*১১৫১. নাটিকা: ‘বনের বেদে’
উঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে।
নিবিড় হলে মনের বাঁধন গভীর ব্যথা পেতে হবে॥
কোথায় শূন্য মরুভূমি
ডাকো মোদের ডাকো তুমি,
চিড়িয়াখানায় সিংহ গেলে নিঠুর চাবুক খেতে হবে॥
বেদের মেয়ের চোখের জল বনের ঝরা ফুল
বেদের মেয়ে কাঁদে ভাসে নদীর দু’-কূল।
*১১৫২. রাগ: গারা-খাম্বাজ, তাল: দাদ্‌রা
(পিয়া মোর) উচাটন মন ঘরে রয় না।
(পিয়া মোর) ডাকে পথে বাঁকা তব নয়না॥
ত্যজিয়া লোক-লাজ
সুখ-সাধ গৃহ-কাজ,
(প্রিয়া মোর) নিজ গৃহে বনবাস সয়না॥
লইয়া স্মৃতির লেখা
কত আর কাঁদি একা,
(পিয়া মোর) ফুল গেলে কাঁটা কেন যায় না॥
*১১৫৩. রাগ: দরবারি-টোড়ি, তাল: তিল্‌ওয়াড়া
উদার অম্বর দরবারে তোরই প্রশান্ত প্রভাত বাজায় বীণা।
শতদল-শুভ্রা পদতল-লীনা, প্রশান্ত প্রভাত বাজায় বীণা॥
সহস্র কিরণ-তারে হানি’ ঝঙ্কার
ধ্বনি তোলে অনাহত গভীর ওঙ্কার,
সেই সুরে উদাসীন, পরমা প্রকৃতি ধ্যান-নিমগ্না মহাযোগাসীনা॥
আনন্দ-হংস বিমুগ্ধ গতিহীন
স্থির হ’য়ে ব্যোমে শোনে সে জ্যোতির্বীণ,
ঝরা ফুল-অঞ্জলি তা’রি চরণে প্রণতা ধরণী বাণী-বিহীনা॥
*১১৫৪.
উঠেছে কি চাঁদ সাঁঝ গগনে
আজিকে আমার বিদায় লগনে॥
জানালা পাশে চাঁপার শাখে
‘বউ কথা কও’ পাখি কি ডাকে?
ফুটেছে কি ফুল মালতী বকুল-
আমার সাধের কুসুম বনে সাঁঝ গগনে॥
তুলসী তলায় জ্বলেছে কি দীপ
পরেছে আকাশ তারকার টিপ?
হারিয়ে যাওয়া বঁধু অবেলায়
এলো কি ফিরে দেখিতে আমায়,
ঝুরিছে বাঁশি পিলু বারোয়াঁয়-
কেন গো আমার যাবার ক্ষণে॥
১১৫৫. হৈমন্তী, তাল: তেওড়া
উত্তরীয় লুটায় আমার
ধানের ক্ষেতে, হিমেল্ হাওয়ায়।
আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়॥
ভাটির শীর্ণা নদীর কূলে
আমার রবি-ফসল-দুলে,
নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর চাষির মুখে টপ্‌পা গাওয়ায়॥
*১১৫৬. রাগ: টোড়ি, তাল: আদ্ধা-কাওয়ালি
উদার প্রাতে কে উদাসী এলে।
প্রশান্ত দীঘল নয়ন মেলে’ ॥
স্নিগ্ধ সকরুণ তোমার হাসি
আঘাত করে যেন আমারে আসি’,
পাষাণ সম তব মৌন মূরতি মোর বুকে বিষাদের ছায়া কেন ফেলে॥
উন্মন ভিখারি গো বল মোর কাছে
শূন্য হৃদয় তব কোন মন যাচে,
অশ্রু তুষার ঘন বিগ্রহ তব গলিয়া পড়িবে প্রেমে কার মালা পেলে॥
*১১৫৭. রাগ: সিন্ধু-ভৈরবী, তাল: কাহার্‌বা
উম্মত আমি গুনাহগার তবু ভয় নাহি রে আমার।
আহম্‌দ আমার নবী যিনি খোদ্ হবিব খোদার॥
যাঁহার উম্মত্ হ’তে চাহে সকল নবী,
তাঁহারি দামন ধরি’ পুলসরাত হব পার॥
কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে
যবে ‘নফ্‌সি য়্যা নফ্‌সি’ রবে,
‘য়্যা উম্মতী’ ব’লে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার॥
কাঁদিবেন সাথে মা ফাতেমা ধরিয়া আরশ্ আল্লার।
হোসায়নের খুনের বদ্‌লায় মাফী চাই পাপী সবাকার।
দোজখ্ হয়েছে হারাম যে-দিন পড়েছি কলেমা।
যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান-বর্দার॥
*১১৫৮. রাগ: আশা-টোড়ি, তাল: ত্রিতাল
ঊষা এলো চুপি চুপি রাঙিয়া সলাজ অনুরাগে।
চাহে ভীরু নববধূ সম তরুণ অরুণ বুঝি জাগে॥
শুকতারা যেন তার জলভরা আঁখি
আনন্দ বেদনায় কাঁপে থাকি’ থাকি’,
সেবার লাগিয়া হাত দু’টি
মালার সম পড়ে লুটি
আহার পরশ-রস মাগে॥
*১১৫৯. নাটক: ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’
এ কি অপরূপ যুগল-মিলন হেরিনু নদীয়া ধামে
বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী যেন রে গোলক-পতির বামে॥
এ কি অতুলন যুগল-মূরতি
যেন শিব-সতী হর-পার্বতী,
জনক-দুহিতা সীতাদেবী যেন বেড়িয়া রয়েছে রামে॥
গৌরের বামে গৌর-মোহিনী
(যেন) রতি ও মদন চন্দ্র-রোহিণী
(তোরা) দেখে যা রে আজ মিলন-রাসে যুগল রাধা-শ্যামে॥
*১১৬০.
এ দেবদাসীর পূজা লহ হে ঠাকুর।
দয়া কর, কথা কও, হ’য়ো না নিঠুর॥
লহ মান অভিমান, দেহ প্রাণ মন
মম প্রেম-ধূপ নাও রূপচন্দন,
এই লহ আভরণ, চুড়ি-কঙ্কন-
চোখের দৃষ্টি নাও কণ্ঠের সুর॥
আজ, শেষ ক’রে আপনারে দিব তব পায়,
চাও চাও মোর কাছে যাহা সাধ যায়।
কহিবে না কথা কি গো তুমি কিছুতেই?
আরতির থালা তবে ফেলে দিনু এই,
নাচিব না, বাজুক না মৃদঙ্গ তাল-
খুলিয়া রাখিনু এই পায়ের নূপুর॥
*১১৬১. রাগ: ভৈরবী, তাল: একতাল
এই দেহেরই রঙমহলায় খেলিছেন লীলা-বিহারী
মিথ্যা মায়া নয় এ কায়া কায়ায় হেরি ছায়া তাঁরি॥
রূপের রসিক রূপে রূপে
খেলে বেড়ায় চুপে চুপে,
মনের বনে বাজায় বাঁশি মন-উদাসী বন-চারী॥
তার খেলা-ঘর তোর এ দেহ
সে ত নহে অন্য কেহ,
সে যে রে তুই,-তবু মোহ ঘুচল না তোর হায় পূজারি॥
খুঁজিস্ তারে ঠাকুর-পূজায়
উপাসনায় নামাজ রোজায়,
চাল কলা আর সিন্নি দিয়ে ধর্‌বি তারে হায় শিকারি!
পালিয়ে বেড়ায় মন-আঙিনায় সে যে শিশু প্রেম-ভিখারি॥
*১১৬২. নাটক: ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ (নিত্যানন্দের গান)
এই যুগল মিলন দেখ্‌ব ব’লে ছিলাম আশায় ব’সে।
আমি নিত্যানন্দ হলাম, পিয়ে মধুর ব্রজ-রসে॥
রাই বিষ্ণুপ্রিয়া আর কানাই গৌর
হের নদীয়ায় যুগল রূপ সুমধুর,
তোরা দেখে যা দেখে যা মধুর মধুর।
মধুর রাই আর মধুর কানাইরে দেখে যা দেখে যা মধুর মধুর॥
*১১৬৩. নাটক: ‘সতী’ (মন্মথ রায়-রচিত)
একদা সব সুরাসুরের খেয়াল হল দাদা।
সমুদ্রেরে ঘেঁটে ঘুঁটে করতে হবে দধিকাদা॥
দেখেছ তো গয়লানিরা যে-ভাবে দই মথে।
(তেমনি) সাগরকে সব ঘুঁটেছিলেন মন্দার পর্বতে॥
(অর্থাৎ) মন্দার গিরি হয়েছিল দই ঘুঁটবার কাঠি॥
আর কূর্ম হলেন সমুদ্ররূপ দই রাখবার বাটি॥
কাঠি এলো, বাটি এলো, দড়া কোথায় পান।
(সবে) বাসুকীর শ্রী-লেজুড় ধ’রে মারেন হেঁচ্‌কা টান॥
বাসুকী কয় ল্যাজ ছাড়ো বাপ গ্যাজ উঠল মুখে।
বাসুকীকে করল দড়া দেবতারা সব রুখে॥
ল্যাজ ধরল দেবতা, অসুর দানব ধরে মুড়ো।
সাগর বলে আস্তে বাবা একি প্রলয় হুড়ো॥
যা আছে মোর বের করছি-ঘাঁটিস্‌নে আর পেট॥
উচ্চৈঃশ্রবা, চন্দ্র, লক্ষ্মী-সব দিচ্ছি ভেট॥
(ক্রমে) অমৃত যেই উঠল অমনি লাগলো গুঁতোগুঁতি।
দৈত্যেরা সব কোপ্‌নি আঁটে দেবতা কষেন ধুতি॥
মাঝে থেকে শ্রীবিষ্ণু মোহিনী রূপ ধ’রে।
ছোঁ মেরে সেই সুধার ভাণ্ড নিয়ে পড়লেন স’রে॥
অমৃত খান দেবতারা সব, অসুর মাটি চাটে।
(যেমন) দোহন শেষে দুগ্ধ খোঁজে বাছুর শুকনো বাঁটে॥
(ক্রমে) ঘটর ঘটর ঘোঁটার ঠেলায় উঠলো হলাহল।
ত্রাহি ত্রাহি বলে ত্রিলোক, করে কোলাহল॥
বিষের জ্বালায় সৃষ্টি বুঝি পটল তোলে ওই।
সিদ্ধিখোর শ্রীপিশাচপতি কয় ডেকে মাভৈঃ॥
ছুটে এসে পাগ্‌লা ভাঙোড় এক সুমুদ্দুর বিষ।
ঢক ঢকিয়ে ফেললে গিলে গা করে নিস্‌পিস্॥
বলদে যে বেড়ায় চ’ড়ে ছাই পাঁশ গায়ে মাখে।
তাকে ছাড়া চতুর দেবতা বিষ দেবে বল কাকে॥
ফুলের মধ্যে ধুতরো নিলেন মশান যাহার ঘর।
(পোড়া) কপাল তার আগুন জ্বলে-জয় ন্যাংটেশ্বর॥
*১১৬৪. রাগ: ভৈরবী-পিলু, তাল: কাওয়ালি
এলো ফুল-দোল ওরে এলো ফুল দোল আনো রঙ-ঝারি।
অশোকমঞ্জরি অলকে পরি এসো গোপ-নারী॥
ঝরিছে আকাশে রঙের ঝরনা
হায় শ্যামা ধরণী হ’ল আবির-বরণা,
ত্যজি’ গৃহ-কাজ এসো চল-চরণা-ডাকে গিরিধারী॥
পরাগ-আবির হানে বনবালা সুরের পিচকারি হানিছে কুহু,
রঙিন্ স্বপন রাতের ঘুমে অনুরাগ-রং ঝরে মনে মুহু মুহু।
রাঙে গিরি-মল্লিকা রঙিন বর্ণে,
রাতের আঁচল ভরে জোছনার স্বর্ণে
কুলের কালি সখি দেবে ধুয়ে রাঙা পিচ্‌কারি॥
*১১৬৫. গীতিচিত্র: ‘আগমনী’
এলো শিবানী-উমা এলো এলোকেশে।
এলো রে মহামায়া দনুজদলনী বেশে॥
এলো আনন্দিনী গিরি-নন্দিনী
রবে না কেহ আর বন্দী-বন্দিনী,
শক্তি প্রবাহ বহিল মৃতদেশে॥
এলো রে বরাভয়া ভয় হরিতে,
শ্মশান কঙ্কালে বজ্র গড়িতে।
এলো মা অন্নদা, আয় রে ভিখারি
বর চেয়ে নে যার যে অধিকারী
মুক্তি বন্যায় ভারত যাক্ ভেসে॥
*১১৬৬.
এসো আনন্দিতা ত্রিলোক-বন্দিতা কর দীপান্বিতা আঁধার অবনি মা।
ব্যাপিয়া চরাচর শারদ অম্বর ছাড়াও অভয় হাসির লাবনি মা॥
সারাটি বরষ নিখিল ব্যথিত
চাহিয়া আছে মা তব আসা-পথ,
ধরার সন্তানে ধর তব কোলে ভুলাও দুঃখ-শোক চির-করুণাময়ী মা॥
অটুট স্বাস্থ্য দীর্ঘ পরমায়ু
দাও আরো আলো নির্মল বায়ু,
দশ হাতে তব আনো মা কল্যাণ পীড়িত-চিত গাহে অকাল জাগরণী মা॥
*১১৬৭.রাগ: পটদীপ, তাল: ত্রিতাল
এসো কল্যাণী চির-আয়ুষ্মতী।
তব নির্মল করে ভবন-প্রদীপ জ্বালো জ্বালো জ্বালো সতী॥
মঙ্গল-শঙ্খ বাজাও বাজাও সুমঙ্গলা
সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল কর দূর (শুভ) সমুজ্জ্বলা!
এ মাটির কুটিরে দূর আকাশের অরুন্ধতী॥
এসো লক্ষ্মী গৃহের আঁকো অঙ্গনে মঙ্গল আল্‌পনা
তব পুণ্য-পরশ দিয়ে ধূলি-মুটিরে কর গো সোনা,
তুমি দেবতার শুভ বর মূর্তিমতী॥
স্নান-শুদ্ধা তুমি পূজা-দেউলে যবে কর আরতি,
আনত আকাশ যেন তব চরণে করে প্রণতি।
তব কুণ্ঠিত গুণ্ঠন-তলে
চির শান্তির ধ্রুবতারা জ্বলে,
সংসার অরণ্যে ধ্যান-মগ্না তুমি তপতী॥
*১১৬৮. রাগ: গুণকেলী, তাল: ত্রিতাল
এসো মা দশভুজা
দশহাতে কল্যাণ আন দশভুজা
মৃত্যুঞ্জয় ঘরণী! মৃতজনে অমৃত দান।
নিরাশ প্রাণে দেও আশা
মৃকজনে দাও ভাষা
আঁধার মহিষাসুর বুকে আলোর ত্রিশূল হান॥
দেও জয় বরাভয়, শক্তি, তেজ, প্রেম, প্রীতি
দনুজদলনী! শাপ মুক্ত কর ক্ষিতি,
এলে যদি আর বার মাগো
ভক্তের হৃদি মাঝে জাগো
দুঃখ শোক আর দিও না গো
তারিণী সন্তানে ত্রাণ॥
*১১৬৯. রাগ: কাফি মিশ্র, তাল: কাহার্‌বা
এ কোথায় আসিলে হায়, তৃষিত ভিখারি।
হায়, পথ-ভোলা পথিক, হায়, মৃগ মরুচারী॥
মোর ব্যথায় চরণ ফেলে
চির-দেবতা কি এলে,
হায়, শুকায়েছে যবে মোর নয়নে নয়ন-বারি॥
তোমার আসার পথে প্রিয় ছিলাম যবে পরান পাতি’,
সেদিন যদি আসিতে নাথ হইতে ব্যথার ব্যথী।
ধোওয়ায়ে নয়ন-জলে পা মুছাতাম আকুল কেশে
আজ কেন দিন-শেষে এলে নাথ মলিন বেশে!
হায়, বুকে ল’য়ে ব্যথা আসিলে ব্যথা-হারী॥
স্মৃতির যে শুকানো মালা যতনে রেখেছি তুলি’
ছুঁয়ে সে হার ঝরায়ো না ম্লান তার কুসুমগুলি,
হায়, জ্বলুক বুকে চিতা, তা’য় ঢেলো না আর বারি॥
*১১৭০. রাগ: জয়জয়ন্তী, তাল: ত্রিতাল
এ ঘোর শ্রাবণ-দিন কাটে কেমনে,
বলো তুমি বিনে প্রিয়তম মোর,
চমকি’ চমকি’ উঠি বারিধারা পরশে
কোথা তুমি চিত-চকোর!
দাও দেখা, দেখা দাও আজি এ শ্রাবণে-
এসো ভ’রি মোর দু’নয়নে,
বরষা ঘনায়ে ওঠে বিরহী এ পরানে-
পরাতে তোমার গলে আজি নবধারা-জলে
রচেছি মিলন-তিথি ডোর॥
১১৭১. রাগ: পিলু মিশ্র, তাল: কাহার্‌বা
এ জনমে মোদের মিলন হবে না আর, জানি জানি।
মাঝে সাগর, এপার ওপার করি মোরা কানাকানি॥
দুজনে দুকূলে থাকি’
কাঁদি মোরা চখা-চখি,
বিরহের রাত পোহায় না আর বুকে শুকায় বুকের বাণী॥
মোদের পূজা আরতি হায়
চোখের জলে, গহন ব্যথায়,
মোদের বুকে বাজায় বীণা বেদনারি বীণাপাণি॥
হেথায় মিলন-রাতের মালা
ম্লান হয়ে যায় প্রভাত বেলা,
সকালে যাব তরে কাঁদি, বিকালে তায় হেলাফেলা।
মোদের এ প্রেম-ফুল না শুকায়
নিঠুর হাতে কঠোর ছোঁওয়ায়,
ব্যথার মাঝে চির-অমর মোদের মিলন-কুসুমদানি॥
*১১৭২. সঙ্গীতালেখ্য: ‘কাফেলা’
একলা গানের পায়রা উড়াই।
সে কাছে নাই গো সে কাছে নাই॥
চাঁদ ভালো লাগে না, তার চেনা কার যেন ইহুদি মাক্‌ড়ি,
সে কেন কাছে নাই, অভিমানে ঝ’রে যায় গোলাপের পাপ্‌ড়ি।
ফিরোজা আকাশের জাফ্‌রানি জোছনায়
মন ভরে না, কি যেন চাই গো কি যেন চাই॥
*১১৭৩. রাগ: বেহাগ মিশ্র, তাল: দাদ্‌রা
এক্‌লা ভাসাই গানের কমল সুরের স্রোতে।
খেলার ছলে ওপার পানে এপার হ’তে॥
আসবে গো এই গাঙের কূলে হয়ত ভুলে আমার প্রিয়া
খোঁপায় নেবে আমার গানের কমল তুলে আমার প্রিয়া
খুঁজতে আমায় আসবে সুরের নদী-পথে॥
নাম-হারা কোন্ গাঁয়ে থাকে অচেনা সে,
তারে না-ই জানিলাম, গান ভেসে যাক্ তাহার আশে।
নদীর জলে আল্‌তা- রাঙা পা ডুবায়ে, রয় সে মেয়ে
গানের কমল লাগে গো তা’র কমল-পায়ে, উজান বেয়ে,
সেদিন অমর হয় মোর গান, যায় অমরায় পুষ্প-রথে॥
*১১৭৪. নাটক: ‘দেবী দুর্গা’
একাকিনী বিরহিণী জাগি আধো রাতে।
বঁধু নাহি পাশে, নিদ নাহি আসে,
কণ্টক ফোটে হায় ফুল-বিছানায়।
আবার ফুটিবে ফুল উঠিবে চাঁদ,
আমারি মনের হায় মিটিল না সাধ,
যামিনীর ফুল যেন এ রূপ-যৌবন
নিশীথে ফুটিয়া লাজে ঝ’রে যায় প্রাতে॥
*১১৭৫. রাগ: ভৈরবী, তাল: আদ্ধা কাওয়ালি
একেলা ঢুলিয়া ঢুলিয়া কে যায়।
চলিতে চরণ চরণে জড়ায়॥
এখনো ভাঙেনি মল্লিকার ঘুম
এখনো অমলিন-করবী কুসুম,
নয়নে নিশির ঝরেনি শিশির
বিহগ পাখায় বিহগী ঘুমায়॥
অভিসার নিশি বৃথাই জাগি কোথা
অভিমানিনী চলে মূর্তিমতী ব্যথা।
ভীরু চকিত চোখে করুণ কাতরতা
রবি না ওঠে যেন মিনতি জানায়॥
*১১৭৬.
এখনো দোলন-চাঁপার বনে কুহু পাপিয়া।
প্রিয়া তব নাম ল’য়ে ওঠে ডাকিয়া কুহু পাপিয়া॥
আজও তোমার কথা
ভোলেনি বনের লতা,
জড়ায়ে তরুমূলে জড়ায়ে পথে ফুল ওঠে কাঁদিয়া॥
*১১৭৭. নাটক: ‘অর্জুন-বিজয়’
এত দিনে ধরা দিলে বনের পাখি।
কোথায় রাখি, কোন্ প্রিয় নামে ডাকি॥
সদাই জাগে ভয়, দুরু দুরু হিয়া
কখন উড়ে যাবে বনের পাপিয়া
জেগে থাকি তাই সদা ঘুমহারা আঁখি॥
নয়নে রাখিলে, হিয়া কাঁদে অভিমানে
হিয়ায় রাখিলে, বারি ঝরে নয়নে,
তুমি ব’লে দাও প্রিয় কোথায় রাখি॥
*১১৭৮. নাটক: ‘মধুমালা’ (স্বপনপরীর গান)
এতো একা চন্দ্রমণি সে মানিকের ডালা।
এ সারা বনে একটি কুসুম, সে কুসুমের মালা॥
হাসলে কন্যা ফুটে ওঠে পৃথিবীতে ফুল
সে কাঁদ্‌লে পরে ভেঙে পড়ে সাত সাগরের কূল,
ইন্দ্রলোকে দেখেনি কেউ তেমন দেব-বালা॥
*১১৭৯.
এবার যখন উঠ্‌বে সন্ধ্যাতারা- সাঁঝ আকাশে
দেখতে পাবে দু’টি নতুন তারা- তাহার পাশে॥
চেয়ে’ দেখ ভালো ক’রে
কা’র দু’টি চোখ যেন ম’রে,
তারা হয়ে ধরার পানে চাহে তোমার আঁখি দেখার আশে॥
যে দু’টি চোখ নিত্য লোকের মাঝে তোমায় দিত লাজ
পড়বে মনে গো-
সেই দু’টি চোখ চিরতরে এই পৃথিবী হতে হারিয়ে গেছে আজ।
পায়নি গো, তাই অভিমানে
চ’লে গেলে দূর বিমানে,
(দেখো) সেদিন যেন আজের মত চাইতে ওদের পানে
দ্বিধা নাহি আসে॥
*১১৮০.
এমনি মধুর ক্ষণে প্রিয়তম নাহি পাশে।
আকুল পরান মম চম্পা-ফুল-সুবাসে॥
উতলা সমীরে বাজে ব্যাকুল বাঁশি
কাননে উছলি’ পড়ে সুরের রাশি,
আলোকে সুরভি তারি গগন ভরিয়া হাসে॥
বাতায়নে মোর নিশীথের তারা সুধায় নীরবে ডাকি,
‘হায় গো উদাসী এমন নিশায় সজল কেন গো আঁখি।’
সুদূরে রহিল বঁধু একেলা আমি
অসহ বিরহ সহি দিবসযামী,
আশার মালিকা রচি’, বসিয়া তাহারি আশে॥
*১১৮১. নাটক: ‘মধুমালা’ (স্বপনপরীর গান)
এরি লাগি তপস্যা কি করে আঁধার রাতি॥
সই দেখলো চেয়ে রূপ-সায়রে জ্বলে এ কোন্ বাতি
লক্ষ চাঁদের জোছনা হেথা কে রেখেছে পাতি’?
*১১৮২. নাটিকা: ‘ঈদ’ (বিদৌরার গান)
এলো ঈদল-ফেতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ।
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ॥
রোজা রাখার ফল ফ’লেছে দেখ রে ঈদের চাঁদ,
সেহরি খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ,
ওরে বাঁধ আমামা বাঁধ।
প্রেমাশ্রুতে ওজু ক’রে চল্ ঈদগাহ মসজিদ॥
(আজ) ছিটায় মনের গোলাব-পাশে খুশির গোলাব- পানি
(আজ) খোদার ইস্কের খুশবু-ভরা প্রাণের আতরদানি,
ভরল হৃদয়-তশ্‌তরিতে শিরনি তৌহিদ॥
(দেখ) হজরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে
সেই চাঁদেরই রঙ যেন আজ সবার বুকে লাগে,
(এই) দুনিয়াতেই মিটল ঈদে বেহেশ্‌তী উমিদ॥॥
*১১৮৩. তাল: কাহার্‌বা
এলো এলো শবেরাত তোরা জ্বাল্ রে বাতি।
হোক রওশন মুসলিম- জাহানের অন্ধকার রাতি॥
আজ ফিরদৌসের হুর-পরীরা আলোতে রাঙে
চাঁদ সেতারার প্রদীপ ভাসায় আস্‌মানি গাঙে,
ফেরেশ্‌তা সব হয়েছে আজ মোদের সাথি॥
আজ জ্বাল্‌রে বাতি প্রিয়জনের আঁধার গোরে
আজ বরষ পরে লুকিয়ে তারা এসেছে ঘরে,
রাখ্ তাদের তরে অশ্রু-ভেজা হৃদয় পাতি॥
*১১৮৪. তাল: কাহার্‌বা
এলো শোকের সেই মোহর্‌রম কার বালার স্মৃতি ল’য়ে।
কাঁদিছে বিশ্বের মুসলিম সেই ব্যথায় বেতাব হয়ে॥
মনে পড়ে আসগরে আজি পিয়াসা দুধের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদৎ হোসেনের বুকে র’য়ে॥
একহাতে বিবাহের কাঙন একহাতে কাশেমের লাশ,
বেহোঁশ্ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা স’য়ে॥
পাশে শহীদ বীর জব্বার পানির মশক মুখে
হল শহীদ কাঁদে জয়নব কুলসুম আকুল হয়ে॥
শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল্ হজরত হোসেন শহীদ্,
ঝরিতেছে শোকের বারিষ্ আসমান জমিন ছেয়ে॥
*১১৮৫. রাগ: সিন্ধু মিশ্র, তাল: খেম্‌টা
এলো ফুলের মহলে ভ্রমরা গুন্‌গুনিয়ে।
ও-সে কুঁড়ির কানে কানে কি কথা যায় শুনিয়ে॥
জামের ডালে কোকিল কোতুহলে
আড়ি পাতি’ ডাকে কূ কূ ব’লে,
হাওয়ায় ঝরা পাতার নূপুর বাজে রুন্‌ঝুনিয়ে॥
‘ধীরে সখা ধীরে’ কয় লতা দু’লে,
জাগিও না কুঁড়িয়ে কাঁচা ঘুমে তুলে,
গেয়ো না গুন্ গুন্ গুন্ গুন্ গুন্ গুন্ সুরে প্রেমে ঢুলে ঢুলে।’
নিলাজ ভোম্‌রা বলে, ‘না- না- না-না’, ফুল দুলিয়ে॥
*১১৮৬. গীতি আলেখ্য: ‘শারদশ্রী’
এলো শারদশ্রী কাশ-কুসুম-বসনা রসলোক-বাসিনী
ল’য়ে ভাদরের নদী সম রূপের ঢেউ মৃদু মধু-হাসিনী॥
যেন কৃশাঙ্গী তপতী তপস্যা শেষে
সুন্দর বর পেয়ে হাসে প্রেমাবেশে,
আমন ধানের শিষে মন ভোলানো কোন্ কথা কয় সে মঞ্জুল-ভাষিণী॥
শিশির স্নিগ্ধ চাঁদের কিরণ ওকি উত্তরী তার,
অরণ্য কুন্তলে খদ্যোত মণিকা মালতীর হার।
তার আননের আবছায়া শতদলে দোলে
হংসধ্বনিতে মায়া মঞ্জীর বোলে,
সে আনন্দ এনে কেঁদে চলে যায় বিজয়ায় বেদনার বেদমতী সন্ন্যাসিনী॥
*১১৮৭. রাগ: পিলু, তাল: কাহার্‌বা
এলে কি বঁধু ফুল-ভবনে।
মেলিয়া পাখা নীল গগনে॥
একা কিশোরী লাজ বিসরি’
তোমারে স্মরি সঙ্গোপনে,
এসো গোধূলির রাঙা লগনে॥
পাতার আসন শাখায় পাত,
বালিকা আসন শাখায় পাত,
বালিকা কলির মালিকা গাঁথা,
দিনু গন্ধ-লিপি ভোর-পবনে॥
*১১৮৮. রাগ: পুরিয়া-ধানেশ্রী, তাল: কাহার্‌বা
এলো ঐ শারদ রাতি!
শেফালি-সুগন্ধে ভরিয়া পবনে, জ্বালায়ে চাঁদের বাতি॥
বরষার জলধারা ত্যাজিল সে-খরবেগ
ঝরঝর ঝরণে রিক্ত হইল মেঘ,
শ্বেত-হংস খেলে, সারঙ্ সুরে মাতি’॥
আবরণ-হীনা মেঘ ভেসে যায় বাতাসে
কাহার আগমনী প্রকাশে আভাসে,
কদম্ব রেণু মাখি’, এসো প্রিয় সাথি॥
*১১৮৯. নাটক: ‘কাফন-চোর’
এলো মিলন-রাতি
জ্বলে বাসর-বাতি
ওগো পরান-সাথি
এসো পরানে॥
প্রেম-কুসুম গাঁথি
ছিনু আসন পাতি
ছিনু হরষে মাতি
তব বরণ-গানে॥
প্রেম-মদির-আঁখি
আঁখিতে রাখি,
শুধু চাহিয়া থাকি
তব মুখের পানে॥
*১১৯০. রাগ: ভৈরবী, তাল: একতাল
এসো এসো রস-লোক বিহারী এসো মধুকর-দল।
এসো নভোচারী-স্বপন-কুমার এসো ধ্যান-নিরমল॥
এসো হে মরাল কমল-বিলাসী,
বুলবুল্ পিক সুর-লোক-বাসী,
এসো হে স্রষ্টা এসো অ-বিনাশী এসো জ্ঞান-প্রোজ্জ্বল॥
দীওয়ানা প্রেমিক এসো মুসাফির-
ধূলি-ম্লান তবু উন্নত শির,
আমরা-অমৃত-জয়ী এসো বীর আনন্দ বিহ্বল॥
মাতাল মানব করি’ মাতামাতি
দশ হাতে যবে লুটে যশ খ্যাতি,
তোমরা সৃজিলে নব দেশ জাতি অগোচর অচপল॥
খেল চির-ভোলা শত ব্যথা স’য়ে
সংঘাত ওঠে সঙ্গীত হ’য়ে,
শত বেদনার শতদল ল’য়ে লীলা তব অবিরল॥
ভুলি’ অবহেলা অভাব বিষাদ
ধরণীতে আনো স্বর্গের স্বাদ,
লভি’ তোমাদের পুণ্য প্রসাদ পেনু তীর্থের ফল॥
*১১৯১. নাটক: ‘সাবিত্রী’, রাগ: টোড়ি, তাল: কাওয়ালি
এসো এসো তব যাত্রা-পথে
শুভ বিজয়-রথে ডাকে দূর-সাথি।
মোরা তোমার লাগি,’ হেথা রহিব জাগি’
তব সাজায়ে বাসর জ্বালি’ আশার বাতি॥
হের গো বিকীর্ণ শত শুভ চিহ্ন পথ-পাশে নগর-বাটে,
স-বৎসা ধেনু গো-ক্ষুর-রেণু উড়ায়ে চলে দূর মাঠে।
দক্ষিণ-আবর্ত-বহ্নি, পূর্ণ-ঘট-কাঁখে তন্বী,
দোলে পুষ্প-মালা, ঝরে’ শুক্লা রাতি॥
হের পতাকা দোলে দূর তোরণ-তলে, গজ তুরগ চলে।
শুক্লা ধানের হের মঞ্জরী ঐ, এসো কল্যাণী গো,
আনো নব-প্রভাতী॥
১১৯২.
এসো এসো বন ঝরনা উচ্ছল-চল-চরণা।
সর্পিল ভঙ্গে লুটায়ে তরঙ্গে ফেন-শুভ্র-ওড়না॥
পাষাণ জাগায়ে এসো নির্ঝরিণী
এসো প্রাণ-চঞ্চলা জল-হরিণী
মরু-তৃষিতের বুকে ঢালো ধারা জল-শ্যাম মেঘ-বরণা॥
এসো বুনো পথ বেয়ে অকারণ গান গেয়ে,
গভীর অরণ্যের মৌনব্রত ভেঙে ভয়হীন পাহাড়ি মেয়ে।
নৃত্য পরা পায়ে ছন্দ আনো
আনন্দ আনো মৃত প্রাণ জাগানো,
অনাবিল হাসির ঝরাফুল ছড়ায়ে এসো মঞ্জুলা মনোহরণা॥
*১১৯৩. নাটক: ‘অর্জুন বিজয়’ (নাট্যকার: দেন্দ্রেনাথ রাহা)
এসো প্রিয়তম এসো প্রাণে।
এসো সুদূর মোর অভিমানে॥
এসো কম্পিত হৃদয়ের ছন্দে
এসো বিরহের বিধুর আনন্দে,
এসো বেদনার চন্দন-গন্ধে-
মম পূজার বন্দনা-গানে॥