নির্ঝর
কাব্যগ্রন্থ
কাজী নজরুল ইসলাম


বঙ্গনূর পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৭ (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

             চিঠি

                বিনু!
তোমায় আমায় ফুল পাতিয়েছিনু,
            মনে কি তা পড়ে? –
যেদিন সাঁঝে নতুন দেখা বোশেখ মাসের ঝড়ে
    আমবাগানের একটি গাছের তলায়
দুইটি প্রাণই দুলেছিল হিন্দোলেরই দোলায়?
তুমি তখন পা দিয়েছ তরুণ কৈশোরে!
    দোয়েল-কোয়েল-ঘায়েল-করা করুণ ওই স্বরে
    জিজ্ঞাসিলে আবছায়াতে আমায় দেখে – ‘কে?’
    সে স্বরে মোর অশ্রুজল চক্ষু ছেপে যে!
বলতে গিয়ে কাঁপল আমার আওয়াজ, - ‘বিনু, আমি!’
চমকে তুমি লাল করে গাল পথেই গেলে থামি।
    আঁখির ঘন কালো পল্লবে
চটুল তোমার চাউনি চোখের হঠাৎ নিবল যে!
    পানের পিকে-রাঙা হিঙুল বরন
    আকুল অধর আলতা-রাঙা চরণ,
শিউরে শিউরে উঠল কেঁপে অভিমানের ব্যথায়,
বরষ পরে এমন করে আজ যে দেখা হেথায়!
    নলিন-নয়ান হয়ে মলিন সজল
    মুছলে তোমার চোখের কালো কাজল!

    *      *      *

তারপর ঘেরে ঝড়ঝঞ্ঝা বৃষ্টি করকায়
অভিমান আর সংকোচেরই নিদয় ‘বোরকা’য়
উড়িয়ে দিল; কেউ জানিনি কখন দুজনে
অনেক আগের মতোই আবার আকুল কূজনে
    উঠেছিনু মেতে!
তারপর হায়, ফিরে এনু আবার ঘরে রেতে,
আম বাগানের পাশের খেতে বদল করে মালা, -
    ফের বিদায়ের পালা!
দুজনারই শুধু ফুলের মালার চুম্বনে
ছাড়াছাড়ি হল কেয়ার সেই নিঝুম বনে।
হয়নি তো আর দেখা,
    আজও আশায় বসেই আছি একা
সেই মালাটির শুকনো ফুলের বুকনোগুলি ধরে
    আমার বুকের পরে।
  
এ তিন বরষ বিনা কাজের সেবায় খেটে যে
কেউ জানে না, বিনু, আমার কেমন কেটেছে!
আজও তেমনি কান্না-ধোয়া সজল যে জ্যোৎস্না,
    তেমনি ফুটেছে হেনা-হাসনা, -
তুমিই শুধু নাই!
সিন্ধুপারের মৌন-সজল ইন্দুকিরণ তাই
    তোমার চলে যাওয়ার দেশে যেতে
অভিসারের গোপন কথা এনেছে এ রেতে!
সেবার এবার শেষ হয়েছে, আজ যে কাজের ছুটি,
তাইতে, বিনু, হেসে কেঁদে খাচ্ছি লুটোপুটি!
অচিন দেশে আগের স্মৃতি নাই বা যদি জাগে,
    তাইতো বিনু চিঠি দিনু আগে।
    এখন শুধু একটি কথা প্রিয়,
বিচ্ছেদেরও বেদন দিয়ো – বুকেও তুলে নিয়ো।
ব্যথায়-ভরা ছাড়াছাড়ি মিলন হবে নিতি,
    সেথায় মোদের এমনি করে, প্রিয়তম! – ইতি।