শচীন কর-কে
কৃষ্ণনগর
৩. ১. ২৭
স্নেহভাজনেষু –
স্নেহের হাবুল! তুই এবার এলিনে, আসলে বড়ো খুশি হতুম। তোকে দেখবার ইচ্ছা ছিল, দেখিনি অনেকদিন তোদের; কিন্তু তোর চেয়েও তোর মাঝে যে কবি-শিশুটি দিনের পর দিন বড়ো হয়ে উঠেছে তাকে দেখবার বেশি ইচ্ছা ছিল। একদিন তাকে দেখবই, তখন হয়তো সে রীতিমতো ঘোড়দৌড় করছে দেখব। কিন্তু মানুষের ঘোড়দৌড় দেখার চেয়ে শিশুর হাঁটি-হাঁটি পা-পা দেখতে অধিক ভালো লাগে। প্রাণতোষকে দেখলাম, তার মনের কবি বোধ হয় তোর অগ্রজ। তার কবিশিশু এখন বেশ চলতে শিখেছে, আগে পা পিছলাত, এখন পা শক্ত হয়েছে। চলার মিল ছিল না আগে, এখন দুইটা চরণই বেশ মিলেমিশে চলছে। – ওর দুঃখের দিন ঘনিয়ে এল বলে। অর্থাৎ ও কবি বলে পরিচিত হল বলে। কবি হওয়ার মতো দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে আর নেই বলেই এ কথা বললুম। এদেশে কবির কবিতার সব শব্দগুলো পাটকেল হয়ে ফিরে আসে, আর তা আঘাত করে তার বুকে। অবশ্য সব কবিই যে ‘ইট’ লেখে এবং তা পাটকেল হয়ে ফিরে আসে তা নয়। যারা ফুল ফোটায় তাদের মাথাই সবচেয়ে অ-নিরাপদ।...
তোদের একটি ‘মুশায়েরা’র বৈঠকে বসে তোর অল্পপরিসর কামরাটিতে – শুনলাম। বড়ো খুশি হয়েছি শুনে। তোদের আরম্ভ এমনি করেই হোক। বিপুল জগৎকে জানবার আকাঙ্ক্ষা শিশুর দুরন্ত চলায় গোপন থাকে। পা যখন হবে শক্ত তখন সে আপনি টেনে নিয়ে যাবে শিশুটি বিরাট বিস্ময়ের অন্তরে। তোদের কাপের চায়ের রসটুকু প্রাণের চুঁয়ানো রসে মদির হয়ে ওঠে যে, এ কি কম সৌভাগ্যের কথা? আরম্ভের এই আনন্দ মাঝখানে গিয়ে তিক্ত হয়ে ওঠে, ঈর্ষায় বিস্বাদ হয়ে ওঠে – এ আমরা অনুভব করছি – যারা মাঝখানে এসে পৌঁছেছি। আমাদের আরম্ভের আনন্দ যদি বিশ্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয় তাহলে তার পরিণতি ট্র্যাজেডিতে।আনন্দলোকে দ্বন্দ্ব নেই, প্রতিদ্বন্দিতা নেই। এ যারা ভোলে, তারা চালের গুদাম খুলুক গিয়ে – ফুলের বেসাতি না করে। তোদের চলা আজও শুরু হয় নাই, আজও তোদের ফোটার আনন্দ কুঁড়ির প্রাকারে গুমরে মরছে – তাই এই সাবধান করে দেওয়া। উপদেশের বেত উঁচাইনি আমি।
তোর খাটুনি দুনো। তোকে খুব আত্মরক্ষা করে চলতে হবে। এটা আমি খুব বুঝি যে কবিতা গান লেখা যায় হয়তো দিনে একশোটা, কিন্তু হিসাব লেখা যায় না ক-পাতা। ফুল কুড়ানো যায় ঝুড়ি ঝুড়ি, কিন্তু বেগুন বোধ হয় এক ঝুড়ির বেশি তোলা যায় না। অবশ্য আমার এ মত তাঁদের জন্য নয়, যাঁরা কেয়াফুলের চেয়ে ভুট্টাকে বেশি দামি মনে করেন।... কবিতা লেখার একটা সোয়াস্তি আছে, কেননা তা লেখা যায় কাছা খুলে, কিন্তু হিসাব লিখতে হয় কাছাকোছা এঁটে, যেন একটা পাইও এধার-ওধার না হয়।
এই হিসেবের আর বে-হিসেবের দুটো বিপরীত মুখকে যে তুই কী করে মিল খাইয়েছিস, তা ভেবে আমি অবাক হই। তার উপর তুই পড়ছিস। তুই পড়ছিস, লিখছিস, হিসাব লিখছিস। এই তিন শঙ্কায় পড়ে ত্রিশঙ্কু হয়ে পড়িসনে যেন, এই আশীর্বাদ করি। তোর হিসেবের ফিরিস্তি গরমিল হোক বা চুলোয় যাক – আমার তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু কাব্যের ফেরেশ্তা বেঁচে থাকুক – এ প্রার্থনা আমি চিরকাল করব। অবশ্য ফেরেশ্তা কখনও পটল তোলেনি, তুলেছে মুদি বা বেনে। ফেরেশ্তা অমর কিন্তু অনেক পটলাবেনেকে পটল তুলতে আমি স্বচক্ষে দেখেছি।
পড়া ছাড়িসনে তুই, তা হলে তোকে লেখায় ছাড়বে। অবশ্য পণ্ডিত হতে আমি বলছিনে, কিন্তু আমার আনন্দকে প্রকাশের পুঁজি তো আমার থাকা চাই। পণ্ডিত জমায়, সে কৃপণ; কবি বিলোয়, সে দাতা। কবি নেয়, কিন্তু সে দান করে, – নদীর মতো সে চলে গাইতে গাইতে, দান করে করে, দু-পাশে ফুল ফুটিয়ে। পণ্ডিত নেয়, মাড়োয়ারির ভুঁড়ির মতো ওর পরিধি শুধু বেড়েই চলে নিয়ে নিয়ে, ও আর দিতে চায় না তাই ওর মরণং ধ্রুবঃ। মাড়োয়ারির নিলে সে নালিশ করে, নদীর নিলে সে খুশি হয়। জরদ্গবের মতো তোর পেটটা গজগজ করুক বিদ্যেয়, এ আমি বলছিনে; তাই বলে জানতে শুনতে যতটুকু জানা শোনার দরকার – তা থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখবি কেন? কত ফুল কত পাখি কত গান কত গান কত রং – এ আমি উপভোগ করব না?
চিঠি বড়ো হয়ে যাচ্ছে – অর্থাৎ এটা হয়ে উঠছে প্রবন্ধ – যাকে কবি ভয় করে। ক্লাসে ওর দরকার আছে, কিন্তু মুশায়েরায় ওর প্রবেশ নিষেধ। ফুলের ভাষা, কুঁড়ির ব্যথা, পাতার কথা, লতার আবেগ, তরুর বাণী আমরা শুনতে পাই বুঝতে পারি বলে আচার্য জগদীশের ল্যাবরেটরি দেখতে যাইনে। তরুলতাকে মেরে ছুঁচ ফুটিয়ে তার হাসিকান্না দেখার প্রবৃত্তি আমার নেই।
ক-দিন বেশ কাটল। প্রাণতোষটা আজ চলে যাচ্ছে। আবার প্রবেশ করব কাব্যলক্ষ্মীর হারেমখানায়।
আমি শিগগির কলকাতা যাব, তখন দেখা হবে। তোদের মুশায়েরার সব রসপিপাসু হৃদয় ক-টিকে অভিনন্দন করছি আমি। তোরা সকলে আমার আন্তরিক স্নেহাশিস ও স্নেহ-ইচ্ছা নে। তোরা সুন্দর হয়ে ওঠ। ইতি –
নিত্য –
শুভার্থী
কাজীদা