আবুল হোসেন-কে
কৃষ্ণনগর
১০.২.২৭
প্রিয় আবুল হুসেন সাহেব!
আপনার সাদর আমন্ত্রণলিপি নব-ফাল্গুনের দখিন হাওয়ার মতোই খুশ-খবরি নিয়ে এসেছে। আমার শরীর জ্বরের উপর্যুপরি আক্রমণে জর্জরিত হয়ে উঠেছে। তাই মন আমার এ আনন্দবার্তা পেয়ে যত হালকাই হয়ে উঠুক, শরীর হয়তো তেমন হালকা হয়ে উঠতে পারছে না। আর শরীর যদি এমনি ভারী হয়ে থাকে আর কিছুদিন, তা হলে এর ভার কোনো রেলগাড়িতেই বইতে সমর্থ হবে না। আমার বর্তমান অভিভাবক জ্বর, তারই আদেশের প্রতীক্ষা করছি।
বসন্তের হাওয়া জরা ও জ্বর সইতে পারে না। তাই আশায় বসে আছি, কখন আসবে দখিন হাওয়া – আসবে আমার রোগশয্যায় ফুলের আমন্ত্রণলিপি।
আপনাদের আনন্দ-মহফিলে আমার বাঁশি যদি নাই বাজে, তা হলেও আপনাদের খুশির ‘জাম’ অপূর্ণ থাকবে না। ঢাকার অতগুলি কবি-কিশোরের কচি-কণ্ঠের সুরে সুরে আপনাদের সুরলোক মস্ত হয়ে উঠবে। এ আমি অত্যুক্তি করচিনে।... আপনাদের উৎসব-দিনের ‘মুতরির’ হবার গৌরব আমায় দিতে চান; কিন্তু যে গান আমি গাঁথব, তার সুর যে আপনাদের মনের বেণুকুঞ্জে। কোন আনন্দ-মানিক আপনাদের উৎসবের অন্তরের কথা – যাকে কেন্দ্র করে সুরলক্ষ্মীর নৃত্য চলবে – শিগগির জানাবেন।
আর আমার বাণী? তার প্রকাশ কি শোভন হবে আপনাদের নওরোজের মজলিশে? আমার সরস্বতী অশ্রুমতী, – বেদনা-শতদলে তাঁর চরণ। যুগযুগান্তরের অশ্রুর অঞ্জলি এসে পড়ছে তাঁর পায়ে। এ ক্রন্দসীর গান শুধু একটানা ক্রন্দন। আনন্দ উৎসবের নৌরাতির দীপশিখা নিভে যায় এর হতাশ্বাসে। তবু হয়তো সে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো সুন্দরের নেশায় আনন্দ-গান গেয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। চোখের জলে ধোয়া সে সুর। বেদনায় রাঙা সে হাসি। আমার বাণী শিল্পীর বাণী নয়, আমার বাণী বেদনাতুরের কান্না। আমার সুরলক্ষ্মী স্বর্গের উর্বশী নয়, মর্ত্যের শকুন্তলা – বিরহশীর্ণা অশ্রুমুখী পরিত্যক্তা শকুন্তলা, উৎপীড়িতা লায়লি!
আপনি আমার লেখা পড়ে মনে করছেন, হয়তো আবার আমার জ্বর এসেছে। নইলে এত বকছি কেন?
আপনারা যদি নেহাত না ছাড়েন, যেতেই হবে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, তাতে আপনাদের উৎসবরজনি বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না। আপনার পত্র পেলে সেইরূপ ব্যবস্থা করব।
আমার আন্তরিক প্রীতি ভালোবাসা নেবেন সকলে।
আপনাদের সুন্দর পূজার আয়োজন সার্থক হোক, সুন্দর হোক, পূর্ণ হোক!
ইতি –
প্রীতি-সিক্ত
–
নজরুল ইসলাম