[
হাফেজ শিরাজি 'র একটি গজলের অনুবাদ করেছিলেন নজরুল। গজলের শিরোনাম ছিল 'আশায়'। কবিতাটি নজরুল সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পত্রিকাটির সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী কবিতাটি প্রকাশ করার অনুমোদন দেন নি। এই সময় এই পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। চারুচন্দ্র কবিতাটি প্রবাসীতে প্রকাশ করেন। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী পত্রিকার পৌষ ১৩২৬ সংখ্যার (ডিসেম্বর ১৯১৯-জানুয়ারি ১৯২০) ২৩৯ পৃষ্ঠায়। শিরোনাম ছিল 'আশায়' (হাফেজ)। কবিতাটির পাদটীকায় কবির নাম ছিল- '(হাবিলদার) কাজী নজরুল ইসলাম'। কবিতাটি পরে '' নির্ঝর' কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি প্রকাশের পর, নজরুল একটি পত্রে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখেছিলেন-'প্রবাসী'তে বেরিয়েছে ' সবুজপত্র '-এ পাঠানো কবিতা, এতে কবিতার মর্যাদা বেড়েছে কী কমেছে, তা আমি ভাবতে পারছি না। ' সবুজপত্র'-এর নিজস্ব আভিজাত্য থাকলেও ' প্রবাসী'র মর্যাদা একটুকও কম নয়। প্রচার আরও বেশি। তা ছাড়া আমি কবিতা লিখেছি, পারসিক কবি হাফেজের মধ্যে বাংলার সবুজ দূর্বা ও জুঁই ফুলের সুবাস আর প্রিয়ার চূর্ণ কুন্তলের যে মৃদু গন্ধের সন্ধান আমি পেয়েছি, সে-সবই তো খাঁটি বাংলার কথা, বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আনন্দরসের পরিপূর্ণ সমারোহ। কত শত বছর আগের পারস্যের কবি, আর কোথায় আজকের সদ্য শিশির-ভেজা সবুজ বাংলা। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের রুক্ষ পরিবেশে মৃত্যু সমারোহের মধ্যে বসে এই যে চিরন্তন প্রেমিক-মনের সমভাব আমি চাক্ষুস করলাম আমার ভাষায়, আমার আপন জন বাঙালিকে সেই কথা জানাবার আকুল আগ্রহই এই এক টুকরো কবিতা হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। জানি না জুঁই ফুলের মৃদু গন্ধ ও দূর্বা শ্যামলতা এর মধ্যে ফুটেছে কি-না। তবু বাঙালির সচেতন মনে মানুষের ভাব জীবনের এই একাত্মবোধ যদি জাগাতে পারে তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। অবশ্য বাঙালির কাছে পৌঁছে দেওয়ার ও যোগ্য বাহনে পরিবেশন করবার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার। ...'
বাহনে পরিবেশন করবার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার। ...'
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে এই চিঠির একটি জবাব দিয়েছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের 'চলমান-জীবন' গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে ছাপা হয়েছে। চিঠিটি হলো-
'....চুরুলিয়ার লেটুর দলের গান লিখিয়ে ছোকরা নজরুলকে কে-ই বা এক কানাকড়ি দাম দিয়েছে! স্কুল-পালানো ম্যাট্রিক পাশ-না-করা পল্টন-ফেরত বাঙালি ছেলে কী নিয়েই-বা সমাজে প্রতিষ্ঠার আশা করবে! আমার একমাত্র ভরসা মানুষের হৃদয়। হয়তো তা আগাছা বা ঘাসের মতো অঢেল খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলা দেশে তা যে দুর্লভ নয়, তার প্রমাণ আমি এই সুদূরে থেকেও পাচ্ছি। নিঃসঙ্কোচে ও নির্বিকারে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু মন দেওয়া যে স্থান-কাল দূরত্বের ব্যবধান মানে না, তাও উপলব্ধি করছি। ...'