মোতাহার হোসেন-কে

The Saogat
11, Wellesly Street
Calcutta,
31.3.1928


প্রিয় মোতিহার!
    একটু আগে তোমার চিঠি পেলাম। বড্ড মন যেন কেমন করছে।... সওগাতের (বার্ষিকের, মাসিকের) লেখা শেষ করেছি বিকেলে। আজ আমার মুক্তি, বাণীর মন্দির-দুয়ার থেকে অলক্ষ্মীর উন্মুক্ত প্রান্তরে।... গাঁঠরি বাঁধাবাঁধি করে রাখলুম – নিশ্চিন্তে কোথাও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচবার জন্য। এখ্‌খনি হুগলি যাব, একজন সাহিত্যিক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যায় গান। সেখানে দু-দিন থেকে বোধ হয় কৃষ্ণনগরেই যাব। কলকাতায় কুড়ি-একুশ দিন কাটল, আর ভালো লাগে না এক জায়গা।... তোমার চিঠি হয়তো কৃষ্ণনগর গিয়ে পড়ে আছে। তবে সে চিঠি যেমন
redirect করে পাঠাবারও কারও তাগিদ নেই, তেমনই তা খুলে পড়ে দেখবারও কেউ নেই। আমার চিঠি ওরা খোলে না। তাদের খবর জানতে চেয়েছ – তারা ভালোই আছে হয়তো, কেননা ওরা ভালো থাকলে চিঠি দেয় না। অন্য কী খবর চাও – লিখো। পারি যদি উত্তর দেব।... তুমি ভাবতে পার বন্ধু, একটি অন্ধকার ঘরে দু-জন দু-জনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে কাঁদছে। ভাবছ কী অমানুষ আমি! নয়? তাই ভাবো।...
    তোমার চিঠির জন্য কী করে যে কাটিয়েছি এ কয়দিন, তা যদি বুঝতে, তাহলে তোমার চিঠি লিখবার অবসরের অভাব হত না। আজ যদি তোমার চিঠি না আসত তাহলে তোমায় আর কখনও চিঠি দিতাম না। কী যে রাগ হচ্ছিল তোমার উপর সে কী বলব! এক একবার মনে হয়েছে, খুব করে গাল দিয়ে তোমায় শেষ চিঠি দিই, তোমার চিঠির জন্য কী করে যে কাটিয়েছি এ কয়দিন, তা যদি বুঝতে, তাহলে তোমার চিঠি লিখবার অবসরের অভাব হত না। আজ যদি তোমার চিঠি না আসত তাহলে তোমায় আর কখনও চিঠি দিতাম না। কী যে রাগ হচ্ছিল তোমার উপর সে কী বলব! এক একবার মনে হয়েছে, খুব করে গাল দিয়ে তোমায় শেষ চিঠি দিই, একেবারে ‌'সবিনয় নিবেদন‌' থেকে শুরু করে। কিন্তু তুমি কৃষ্ণনগরের ঠিকানায় চিঠি দেলে কেন? আমি তো কোনো চিঠিতে লিখিনি বোধ হয় যে, সেখানে এখন যাব।

    আমি আবার বিষ্যুতবার কলকাতা ফিরে আসব। সেদিন সন্ধ্যায়
Broadcasting-এ আমার গান গাইতে হবে। তোমাদের ঢাকায় wireless সেট নেই কারুর? তাহলে শুনতে পেতে হয়তো। কী গ্র্যান্ড হত বলো তো তাহলে! আমি এখান থেকে গান করতেম – আর তোমরা ঢাকা থেকে শুনতে। এখন থেকে হপ্তায় অন্তত দু-তিন দিন করে গাইতে হবে আমায় Broad casting-এ। আমি বিষ্যুতবারে দুটো গান আর আমার নতুন কবিতা ‘রহস্যময়ী’ আবৃত্তি করব। ‘রহস্যময়ী’ চৈত্রের ‘সওগাতে’ বেরুবে। ওর ‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ’ নামটা বদলে ‘রহস্যময়ী’ করেছি। দেখো এক কাজ করা যায়। Broadcasting Company আমায় একটা মেশিন প্রেজেন্ট করবে – সেইটে তোমায় প্রেজেন্ট করব আমি। ওরা ওটা দিলেই তোমায় পাঠিয়ে দেব। কিন্তু ঠিক করে নিতে পারবে তো? তোমরা বৈজ্ঞানিক, গণিতজ্ঞ, হয়তো পারবে।
    লিখছি, আর কেন যেন মন কেঁদে কেঁদে উঠছে। তোমার বোনের অসুখ, অথচ তুমি জানাওনি এর আগে? তুমি না জানালেও রোজ দেখেছি তারে ঘুমের আড়ালে – স্থির, শান্ত, উদাস – রোগ-পাণ্ডুর। সন্ধ্যা-তারাটির মতো। কেবলই মনে হয়েছে কত যেন অসুখ করেছে তার। তবু শফিক এসেছে শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হওয়া গেল। শফিক তার বাঁশিতে গানে তাঁকে অনেকটা ভালো রাখতে পারবে। শফিক কি দু-এক দিনের মধ্যেই চলে যাবে আবার? আচ্ছা ভাই মোতিহার, তোমার কথা তো তোমার বোন শোনেন; তাঁকে বুঝিয়ে তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে দাও না। মা-বাপের কোলে থাকলে হয়তো অনেকটা ভালো থাকবে। আমার কেবলই ভয় করে কেন? কী যেন ভয়। তা ঠিক বলতে পারছিনে! শফিককে এখন যেতে মানা করো। কী হবে দুটো মাস কামাই করলে? শফিক থাকলে সে ভালো হয়ে যাবে, অন্তত ওষুধটা খাবে হয়তো সময় মতো।
    যাক্‌, তোমার চেয়ে বা আর-কারুর চেয়ে তো তাঁর শুভার্থী কেউ নেই। কিন্তু তবু কেন শান্তি পাই না? দিলীপের৪ গান শোনার পর কি আর আমার গান ভালো লাগবে? এমনিই তো আমার গান ভালো লাগেনি! আফতাবউদ্দিনের বাঁশি শুনলে কেমন? অদ্ভুত লোকটা, না?
    তোমার আমন্ত্রণ হয়তো নিলাম। আমার আবার কাজ কী? লিখি, গান করি, আড্ডা দিই, আর ঘুরে বেড়াই – এই বই তো না! তবে শফিককে গান শেখাতে পারব কি না জানিনে। শুনেছি, শফিক খুব ভালো গান জানে। অন্তত ওর বাঁশি শোনবার জন্য যাব। হাঁ, আর একটা খবর দিই তোমায়। আগামী ১৪ই এপ্রিল আমি গ্রামোফোনে গান ও আবৃত্তি দিচ্ছি। তা বেরুবে হয়তো জুলাই-এ।
    বার্ষিক ‘সওগাতে’ দুটো কবিতা দিলাম– ‘উমর ফারুক’ আর ‘হিংসাতুর’। চৈত্রের সওগাতে ‘রহস্যময়ী’ (কবিতা), ‘মৃত্যুক্ষুধা’র
continuation আরেকটা কবিতা ও একটা গজল-গান যাচ্ছে । চৈত্রের ‘সওগাত’ বেরুবার দেরি আছে। আগে বার্ষিকীটা বেরুবে – আর এক সপ্তাহের মধ্যেই।... আরও অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। ইচ্ছা করে, সবগুলো পাঠিয়ে দিই, কিন্তু পাঠাব না – ভয় নেই। যে কাগজে বেরোয়, তা-ই পাঠাব এখন থেকে। ‘জাগরণ’-এর জন্য লেখা চাওয়ার অর্থ বুঝলাম না। ‘জাগরণ’ বলে কাগজ বেরুচ্ছে নাকি, না বেরুবে? কার কাগজ? চিঠি লিখবার আগের একটা ছোট্ট কবিতা লিখছিলাম– সেইটেই দিচ্ছি এই সাথে। দরকার হলে কাজে লাগাতে পার।... তোমার ‘চোখের জ্বালা’ হল কেন আবার? চোখের বালির জন্য?
    ‘দু-দিনের দেখা’ গল্পটার এমন কিছু বেশি পরিবর্তন করিনি। মাঝে মাঝে দু-চারটে লাইন সংযোগ বা বিয়োগ করেছি মাত্র। তাতে তাঁকে ছাড়িয়ে আমি উঠিনি, – তুমি তাঁকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলো। ওটা ছাপা হয়ে গেছে। বলো যদি, পাঠিয়ে দিতে পারি ওই ফর্মাটা। আচ্ছা, ব্যবস্থা করছি ওটা পাঠাবার।... আজ আমার বইগুলো পাঠাব তাঁকে। সব বই ছাপা নেই। অনেকগুলো
out of print হয়ে গেছে। তোমাকেও পাঠাব দু-দিন পরে। আজ আর সময় নেই বলে এ-কথা বলছি। অভিমান কোরো না লক্ষ্মীটি!
    এপ্রিলের শেষাশেষি বা ছুটিতে তোমার বোন কোথায় থাকবেন? ঢাকায় না অন্য কোথায়ও, অবশ্য জানিয়ো। ভুলো না যেন। ছানু কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি উত্তরটা দিয়ো, লক্ষ্মীটি! ভালোবাসা নাও।
      শরিফের [য] বিয়ের কী হল? নুরুন্নবী চৌধুরী এসেছিলেন কি?
      ... রক্তদান করিনি ডাক্তার-শালা বলে, হার্ট দুর্বল। শালার মাথা! মনে হচ্ছিল, একটা ঘুষি দিয়ে দেখিয়ে দিই কেমন হার্ট দুর্বল। ভিতরের কথা তা নয়। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ‘মুসলমানের’ রক্ত নিতে রাজি হলেন না। হায় রে মানুষ, হায় তার ধর্ম! কিন্তু কোনো হিন্দু যুবক আজও রক্ত দিলে না। লোকটা মরছে – তবুও নেবে না ‘নেড়ে’র রক্ত।
    দেরি হয়ে গেল – তবু ঈদের কোলাকুলি নাও...হ্যাঁ, আমি ঢাকা যেতে রাজি আছি তোমার লিখিত শর্ত মতো। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। সে হচ্ছে, আমি যদি কোনোদিন হঠাৎ চলে আসতে চাই কোনো কারণে, – বা অকারণে, তাহলে আটকে রাখতে পারবে না। এই একটি শর্ত শুধু।

তোমার
নজরুল