনি এখন শান্তির ছায়া খুঁজছেন। বাড়িতে থেকেও এসব
লোকের অস্তিত্ব বোঝা যায় না, কিন্তু বাড়ির সমস্ত শান্তিটুকুকে ঘিরে রয়েছেন এঁরাই,
বিহগ-মাতার ডানার মতো করে।
এঁরা যখন চলে যান, তখনই বুঝতে পারি যে, কী এক শূন্যতায় সারা
সংসার ভরে উঠেছে।
হাঁরে, ভালো কথা! তুই এ চিঠিতে খুকির কথা লিখিসনি যে বড্ড?
প্রথমে এটা আমার চোখে পড়েনি, কিন্তু শেষে জানতে পেরে হাজারবার তন্ন-তন্ন করে তোর
চিঠি খুঁজেও আমার ‘আনারকলি’ মা-র নাম-গন্ধও পেলাম না, আমার এতে কান্না পেয়ে গেল রাগে!
আচ্ছা ভোলা মেয়ে তুই যা হোক লো! বোধ হয় মেয়েটাকে চিরদিন এমনই অনহেলাই করবি, না? জানি,
তুই তোর হাজার কাজের ওজর করবি! চুলোয় যাক তোর কাজ, এমন আনারকলির মতোই এতটুকু ফুটফুটে
মেয়ে, – হায়, তাকে কখনও তোকে বুক ভরে সোহাগ করতে দেখলাম না। এ আমাদের বুকে বড়ো লাগে
বোন! অমন মা হতে গিয়েছিলি কেন লো তবে মুখপুড়ি? ‘মা’ আসবার আগেই হয়তো এই মা-কাঙালি
‘মেয়ে’ এসে পৌঁচেছে। কিন্তু এখনও কি তোর মাঝে ‘মা’ জাগল না? না, হাতের কাছে পেয়েই
এত অনহেলা? দেখ, তোর নাড়ির মাঝে যে মা এখনও সুপ্ত। খুকির বাবা রবিয়ল সাহের পুরুষ
হলেও তাঁর মাঝে সেই মা কী স্নেহময়ী মূর্তিতে জাগ্রত! কিন্তু এই ছেলের জাত কী
নিমকহারাম, সে যা পায় তাকে ছেড়ে দিয়ে যেটা পায় না সেইটাকেই পাবার জন্যে
হাঁকুচ-পাঁকুচ করে। বাপের এত স্নেহ পেয়েও তাই সে যে বেশি করেই তোর কোলের – মায়ের
কোলের কাঙাল, তা তো আমি নিজেই দেখেচি।
সত্যি ভাই, এ কচি মেয়েটাকে পেলে আমি যেন এখন বেঁচে যাই। আমি ওকে
এখনই চাইতাম, কিন্তু দুষ্টু তুই হয়তো একটা বদমায়েশি বিদ্রুপ করে বসবি বলে থেমে
গেলাম। খুকি বড়ো হলে কিন্তু আমার কাছে এসে থাকবে আর লেখাপড়া শিখবে বলে কথা দিয়েছিস,
মনে থাকে যেন।
সোফিটার অত্যাচারে তুই নাজেহাল হয়ে গিয়েছিস শুনে আমি আর হেসে
বাঁচিনে। আচ্ছা, জব্দ, না? ও জন্ম হতেই বড্ড বেশি আদর-সোহাগ পেয়ে মানুষ হয়েছে কিনা,
তাই এত দুরন্ত! তা নাহলে তোদের হারেমের আইবুড়ো থুবড়ো মেয়ে কি বলতে পারত ‘আমি বিয়ে
করব না, থুবড়ো থাকব’? ও এখনও একেবারে ছেলেমানুষ। তবে বিয়ে হওয়ার পর বরের হাতে পড়ে
হয়তো বাগ মানলেও মানতে পারে। ওর আদত ইচ্ছে কী জানিস? ও নূরুটাকে বিয়ে করতে চায়।
আমায় একদিন কানে কানে বলে ফেলে আমার হাসি দেখে সে কী ভাই রাগ আর লজ্জা তার!
কেঁদে-কেটে তো একাকার – অথচ খামখাই! আমি আর হেসে বাঁচিনে।
তারপর তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছি যে, এ কথাটা কী আমি আর সবাইকে বলতে
পারি রে, যে, আমার ছোটো বোন ভালোবাসায় পড়েছে! যতই হোক, আমি তো তার সাহসী দিদি, তবে
তখন সে চুপ করে। দেখিস ভাই, তোর পায়ে পড়ি, তুই যেন এ-কথা আবার বলে দিয়ে আমার সঙ্গে
ঝগড়া বাধিয়ে দিসনে! এ-পাগলি ছুঁড়িটার যৌবন কিন্তু বয়সের অনেক পেছনে পড়ে ; হয়তো বিশ
বছর বয়সে গিয়ে তবে কখনও ওর যুবতির লজ্জা আসবে। তবে বিয়ে হয়ে গেলে আলাদা কথা। কেননা,
তখন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো হবে কিনা।
তোর খেলার সাথি বেচারার দুঃখে আমি এতটুকুও সহানুভূতি দেখাতে
পাচ্ছিনে, কেননা তিনি এমন মূক না হয়ে গেলে কি আর তোর আমায় এখন মনে পড়ত রে ছুঁড়ি!
হাঁ, সোফির বিয়েতে যাব বই কি! তা নাহলে ওকে বাগ মানাবে কে? হয়তো
বিয়ের সময়ই রেগে দোর দিয়েই বসে থাকবে! ওকে বলে দিস বোন যে, সে বিয়ে যদি নেহাতই না
করে, তবে আমার স্কুলের মেয়ে দফতরি করে দেওয়া যাবে। দেখিস সে যেন ঠাট্টা মনে না করে।
তা হলেই আমি হাবাৎ আর কি?
আমার বরের ভাবনা নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না লো, তুই নিজের চরকায়
তেল দে! ‘যার বিয়ে তার ধুম নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নেই!’ যত দিন না আমার সন্ন্যাসীঠাকুর
আসবেন ততদিন আমায় সন্ন্যাসিনীই থাকতে হবে বই কি! সংসার না ডাকলে তো আর সংসারী হতে
পারিনে নিজে সেধে! থাক, আরও অনেক বলবার রইল! খুকিকে চুমু দিস। ইতি
সাহসিকা
১লা আষাঢ়
দুপুর রাত্তির
সাহসিকাদি! বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে গেল। ঝড়-ঝঞ্ঝা যত বইবার, বয়ে
গেল আমার জীবনের ওপর দিয়ে। কিন্তু বৃষ্টি আজও থামেনি। আজ পয়লা আষাঢ়। আমার জীবনের এ-আষাঢ়
বুঝি আর ফুরোবে না। আশীর্বাদ করো দিদি, সত্যিই এ আষাঢ়ের যেন আর শেষ না হয়।
বিয়ের পর আর কাউকে চিঠি দিইনি। আমার এত শ্রদ্ধার মা, দাদাভাই
রবিয়ল সাহেব, এত ভালোবাসার ভাবিসাহেবা – সোফি – সকলের মাঝে যেন একটা মস্ত আড়াল পড়ে
গেছে। আমি যেন কাউকেই আর ভালো করে দেখতে পাচ্ছিনে। সব মুখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে –
আমার মনের মুকুরে দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া লেগে! আজ আমার মনে হচ্ছে দিদি, যেন তুমি ছাড়া
আর আমার আপনার বলতে কেউ নেই। শুধু তুমিই আমার মনে আজও ঝাপসা হয়ে ওঠনি। তাই আজ আমার
মনের সকল দ্বন্দ্বগ্লানি কাটিয়ে উঠে তোমার পানে সহজ চোখে চাইতে পারছি। তাই আবার বলছি,
সাহসিকাদি, আজ তুমিই, – একমাত্র তুমিই আমার গুরু, আমার বন্ধু, আমার সখী – সব আজ আমি
মনের কথা যেন মন খুলে বলতে পারি তোমার কাছে। আজ যেন আমি আত্মপ্রবঞ্চনা না করি!
আর আপনাকে ফাঁকি দিতে পারিনি দিদি! আজ আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত মেঘের
সাথে সাথে আমারও মন যেন ভেঙে পড়ছে! মনে হচ্ছে, মাটির মতো করে আমায় কেউ চাক, আমিও
আষাঢ় মেঘের মতো নিঃশেষে নিজেকে ঝরিয়ে দিই তার বুকে। নিজেকে জমিয়ে জমিয়ে যে-ভার
বিপুল করে তুলেছি নিজেরই জীবনে, আজ আমি মুক্তি চাই সে-ভার হতে। বিলিয়ে দেওযার সে-সাধনা
কেমন করে আয়ত্ত করি বলে দিতে পার, দিদি?
এই তো দুটো চোখ, ক ফোঁটাই-বা জল ধরে ওতে! তবু মনে হচ্ছে আজ যেন
আমি আষাঢ়ের মেঘকেও হার মানিয়ে দিতে পারি কেঁদে কেঁদে।
কত ঝঞ্ঝা, কত বজ্র, কত বিদ্যুতের পরিণতি এই বৃষ্টিধারা, এই
চোখের জল
তুমি হয়তো মনে করছ, আমি পাগল হয়েছি। তাও যদি হতে পারতাম তাহলে
নিজেকে ভোলার একটু অবসর মিলত। অবসরের চেয়েও বড়ো কথা দিদি, এই স্ত্রী জাতির বড়ো
কর্তব্যটা থেকে রেহাই মিলত একটু! তুমি হয়তো অসন্তুষ্ট হচ্ছ এইবার, কিন্তু দশ আঙুলের
ক্ষুদ্র মুষ্টির চাপে এক মুঠো ফুলের দুর্দশা দেখেছ? শুকিয়ে মরতে আমি রাজি আছি দিদি,
কিন্তু এমন করে কর্তব্যের মুঠিতলে পিষ্ট হয়ে মরে নাম কিনবার সাধ আমার নেই।
নারীজীবনের ফুলহার নাকি বিধাতা প্রেমের গলায় দিবার জন্যই গেঁথেছিলেন, কবিরা তাই
বলেন ; কিন্তু তাকে মুঠি-তলে পিষবার আদেশ যে শাস্ত্রকার দিয়েছিলেন, তাঁকে যদি এই
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরবার সময় শ্রদ্ধা করতে না-ই পারি – সেটা কি এতই দোষের!
বাঁচবার সাধ আমার ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এমন করে জাঁতা-পেষা হয়ে
মরবার প্রবৃত্তিও নেই আমার। মরতেই যদি হয় দিদি, তাহলে সে-সময় কাছে আমার চাওয়ার ধনকে
না-ই পাই, অন্তত আমার চারপাশের দুয়ার-জানালাগুলো যেন খোলা থাকে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস
নেওয়ার মতো বায়ুর যেন সেদিন অভাব না হয়, এই ধরণি-মা-র মুখের পানে চেয়ে প্রাণ ভরে
কেঁদে নেওয়ার মতো অবকাশ যেন সেদিন পাই দিদি, এইটুকু প্রার্থনা করো – শুধু আমার জন্যে
নয় – আমারই মতো বাংলার সকল কুলবধূর জন্য!
দেখেছ, নিজের দুঃখটাকে ফেনাচ্ছি এতক্ষণ ধরে ; সুখের তলানিটার
পরিমাপ করতে যেন ভুলেই গেছি। আমার জীবনের পাত্র উপচে যেটা পড়ছে নিরন্তর – সেইটাই
দেখলাম শুধু নীচে জমা হয়ে রইল যা তা দেখবার সৌভাগ্য আমার হল না – এ যে শুধু তুমিই
ভাবছ তা নয় – আমিও ভেবেছি বহুদিন, আজও ভাবি। কিন্তু দিদি, তলানিটাকে যখন দেখি একটা
চোখে যতটুকু জল ধরে তার চেয়েও কম, তখন সেটার ক্ষতিপূরণ করতে এই পোড়া চোখের জল ছাড়া
আর কী থাকতে পারে – বলতে পারো?
আমার স্বামী দেবতা মানুষ। অর্থাৎ দেবতার যেমন ঐশ্বর্যের অভাব
নাই আবার লোভেরও ঘাটতি দেখিনে তেমনই। তাঁর সম্বন্ধে অপবাদ আমি দেব না, দিলে তোমরা
ক্ষমা করবে না। ঐশ্বর্যে তাঁর আকর্ষণ যত বেশিই থাক, অমৃতে তাঁর অরুচি নেই এবং ওটার
জন্য আবদার হয়তো একটু অতিরিক্ত রকমেরই করেন। আহা বেচারা! দেখে দয়া হয়! ছেলেবেলায়
পড়েছিলাম, – সমুদ্র মন্থন চলেছে, ভালো ভালো জিনিস সব দেবতারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে
নিচ্ছেন, বেচারা দানব-দৈত্যের দল বানরের পিঠে ভাগ করার সময় বেড়ালের মুখ যেমন হয়েছিল
তেমনই মুখ করে দাঁড়িয়ে, – ক্রমে উঠলেন লক্ষ্মী, সুধার ভাঁড় হাতে নিয়ে এবং তাঁকে
অধিকার করে বসলেন বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটি। এতক্ষণ যদিই বা সয়েছিল – এই বার দেবতা দানব
কারুরই সইল না! লাগল একটা গণ্ডগোল – এবং এই গন্ডগোলের অবকাশে বৈকুণ্ঠের চতুর ঠাকুরটি
লক্ষ্মীঠাকুরণকে নিয়ে একবারে পগার পার! দ্বন্দ্ব যখন মিটল তখন সুধার অংশ হয়তো সব
দেবতাই পেলেন, কিন্তু জিতে গেলেন যে ঠাকুরটি তিনি যে সুধাসমেত সুধাময়ীকে পেলেন – এ
ব্যথা আমরা ভুললেও দেবতারা ভুললে না। তা আমার স্বামী দেবতাকে দেখেই অনুভব করছি। উনি
যা বলেন, তার মানে ওই রকমেরই কতকটা। ওঁর মাঝে আবার একটা দুষ্ট দানবও প্রবেশ করেছে –
জানিনে কোন পথ দিয়ে। ওঁর মাঝের দেবতা যখন অমৃতের জন্য অভিযোগ করেন নিরুদ্দেশ
ঠাকুরটির উদ্দেশে, তখন দৈত্যটাও মুষ্টি পাকায় ক্রুদ্ধ রোষে, বোধ হয় বলে, পেতাম
একবার এই হাতের কাছে! আমার স্বামী রসিক মানুষ, এই কথাটা তিনিও একদিন আমায় বলেছিলেন
– আফিমের নেশার ঝোঁকে। অবশ্য, তাঁর বলার ধরনটা ছিল অন্য ধরনের, মোদ্দা মানে তার ওই
এক যে, সুধায় তিনি বঞ্চিত হলেন, তাঁর সুধাময়ীকে চোরে নিয়ে গেল!
সেদিন আমার মনটা হয়তো ভালো ছিল না, আমি বলেছিলাম কী, দিদি জান?
বলেছিলাম,সেই চোরটি যদি বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটির কাছে একটু চতুরালি শিখতই, তাহলে তাকে আজ
জীবনে এত বড়ো ঠকতে হত না। সে তাহলে সুধাময়ীকেও চাইতো সুধার সাথে। স্বামী আফিমের
নেশায় ঝিমোচ্ছিলেন, বোধ হয় বুঝতে পারেননি ভালো করে আমার হেঁয়ালি। বুঝলে আমার ভাগ্যে
হয়তো এ দেব-লোক অক্ষয় না হতেও পারত।
স্বামী আফিম খেয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে গেছেন, আমারও এক একবার
লোভ হয় দিদি, যে, ওই আফিমের অংশ নিয়ে আমিও চিরজনমের মতো বেঁচে যাই? যে লোভটা ওই
উৎকট দিকটায় এত করে আকর্ষণ করে আমায় – সেই লোভটাই আবার মিষ্টি কোনো ভবিষ্যতের পানে
ইশারা হেনে বলে – ওরে হতভাগি বেঁচে থাক, বেঁচে থাক তুই, সারা জীবনের ক্ষতি তোর এক
মুহূর্তের কল্যাণে পুষ্পিত হয়ে উঠবে। তোর প্রতীক্ষার ধন ফিরে পাবি! তোর মৃত্যুক্ষণ
হাসির রঙে রেঙে উঠবে! – আমিও তার সাথে সাথে বলি, আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই। – যাকে
আমি বাম হস্তের বারণ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি, দক্ষিণ হস্তের বরণমালা দিয়ে যদি তার
প্রায়শ্চিত্ত না করি, তাহলে আমার আর মুক্তি নেই ইহকালে।
আমার স্বামী আমার রূপকে চেয়েছিলেন রুপার দরে যাচাই করতে। শুনে
খুশি হবে যে, এ সওদায় তিনি ঠকেননি। কিন্তু এর জন্য স্বামীকে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই। এই
তো আমাদের বাংলার – অন্তত শরিফ মুসলমান মেয়েদের – চিরকেলে – একঘেয়ে কাহিনি। আমাদের
সমাজের স্ত্রী-শিকারি অর্থাৎ স্বামীরা শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে শিকার করেন আমাদের। তাঁরা
আমাদের দেখতে পান না বটে, কিন্তু শুনতে পান। রূপের একটা অভিশাপ আছে, হেরেমের দেয়াল
ডিঙাতে তার বিশেষ বেগ পেতে হয় না। প্রভাত-আলোর মতো, ফুলের গন্ধের মতো তার খ্যাতি
ঘরে-ঘরে দেশে-দেশে পুরুষের কানে গিয়ে পৌঁছে। কোথাও ভালো শিকার আছে শুনলেই পুরুষ
ছোটেন সেখানে, সেই শব্দভেদী বাণের কল্যাণে তাঁদের হয়ে যায় শাপে-বর – কিন্তু এই
হতভাগিনিদের বরই হয়ে ওঠে শাপ।
আমার স্বামী শিকার করে করে প্রধান হয়েছেন, হাত তাঁর পাকা,
লক্ষ্যও অব্যর্থ। কাজেই আমার রূপের খ্যাতি তাঁর কাছে পৌঁছবার পরেও তিনি চুপ করে বসে
থাকবেন – তাঁর বীর চরিত্রে এত বড়ো অপবাদ দিবার সুযোগ তিনি দেননি। ছুঁড়লেন শব্দ লক্ষ
করে বাণ, বাণের রৌপ্যফলকে বিঁধে আমার বক্ষের অবস্থা যা-ই হোক, তাঁর মুখে হাসি যে
ফুটল তা খাঁটি সোনার। এইখানে শুনে খুশি হবে দিদি, তাঁর দাঁত সব সোনার। খোদার দেওয়া
হাড়ের দাঁতের লজ্জা তিনি দূর করেছেন ও-দাঁত খসে পড়তেই। এখন তিনি সোনায় দাঁত বাঁধিয়ে
নিয়েছেন। তাঁর গোশত খাওয়া এবং বিবাহ করা দুই শখই অক্ষয় হয়ে গেল! বিজ্ঞানের জয়জয়কার
হোক, আমাদের মতো বহু হতভাগিনির স্বামীর যৌবন এই বিজ্ঞানের কৃপায় অটুট হয়ে রইল!
আমার স্বামী জমিদার এ শুনে আমারই জাতের অনেক হতভাগিরই বুক চচ্চড়
করবে – সতিনের মতো। কিন্তু আমার কপাল এমনই মন্দ দিদি, যে এই জমিদারির পঙ্খিরাজে
চড়েও আমার দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা আর জাগল না কোনও দিন।
স্বামীর নব নব অলংকারে আমার বন্দনা করেন। কিন্তু প্রসন্ন যে হতে
পারি না – এর ওষুধ কি!
অলংকারে কাব্যদেবীর সুষমালক্ষ্মীর দাম বাড়ে, কিন্তু মাটির
মানুষের দাম ওতে বাড়ে না কমে – বলে দিতে পার দিদি? হাটে যে বিকাল মাটির দরে, তাকে
নিয়ে এ বিদ্রুপ কেন? হায় রে হতভাগিনি নারী, প্রাণের ডালা তার শূন্য রইল বলে দেহের
ডালা সাজিয়ে সে হেসে বেড়ায়! অলংকার সুন্দর, কিন্তু ও কঠিন বস্তু দিয়ে প্রাণের পিপাসা
মেটে না। তাছাড়া পাষাণের বেদির বুকে থাকতে হয় যাকে পড়ে – তার গায়ে অলংকার বড়ো বাজে
দিদি। অলংকার দিয়ে রূপ আমার খুলল কিন্তু মন কিছুতেই খুলল না, তাই বলেন আমার স্বামী।
অদ্ভুত এই মানুষের মন। যে মানুষ, মানুষ খেয়ে খেয়ে এতটা মোটা হল,
আজ সেই মানুষই মানুষের একটুখানি করুণার জন্য কত কাঙাল হয়ে উঠেছে! দেখলে দুঃখ হয়!
আমার স্বামী জমিদার, এটা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। জমিদার নামের পেছনে একটা কৌতূহল
আছে। রাজার ওঁরা পাড়াগেঁয়ে সংস্করণ, তাই লোকের বিশ্বাস – কত না জানি রূপকথার সৃষ্টি
হচ্ছে ওখানে। হয়তো বা হচ্ছেও! আমার স্বামী জমিদার একথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি ভুলেন
না। তাঁর প্রতাপে দেশে যে ইংরেজ বলে এখনও কোনো শাসনকর্তা আছে, একথা ভুলে গেছে তাঁর
জমিদারির লোক! আর, টাকাকড়ি? ইচ্ছা করলে আমায় বনবাস দিয়ে স্বর্ণসীতা গড়ে পাশে বসাতে
পারেন! কত নারী তাঁকে অত্মদান করে ধন্য হয়ে বেহেশ্তে চলে গেছে হাসতে হাসতে! যাওয়ার
বেলায় তাদের এই সালংকার জমিদার-স্বামীর জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে এই ভেবে, যে, কোনো
মুখপুড়ি আবার তাঁর ঐশ্বর্যের ওপর বসে তার প্রভুত্ব চালাবে! গয়না ও টাকা ছাড়া যে
মেয়েলোক আরও কিছু চায়, এই নতুন জিনিসটের সঙ্গে যখন পরিচয় হল তাঁর আমার কৃপায়, তখণ
এই হতভাগ্যের দুঃখ দেখে আমার মতো পাষাণীরও চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। বলতে সে পারে
না ঠিক প্রকাশ করে কিন্তু তার মুখ দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকে না – কী যন্ত্রণাই তার
আজ হচ্চে! আজ সে যেন বুঝেছে, জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া যেটা, সেইটে থেকেই সে বঞ্চিত
রয়ে গেল! অন্যের ভালোবাসার যে কত দাম, তা বুঝেছে বেচারা – যখন তার জীবন-প্রদীপের
তৈল ফুরিয়ে এসেছে। সে আবার চায় যৌবন-ভিক্ষা – হয়তো সমস্ত ঐশ্বর্যের বিনিময়েও, সে
তার সারা জীবনের ক্ষতিকে একদিনে আত্মদানে ভুলতে চায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে-ই জানে,
যে তা আর হয় না! তবু সে আমার পায়ে-পায়ে ঘুরে মরে! আমার রূপ তার গায়ে যে কখন কঠিন হয়ে
বাজল জানি না, কিন্তু এ আমার বেশ স্মরণ আছে যে, সে এর জন্য প্রস্তুত ছিল না – এমনই
একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে পাগলের মতো করে সে একদিন চেয়েই ছিল। মনের জাদুস্পর্শে কোমল
না হলে রূপ যে স্ত্রী-শিকারের বাণের রৌপ্য-ফলকের চেয়েও কঠিন হয়ে বাজে এ-শিক্ষা তার
সেদিন নতুন হল। রূপা দিয়ে মানুষ যাচাই করেও যে সবচেয়ে বড়ো ঠকা ঠকতে হয়, এ-শিক্ষা হল
তার আমায় দিয়ে প্রথম। অলংকার দিয়ে আমার ওজন করতে পারল না বলে – তার ঐশ্বর্যের
স্বল্পতা ধরা পড়ল তার চোখে!
এখন সে ঐশ্বর্যকে পিছনে ফেলে নিজেকে অঞ্জলি করে এনেছে আমার
চরণতলে অর্পণ করতে, এটাই আমার মনকে মাধুর্যে-বেদনায় অভিভূত করে ফেলেছে। একটা
দুর্দান্ত পশুকে জয় করার গৌরব কি কম! আমার যদি দেওয়ার থাকত রূপ, দেহ ছাড়া আর কিছু
পুঁজি, সব দিতাম – এ বেচারার মৃত্যুপাণ্ডুর অধরে নিঙড়ে! কিন্তু এ যা চায় তা আমি পাই
কোথা দিদি? রাবণ রামের সীতাকে হরণ করেছিল এইটেই লোকে শিখে রেখেছে, কিন্তু সীতা রামকে
নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে এমনই একটা মহাকাব্য লিখবার বাল্মীকি কেউ নেই?
থাক, সোজা কথায় খেয়ে-দেয়ে আমি দিব্বি মোটা হচ্ছি। দুটো বাঘে খেয়ে
উঠতে পারে না – এমনই গতর হয়ে উঠেছে আমার। আমার কপাল ভালো, স্বামীর আমার কোনো পক্ষের
কোনো ছেলেপিলে নেই। অতএব আমি মুক্তপক্ষ। সেবা, আদর যা-কিছু স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে
দেওয়ার নেই।
তোমাদের খবর জানবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছি, এই বুঝে যা হয় একটা
বিহিত করো।
আমার বোধ হয় আর বেশি চিঠি দেওয়া হবে না দিদি। মন একটা বিস্বাদ
ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়ছে দিন দিন, আর কিছু করতে – এমনকি চিঠি লিখতেও মন চায় না।
রাতদিন রাজ্যের বই আনিয়ে পড়ি। খবরের কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ি, মন আমার আরব-সাগরের
উপকূলে তরঙ্গের মতো মাথা খুঁড়ে মরতে চায়।
আশীর্বাদ করো দিদি, এই মাথাটা যেন কল্যাণের চরণতলে এইবার নোয়াতে
পারি।
হতভাগিনী
মাহ্বুবা
২৩শে চৈত্র
সাহসিকাদি! এই হয়তো আমার শেষ চিঠি। কিন্তু এই শেষ চিঠিটা লিখতেই
একটা বছর পেরিয়ে গেল। ফুল জমে পাথর হয়ে গেছে, দেখেছ? আমি কিন্তু দেখেছি।... যাক,
ওসব কথা বলতে আসিনি আমি। কয়েকটা খবর আছে দেওয়ার, তাই দিই। অবসর যে নেই, তা নয় – এখন
বরং অবসরটা চাওয়ার চেয়ে বেশিই হয়ে উঠেছে। আর সেটা এত বেশি হাতে জমেছে বলেই হয়তো খরচ
করতে এত কার্পণ্য। এখন আমার মনে হয়, চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার চেয়ে বসে বসে আমার
অতীতকে – আপনাদের সকলকে নিয়ে চিন্তার অতলতায় ডুব দেওয়ায় ঢের শান্তি। আমার জীবনে যারা
ছিল মানুষ, ধ্যানের মন্দিরে তারা আজ দেবতা। তারা আজ শুধু পূজা গ্রহণ করে, কথা কয়
না, নির্বাক নিশ্চুপ! পাছে কথা কয়ে আমার ধ্যান ভঙ্গ করে, তাই দেবতাকে করেছি পাথর –
জমানো অশ্রুর শ্বেতমর্মরের দেবতা!
এই একটা বৎসরে কত অঘটনই না ঘটল। শুধু আমার জীবনেই নয়, সারা
সৃষ্টিটা জুড়ে। মন্থন শেষে সৃষ্টি আজ নিষ্পন্দ – সাড়া-শব্দহীন। সে যেন আজ তার
লাভক্ষতির হিসাব খতিয়ে দেখছে অন্ধকার নির্জনে বসে প্রকৃতির খাতা খুলে। খরচের লাল
কালি আজ তার জমার সবুজ কালিকে লজ্জা দিচ্ছে।
যুদ্ধ থেমে গেছে! আর্মিসটিস! শান্তি! মহাপ্লাবনের পর পিতা নুহ্
যেন ধ্যানে বসেছেন। সারা সৃষ্টি উন্মুখ প্রতীক্ষায় তাঁর কুটির দ্বারে দাঁড়িয়ে। তার
সকল অনুশোচনা, সকল গ্লানি এই মহামৌনীর আঁখির প্রসাদে ফুল হয়ে ফুটে উঠুক এই আশিস আজ
সে চাইতে এসেছে। ঐশ্বর্য-মদমত্ত দাম্ভিক আজ ভিখারির কুটিরদ্বারে ভিক্ষার্থী। এ
দৃশ্য অভিনব, অদ্ভুত, না দিদি?
এই একটা বৎসর ধরে আমার কেটেছে ইরাকের মরু প্রান্তরে, ফোরাতের
কূলে কূলে, শুকনো পর্বতের অস্থিশ্মশানে। ইচ্ছা করলে যে চিঠি লিখতে পারতাম না, তা নয়।
ইচ্ছা করেই লিখিনি। এই একটা বৎসর ধরে আমার কেবলই ভয় হয়েছে, এই বুঝি কারুর চিঠি এসে
পড়ল! একেবারে যে আসেনি, তা নয়। এবং সে সব চিঠি আপনাদেরই। তার অনেকগুলো আজও পড়িনি –
কেন যে এ দুর্বলতা আমার তা নিজেই জানিনে। ভয় হয়, ওগুলোতে কত যেন দুঃসংবাদ, কত যেন
অভিশাপ লুকিয়ে আছে। অথচ ফেলেও দিইনি। মনে করেছি যেদিন আমি ধ্যান-শান্ত হতে পারব –
বাইরের কোনো দুঃসংবাদই আমার মনে দোলা দিতে পারবে না – এইরূপ বিশ্বাস হবে আমার নিজের
উপর, সেই দিন খুলব ওগুলো।
যেগুলো খুলে পড়েছি, তাতে যা সব জেনেছি তার বেশি জানবার আমার
বর্তমান জীবনে প্রয়োজন দেখিনে। মনে হয় আমার জানাশোনার হিসাব-নিকাশ চুকে গিয়ে এবারের
মতো কৈফিয়ত কাটা হয়ে গেছে। এবারের মতো আমার বেচাকেনা বন্ধ।
আচ্ছা সাহসিকাদি, পুরুষগুলো মেয়েদের চেয়ে একটু চোখে খাটো না?
অন্তত, ওদের প্রত্যকেরই শর্ট-সাইট – কাছের দৃষ্টিটা খারাপ। কাছের জিনিসকে ওরা
উপচক্ষু ছাড়া দেখতে পায় না। কিন্তু দূরের জিনিস দিব্যি সাদা চোখে দেখতে পায়।
সোফিটাকে দেখেছি – মাহ্বুবার চেয়েও কাছে করে, কিন্তু পাতার আড়ালে যে বেদনার কুঁড়ি
ধরেছিল – তা আমার এই হাজার মাইল দূরে চলে আসার আগে আর চোখে পড়েনি, কিন্তু দূরের এ-দৃষ্টিটা
হয়ে উঠেছে আমার বরে শাপ।
আজ যখন একান্ত চিত্তে মনের তলা হাতড়িয়ে দেখি, তখন ভয়ে বিস্ময়ে
চমকে উঠি। মনে হয়, কে যেন আমায় দেখে ফেললে! চিরকাল এ মনে শুধু একটি মুখেরই
প্রতিচ্ছবি পড়েছে – এই ছিল আমার ধ্রুব বিশ্বাস। চিত্ত যেদিন আর একজন দেখিয়ে দিলে
মনটাকে নাড়া দিয়ে যে, পিছনে হলেও সেও আছে সেখানে – তখন স্তব্ধ হয়ে গেলাম ভয়ে
বিস্ময়ে-বেদনায়। আমার কেবল মনে হতে লাগল, এইবার একটা প্রলয় না হয়ে যায় না। আকাশে যদি
কোনোদিন দুটো সূর্য ওঠে, তাহলে সেদিন ভীষণ কিছু একটা হবে, একথা পাঁজিতে না লিখলেও
আমি বিশ্বাস করি।
সেই প্রলয় হয়তো ঘনিয়ে এসেছে সাহসিকাদি আমার জীবনে। এক সূর্য আলো
দেয়, কিন্তু দুটো সূর্য দগ্ধ করে। আমার মন পুড়ে যাচ্ছে – তাই বিষের ওষুধ বিষ মনে করে
এই দগ্ধীভূত মরুভূমিতে এসে পড়েছি। মনে করেছি, এই পোড়া দেশের মরুভূমি দেখে সান্ত্বনা
খুঁজব। আমি আজ এই মনের অগ্নিকুণ্ডে আত্মস্থ হয়ে তপস্যা করবার চেষ্টা করছি। প্রার্থনা
করো যেন বিফল না হই।
আমি আর কোথাও চিঠি দেব না, কাউকে না তোমায়ও না। আর আমার খোঁজ
করবার চেষ্টা কোরো না। মনে কোরো ধূমকেতু দেখার মতো দু-দিন একটা অমঙ্গলকে দেখে স্নেহ
করেছিলে, ভালোবেসেছিলে। আজ সে অকস্মাৎ এসে আবার অকস্মাৎ হারিয়ে গেল, তখন ওকে আবার
দেখতে চাওয়া পণ্ডশ্রম। ধূমকেতুর একটা নিয়ম আছে – সেই নিয়মাধীন যদি হই, তবে আবার দেখা
দিব, আপনারা দেখতে না চাইলেও।
খবর পেয়েছি সোফির বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ের পরই তার ভীষণ
অসুখ, হয়তো বা বাঁচবে না। আমার চেয়ে সে খবর আপনিই বেশি জানেন। আর একটা ভীষণ খবর
পেয়েছি, মাহ্বুবা হতভাগি বিধবা হয়েছে, তার বৃদ্ধ স্বামী মারা গেছেন। মাহ্বুবা নিজে
লিখেছে চিঠি। সে লিখেছে, সে-ই এখন সমস্ত জমিদারির মালিক। সংসারে আর তার মন নাই ; সে
নাকি শিগগিরই পবিত্র স্থানসমূহ পর্যটন করতে বেরোবে, মক্কা-মদিনাও আসবে এবং আরও
লিখেছে বোগদাদ শরিফও আসতে পারে। আমি বারণ করিনি। আর আমার ভয় নেই তাকে।
যে মাহ্বুবা একদিন স্বেচ্ছায় আমাকে পাওয়ার লোভ দুহাতে ঠেলে
দিয়েছিল ; আমার মহৎ জীবন পাছে বিবাহের জন্য নিষ্ফল হয়ে যায়, তাই আমাকে নিজে হাতে
মরণের মুখে পাঠিয়ে দিলে – তাকে যদি আজ অযথা সন্দেহ করি, তাহলে আমার ইহকালে পরকালে
কোথাও মুক্তি হবে না, সাহসিকাদি।
আমাদের পল্টন শিগগির ফিরে যাচ্ছে। শিগগির সব ভাইরা আমার দেশে
ফিরবে। আমিই আর ফিরব না।
আমি আবার তিন বছরের জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখে দিয়ে যুদ্ধ অফিসে
নতুন কাজ নিয়েছি। ইচ্ছা করলেও আর যেতে পারব না এ তিন বছরের মধ্যে।
আমার বাঁধনহারা জীবন-নাট্যের একটা অঙ্ক অভিনীত হয়ে গেল। এর পর
কী আছে, তা আমার জীবনের পাগলা নটরাজই জানেন।
আশীর্বাদ করো তোমরা সকলে, আবার যখন আসব রঙ্গমঞ্চে – তখন যেন
আমার চোখের জলে আমার সকল গ্লানি, সকল দ্বন্দ্ব কেটে যায় – আমি যেন পরিপূর্ণ শান্তি
নিয়ে তোমাদের সকলের চোখে চোখে তাকাতে পারি। ইতি –
নূরুল হুদা