যাম-যোজনায়
কড়ি মধ্যম
কাজী নজরুল ইসলাম
এক অহোরাত্র আট
প্রহরে বা যামে বিভক্ত। অর্থাৎ প্রতি তিন ঘন্টায় এক প্রহর বা যাম। সঙ্গীতের স্বর সপ্তকের মধ্যে কড়ি 'মা' বা তীব্র মধ্যম স্বর এই যাম বা প্রহর যোজনায় সেতু স্বরূপ। প্রতি প্রহরকে এই তীব্র মধ্যম যেন আহবান করে আনে আগত প্রহরের সাথে বিদায় প্রহরের পরিচয় ক'রে দেয়! নিশির শেষ প্রহরে যে রাগ গীত হয়, তার মধ্যে ললিত রাগ
অন্যতম।
ললিত রাগের শুদ্ধ ও তীব্র দুই মা। "পা" নেই বলেই বোধ হয় দুই মার কোলে ললিত রাগ লালিত হয়েছে। এই রাগের খেয়াল শুনুন। 'মা' এ রাগের প্রাণ।
ললিত তেতালা (চিত্তরায়)
পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে;
কৃষ্ণচূড়া বনে ফাগুন সমীরণে
ঝুরে ফুল বন-পথ-তলে॥
নিশি পোহায়ে যায় কাহার লাগি
নয়নে নাহি ঘুম বসিয়া জাগি
আমারই মত হায় চাহিয়া আশা পথ
নিশীথের চাঁদ পড়ে গগনে ঢলে॥
টোড়ি রাগিনী
দ্বিতীয় প্রহরে গীত হয়। ভৈরবী আশাবরী গান্ধারী প্রভৃতি রাগিনীর পর এই রাগের তীব্র
মধ্যম তীব্র সুরে জানিয়ে দেয় যে, দিনের দ্বিতীয় প্রহর এল। দু' একটী টোড়িতে দুই
মধ্যম লাগে। শুদ্ধ টোড়ির এক 'মা'। আরোহণের সময় এর পা পড়ে বক্র গতিতে। আরোহণের সময় ঋষভ বা রেখাবে চড়তে এ একটু ইতস্ততঃ করে।
অবরোহণের বেলায় কিন্তু ঋষভের গা ঘেঁসে খেলা করে। টোড়ির খেয়াল শুনুন।
টোড়ি ─ তেতালা
উদার প্রাতে কে উদাসী এলে।
প্রশান্ত দীঘল নয়ন মেলে' ॥
স্নিগ্ধ সকরুণ তোমার হাসি
আঘাত করে যেন আমারে আসি',
পাষাণ সম তব মৌন মূরতি
মোর বুকে বিষাদের ছায়া কেন ফেলে॥
উন্মন ভিখারি গো বল মোর কাছে
শূন্য হৃদয় তব কোন মন যাচে,
অশ্রু তুষার ঘন বিগ্রহ তব
গলিয়া পড়িবে প্রেমে কার মালা পেলে॥
টোড়ির পর যে সব সারং গীত হয় তার মধ্যে শুদ্ধ সারং ও গৌড় সারং ছাড়া অন্য রাগে তীব্র মধ্যম নেই। গৌড় সারংকে দিনের বেহাগও বলা হয়। দুপুর বেলায় এই রাগ গাওয়া হয়। এরও দুই মা। এর দুই মা'র উপরে সমান টান। এর চলন অত্যন্ত বাঁকা। এর খেয়াল গান গাওয়া হচ্ছে শুন্লেই এর বাঁকা স্বভাবের পরিচয় পাবেন।
গৌড় সারং ─ তেতালা
ভবনে আসিল অতিথি সুদূর।
সহসা উঠিল বাজি' রুমু রুমু ঝুম্
নীরব অঙ্গনে চঞ্চল নূপুর॥
মুহু-মুহু বন-কুহু বোলে
দোয়েল তমাল-ডালে দোলে ;
মেঘের ধ্যান ভুলি' চমকি' আঁখি খোলে
'কে-গো-কে' বলে বন-ময়ুর॥
দগ্ধ হিয়ার জ্বালা জুড়ায়ে
সজল মেঘের শীতল চন্দন কে দিল বুলায়ে ?
বকুল-কেয়া-বীথি হ'তে
ছুটে এলো সমীরণ চঞ্চল স্রোতে
চাঁদিনী নিশীথের আবেশ আনে
মিলন তন্দ্রাতুর অলস-দুপুর॥
গৌড় সারং-এর পরে
অন্য প্রহরকে পরিচয় ক'রে দেওয়ার জন্য আসেন মূলতান রাগের তীব্র মধ্যম। মূলতান
রাগের এক মা
─
অর্থাৎ এতে কেবল কড়ি 'মা' লাগে। সকালের টোড়ি আর বিকালের মূলতান একই ঘরের
ছেলে মেয়ে। শুধু চাল চলনের তফাতের জন্য দুই জনের স্বভাব দুরকমের হয়ে গেছে। টোড়ি শুনেছেন, এখন
মূলতানের খেয়াল শুনুন, তা-হলেই এদের চালের তফাৎ বুঝ্তে পারবেন। টোড়ির রাধা অর্থাৎ 'রে' আর 'ধা' প্রীতি
প্রবল, পা দুর্ব্বল। মূলতানীর 'পা' বেশ প্রবল। রাধা
প্রীতি খুব কম।
মূলতানী-তেতালা
মুকুর ল'য়ে কে গো বসি'
হেরিছে আপন ম্লান-মুখ-শশী॥
সখিরা ডাকে বেলা ব'য়ে যায়
দোপাটির ফুল ঝুরে আঙিনায়'
ধূলাতে লুটায় কাঁখের কলসি॥
হেরিয়া তারি অলস ছবি,
ডুবিতে নারে সাঁঝের রবি।
কমল-কলি ল'য়ে আঁচলে
ডাকিছে তারে গাঁয়ের সরসী॥
বিকালের মূলতানীর পর পিলু ভীমপলস্ত্রী পভৃতি রাগিণীতে আর কড়ি মা নেই। সান্ধ্য প্রহর যেই এল, অমনি কড়িমা আন্লেন 'পূরবী'কে ধ'রে। পূরবী এল কাঁদতে কাঁদতে। দুই মা'র গলা জড়িয়ে এর কান্না অতি সকরুণ।
পূরবী ─ তেতালা
বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে।
দিনের চিতা জ্বলে অস্ত আকাশে॥
দিন শেষে শুভদিন এলো বুঝি মম
মরণের রূপে এলে মোর প্রিয়তম,
গোধূলির রঙে তাই দশ দিশি হাসে॥
দিন গুণে নিরাশার পথ-চাওয়া ফুরালো,
শ্রান্ত এ জীবনের জ্বালা আজ জুড়ালো।
ওপার হ'তে কে এলো তরী বাহি'
হেরিলাম সুন্দরে, আর ভয় নাহি,
আঁধারের 'পারে তার চাঁদ মুখ ভাসে॥
পূরবী পুরিয়া প্রভৃতি রাগের কান্নার পর, রাত্রি যেমন ঘনিয়ে এল অমনি চাঁদের চাঁদ-মুখ দেখে রাতের চোখে ফু'টে উঠ্ল হাসি। তীব্র মধ্যম নিয়ে এল চঞ্চল ছায়ানটকে ধ'রে। নটের মত এর আঁকা-বাঁকা গতি, মধুর অঙ্গ-ভঙ্গী কী অপরূপ তার আভাস পাবেন এই সুরের গানে।
ছায়ানট ─ তেতালা
বিরহী বেণুকা যেন বাজে সখি ছায়ানটে।
উথলি' উঠিল বারি শীর্ণা যমুনাতটে॥
নীরব কুঞ্জে কুহু
গেয়ে ওঠে মুহু মুহু,
আঁধার মধু বনে বকুল চম্পা ফোটে॥
সহসা সরস হল বিরস বৃন্দাবন,
চন্দ্রা যামিনী হাসে খুলি মেঘ-গুণ্ঠন।
সে এলো, তারে নিরখি'
পরান কি রবে সখি,
আবেশে অঙ্গ মম থরথর কেঁপে ওঠে॥
ছায়ানটের পর আসে নিঝুম নিশি। বিহগ যখন ঘুমায় বেহাগ তখন জাগে। শুদ্ধ মধ্যমই এর আসল মা। কড়ি মা ─ এর সৎমা। দুই মধ্যমে এর যে অপরূপ শ্রী ফুটে উঠে তার বুঝি তুলনা নেই।
বেহাগ ─ তেতালা
নিশি-পবন! নিশি-পবন! ফুলের দেশে যাও
ফুলের বনে ঘুমায় কন্যা তাহারে জাগাও ─ যাও যাও যাও॥
মৌ-টুস্টুস্ মুখখানি তার ঢেউ-খেলানো চুল
(ওরে) ভোমরার ঝাঁক-ঘেরা যেন ভোরের পদ্ম-ফুল
হাসিতে তার মাঠের সরল বাঁশির আভাস পাও
যাও যাও যাও॥
চাঁপা ফুলের পুত্লি-ঘেরা চাঁপা রঙের শাড়ি
তারেই দেখতে আকাশ-গাঙে (ওরে) চাঁদ দেয় রে পাড়ি।
তার একটুখানি চোখের আদল বাদল-মেঘে পাও।
যাও যাও যাও॥
ধীরে ধীরে জাগাইয়ো তায়
ঝরা-কুসুম ফেলিয়া গায়
জাগলে কন্যা যেন রে মোর পত্রখানি দাও ─
যাও যাও যাও ॥
বেহাগের পর
নিশীথের তৃতীয় প্রহরে কড়ি মধ্যম ধ'রে আনে চঞ্চল 'পরজ'কে। এঁর মান অত্যন্ত প্রবল
─
অর্থাৎ
কড়ি মধ্যম ও নিখাদে এঁর অত্যন্ত প্রীতি। এর তীব্র নিখাদ ও মধ্যম ঘুমন্তের ঘুম ভেঙে দেয়। এর বিরহ যেন বিলাস। বসন্তের সাথে এর অত্যন্ত প্রীতি।
পরজ ─ তেতালা
পরজনমে যদি আসি এ ধরায়।
ক্ষণিক বসন্ত যেন না ফুরায়॥
মিলনে নাহি যেন রহে অবসাদ
ক্ষয় নাহি হয় যেন চৈতালি-চাঁদ,
কণ্ঠ-লগ্ন মোর প্রিয়ার বাহু
খুলিয়া না পড়ে যেন, নিশি না পোহায়॥
বাসি নাহি হয় যেন রাতের মালা,
ভরা থাকে যৌবন রস-পেয়ালা।
জীবনে না রহে যেন মরণ-স্মৃতি
পুরাতন নাহি হয় প্রেম-প্রীতি,
রবে অভিমান রহিবে না বিরহ,
ফিরে যেন আসে প্রিয়া মাগিয়া বিদায়॥