*৫১. রাগঃ যোগিয়া মিশ্র, তালঃ কাহার্বা
দিতে এলে ফুল, হে প্রিয়, কে আজি সমাধিতে মোর?
এতদিনে কি আমারে পড়িল মনে মনো-চোর।।
জীবনে যারে চাহনি তাহারে ঘুমাইতে দাও।
মরণ-পারে ভেঙো না, ভেঙো না তাহার ঘুম-ঘোর।।
দিতে এসে ফুল কেঁদো না প্রিয় মোর সমাধি-পাশে
ঝরিল যে ফুল অনাদরে হায়, নয়ন-জলে বাঁচিবে না সে!
সমাধি-পাষাণ নহে গো তোমার সমান কঠোর।।
কত আশা, সাধ মিশে যায় মাটির সনে
মুকুলে ঝরে কত ফুল কীটেরি দহনে।
কেন অসময়ে আসিলে, ফিরে যাও, মোছ আঁখি-লোর।।
*৫২. তালঃ দাদ্রা
আকাশে ভোরের তারা মুখ পানে চেয়ে আছে
ঝরা-ফুল অঞ্জলি পড়ে আছে, পা’র কাছে।
দেবতা গো, জাগো জাগো জাগো।।
আঁধার-ঘোমটা খুলি শতদল আঁখি তুলি’
পৃথিবী প্রসাদ যাচে দেবতা গো, জাগো।।
কপোত-কন্ঠে শোন তব বন্দনা বাজে
তোমারে হেরিতে ঊষা দাঁড়ায় বধূর সাজে।
দেবতা, তোমার লাগি’ আজি আছি নিশি জাগি’
ভীরু এ মনের কলি হের, দল মেলিয়াছে।
দেবতা গো, জাগো জাগো জাগো।।
*৫৩. তালঃ কাহার্বা
মম মায়াময় স্বপনে কার বাঁশি বাজে গোপনে
বিধুর মধুর স্বরে কে এলো, কে এলো সহসা।।
যেন স্নিগ্ধ আনন্দিত চন্দ্রালোকে ভরিল আকাশ
হাসিল তমসা কে এলো, কে এলো সহসা।।
অচেনা সুরে কেন ডাকে সে মোরে
এমন ক’রে ঘুমের ঘোরে –
নব-নীরদ-ঘন-শ্যামল কে এ চঞ্চল
হেরিয়া তৃষিত-প্রাণ হলো সরসা
কে এলো, কে এলো সহসা।।
কভু সে অন্তরে কভু দিগন্তরে
এই সোনার মৃগ ভুলাতে আসে মোরে,
দেখেছি ধ্যানে যেন এই সে সুন্দরে
শুনেছি ইহারি বেণু প্রাণ-বিবশা
কে এলো, কে এলো সহসা।।
*৫৪.
যায় ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্ ঢেউ তুলে দেহের কূলে
কে চঞ্চলা দিগঞ্চলা মেঘ-ঘন-কুন্তলা।
দেয় দোলা পুর-সমীরণে বনে বনে দেয় দোলা।।
চলে নাগরি দোলে ঘাগরি
কাঁখে বরষা-জলের গাগরি
বাজে নূপুর-সুর-লহরি
রিমি ঝিম্, রিম্ ঝিম্, রিম্ ঝিম্ চল-চপলা।।
দেয়ারই তালে কেয়া কদম নাচে
ময়ূর-ময়ূরী নাচে তমাল-গাছে।
এলায়ে মেঘ-বেণী কাল-ফণি
আসিল কি দেব-কুমারী নন্দন-পথ-ভোলা।।
*৫৫. তালঃ দাদ্রা
আহার দেবেন তিনি রে মন জীব দিয়াছেন যিনি।
তোরে সৃষ্টি ক’রে তোর কাছে যে আছেন তিনি ঋণী।।
সারা জীবন চেষ্টা ক’রে, ভিক্ষা-মুষ্টি আনলি ঘরে
(ও মন) তাঁর কাছে তুই হাত পেতে দেখ্ কি দান দেন তিনি।।
না চাইতে ক্ষেতের ফসল পায় বৃষ্টির জল
তুই যে পেলি পুত্র-কন্যা তোরে কে দিল তা বল।
যাঁর করুণায় এত পেলি, তাঁরেই কেবল ভুলে গেলি
(তোর) ভাবনার ভার দিয়ে তাঁকে ডাক্ রে নিশিদিন-ই।।
*৫৬. তালঃ দ্রুত-দাদ্রা
ওরে কে বলে আরবে নদী নাই
যথা রহ্মতের ঢল বহে অবিরল
দেখি প্রেমে-দরিয়ার পানি, যেদিকে চাই।।
যাঁর ক্বাবার ঘরের পাশে আব্-এ-জম্জম্
যথা আল্লা-নামের বাদল ঝরে হরদম,
যার জোয়ার এসে দুনিয়ার দেশে দেশে
পুণ্যের গুলিস্তান রচিল দেখিতে পাই।।
যার ফোরাতের পানি আজো ধরার ‘পরে
নিখিল নর-নারীর চোখে ঝরে
শুকায় না যে নদী দুনিয়ায়,
যার শক্তির বন্যার তরঙ্গ-বেগে
যত বিষণ্ন-প্রাণ ওরে আনন্দে উঠল জেগে
যাঁর প্রেম-নদীতে, যাঁর পুণ্য-তরীতে
মোরা ত’রে যাই।।
*৫৭. রাগঃ জৌনপুরী, তালঃ দাদ্রা
বৃথা তুই কাহার, পরে করিস অভিমান
পাষাণ-প্রতিমা সে যে হৃদয় পাষাণ।।
রূপসীর নয়নে জল নয়ন-শোভার তরে
ও শুধু মেঘের লীলা নভে যে বাদল ঝরে।
চাতকেরই তরে তাহার কাঁদে না পরান।।
প্রনয়ের স্বপন-মায়া, ধরিতে মিলায় কায়া
গো-ধূলির রঙের খেলা ক্ষণে অবসান।।
*৫৮. তালঃ ত্রিতাল
আমি তব দ্বারে প্রেম-ভিখারি
নয়নের অনুরাগ-দৃষ্টির সাথে চাহি নয়ন-বারি।।
তব পুষ্পিত তনুতে, হৃদয়-কমলে
গোপনে যে প্রেম-মধু উথলে
তোমার কাছে সেই অমৃত যাচে তৃষিত এ পথচারী।।
জনম জনম আমি রূপ ধ’রে আসি গো,
তোমারি বিরহে কাঁদিতে,
রাহুর মত আমি আসি না
বাহু-পাশে বাঁধিতে।
আমি ফুলের মধু চাহি, ছিঁড়ি না ফুল গো,
দূরে রহি, গাহি গান বন-বুলবুল গো,
মনোবনে আছে তব নন্দন-পারিজাত, আমি তা’রি পূজারী।।
*৫৯. তালঃ কাহার্বা
সাহারাতে ফুট্ল রে রঙীন গুলে লালা
সেই ফুলেরি খোশরুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা।।
সে ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি চাঁদ-সুরুজ গ্রহ-তারায়
ঝুঁকে প’ড়ে চুমে সে ফুল নীল গগন নিরালা।।
সেই ফুলেরি রওশনীতে আরশ কুর্সী রওশন্
সেই ফুলেরি রঙ লেগে আজ ত্রিভুবন উজালা।।
চাহে সে ফুল জ্বীন ও ইন্সান্ হুরপরী ফেরেশ্তায়
ফকির দরবেশ বাদশা চাহে করিতে গলার মালা (তারে)।
চেনে রসিক ভ্রমর, বুলবুল সেই ফুলের ঠিকানা
কেউ বলে হযরত মোহাম্মদ কেউ বা কমলিওয়ালা।।
*৬০. তালঃ দ্রুত-দাদ্রা
নিশি-পবন! নিশি-পবন! ফুলের দেশে যাও
ফুলের বনে ঘুমায় কন্যা তাহারে জাগাও – যাও যাও যাও।।
মৌ-টুস্টুস্ মুখখানি তার ঢেউ-খেলানো চুল
(ওরে) ভোমরার ঝাঁক-ঘেরা যেন ভোরের পদ্ম-ফুল
হাসিতে তারে মাঠের সরল বাঁশির আভাস পাও
যাও যাও যাও।।
চাঁপা ফুলের পুতলি-ঘেরা চাঁপা রঙের শাড়ি
তারেই দেখতে আকাশ-গাঙে (ওরে) চাঁদ দেয় রে পাড়ি।
তার একটুখানি চোখের আদল বাদল-মেঘে পাও।
যাও যাও যাও।।
ধীরে ধীরে জাগাইয়ো তায়
ঝরা-কুসুম ফেলিয়া গায়
জাগলে কন্যা যেন রে মোর পত্রখানি দাও –
যাও যাও যাও।।
*৬১. তালঃ কাহার্বা
খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে
ছেড়ে’ মস্জিদ আমার মুশির্দ এলো যে এই পথ ধ’রে।।
দুনিয়াদারির শেষে আমার নামাজ রোজার বদ্লাতে
চাইনে বেহেশ্ত, খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে।।
কায়েস যেমন লাইলী লাগি’ মভিনু মজনু খেতাব
যেমন ফরহাদ শিঁরির প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব।
বে-খুদীতে মশ্গুল্ আমি তেমনি মোর খোদার তরে।।
*৬২. তালঃ তাল–ফেরতা
ওকে ট’লে ট’লে চলে এক্লা গোরী
নব-যৌবনা নীল-বসনা কাঁখে গাগরি।।
মন্দির মন্দ বায় অঞ্চল দোলে
খোঁপা খুলে দোলে আকুল কবরী।
তারে ছল ছল দূরে ডাকে নদী
তারি’ নাম যপে পাপিয়া নিরবধি
ডাকে-বনের কিশোর বাজায়ে বাঁশরি।।
*৬৩. রাগঃ শুধ্ সারং, তালঃ ত্রিতাল
ঝর ঝর বারি ঝরে অম্বর ব্যাপিয়া
এসো এসো মেঘমালা প্রিয়া প্রিয়া।।
দূরে থেকো না এই শ্রাবণ নিশীথে
কাঁদে তব তরে পিয়াসী হিয়া।।
বিজলি খুঁজে ফেরে সুদূর আকাশে
হৃদয় কাঁদে প্রেম পাপিয়া পিয়া।।
*৬৪. তালঃ দাদ্রা
এখনো ওঠেনি চাঁদ এখনো ফোটেনি তারা
এখনো দিনের কাজ হয় নি যে মোর সারা –
হে পথিক যাও ফিরে।।
এখনো বাঁধিনি বেণী, তুলিনি এখনো ফুল
জ্বালি নাই মণিদীপ মম মন-মন্দিরে –
হে পথিক যাও ফিরে।।
পল্লব গুন্ঠনে নিশি-গন্ধার কলি
চাহিতে পারে না লাজে দিবস যায়নি বলি’।
এখনো ওঠেনি ঢেউ থির সরসীর নীরে –
হে পথিক যাও ফিরে।।
যবে ঝিমাইবে চাঁদ ঘুমে তখন তোমার লাগি’
র’ব একা পথ চেয়ে বাতায়ন-পাশে জাগি’
কবরীর মালা খুলে ফেলে দেব ধীরে ধীরে –
হে পথিক যাও ফিরে।।
*৬৫. তালঃ কাহার্বা
বেদিয়া বেদিনী ছুটে আয়, আয়, আয়
ধাতিনা ধাতিনা তিনা ঢোলক মাদল বাজে
বাঁশিতে পরান মাতায়।।
দলে দলে নেচে নেচে আয় চলে
আকাশের শামিয়ানা তলে
বর্শা তীর ধনুক ফেলে আয় আয় রে
হাড়ের নুপূর প’রে আয়।।
বাঘ-ছাল প’রে আয় হৃদয়-বনের শিকারি
ঘাগরা প’রে, প’রে পলার মালা আয় বেদের নারী
মহুয়ার মধু পিয়ে ধুতুরা ফুলের পিয়ালায়।।
*৬৬. তালঃ কাহার্বা
তুমি যদি রাধ হতে শ্যাম,
আমারি মতন দিবস-নিশি জপিতে শ্যাম-নাম।।
কৃষ্ণ-কলঙ্কেরই জ্বালা, মনে হ’ত মালতীর মালা
চাহিয়া কৃষ্ণ-প্রেম জনমে জনমে আসিতে ব্রজধাম।।
কত অকরুণ তব বাঁশরির সুর
তুমি হইলে শ্রীমতি ব্রজ-কুলবতী বুঝিতে নিঠুর।
তুমি যে-কাঁদনে কাঁদায়েছ মোরে
আমি কাঁদাতাম তেমনি ক’রে
বুঝিতে, কেমন লাগে এই গুরু-গঞ্জনা
এ প্রাণ-পোড়ানি অবিরাম।।
*৬৭. চলচ্চিত্রঃ ‘সাপুড়ে’, তালঃ দাদ্রা
আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।
ওই পাহাড়ের ঝর্না আমি, ঘরে নাহি রই গো
উধাও হ’য়ে বই।।
চিতা বাঘ মিতা আমার গোখ্রো খেলার সাথী
সাপের ঝাঁপি বুকে ধ’রে সুখে কাটাই রাতি
ঘূর্ণি হাওয়ায় উড়্নি ধ’রে নাচি তাথৈ থৈ গো ‘আমি’
নাচি তাথৈ থৈ।।
*৬৮. তালঃ তাল-ফের্তা
বাজে মঞ্জুর মঞ্জির রিনিকি ঝিনি
নীর ভরনে চলে রাধা বিনোদিনী
তার চঞ্চল নয়ন টলে টলমল
যেন দু’টি ঝিনুকে ভরা সাগর জল।।
ও সে আঁখি না গো পাখি গো
কার আশে উড়িতে চায় থাকি, থাকি, গো।।
রাই ইতি-উতি চায়
কভু তমাল-বনে কভু কদম-তলায়।
রাই শত ছলে ধীরে পথ চলে কভু কন্টক বেঁধে চরণে
তবু যে কাঁটা-লতায় আঁচল জড়ায় বেণী খুলে যায় অকারণে।
গিয়ে যমুনার তীরে চায় ফিরে ফিরে আনমনে ব’সে গণে ঢেউ
চকিতে কলসি ভরি লয় তার যেই মনে হয় আসে কেউ।
হায় হায় কেউ আসে না
‘ভোলো অভিমান রাধারানী’ বলি’ শ্যাম এসে সম্ভাষে না।
রাই চলিতে পারে না পথ আর,
বিরস বদন অলস চরণ শূণ্য-কলসি লাগে ভার।
বলি, কালা নাহি এলো যমুনা তো ছিল লইয়া শীতল কালো জল।
কেন ডুবিয়া সে-জল উঠিলি আবার কাদায়ে ভাসাতে ধরাতল।।
*৬৯. তালঃ কাহার্বা
গানের শুরুতে নীচের কথাগুলি সাপুড়েদের মন্ত্র-পড়ার ঢংয়ে আবৃত্তি করা হয়েছেঃ
“খা খা খা
তোর বক্ষিলারে খা
তারি দিব্যি ফণাতে তোর যে ঠাকুরের পা’।
বিষহরি শিবের আজ্ঞ্যে দোহাই মনসা,
আমায় যদি কামড়াস খাস জরু-কারুর হাড়
নাচে নাগিনী ফণা তুলে, নাচ রে হেলেদুলে
মারলে ছোবল বিষ-দাঁত তোর অমনি নেব তুলে
বাজ তুবরী বাজ ডমরু বাজ, নাচ রে নাগ-রাজ”।।
সাপুড়িয়া রে –
বাজাও বাজাও সাপ-খেলানোর বাঁশি।
কালিদহে ঘোর উঠিল তরঙ্গ রে
কালনাগিনী নাচে বাহিরে আসি’।।
ফণি-মনসার কাঁটা-কুঞ্জতলে
গোখ্রা কেউটে এলো দলে দলে রে
সুর শুনে ছুটে এলো পাতাল-তলের
বিষধর বিষধরী রাশি রাশি।।
শন্-শন্-শন-শন্ পুব হাওয়াতে
তোমরা বাঁশি বাজে বাদলা-রাতে
মেঘের ডমরু বাজাও গুরু গুরু বাঁশির সাথে।
অঙ্গ জর জর বিষে
বাঁচাও বিষহরি এসে রে
এ কি বাঁশি বাজালো কালা, সবর্নাশী।।
*৭০.
নব কিশলয়-রাঙা শয্যা পাতিয়া
বালিকা-কুঁড়ির মালিকা গাঁথিয়া
আমি একেলা জাগি রজনী
বঁধু এলো না তো কই সজনী,
আমি বিজনে বসিয়া রচিলাম বৃথা
বনফুল দিয়া ব্যজনী।
কৃষ্চূড়ার কলিকা অফুট
আমি তুলি আনি’ বৃথা রচিনু মুকুট,
মোর হৃদয়ের রাজা এলো না,
আমার হৃদি-সিংহাসন শূন্য রহিল
আমি যাহার লাগিয়া বাসর সাজাই
সে ভাবে মিছে এ খেলনা (সখি)।
সে-যে জীবন লইয়া খেলা করে সখি,
আমি মরণের তীরে ব’সে তা’রে ডাকি
হেসে যায় বঁধু আনঘরে
সে-যে জীবন লইয়া খেলা করে (সখি)।
সে-যে পাষাণের মূরতি বৃথা পূজা-আরতি
নিবেদন করি তার পায়ঃ
সাধে কি গো বলে সবে পাষাণ গলেছে কবে?
তবু মন পাষাণেই ধায় (সখি রে)।
আমি এবার মরিয়া পুরুষ হইব, বঁধু হবে কুলবালা
দিয়ে তারে ব্যথা যাব যথাতথা বুঝিবে সেদিন কালা,
বিরহিনী কী যে জ্বালা তখনি বুঝিবে কালা।
দিয়ে তারে ব্যথা যাব যথাতথা বুঝিবে সেদিন কালা।।
*৭১. তালঃ দ্রুত-দাদ্রা
শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা, আয় রে আয়
গিরি-দরি, বনে-মাঠে, প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায়।।
ধানের ক্ষেতে, বনের ফাঁকে, দেখে যা মোর কালো মা-কে
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিনী বীণ বাজায়।।
ভীরু মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় পল্লীগ্রামে এক্লাটি
বিজনমাঠে গ্রাম সে বসায় নিয়ে কাদা, খড়, মাটি
কালো মেঘের ঝারি নিয়ে করুণা-বারি ছিটায়।।
কাজলা-দীঘির পদ্মফুলে যায় দেখা তার পদ্ম-মুখ
খেলে বেড়ায় ডাকাত-মেয়ে বনে লয়ে বাঘ-ভালুক
ঝড়ের সাথে নৃত্যে মাতে বেদের সাথে সাপ নাচায়।।
নদীর স্রোতে পাথর নুড়ির কাঁকন চুড়ি বাজে তার
সাঁঝের বারান্দাতে দাঁড়ায় টীপ প’রে সন্ধ্যা-তারার।
ঊষার গাঙে ঘট ভরিতে যায় সে মেয়ে ভোর বেলায়।
হরিত শস্যে লুটায় আঁচল ঝিল্লিতে নূপুর বাজে
ভাটিয়ালি গায় ভাটির স্রোতে গায় বাউল মাঠের মাঝে (মা)।
গঙ্গা-তীরে শ্মশান-ঘাটে কেঁদে কভু বুক ভাসায়।।
*৭২. তালঃ দাদ্রা
বিকাল বেলার ভুঁইচাঁপা গো সকাল বেলার যুঁই
কারে কোথায় দেব আঁচল তাই ভাবি নিতুই।।
ফুলদানিতে রাখব কারে, কারেই বা দিই কন্ঠ-হারে
কারে দেব দেবতারে কারে বুকে থুই।।
সমান অভিমানী ওরা সমান সুকোমল
চাঁপা আমার চোখের আলো, যুঁই চোখের জল।
বরষা-মুখর শ্রাবণ-রাতি, কাঁদি আমি যুঁথির সাথে
চাঁপায় চাহি চৈতী-রাতে প্রিয় আমার দুই-ই।।
*৭৩. তালঃ কাহার্বা
তৌহিদেরি বান ডেকেছে সাহারা মরুর দেশে
দুনিয়া জাহান ডুবু-ডুবু সেই স্রোতে যায় ভেসে।।
সেই জোয়ারে আমার নবী পারের তরী নিয়ে
‘আয় কে যাবি পারে’ – ডাকে দ্বারে দ্বারে গিয়ে
যে চায় না তারেও নেয় সে নায়ে আপনি ভালবেসে।।
পথ দেখায় সে ঈদের চাঁদের পিদিম নিয়ে হাতে
হেসে, হেসে, দাঁড় টানে চা’র আস্হাব তাঁরি সাথে।
নামাজ-রোজার ফুল-ফসলে শ্যামল হ’ল মরু
প্রেমের রসে উঠ্ল পুরে নীরস মনের তরু
খোদার রহম এলো রে আখেরি নবীর বেশে।।
৭৪.
তালঃ কাহার্বা
সই,
পলাশ-বনে রঙ্ ছড়ালো কে?
সেই রঙে রঙীন মানুষটিরে কাছে ডেকে দে, লো।
সে ফাগুন জাগায় আগুন
লাগায়,
স্বপন ভাঙায় হৃদয় রাঙায়
রে,
তা’রে
ধরতে গেলে পালিয়ে সে যায় রঙ্ ছুঁড়ে চোখে॥
সে ভোরের
বেলায় ভ্রমর হয়ে পদ্মবনে কাঁদে
তার বাঁকা ধনুক যায় দেখা ঐ সাঁঝ-আকাশের চাঁদে।
সেই গভীর রাতে আবির হাতে
রঙ খেলে ফুল-পরীর সাথে লো
তার রঙিন
সিঁথি দেখি প্রজাপতির পালকে॥
৭৫.
তালঃ কাহার্বা
বন-বিহঙ্গ যাও রে উড়ে
মেঘ্না নদীর পারে
দেখা হলে আমার কথা কইয়ো
গিয়া তারে।
কোকিল ডাকে বকুল-ডালে,
যে-মালঞ্চে সাঁঝ-সকালে রে,
আমার বন্ধু কাঁদে সেথায় গাঙেরি কিনারে॥
গিয়া তারে দিয়া আইস আমার
শাপ্লা-মালা
আমার তরে লয়া আইস তাহার
বুকের জ্বালা।
সে যেন রে বিয়া করে,
সোনার কন্যা আনে ঘরে রে,
আমার পাটের জোড় পাঠাইয়া
দিব সে-কন্যারে॥
৭৬.
রাগ: সিন্ধু তাল: তেওড়া
অম্বরে মেঘ-মৃদঙ বাজে জলদ-তালে
লাগিল মাতন ঝড়ের নাচন ডালে ডালে॥
দিগন্তের
ঐ
দুর্গ-মূলে
ধূলি-গৈরিক কেতন দুলে
কে দুরন্ত আগল
খুলে ঘুম ভাঙালে॥
থির সাগরের নীল
তরঙ্গে আনন্দেরি
সেই নাচনের তালে
তালে বাজিল ভেরি।
মাভৈঃ
মাভৈঃ ডাক শুনি যার
পথ ছেড়ে
দে রথ এলো তাঁর।
দুদির্নে সে
বজ্র-শিখার আগুন জ্বালে॥
৭৭.
রাগ সাহানা।
তাল: কাহার্বা
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে
ভাঙবে সভা বসবো একা রেবা নদীর তীরে॥
গীত শেষে গগন তলে, শ্রান্ত-তনু পড়বে ঢলে
ভালো যখন লাগবে না আর সুরের সারঙ্গীরে॥
মোর কণ্ঠের জয়ের মালা তোমার গলায় নিও
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিও প্রিয় হে মো প্রিয়।
ঘুমাই যদি কাছে ডেকো, হাতখানি মোর হাতে রেখো
জেগে যখন খুঁজবো তোমায় আকুল অশ্রু-নীরে
তখন এসো ফিরে॥
৭৮.
তালঃ কাহার্বা
আসিয়া কাছে গেলে
ফিরে
কেন আসিয়া কাছে গেলে ফিরে॥
মুখের হাসি সহসা
কেন
নিভে
গেল আঁখি নীরে
ফুটিতে গিয়ে কোন্
কথার মুকুল
ঝরে গেল
অধরের তীরে॥
ঝড় উঠিয়াছে বাহির
ভুবনে আঁধার নামে বন ঘিরে
যে কথা বলিলে না-ব'লে
যাও বিদায়-সন্ধ্যা তিমিরে॥
৭৯.
তালঃ ত্রিতাল
বসন্ত এলো এলো এলো রে
পঞ্চম
স্বরে কোকিল কুহরে
মুহু মুহু
কুহু কুহু তানে।
মাধবী
নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে
ভ্রমর গুঞ্জে গুন্গুন্ গানে॥
পিয়া পিয়া
ডেকে ওঠে পাপিয়া
মহুল, পলাশ
বন-ব্যাপিয়া
সুরভিত
সমীরণ চঞ্চল উন্মন
আনে নব-যৌবন প্রাণে॥
বেনুকার
বনে বাঁশি বাজে
বনমালী এলো
বন-মাঝে
নাচে
তরু-লতিকা যেন গোপ-গোপিকা
রাঙা হয়ে
রঙের বানে॥
৮০
তালঃ কাহার্বা
বৈকালি
সুরে গাও চৈতালি
গান, বসন্ত হয় অবসান।
নহ্বতে বাজে সকরুণ
মূলতান॥
নীরব আনমনা পিক চেয়ে
আছে দূরে অনিমিখ
ধূলি-ধূসর হলো যে আসে
বৈশাখ অভিযান॥
চম্পা-মালা বিমলিন
লুটায় ফুল-ঝরা বন-বীথিকায়,
ঢেলে দাও সঞ্চিত
প্রাণের মধু-যৌবন দেবতার পায়।
অনন্ত বিরহ-ব্যথায়
ক্ষণিকের মিলন হেথায়
ফিরে নাহি আসে যাহা
যায়-নিমেষের মধুতর গান॥
৮১
তালঃ দাদ্রা
আরো কতদিন বাকি
তোমারে পাওয়ার আগে বুঝি
হায়! নিভে যায় মোর আঁখি॥
কত আঁখি-তারা নিভিয়া গিয়াছে কাঁদিয়া তোমার লাগি'
সেই আঁখিগুলি তারা হয়ে আজো
আকাশে রয়েছে জাগি
যেন নীড়-হারা পাখি॥
যত লোকে আমি তোমারি বিরহে
ফেলেছি অশ্রু-জল
ফুল হয়ে সেই অশ্রু ছুঁইতে
চাহে, চাহে তব পদতল্
সে-সাধ মিটিবে নাকি॥
৮২
তালঃ কাহার্বা
দোলে বন-তমালের ঝুলনাতে কিশোরী-কিশোর
চাঁদে দুঁহু দোঁহার
মুখপানে চন্দ্র ও চকোর,
যেন চন্দ্র ও চকোর
প্রেম-আবেশে বিভোর॥
মেঘ-মৃদঙ বাজে সেই
ঝুলনের ছন্দে
রিম্ ঝিম্ বারিধারা
ঝরে আনন্দে
হেরিতে যুগল শ্রীমুখ
চন্দে
গগনে ঘেরিয়া এলো
ঘন-ঘটা ঘোর॥
নব নীরদ দরশনে
চাতকিনী প্রায়
ব্রজ-গোপিনী
শ্যামরূপে তৃষ্ণা মিটায়
গাহে বন্দনা-গান
দেব-দেবী অলকায়
ঝরে বৃষ্টিতে সৃষ্টির
প্রেমাশ্রু-লোর॥
৮৩
তালঃ দাদ্রা
পাষাণের ভাঙ্গালে
ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়॥
গলিয়া সুরের তুষার গীত-নির্ঝর
ব'য়ে
যায়॥
উদাসী বিবাগী
মন যাচে আজ বাহুর বাঁধন,
কত জনমের
কাঁদন ও-পায়ে লুটাতে চায়॥
ওগো তোমার চরণ-ছন্দে
মোর মুঞ্জরিল গানের মুকুল
তোমার বেণীর বন্ধে
গো মরিতে চায় সুরের বকুল
চম্কে ওঠে মোর
গগন ঐ হরিণ-চোখের চাওয়ায়॥
৮৪
তালঃ কাহার্বা
বসিয়া নদী-কূলে,
এলোচুলে কে উদাসিনী
কে এলে, পথ ভুলে, এ অকূলে
বন-হরিণী॥
কলসে জল ভরিয়া চায়
করুণায় কূল-বধূরা,
কেঁদে যায় ফুলে , ফুলে, পদমূলে
সাঁঝ-তটিনী॥
দলিয়া কত ভাঙ্গা-মন,
ও চরণ, করেছ রাঙা
কাঁদায়ে কত না দিল্, এলে নিখিল
মন-মোহনী॥
হারালি গোধূলি-লগন
কবি, কোন্ নদী কিনারে,
একি সেই স্বপন-চাঁদ,
পেতেছে ফাঁদ প্রিয়ার সতিনী॥
৮৫
তাল: কাহার্বা
আমি পূরব
দেশের পুরনারী (গো)
গাগরি ভরিয়া
এনেছি গো অমৃত-বারি॥
পদ্মাকূলের
আমি পদ্মিনী-বধূ
এনেছি
শাপলা-পদ্মের মধু
ঘন বন ছায়ায়
শ্যামলী মায়ায়
শান্তি আনিয়াছি ভরি'
হেমঝারি॥
আমি শঙ্খ-নগর
হতে আনিয়াছি শাখা, অভয়শঙ্খ,
ঝিল্ ছেনে এনেছি সুনীল কাজল গো—
বিল্ ছেনে
অনাবিল চন্দন-পঙ্ক (এনেছি)।
এনেছি, শত
ব্রত-পাবর্ণ-উৎসব
এনেছি, সারস
হংসের কলরব
এনেছি, নব
আশা-ঊষার সিন্দুর
মেঘ-ডম্বরু
সাথে মেঘ-ডুমুর শাড়ি॥
৮৬
নাটিকা:
মীরাবাঈ।
রাগ: কানাড়া মিশ্র, তাল: যৎ
কও কথা কও কথা,
কথা কও হে দেবতা।
তুমি তো জানো স্বামী আমার
প্রাণে কত ব্যথা॥
মোর তরে আজি
সকল দুয়ার
হইল বন্ধ হে
প্রভু আমার
তুমি খোলো দ্বার! সহে না
যে আর সহে না এ নীরবতা॥
শুনি অসহায়
মোর ক্রন্দন
গলিবে না
পাষাণের নারায়ণ
ভোলো অভিমান চরণে লুটায়
পূজারিণী আশাহতা॥
৮৭
তাল:
কাহার্বা
বন-ফুলে তুমি
মঞ্জরি গো
তোমার নেশায় পথিক-ভ্রমর ব্যাকুল হ'ল
গুঞ্জরি'
গো॥
তুমি মায়ালোকের
নন্দিনী নন্দনের আনন্দিনী
তুমি ধূলির ধরার
বন্দিনী, যাও গহন কাননে সঞ্চরি গো॥
মৃদু
পরশ-কুঞ্চিতা তুমি বালিকা
বল্লভ-ভীতা
পল্লব অবগুণ্ঠিতা মুকুলিকা।
তুমি প্রভাত বেলায় মঞ্জরি লাজে সন্ধ্যায় যাও ঝরি'
অরণ্যা-বল্লরী শোভা, পুণ্য পল্লী-সুন্দরী॥
*৮৮. তালঃ দাদ্রা
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী,
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি (আহা)।।
দুলে আলোছায়া বন-দুকূল
ওড়ে প্রজাপতি কল্কা ফুল
কর্ণে অতসী স্বর্ণ-দুল্
আলোক-লতার সাত-নরী।।
সোনার গোধূলি নামিয়া আয়
আমার রূপালি ফুল-শোভায়
আমার সজল আঁখি-পাতায়
আয় রামধনু রঙ ধরি’।
কবি, তোর ফুলমালী কেমন
ফাগুনে শুষ্ক পুষ্প-বন
বরিবি বঁধুরে এলে চমন
রিক্ত হাতে কি ফুল ভরি’।।
*৮৯. তালঃ কাহার্বা
পুরুষঃ এলে তুমি কে, কে ওগো
তরুণা অরুণা করুণা সজল চোখে।
স্ত্রীঃ আমি তব মনের বনের পথে
ঝিরি ঝিরি গিরি-নির্ঝরিণী
আমি যৌবন-উন্মানা হরিণী মানসলোকে।।
পুরুষঃ ভেসে যাওয়া মেঘের সজল ছায়া
ক্ষণিক মায়া তুমি প্রিয়া
স্বপনে আসি’ বাজায়ে বাঁশি স্বপনে যাও মিশাইয়া।
স্ত্রীঃ বাহুর বাঁধনে দিই না ধরা –
আমি স্বপন-স্বয়ম্বরা
সঙ্গীতে জাগাই ইঙ্গিতে ফোটাই
তোমার প্রেমের যুঁই-কোরকে।
পুরুষঃ আধেক প্রকাশ আধেক গোপন
আধো জাগরণ আধেক স্বপন
খেলিব খেলা ছায়া-আলোকে।।
*৯০. তালঃ কাহার্বা
ম্লান আলোকে ফুট্লি কেন গোলক-চাঁপার ফুল।
ভূষণহীনা বনদেবী কার হ’বি তুই দুল।।
হার হ’বি কার কবরীতে
সন্ধ্যারানী দূর নিভৃতে,
ব’সে আছে অভিমানে ছড়িয়ে এলোচুল।।
মাটির ধরার ফুলদানিতে তোর হবে কি ঠাঁই,
আদর কে আর করবে তোরে, বসন্ত যে নাই (হায়)।
গোলক-চাঁপা খুঁজিস কারে –
কোন্ গোলকের দেবতারে ?
সে দেবতা নাই রে হেথা শূন্য যে আজি গোকুল।।
*৯১. তালঃ কাহার্বা
ছন্দের বন্যা হরিণী অরণ্যা
চলে গিরি-কন্যা চঞ্চল ঝর্না
নন্দন-পথ-ভোলা চন্দন-বর্ণা।।
গাহে গান ছায়ানটে, পরবতে শিলাতটে
লুটায়ে পড়ে তীরে শ্যামল ওড়না।।
ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় ধীরি ধীরি বাজে
তরঙ্গ-নুপূর বন-পথ মাঝে।
এঁকেবেঁকে নেচে যায় সর্পিল ভঙ্গে
কুরঙ্গ সঙ্গে অপরূপ রঙ্গে
গুরুগুরু বাজে তাল মেঘ-মৃদঙ্গে
তরলিত জোছ্না-বালিকা অপর্ণা।।
*৯২. তালঃ কাহার্বা
কেন ফোটে কেন কুসুম ঝ’রে যায়!
মুখের হাসি চোখের জলে ম’রে যায়, হায়।।
নিশীথে কে কাঁদিল প্রিয় ব’লে
হায় নিশি-ভোরে সে কেন হায় স’রে যায়।।
হায় আজ যাহার প্রেম করে গো রাজাধিরাজ
কাল্ কেন সে চির কাঙাল ক’রে যায়
মান-অভিমান খেলার ছলে
ফেরে না আর যে যায় চ’লে
মিলন-মালা মলিন ধূলায় ভ’রে যায়।।
*৯৩. তালঃ ত্রিতাল
জাগো মালবিকা ! জাগো মালবিকা !
ডাকে তোমায় গগন-সীমায় মেঘ-বালিকা।।
বরষার মিনতি মানো, মেঘপানে ভুরু হানো,
বন-ডালি ভরি’ আনো নীপ-যুথিকা।।
তব অবগুন্ঠন খোলো, তমাল ঝুলনায় দোলো,
তরঙ্গ-লহরি তোলো সাগরিকা।।
*৯৪. তালঃ কাহার্বা
তুমি যখন এসেছিলে তখন আমার ঘুম ভাঙেনি
মালা যখন চেয়েছিলে বনে তখন ফুল জাগেনি।।
আমারি আকাশ আঁধার কালো
তোমার তখন রাত পোহালো
তুমি এলে তরুণ-আলো তখন আমার মন রাঙেনি।।
ওগো রুদ্ধ ছিল মোর বাতায়ন-পূর্ণ শশী এলে যবে,
আঁধার-ঘরে একেলা জাগি হে চাঁদ আমার আসবে কবে।
আজকে আমার ঘুম টুটেছে
বনে আমার ফুল ফুটেছে
ফেলে যাওয়া তোমারি মালায় বেঁধেছি মোর বিনোদ-বেণী।।
*৯৫. তালঃ কাহার্বা
কাছে আমার নাইবা এলে হে বিরহী দূর ভালো।
নাই কহিলে কথা তুমি ব’লো গানে সুর ভালো।।
নাই দাঁড়ালে কাছে আসি’
দূরে থেকেই বাজিয়ো বাঁশি।
চরণ তোমার নাই বা পেলাম চরণের নুপূর ভালো।।
ওগো পথে পাওয়ার চেয়ে আমায় চাওয়ায় যেন পথ-বঁধু
দুই কূলেতে রইব দুজন বইবে মাঝে স্রোত-বঁধু।
পরশ তোমার চাই না প্রিয়
তোমার হাতের আঘাত দিও
মিলন তোমার সইতে নারি বেদনা-বিধুর ভালো।।
*৯৬. তালঃ কাহার্বা
ওগো প্রিয়, তব গান! আকাশ-গাঙের জোয়ারে
উজান বহিয়া যায়
মোর কথাগুলি কাঁদিছে বুকের দুয়ারে
পথ খুঁজে নাহি পায়।।
ওগো দখিনা বাতাস, ফুলের সুরভি বহ
ওর সাথে মোর না-বলা বাণী লহ
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ
বন্দিনী গিরি ঝরনা পাষাণ-তলে
যে কথা কহিতে চায়।।
ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না-বলা কথাগুলি ধুয়ে মোর বুক হ’তে।
ওরে’ ‘চোখ গেল’ ‘বউ কথা কও’ পাখি
তোদের কন্ঠে মোর সুর, যাই রাখি’ কি?
(ওরে) মাঠে মুরলী কহিও তাহারে ডাকি,
আমার গানের কলি না-ফোটা বুলি ঝ’রে গেল নিরাশায়।।
*৯৭. তালঃ কাহার্বা
এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আন্লে বল কে।
টলমল জল-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পলকে।।
দিল কি পুব হাওয়াতে দোল, বুকে কি বিঁধির কেয়া?
কাঁদিয়া কুটিলে গগন এলায়ে ঝামর-অলকে।।
চলিতে পৈঁচি কি হাতের বাঁধিল বৈচি-কাঁটাতে?
ছাড়াতে কাঁচুলির কাঁটা বিঁধিল হিয়ার ফলকে।।
মুকুলী-মন সেধে সেধে কেবলি ফিরিনু কেঁদে,
সরসীর ঢেউ পলায় ছুটি’ না ছুঁতেই নলিন-নোলকে।।
বুকে তোর সাত সাগরের জল, পিপাসা মিট্ল না কবি
ফটিক জল! জল খুঁজিস্ যেথায় কেবলি তড়িৎ ঝলকে।।
*৯৮. তালঃ কাহার্বা
আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী।
খুলে দাও রং মহলার তিমির-দুয়ার ডাকিলে যদি।।
গোপনে চৈতি হাওয়ায় গুল্-বাগিচায় পাঠালে লিপি,
দেখে তাই ডাক্ছে ডালে কু কু ব’লে কোয়েলা ননদী।।
পাঠালে ঘূর্ণি-দূতী ঝড়-কপোতী বৈশাখে সখি
বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল-ভরা নদী
তোমারি অশ্রু ঝরে শিউলি তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।।
পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী,
দুঁহু হায় চাই বিষাদে, মধ্যে কাঁদে তৃষা-জলধি।।
ভিড়ে যা ভোর-বাতাসে ফুল-সুবাসে রে ভোমর কবি
ঊষসীর শিশ্-মহলে আস্তে যদি চাস্ নিরবধি।।
*৯৯. তালঃ দ্রুত-দাদ্রা
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নুতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
আস্ল এবার অনাগত প্রলয়-নেশায় নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্ল আগল!
মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে, মহাকালের চণ্ড-রূপে ধূম্র-ধূপে
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!
ওরে ঐ আসছে ভয়ংকর!
তোরা সব জয়ধ্বানি কর!!
দ্বাদশ রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়,
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়!
বিন্দু তাহার নয়ন-জলে
সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে
কপোল-তলে!
বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর ’পর –
হাঁকে ঐ “জয় প্রলয়ংকর”!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
মাভৈঃ, ওরে মাভৈঃ, মাভৈঃ, মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায়-মরা মুমূর্ষদের প্রাণ-লুকানো ঐ বিনাশে।
এবার মহা-নিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে
করুণ্ বেশে!
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু-চাঁদের কর!
আলো তার ভরবে এবার ঘর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
*১০০.
মোরা ঝঞ্চার মত উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল।
মোরা বিধাতার মত নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মত সচ্ছল।।
আকাশের মত বাধাহীন,
মোরা মরু-সঞ্চর বেদুঈন,
(মোরা) বন্ধনহীন জন্ম-স্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল।।
মোরা সিন্ধু-জোয়ার কল-কল
মোরা পাগলা-ঝোরার ঝরা জল
কল-কল-কল্ ছল-ছল-ছল্ কল-কল-কল্ ছল-ছল-ছল্
মোরা দিল্-খোলা খোলা প্রান্তর,
মোরা শক্তি-অটল মহীদর
হাসি-গান সম উচ্ছল
মোরা বৃষ্টির জল বনফল খাই, শয্যা শ্যামল বন-তল।।