শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান সাহেব!

আমাদের আশি বছরে নাকি স্রষ্টা ব্রহ্মার একদিন। আমি অত বড়ো স্রষ্টা না হলেও স্রষ্টা তো বটে, তা আমার সে-সৃষ্টির পরিসর যত ক্ষুদ্র পরিধিই হোক, কাজেই আমারও একটা দিন অন্তত তিনটে বছরের কম যে নয়, তা অন্য কেউ বিশ্বাস করুক চাই না করুক, আপনি নিশ্চয়ই করবেন।

আপনার ১৯২৫ সালের লেখা চিঠির উত্তর দিচ্ছি ১৯২৭ সালের আয়ু যখন ফুরিয়ে এসেছে তখন। এমনও হতে পারে ১৯২৭-এর সাথে সাথে হয়তো বা আমারও আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, তাই আমিও আমার অজ্ঞাতে কোনো অনির্দেশের ইঙ্গিতে আমার শেষ বলা বলে যাচ্ছি আপনার চিঠির উত্তর দেওয়ার সুযোগে। কেননা, আমি এই তিন বছরের মধ্যে কারুর চিঠির উত্তর দিয়েছি, এত বড়ো বদনাম আমার শত্রুতেও দিতে পারবে না – বন্ধুরা তো নয়ই। অবশ্য আয়ু আমার ফুরিয়ে এসেছে – এ সুসংবাদটা উপভোগ করবার মতো সৎসাহস আমার নেই, বিশ্বাসও হয়তো করিনে ; কিন্তু আমার স্বজাতি অর্থাৎ বিজাতীয় অনেকেই এ বিশ্বাস করেন এবং আমিও যাতে বিশ্বাস করি তার জন্যে অর্থ ও সামর্থ্য ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণেই করছেন। কিন্তু আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা যে নিশ্বাস মোচন করেন, তা হ্রস্ব নয় এবং সে নিশ্বাস বিশ্বাসীরও নয়! হতভাগা আমি, তাঁদের এই আমার প্রতি অতি মনোযোগ নাকি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে পারিনে – মন্দ লোকে এমন অভিযোগও করেছে তাঁদের দরবারে।

লোকে বললেও আমি মনে করতে ব্যথা পাই যে, তাঁরা আমার শত্রু। কারণ একদিন তাঁরাই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আজ যদি তাঁরা সত্যি সত্যিই আমার মৃত্যু কামনা করেন, তবে তা আমার মঙ্গলের জন্যই, এ আমি আমার সকল হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি – তাদের হাতের আঘাত যত বড়ো এবং যত বেশিই পাই। মানুষের মুখ উল্‌টে গেলে ভূত হয়, বা ভূত হলে তার মুখ উল্‌টে যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয় উল্‌টে গেলে সে যে ভূতের চেয়েও কত ভীষণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র হয়ে ওঠে – তাও আমি ভালো করেই জানি। তবু আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি – ভালোবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, চিররহস্যের অবগুণ্ঠন মোচন করবে, এই ধুলোর নীচে স্বর্গ টেনে আনবে, এ আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি, এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনে, এই ব্যথিতের অশ্রুজলের মুকুরে যেন আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কিছু করতে যদি নাই পারি, ওদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পাই!

কিন্তু এ তো আপনার চিঠির উত্তর হচ্ছে না। দেখুন, চিঠি না লিখতে লিখতে চিঠি লেখার কায়দাটা গেছি ভুলে। তাতে করে কিন্তু লাভ হয়েছে অনেক। যদিও চোখ-কান বুঁজে উত্তর দিয়ে ফেলি কারুর চিঠির, সে উত্তর পড়ে তাঁর প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো উৎসাহ বা প্রবৃত্তির ইতি ওইখানেই হয়ে যায়। কেননা, সেটা তাঁর চিঠির উত্তর ছাড়া আর সব কিছুই হয়। এ-বিষয়ে ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নিতে পারেন। সুতরাং এটাও যদি আপনার চিঠির উত্তর না হয়ে আর কিছুই হয়, তবে সেটা আপনার অদৃষ্টের দোষ নয়, আমার হাতের অখ্যাতি।

আমাদের দেখার না হলেও শোনার ত্রুটি কোনো পক্ষ থেকেই ঘটেনি দেখছি। আপনাকে চিনি, আপনি আমায় যতটুকু চেনেন তার চেয়েও বেশি করে ; কিন্তু জানতে যে আজও পারলাম না, তার জন্য অভিযোগ আমার অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাকে করব বলুন। এতদিন ধরে বাংলার এত জায়গা ঘুরেও যখন আপনাকে দেখা হল না, তখন আর যে হবে সে আশা রাখিনে। বিশেষ করে – আজ ক্রমেই নিজেকে জানাশোনার আড়ালে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ ভালোই হয়েছে – অন্তত আপনার দিক থেকে। আমার দিকের ক্ষতিটাকে আমি সইতে পারব এই আনন্দে যে, আপনার এত শ্রদ্ধা অপাত্রে অর্পিত হয়েছে বলে দুঃখ করবার সুযোগ আপনাকে দিলাম না। এ আমার বিনয় নয় ; আমি নিজে অনুভব করেছি যে, আমায় শুনে যাঁরা শ্রদ্ধা করেছেন, দেখে তাঁরা তাঁদের সে শ্রদ্ধা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাই আমি অন্তরে অন্তরে প্রার্থনা করছি, কাছে থেকে যাদের কেবল ব্যথাই দিলাম, দূরে গিয়ে অন্তত তাঁদের সে দুঃখ ভুলবার অবসর না দিই, তবে মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা সত্য নয়।

তা ছাড়া নৈকট্যের একটা নিষ্ঠুরতা আছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় কলঙ্ক নেই, কিন্তু চাঁদে কলঙ্ক আছে। দূরে থেকে চাঁদ চক্ষু জুড়ায়, কিন্তু মৃত চন্দ্রলোকে গিয়ে খুশি হয়ে উঠবেন বলে মনে হয় না। বাতায়ন দিয়ে যে-সূর্যালোক ঘরে আসে তা আলো দেয়, চোখে দেখার সূর্য দগ্ধ করে। চন্দ্র-সূর্যকে আমি নমস্কার করি, কিন্তু তাঁদের পৃথিবী-দর্শনের কথা শুনলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। ভালোই হয়েছে ভাই, কাছে গেলে হয়তো আমার কলঙ্কটাই বড়ো হয়ে দেখা দিত।

তারপর শ্রদ্ধার কথা। ওদিক দিয়ে আপনার জিতে যাওয়ার কোনো আশা নেই, বন্ধু। শ্রদ্ধা যদি ওজন করা যেত, তাহলে আমাদের দেশের একজন সম্পাদক – যিনি মানুষের দোষগুণ বানিয়ার মতো করে কড়ায়-গন্ডায় ওজন করতে সিদ্ধহস্ত, তাঁর কাছে গিয়েই এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যেত! গ্রহের ফেরে তাঁর কাঁচিপাকি ওজনের ফের আমার পক্ষে কোনোদিনই অনুকূল নয় ; তা সত্ত্বেও আপনিই হারতেন, এ আমি জোর করে বলতে পারি।

হঠাৎ মুদির প্রসঙ্গটা এসে পড়বার কারণ আছে, বন্ধু! জানেন তো আমরা কানাকড়ির খরিদ্দার। কাজেই ওজনে এতটুকু কম হতে দেখলে প্রাণটা ছ্যাঁক করে ওঠে। মুদিওয়ালার ওতে লাভ কতটুকু জানিনে, কিন্তু আমাদের ক্ষতির পরিমাণ আমরা ছাড়া কেউ বুঝবে না ; – মুদিওয়ালা তো নয়ই। তবু মুদিওয়ালাকে তুল-দাঁড়ি ধরতে দেখলে একটু ভরসা হয় যে, চোখের সামনে অতটা ঠকাতে তার বাধবে ; কিন্তু তার পাঁচসিকে মাইনের নোংরা চাকরগুলো যখন দাঁড়ি-পাল্লার মালিক হয়ে বসে, তখন আর কোনো আশা থাকে না। আগেই বলেছি, আমরা দরিদ্র খরিদ্দার। থাকত বড়ো বড়ো মিঞাদের মতো সহায়-সম্বল, তাহলে এ অভিযোগ করতাম না।

পায়া-ভারি লোকের ভারি সুবিধে। তা সে পায়া-ভারি পায়ে ফাইলেরিয়া গোদ হয়েই হোক, বা ভারগুণেই হোক। এঁদের তুলতে হয় কাঁধে করে, আর কাছে যেতে হয় মাথাটা ভুঁই-সমান নীচু করে। ব্যবসা যারা বোঝে, তারা অন্য দোকানির বড়ো খদ্দেরকে হিংসা ও তদ্‌জনিত ঘৃণা যতই করুক, তাঁকে নিজের দোকানে ভিড়াতে তার দোকানের সবটুকু তেল তাঁর ভারী পায়ে খরচ করতে তার এতটুকু বাধে না। দরকার হলে তার পুত্র ছোটে তেলের টিন ঘাড়ে করে, সাঁতরে পার হয় রূপনারায়ণ নদ, তাঁর ভারী পায়ে ঢালে তেল, – তা সে পা যতই কেন ঘানি-গাছের মতো অবিচলিত থাক। সাথে সে ভাড়াটে ভাঁড় ও স্তুতি-গাইয়ে নিয়ে যেতেও ভোলে না।

যাক এখন এসব বাজে কথা। অনেক কথার উত্তর দিতে হবে।

আমি আপনার মতো অসংকোচে ‘তুমি’ বলতে পারলাম না বলে ক্ষুণ্ণ হবেন না যেন। আমি একে পাড়াগেঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় না। (পেটে বোমা মারার উপমাটা দিলাম না স্পেশাল ট্রিবিউনালের ভয়ে)। যদি বা ‘খাজা’ বা ইব্রাহিম খানকে ‘তুমি’ বলতে পারতাম, কিন্তু কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম শুনেই আমার হাত-পা একেবারে পেটের ভেতর সেঁদিয়ে গেছে। আরে বাপ! স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আমার আজও জলতেষ্টা পেয়ে যায়, আর কলেজের প্রিন্সিপাল, সে না জানি আরও কত ভীষণ! আমার স্কুল-জীবনে আমি কখনও ক্লাসে বসে পড়েছি, এত বড়ো অপবাদ আমার চেয়ে এক নম্বর কম পেয়ে যে ‘লাস্ট বয়’ হয়ে যেত – সেও দিতে পারবে না। হাইবেঞ্চের উচ্চাসন হতে আমার চরণ কোনোদিনই টলেনি, ওর সাথে আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছিল। তাই হয়তো আজও বক্তৃতামঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিলে মনে হয়, মাস্টারমশাই হাইবেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যার রক্তে রক্তে এত শিক্ষক-ভীতি, তাকে আপনি সাধ্যসাধনা করেও ‘তুমি’ বলাতে পারবেন না, এ স্থির নিশ্চিত।

এইবার পালা শুরু।

বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কি না জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হওয়ার মতো বড়ো তো আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পঙ্‌ক্তিতে উঠে গেলাম।

হিন্দু লেখক-অলেখক জনসাধারণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড়ো করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তাহলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু-সভাওয়ালা’ আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙুল দিয়ে গোনা যায়। এঁদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। এঁদের অবিচারের জন্য সমস্ত হিন্দুসমাজকে দোষ দিই নাই এবং দেবও না। তাছাড়া আজকালকার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমান এইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ, – আমি যত বেশি অসাম্প্রদায়িক হই না কেন। প্রথম গালাগালির ঝড়টা আমার ঘরের দিক অর্থাৎ মুসলমানের দিক থেকে এসেছিল – এটা অস্বীকার করিনে ; কিন্তু তাই বলে মুসলমানেরা যে আমায় কদর করেননি, এটাও ঠিক নয়। যাঁরা দেশের সত্যিকার প্রাণ, সেই তরুণ মুসলিম বন্ধুরা আমায় যে ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নীচে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবীণদের আশীর্বাদ – মাথার মণি হয়তো পাইনি, কিন্তু তরুণদের ভালোবাসা, বুকের মালা আমি পেয়েছি। আমার ক্ষতির খেতে ফুলের ফসল ফলেছে। এই তরুণদেরই নেতা ইব্রাহিম খাঁ, কাজি আবদুল ওদুদ,৩ আবুল কালাম শামসুদ্দীন৪, আবদুল মনসুর৫, ওয়াজেদ আলি৬, আবুল হোসেন৭। আর এই বন্ধুরাই তো আমায় বড়ো করেছেন, এই তরুণদের বুকে আমার জন্য আসন পেতে দিয়েছেন – প্রীতির আসন! ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ফরিদপুরে যারা তাদের গলার মালা দিয়ে আমায় বরণ করল, তারা এই তরুণদেরই দল। অবশ্য এই তরুণের জাত ছিল না। এরা ছিল সকল জাতির। সকলকে জাগাবার কাজে আমায় আহ্বান করেছেন। আমার মনে হয়, আপনাদের আহ্বানের আগেই আমার ক্ষুদ্র শক্তির সবটুকু দিয়ে এদের জাগাতে চেষ্টা করেছি – সে শুধু লিখে তা নয়, – আমার জীবনী ও কর্মশক্তি দিয়েও। আমার শক্তি স্বল্প, তবু এই আট বছর ধরে আমি দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক-শ্রমিক তরুণদের সংঘবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি – লিখেছি, বলেছি, চারণের মতো পথে পথে গান গেয়ে ফিরেছি। অর্থ আমার নেই, কিন্তু সামর্থ্য যেটুকু আছে, তা ব্যয় করতে কুণ্ঠিত কোনোদিন হয়েছি, এ-বদনাম আর যেই দিক, আপনি দেবেন না বোধ হয়। আমার এই দেশ-সেবার সমাজ-সেবার ‘অপরাধের’ জন্যে শ্রীমৎ সরকার বাবাজির আমার উপর দৃস্টি, অতি মাত্রায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। আমার সবচেয়ে চলতি বইগুলোই গেল বাজেয়াফ্‌ত হয়ে। এই সেদিনও পুলিশ আবার জানিয়ে দিয়েছে, আমার নব-প্রকাশিত ‘রুদ্র-মঙ্গল’৮ আর বিক্রি করলে আমাকে রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত করা হবে। আমি যদি পাশ্চাত্য ঋষি হুইটম্যানের সুরে সুরে মিলিয়ে বলি৯ : ‘Behold, I do not give a little charity. When I give, I give myself.’ আপনি সমাজকে ‘পতিত, দয়ার পাত্র’ বলেছেন। আমিও সমাজকে পতিত Demoralized মনে করি – কিন্তু দয়ার পাত্র মনে করতে পারিনে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি আমার সমাজকে মনে করি ভয়ের পাত্র। এ-সমাজ সর্বদাই আছে লাঠি উঁচিয়ে ; এর দোষ-ত্রুটির আলোচনা করতে গেলে নিজের মাথা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়তে হয়। আপনি হয়তো হাসছেন, কিন্তু আমি তো জানি, আমার শির লক্ষ করে কত ইট-পাটকেলই না নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আমার কী মনে হয় জানেন? স্নেহের হাত বুলিয়ে এ পচা সমাজের কিছু ভালো করা যাবে না। যদি সেরকম ‘সাইকিক-কিওর’-এর শক্তি কারুর থাকে, তিনি হাত বুলিয়ে দেখতে পারেন। ফোঁড়া যখন পেকে পচে ওঠে তখন রোগী সবচেয়ে ভয় করে অস্ত্র-চিকিৎসককে। হাতুড়ে ডাক্তার হয়তো কখনও আশ্বাস দিতে পারে যে, সে হাত বুলিয়ে ওই গলিত ঘা সারিয়ে দেবে এবং তা শুনে রোগীরও খুশি হয়ে উঠবার কথা। কিন্তু বেচারি ‘অবিশ্বাসী’ অস্ত্র-চিকিৎসক তা বিশ্বাস করে না। সে বের করে তার ধারালো ছুরি ; চালায় সে-ঘায়ে ; রোগী চেঁচায়, হাত পা ছোঁড়ে, গালি দেয়। সার্জন তার কর্তব্য করে যায়। কারণ সে জানে, আজ রোগী গালি দিচ্ছে, দু-দিন পরে ঘা সেরে গেলে সে নিজে গিয়ে তার বন্দনা করে আসবে।  

আপনি কী বলেন? আমি কিন্তু অস্ত্রচিকিৎসার পক্ষপাতী। সমাজ তো হাত-পা ছুঁড়বেই, গালিও দেবে ; তা সইবার মতো শক্ত চামড়া যাঁদের নেই, তাঁদের দিয়ে সমাজসেবা হয়তো চলবে না। এই জন্যেই আমি বারেবারে ডাক দিয়ে ফিরছি নির্ভীক তরুণ ব্রতীদলকে। এ-সংস্কার সম্ভব হবে শুধু তাদের দিয়েই। এরা যশের কাঙাল নয়, মানের ভিখারি নয়। দারিদ্র্য সইবার মতো পেট, আর মার সইবার মতো পিঠ যদি কারুর থাকে, তো এই তরুণদেরই আছে। এরাই সৃষ্টি করবে নূতন সাহিত্য, এরাই আনবে নূতন ভাবধারা, এরাই গাইবে ‘তাজা-ব-তাজা’র গান। আপনি হয়তো আমায় এদেরই অগ্রনায়ক হতে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু আপনার মতো আমিও ভাবি, আজও ভাবি যে, কে সে ভাগ্যবান এদের অগ্রনায়ক। আমার মনে হয়, সে ভাগ্যবান আজও আসেনি। আমি অনেকবার বলেছি, আজও বলছি – সে ভাগ্যবানকে আমি দেখিনি, কিন্তু দেখলে চিনতে পারব। আমি বাণী – তাঁরই আগমনি-গান। আমি তাঁরই অগ্রপথিক তূর্যবাদক। আমার মনে হয়, সেই ভাগ্যবান পুরুষেরই ইঙ্গিতে আমি শুধু গান গেয়ে চলেছি। - জাগরণী গান। আঘাত, নিন্দা. বিদ্রুপ, লাঞ্ছনা দশদিক হতে বর্ষিত হচ্ছে আমার উপর, তবু আমি তাঁর দেওয়া তূর্য বাজিয়ে চলেছি। এ-বিশ্বাস কোথা হতে কী করে যে আমার মাঝে এল, তা আমি নিজেই জানিনে। আমার শুধু মনে হয়, কার যেন আদেশ – কার যেন ইঙ্গিত আমার বেদনারও রন্ধ্রপথে নিরন্তর ধ্বনিত হয়ে চলেছে। তাঁর আসার পদধ্বনি আমি নিরন্তর শুনছি আমার হৃৎপিণ্ডের তালে তালে, আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি আক্ষেপে। তবে এও আমি বিশ্বাস করি, সেই অনাগত পুরুষের আমাদের যে কারুর মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করা বিচিত্র নয়। আমি এতদিন তাঁকে খুঁজেছি আমারও ঊর্ধ্বে। তাঁকে আমারই মাঝে খুঁজতেও হয়তো চেয়েছি। দেখা তাঁর পেয়েছি এমন কথা বলব না, তবে এ-কথা বলতেও আমার আজ দ্বিধা নেই যে, আমি ক্রমেই তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করছি। এমনও মনে হয়েছে কতদিন, যেন আর একটু হাত বাড়ালেই তাঁকে ধরতে পারি। আপনার ‘হাত-বাড়াবে কি?’ কথাটা আমায় সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। তাই আমি খুঁজে ফিরছি নিরাশ-হতাশ্বাসে সেই নিশ্চিত শান্তি – যার ধ্যান-লোকে বসে আমি তপস্যা-প্রোজ্জ্বল নেত্রে আমার অবহেলিত আমাকে খুঁজে দেখবার অবকাশ পাব। এ-শান্তি আমার এ জীবনে পাব কি না জানি না ; যদি পাই – আপনার জিজ্ঞাসার শেষ উত্তর দিয়ে যাব সেদিন। আপনার কয়েকটি মৃদু অভিযোগের উত্তর দিতে চেষ্টা করব এইবার। আপনি আমার যে-দায়িত্বের উল্লেখ করেছেন, সে-দায়িত্ব আমার সত্যিকার কাব্যসৃষ্টির, না সমাজ-সংস্কারের? আমি আর্টের সুনিশ্চিত সংজ্ঞা জানিনে জানলেও মানিনে। ‘এই সৃষ্টি করলে আর্টের মহিমা অক্ষুণ্ণ থাকে, এই সৃষ্টি করলে আর্ট ঠুঁটো হয়ে পড়ে’ – এমনিতরো কতকগুলো বাঁধা নিয়মের বলগা কষে কষে আর্টের উচ্চৈঃশ্রবার গতি পদে পদে ব্যাহত ও আহত করলেই আর্টের চরম সুন্দর নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ হল – এ কথা মানতে আর্টিস্টের হয়তো কষ্টই হয়, প্রাণ তার হাঁপিয়ে ওঠে। জানি, ক্লাসিকের কেশো রোগীরা এতে উঠবেন হাড়ে হাড়ে চটে, তাঁদের কলম হয়ে উঠবে বাঁশ। এরই মধ্যে হয়েও উঠেছে তাই। তবু আজ এ-কথা জোর গলায় বলতে হবে নবীনপন্থীদের। এই সমালোচকদের নিষেধের বেড়া যাঁরাই ডিঙিয়েছেন, তাঁদেরই এদের গোদা পায়ের লাথি খেতে হয়েছে, প্রথম শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে নেমে যেতে হয়েছে। বেদনা-সুন্দরের পূজা যাঁরাই করেছেন, তাঁদের চিরকাল একদল লোক হুজুগে বলে নিন্দা করেছে। আর, এরাই দলে ভারী। এরা মানুষের ক্রন্দনের মাঝেও সুর-তাল-লয়ের এতটুকু ব্যতিক্রম দেখলে হল্লা করে যে, ও কান্না হাততালি দেওয়ার মতো কান্না হল না বাপু, একটু আর্টিস্টিকভাবে নেচে নেচে কাঁদো! সকল সমালোচনা উপরে যে-বেদনা, তাকে নিয়েও আর্টশালারক্ষী – এই প্রাণহীন আনন্দ-গুণ্ডার কুশ্রী চিৎকারে হুইটম্যানের মতো ঋষিকেও অ-কবির দলে পড়তে হয়েছিল। আমার হয়েছে সাপের ছুঁচো-গেলা অবস্থা। ‘সর্বহারা’১০ লিখলে বলে – কাব্য হল না ; ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’ লিখলে বলে – ও হল ন্যাকামি! ও নিরর্থক শব্দ ঝংকার দিয়ে লাভ হবে কী? ও না লিখলে কার কী ক্ষতি হত?  

‘লিরিক’ নাকি ‘লভ’ এবং ‘ওয়ার’ নিয়ে। আমাদের দেশের যুদ্ধ নাই (হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ ছাড়া) ; কাজেই মানুষের নির্যাতন দেখে তার সেই মর্মব্যথার গান গাইলে এখানে হয় তা ‘বীভৎস বিদ্রোহ-রস’। ওটা দিয়ে নাকি মানুষের প্রশংসা সহজলভ্য হয় বলেই আজকালকার লেখকরা রসের চর্চা করে। ‘আমার লেখা কাব্য হচ্ছে না, আমি কবি নই’ – এ বদনাম সহ্য করতে হয়তো কোনো কবিই পারে না। কাজেই যারা করছিল মানুষের বেদনার পূজা, তারা এখন করতে চাচ্ছে প্রাণহীন সৌন্দর্যসৃষ্টি। এমন একটা যুগ ছিল – সে সত্যযুগই হবে হয়তো – যখন মানুষের দুঃখ আজকের মতো এত বিপুল হয়ে ওঠেনি। তখন মানুষ নিশ্চিন্ত নির্ভরতার সঙ্গে ধ্যানের তপোবনে শান্ত সামগান গাইবার অবকাশ পেয়েছে। কিন্তু যেইমাত্র মানুষ নিপীড়িত হতে লাগল, অমনি সৃষ্টি হল বেদনার মহাকাব্য – রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড প্রভৃতি। আর তাতে সমাজের আজকালকার বেঁড়ে-উস্তাদ সমালোচকদের তথাকথিত ‘বীভৎস বিদ্রোহ বা রুদ্র রসের’প্রাধান্য থাকলেও – তা কাব্য হয়নি. এমন কথা কেউ বলবে না। এই বেদনার গান গেয়েই আমাদের নবীন সাহিত্য-স্রষ্টাদের জন্য নূতন সিংহাসনগড়ে তুলতে হবে। তারা যদি কালিদাস১১, ইয়েটস১২, রবীন্দ্রনাথ১৩ প্রভৃতি রূপস্রষ্টাদের পাশে বসতে নাই পায়, পুশকিন১৪, দস্তয়ভ্‍স্‍কি১৫, হুইটম্যান১৬, গর্কি, জোহান বোয়ারের১৭ পাশে ধূলির আসনে বসবার অধিকার তারা পাবেই। এই ধূলির আসনই একদিন সোনার সিংহাসনকে লজ্জা দেবে ; এই তো আমাদের সাধনা। দুঃখী বেদনাতুর হতভাগাদের একজন হয়েই আমি বেদনার গান গেয়েছি, – সে-গানে হয়তো রূপ-রং ফুটে ওঠেনি আমি ভালো রংরেজ নই বলে ; কিন্তু সেই বেদনার সুরকে অশ্রদ্ধা করবার মতো নীচতা মানুষের কেমন করে আসে। অথচ এইসব গালাগালির বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদও তো হতে দেখিনি। আজ কিন্তু মনে হচ্ছে, শত্রুর নিক্ষিপ্ত বাণে এতটা বিচলিত হওয়া আমার উচিত হয়নি। আমার দিনের সূর্য ওদের শরনিক্ষেপে মুহূর্তের তরে আড়াল পড়লেও চিরদিনের জন্য ঢাকা পড়বে না – আমার এ বিশ্বাস থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এর জন্য দুঃখও করিনে। অন্তত আমি তো জানি, আমার এই তো জানি, আমার এই তো চলার আরম্ভ, আমার সাহিত্যিক জীবনের এই তো সবেমাত্র সেদিন শুরু। আজই আমি আমার পথের দাবি ছাড়ব কেন? ওদের রাজপথে ওরা চলতে যদি নাই দেয়, কাঁটার পথেই চলব সমস্ত মারকে সহ্য করে। অন্তত পথের মাঝ পর্যন্ত তো যাই। আমার বনের রাখাল ভাইরা যে মালা দিয়ে আমায় সাজাল, সে-মালার অবমাননা-ই বা করব কেমন করে? ঠিক বলেছ বন্ধু এবার তপস্যাই করব – পথে চলার তপস্যা। ‘বিদ্রোহী’র১৮ জয়-তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্ক-তিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি। বেদনা-সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য-সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি? আমি বিদ্রোহ করেছি – বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, – যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, – পচা সেই মিথ্যা-সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রুপার খাপের ঝকমকানিটাকেই দেখাইনি – এই তো আমার অপরাধ। এরই জন্য তো আমি বিদ্রোহী। আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, সমাজের সকল কিছু কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছি, এর দরকার ছিল মনে করেই। যাক আগেই বলেছি, এ কুম্ভকর্ণ-মার্কা সমাজকে জাগাতে হলে আঘাত দিয়েই জাগাতে হবে। একদল প্রগতিশীল বিদ্রোহীর উদ্ভব না হলে এর চেতনা আসবে না। কুম্ভকর্ণের পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বা চিমটি কেটে এর ঘুম ভাঙাবার যে সব পলিসির উল্লেখ আছে, তা একেবারে মোলায়েম নয়। সেই পলিসিই একবার একটু পরখ করে দেখুকই না ছেলেরা! এতে কী আর এমন হবে! আপনি বলবেন, কুম্ভকর্ণ না হয় জাগল ভায়া, কিন্তু জেগে সে যেরকম হাঁ-টা করবে, সে হাঁ তো সংকীর্ণ নয়, তখন! আমি বলি কী, তখন কুম্ভকর্ণ তাদেরই ধরে ‘জলপানি’ করবে, যারা তার ঘুম ভাঙাতে গিয়েছিল।  

 

এতই তো মরছে, না হয় আরো দু-দশটা মরবে! আপনি বলবেন, ভয় তো ওইখানেই বন্ধু : বেড়ালের গলার ঘন্টা বাঁধতে এগোয় কে? আমি বলি, সে দুঃসাহস যদি আমাদের কারুর না থাকে, তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে সকলে ‘আসহাব কাহাফে’র মতো রোজ-কিয়ামত তক ঘুমোতে পারেন। সমাজকে জাগাবার আশা একেবারেই ছেড়ে দিন! কারুর পান থেকে এতটুকু চুন খসবে না, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না ; তেল-কুচকুচে নাদুস-নুদুস ভুঁড়িও বাড়বে এবং সমাজেও সাথে সাথে জাগতে থাকবে – এ আশা আলেম সমাজ করতে পারেন, আমরা অবিশ্বাসীর দল করিনে।

আমার কথাগুলো ‘মরিয়া হইয়া’র মতো শুনাবে, কিন্তু বড়ো দুঃখে দেখে শুনে তেতো-বিরক্ত হয়ে এসব বলতে হচ্ছে। তাই তো বলি যে, ‘বাবা! তোকে রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। মরতে হয় তো এদেরই একজনের হাতে মর বেশ একটু হাতাহাতি করে ; তাতে সুনাম আছে। কিন্তু ওই হনুমানের হাতে মরিস কেন? হনুমানের হাতে মরার চেয়ে বরং কুম্ভকর্ণকে জাগাতে গিয়ে মরা ঢের ভালো।’ কথাগুলো যখন বলি, তখন লোকে হাততালি দেয়, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিও করে ; কিন্তু তারপর আর তাদের খবর পাইনে।

আমিও মানি, গড়ে তুলতে হলে একটা শৃঙ্খলার দরকার। কিন্তু ভাঙার কোনো শৃঙ্খল বা সাবধানতার প্রয়োজন আছে মনে করিনে। নূতন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙি – শুধু ভাঙার জন্যই ভাঙার গান আমার নয়। আর ওই নূতন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি – আঘাতের পর নির্মম আঘাত হেনে পচা-পুরাতনকে পাতিত করি। আমিও জানি, তৈমুর, নাদির সংস্কার-প্রয়াসী হয়ে ভাঙতে আসেনি, ওদের কাছে নতুন-পুরাতনের ভেদ ছিল না। ওরা ভেঙেছিল সেরেফ ভাঙার জন্যই। কিন্তু বাবর ভেঙেছিল দিল্লি-আগ্রা, ময়ূরাসন-তাজমহল গড়ে তোলার জন্য। আমার বিদ্রোহ ‘যখন চাহে এ মন যা’র বিদ্রোহ নয়, ও আনন্দের অভিব্যক্তি সর্ববন্ধনমুক্তের – পূর্ণতম স্রষ্টার।

আপনার ‘মুসলিম-সাহিত্য’ কথাটার মানে নিয়ে অনেক মুসলমান সাহিত্যিকই কথা তুলবেন হয়তো। ওর মানে কি মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য না মুসলিমভাবাপন্ন সাহিত্য? যদি সত্যিকার সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে। তবে তার বাইরের একটা ফর্ম থাকবে নিশ্চয়। ইসলাম ধর্মের সত্য নিয়ে কাব্যরচনা চলতে পারে, কিন্তু তার শাস্ত্র নিয়ে চলবে না। ইসলাম কেন, কোনো ধর্মেরই শাস্ত্র নিয়ে কাব্য লেখা চলে বলে বিশ্বাস করি না। ইসলামের সত্যকার প্রাণশক্তি গণতন্ত্রবাদ, সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ।

ইসলামের এই অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আমি তো স্বীকার করিই, যাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন তাঁরাও স্বীকার করেন। ইসলামের এই মহান সত্যকে কেন্দ্র করে কাব্য কেন, মহাকাব্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার বহু লেখার মধ্য দিয়ে আমি ইসলামের এই মহিমার গান করেছি। তবে কাব্যকে ছাপিয়ে ওঠেনি সে-গানের সুর। উঠতে পারেও না। তাহলে তা কাব্য হবে না। আমার বিশ্বাস কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড়ো হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়। আপনি কী চান তা আমি বুঝতে পারি – কিন্তু সমাজ যা চায়, তা সৃষ্টি করতে আমি অপারগ। তার কাছে এখনও –

আল্লা আল্লা বলো রে ভাই নবি করো সার।

মাজা দুলিয়ে পারিয়ে যাব ভবনদীর পার॥

রীতিমতো কাব্য। বুঝবার কোনো কষ্ট হয় না, আল্লা বলতে এরং নবীকে সার করতে উপদেশও দেওয়া হল, মাজাও দুলল ভবনদী পারও হওয়া গেল! যাক, বাঁচা গেল – কিন্তু বাঁচল না কেবল কাব্য। সে বেচারি ভবনদীর এ পারেই রইল পড়ে। ঝগড়ার উৎপত্তি এইখানেই। কাব্যের অমৃত যারা পান করেছে, তারা বলে – মাজা যদি দুলাতেই হয় দাদা, তবে ছন্দ রেখে দুলাও ; পারে যদি যেতেই হয়, তবে তরি একেবারে কমলবনের ঘাটে ভিড়াও। অমৃত যারা পান করেনি – আর এরাই শতকরা নিরানব্বই জন – তারা বলে, কমলবন, টমলবন জানিনে বাবা, সে যদি বাঁশবন হয়, সেও-ভি আচ্ছা – কিন্তু একেবারে ভবনদীর ঘাটায় লাগাও নৌকা। এ অবস্থায় কী করব বলতে পারেন? আমি ‘হুজ্জতুল ইসলাম’১৯ লিখব, না সত্যিকার কাব্য লিখব?

এরা যে শুধু হুজ্জতুল ইসলামই পড়ে, এ আমি বলব না ; রসজ্ঞানও এদের অপরিমিত। আমি দেখেছি, এরা দল বেঁধে পড়ছে – ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।’ অথবা ‘লাখে লাখে ফৌজ মরে কাতারে কাতার শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার॥’ আর এই কাব্যের চরণ পড়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে। উম্মর-উম্মিয়ার প্রশংসায় রচিত – ‘কাগজের ঢাল মিয়াঁর তালপাতার খাঁড়া আর লগির গলায় দড়ি দিয়ে বলে চল হামারা ঘোড়া।’ পড়তে পড়তে আনন্দে গদগদ হয়ে উঠেছে। বিদ্রুপ আমি করছিনে, বন্ধু – এ আমার চোখের জল-মেশানো হাসির শিলাবৃষ্টি। সত্য সত্যই আমার লেখা দিয়ে যদি আমার মুমূর্ষু সমাজের চেতনা সঞ্চার হয়, তাহলে তার মঙ্গলের জন্য আমি আমার কাব্যের আদর্শকেও না হয় খাটো করতে রাজি আছি। কিন্তু আমার এ ভালোবাসার আঘাতকে এরা সহ্য করবে কিনা সেটাই বড়ো প্রশ্ন। হিন্দু লেখকগণ তাঁদের সমাজের গলদ-ত্রুটি-কুসংস্কার নিয়ে কী না কশাঘাত করেছেন সমাজকে ; – তা সত্ত্বেও তাঁরা সমাজের শ্রদ্ধা হারাননি। কিন্তু এ হতভাগ্য মুসলমানের দোষ-ত্রুটির কথা পর্যন্ত বলবার উপায় নেই। সংস্কার তো দূরের কথা, তার সংশোধন করতে চাইলেও এরা তার বিকৃত অর্থ করে নিয়ে লেখককে হয়তো ছুরিই মেরে বসবে। আজ হিন্দুজাতি যে এক নবতম বীর্যবান জাতিতে পরিণত হতে চলেছে, তার কারণ তাদের অসমসাহসিক সাহিত্যিকদের তীক্ষ্ণ লেখনী। আমি জানি যে, বাংলার মুসলমানকে উন্নত করার মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড়ো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এদের আত্ম-জাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ আজ রুদ্ধ। হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, আমিও মানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ-অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে। কিন্ত ইসলামের ‘সভ্যতা-শাস্ত্র-ইতিহাস’ এ সমস্তকে কাব্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার নয় কি? আমার মনে হয়, আমাদের নূতন সাহিত্য-ব্রতীদল এর এক-একটা দিক নিয়ে রিসার্চ ও আলোচনার দায়িত্ব নিলে ভালো হয়। আগেই বলেছি, নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার পূর্ণ শান্তি কোনোদিন পাইনি। যদি পাই, সেদিন আপনার এই উপদেশ বা অনুরোধের মর্যাদা রক্ষা যেন করতে পারি – তাই প্রার্থনা করছি আজ। আবার বলি, যাঁরা মনে করেন – আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তাঁরা অনর্থক এ-ভুল করেন। ইসলামের নামে যে-সব কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে – তাকে ইসলাম বলে না-মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ-ভুল যাঁরা করেন, তাঁরা যেন আমার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে – এ ছাড়া আমার কী বলবার থাকতে পারে?  

আমার ‘বিদ্রোহী’ পড়ে যাঁরা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তাঁরা যে হাফেজ-রুমিকে২০ শ্রদ্ধা করেন – এও আমার মনে হয় না। আমি তো আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদের। এঁরা কি মনে করেন, হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাংলা-সাহিত্য সৃষ্টি কোনো কালেই সম্ভব হবে না – জৈগুন বিবির পুথি ছাড়া। বাংলা-সাহিত্য সংস্কৃতের দুহিতা না হলেও পালিতা কন্যা। কাজেই তাতে হিন্দুর ভাবধারা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ও বাদ দিলে বাংলা ভাষার অর্ধেক ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে। ইংরেজি-সাহিত্য হতে গ্রিক পুরাণের ভাব বাদ দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে না। বাংলা-সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায় হিন্দুরও তেমনই মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্য হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি। কিন্তু বন্ধু, এ কর্তব্য কি একা আমারই? আমার শক্তি সম্বন্ধে আপনার যেমন বিশ্বাস, আপনার উপরও আমার সেই একই বিশ্বাস – একই শ্রদ্ধা। আপনিও ‘কামালপাশা’ না লিখে এই হতভাগ্য মুসলমানদের জীবন নিয়ে নাটক লিখতে আরম্ভ করুন না কেন? আমার মনে হয়, ওদিকে আপনার জুড়ি নেই অন্তত আমাদের মধ্যে কেউ। ‘কামাল পাশা’র২১ দরকার আছে জানি, কিন্তু তার চেয়েও দরকার – আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই জীবনের এই ট্রাজেডি তুলে ধরা। কবিতা ও প্রবন্ধ-লেখকের আমাদের অভাব নেই। নাটক-লিখিয়ের অভাবও আপনাকে দিয়ে পূরণ হতে পারে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অভাব কথাসাহিত্যিকের। এর তো কোনো আশা ভরসাও দেখছিনে কারুর মধ্যে। অথচ কথাসাহিত্য ছাড়া শুধু কাব্যের মধ্যে আমাদের জীবন, আমাদের আদর্শকে ফুটিয়ে তুলতে কেউ পারবেন না। অনুবাদকের দিক দিয়েও আমরা সবচেয়ে পিছনে। সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয় ইত্যাদি ফাইন আর্টের কথা না-ই বললাম। এত অভাবের কোন্ অভাব পূর্ণ করব আমি একা, বন্ধু! অবশ্য একাই হাত দিয়েছি অনেকগুলি কাজে – তাতে করে হয়তো কোনোটাই ভালো করে হচ্ছে না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব আমি নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা। আপনার এত সুন্দর, এমন সুলিখিত চিঠির কী বিশ্রী করেই না উত্তর দিলাম। ব্যথা যদি দিয়ে থাকি, আমার গুছিয়ে বলতে না পারার দরুন, তাহলে আমি ক্ষমা না চাইলেও আপনি ক্ষমা করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে। আপনার বিরাট আশা, ক্ষুদ্র আমার মাঝে পূর্ণ যদি না-ই হয়, তবে তা আমাদেরই কারুর মাঝে পূর্ণত্ব লাভ করুক, আমি কায়মনে এই প্রার্থনা করি।
            কাজী নজরুল ইসলাম