আমার প্রিয় ময়মনসিংহের প্রজা ও শ্রমিক ভ্রাতৃবৃন্দ!
আপনারা আমার আস্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা
ছিল, আপনাদের এই নব-জাগরিত প্রাণের স্পর্শে নিজেকে পবিত্র করিয়া লইব, ধন্য
হইব। কিন্তু দৈব প্রতিকূল হওয়ায় আমার সে আশা পূর্ণ হইল না। আমার শরীর আজো
রীতিমতো দুর্বল, এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইবার মতো শক্তি আমার একেবারেই
নাই। আশা করি আমার এই অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতা সকলে ক্ষমা করিবেন।
এই ময়মনসিংহ আমার কাছে নূতন নহে। এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি
অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহার বুকে কাটিয়া গিয়াছে।
এইখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি। আজো আমার মনে সেই
সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল, ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে। এই আশা করিয়াছিলাম, আমার
সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার হৃদয় ময়মনসিংহ
জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহ-প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব;
কিন্তু তাহা হইল না, দুরদৃষ্ট আমার। যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহ দিন দেন, আমার স্বাস্থ্য
ফিরিয়া পাই, তাহা হইলে আপনাদের গফরগাঁওয়ের নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনীতে
যোগদান করিয়া ও আপনাদের দর্শন লাভ করিয়া ধন্য হইব।
আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দেশের ভবিষ্যত ! মাটির মায়ায় আপনাদের
হৃদয় কানায় কানায় ভরপুর। মাটির খাঁটি ছেলে আপনারাই! রৌদ্রে পড়িয়া বৃষ্টিজলে
ভিজিয়া দিন নাই- রাত নাই- সৃষ্টির প্রথম দিন হইতে আপনারাই তো এই মাটির
পৃথিবীকে প্রিয় সন্তানের মতো 'লালন-পালন করিয়াছেন, করিতেছেন ও করিবেন।
আপনাদের মাঠের এক কোদাল মাটি লইলে আপনারা আততায়ীর হয় শির নেন, কিংবা
তাকে শির দেন- এত ভালোবাসায় ভেজা যাদের মাটি, এত বুকের খুনে উর্বর যে
শস্যশ্যামল মাঠ- আপনারা আমার কৃষাণ ভাইরা ছাড়া অন্য অধিকারী কেহ নাই।
আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, তাদের বুকের
স্নেহধারার মতোই মাঠ-ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়, আমার এই কৃষাণ
ভাইদের আদর সোহাগে মাঠ-ঘাট ফুলে ফলে ফসলে শ্যাম-সবুজ হইয়া ওঠে, আমার
কৃষাণ ভাইদের বধূদের প্রার্থনায় কাঁচা ধান সোনার রঙে রাডিয়ে ওঠে-
এই মাঠকে
জিজ্ঞাসা করো, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে, এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার,
এর ফুল-ফল কৃষক-বধূর।
আর আমার শ্রমিক ভাইরা, যাহারা
আপনাদের বিন্দু বিন্দু রক্ত দান করিয়া হুজুরদের
অট্টালিকা লালে লাল করিয়া তুলিতেছে, যাহাদের অস্থির মজ্জা ছাঁচে ঢালিয়া রৌপ্য
মুদ্রা তৈরি হইতেছে, যাহাদের চোখের জল সাগরে পড়িয়া মুক্তা মাণিক ফলাইতেছে”-
তাহারা অবহেলিত, নিস্পেষিত, বুতূক্ষু। তাহাদের শিক্ষা নাই, দীক্ষা নাই, ক্ষুধায় পেট
পুরিয়া আহার পায় না; পরনে বস্ত্র নাই।
হায় রে স্বার্থ! হায় রে লোভী দানব-প্রকৃতির মানব ! আজ কৃষাণের দুঃখে শ্রমিকের
কাৎরানিতে আল্লার আরশ কীপিয়া উঠিয়াছে। দিন আসিয়াছে, বহু যন্ত্রণা পাইয়াছ
ভাই- এইবার তাহার প্রতিকারের ফেরেশতা, দেবতা আসিতেছেন। তোমাদের লাঙল,
তোমাদের শাবল তাঁহার অস্ত্র, তোমাদের কুটির তাহার গৃহ। তোমাদের ছিন্ন মলিন বস্ত্র
তাঁহার পতাকা। তোমরাই তাঁহার পিতামাতা। আমি আপনাদের মাঝে সেই অনাগত
মহাপুরুষের শুভ আগমন প্রতীক্ষা করিয়া আপনাদের নব-জাগরণকে সালাম করিয়া
নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছি, এঁ বুঝি নব দিনমণির উদয় হইল! ইতি
-নজরুল ইসলাম