মোতাহার হোসেন-কে
কৃষ্ণনগর
২৫.২.২৮
বিকেল।
বন্ধু!
আজ সকালে এসে পৌঁছেছি। বড্ড বুকে ব্যথা। ভয় নেই, সেরে যাবে এ ব্যথা। তবে ক্ষত-মুখ সারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। ক্ষত-মুখের রক্ত মুখ দিয়ে উঠবে কী
না জানি না। কিন্তু আমার সুরে, আমার গানে, আমার কাব্যে সে রক্তের যে বন্যা ছুটবে তা কোনোদিনই শুকোবে না।
আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো অভাব ছিল
sadness-এর। কিছুতেই
sad হতে পারছিলাম না। তাই ডুবছিলাম না। কেবল ভেসে বেড়াচ্ছিলাম কিন্তু আজ ডুবেছি, বন্ধু! একেবারে নাগালের অতলতায়।
ভাসে যারা, তাদের কূল মেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু যে ডোবে, তার আর উঠবার কোনো ভরসা রইল না। প্রতাপ-শৈবলিনী ভেসেছিল এক সাথে, তাদের কূলও মিলল।
তোমাকে দু-দিনেই বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি – তোমার গণিতের পাষাণ-টবে ফুলের চারা দেখতে পেয়েছি বলে। অদ্ভুত লোক তুমি কিন্তু! নিজেকে কেবলই অসুন্দরের আড়াল দিয়ে রাখছ! তোমাকে আমার নখ-দর্পণে দেখতে পাচ্ছি। – নিঃস্বার্থ, কোমল, অভিমানী, প্রেমিক – কিন্তু সবকে গোপন করে চলতে চাও যেন। তোমার তৃষ্ণা আছে, কিন্তু নেলসনের মতো তোমার তৃষ্ণার বারি অনায়াসে আরেকজনের মুখে তুলে দিতে পার।
তুমি দেবতা! তোমাকে যদি কেউ ভুল করে, তবে তার মতো ভাগ্যহীন আর কেউ নেই।...
তোমায় আমি বুঝি। কিন্তু কোনো নারী – সুন্দরের উপাসিকা নারী –কোনো অঙ্কশাস্ত্রীর কবলে পড়েছে, এ আমি সইতে পারিনে। নারী হবে সুন্দরের অঙ্কলক্ষ্মী, সে অঙ্কশাস্ত্রের ভাঁড়ার-রক্ষী হবে কেন? আমি কবি, হিসেব যেখানে – সেখানে আমি খড়গহস্ত। তুমি ভাবতে পার যে, সুন্দরই যার ধ্যান, সেই নারী রাস্তায় বসে দিনের পর দিন পাথর ভাঙবে, আর তারই পাশে সমানে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে কর্তব্যপরায়ণ স্টার্ন একটা লোক? এবং ওই পাথর- ভাঙিয়ে লোকটা মনে করবে – সে একটা খুব বড়ো কাজ করছে! আর যে-কেউ তাকে দেবতা বলুক, – আমি তাকে বলি প্রাণহীন যক্ষ। অকারণে ভূতের মতো রত্ন-মানিক আগলে বসে আছে। সে রত্ন সে-ও গলায় নিতে পারে না – অন্যকেও নিতে দেবে না।
হায় রে মূঢ় নারী! তাকে চিরকাল আগলে রইল বলেই যক্ষ হয়ে গেল দেবতা! অঙ্কের পাষাণ-টবে ঘিরে রেখে তিলোত্তমাকে তিলে তিলে মারাই যদি বড়ো দেবত্ব হয়, তবে মাথায় থাক আমার সে দেবত্ব! আমি ভালোবাসলে তাকে আমার বাঁধন হতে মুক্তি দিই। আমি কবি, আমি জানি কী করে সুন্দরের বুকে ফুল ফোটাতে হয়।
যে যক্ষ রাজকুমারীকে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে পাষাণ-পুরীতে সোনার খাটে শুইয়ে রাখলে, তার অতি স্নেহকে কি দেবত্ব বলে ভুল করবে? হয় তাকে মেরে ফেলো, কিংবা ছেড়ে দিয়ে বাঁচতে দাও। রূপার কাঠির জাদুতে ঘুমিয়ে রইল বলেই রাজকুমারী হয়তো যক্ষকে অভিশাপ দিলে না – হয়তো বা দেবতাই মনে করলে! কিন্তু যেদিন না-চাওয়ার পথ দিয়ে এল না-দেখা রূপকুমার, তখন কোথায় রইল ‘যক্ষ’- কোথায় রইল পাষাণপুরী! আমার মনে হয় কী জান? ওই দেবতার মোহ যেদিন তেপান্তরের রূপকুমারীর ঘুচবে, সেদিন সে বেঁচে যাবে – বেঁচে যাবে।
সে শুভদিনের প্রতীক্ষা করেই আমি মালা
গাঁথব, গান রচনা করব। আমি এত বড়ো ধৈর্যহারা বোকা
blunt
নই যে, যাকে পেলাম না – তাকে আমার এই জন্মেই পেতেই হবে। তাকে মড়া-আগলা করে আগলাব,
এ-প্রবৃত্তি আমার – কবির – হবে না; এ তুমি নিশ্চিত জেনো। যাক, বহু জন্ম হারিয়েছি
তাকে পাবার জন্য আরও বহু জন্ম অপেক্ষা করতে পারব। তাই তো, যেই শুনলাম, আমার জন্য আর
একজনের মুখ ম্লান হয়ে গেছে, অমনি চলে এলাম চিরদিনের মতো।
বোধ হয় তোমার মনে আছে বন্ধু, তোমাকে
শেষ অনুরোধ করে এসেছিলাম যে, তুমি কারুর অবিচারের বিচার কোরো না। কারুর ভুলের
প্রতিশোধ ভুল দিয়ে কোরো না। কে তোমায় অপমান করতে পারে, যদি নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে
ধরতে পার!
যার কল্যাণ কামনা কর, সে যদি কোনোদিন
তোমায় দুর্ভাগ্যবশত বিষদৃষ্টিতেই দেখে – তাকেই বরণ করে নিয়ো। তাকে ত্যাগ কোরো না। এ
তোমার শুধু বন্ধুর অনুরোধই নয়, আরও কিছু।
খবর দিয়ো – সব খবর। বুকের ব্যথা হয়তো
তাতে কমবে। এখন কী ইচ্ছে করছে জান? চুপ করে শুয়ে থাকতে, সমস্ত লোকের সংস্রব ত্যাগ
করে পদ্মার ধারে একটি একা কুটিরে। হাসি-গান আহার-নিদ্রা সব বিস্বাদ ঠেকছে।
তোমার ছেলেমেয়েদের চুমু দিয়ো – তোমার
বউকে সালাম।
সেরে উঠলে জানাব। তোমার চিঠি চাই। এ
চিঠি শুধু তোমার এবং আর একজনের। একে
secret
মনে কোরো। আর একজনকে দিয়ো এই চিঠিটা দু-দিনের জন্য।
কতকগুলো ঝরা মুকুল দিলাম, নাও।
তোমার
নজরুল