রাজবন্দীর চিঠি
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর (মঙ্গলবার ২২ কার্তিক ১৩২৯ ) রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায়, পত্রিকার সম্পাদক নজরুল ইসলাম এবং মুদ্রাকর প্রকাশক আফজাল-উল হকের বিরুদ্ধে গ্রফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই সময় ৩২ কলেজ স্ট্রিট থেকে আফজাল-উল হককে গ্রেফতার করা হয়। নজরুল গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সমস্তিপুরে চলে যান।

২৩শে নভেম্বর (বৃ্হস্পতিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) বেলা ১২টার সময় নজরুলকে পুলিশ গ্রেফ্তার করে। এই উৎসুক জনতা তাঁকে দেখার জন্য জড় হতে থাকলে, প্রশাসন নজরুলকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ২৪শ নভেম্বর (শুক্রবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) পুলিশ প্রহরায় চট্টগ্রাম মেলে নজরুলকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ট্রেনটি কলকাতায় পৌঁছায় সন্ধ্যাবেলায়। তাঁকে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি (মঙ্গলবার ২রা মাঘ ১৩২৯) নজরলকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৭ই জানুয়ারি (বুধবার ৩রা মাঘ ১৩২৯) নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।

রাজবন্দীর চিঠি রচিত হয়েছিল  প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালে। অর্থাৎ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ নভেম্বর থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি'র ভিতরে কোনো এক সময় এই নজরুল গল্পটি রচনা করেছিলেন।


প্রেসিডেন্সি জেল, কলিকাতা
মুক্তি-বার, বেলা-শেষ

প্রিয়তমা মানসী আমার!
    আজ আমার বিদায় নেবার দিন। একে একে সকলেরই কাছে বিদায় নিয়েছি। তুমিই বাকি। ইচ্ছা ছিল, যাবার দিনে তোমায় আর ব্যথা দিয়ে যাব না, কিন্তু আমার যে এখনও কিছুই বলা হয়নি। তাই ব্যথা পাবে জেনেও নিজের এই উচ্ছৃঙ্খল বৃত্তিটাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। তাতে কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবে না, কেন না তোমার মনে তো চিরদিনই গভীর বিশ্বাস যে, আমার মতন এত বড়ো স্বার্থপর হিংসুটে দুনিয়ায় আর দুটি নেই।
    আমার কথা তোমার কাছে কোনোদিনই ভালো লাগেনি। (কেন, তা পরে বলছি), আজও লাগবে না। তবু লক্ষ্মী, এই মনে করে চিঠিটা একটু পড়ে দেখো যে, এটা একটা হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া পথিকের অস্ত-পারের পথহারা পথে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিদায়-কান্না। আজ আমি বড়ো নিষ্ঠুর, বড়ো নির্মম। আমার কথাগুলো তোমার বে-দাগ বুকে না-জানি কত দাগই কেটে দেবে। কিন্তু বড়ো বেদনায় প্রিয়, বড়ো বেদনায় আজ আমায় এত বড়ো বিদ্রোহী, এত বড়ো স্বেচ্ছাচারী উন্মাদ করে তুলেছে। তাই আজও এসেছি কাঁদাতে। তুমিও বলো, আমি আজ জল্লাদ, আমি আজ হত্যাকারী কসাই। শুনে একটু সুখী হব।
    আমার মন বড়ো বিক্ষিপ্ত। তাই কোনো কথাই হয়তো গুছিয়ে বলতে পারব না। যার সারা জীবনটাই বয়ে গেল বিশৃঙ্খল আর অনিয়মের পূজা করে, তার লেখায় শৃঙ্খলা বা বাঁধন খুঁজতে যেও না। হয়তো যেটা আরম্ভ করব সেইটেই শেষের, আর যেটায় শেষ করব সেইটেই আরম্ভের কথা। আসল কথা, অন্যে বুঝুক চাই নাই বুঝুক, তুমি বুঝলেই হল। আমার বুকের এই অসম্পূর্ণ না-কওয়া কথা আর ব্যথা তোমার বুকের কথা আর ব্যথা দিয়ে পূর্ণ করে ভরে নিও। – এখন শোনো।
    প্রথমেই আমার মনে পড়ছে (আজ বোধ হয় তোমার তা মনেই পড়বে না), তুমি একদিন সাঁঝে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে, – ‘কী করলে তুমি ভালো হবে?’
    তোমারই মুখে আমার রোগ-শিয়রে এই নিষ্ঠুর প্রশ্ন শুনে অধীর অভিমানের গুরু বেদনায় আমার বুকের তলা যেন তোলপাড় করে উঠল!
    হায় আমার অসহায় অভিমান! হায়, আমার লাঞ্ছিত অনাদৃত ভালোবাসা। আমি তোমার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। দেওয়া উচিতও হত না। তখন আমার হিয়ার বেদনামন্দিরে যেন লক্ষ তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যর্থ জীবনের আর্ত হাহাকার আর বঞ্চিত যৌবনের সঞ্চিত ব্যথা-নিবেদনের গভীর আরতি হচ্ছিল। যার জন্যে আমার এত ব্যথা সেই এসে কিনা জিজ্ঞেস করে, – ‘তোমার বেদনা ভালো হবে কিসে?’ ...
    মনে হল, তুমি আমায় উপহাস আর অপমান করতেই অমন করে ব্যথা দিয়ে কথা কয়ে গেলে। তাই আমার বুকের ব্যথাটা তখন দশ গুণ হয়ে দেখা দিল। আমি পাশের বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। আমার সবচেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল, পাছে তুমি আমার অবাধ্য চোখের জল দেখে ফেল। পাছে তুমি জেনে ফেল যে, আমার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়ে উঠেছে! যে আমার প্রাণের দরদ বোঝে না, সেই বে-দরদির কাছে চোখের জল ফেলা আর ব্যথায় এমন অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দুর্নিবার লজ্জা আর অপমানের কথা আর কী থাকতে পারে? কথাও কইতে পারছিলুম না, ভয় হচ্ছিল এখনই আর্দ্র গলার স্বরে তুমি আমার কান্না ধরে ফেলবে। যাক, ভগবান আমায় রক্ষা করলেন সে বিপদ হতে। তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগলে। তার পর আস্তে আস্তে চলে গেলে। তুমি বোধ হয় আজ পড়ে হাসবে, যদি বলি, যে, আমার তখন মনে হল, যেন তুমি যাবার বেলায় ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে গিয়েছিলে। – হায় রে অন্ধ বধির ভিখিরি মন আমার! যদি তাই হত, তবে অন্তত কেন আমি অমন করে শুয়ে পড়লুম, তা একটু মুখের কথায় শুধাতেও তো পারতে।
    তুমি চলে যাবার পরেই ব্যথায় অভিমানে আমার বুক যেন একেবারে ভেঙে পড়ল। নিষ্ফল আক্রোশে আর ব্যর্থ বেদনার জ্বালায় আমি হুঁকরে হুঁকরে কাঁদতে লাগলুম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তার পর ডাক্তার এল, আত্মীয়-স্বজন এল, বন্ধু-বান্ধব এল। সবাই বললে, – হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বড়ো অস্বাভাবিক। গতিক...ডাক্তার বললে, – ‘রোগী হঠাৎ কোনো – ইয়ে – কোনো বিশেষ কারণে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছে। এ কিন্তু বড্ডো খারাপ। এতে এমনও হতে পারে যে ...।’
    বাকিটুকু ডাক্তার আমতা আমতা করে না বললেও আমি সেটার পূরণ করে দিলুম, – ‘একেবারে নির্বাণ দীপ গৃহ অন্ধকার। না ডাক্তার বাবু?’ – বলেই হাসতে গিয়ে কিন্তু এত কান্না পেল আমার যে, তা অনেকেরই চোখ এড়াল না। সত্যিই তখন আমার কণ্ঠ বড়ো কেঁপে উঠেছিল, অধর কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও কেউ আর আমায় তুলতে পারলে না। আমার গোঁয়ার্তুমির অনেকক্ষণ ধরে নিন্দে করে বন্ধু-বান্ধবরা বিদায় নিলে। আমিও মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলুম।
    হায়, এই নিষ্ঠুর লোকগুলো কি আমায় একটু নিরিবিলি কেঁদে শান্তি পেতেও দেবে না?... তখনও তোমরা সবাই আমার পাশে, কেউ বা আমার শিয়রে বসেছিলে। হঠাৎ মনে হল, তুমি এসে আমার হাত ধরেছ। এক নিমেষে আমার সকল ব্যথা যেন জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। এবারেও কান্না এল, কিন্তু সে যেন কেমন এক সুখের কান্না! তবে এ কান্নাতেও যে অভিমান ছিল না, তা নয়। তবু তোমার ওই ছোঁয়াটুকুর আনন্দেই আমি আমার সকল জ্বালা সকল ব্যথা-বেদনা মান-অপমানের কথা ভুলে গেলুম। মনে হল, তুমি আমার – তুমি আমার – একা আমার! হায় রে শাশ্বত ভিখিরি! চির তৃষাতুর দীন অন্তর আমার! কত অল্প নিয়েই না তুই তোর আপন বুকের পূর্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলতে চাস, তবু তোর আপন জনকে আর পেলিনে।
    খানিক পরেই আমি আবার সকলের সঙ্গে দিব্যি প্রাণ খুলে হাসি-গল্প জুড়ে দিলুম দেখে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলে। কেউ বুঝলে না, হয়তো তুমিও বোঝনি, কেমন করে অত অধীর বেদনা আমার এক পলকে শান্ত স্থির হয়ে গেল। সে সুখ সে ব্যথা শুধু আমি জানলুম আর আমার অন্তর্যামী জানলেন। হাঁ, সত্যি বলব কি? আরও মনে হয়েছিল, সে ব্যথা যেন তুমিও একটু বুঝতে পেরেছিলে? দেখছ? কী ভিখিরি মন আমার! তুমি না জানি আমায় কতই ছোটো মনে করছ! – আহা একবার যদি মিথ্যা করেও বলতে লক্ষ্মী যে, আমার ব্যথার কারণ অন্তত তুমি মনে মনে জেনেছ, তা হলে আমি আজ অমন করে হয়তো ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়তুম না! আমার জীবন এমন ছন্ন-ছাড়া ‘দেবদাস’-এর জীবন হয়ে পড়ত না! – যাঃ, খেই হারিয়ে বসেছি আমার কথার!
    হ্যাঁ, সেদিন তোমার ওই একটু উষ্ণ ছোঁয়ার আনন্দেই বিভোর হয়ে রইলুম। তার পরের দিন মনে হতে লাগল, তোমায় আড়ালে ডেকে বলি, কেন আমার এ বুকভরা ব্যথার সৃষ্টি। সারা দিন তোমার পানে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলুম, যদি আবার এসে জিজ্ঞেস কর তেমনই করে, কী করলে তুমি ভালো হবে?
                                                     * * *

হায়রে দুর্ভাগার আশা! তুমি ভুলেও আর সে-কথাটি আর একবার শুধালে না এসে! সারাদিন আকুল উৎকণ্ঠা নিয়ে বেলা-শেষের সাথে সাথে আমারও প্রাণ যেন কেমন নেতিয়ে পড়তে লাগল। আমার কাঙাল আত্মার এক নির্লজ্জ বেদনা ভুলবার জন্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটা বড়ো দুঃখে বড়ো প্রাণ ভরেই গাইতে লাগলুম, –

                ‘তুমি জান ওগো অন্তর্যামী
                পথে পথেই মন ফিরালেম আমি।
                        ভাবনা আমার বাঁধলনাকো বাসা।
                        কেবল তাদের স্রোতের পরেই ভাসা,
                        তবু আমার মনে আছে আশা,
                                        তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী॥
                        টেনেছিল কতই কান্না হাসি,
                        বারে বারেই ছিন্ন হল ফাঁসি!
                                শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে –
                                ‘মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’
                                জানি জানি, নামব তোমার কোলে
                                        আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি।‘

    আমার কণ্ঠ আমার আঁখি আমারই ব্যথায় ভিজে ভারী হয়ে উঠল! আমার গানের সময় আমি আর বাহিরকে ফাঁকি দিতে পারিনে। সে সুর তখন আমার স্বরে কেঁপে কেঁপে ক্রন্দন করে, সে-সুর সে-কান্না আমার কণ্ঠের নয়, আমার প্রাণের ক্রন্দসীর। গান গেয়ে মনে হল, যেন এই বিশ্বে আমার মতোন ছন্ন-ছাড়ারও অন্তত একজন বন্ধু আছেন, যিনি আমার প্রাণের জ্বালা, মর্ম-ব্যথা বোঝেন, আমার গান শুনে যাঁর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। তিনি আমার অন্তর্যামী। অমনি এ-কথাটিও মনে হয়েছিল যে, যদি সত্যিই আমার কেউ প্রিয়া থাকত, তাহলে সে আমার ওই ‘শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে, মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’ – ওইটুকু শুনবার পরই আর দূরে থাকত পারত না, তার কোলে আমার মাথাটি থুয়ে সজল কণ্ঠে বলত, – ‘ওগো, আমার কোলে প্রিয়, আমার কোলে।’ তার তরুণ কণ্ঠে করুণ মিনতি ব্যথায়-অভিমানে কেঁপে কেঁপে উঠত, – ‘ছি লক্ষ্মী! এ গান গাইতে পারবে না তুমি।
    কী বিশ্রী লোভী আমি, দেখেছ? তুমি হয়তো এতক্ষণ হেসে লুটিয়ে পড়েছ আমার এই ছেলেমান্‌ষী আর কাতরতা দেখে! তুমি হয়তো ভাবছো, কি করে এত বড়ো দুর্জয় অভিমানী, দুরন্ত বাঁধন-হারা এমন করে নেতিয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে, কেমন করে এক বিশ্বজয়ীর এত অল্পে এমন আশ্চর্য এত বড়ো পরাজয় হতে পারে! তা ভাব, কোনো দুঃখ নেই। আমিও নিজেই তাই ভাবছি। কিন্তু ভয় হয় প্রিয়, কখন তোমার এত গরব না-জানি এক নিমেষে টুটে গিয়ে সলিল বয়ে যাবে নয়ানে। সেই দিন হয়তো আমার এ ভালোবাসার ব্যথা বুঝবে। আমার এই পরাজয়ের মানেও বুঝবে সে-দিন।
    যাক, যা বলছিলাম তাই বলি। – গান গেয়ে কেন আমার মনে হল, আমার অন্তর্যামী বুঝি আমার আঁখির আগে এসে নীরবে জল-ছল-ছল চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে সামনে চাইতেই, – ও হরি! কে তুমি দাঁড়িয়ে অমন করুণ চোখে আমার পানে চেয়ে? আহা, চটুল চোখের কালো তারা দুটি তাদের দুষ্টুমি চঞ্চলতা ভুলে গিয়ে ব্যথায় যেন নিথর হয়ে গেছে! সে পাগল-চোখের কাজল আঁখি-পাতা যেন জলভারাতুর। ওগো আমার অন্তর্যামী! তুমি কি সত্য-সত্যই এই সাঁঝের তিমিরে আমার আঁখির আগে এসে দাঁড়ালে? হে আমার দেবতা! তবে কি আমার আজিকার সন্ধ্যা-আরতি বিফলে যায়নি? আমি আমার সব কিছু ভুলে কেমন যেন আত্মবিস্মৃতের মতো বলে উঠলুম  ‘তুমি আমার চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসতে পাবে না? কেমন?’
    কোনো কথা না বলে তুমি আমার কোলের উপরকার বালিশটিতে এসে মুখ লুকালে। কেন? লজ্জায়? না সুখে? না ব্যথায়? জানি না, কেন। তাই তো আজ আমার এত দুঃখ আর এত প্রাণপোড়ানি। তোমার প্রাণের কথা তুমি কোনো দিনই একটি কথাতেও জানাওনি, তাই তো আজ আমার বুক জুড়ে এত না জানার ব্যথা! অনেক সাধ্য-সাধনায় তুমি মুখ তুলে চাইলে, কিন্তু বললে না, কেন অমন করে মুখ লুকালে। সেদিন একটিবার যদি মিথ্যা করেও বলতে, – ‘হে আমার চির-জনমের প্রিয়! যে, ...।’ না, না, যাক সেকথা।
    এইখানে একটা মজার খবর দিই তোমাকে। এই হাজত-ঘরে বসেও আমার এমন অসময়ে মনে হচ্ছে, যেন আমি একজন কবি। রোসো, এখনই হেসে লুটিয়ে পড়ো না! তোমার চেয়ে আমি ভালো করেই জানি যে আমার কবি না হওয়ার জন্যে যা-কিছু চেষ্টা-চরিত্তির করার প্রয়োজন, তার কোনোটাই বাদ দেননি ভগবান। তাই আমার বাহির-ভিতর সব কিছুই যেন খোট্টাই মুল্লুকের চোট্টাই ভেইয়্যার মতোই কাঠখোট্টা! তবু যদি আমি কবি হতুম, তাহলে আমার এই ভাবটাকে কী সুন্দর করেই না বলতুম, –

                  শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান!
                   ভালোবাসা? – সে শুধু কথার কথা রে!
                   অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!
                   শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান!

    যাক, যা হইনি, কপাল ঠুকলেও আর তা হচ্ছি নে। এখন যা আছি, তাই নিয়েই আলোচনা করা যাক।
    দাঁড়াও, – অভিমান করে চেঁচিয়ে হয়তো ও কথাটার অপমানই করছি আমি। নয় কি? আমার মতোন হয়তো তুমিও ভাবছ, কার উপর এ অভিমান আমার? কে আমায় এ অধিকার দিয়েছে এত অভিমান দেখাবার? একবিন্দু ভালোবাসা পেলাম না, অথচ এক সিন্ধু অভিমান নিয়ে বসে আছি! তবু শুনে আশ্চর্য হবে তুমি যে, সত্যি-সত্যিই আমার বড্ড অভিমান হয়। যার উপর অভিমান করি, সে আমার এ অভিমান দেখে হাসবে, না দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপও করি না। চেয়েও দেখি না, আমার এত ভালোবাসার সম্মান সে রাখবে কিনা, শুধু নিজের ভালোবাসার গরবে আজ অন্ধতায় মনে করি, সেও আমায় ভালোবাসে। তাই তো আর আমার এত লাঞ্ছনা ঘরে-বাইরে!
    অনেক পথিক-বালা এ পথিকের পথের ব্যথা মুছিয়ে দিতে চেয়েছিল, হয়তো ভালোও বেসেছিল (শুনে হেসো না), আমি কিন্তু ফিরেও চাইনি তাদের পানে। ওর মধ্যে আমার কতকটা গরবও ছিল। মনে হত, এ বালিকা তো আমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারবে না, অনর্থক কেন তার জীবনটাকে ব্যর্থ করে দেব? যে-সে এসে আমার মতোন বাঁধন-হারা বিদ্রোহীর মনটাকে এত অল্প সাধনায় জয় করে নেবে, এও যেন সইতে পারতুম না। তাই কোনো হতভাগীর মনে আমার ছাপ লেগেছে বুঝতে পারলেই আমি অমনই দূরে – অনেক দূরে সরে যেতুম; আর দেখতুম, তার এ আকর্ষণের জোর কত – সে সত্যি আমায় ভালোবাসে, না একটু করুণা করে না ওটা মোহ? ওই দূরে সরে যাবার আর একটা কারণ ছিল যে, আমাদের কাউকে যেন কোনো দিন অনুতাপ করতে না হয় শেষে কোনো ভুলের জন্যে।
    আমার এক জায়গায় বড়ো দুর্বলতা আছে। স্নেহের হাতে আমার মতো এমন করে কেউ বুঝি আত্মসমর্পণ করতে পারে না। তাই কেউ স্নেহ করছে বুঝলেই অমনি বাঁধা পড়বার ভয়ে আমি পালিয়ে যেতুম। ওই দূরে গিয়ে কিন্তু অনেকেরই ভুল ধরা পড়ে গেছে। অনেকেই নাকি আমায় ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের সকলেরই মনের মিথ্যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলুম ওই দূরে সরে গিয়েই। তাদের কেউ আমায় তার জীবন ভরে পেতে চায়নি। আমি পথিক, তাই পথের মাঝে আমায় একটু ক্ষণের জন্যে পেতে চেয়েছিল মাত্র। তাই কেউ আমায় কোনদিনই তার হাতের নাগালের মধ্যেও পেলে না। অনেকে বলে হয়তো এটাও আমার অভিমান। জানি না। কিন্তু দু-এক জায়গায় একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে যেই নিকটে আসতে চেয়েছি, অমনি সে আমার দেবতার – আমার ভালোবাসার বুকে জোর পদাঘাত করেছে। তবু কি তুমি বলবে, ও আমার অহেতুক অভিমান?
    এইখানে একটা কথা মনে রেখো কিন্তু যে, এই যে যারা আমায় পেতে চেয়েছিল, তাদের সকলেই আগে আমায় ভালোবেসেছিল, আমি কখনও তাদের ভালোবাসিনি। অত পেয়েও আমার মন চিরদিন বলে এসেছে , – এ নহে, এ নহে।
    হায় আমার অতৃপ্ত হিয়া! কাকে চাস তুই? কে সে তোর প্রিয়তমা? কে সে গরবিনী, কোথায় কোন্ আঙিনা-তলে তোর তরে মালা-হাতে দাঁড়িয়ে রে?...আমার মনের যে মানসী প্রিয়া, তাকে না পেয়েই তো কাউকে ভালোবাসতে পারলুম না এ জীবনে। কতগুলো কচি বুকই না দলে গেলুম আমার এই জীবনের আরম্ভ হতে না হতেই, তা ভেবে আজ আর আমার কষ্টের অন্ত নেই। তবে আমার এইটুকু সান্ত্বনা যে, আমি কারুর ভালোবাসার অপমান করিনি। কাউকে ভালোবেসেছি বলে প্রলোভন দেখিয়ে শেষে পথে ফেলে চলে যাইনি। উলটো তাদের কাছে দু-হাত জুড়ে ক্ষমাই চেয়েছি, অমনি করে সুদূর থেকেই। আমায় ভালো না বাসতে অনুরোধ করে তার পথ হতে চিরদিনের মতো সরে গিয়েছি। পাছে কোনোদিন কোনো কাজে তার বাধা পড়ে, সেই ভয়ে আর কোনোদিন তার পথের পাশ দিয়েও চলিনি। অনেকে আমায় অভিশাপও দিয়েছে আমার এই নির্মমতার জন্যে, অনেকে আবার অহংকারী দর্পী বলে গালও দিয়েছে।
    এমনই করে বিজয়ী বীরের মতো আপন মনে পথে-বিপথে আমার রথ চালিয়ে বেড়াচ্ছিলুম। এমন সময় একদিন সকালে তোমায় আমায় দেখা। হঠাৎ আমার রথ থেমে গেল! আমার মন কী এক বিপুল সুখে আনন্দ-ধ্বনি করে উঠল, – পেয়েছি, পেয়েছি। আমার মনের পথিক-বন্ধু হঠাৎ ম্লান মুখে আমার সামনে এসে বললে – বন্ধু বিদায়! আর তুমি আমার নও; এখন তুমি তোমার মানসীর! তোমার পথের শেষ হয়েছে! দেখলুম, সে পথের শেষে দিগন্তের আঁধারে মিলিয়ে গেল।
    এতদিন আমায় শত সাধ্য-সাধনা করেও পথিক-বালারা আমার রথ থামাতে পারেনি, কতজন রথের চাকার সামনে বুক পেতে শুয়ে পড়েছে, আমি হাসতে হাসতে তাদের বুকের উপর দিয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু হায়, আজ আমার এ কী হল? রথ যে আর চলে না! তুমি শুধু আমার পানে চোখ তুলে চাইলে মাত্র, একটু সাধলেও না যে, পথিক! আমার দ্বারে একটু থামো!
    তবু আমার দুঃখ হল না, মান-অপমান জ্ঞান রইল না, আমি মালা-হাতে রথ থেকে নেমে পড়লুম। তোমার গলায় আমার জন্ম-জন্মের সাধের গাঁথা মালা পরিয়ে দিলুম। তুমি নীরবে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলে। তোমার ওই মৌন বুকের ভাষা বুঝতে পারলুম না। প্রাণ যেন কেমন করে উঠল। তুমি সুখী হলে, না ব্যথা পেলে, কিছুই বোঝা গেল না। অমনি চির-অভিমানী আমার বুকে বড়োই বাজল। ভগবান কেন অন্যের মনটি দেখবার শক্তি দেননি মানুষকে? কিন্তু তোমার প্রতি অভিমান আমার যতই হোক, তোমাকে নালিশ করবার কিছুই ছিল না আমার (আজও নেই)। আমি যে তোমার মনটি না জেনেই তোমায় ভালোবেসেছি। চিরদিন জয় করে ফিরে তোমার গলায় যে হার-মানা হার পরিয়েছি – তুমি যে আমার মানসী প্রিয়া। আমার মনে-মনে জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে ছবি আঁকা ছিল, যাকে খুঁজতে এমন করে আমার এমন চিরন্তন-পথিক বেশ, সে-মানসীকে দেখেই চিনে নিয়েছি। তাই আমি একটুক্ষণের জন্যেও ভেবে দেখিনি, তুমিও এ পরাজিত বিদ্রোহীর নৈবেদ্য-মালা হেসে গ্রহণ করবে, না পায়ে ঠেলে চলে যাবে। তুমি আমায় ভালো না বাসতে পার, তার জন্যে তো তোমায় দোষ দিতে পারিনে। আমি জানি,খুব জানি প্রিয়, যে কোনো মানুষেরই মন তার অধীন নয়। সে যাকে ভালোবাসতে চায়, যাকে ভালোবাসা কর্তব্য মনে করে, মন তাকে কিছুতেই ভালোবাসবে না। মন তার মনের মানুষের জন্যে নিরন্তর কেঁদে মরছে, সে অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। কত জন্ম ধরে তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি এমনই করে, তুমি কিন্তু ধরা দাওনি। এবারেও ধরা দিলে না। কখন কোন্ জন্মে কোন্ নাম-হারা গাঁয়ের পাশে তোমায় আমায় ঘর বাঁধব, কখন তুমি আমায় ভালোবাসবে জানি নে। তবু আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই আমার এত বিপুল অভিমান তোমার ওপর।
    ধরো, আমার এ-অভিমান যদি মিথ্যে হয়, যদি সত্যিই তুমি আমায় ভালোবাস, তা হলে হয়তো মনে করবে যে, আমি কেন তোমায় ভুল বুঝে এমন করে কষ্ট পাচ্ছি। কেন তোমাকে এমন করে ব্যথা দিচ্ছি। সেই কথাটি জানবার জন্যেই কাল সারা রাত্তির ধরে তোমার দয়ার দান চিঠিকটি নিয়ে হাজার বার করে পড়েছি, কিন্তু হায়, তাতেও এমন কিছু পেলুম না, যাতে করে আমার এ নির্মম ধারণা, কঠোর বিশ্বাস দূর হয়ে যেতে পারে। আমার দুঃখে, আমার বেদনায় করুণা-বিগলিত হৃদয়ে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছ, অনেক কিছু লিখেছ, অনেক জায়গায় পড়তে পড়তে চোখের জলও বাধা মানে না, কিন্তু ‘তোমায় আমি ভালোবাসি’ এই কথাটি কোথাও লেখনি – ভুলেও না। ওই কথাটি ঢাকবার জন্যে যে সলজ্জ কুণ্ঠা বা আকুলতা, তাও নেই কোনো চিঠির কোনোখানটিতেই। হায় রে অন্ধ বিশ্বাস আমার! তবু এতদিন কত অধিকার নিয়ে কত অভিমান করেই না তোমায় চিঠি দিয়ে এসেছি। সেই লজ্জায় সেই অপমানে আজ আমার বুকের বেদনা শতগুণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে, তবু কিন্তু আর তোমায় ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারছিনে। এবার যে আমি আগে ভালোবেসেছি! যে আগে ভালোবাসে , প্রায়ই তার এই দুর্দশা এই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তাই বড়ো দুঃখে আজ অবিশ্বাসী নাস্তিকের মতো এই বলে মরতে যাচ্ছি যে, পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই। ভালোবেসে ভালোবাসা পাওয়া যায় না এই অবহেলার মাটির ধরায়। মানুষ যে কত বড়ো ঘা খেয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিক হয়, তা যে নাস্তিক হয়, সেই বোঝে। জানি যে ভালোবেসে আত্মদানেই তৃপ্তি। বিশ্বাসও করি যে, যাকে সত্যিকার ভালোবাসা যায়, সে অপমান আঘাত করলে হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না। প্রিয়ের দেওয়া সেই ব্যথাও যেন সুখের মতোই প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে এত প্রাণ-ঢালা ভালোবাসার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে প্রাণটা হা-হা করে কেঁদে ওঠে না, এ যে বলে, সে সত্যি কথা বলে না।
    পুরুষ জন্ম-জন্ম সাধনা করেও নারীর মন পায় না। নারীর অন্তরের রহস্য বড়ো জটিল, বড়ো গোপন। নারী সব দিতে পারে, কিন্তু তার মনের গোপন মঞ্জুষার কুঞ্জিকাটি যেন কিছুতেও দিতে চায় না। শুনেছি, কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে তবে তার হাতে ওই চাবিকাঠিটি নাকি সমর্পণ করে। তোমার উপর আজ আমার এত অভিমান কেন জান? তুমি আমার সকল আদর সকল সোহাগ আমার দুরন্ত ভালোবাসার সকল বাড়াবাড়ি নীরবে সয়ে গেছ। কখনো এতটুকু প্রতিবাদ করনি। তোমার মুখ দেখে কোনোদিন বুঝতে পারিনি, তুমি আমার সে আদর-সোহাগে ব্যথা পেয়েছ, না সুখী হয়েছ। তোমার মুখে কোনোদিন এক রেখা হাসিও ফুটে উঠতে দেখিনি সে সময়। তাই আজ এই কথাটি ভাবতে বুক আমার ভেঙে পড়ছে যে, হয়তো তুমি দায়ে পড়েই আমার অত বাড়াবাড়ি নীরবে সয়েছ, হয়তো ওতে কত ব্যথাই পেয়েছ মনে মনে। কোনো চিঠিতে ও-কথাটির ভুলেও উল্লেখ করনি। তাই মনে হয়, ওটাকে কোনোরকমে চাপা দেওয়াই তোমার ইচ্ছা। আচ্ছা, তাই হোক! এইবার সকল ভুল সকল যাতনা চিরতরেই চাপা পড়বে, ফিরলেও আর সে-কথা কখনও তুলব না, না ফিরলে তো নয়ই। তাতে প্রাণ যত বেশিই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাক না কেন। যদি ফিরি, তবে আর একবার আত্মবিদ্রোহী হবার শেষ চেষ্টা করব। কিন্তু হায়! কার কাছে এ-কথা বলছি! কোন্ পাষাণ মৌন-নির্বাক দেবতা আমার এ তিক্ত ক্রন্দন শুনছে? যা বলছিলাম, তাই বলি।
    আমি কেন সুখী হতে পারছিনে, জান? সাধারণ লোকের মতোন সহজ ভালোবাসায় তুষ্ট হতে পারছিনে বলে। আমারই চারি পাশে আর সক্কলে কেমন খাচ্ছে-দাচ্ছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছে আবার তখনই মিল হয়ে যাচ্ছে, – এমনই করে তাদের সুখে-দুঃখে বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সাধারণের পথ ধরে চলতে পারি নে বলেই ওদের একজন হয়ে সুখী হওয়া তো দূরের কথা, অমনই অসুখীও হতে পারলুম না। ওরা বিয়ে করে , ছেলে-পিলে হয়, বড়ো হলে বে দেয়, জামাই-বউ ঘরে আসে, – ব্যাস, আর কী চাই? ওরই মধ্যে হাসে, কাঁদে, সব করে। ওরা ওতেই সুখী। ওরা যা পেয়েছে তাতেই তুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, বেচারাদের শতকরা নব্বই জনই যেন জানে না আর জানতে চায় না যে, যে-মানুষটিকে নিয়ে এতদিন ঘরকন্না করছে, সেই মানুষটির মনটিই তার নয়। দুইজনাই দুই জনের মন কোনোদিন বোঝেনি, বুঝবার দরকারও হয়নি। এত কাছাকাছি থেকেও তাই – মনের দেশে দুইজন দুইজনের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই ফাঁকি আমার চোখে যে-দিন ধরা পড়েছে, সেই দিন থেকে আমি আর কাউকে সাথি করে ঘর বাঁধতে সাহস পাচ্ছিনে। সদা ভয় হয় আর ব্যথাও বাজে এই কথাটি ভাবতে যে, আমারই বুকে মাথা রেখে আমারই জীবন-সঙ্গিনী অন্যের কথা ভাববে, তার ব্যর্থ জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর আমি তারই কাছে আমার ভালোবাসার অভিনয় করে যাব, সেও দায়ে পড়ে দিব্যি সয়ে যাবে, – উঃ! এ-কথা ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে! আমি যাকে নিয়ে বাসা বাঁধব, আগে দেখে নেব তার মনের মানুষটি আমার মনের মানুষটিকে চিনেছে কিনা। তা যত জন্ম না হবে, তত জন্ম আমি হয় মায়ের লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে মায়ের কোলেই থাকব, নতুবা লোটা কম্‌লি নিয়ে এমনই বোম্-বোম্ করেই বেড়িয়ে বেড়াব।
    আমি মানুষ দেখেই তার মনের কথা ধরে দিতে পারি বলে বড্ডো গর্ব করে এসেছি এতদিন, আর অনেক জায়গাতেই চিনেওছি ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে যে এমন করে আমার সকল অহঙ্কার চোখের জলে ডুবে যাবে, তা কে জানত। সত্যই,

          ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে।
              সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়ানে।’

    তা না হলে এতো বড়ো দুর্দান্ত দুর্বার আমাকেও তুমি আজ শিশুর মতোন করে কাঁদাচ্ছ! তুমি আর-সকলের কাছে এত সরল, আর আমার কাছেই কেন এত দুর্বোধ হয়ে পড়েছ, বলতে পারো লক্ষ্মীমণি? – হাঁ, একটি কথা নিবেদন করে রাখি এর মধ্যে, – যখন জীবনে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে, যখন দেখবে তোমার বুক-ভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে (ভগবান না করুন), সেদিন এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়ো প্রিয় আমার, যে, এই দুঃখের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড়ো প্রাণ ভরে ভালোবেসেছিল। বিনিময়ে তার এক কণাও ভালোবাসা সে পায়নি, তবু সে এতটুকু ব্যথা রেখে যায়নি তোমার জন্যে, এমনকী কোনোদিন তোমার কাছে তা নিয়ে অনুযোগও করেনি। সে তোমায় পেলে মাথার মণি করে রাখত। তোমাকে রাজরাজেন্দ্রাণী করবার সকল ক্ষমতা, সকল সাধ তার ছিল। তোমার এত ভালোবাসা এত অভিমানের অধিকারী হলে সে এমন করে তার বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভরা উদ্দাম তরুণ জীবনকে এত অল্প দিনে ব্যর্থ করে এমন করে বিদায় নিত না। অনেক-অনেক বড়ো কিছু বিশ্বের বিস্ময় হতে পারত। বড়ো ব্যথায় তার সারা জীবনটা বিদ্রোহ আর স্বেচ্ছাচারিতা করেই কেটে গেল। আরও মনে করো যে, পরপারে গিয়েও সে শান্ত হতে পারেনি, চিরদিনের মতো এবারেও সে সেখানে তোমারই তরে মালা হাতে করে তার অশান্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে পথে পথে ঘুরে। তোমায় বুকে করে তুলে নেবার জন্যে সে সকল সময় তোমার পানে তার সকল প্রাণ-মন নিয়োজিত করে রেখেছে। সে যে তোমায় সত্যিই ভালোবাসে, তাই প্রমাণ করতে সে তার নিজের গর্দানে নিজে খড়্গ হেনে মরেছে! আরও মনে করো সেই দিন, যাকে তুমি একদিন মনে মনে তোমার সুখের পথের কাঁটা, তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করেছিলে, সে-ই তোমার সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল থেকে বাঁচাবার জন্যেই চিরদিনের মতো তোমার পথ হতে সরে গিয়েছে। মনে করো, যাকে তুমি অনাদর করেছ, তার এককণা ভালোবাসা পাবার জন্যে বহু হতভাগিনি বহুদিন ধরে সাধনা করেছিল, কিন্তু সে কোনোদিন তার মানসী-প্রিয়া – তোমায় ছাড়া আর কারুর পানে একটু হেসেও চাইতে পারেনি, পাছে তোমার অভিমান হয়, পাছে তুমি ব্যথা পাও ভেবে।
    আর একটা ছোটো কথা এইখানেই মনে পড়ে গেল। শুনে তুমি হয়তো আমায় কী ভাববে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে যে-যে কারণে আজ এত বড়ো বুক-জোড়া অভিমান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও তারই একটা। সেটা আর কিছু নয়, কাল চিঠিগুলো তোমার পড়তে পড়তে হঠাৎ ও-কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি জান, আমি বড্ড হিংসুটে। তোমায় অন্যে ভালোবাসবে, এ-চিন্তাটাও সইতে পারিনে, দেখতে পারা তো দূরের কথা। সকলে তোমার খুব প্রশংসা করুক, তোমায় ভালো বলুক, তাতে খুবই আনন্দ আর গৌরব অনুভব করব, কিন্তু তাই বলে অন্যকে তোমায় ভালোবাসতে তো দিতে পারিনে। আমি চাই, তুমি একা আমার – শুধু আমার – ভিতরে বাইরে পরিপূর্ণরূপে আমার হও, আর আমিও পূর্ণরূপে তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সুখী হই। আমি ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না – কখনই না, কিছুতেই না। তাই যখনই দেখেছি যে, অন্যে তোমার দিকে একটু চেয়ে দেখেছে আর তুমিও তার পানে হেসে চেয়েছ, অমনি মনে হয়েছে এক্ষুণি গিয়ে তার বুকে ছোরা বসিয়ে দিই। কিন্তু ভগবান তোমাকে রূপ আর গুণ এত অপর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছেন যে, তোমায় দেখেই লোকে ভালোবেসে ফেলে। তোমাকে ভালোবাসা-পিয়াসী তৃষাতুর মানুষের মন যে ভালো না বেসেই পারে না। তাই কতদিন মনে হয়েছে যে, তোমাকে নিয়ে এমন বিজন বনে পালাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। চোখ মেললেই আমি তোমাকে দেখব, তুমি আমাকে দেখবে। আমার এ যেন রাহুর প্রেম। নয়? আমায় ছেড়ে অন্যকে তুমি ভালোবাসবে, আমার এই ব্যথাটাই সব চেয়ে মর্মন্তুদ। তাই তো এমন করে তোমার কাছে যাচ্ঞা করে এসেছি যে, আমার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না – পারবে না। কিন্তু তুমি আমার অত সকরুণ মিনতি শুনেও কোনোদিন কথা কয়ে তা জানাওনি, একটু মিথ্যা করে মাথা দুলিয়েও বলনি, যে, হাঁ গো হাঁ। ... শুধু নিস্তব্ধ মৌন হয়ে গেছ। তোমার তখনকার ভাবের মানেটা আজও বুঝতে পারছিনে বলেই আমার এত প্রাণপোড়ানি আর ছটফটানি। আজ আমি বড়ো সুখে মরতে পারতাম, যদি আমার এই চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ির ক্ষণেও জানতে পারতাম তোমার সত্যিকার মনের কথা। এখন জানাতে চাইলেও হয়তো আর জানাতে পারবে না। যদিই পারতে, তাহলে হয়তো চির-হতভাগ্য বলে একটু করুণা করে আমায় অনেক কিছু সিক্ত সান্ত্বনা দিয়ে আমায় প্রবোধ দিতে, কিন্তু হায় প্রিয় আমার, এ মৃত্যুপথের পথিককে আর ভুলাতে পারতে না, সে সুযোগ তাই আমি ইচ্ছে করেই দিলাম না তোমায়। যখন তুমি আমার এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমার নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ব। দেখো, আমার আজ মনে হচ্ছে পুরুষদের মতোন বোকা ভ্যাবাকান্ত আর নেই, অন্তত মেয়েদের কাছে। পুরুষ যেমন করে ভালোবাসা পাবার জন্যে হা-হা করে উন্মাদের মতোন ছুটে যায়, তা দেখে মনে হয়, এর এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা বুঝি স্বয়ং ভগবানও মেটাতে পারবে না, কিন্তু তাকে একটি ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে তোমরা এমনই ভুলিয়ে দিতে পার যে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। এত বড়ো দুর্দান্ত দুর্বিনীতকে ওই একটু মিষ্টি করে ‘লক্ষ্মীটি’ বলে একটু কপালে গিয়ে হাতটি রাখলে, বা গিয়ে তার হাতটি ধরলেই সে যত দূর হতে-পারা-সম্ভব সুশীল সুবোধ বালকটির মতোন শান্ত হয়ে পড়ে। তোমার মনে কী আছে তা ভেবে দেখতে চায় না, ওই একটু পেয়েই ভালোবাসার কাঙাল পুরুষ এত বেশি বিভোর হয়ে পড়ে। তবু তোমরা এই বেচারা হতভাগা পুরুষদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দাও না। কিছুতেই তোমাদের মনের কথাটি পাওয়া যায় না, সব ভালোবাসাটুকু পাওয়ার আশা তো মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। কোথায় যেন তোমাদের মনের সীমারেখা, কোথায় যেন তোমাদের ভালোবাসার তল, কোথায় যেন তার শেষ! আমি তাই অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবি আর ভাবি! মনে কোরো না যে, এগুলো সকলেরই মনের ভাব। আমি আমার এখনকার মনের ভাবগুলো সোজাসুজি জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে তা না মিলতেও পারে। এমনি করে পুরুষ নারীর কাছে চিরদিন প্রতারিত হয়ে আসছে। কারণ, তারা বাইরে যতো বড়ো কর্মী বিদ্বান আর বীর হোক না কেন, তোমাদের কাছে তারা একের নম্বর বোকা, একেবারে ভেড়া বনে যায় বললেও অত্যুক্তি হয় না। তোমাদের কাছে থেকেও তোমাদের মন বুঝতে স্বয়ং ভগবান পারবে না, এ আমি আজ জোর গলায় বলছি। তোমরা নারী, তোমাদের স্বভাবই হচ্ছে স্নেহ করা, সেবা করা, যে কেউ হোক না কেন, তার দুঃখ দেখলে তোমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে, একটু সেবা করতে ইচ্ছা হয়। ওতে তোমাদের গভীর আত্মপ্রসাদ, নিবিড় তৃপ্তি। এইখানে তোমরা দেবী, সন্ন্যাসিনী। এই ব্যথিতের ব্যথা মুছাতে তোমরা সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করতে পার, কিন্তু তাই বলে সবাইকে ভালোবাসতে পার না, আর ভালোবাসও না। এইখানে পুরুষ সাংঘাতিক ভুল করে বসে। তোমাদের ওই সেবা আর করুণাটুকু সে ভালোবাসা বলে ভুল করে দেখে, অবশ্য যদি সে তোমায় ভালোবেসে ফেলে। আর যাকে জান যে, সে সত্যি-সত্যিই তোমাকে বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে, অথচ তুমি কিছুতেই তাকে ভালোবাসতে পারছ না; তা হলে তার জন্যেও তুমি সকল রকম বাইরের ত্যাগ স্বীকার করতে পার, তার সেবা কর, শুশ্রূষা কর, তার ব্যথায় সান্ত্বনা দাও, কত চোখের জল ফেল করুণায়, – তবু কিন্তু ভালোবাসতে পার না। বাইরের সব সুখে জলাঞ্জলি দিতে পার তার জন্যে, কিন্তু মনের সিংহাসনে রাজা করে কিছুতেই তাকে বসাতে পার না।
    কিন্তু অন্ধ অবোধ পুরুষ তোমাদের ওই স্বভাবজাত করুণাকেই ভালোবাসা মনে করে বড়ো বেশি আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে। হায় রে অভাগা! তাকে পরে তার জন্যে আবার দুঃখও পেতে হয় অনেক গুণ বেশি। কারণ, মিথ্যা যা, তা একদিন-না একদিন ধরে পড়েই। হঠাৎ একদিন নিশীথে বুকে জড়িয়ে ধরেও সে ধরে ফেলে যে, আমার এই নিকটতম মানুষটি আমার সব চেয়ে সুদূরতম। আমার বুকে থেকেও এ আমার নয়। একে হারিয়েছি, হারিয়েছি এ জনমের মতো। সে যাতনা যে কী নিদারুণ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এ ভুল-ভাঙার সাথে সাথে অনেকেরই বুক নিষ্করুণভাবে ভেঙে যায়, তার জীবন চিরতরে নিষ্ফল ব্যর্থ হয়ে যায়! সে তখন নির্মম আক্রোশে নিজের উপর নির্দয়তম ব্যবহার করে নিজের সে ভুলের শোধ নেয়। সে আত্মহত্যা করে, এক নিমেষে নয়, একটু একটু করে কচলিয়ে কচলিয়ে।
    তোমাদের নারী জাতিকে আমি খুব বেশি শ্রদ্ধা করি, প্রাণ হতে তাদের মঙ্গল কামনা করি, কিন্তু তাদের উপর এই অভিযোগ চিরদিন রয়ে গেল যে, তারা পুরুষের ভালোবাসার বড়ো অনাদর করে, বড়ো অবহেলা অপমান করে। তারা নিজেও জীবনে সুখে হয় না, অন্যকেও সুখী করতে পারে না। আমাদের সমাজের বেদনার সৃষ্টি এইখানেই। যে তাকে সকল রকমে সুখী করে তার বাহিরে ভিতরে রানি করে দেবী করে রাখতে পারত, রূপ-যৌবন-গরবিনি নারী তাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। সে হতভাগার রক্তঝরা প্রাণের উপর দিয়ে পায়ে আলতা পরে। পরে তাকে এর জন্যে অনুতাপ করতে হয় সারাটা জীবন ধরে, তা জানি। ভালোবাসাকে অবমাননা করে সে-ও জীবনে আর ভালোবাসা পায় না, তখন তার জীবন বড়ো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, বিষিয়ে ওঠে! তখন হয়তো তার বেশি করে তাকেই মনে পড়ে, যে তার এক কণা ভালোবাসা পেলে আজ তাকে মাথায় নিয়ে নাচত। তোমরা হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, এ আমার মিথ্যা ধারণা। তা বলো, আমি যা দেখছি, তাই বলছি। তোমরা একটা কথা বলবে – ‘নারী বড়ো ভালোবাসার কাঙালিনি। একটু আদর পেলে তাকে সে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলে।’
    শুনে হাসি পায় আমার! একটু আদর তো ছোটো কথা, জন্ম-জন্ম ধরে পাখিটির মতো করে বুকে রেখে, আদর-সোহাগ করে ভালোবেসেও তোমার মন পাইনি, শুধু এই একটা উদাহরণ দেখিয়েই ক্ষান্ত হলুম। আমার মতোন হতভাগা দু-দশটা প্রায়ই দেখতে পাবে পথে ঘাটে টো-টো কোম্পানির দলে। নেহাৎ চোখের মাথা না খেলে তোমরা তা অস্বীকার করতে পারবে না।
    যাক, আমি হিংসের কথা বলতে গিয়ে কী সব বকলুম। আমি বলতে চাই যে, আমি তোমায় দেখিয়ে-দেখিয়ে তোমারই চোখের সামনে একে ওকে কত আদর করেছি, কিন্তু কোনোদিন তোমার তাতে হিংসে হয়নি। তুমি কোনোদিন বাইরে ভিতরে এতটুকু চঞ্চল বা বিচলিত হওনি। তুমি মনে মনে জান যে, তুমি আমার নও, তুমি আমায় ভালোবাসতে পার না, অতএব আমি যাকেই যত আদর ভালোবাসা দেখাই, তাতে তোমার কিছুই আসে যায় না। আমার উপর যখন তুমি কোনো দাবিই রাখ না, তখন আমায় যে-কেউ ভালোবাসুক বা আমি যাকেই ভালোবাসি, তাতে তোমার কী আসে যায়?
    আমার এখন মনে হচ্ছে কী জান? আমি যদি তোমার চেয়েও সুন্দরী মেয়ে হতে পারতুম, তাহলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবেসে দেখতুম তোমার বুকে কেমন ব্যথা বাজে, কত বেদনা লাগে!
    এত কথা কেন জানালুম, জান? আমি আজ রাজবন্দি। প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতে বসে তোমায় এই চিঠি দিচ্ছি। কাল আমার বিচার হবে। বিচারে দুটি বছরের সশ্রম কারাদন্ড তো হবেই। জেলের এক কর্মচারী দৈবক্রমে আমারই এক বন্ধু – শৈশব কালের। আমাদের আজ আশ্চর্য রকমের দেখাশোনা। স্কুলে আমাদের দুইজনের মধ্যে বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট কে হবে এই নিয়ে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। ওরই কৃপায় এত বড়ো চিঠি এমন করে লেখবার অবসর আর সাজ-সরঞ্জাম পেয়েছি, তা না হলে কারুকখে কোনো কিছু জানিয়ে যেতে পারতুম না। ভগবান বন্ধুর আমার মঙ্গল করুন!
    তুমি মনে করবে, মাত্র দু-বছরের জেল হবে হয়তো, তার জন্যে এমন বিদায়-কান্না কেন? আবার তো ফিরে আসব। কিন্তু আমি জানি, আমি আর ফিরব না। তোমায় এতদিন বলিনি, লুকিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু আজ যাবার দিনে কষ্ট পাবে জেনেও জানিয়ে যাচ্ছি। আমার যক্ষ্মা হয়েছে – যাকে আমাদের দেশে শিবের অসাধ্য রোগ বলে। ডাক্তার কতবার আমায় পরিশ্রম করতে মানা করেছে, আমার কত বন্ধু আমায় কত মিনতি করে হাতে-পায়ে ধরে এখন কিছু দিনের জন্যে বিশ্রাম করতে বলেছে, আর আমি ততই দ্বিগুণ বেগে কাজ করেছি। সে সময় তুমি যদি আমায় একটিবার মানা করতে! করুণা করে নয় – ভালোবেসে, তাহলে কী করতুম, জানি না। কিন্তু তুমি তো আর আমার এ ভীষণ রোগের খবর জানতে না! তাহলে দয়া করে হয়তো আমায় মিনতি করে লিখতে ভালো হবার জন্যে। ...
    তবু কিন্তু তোমার সকল শাসন মেনে চলছি আমি আমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন করে আর কেউ আমায় কথা শোনাতে পারেনি, এ-বিশ্বে এত বড়ো স্পর্ধা তুমি ছাড়া আর কারুর হয়নি যে, আমায় শাসন করে, হুকুম শোনায়! – যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তোমার কাছে কোনোদিন, তবে তা ভুলে যেও না, ক্ষমা করো এই ভেবে যে, তুমি যাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারনি, সেই তোমার সকল কথা তার শেষ দিন পর্যন্ত খোদার পবিত্র বাণীর চেয়েও পবিত্রতর মনে করে মেনে চলেছে। এইটুকু ভেবে পার তো একটু আনন্দ অনুভব করো। আমার মতোন দুর্জয় বাঁধন-হারাকে তুমি জয় করেছিলে, এই ভেবেও একটু গৌরব করো।
    দু-বছর না হয়ে যদি মাত্র ছয় মাসেরও সশ্রম কারাদণ্ড হয় আমার, তাহলেও আমার ফিরবার কোনো আশা নেই। যক্ষ্মায় আমার শরীরটাকে খেয়ে ফেলেছে, আর ব্যথায় আমার বুকে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে। এর উপর জেলের খাটুনি। কখন যে আমার হৃদক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে, তা বলতে পারি নে। এখনই একটু পরিশ্রম করলেই আমার নাকে মুখে অজস্র ধারে রক্ত নির্গত হয়। হয়তো ইচ্ছা করলে বাঁচতেও পারতুম, কেননা আমার ইচ্ছাশক্তির ও প্রাণ-শক্তির উপর আমার গভীর বিশ্বাস আছে। কিন্তু আর সে ইচ্ছা নেই লক্ষ্মী। এখন ফিরাতে এলেও হয়তো আমি ফিরতে পারতুম না। বড়ো দুঃখেই বলতে হত, – ‘অবেলায় প্রিয়তম , এ যে অবেলায়!’ তাছাড়া, বাঁচতে পারতুম যদি জীবনটাকে অন্য কোনো বড়ো দিক দিয়ে সার্থক করে তুলতে পারতুম, তাও পারলুম না। অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করে দেখা গেল। আর পারবও না। তাই আজ হাল ছেড়ে দিয়ে বলছি, – ‘সন্ধে হল গো, এবার আমায় বুকে ধরো।’ এত শীঘ্র এমন করে ধরা পড়ব, তা আমি দু-দিন আগে স্বপ্নেও ভাবিনি। কেননা আমার আশা ছিল, এর চেয়েও অনেক বড়ো কাজ করে মরণ-বরণ করা। কিন্তু তা আর ঘটে উঠল না। কারণগুলো জেনে আর কী হবে বল!
    তবে বিদায় হই। বিদায়-বেলায় অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছি, যেন তুমি জীবনে একটি দিন সত্যিকার ভালোবেসে দুঃখ পেয়ে আমার ব্যথা বোঝো! তোমার জীবনের অভিশাপ আজ এ পৃথিবী ছেড়ে চলল! আর ভয় নেই!
    হাঁ, যদি পার আশীর্বাদ করো, যেন এবার জন্ম নিলে তুমি যাকে ভালোবাস, সে-ই হয়ে জন্মগ্রহণ করি! – ইস্! কী অন্ধকার! ... ইতি –

তোমার চির-জীবন-জোড়া অভিশাপ আর অমঙ্গল –
শ্রীধূমকেতু